#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৬১)[প্রথম অংশ]
‘ভেতরে আসবো?’
বলতে বলতেই সে দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দেয়।
ইফাজ চোখ তুলে সামনে দেখে।স্মিত হেসে বলে,’ইজমা! আপনি?আসুন না।এনি প্রবলেম?’
ইজমা গালভর্তি হেসে ভেতরে প্রবেশ করল।ইফাজের মুখোমুখি থাকা চেয়ারটা টেনে বলল,’কেমন আছেন আপনি?’
‘আমি ভালো।আপনার কি অবস্থা?হাত নাড়তে পারেন স্বাভাবিক ভাবে?’
‘জ্বী পারি।আজও একটা টেস্ট করিয়েছি।’
‘গুড।’
ইফাজ পুনরায় নিজের কাজে মন দেয়।ইজমা উসখুস করতে করতে বলল,’আপনি কি জ্বর মাপতে পারেন?’
‘সরি?’
‘জ্বর।ফিভার।মাপতে পারেন আপনি?’
‘মাপার কি আছে?হাত দিলেই তো বুঝা যায়।’ অবাক হয়ে উত্তর দেয় ইফাজ।
‘তাহলে আমার কপালে হাত দিয়ে বলুন তো আমার জ্বর আছে নাকি?’
ইফাজ তীর্যক চোখে তার দিকে তাকায়।তারপরই উঠে এসে খুব স্বাভাবিক ভাবে তার কপালে হাত ছুঁয়িয়ে বলল,’জ্বী না ইজমা।আপনার শরীর অনেক ঠান্ডা।কোনো জ্বর নেই আপনার।’
বলে সে আবার নিজের চেয়ারে গিয়ে বসে।ইজমা পা দোলায়।হাত নেড়ে বলল,’আপনি কি প্রেশার মাপতে পারেন?আমার মনে হচ্ছ আমার প্রেশারও বেড়ে গেছে।’
ইফাজ ঠোঁট টিপে হাসল।মাথা নেড়ে জানালো,’প্রেশার যেকোনো ডাক্তারই মাপতে পারে।এটা আমাদের থার্ড ইয়ারেই শেখানো হয়।আপনি কি প্রেশারও মাপবেন?’
‘জ্বী।’
ইফাজ মাথা নামিয়েই একগাল হাসল।কোনো কথা না বাড়িয়ে ইজমার প্রেশার মেপে সে গাঢ় স্বরে বলল,’নো মিস।আপনার প্রেশারও একদম নরমাল।আপনি পুরোপুরি সুস্থ একজন মানুষ।’
ইজমা হতাশ হলো।তার পাংশুটে মুখখানা দেখেই ইফাজ বড় বড় চোখ করে বলল,’সেকি! মন খারাপ কেন?সুস্থ হওয়া কি কোনো মন খারাপের বিষয়?’
ইজমা সে কথার জবাব দেয় না।কতোক্ষণ থম মেরে বসে থেকে শেষে ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিয়ে হনহন করে ইফাজের চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল।আশ্চর্য! তার শরীর আজ এতো সুস্থ কেন?সে কি একটু অসুস্থ হতে পারতো না?তাহলে তো সেই অসুস্থতা নিয়ে ইফাজের সাথে অহেতুক বকবক করা যেত।
সে যেতেই ইফাজ শব্দ করে হেসে ফেলল।একহাত মাথার পেছনে নিয়ে দরজার দিকে দেখতে দেখতে বলল,’অসুখ তো একটা হয়েছে আপনার ইজমা।কিন্তু সেটা জ্বর কিংবা প্রেশারজনিত না।বিষয়টা তার চেয়েও জটিল।’
______________________________________________
এপার্টমেন্টের সামনে আসতেই আপনাআপনি কপাল কুঁচকে এলো ওয়াজিদের।অন্য সময় দরজা পর্যন্ত আসতেই ভেতরের হই হুল্লোড়ে তার কানে তালা লাগার মতো অবস্থা হতো।অথচ আজ বাড়ির অবস্থা একদমই ঠান্ডা।ভেতর থেকে কোনো শব্দ পর্যন্ত বের হচ্ছে না।সে বিচলিত হয়ে দ্রুত চাবি ঘুরিয়ে লক খোলে।
এপার্টমেন্টে পা রেখে সে আরো এক দফা বিস্মিত হয়।পুরো বাড়ি আধার করে রাখা।এখনো বাতি জ্বালানো হয়নি।দেখে মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ নেই।সে তাড়াতাড়ি মোবাইল বের করে রিমিকে ফোন দিলো।কোথাও গেল নাকি তারা?
কাছে কোথাও টুংটুং শব্দে মোবাইল বেজে উঠে।ওয়াজিদ কপাল কুঁচকে বলল,’রিমি! আছো তুমি এদিকে?’
সে বিভ্রান্ত হয়ে আরো দুই পা সামনে বাড়ায়।আচমকা কানের কাছ থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠল,’হ্যাপি বার্থডে!’
হকচকিয়ে গেল ওয়াজিদ।লাফিয়ে দুই পা পিছিয়ে এলো সঙ্গে সঙ্গে।হাত তার আপনাআপনি বুক পর্যন্ত উঠে এলো।ক্ষণিক বাদেই ঘরের সবগুলো বাতি জ্বল জ্বল করে জ্বলে উঠল।ওয়াহিদুল সাহেব এক কোণায় দাঁড়িয়ে ভারি গলায় বললেন,’শুভ জন্মদিন বাবা।’
তার পাশেই শীলা।তার পরণে খয়েরি রঙের একটা শাড়ি।ওয়াজিদ তাকে দেখতেই তিনি হাসিমুখে বললেন,’শুভ জন্মদিন আব্বু।জীবনে অনেক বড় হও।’
আশ্চর্যে তার চোয়াল ঝুলে যায়।বড় বড় চোখ করে সে সবাইকে দেখে।চোখ যায় ডানপাশে,তার থেকে কয়েক হাত দূরে।একটি মিষ্টি মতোন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার হাতে একটা কেক,মুখে তার সবসময়ের মতো চওড়া হাসি।ওয়াজিদের সাথে চোখাচোখি হতেই সেই হাসি আরো প্রশস্ত হলো।উৎফুল্ল স্বরে সে বলল,’শুভ জন্মদিন ওয়াজিদ।মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অব দ্য ডে।’
আজকের তারিখটা মনে করার চেষ্টা করল ওয়াজিদ।ওহ হ্যাঁ।আজ তো তার জন্মদিন।দুই দিন আগেও মনে ছিল,এখন আর মনে নেই।মুহূর্তেই তার মন ভালো হয়ে গেল।সে ঘাড়ে হাত বুলাতে বুলাতে খানিকটা লাজুক হেসে বলল,’থ্যাঙ্ক ইউ।’
জন্মদিন উপলক্ষে তেমন কোনো আয়োজন নেই।রিমি একটা কেক অর্ডার করেছে।শীলা পোলাও আর রোস্ট রান্না করেছে।ওয়াহিদুল সাহেব কয়েক রকমের মাছ কিনেছেন।এর মধ্যে শীলা রান্না করেছেন রূপচাঁদা আর রুই মাছ ভাজা।
সেই রাতে সবাই একসাথেই খেলো।এই মুহূর্তটা কি দারুণ না?ওয়াজিদের দারুণ লাগে।খেতে খেতে শীলা আর ওয়াহিদুল ওয়াজিদের ছোট বেলার নানা গল্প,নানা স্মৃতিচারণে মশগুল হলেন।ওয়াজিদ মাথা নামিয়ে সেসব কথা শুনে।মাঝে মাঝে লজ্জায় তার মাথা হেট হয়।রিমির সামনে এসব কথা বলার কোনো মানে আছে?মা বাবা কি কিছুই বুঝে না?
রাতের খাবার শেষে সবাই মিলে কেক কাটলো।ওয়াজিদ সবাইকে নিজ হাতে একটু একটু কেক খাওয়ায়,রিমিকেও।ওয়াহিদুল আর শীলা কিছুক্ষণ পর তাদের ঘরে চলে গেলেন।পড়ে রইল কেবল ওয়াজিদ আর রিমি।একবার মা বাবার ঘরের দিকে দেখেই ওয়াজিদ সামনে ফিরে।কেকের উপর থেকে সামান্য পেস্ট্রি হাতে তুলে চট করে রিমির গালে মাখায়।
চমকে উঠে সামনে দেখল রিমি।মুখ হা করে নিজের গালে হাত রেখে সে ওয়াজিদের দিকে তাকায়।দু’জনের চোখাচোখি হতেই ওয়াজিদ তার হাত টেনে ধরল।গাঢ় স্বরে বলল,’তা কি যেন বলছিলে তুমি?’
একরাশ অস্বস্তি জেঁকে ধরল রিমিকে।ওয়াজিদ কাছে আসতেই যেন কয়েকটা হৃদস্পন্দন মিস হলো।কন্ঠ শুকিয়ে কাঠ।আমতা আমতা করে সে জবাব দেয়,’কই কিছু বলিনি তো।’
ওয়াজিদ সামান্য ঝুকে তার কপালে কপাল ঠেকায়।ঘোর লাগা কন্ঠে বলে,’রিমি! আর ইউ লিসেনিং?’
রিমি কি উত্তর দিবে?তার তো গলা বসে যাচ্ছে।মন চাচ্ছে চিৎকার করে বলতে,’ইয়েস আই অ্যাম লিসেনিং।’কিন্তু মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না। সে মাথা নেড়ে মিনমিনে স্বরে বলল,’হু।’
ওয়াজিদ মুচকি হাসে।হাস্কি গলায় বলে,’Anata o aishitemasu’
রিমি ভড়কে গিয়ে বলল,’জ্বী?’
হাসি চওড়া হয় ওয়াজিদের।একহাতে রিমির কানের পেছনে এক ফালি চুল গুজে দিয়ে বলল,’কালকে গুগল করে দেখবে কেমন?’
‘জ্বী আচ্ছা দেখব।’
ওয়াজিদ তার গালের সাথে আলতো করে নিজের গাল চেপে ধরল।রিমির মনে হলো রিমি এখুনি দম বন্ধ হয়ে ম’রে যাবে।সে টেনে টেনে কিছুক্ষণ শ্বাস নেয়।ওয়াজিদ আগের মতো করেই জানতে চায়,’আমাকে তোমার কেমন লাগে রিমি?’
রিমি ছটফট করে উঠল।বুক ধুকপুক করছে তার।আনত স্বরে সে উত্তর দেয়,’ভালো লাগে।’
‘কতোখানি?’
রিমি বোকা বোকা হয়ে তার দিকে তাকায়।এর উত্তর সে কিভাবে দিবে?অনেকক্ষণ চুপ থেকে শেষে লাজুক হেসে সে জবাব দিলো,’যতোখানি ভালো লাগলে কেউ পাত্তা না দেওয়া স্বত্তেও তার পেছন পেছন ঘুরা যায়,ততখানি ভালো লাগে।’
ওয়াজিদ ভ্রু কুঁচকায়।
‘আমি তোমায় পাত্তা দেই না?’
‘জ্বী না।’
‘এতো বড়ো অপবাদ?’
দু’জন সমস্বরে হেসে ফেলল।ওয়াজিদ তার গালে আলতো করে চুমু খায়।রিমির ঘন ঘন নিশ্বাস তার মুখে এসে পড়ছে।সে জড়ানো মোহাবিষ্ট কন্ঠে বলল,’আমি তোমায় পাত্তা দেই না বিষয়টা একদমই এমন না।তুমি যে আমার পেছন পেছন ঘুরে এতো রকম কথা বলো,এই বিষয়টা আমার দারুণ লাগে।আই ফিল ইউ গার্ল।’
রিমির মনে হলো তার অনুভূতি সব দলা পাকিয়ে গলার কাছে এসে আটকে গেছে।তার হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে মাটি ফাঁক করে যদি ভেতরে ঢোকা যেত,তবে এক্ষুনি সে সেখানে ঢুকে বসে থাকতো।
‘আমাদের বিয়ের কয়দিন হয়েছে রিমি?’
রিমির ধ্যান ভাঙে।কাঁপা গলায় সে জবাব দেয়,’এই তো দেড় মাস বোধহয়।’
ওয়াজিদ আর কিছু জানতে চাইল না।আচমকাই দুই হাতে তাকে পাজাকোলা করে তুলে নিল।রিমি প্রথমে হতভম্ব হলো,শেষে ধাতস্থ হয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরল।তার সব তালগোল পাকাচ্ছে।ওয়াজিদ কাছে এলেই তার সব তালগোল পাকিয়ে যায়।নবনীতার বিয়ের দিন থেকে তার মনে ওয়াজিদের জন্য সুপ্ত অনুভূতি ছিল।এই কথা কি তার ওয়াজিদ কে বলে দেওয়া উচিত?ওয়াজিদ তাকে খারাপ ভাববে না তো?
ঘরে আসার পরেই ওয়াজিদ তাকে খাটে নামিয়ে আবারো তার কাছাকাছি গিয়ে বসল।রিমির মনে তখন কালবৈশাখীর ঝড়।মন চাচ্ছে ওয়াজিদকে সেই ঝড় দেখাতে।কিরকম অস্থির অস্থির লাগছে সব।
সেই রাতে দু’জন সত্যিকার অর্থে তাদের বৈবাহিক সম্পর্ককে একটা পূর্ণতা দিলো।ওয়াজিদ তার সহধর্মিণীর ভীষণ কাছে গেল।যতখানি কাছে যাওয়ার জন্য একটা সম্পর্কের নির্দিষ্ট বৈধতা থাকা বাঞ্ছনীয়,ঠিক ততখানি কাছে।আর রিমি লজ্জায়,জড়তায়,স্বামীর ভালোবাসায় রীতিমতো রক্তিম হচ্ছিল।তার আরক্ত মুখটা দেখেই ওয়াজিদ একগাল হাসল।রিমির সাথে বিয়ের মতো দুর্ঘটনা যদি তার জীবনে না ঘটতো,তবে জীবন কখনোই এতো সুন্দর হতো না।সে রিমির কপালে প্রগাঢ় চুম্বন খেয়ে বলল,’সেদিন সত্য বলে ধরা খাওয়ানোর জন্য তোমায় ধন্যবাদ।আর সবকিছুর শেষে আমাকে বিয়ে করার জন্য আরো একটা ধন্যবাদ রিমি।’
.
.
.
.
নবনীতার চাকরি হয়েছে একটা কলেজে,পদার্থবিজ্ঞানের গেস্ট টিচার হিসেবে।রোজ সকাল আটটায় তাকে বের হতে হয়।বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা ছয়টা।কলেজ শেষ হওয়ার পরেও অনেকটা সময় তাকে অন্য কাজ করতে হয়।নবনীতার অবশ্য তাতে আপত্তি নাই।বেতনের টাকা টা কল্পনা করলে এসব কষ্ট আর কষ্ট বলে মনে হয় না।
রোজকার মতো আজও সে কলেজ শেষ হওয়ার পর তার ডেস্কে বসে কাজ করছিল।শুরুতে তার সাথে আরো অনেকেই ছিল।বেলা গড়াতেই আস্তে আস্তে মানুষ কমতে শুরু করল।নবনীতা একবার পাশ ফিরে আশপাশ দেখল।তার কলিগ কেউই আপাতত এখানে নেই।জায়গা টা কেমন নিরব।গা ছমছম করার মতো।সে আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে।আর মাত্র আধঘন্টা।তারপর সে নিজেও বেরিয়ে যাবে এই নিরব নিস্তব্ধ অফিসরুম থেকে।
সাইফুল সাহেব একটা ঢোক গিলে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন।তার দৃষ্টি একেবারে কোণার দিকে ডেস্কে বসে থাকা মেয়েটার দিকে।তার পরণে নীল সুতির শাড়ি।কি সুন্দর গায়ের গড়ন।তিনি জিভ দিয়ে দুই ঠোঁট ভেজান।একবার চোখ রাখেন তার কোমরের দিকে।মুহুর্তেই কেমন মাদকতা আর অস্থিরতা জেঁকে ধরল তাকে।তিনি এগিয়ে যান।তার লোলুপ দৃষ্টি মেয়েটার সমস্ত অঙ্গে বিচরণ করছে।কাছে গিয়েই তিনি সহসা একহাত তার কাঁধে রাখলেন।
মুহূর্তেই ছিটকে দূরে সরে আসে নবনীতা।এক লাফে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে।বিস্ময়ে তার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।সেকেন্ডের মাথায় তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়।সে তেঁতেঁ উঠে বলল,’এসব কেমন অসভ্যতা?দূরে যান।’
তার কথায় সাইফুলের কোনো হেলদোল হলো না।তিনি উল্টা কুটিল হেসে বললেন,’আহা নবনী! কাম অন।কেউ কিছু জানবে না।জাস্ট তুমি আর আমি।’
নবনীতা আরো দুই পা পেছায়।ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে সামনে দেখেই কটমট করে বলে,’একটা চড় দিব ধরে।বেয়াদব কোথাকার!’
সে সাথে সাথে সবকিছু গুছিয়ে নেয়।এখানে আর এক মুহূর্তও না।দরকার পড়লে কাল সে ওভারটাইম করবে।কিন্তু এখানে আর কিছুতেই থাকবে না।সে সবকিছু গুছিয়ে সামনে এগোতেই সাইফুল সাহেব খপ করে তার আঁচল টেনে ধরলেন।নবনীতা পেছন ফিরে স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকায়।মুহূর্ত গড়াতেই তার একহাত গিয়ে সপাটে চড় বসালো সাইফুলের গালে।
সাইফুল গালে হাত রেখেই অগ্নিচোখে তার দিকে তাকায়।নবনীতা একটানে নিজের আঁচল ছাড়িয়ে নিয়ে কড়া গলায় হুংকার তুলে,’একদম জেলের ভাত খাওয়াবো বলে দিলাম যদি আর এই দুঃসাহস দেখিয়েছেন তো।’
সাইফুলের গায়ে জ্বালা ধরল ভীষণ।এতো দেমাগ এই মেয়ের?এই একা ঘরেও সে এতো সাহস দেখাচ্ছে কেমন করে?সে দাঁত কিড়মিড় করে এগিয়ে যায়।দুই হাতে নবনীতার কনুই চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’দরকার হয় আমি জেলের ভাত খাবো,তার আগে তোকে ভোগ করব।’
নবনীতা আঁতকে উঠে তার দিকে তাকালো।এই মুহূর্তে তার সমস্ত শরীর ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে।সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে চেঁচিয়ে উঠে,’ছাড়ুন।আপনি একজন শিক্ষক।মাথা খারাপ আপনার?’
সাইফুল খেঁকিয়ে উঠল,’শিক্ষক তো কি হয়েছে?পুরুষ না আমি?এই শরীর দেখলে কি আমাদের কামনা জাগে না?বললাম তো কেউ জানবে না।শুধু তুমি আর আমি।তাতে এতো সমস্যা কি?এমনিতেই তো জামাই তোমাকে ছেড়ে দিয়েছে।আমার সাথে কিছু করলে তো কেউ তোমায় কিছু বলবে না।’
নবনীকার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে এলো।সাইফুল তাকে যেভাবে ধরেছে সেখান থেকে ছাড়া পাওয়া অসম্ভব।সে তবুও গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দেয়,চিৎকার করে নিজেকে বাঁচানোর জন্য সাহায্য চায়।ফলাফল শূন্য।সাইফুলের পুরুষালি শক্তির কাছে যখন সে পুরোপুরি পরাজিত হয়ে যাচ্ছিল তখন একটা কথাই তার মাথায় আসলো।
‘আমার ছায়া থেকে বেরিয়ে দুনিয়াতে চলতে শেখো না।তখন দেখবে দুনিয়া কি জিনিস।হায়নারা তো সব খুবলে খাবে।তখন বুঝবে বর কি জিনিস।’
নবনীতা শব্দ করে কেঁদে ফেলল।মানুষটা রাগের মাথায় কথাটা বলেছিল।কিন্তু ভুল কিছু বলেনি।এই এতোগুলো মাসে কেউ কোনোদিন আড়চোখেও তাকে দেখার সাহস করেনি।আজ দেখছে,নিস্তব্ধ জনমানবশূন্য অফিসরুমে তার সম্মান আর সম্ভ্রমে হাত দিয়ে তাকে কলুষিত করতে চাইছে।শক্তিতে সে ভীষণ দুর্বল।কিভাবে সে এদের সাথে পেরে উঠবে?
সে শেষ মুহূর্তে আর কোনো উপায়ান্ত না দেখে গলা ছেড়ে চিৎকার করলো।তার দুর্বল শরীরটা মাটিতে ঢলে পড়ার আগেই অকস্মাৎ বিকট শব্দে কেউ দরজা খুলল।মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে নবনীতার চোখ জোড়া ছলকে উঠে তাকে দেখল।দেখতেই তার মুখে হাসি ফুটল।সে বিড়বিড় করে আওড়ায়,’আরহাম! আপনি এসেছেন?সত্যিই আপনি এসেছেন?’
চলবে-
#কোনো_এক_শ্রাবণে[তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৬১)[দ্বিতীয় অংশ]
‘পরী’
দখিনের জানালা খোলা।বসন্তের সুন্দর বাতাস সেই জানালা দিয়ে সুড়সুড় করে ভেতরে প্রবেশ করছে।ঘরের বাতি নিভিয়ে রাখা।চাঁদের আলোতে যতখানি দেখা যায়,ঠিক ততটুকুই দেখা যাচ্ছে।নবনীতা বসেছে খাটের মাঝামাঝি দুই হাঁটু ভাঁজ করে।হাঁটুর ভাজেই কপাল ঠেকানো।তার শরীর স্বাভাবিকের চাইতে একটু গরম।জ্বর আসবে বোধহয়।সে জবাব দিলো না।যেভাবে বসেছিল সেভাবেই বসে রইল।
আরহাম বসেছে তার একদম সামনে।খাটে না,একটা টুলে।তিনবার ডাকার পরেও যখন মেয়েটা কোনো সাড়া দিলো না,তখন সে আর অহেতুক ডেকে শক্তি অপচয় করলো না।কেবল মাথা নামিয়ে নিজের হাতটা দেখল।উফফ! জ্বলছে ভীষণ।ঐ সাইফুল কে মারতে মারতে তার হাত ব্যাথা হয়ে গেছে।শেষে যখন কিল ঘুষি মেরেও কাজ হচ্ছিল না,তখন সোজা তার মাথা ফাটিয়েছে সে।আইন আদালত নিয়ে সে ভয় পায় না।এসব তার অনুকূলেই থাকবে।ক্ষমতার এইতো সুবিধা। নিজের খেয়ালখুশি মতো যা মন চায় করা যায়।
সে মাথা না তুলেই বলল,’কেমন আছো পরী?রাগ কমেছে তোমার?’
নবনীতা নিশ্চুপ।কিছুক্ষণ জড়ো পদার্থের ন্যায় চুপ থেকে শেষটায় ঠান্ডা গলায় বলল,’আপনি যান এখান থেকে।’
আরহাম চোখ তুলে।গভীর মনোযোগ দিয়ে তার হাবভাব বোঝার চেষ্টা করে।গাঢ় স্বরে প্রতিউত্তর করে,’জেদ ছেড়ে দাও পরী।অনেক হয়েছে।বাড়ি চলো।’
‘যাব না আমি।’ এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে জবাব দেয় সে।
‘বেশ।তো কি করবে এখন?কিভাবে চলবে?বলেছিলাম না মেয়ে মানুষ একা দুনিয়ায় চলতে পারে না।মিলল তো আমার কথা?’
তার কন্ঠে দম্ভ,স্পষ্ট অহংকারের ছাপ।সে জয়ী,নবনীতা পরাজিত।হাঁটুতে কপাল ঠেকিয়েই নবনীতা ক্লান্ত স্বরে বলল,’আপনি না আসলেও আমি কোনো না কোনো ভাবে ঠিকই নিজেকে রক্ষা করতাম।’
‘কিভাবে?’
আরহাম বিদ্রুপ করে বলল,’সুপার ওম্যান নাকি তুমি?যেভাবে ঐ কু’ত্তার বাচ্চা তোমাকে ধরেছিল,নড়তেও তো পারছিলে না।’
‘সে যাই হোক।আল্লাহ বাঁচাতো আমায়।’
‘আল্লাহ কেন বাঁচাবে?আল্লাহ কি বলেছে স্বামীর সাথে জেদ দেখিয়ে এমন বেডাগিরি করতে?’
‘বেডাগিরি কখন করেছি?’
‘আমার সামর্থ্য থাকা স্বত্তেও তুমি আবার এসব চাকরি করছো কেন?এতো জেদ কেন ধরছো?আল্লাহ তো এসব করতে বলেনি।’
‘ওহহ আচ্ছা।আল্লাহ বলেছে বউকে থাকার খোঁটা দাও,খাওয়ার খোঁটা দাও,যোগ্যতার খোঁটা দাও।তাই না?’
আরহাম চুপ থাকলো কিছুক্ষণ।কতোক্ষন মেঝেতে পা দিয়ে আঁচড় কেটে অবশেষে অতিমাত্রায় ক্ষীণ স্বরে বলল,’আই অ্যাম সরি।এবার চলো।’
নবনীতা হাঁটুর কাছ থেকে মাথা তুলল।তার হঠাৎই হাসি পেল ভীষণ।সে এলোমেলো হেসে বলল,’সরি বলতে এতো জড়তা আপনার?’
‘বেশি কথা বলবে না।বাড়ি চলো।’
‘আমি যাব না।’
‘বাড়াবাড়ি করছো পরী।’
‘আমি এমনই।’
আরহাম কটমট করে বলল,’মামার পেনশনের টাকা দিয়ে এতো ভাব নিচ্ছ।বসে বসে খেলে তো রাজার সম্পদও ফুরায়।আর তোমার এই কয়টা টাকা ফুরাতে কয়দিন?’
‘যতদিনই হোক।আগে ফুরাক,তারপর দেখা যাবে।আমাদের টাকা হালাল,কম হলেও দেরিতে ফুরায়।’
আরহাম খেঁকিয়ে উঠল,’আর আমার টা কি হারাম?’
নবনীতা ঠোঁট উল্টে বলল,’কে জানে! আপনি নির্বাচনে জেতার আগ পর্যন্ত বোধহয় হালালই ছিলো।এখন কি জানি না।’
‘আমি কোনো চিটার বাটপার না পরী।আগেও বলেছি,এখনো বলছি।’
‘আর আমি কোনো জন্ম পরিচয় বিহীন কুকুর বিড়াল না।মন চাইলো আর অপমান করবেন,মন চাইল আর ভালোবাসবেন।আর্থিক ভাবে দুর্বল হলেও এতোটা ছাপোষা আমি না।’
আরহাম তপ্ত শ্বাস ছাড়ল।কন্ঠে অতিমাত্রায় কোমলা ঢেলে বলল,’সরি বলছি তো পরী।মাথা ঠিক ছিলো না আমার।আর এমন হবে না।বাসায় চলো।সব বুঝিয়ে বলছি।’
নবনীতা তাকালো,একদম তার চোখ বরাবর।তার ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।
‘এই এক কথা শুনতে শুনতে আমার কান পচে গেছে।আর এমন হবে না,আর এমন হবে না।আর কতোবার এক কথা শুনবো?এমনই তো হয়ে আসছে আরহাম।আমি একটু শান্তি চাই।প্লিজ আপনি এমন হুটহাট বাড়িতে চলে আসবেন না।ভালো লাগে না আমার।এই বাড়ি,এই বাড়ির সব ফার্নিচার,আমার পরনের সব শাড়ি আমার নিজের টাকায় কেনা,কয়েকটা অবশ্য মামার টাকায় কেনা।কিন্তু আপনার টাকার কিচ্ছু এখানে নেই।যা ছিলো সব আগের বাসার ওয়্যারড্রবে রাখা।’
বলা শেষ করেই সে আরেক দফা হাসল।আরহাম একটা শুকনো ঢোক গিলল।গম্ভীর কিন্তু অনুতপ্ত সুরে বলল,’পরী তখন আমার মাথা ঠিক ছিলো না।বারবার বিষয় গুলো এভাবে প্রেজেন্ট করছো কেন?আই ফিল আনকম্ফোর্টেবল।’
‘এন্ড আই ফিল ইনসাল্টেড।মনে পড়লে নিজের উপরই কেমন ঘিন ঘিন লাগে।কেন চাকরিটা ছেড়ে দিলাম?কেন নিজেকে এতোটা পরনির্ভরশীল বানালাম?কোনো কেনো’র ই উত্তর নেই আমার কাছে।’
সে পুনরায় হাঁটুতে মুখ গুজে।ধরে আসা গলায় কোনোরকমে বলে,’আপনি সত্যিটা মেনে নিন আরহাম।আপনি যেমন করে আশা করছেন আমি সবটা ভুলে যাব,এটা আসলে সম্ভব না।সবটা ভুলতে হলে আমার আগে নিজেকেই ভুলতে হবে।সেটা সম্ভব না।আপনি যদি এই সম্পর্ককে ন্যুনতম সম্মান করে থাকেন,তবে আমার এই সিদ্ধান্তকেও সম্মান করুন।একটু স্পেস চাই আমার।প্লিজ।নিজের কাছে যেই অপরাধবোধ হচ্ছে আমার,সেই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি চাই।আপনি আসুন।আমাদেরকে আমাদের মতো ছেড়ে দিন।যিনি আমাদের সর্বশূন্য করেছেন,তিনিই আমাদের টিকে থাকার ব্যবস্থা করবেন।আপনাকে এতো ভাবতে হবে না এসব নিয়ে।যান আপনি।’
আরহাম কতোক্ষণ তাকে দেখল।শেষে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।মন চাইছে ঠাস ঠাস কয়েকটা কড়া কথা শুনিয়ে দিতে।তবুও দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সে রাগটুকু গিলে নিলো।তার মুষ্টিবদ্ধ হাত নবনীতার নজর এড়ালো না।সে মাথা নামিয়ে বলল,’ভুল আপনি একা করেন নি।আমিও করেছি।গায়ে হাত দেওয়া আমার ভুল ছিলো।সম্ভব হলে ক্ষমা করে দিবেন।’
আরহাম তার দিকে ফিরে তাচ্ছিল্য করে বলল,’সরি বললেই মিটে গেল?আমি যেমন আমার কথা ফিরিয়ে নিতে পারব না,তুমি পারবে ঐ কাজগুলো ফিরিয়ে নিতে?আমি যদি মেইডদের সামনে তোমায় ঠাটিয়ে চড় মারতাম তবে কেমন লাগতো তোমার?’
আরহাম আর কথা বাড়ালো না।বলতে গেলেই তার সমস্ত শরীর রাগে রিরি করে।সে না হয় হঠকারিতা করে।পরী সেদিন যেটা করল ঐটা কি খুব ভালো কাজ?বড় বড় পা ফেলে সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।দরজার কাছেই চিত্রা দাঁড়িয়েছিল।আরহাম তাকে দেখতেই হাঁটু মুড়ে বসল।তার গালে হাত রেখে বলল,’কি পাখি?কেমন আছো?তুমি যে এতো গুলো দিন আমায় ফোন দিলে না একবারো,আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করেছি।’
চিত্রা নখ কামড়াতে কামড়াতে নবনীতার দিকে তাকায়।তার অসহায় চোখ জোড়া দেখেই আরহাম কপাল কুঁচকে বলল,’আপাই ফোন করতে দেয়নি তাই না?’
সে এক টানে চিত্রাকে কোলে তুলে নেয়।কপালে টপাটপ চুমু খেয়ে বলে,’ভাইয়া তোমাকে অনেক মিস করেছি সোনা।আরশাদও মিস করেছে।’
চিত্রা একটু লজ্জা পেল বোধহয়।সে এখন স্কুলে পড়ে।ভাইয়া তাকে আরশাদের মতোন হুটহাট কোলে নেয় কেন?সে কি বাবু নাকি?সে নিচু গলায় বলল,’ধুর! আরশাদ কি অতোকিছু বুঝে নাকি?’
‘বুঝে বুঝে।তোমাকে চিনে তো।চোখ দিয়ে তোমাকে খুঁজে।তুমি যাবে আরশাদের সাথে দেখা করতে?’
চিত্রা অসহায় গোল গোল চোখে নবনীতার দিকে তাকায়।ব্যাপারটা বুঝতেই আরহাম বলল,’আচ্ছা থাক যেতে হবে না।পরে কোনোদিন যাবে।এখন বলো কি খাবে?চকলেট,চিপস,নাকি আইসক্রিম?নাকি সবগুলোই?’
আরো একটা মলিন,অসহায় চাহনি।চিত্রার ছটফটে মুখটা দেখেই আরহামের মায়া হলো।সমস্যা চলছে তার আর নবনীতার মাঝে।মাঝখানটায় এই ছোট্ট বাচ্চা মেয়েটা কেন দোটানায় পড়ছে?
নবনীতা খাট থেকেই চেঁচিয়ে উঠল,’কিছু খাবে না চিত্র।বলো আমাদের যা আছে তাই নিয়ে আমরা খুশী।আর আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।আমার দুই বোন যার তার টাকায় চলে না।’
আরহাম থমথমে মুখে একবার তার দিকে তাকালো।তারপর আবার ঘুরে চিত্রার দিকে ফিরে বলল,’চলো আমরা একটু বাইরে থেকে হেঁটে আসি।’
চিত্রা কিছুক্ষণ চুপ থাকল।তারপর গোল গোল চোখ করে বলল,’আমি যদি তোমার থেকে চকলেট আর চিপস নেই তাহলে কি তুমি ভাববে আমি শুধু টাকার জন্যই তোমাকে পছন্দ করি?’
দ্রুত মাথা তুলে নবনীতা।কি সর্বনাশ! চিত্র সব কথা এমন জায়গা মতো ফাঁস করে দিচ্ছে কেন?তার প্রশ্ন শুনেই আরহামের চোখ মুখ শক্ত হলো।সে কটমট করে জানতে চাইল,’কেন?তোমার এমনটা কেনো মনে হয়েছে?’
‘আপাই বলেছে কারো থেকে চকলেট চিপস না নিতে।কারণ এগুলো তারা আমাদের ভালোবেসে দেয় না,আমাদের যে টাকা কম তাই খোঁটা দেওয়ার জন্য দেয়।”
একহাত আপনাআপনি কপালে গিয়ে ঠেকলো নবনীতার।বিড়বিড় করে বলল,’চিত্র রে! তোর গাড়িতে ব্রেক দে এক্ষুনি!’
আরহাম আর সেদিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করল না।কেবল কটাক্ষ করে বলল,’তোমার সবজান্তা আপাই এসব কথা বলেছে তাই না?যাক গে।তুমি চলো ভাইয়ার সাথে।আমরা একটু ঘুরে আসি।সে ঘরে থাকুক।ঘরে থেকে সে বিশ্বজয় করুক।’
সে চিত্রাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল সাথে সাথে।নবনীতা সেভাবেই আগের মতো হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকলো।হঠাৎ একটা কথা মাথায় আসছে তার।আরহাম কি করে জানলো যে এটাই তার বাসা?তার কলেজ পর্যন্তও বা পৌঁছুলো কি করে?সে একটা ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ে।মানুষকে প্রতি মুহূর্ত ট্রেস করার স্বভাব তার আর যাবে না।
.
.
.
.
‘আমার মনে হচ্ছে আমি কোনো মনোরোগে ভুগছি।’ দুই হাত ডেস্কে রেখে সামান্য ঝুঁকে কথাটা বলল ইজমা।
ইফাজ ফাইল চেক করার ফাঁকে ফিচেল হাসল।চোখ না তুলেই বলল,’বাপরে! জটিল বিষয়।’
‘জ্বী।অনেক বেশি জটিল।আপনি কি আমার সমস্যা টা ধরতে পারবেন?’
ইফাজ মাথা নাড়ল।
‘জ্বী না মিস।আমি কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট নই।আমি আপনার মনের অসুখ ধরতে পারব না।’
ইজমা কিছুটা হতাশ হলো।গালের নিচে হাত রেখে বলল,’আচ্ছা তাহলে কোনো ভালো সাইকিয়াট্রিস্টের খোঁজ দিন আমায়।’
‘আপনি ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট দিয়ে কি করবেন?আমেরিকাতে এর চেয়ে অনেক ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট আছে।ফিরে গিয়ে তাদের কাউকে দেখিয়ে নিবেন,তার সাথে কনসাল্ট করবেন।কেমন?’
ইজমা অন্যদিকে ফিরে ভেঙচি কাটে।এই লোক একবারো চোখ তুলছে না কেন?সে আরো কিছুক্ষণ উসখুস করল।মাথা চুলকে বলল,’এমনিতে প্রাথমিকভাবে আপনার কি মনে হয়?আমার সমস্যা টা আসলে কি?’
ইফাজ ফাইল থেকে চোখ সরালো।ইজমাকে দেখে ভাবলেশহীন হয়ে বলল,’সমস্যা টা জটিল।আমার অনুধাবনের বাইরে।’
‘এতে কি আমার মরে যাওয়ার কোনো চান্স আছে?’
ইফাজ মুচকি হাসল।
‘জ্বী না।তবে বৈরাগী হওয়ার চান্স আছে।’
ইজমা লজ্জা পেল খানিকটা।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে বলল,’আমি আসি তাহলে।’
সে দরজার কাছে যেতেই ইফাজ তাকে পিছু ডাকল,’দাঁড়ান ইজমা।’
সে ঘুরে দাঁড়ায়।তার আরক্ত মুখখানা দেখেই ইফাজ স্মিত হাসে।বলপয়েন্ট কলমটা গালের সাথে চেপে ধরে বলে,’আবার আসবেন ইজমা।সমস্যা যেটাই হোক,আমি সমাধানের চেষ্টা করব।আর সমস্যা না থাকলেও আসবেন।আমার ধারণা সমস্যা টা মূখ্য বিষয় না,বরং আমার সাথে সাক্ষাৎ হওয়াটাই মূখ্য।’
ইজমা পুনরায় ঘুরে দাঁড়ায়।সে ধরা পড়ে গেছে।একটু আগেও তার ভেতর কোনো জড়তা কাজ করছিল না।এখন করছে।সে সিদ্ধান্ত নিল সে আর পেছন ফিরবে না।ফিরলেই অস্বস্তিতে পড়বে।সে তাড়াতাড়ি সামনের দিকে পা বাড়ায়।যেতে যেতে শুনলো ইফাজ পেছন থেকে খানিকটা চওড়া গলায় বলছে,’কাল আবার আসবেন ইজমা।আমি অপেক্ষা করব।’
.
.
.
.
‘তুই এক কাজ কর।তুই নারায়ণগঞ্জে একটা বাড়ি কিনে ফেল।তারপর সেখানেই থাকা শুরু কর।সব মিটিং ভার্চুয়ালি করবি।আর সারাদিন বউয়ের উপর নজর রাখবি।ভালো না আইডিয়া টা?’
আরহাম সোফায় বসে চা খাচ্ছিল।আদি তার পাশে বসতে বসতে কথাটা বলে তার দিকে তাকালো।সে বিরক্তি হলো ভীষণ।কপাল কুঁচকে বলল,’বাজে বকিস না তো।তুই জানিস সেদিন আমি লেইট করলে কি হতো?’
‘না জানি না।জানতে চাইও না।যা হওয়ার হতো।তুই তো বলেই দিয়েছিস নবনীতার যা খুশি হোক,তোর কিছু যায় আগে না।এখন এতো জ্বলছে কেন?’
আরহাম ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে আরো একটা চুমুক দিলো।শ্বাস ছেড়ে বলল,’আর কয়বার মাফ চাইলে এই পাপের প্রায়শ্চিত্ত হবে?’
আদি একটা হাত তার কাঁধে রাখল।ঠান্ডা গলায় বলল,’এতো অধৈর্য হচ্ছিস কেন?সময় দে একটু।টাইম হিলস এভরিথিং।’
‘আর কতো টাইম?মাস গড়িয়ে যাচ্ছে।’
‘যাক না।এই একমাসে তুই কি কি পরিবর্তন এনেছিস নিজের মাঝে আমাকে বল।’
আরহাম কটমট চোখে তার দিকে তাকালো।চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’তাকে আমি চাইলে সেদিনই আমার সাথে নিয়ে আসতে পারতাম।নবনীতাকে আমি অনেক ভাবেই পরাজিত করতে পারি আদি।সে যেই কলেজে চাকরি করে সেখানের প্রিন্সিপালকে যদি আমি একবার কল দেই,তাহলে পরের দিনই তার চাকরি থাকবে না।আমি সেটা করিনি।আমার নির্লিপ্ততাই কি আমার সবচেয়ে বড় পরিবর্তন না?সে আমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে।যাকগে,তার বয়স অল্প,বুঝজ্ঞান কম।বুঝজ্ঞান থাকলে বুঝতো যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে,যোগ্যতায় তাকে ছাড়িয়ে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।থাক,সে কথা আর বলছি না।করুক চাকরি,আমার আপত্তি নেই।কিন্তু একটা সম্পর্ক ঠিক কতোদিন এভাবে ঝুলে থাকবে তুই বলতে পারিস?আমাদের একটা কনক্লুসানে যেতে হবে।না সে কিছু বলছে,না সে আমার কথা শুনছে।হোয়াট শ্যুড আই ডু?সে তো দিব্যি আনন্দে আছে।মাঝখানটায় আমার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়েছে।সে জানে আমি তার প্রতি দুর্বল।এটারই ফায়দা নিচ্ছে সে।সব মেয়েই একরকম।’
আদি মাথা নামিয়ে শব্দ করে হাসল।একটা হাত আরহামের হাঁটুর উপর রেখে বলল,’বাচ্চাদের মতো অভিমান করছিস তুই।বাদ দে।নিজের কাজে মন দে।দেখ না,সামনের দিনগুলো তে কি হয়।এখনই এতো অধৈর্য হোস না।’
আরহাম এক ঝাড়ায় তার হাত সরিয়ে দিলো।জীবনের প্রতি তার বিতৃষ্ণা ধরেছে,ভয়াবহ রকমের বিতৃষ্ণা।ইশশ! এমন কি কোনো যন্ত্র নেই,যেই যন্ত্রের ভেতরে গিয়ে আরহাম সবার মেমরি থেকে সেদিনের সমস্ত স্মৃতি মুছে দিবে?তারপর সব আবার আগের মতো ঠিক হয়ে যাবে।আর কতো?আর কতো হায় হুতাশ করবে সে?এতোদিনে তো তার প্রায়শ্চিত্ত হয়ে যাওয়ার কথা।
.
.
.
.
প্রথম মাসের বেতনটা হাতে পাওয়া মাত্রই নবনীতার মুখে হাসি ফুটল।কতো মাস পর সে আবার নিজ থেকে উপার্জন করছে! সাতাশ হাজার টাকা।কম কি?যেদিন সে বেতন পায়,সেদিন সে রিকশা করে বাড়ি ফিরে।আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সে বাড়ি ফিরতেই চিত্রা তার কাছে দৌড়ে এলো।নবনীতা চোখ সরু করে জানতে চায়,’কি রে?এমন দৌড়াচ্ছিস কেন?’
‘আপাই আমি আজকে ত্রি স্টার পেয়েছি ক্লাস টেস্টে।’ অত্যাধিক আনন্দিত স্বরে উত্তর দিলো চিত্রা।
নবনীতার মুখে হাসি ফুটল।সে হাঁটু গেড়ে বসে চিত্রার গালে চুমু খেয়ে বলল,’আমি তো জানতাম তুমি পাবে।তুমি না আমার লক্ষী বোন?’
‘পরী! আজ কি দিয়ে ভাত খাবে পরী?’
মিসেস রোকেয়া ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।নবনীতা হাসি মুখ করে বলল,’একটা হলেই হলো।তোমার সব রান্নাই আমার ভালো লাগে।’
মিসেস রোকেয়া জবাব শুনেই আবার রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন।নবনীতা অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’তোমার ঐ চিংড়ি মাছ আর পুঁইশাকের ঝোলটা আমাকে শিখিয়ে দিয়ো তো মামি।আরহামের অনেক পছন্দ—-
সে থামল।আঁতকে উঠে রান্নাঘরের তাকালো।সাথে সাথে মুখ চেপে চারপাশ দেখল।মামি শুনেনি তো?কেউ আশেপাশে নেই তো?সে তাড়াতাড়ি তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।অতীত সে ভুলে গেছে।নিজের ভেতর যেই যন্ত্রণা সে চেপে রেখেছে,সেটা সে বাইরে প্রকাশ করতে চায় না।সম্পর্কের সমঝোতায় সে আসতে চায় না।আগে বহুবার এসেছিল।ফলাফল শূন্য।
সে ঘরে গিয়েই প্রথম বর্ষের মিডটার্মের খাতা গুলো খুলে বসল।মোট একশো আঠারোটা খাতা।আজ রাতের মধ্যেই তাকে এগুলো দেখতে হবে।ধ্যাত! এতো কাজ সে কতোক্ষণে শেষ করবে?আঁচল দিয়ে কপাল মুছে সে কাজে লেগে গেল।বাইরে সূর্যের তাপ বাড়ছে।এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত হলে ভালো হতো।সে খাতা কাটায় মনোযোগ দেয়।কাজের ফাঁকেই তিন বছর বয়সের একটা ছোট্ট বাচ্চার মুখ বার বার তার মস্তিষ্ক ভেসে উঠে।কতোদিন হয়েছে সে তাকে আদর করে না,বুকের সাথে চেপে ধরে ঘুম পাড়ায় না! এতো গুলো দিন সে কেমন করে মা কে ছাড়া থাকছে?মায়ের বুকের ওম না পেলে তো তার ঘুম হয় না।মাও তো তাকে ছাড়া নির্বিঘ্নে ঘুমুতে পারে না।এই কথা সে কাকে বলবে?কে বুঝবে তার ভেতরের টানাপোড়েন?
চলবে-