#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৫৯)
কপালের দিকটায় চিনচিন ব্যাথা হচ্ছে।বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে উঠছে কিছু অপ্রীতিকর দৃশ্য।একটা খুব কাছের মানুষ তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে কাঁচের টি-টেবিলের দিকে ছুড়ে মেরেছে।সে হুড়মুড়িয়ে সেটার উপর আঁছড়ে পড়তেই তার মাথা গিয়ে ঠেকল টেবিলের এক কোণায়।আর তারপর?মানুষটা হাঁটু মুড়ে বসে তার গাল চেপে ধরল।জানতে চাইল তার কি যোগ্যতা আছে স্ত্রী হওয়ার?আদৌ কি কোনো যোগ্যতা আছে?উঠে দাঁড়িয়ে লোকটা গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’তার জায়গা আমার পায়ের কাছেই।’
দৃশ্য গুলো অনেকটা বড় পর্দায় দেখানো সিনেমার মতো মানসপটে ভেসে উঠল।স্তব্ধ,নির্বাক হয়ে পড়ে থাকা রুগ্ন দেহটা সামান্য কেঁপে উঠে।মুহূর্ত গড়াতেই সে ঘুমের ঘোরেই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।সেই কান্না সময়ে সময়ে গোঙানিতে রূপ নেয়।মা বাবার মৃত্যুর পর সে পুরোপুরি ভেঙে পড়েছিল।তারপর একেবারে রূপকথার নায়কের মতো একটা মানুষ তার জীবনে এসে শক্ত হাতে তাকে আগলে নিয়েছে।সেই হাতে সে নিজেকে ভীষণ নিরাপদ ভাবতো।সেই লোকটা কি গ্রীক পুরাণের কোনো অসাধারণ মানবের চেয়ে কম কিছু ছিল?তার শূন্য জীবনটা সে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে,আদরে ভালোবাসায় তাকে অনুভব করিয়েছে সে একা না,তার জন্যও কেউ না কেউ আছে।তার মামা,মামি দুই বোন-সবার দায়িত্ব নিয়েছে।আভিজাত্য আর জৌলুসে তাকে মুড়িয়ে রেখেছে।কিন্তু হঠাৎই একদিন সে তাকে মনে করিয়ে দিলো সে আসলে একটা অযোগ্য মেয়ে।পায়ে থাকার জিনিস,যাকে সে মহানুভবতা দেখিয়ে মাথায় তুলে রেখেছিল।তার গলা চে’পে,তাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে সে প্রমাণ করেছে সে লাথি উষ্ঠা খাওয়ারই যোগ্য।তার যোগ্যতা ঐটুকই।মা নেই বাবা নেই,দুই পয়সার আয় নেই,,সে আবার কিসের ভিত্তিতে অতো বড়ো নেতার বউ হবে?আছে তার কোনো যোগ্যতা?
সে ফুপিয়ে উঠল।বুজে রাখা চোখ গলিয়ে নোনা জল গাল পর্যন্ত নেমে এলো।রিমি আলতো করে নিজের হাতটা তার মাথায় রাখে।ধিমি আওয়াজে ডাকে,’নবনী! এ্যাই নবনী! আর কতো কাঁদবি?চোখ খুল।দেখ আমরা সবাই তোর সাথে আছি।’
আওয়াজ কানে যেতেই খাটের এক কোণায় শুয়ে থাকা মেয়ে মানুষটা সামান্য নড়ে উঠল।ক্লান্ত চোখ জোড়া মেলে দিয়ে সামনে দেখার চেষ্টা করল।রিমিকে দেখামাত্রই তার কান্নার বেগ বাড়ল।এক লাফে উঠে সহসা সে রিমিকে শক্ত
করে জড়িয়ে ধরল।কান্নার মাঝেই হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,’চলে এসেছি রিমি।সব ছেড়ে ছুড়ে চলে এসেছি।আর সম্ভব না,আর পারছি না।হেরে গেছি রিমি,খুব বাজে ভাবে হেরে গেছি।’
সে থামে।টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে নিজেকে কিছুটা শান্ত করার চেষ্টা করে।একটু ধাতস্থ হতেই পুনরায় জড়ানো গলায় বলে,’সে আমাকে থাকার খোঁটা দিয়েছে,খাওয়ার খোঁটা দিয়েছে।বলেছে আমি নাকি পায়ে থাকার জিনিস।মাথায় এনে জায়গা দিয়েছে সে।রিমি সত্যি বলছি।আরহাম এই কথা বলেছে।আরহাম।আমার হাসবেন্ড।আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ।’
রিমি শান্ত।কেবল একহাতে অনবরত নবনীতার পিঠে হাল বুলিয়ে দিচ্ছে।ভীষণ আদুরে গলায় বলছে,’নবনী! তুই না সাহসী মেয়ে?তুই না একা হাতে চিত্র আর শুভিকে বড়ো করেছিস?তুই এভাবে কাঁদলে হবে?’
‘ওহহ হ্যাঁ।চিত্র আর শুভিকে নিয়েও খোঁটা দিয়েছে।বলেছে আমাকে পালে,আমার বোনদের পালে।তার টাকায় আমার পুরো ঘর চলে।ঠিক এভাবেই বলেছে রিমি।বিশ্বাস কর আমি একটুও বাড়িয়ে বলছি না।’
রিমির কন্ঠ জড়িয়ে যায়।তবুও সে কোনোরকমে বলল,’জানি আমি।বিশ্বাস কেন করব না?বোকা নাকি তুই?’
‘তুই বিশ্বাস করছিস?অথচ আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না।’
বলতে বলতেই তার শ্বাস উঠল।এমনভাবে কি কেউ কাউকে ভাঙতে পারে?সেদিনের কথা কি নবনীতা ভুলে গেছে?যেদিন আরহাম তার হাত জড়িয়ে ধরে বলেছিল তার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত তার যাবতীয় সমস্ত খরচ আরহাম বহন করবে।তারপর সে চাকরি পেলে তখন সে নিজেই তার পরিবারের খরচ চালাবে।ঠিক এমন করেই তো বলেছিল।ভালোবেসে বলেছিল তাই না?তবে সময়ের সাথে ভালোবাসা ফুরিয়ে গেল?
একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে রিমিকে ছেড়ে দিলো।এতোক্ষণে তার খেয়াল হয়েছে রুমে সে বাদেও ওয়াজিদ আর আরিশ আছে।সে একটু শান্ত হয়ে বসতে আরিশ এগিয়ে এলো।তার মুখটা ভীষণ ফ্যাকাসে দেখাচ্ছে।খাটের এক কোণায় বসেই সে মলিন মুখ করে বলল,’তুমি সত্যিই আর আমাদের বাড়ি যাবে না ভাবি?তুমি না গেলে আমাদের কি হবে?’
নবনীতা হাসল।বিষন্ন আর উদাস হাসি।দুই ঠোঁট সামান্য প্রসারিত রেখেই বলল,’কিছুই হবে না আরিশ।জীবন জীবনের মতো চলবে।আমি যখন ছিলাম না তখন কি তোমরা থাকতে না ঐ বাড়িতে?এখন আবার থাকবে।সমস্যা কি?’
আরিশের আবারো মায়া হলো।ভাবির জন্য তার আর তাসনুভার বিশেষ টান আছে।মা চলে যাওয়ার পর ভাবিই প্রথম মানুষ যে রোজ রোজ মনে করে তার আর তাসনুভার খেয়াল রাখতো।রোজ সন্ধ্যায় ভাবির ঘরে গিয়ে তারা চায়ের আসর জমাতো।অথচ তিনদিন ধরে ভাবি বাড়ি নেই।বাড়িটা কেমন আধার হয়ে আছে।এই নিস্তব্ধ,থমকে যাওয়া বাড়ি আরিশ চায় না।কিন্তু সে কোনোভাবেই ভাবিকে বাড়ি ফেরার কথা বলতে পারে না।তার বিবেকে বাঁধে,মন সায় দেয় না।ভাইয়ের এমন আচরণের পর সে কেমন করে তাকে ফিরে যেতে বলবে?
ওয়াজিদ এসে রিমির পিঠ বরাবর দাঁড়ায়।একটু গম্ভীর হয় জানতে চায়,’এই অ্যাপার্টমেন্টও ছেড়ে দিচ্ছ?’
নবনীতা তাকে দেখল না।খাটের বেডশীট টার দিকে চোখ রেখে বলল,’হুম।বেঁচে থাকতে আর এখানে থাকছি না।আমি আমার দুই বোনকে নিয়ে দরকার হয় না খেয়ে মরব।কিন্তু অন্যের মালিকানাধীন ফ্ল্যাটে আমি আর থাকছি না।’
রিমি লক্ষ্য করল প্রতিটা শব্দে,প্রতিটা বাক্যে তার বিধ্বস্ত ভাব কেটে যাচ্ছে।উল্টো সেখানে এসে জড়ো হচ্ছে একটা চাপা রাগ,একটা দুর্দমনীয় জেদ।
নবনীতা চুপচাপ উঠে দাঁড়ায়।চোখের পানি মুছে একবার নিজের হাত দেখে।এই শেষ,আর সে কাঁদবে না।এই দুই দিন সে অনেক কান্না করেছে।আর না।সে দ্রুত সাদেক সাহেবের ঘরে গেল।মিসেস রোকেয়া সেসময় ঘরেই ছিলেন।নবনীতা তাদের দেখেই জোরপূর্বক সামান্য হাসার চেষ্টা করল।ব্যর্থ প্রয়াস।তার মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা সম্পর্কে সবাই অবগত।
নবনীতা বসল একেবারে সাদেক সাহেবের মুখোমুখি।বসেই তার দুই হাত লুফে নিয়ে নরম সুরে বলল,’মামা আমি আমার জীবনে তেমন কিছুই করতে পারিনি।কোনোরকমে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে তারপর সংসারের জালে জড়িয়ে গেছি।এখন মনে হচ্ছে সেদিন বিয়ের জন্য রাজি না হলেই বোধহয় ভালো ছিল।যাকগে,পুরোনো কথা তুলে লাভ নেই।যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।তোমরা হয়ত জানো আমি সেদিন কেবলই বেড়ানোর জন্য এখানে আসি নি।আমি নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে তবেই এসেছি।আরহামের ঘর,তার সংসার,তার জীবন সবকিছু থেকেই আমি সরে এসেছি।সরে এসেছি বললে ভুল হবে,সে নিজেই আমাকে মুক্তি দিয়েছে।নিজের কোনো ব্যক্তিগত ইনকাম নেই এমন মেয়ের সাথে তার সংসার করা যায় না।আমি সেই সংসার ছেড়ে চলে এসেছি।কিন্তু এই বাড়িটাও তার।তার বাড়িতে আমি আর থাকছি না।ইচ্ছে ছিল সেদিনই একেবারে খালি হাতে সবকিছু ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার।কিন্তু এই দুইদিন শরীর এতো খারাপ ছিলো যে নড়তেও পারছিলাম না।এখন একটু স্থির হয়েছি।এই বাড়িতে আমি আর থাকছি না।আমিও না,তোমরাও না।জানি না তোমাদের নিয়ে কোথায় যাবো।কিন্তু এখানে আপাতত থাকছি না।রিজিক নিয়ে ভাবছি না,আল্লাহ একটা ব্যবস্থা করবেন।কিন্তু ঠিক কিভাবে সবকিছু গোছাবো,সেটা নিয়ে আমার চিন্তা।আমি গুছিয়ে উঠতে পারছি না।তোমরা কি বলতে পারো কিভাবে এই যন্ত্রণা থেকে আমি মুক্তি পাবো?’
সে কথা গুলো বলল একেবারে দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে।বলতে গিয়ে কোথাও থামল না,কোথাও হোঁচট খেল না।তাকে এখন খুবই স্বাভাবিক দেখাচ্ছে।অথচ যেদিন সে এসেছিল সেদিন সে এতো বেশি বিধ্বস্ত ছিল যে কথা পর্যন্ত বলতে পারছিল না ঠিকঠাক।অথচ দুই দিনে মেয়েটি নিজেকে সামলে নিলো।নিজের সাংসারিক টানাপোড়েন এতো সহজভাবে বলে দিলো যেন তার আর কিছুতেই কিছু যায় আসে না।
মিসেস রোকেয়া তার কাঁধে নিজের একটা হাত রাখলেন।অভয় দিয়ে বললেন,’ভয় কিসের পরী?তোমার মামার পেনশনের টাকা আছে না?দরকার পড়লে সেই টাকা ভাঙবো।তবুও তুমি ভেঙে পড়ো না।তুমি ভেঙে পড়লে আমাদের খুব দুর্বল লাগে পরী।
ভীষণ আশ্চর্য হয়ে সামনে তাকায় নবনীতা।মামি তাকে এই কথা বলেছে! তার বিশ্বাস হচ্ছে না।অবিশ্বাস্য চোখেই সে জানতে চাইল,’কি বললে মামি?পেনশনের টাকা ভাঙবে?’
‘হ্যাঁ ভাঙব।তোমাদের ভালোর জন্য যা লাগে তাই করব।অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাদের।আর না।তোমার কাছে আমাদের অনেক ঋণ পরী।তুমি শুধু বলো কোথায় যাবে, আর কিভাবে থাকবে।টাকা নিয়ে ভেবো না।তোমার মামা আছি,আমি আছি।টাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
নবনীতার বিস্ময়ভাব তখনো কাটেনি।সে হা করে কতোক্ষণ মিসেস রোকেয়াকে দেখল।মামি তাকে এসব বলছে?এতো যত্ন কি এর আগে কখনো মামি তাদের করেছিল আগে?মনে পড়ছে না।সহসা সে জাপ্টে ধরিয়ে ধরল মিস রোকেয়া কে।সেই প্রথমদিনের মতো ঝর ঝর করে কেঁদে উঠে বলল,’বিশ্বাস করো মামি।অনেক চেষ্টা করেছি ঘরটা বাঁচানোর।আমি তার অনেক অপরাধ দেখেও এড়িয়ে গিয়েছি।এই সংসার বাঁচাতে আমি নিজের ইগো,প্রেসটিজ কোনোকিছুর তোয়াক্কা করিনি।সত্যিই করিনি।তবে শেষ পর্যন্ত আমি পারি নি মামি।আর সম্ভব হচ্ছে না।বিশ্বাস করো।এই ঘর করা আর সম্ভব না আমার পক্ষে।সে আমার সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গায় আঘাত দিয়েছে।আমি আর পারছি না মামি।ঐ বাড়িতে আর এক মুহূর্ত থাকলে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতো।সত্যি বলছি।’
মিসেস রোকেয়া নিরবে তার মাথায় হাত বুলান।তাকে ভরসা দিয়ে বললেন,’থাকতে হবে না ঐ ঘরে পরী।ঐ ছেলের সংসার আর করতে হবে না।আমরা অতো বড়লোক নই,বড়লোকদের সাথে আমাদের যায়ও না।আমরা যেমন আছি,আমাদের যা আছে তা নিয়ে আমরা সুখে আছি।’
নবনীতা আরো কিছুক্ষণ সেভাবেই পড়ে রইল।তার ভালো লাগছে ভীষণ।সে সাহস পাচ্ছে।যেই জেদ তার ভেতর চেপেছে,সেই জেদ বোধহয় মিসেস রোকেয়ার জোরাল আলিঙ্গনে আরেকটু আশকারা পেল।সে পারবে,অবশ্যই পারবে।
***
শুভ্রা মলিন মুখে পড়ার টেবিলে বসেছিল।কাল তার প্র্যক্টিক্যাল শেষ হয়েছে।আজ কথা ছিলো তারা পুরো শহর ঘুরবে।কিন্তু আজ সারাদিন তার এতো বাজে কেটেছে যে সে একটু ভাত পর্যন্ত মুখে দেয়নি।
আপাইকে দেখলেই তার কান্না পায়।আপাইয়ের মুখটা দেখলেই তার মন হয় তার ভেতর ছিঁড়ে যাচ্ছে।সেদিন যখন আপাই বাড়ি এলো,শুভ্রা দরজা খুলেই আঁতকে উঠেছে।আপাইয়ের কপালে ব্যান্ডেজ।চোখে পানি।এই আপাই শুভ্রার অপরিচিত।বাকিদের বিষয় সে জানে না,তবে আপাইয়ের এই বিধস্ত রূপ শুভ্রা সহ্য করতে পারে না।আপাই কে এভাবে ধাক্কা দেওয়ার অধিকার কারো আছে?নেই তো,কিছুতেই নেই।তাহলে কেন দিলো?আপাইয়ের যখন এভাবে রক্ত বেরুচ্ছিলো তখনও কি তার মন গলেনি?তখনও কি একটু মায়া হয়নি তার?
আরিশ তার ঘরের দরজার কাছে এসে গলা খাকারি দেয়।শুভ্রা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে একনজর দেখল,তারপর পুনরায় সোজা হয়ে বসল।আরিশ দরজা ছেড়ে একটু সামনে এগিয়ে এসে জানতে চাইল,’কিছু খেয়েছ শুভ্রা?’
সে কটমট করে জবাব দেয়,’না খাইনি।’
‘অদ্ভুত! আমার সাথে এমন ব্যবহার করছ কেন?’
শুভ্রা পেছন ফিরে।গলা উঁচু করে জানতে চায়,’তো কি করব?কিভাবে কথা বলব আপনার সাথে?আপনাদের টাকায় আমরা খাই,পরি।সেজন্য কি এখন আপনাদের পা ছুঁয়ে কথা বলব?’
আরিশ চোখ বড় বড় করে বলল,’আশ্চর্য ব্যাপার!ভাইয়ার ইস্যু নিয়ে তুমি আমার সাথে এভাবে কথা বলছ কেন?আমি কখনোই এমন কিছু বলিনি।’
‘তো ভাইয়ার ইস্যু নিয়ে বলব না?আপনার ভাই কে দিয়েই তো আপনার সাথে পরিচয়।আপনি এক কাজ করুন।আপনার ভাইকে পাগলের ডাক্তার দেখান।আপনার ভাই কোনো সুস্থ মানুষ না।ভাববেন না মজা করছি।রাগের মাথায় সে আপনাদেরও মেরে ফেলতে পারে।তার কোনো ভরসা নাই।’
কথাটা আরিশের লাগলো খুব।সে আরো এক পা এগিয়ে কাটকাট গলায় বলল,’একদমই এমন না।ভাইয়ার রাগ বেশি।তবে তুমি যেমন বলছ সে একদমই এমন না।ভাবি তাকে সবার সামনে চড় না দিলে সে কখনোই এমন কাজ করতো না।আমি আমার ভাইয়াকে চিনি।’
‘আর আমিও আমার বোনকে চিনি।’ এক সেকেন্ডও বিলম্ব না করে উত্তর দিলো শুভ্রা।
‘আমার বোনও সামান্য কারণে কাউকে চড় দেয় না।কতোখানি সহ্য করার পর সে এই কাজ করেছে এটা আপনি কোনোদিনও বুঝবেন না।যাকগে,আপনার ভাই আপনার কাছে সেরা।আমার বোন আমার কাছে সেরা।আমরা আর এসব নিয়ে কথা না বাড়াই।আপনি থাকুন আপনার ভাইকে নিয়ে।আমরা চলে যাচ্ছি শহর ছেড়ে।আপনার ভাইকে বলবেন দয়া করে যেন সে অন্য শহরে এসেও আমার বোনকে না জ্বালায়।’
.
.
.
.
ব্যাংক থেকে তিনলক্ষ টাকা তোলা হয়েছে।আপাতত একমাস এই টাকাতেই সবকিছু গুছিয়ে উঠা যাবে আশা করা যায়।আজ রাত দুইটায় বাস।এখন বাজে আটটা ত্রিশ।
শুভ্রা ব্যাগ গোছাচ্ছে।মালামাল তেমন কিছু নেই সাথে।কেবল আছে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আর বই খাতা।সাদেক সাহেবের ঘর থেকে রিমির গলার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।সে রোজ রোজ বাড়ি আসে নবনীতাকে একটু দেখার উদ্দেশ্যে।নবনীতা শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে এই কথা শুনলেই তার চোখ ভিজে যায়।কি আশ্চর্য!মেয়েটা তাকে এতো ভালোবাসে কেন?
নবনীতা চেয়ার টেনে বসল।কোথা থেকে চিত্রা ছুটে এসে খুশিতে গদো গদো হয়ে বলল,’আপাই আপাই।আমরা কি ঘুরতে যাচ্ছি?’
নবনীতা শান্ত চোখে তার দিকে তাকায়।তার গালে আদর দিয়ে বলল,’হ্যাঁ চিত্র।আমরা ঘুরতেই যাচ্ছি।’
খুশিতে চিত্রার দুই চোখ ভরে আসে।সে লাফাতে লাফাতে চলে গেল।আবার কি একটা ভেবে হঠাৎ ছুটে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’আর আরশু আর আরাম ভাই?ওরা কখন যাবে?এখনো আসলো না তো আপাই।’
নবনীতা শীতল চোখে তাকে দেখল।ঠান্ডা স্বরে বলল,’ওরা আসবে না চিত্র।যাও তুমি তোমার জামা গুলো নেওয়া হয়েছে নাকি দেখো।পরে কিন্তু কান্নাকাটি করলে হবে না।যাও সব ঠিক আছে নাকি দেখ।’
চিত্রা চলে গেল।নবনীতা একটা ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে কলম হাতে নিল।
_________________________________________________
“সাত বছর।আনুমানিক সাত বছর আগে আমি এই শহরে এসেছিলাম।একেবারে শূন্য হাতে।দু’টো বোন আর নিজের অনিশ্চিত জীবন নিয়ে এ শহরে পা রেখেছিলাম।সাতটা বছর কিভাবে কাটিয়েছি জানি না।সাত বছর পর আবারো এক প্রকার শূন্য হাতেই চলে যাচ্ছি শহর ছেড়ে।এই শহর আমায় কি দিয়েছে আমি জানি না।ক্ষণিকের আনন্দ দিয়েছে অবশ্যই।বিগত আটমাস আমি রানীর হালে কাটিয়েছি।একটা বড়লোক আর ক্ষমতাধর বর ছিল বলেই সেটা সম্ভব হয়েছে।নয়তো আমার মতো মা বাবাহীন মেয়ের পক্ষে থোড়াই এতো ভালো থাকা সম্ভব।
আসলে কি লিখবো নিজেও জানি না।কেমন ভোঁতা ভোঁতা অনুভূতি হচ্ছে।সেদিন যখন আমি তার বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম,সে খুব তাচ্ছিল্য করে বলল আমি নাকি তার ছায়া থেকে বেরিয়ে দুই দিনও বাঁচতে পারব না।বাড়িতে সে আরশাদকে ছুঁয়েও দেখে না।সারাক্ষণ আরশাদ আমার কাছেই থাকে।অথচ সে আরশাদকে আমার সাথে আনতে দেয়নি।কারণ আমি জানি।সে ভেবেছিল আরশাদকে না আনতে দিলে আমি হয়তো ঐ বাড়ি ছেড়ে যাব না।কিন্তু এবার আর এসব হচ্ছে না।আরশাদের তকদির সে আগেই লিখে এনেছে।আল্লাহই তার ব্যবস্থা করবেন।তার কথা ভেবে নিজের সম্মান খুয়িয়ে ঐ বাড়িতে থাকা সম্ভব না।আমি হয়তো কিছুটা অসহায় হয়ে পড়েছিলাম।কিন্তু আমি এতো সস্তা নই।নবনীতা কোনো রাস্তার কীট না।আরহামকে এই কথা বুঝতে হবে।
আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা নারায়ণগঞ্জ যাব।সেখানে গিয়ে একটা বাসা ভাড়া নিব।শুভ্রা অনলাইনেই মেডিকেলের কোচিং করবে।চিত্রাকে সেখানের স্কুলে ভর্তি করাবো।আমি দেখি একটা চাকরি খুঁজে নিব।পাশাপাশি পড়াশোনা করব।অনেক অনেক পড়ব আমি।আমি কোনো লুজার নই।ভীত নই আমি।আর কখনো ন্যাকুদের মতো কাঁদবো না।খুব বড় হবো জীবনে।নূর আহমদের মেয়েটি কিছুতেই হারবে না।অপমানে অপমানিত হয়ে কান্না করার কোনো মানে নেই।আমি আমার যোগ্যতা দিয়ে নিজের অপমান পুষিয়ে দেবো।আরহাম বলেছে না যে আমার দুই পয়সার মুরোদ নেই?আমি আমার পরিশ্রম দিয়ে দিয়ে মুরোদ দেখাবো।মুখে কিছু বলব না,যা বলার আমার যোগ্যতা বলবে।আরহাম সম্ভবত ভুলে গেছে আমি আমার তিনমাসের বোনকে সামলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগও পেয়েছি।তখন মামিও আমার সাথে ছিল না,শুভি ছিলো অনেক ছোট।এখন সবাই আমার সাথে আছে।আমি পারব না তো কে পারবে?যেই আমি ছয় বছর কোনো সাহায্য ছাড়া এতোদূর আসতে পেরেছি,সেই আমি এইটুকুতেই ভেঙে যাব?
আমি বিয়ের পর সব মেনে নিয়েছি।এর মানে এই না আমি দুর্বল।আমি খামোখা ঘর ভাঙতে চাইনি।সংসারে অশান্তি করতে চাইনি।সবচেয়ে বড় কারণ আমি আরহামকে ভালোবেসেছি।যতখানি ভালোবাসা সম্ভব,ঠিক ততখানি।সেই দুর্বলতা আমাকে এখনো কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।যাকগে,সে কথা থাকুক।সবাই কি ভালোবেসে সুখে থাকতে পারে?আমাদের না হয় বিচ্ছেদেই মুক্তি।
আরহাম,
আপনি ভালো থাকুন।সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করা,পায়ের জুতো হওয়ার যোগ্য মেয়েটি আর কখনোই আপনার সামনে আসবে না।যেদিন তার মুরোদ হবে,সেদিনই না হয় তার সাথে আপনার দেখা হোক।ভালো থাকবেন আপনি আপনার এই ঠুনকো সাম্রাজ্যে।নবনীতা নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে এই বিত্ত বিভবের মাঝে থাকার চেয়ে নিজের সম্মান নিয়ে বস্তির ছোট্ট খুপরিতে থাকাকেই বেশি সাচ্ছন্দ্যের মনে করে।নবনীতা দুর্বল না,সে কোনোদিনই দুর্বল ছিলো না।ভালোবাসার জন্য ছটফট করাকে কি দুর্বলতা বলা যায়? ”
নবনীতা নূর
২৯ শে মাঘ ১৪২৯
চলবে-
#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৬০)
[রিচেক দিতে আলসেমি লাগে।পরে দিবো]
আমার হাতে এক কাপ চা।অন্য হাতে একটা পাউরুটি।আমি পুরোটা চা এক নিমিষে খেলাম না।উল্টা অর্ধেক চা নিজে খেলাম,আর বাকি অর্ধেক চা পাউরুটিকে খাওয়ালাম।এটা হলো আমার উদারতা।ক্ষণিক বাদেই আমি চায়ে ভেজানো পাউরুটিটা খেয়ে নিলাম।এটা কি?এটা হলো রাজনীতি।দূর থেকে যেটা জনসেবা কিংবা মহানুভবতা বলে মনে হয়,ভেতরে উঁকি দিলে দেখা যায়,কোনো না কোনোভাবে সেখানে ব্যক্তি স্বার্থ জড়িয়ে আছে।এই রাজনীতির অঙ্গনে কয়জন টিকে থাকতে পারে বিচক্ষণতার সাথে?অপরপক্ষের কূটচাল ধরে ফেলার মতো দুরদর্শিতা কি সবার থাকে?
সবার খবর জানা নেই,তবে শাহরিয়ার আরহামের সেই দুরদর্শিতা নেই।বিষয়টা দূরদর্শিতার না,বিষয়টা অবিবেচক হওয়ার।রাজনীতিতে সবচেয়ে বুদ্ধিমান ব্যক্তি হলো সে যে নিজের কোনো পিছুটান রাখে না।যার মনে মায়া,দয়া,আবেগ কোনো কিছুরই ঠাই নেই।আরহাম এখনো সেই চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌছুতে পারেনি।এখনো এতোখানি পাষন্ড আর অনুভূতি শূন্য সে হয়ে যায় নি।তাই তার পক্ষে তথাকথিত দূরদর্শী রাজনীতিবিদ হওয়া সম্ভব না।সে সর্বোচ্চ যা করতে পারে তা হলো বাকিদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে নিজের গদি মজবুত করা।ব্যাস এইটুকুই।
আরহাম বয়সে অপরিপক্ক,অভিজ্ঞতা সীমিত,রাজনীতির মারপ্যাচ গভীরভাবে বোঝার মতোন বিচক্ষণ সে কখনোই না।এই কথা সে অস্বীকার করে না।তবে রাজনীতির ভয়াবহ দিকগুলো আজকাল তাকে ভীষণ ভাবায়।যেই লুপ হোলে সে আটকে যাচ্ছে,এর থেকে মুক্তি কোথায়?আরহাম কি কোনো কৃষ্ণগহ্বরে তলিয়ে যাচ্ছে?তাই যদি হয়,তবে এখান থেকে তাকে টেনে তুলবে কে?
সময়টা বসন্তের শুরুর দিকের।খুব সম্ভবত ফাল্গুনের এগারো তারিখ।আরহাম ব্যস্ত তার ব্যবসায়িক কাজে।ইংরেজি মাস শেষ হতে আর কিছুদিন বাকি।কিছু ব্যবসার হিসেব মেলাতে হবে।এ নিয়ে কয়েকদিন যাবত সে ভীষণ ব্যস্ত।তারপর আবার পার্টি অফিসেও যেতে হবে।এতো কিছু সে সামলাবে কেমন করে?
আরহাম ঘন্টাখানকের মতো কাজ করে একটু দম ছাড়ে।দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করে।কি ভ্যাপসা গরম চারপাশে!দ্রুত এসির পাওয়ার বাড়ায় সে।হঠাৎ কি মনে করেই টেবিলের উপর রাখা মুঠোফোনটা হাতে নিল আরহাম।আনমনে স্ক্রল করে ডায়ালার অপশনে যায়।নাহ,কোনো ফোন আসেনি।কেউ ফোন দিয়ে জানতে চায় নি,’আরহাম আপনি কোথায়?বাড়ি ফিরবেন কখন?’
ফোনটা আবারো জায়গা মতো রেখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে আরহাম।শুধু শুধু কেন রোজ এই কাজ করছে সে?কেনো মেনে নিতে পারছে না ঐ নম্বর থেকে আর কোনোদিনও তার ফোনে কল আসবে না?শেষ।সব শেষ।দীর্ঘশ্বাস আর ঘৃণা ব্যতীত ঐ সম্পর্কের আর কিছুই বাকি নেই।
সব কাজ শেষ করে,সব ঝামেলা মিটিয়ে সে বাড়ি ফিরল আটটার দিকে।তাসনুভা নিচতালার ইয়ার্ডে জীবনের সাথে কথা বলছিলো।আরহামকে দেখামাত্রই সে মুখ ফিরিয়ে নিল।আরহাম দেখেও না দেখার ভান করল।এসব আজাইরা ঢং দেখার সময় তার নেই।
সে ঘরে গিয়ে বাতি জ্বালায়।আফরোজা বেগম তখন তার ঘরে।আরশাদ ঘুমিয়েছে একটু আগে।আফরোজা এসেছিলেন তাকে খাটে শুয়িয়ে দিতে।আরহামকে দেখতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন।আরহাম হাতের ঘড়ি খুলতে খুলতে গম্ভীর হয়ে জানতে চায়,’খেয়েছে রাতে?’
‘হ্যাঁ,আমি খাইয়ে দিয়েছি।’
বিনিময়ে সে কেবল মাথা নাড়ল।কাবার্ড থেকে তোয়ালে টা বের করেই শাওয়ার নিতে গেল।সমস্ত শরীর ভার ভার লাগছে,মাথা ধরে আছে।একটু গোসল করলে ভালো লাগবে।যেতে যেতে সে ভারি স্বরে বলল,’এক কাপ চা পাঠাবেন আমার ঘরে।মাথা ধরে আছে আমার।’
সে গোসল শেষে বেরিয়ে আসলো মিনিট দশেক বাদে।তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতেই সে ফোন হাতে তুলে নেয়।কোনো একটা জায়গায় কল দিয়েই জানতে চায়,’তোমার ম্যাডাম কি আজকে বের হয়েছিল কোথাও?’
‘জ্বী স্যার।’
‘কোথায় গিয়েছে?ইন্টারভিউ দিতে?’
অন্য পাশ থেকে কি জবাব এলো বোঝা গেল না।তার আগেই সে গম্ভীর মুখ করে বলল,’একটু খেয়াল রেখো।কোথায় যাচ্ছে,কেমন জায়গায় ইন্টারভিউ দিচ্ছে একটু দেখে রেখো।’
সে ফোন কাটে।চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে বাতি নিভিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।চা খাওয়ার ফাঁকে একবার পেছন ঘুরে নিজের অন্ধকার নিস্তব্ধ ঘরটা দেখে।যেই ঘরটা দেখলেই তার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যায়।এই ঘরে একটা মেয়ে থাকতো।যার হাসির ঝংকারে ঘরটা আলো হয়ে থাকতো।অথচ মেয়েটা এখন আর নেই।সারাদিন ব্যস্ততা শেষে বাড়ি ফেরার পর আরহামের বুকে মাথা রাখার মতো কেউ নেই।একটা মানুষের অনুপস্থিতি পুরোটা ঘর কেমন মলিন করে দেয়! ঘরের সমস্ত চঞ্চলতা এক নিমিষে শেষ হয়ে গেল! সে কি জানে আরহাম এই কয়দিনে মানসিক ভাবে কি পরিমান বিপর্যস্ত হয়েছে?জানে কি?ভালো কি সে একা বেসেছে?আরহাম বাসেনি?তবে সবাই কেনো তাকে দয়া দেখাচ্ছে?সবার সহমর্মিতা শুধু তার জন্য।আরহাম কি কিছুই হারায় নি?
সে ধীর পায়ে হেঁটে নিজের ঘরে এলো।টি টিবিলের নিচের তাকে কাগজ রাখা আছে।ব্যবসার হিসেব করার জন্যই মূলত সে রেখেছিল।হঠাৎ কি ভেবে সে একটা টুল টেনে টি টেবিলের সামনে বসল।নিচের তাক থেকে কয়েকটা কাগজ হাতে নিয়ে কলম খুলে বসল।তার মাথায় অনেক কিছু চলছে।অথচ সে কিছু লিখতে পারছে না।পরীকে দেখতো মন খারাপ হলেই ডায়রি লিখতে।ডায়রি লিখলে কি মন হালকা হয়?তবে সেও চেষ্টা করে দেখতো।এতো বিষন্ন মন নিয়ে আর চলা যাচ্ছে না কিছুতেই।
সে কাগজে কলম চালায়-
“প্রিয় পরী”
স্থির চোখে সম্বোধনটার দিকে একমনে তাকায় সে।উহু,ভালো লাগছে না।কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে।সে আবারো লিখে-
“প্রিয় নবনীতা”
ধ্যাত।কেমন পর পর লাগছে।অনেকক্ষণ ধরে বলপয়েন্ট কলমটা গালের সাথে চেপে ধরে সে অবশেষে লিখল,
“আমার পরী,
ভালোবাসা নিবে।আগেই বলি,তোমার মতো গুছিয়ে আমি লিখতে পারি না।তবু লিখছি।তোমার কথা ভীষণ মনে পড়ে পরী।সেদিন কি থেকে কি হলো আমার জানা নেই।তবে সব দোষ এসে আমার উপর পড়ল।আচ্ছা পরী,আমাকে একটা কথা বলো তো?তোমার কি মনে হয় না সেদিন তুমিও একটু বাড়াবাড়ি করেছো?তুমি বেডরুমে কাজটা করলেও আমি হজম করে নিতাম।তুমি কাজটা করেছো লিভিং রুমে,বাড়িভর্তি মানুষের সামনে।আমার প্রচন্ড মেল ইগো,এটা তুমি জানো।তুমি এই কাজটা করাতে আমি কি পরিমান ট্রিগারর্ড হয়েছি তোমার কোনো ধারনা আছে?আমার মেজাজ খুব খারাপ ছিলো পরী।তুমি জানো না সেদিন আমাকে সারাদিন কিসব ফেস করতে হয়েছিল।কিন্তু টি টেবিলে ধাক্কা খেয়ে তোমার কপাল কেটে যাবে এমনটা জানলে আমি কখনো এই কাজ করতাম না।বিশ্বাস করো,কসম করে বলছি।আমি তোমার ঐ বিধ্বস্ত রূপটা দেখেই দমে গেছি।কিন্তু তুমি তারপর বললে তুমি ঘর ছেড়ে দিবে।এ কথা শুনেই আমার মাথা ঘুরে গেল।যেই ভয় এতোদিন ধরে পাচ্ছিলাম,সেটাই সত্যি হলো।আমি আবারো একটা ভুল করলাম।আরশাদকে ব্যবহার করে তোমাকে আটকানোর চেষ্টা করলাম।তুমি আমায় ভুল বুঝলে।অন্য কেউ আমাকে ভুল বুঝলে আমার কষ্ট কয় না।কারণ অধিকাংশ মানুষই আমায় ভুল বুঝে।কিন্তু তুমি ভুল বুঝলে আমার কেমন যেন দমবন্ধ লাগে পরী।তোমার মতো কেউ কখনো আমায় বুঝেনি।তুমি সব ক্ষেত্রে আমাকে বুঝেছ।তাহলে কেন সেদিন বুঝলে না?আমি নিলয়ের মৃ’ত্যুতে স্বাভাবিক ছিলাম না পরী,কিন্তু স্বাভাবিক থাকতে হয়েছে।তুমি কেন আমাকে বুঝতে পারো নি?তুমি আমাকে ফেলে চলে গেলে।আমি কয়েক শতবার তোমায় ফোন দিতে গিয়েও দেইনি।আমার মেল ইগো বার বার আমাকে টেনে ধরছে পরী।তুমি কি কোনো যাদুবলে আমার মনের কথা শুনতে পাচ্ছ পরী?প্লিজ ফিরে এসো,প্লিজ।প্রয়োজনে পড়াশোনা করবে,আমার আপত্তি নাই।তবুও এই অধম,রগচটা আর জঘন্য মানুষটার জীবনে ফিরে এসো।প্লিজ।’
সে কলম বন্ধ করে।লিখাটা একবার পড়েই তার হাসি পেল।পরী কতো সুন্দর করে লিখে! সে কিছুই পারে না।কেমন বাচ্চাদের মতো লিখা হয়েছে।লিখার মাঝে কোনো আবেগ,ভালোবাস,মাধুর্য্য কিছুই নেই।আরহাম তবুও কাগজটা বুকের সাথে চেপে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।তার ইদানিং সবকিছু দমবন্ধ লাগে।একদম সবকিছু।
.
.
.
.
‘এই বাচ্চা! কি হয়েছে তোমার?’
তাসনুভা অন্যমনস্ক হয়ে দেয়ালে ঝুলানো ওয়েল পেইন্টিং টা দেখছিল।আদির আওয়াজ কানে যেতেই সে সেদিকে ফিরল।আদি ঘরে উঁকি দিয়ে হাসি হাসি মুখ করে বলল,’আসতে পারি?’
সে দ্রুত মাথা নাড়ে।আদি চুপচাপ ঘরে এলো।তার পেছনে থাকা মেয়েটাকে দেখতেই তাসনুভা খুশিতে চেঁচিয়ে উঠে,’ইজমা আপু তুমি?’
বিনিময়ে ইজমাও মিষ্টি করে হাসল।এগিয়ে এসে তাসনুভার গোছানো পরিপাটি খাটটায় বসে পা দোলাতে দোলাতে বলল,’তোমার কথা মনে পড়ল।তাই চলে এলাম।’
‘বেশ করেছো।’
আদি মেঝেতে বিছিয়ে রাখা কার্পেটে হাত পা ছড়িয়ে বসল।তাসনুভা কে দেখে আদুরে গলায় বলল,’এবার বলো।মন খারাপ কি নিয়ে বাচ্চা?’
তাসনুভার মুখটা হঠাৎই চুপসে গেল।সে মিনমিন করে জবাব দিলো,’ভাবিকে খুব মিস করি।’
‘সে তো আমরা সবাই করি।কিন্তু তোমার ভাই তো নিজের জেদ ধরে রেখেছে।কি করব বলো?’
‘ভাইয়া এমন কেন?’ তাসনুভার গলা ভেঙে আসে।
‘আরহাম এমনই।মেয়ে মানুষের মতো।বুক ফাঁটে কিন্তু মুখ ফুটে না।সে যে তোমার ভাবির জন্য এই কয়দিনে আধপাগল হয়ে গেছে,সেটা কি তুমি টের পাচ্ছো?’
‘পাচ্ছি।কিন্তু পাগল হলেও তো মুখে কিছু বলছে না।’
আদি একপেশে হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’বাপরে! আরহাম মুখে কিছু বলবে?বললে তার জাত যাবে না?সে তো সিগমা মেল।সিগমা মেল রা কখনো নিজের ভুল ত্রুটি স্বীকার করে না।জানো না এটা?’
ইজমা ফট করে প্রশ্ন করল,’আর তুই কি?ছ্যাচড়া মেল?একশোবার অপমান করলেও পেছন পেছন ঘুরিস।ছ্যাচড়ার ছ্যাচড়া!’
আদি কটমট চোখে তার দিকে তাকালো।চোখ পাকিয়ে বলল,’দাঁড়া,তোর সাথে আমার পরে হিসেব হচ্ছে।’
___
তাসনুভার মন আজকে বিকেলেও খুব খারাপ ছিলো।কিন্তু আদি আর ইজমা বাড়িতে আসার পর থেকেই তার মন ভালো হয়ে গেছে।ইজমা হাসপাতাল থেকে ডিসচার্জ হওয়ার পর তার ফুফুর বাড়িতেই থাকে।আদি কোনোদিন ওয়াজিদদের বাড়ি,কোনোদিন এই বাড়ি,কোনোদিন তার খালামনির বাড়ি-যখন যেদিকে থাকতে মন চায় সেদিকেই থাকে।আজ সে তিনদিন পর এখানে এসেছে।এসেই তাসনুভার সবচেয়ে পছন্দের চাউমিন বানিয়েছে,তাও আবার নিজ হাতে।
কাটা চামচ দিয়ে বেশ খানিকটা চাউমিন নিয়ে তাসনুভার মুখের সামনে ধরে সে তাড়া দিলো,’দেখি দেখি,দ্রুত শেষ করো তো বাচ্চা।খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।’
তাসনুভা হাসিমুখে পুরোটা চাউমিন খেল।খেতে খেতে দু’হাত নেড়ে বলল,’দারুন দারুন।তোমার এই চাউমিনটা অনেক বেশি মজা হয়।’
‘তাহলে রোজ রোজ তোমার জন্য বানাবো কেমন?তবুও তুমি খুশি থাকবে বুঝেছো?’
তাসনুভা জোরে জোরে মাথা নাড়ে।খুশিতে তার দুই চোখ চিকচিক করছে।পরী ভাবি চলে যাওয়ার পর সে আরহামের সাথে প্রয়োজন ছাড়া কথা বলে না।আরিশ ভাইয়াও ইদানিং কেমন মন মরা হয়ে থাকে।আদি ছাড়া তার মনের অবস্থা কেউ বুঝে না।কেউ আসে না দুই মিনিট বসে তার সাথে কথা বলার জন্য।
সে খাওয়া শেষ করতেই আদি তার পকেটে থাকা টিস্যুটা বের করে তার মুখ মুছিয়ে দিলো।একগাল হেসে বলল,’দেখো কেমন বাচ্চাদের মতো সব ভরিয়ে ফেলেছো।এজন্যই তো তোমায় বাচ্চা বলি।’
ইজমা গালের নিচে হাত দিয়ে তাদের দু’জনকে দেখে।আদি সামনে আসা মাত্রই তাসনুভার চোখে মুখে যেই দীপ্তি খেলে,সেটা সহজেই এড়ানো যায় না।ইজমা এড়াতে পারে না।আদির তার প্রতি আচরণ,তার প্রতি যত্ন তাকে মাঝে মাঝে অন্যমনস্ক করে দেয়।সে ভাবে,খুব মন দিয়ে ভাবে।এই যে পকেট থেকে টিস্যু বের করে সে তার মুখ মুছিয়ে দিলো,এর মাঝে কি কোথাও কোনো স্বচ্ছ অনূভুতি নেই?যেই অনুভূতি আদির অগোচরে তার মনে বাসা বাঁধছে।ইজমা অকারণেই শব্দ করে হাসল।এটাকে বলে প্রিন্সেস ট্রিটমেন্ট।যেটা ছেলেরা কেবলই একজনকে করে।ইজমা সেই একজন না,সে কখনোই ছিল না।
.
.
.
.
‘চিত্র! ঘুমাতে এসো না।আর কতো রাত জাগবে?’
গুটি গুটি পায়ে চিত্রা এগিয়ে আসে।রিনরিনে গলায় বলে,’মাত্র এগারোটা বাজে।’
নবনীতা চোখ পাকায়।
‘এগারোটা মাত্র?’
‘মাত্রই তো।’
‘হয়েছে।এসো ঘুমুবে।আপাইয়ের খুব মাথা ধরেছে।তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে নিজেও ঘুমুবো।’
চিত্রা কথা বাড়ালো না।চুপচাপ হেঁটে নবনীতার পাশ ঘেঁষে শুলো।নবনীতা তাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,’স্কুল কেমন লাগে সোনা?’
‘লাগে।মোটামুটি।’
‘বাপরে! কি পাকা পাকা কথা! তা মোটামুটি কেন শুনি?’
‘কারণ স্কুলে সবাই কেমন অন্যরকম।আমার মনের মতো কেউ নেই।’
নবনীতা মুচকি হাসল।বলল,’আরো কিছুদিন যাক।দেখবে মনের মতো বন্ধু পেয়ে যাবে।’
কিছুক্ষণ চুপ থেকে চিত্রা ডাকলো,’আপাই!’
‘জ্বী সোনা।বলো।’
‘আমার এই শহর ভালো লাগে না আপাই।আমি ঢাকা যেতে চাই।তোমার ঐ সুন্দর বাসাটায় যেতে চাই আপাই।এখানে আমার ভালো লাগে না।’
নবনীতা ধীরে ধীরে তার মাথায় হাত বুলায়।মিষ্টি গলায় বলে,’এভাবে বলে না পাখি।এটাও সুন্দর বাসা।এই শহরও সুন্দর।কয়েক বছর থাকলে দেখবে আর যেতে মন চাচ্ছে না।’
‘আপাই!’
‘বলো।’
‘আমরা কি অনেক গরীব আপাই?’
নবনীতা থমকায়।শ্বাস টেনে বলে,’না,আমরা গরীর না।আমরা হালাল টাকায় চলি।’
‘আপাই!’
‘হু।’
‘আরহাম ভাইয়া কি আর আমাদের সাথে দেখা করতে আসবে না?আরহাম ভাইয়া আসলেই তো হাত ভরে খাবার দাবার নিয়ে আসতো।আমি আরহাম ভাইয়াকে মিস করি আপাই।তুমি একটু তাকে বলো না সে যেন আবার আমাদের ঐ সুন্দর বাসাতে নিয়ে যায়।এখানে ভালো লাগে না আপাই।’
নবনীতা তাকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরল।কপালে একটা চুমু খেয়ে আর্দ্র কন্ঠে বলল,’না সোনা।এভাবে বলে না।আমরা কি শুধু তার বাড়ি আর চকলেট-চিপসের জন্য তাকে পছন্দ করি?কোনো মানুষকে কখনোই তার টাকা দেখে পছন্দ করতে নেই চিত্রা।’
‘তাহলে কি দেখে পছন্দ করব?’
চিত্রার সোজা সরল প্রশ্নে নবনীতার হাসি পেল ভীষণ।সে একগাল হেসে উত্তর দিলো,’আমরা মানুষ কে পছন্দ করব তার দৃষ্টিভঙ্গি দেখে।একটা মানুষ কিভাবে আমাদের দেখছে সেটা দিয়ে আমরা তাকে পছন্দ করব।আমাদের টাকা কম থাকাটা যাদের কাছে উপহাসের বস্তু,আমরা কখনোই তাকে পছন্দ করব না।আমরা কম টাকা থাকা স্বত্তেও নিজের শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখি।আমাদের এই স্বপ্ন গুলোকে যারা সম্মান করে,আমরা তাদেরই পছন্দ করব।’
‘আরহাম ভাই কি এমন না?’ ঠোঁট উল্টে জানতে চাইল চিত্রা।
নবনীতা ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে।নিচু আওয়াজে জবাব দেয়,’জানি না রে সোনা।সত্যিই জানি না।তুমি ঘুমাও।কালকে না আবার স্কুল।’
চিত্রা ঘুমালো বিষন্ন মনে।আপাই যতোই বুঝাক,তার এই শহর ভালো লাগে না।বাড়িটা তো আরো আগে ভালো লাগে না।এর আগে তারা কতো সুন্দর বাড়িতে থাকতো! এখন আবার সেই ভাঙা দেয়ালের দালান,প্লাস্টার খুলে খুলে পড়ছে। কি বিচ্ছিরি লাগে দেখতে!’
সে ঘুমুতেই নবনীতা তাকে ছেড়ে উঠে এলো।শুভি পড়ছে পাশের ঘরে।নবনীতা একটু পরে সেখানে গিয়ে তার পাশাপাশি বসে থাকবে।যতক্ষণ সে পড়বে,ততক্ষণ সে বসে থাকবে।তার ইদানিং ঘুম আসে না।সিলিং দেখতে দেখতেই কখন রাত পার হয়ে যায়,সে টেরও পায় না।
রোজকার মতো আজও সে কলম খুলে বসল।
প্রিয় আরহাম,
অনুশোচনায় নিশ্চয়ই তড়পাচ্ছেন ভীষণ।বারবার ভাবছেন কেন বললাম এতো গুলো কথা।না বললেই পারতাম।কয়েকবার ফোন হাতে নিয়ে কল দিবেন ভেবেও রেখে দিয়েছেন।ঐ যে,নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে ফোন দিলেই আপনার জাত যাবে।যাকগে,আপনার চিন্তা আপনার কাছে।আমি বলার কে?
নতুন শহরে আসার পরেই মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।চাকরির জোগাড় হয়েছে।সে নিয়ে ভাবছি না।ভাবছি চিত্রকে নিয়ে।সবাই সব বুঝলেও সে তো বাচ্চা।অতো কিছু বুঝে না।আপনাকে খুব মিস করে,বার বার আপনার কথা বলে।ওহ ভালো কথা।মেয়েটা খুব বড় হয়ে গেছে আরহাম।এখন আর আপনাকে আরাম ভাই বলে ডাকে না।আরহাম ভাই বলেই ডাকে।স্কুলে যাওয়ার পর থেকেই সে কেমন বড় হয়ে গেছে আরহাম।আপনার কথা খুব বলে।খুব মিস করে আপনাকে।আমিও আপনাকে মিস করি।খুব মনে পড়ে আপনার কথা।তবে মানিয়ে নিচ্ছি।আপনাকে আমি ভালোবেসেছিলাম।আপনি আমাকে বিনিময়ে টেকেন ফর গ্রান্টেড হিসেবে নিয়ে ছিলেন।অর্থাৎ সম্পর্কে সহ্য আর স্যাক্রিফাইস সব সময় আমাকেই করতে হবে,এটাই যেন নিয়ম।অথচ সম্পর্ক এমন না,এটা ভালোবাসা না আরহাম।আপনি এটা উপলব্ধি করুন।যেদিন উপলব্ধি করবেন,সেদিন আমার দরজায় এসে দাঁড়াবেন।নবনীতা আপনাকে জড়িয়ে ধরে আপনার বুক ভাসাবে।কিন্তু তার আগে না।আপনি যেদিন আপনার জঘন্য রাগটা নিয়ন্ত্রণ করতে শিখবেন,সেদিন পরীর সাথে পুনরায় আপনার ঘর হবে।তার আগে না। আমি আর কোনো কথাতেই পড়াশোনা ছাড়ছি না।একটা পার্মানেন্ট চাকরি পাওয়ার আগ পর্যন্ত নবনীতা এই যাযাবর জীবনেই ঠিক আছে।আমি বরাবরই নারী হিসেবে ব্যর্থ।কারণ এতো কিছুর পরেও আমি আপনাকে ঘৃণা করতে পারিনি।কারণ আমার অনুভূতি স্বচ্ছ ছিলো।কিন্তু ভালোবাসি বলেই যে সব কথার পরিশেষে ‘কোনো ব্যাপার না’ বলে এগিয়ে যাবো বিষয় টা এমন না।ভালোবাসা ভালোবাসার জায়গায়,আত্মসম্মান আত্মসম্মানের জায়গায়।আপনি যতদিন না সংশোধন হচ্ছেন,আমি এমনই থাকবো।আমি এমন বেপোরোয়া লোকের ঘর করব না যে কিনা মাথা গরম থাকলে যা নয় তাই বলে অপমান করবে।আপনি ভালো থাকুন।আমার আরশাদের খেয়াল রাখবেন।যদিও আমি জানি আপনি তার খেয়াল রাখবেন।কারণ আপনি আর যাই হোক,দায়িত্বে অবহেলা করেন না।
নবনীতা লিখা শেষ করে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।রূপোলি চাঁদের আলোয় চারপাশ কি মনোরম দেখাচ্ছে!তারা যেই বাড়িটা ভাড়া নিয়েছে,সেটা লোকালয় থেকে একটু দূরে।সামনে একটা খোলা মাঠ।বাড়িটা বেশ পুরোনো,দেয়ালের রং খসে খসে পড়ছে।মোট চারটা ঘর।ভাড়া সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা।তারা থাকে দোতালায়।বাড়িটা নবনীতার ভালোই লাগে।কেমন একটা গ্রামীন ভাব আছে।মন্দ না,মানিয়ে নেওয়া যায়।
নবনীতা গ্রীলের সাথে মাথা ঠেকায়।একটু দূরেই মূল সড়ক,এখন অন্ধকারে ঢেকে আছে।রাস্তায় একটা হুন্ডা থামানো।হেড লাইট জ্বলছে।সেই আলো এখনো নবনীতার চোখে পড়েনি।
কালো রঙের বাইকে থাকা যুবক হেলমেটের আড়াল থেকে তাকে দেখে।সে এতো বেপরোয়া হচ্ছে কেন দিনকে দিন?এই রাতে শুধু একনজর মেয়েটাকে দেখার জন্য সে ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ ছুটে এসেছে।এই কাজ সে আগেও করেছে।রাতে সে কিছু সময় বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।এই খবর তার আগে থেকেই জানা।মেয়েটাকে দেখামাত্র তার স্নায়ু শান্ত হয়,শরীরের অস্থিরতা কেটে যায়।তার একে চাই চাই।যে করেই হোক,আবারো চাই।
সে গভীর চোখে একবার তাকে পরোখ করে।কিছু একটা চোখে পড়তেই দাঁতে দাঁত চেপে বিড়বিড় করে,’স্টুপিড! দুনিয়ার সব বুঝে।আর এই ঠান্ডার রাতে যে এমন পাতলা জামা পরে বারান্দায় দাঁড়ানো যায় না,সেটা বুঝে না?এখন একটা অসুখ বাঁধলে কি হবে?কে যত্ন করবে তার?বেয়াদব মেয়ে একটা!’
চলবে-