#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৫৭)
ঝড়ের বেগে ছুটতে ছুটতে গাঢ় নীল ল্যান্ড ক্রুজারটা মতিঝিলের অফিসে পৌঁছায়।গাড়ির চাকা পুরোপুরি থামার আগেই গাড়ির দরজা খুলে হন্তদন্ত পায়ে বেরিয়ে আসে শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত যুবক।তার অস্থির দৃষ্টি,ছুটে যাচ্ছে এখানে সেখানে।সে তাড়াতাড়ি নিজের ঘাম মুছল।শব্দ করে বড় বড় পা ফেলে মহানগর কার্যালয়ের ভেতরে প্রবেশ করল।
এসি চলছে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায়।এমনিতেও বাইরে ঠান্ডা।অথচ তা স্বত্বেও দরদর করে ঘামছে আরহাম।সে বড় করে দু’টো শ্বাস ছাড়ে।কি থেকে কি হয়েছে সে জানে না।কিচ্ছু জানে না সে।মাথার শিরা গুলো মনে হচ্ছে এখনো লাফাচ্ছে তার।ফোন হাতে নিতে গিয়ে সে টের পেল তার হাত জমে গেছে।কি আশ্চর্য বিষয়! শরীর ঘেমে একাকার,কিন্তু হাত পা ক্রমেই জমে যাচ্ছে।এমন হচ্ছে কেন?সে কাঁপা হাতে ডায়াল করল।
ঢামেকের রেজিস্টার্ড ডাক্তার ইউসুফ বিন জামান।যান্ত্রিক শব্দে ঘোর কাটতেই তিনি তাড়াতাড়ি ফোন রিসিভ করেন।ওপাশ থেকে গুরুগম্ভীর কিন্তু কিছুটা বিচলিত আর অস্থির কন্ঠ ভেসে আসে,
‘ইজ হি অ্যালাইভ অর নট?’
‘আপনি কে?কার কথা বলছেন?’ গলা খাকারি দিলেন ডাক্তার ইউসুফ।
অন্যপাশ থেকে শীতল গলায় জবাব আসে,’আমি শাহরিয়ার আরহাম।জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেটার বিষয়ে জানতে চাইছিলাম।’
নড়েচড়ে উঠেন ডাক্তার ইউসুফ।চোখে তার হতভম্ব ভাব।বিস্ময় কাটিয়ে কোনোরকমে একপাশে চেপে তিনি নিচু স্বরে বললেন,’নিলয় নাম যে তার কথা বলছেন?’
‘জ্বী।’
‘সে তো এখানে আসার আগেই মারা গেছে।ইনফ্যাক্ট রাতেই মারা গেছে।’
অন্যপাশ থেকে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা গেল না।আরহাম নিশ্চুপ।সে নিশ্চিত হয়েছে নিলয় নামের ছেলেটার মৃ’ত্যুর ব্যাপারে।এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃ’ত্যু তাকে কি পরিমান ভোগাবে সে জানে না।সে কোনো জবাব না দিয়ে ফোন কাটল।
নিজের দুইহাতে চুলগুলো টেনে ধরল আরহাম।দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত আর কিছু তার কাছে নেই।নিলয়ের লাশ কি হবে,কোথায় যাবে কিছুই তার জানা নেই।সামান্য ঝুকে কপালটা ডেস্কের সাথে ঠেকিয়ে সে শ্বাস টানে,দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।
‘ভাই আসবো?’
তোফায়েলের কন্ঠ।আরহাম মাথা না তুলেই থমথমে গলায় উত্তর দেয়,’আয়।জানো’য়ার টাকে সাথে এনেছিস?’
সে উত্তরের অপেক্ষা না করে মাথা তুলে।দুই হাত একসাথে করে গুটি গুটি পায়ে আবির এগিয়ে আসে।তার মস্তক নোয়ানো,শরীর সামান্য কাঁপছে,সে নিজেও ঘামছে ভীষণ।
আরহাম তাকে দেখামাত্রই উঠে দাঁড়ায়।এক প্রকার ছুটে গিয়ে তার কলার টেনে ধরে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে ঠাটিয়ে দু’ঘা বসায়।ক্রোধে খেই হারিয়ে বিকট শব্দে চেঁচায়,’কু’ত্তার বাচ্চা! তোকে এতো বড় সাহস কে দিয়েছে?তুই কোন সাহসে এই কাজ করেছিস?মানা করেছিলাম না যে ঐ নিলয় সংক্রান্ত কোনো ব্যাপারে যেন তোকে না দেখি।তবুও তুই কোন সাহসে ঐ কাজ করেছিস?’
বলতে বলতেই সে হাঁপিয়ে উঠে।সে বিধ্বস্ত,পুরোপুরি বিধ্বস্ত।এমন একটা দিন তাকে দেখতে হবে সেটা তার কল্পনাতীত।তার নির্লিপ্ততা,তার মৌন থাকাকে তার নিরব সম্মতি ভেবে ছেলেরা যা খুশি তাই করেছে।একটা নিষ্পাপ ছেলেকে নিছক ব্যক্তিগত আক্রোশের বশবর্তী হয়ে মারধর করে শীতের রাতে বয়েজ হোস্টেলের ছাদে ফেলে এসেছে।ছেলেটা মাঝরাতের গা কনকনে ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে জমে গেছে।দীর্ঘসময় সেই ঠান্ডা সহ্য করে অবশেষে তার শরীর পরাজয় মেনে নিয়েছে।গা হিম করা ঠান্ডা বাতাসে নিলয়ের স্নায়ু থেমে গেছে,বন্ধ হয়েছে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া।চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে হাইপোথার্মিয়া অর্থাৎ অত্যাধিক ঠান্ডায় মৃ’ত্যু।
মৃ’ত্যুর পর তাকে সবচেয়ে প্রথম দেখতে পায় হলের হাউস কিপার।সকালে ছাদের দরজা খুলতেই তিনি দেখেন ছাদের এক কোণায় রেলিং ঘেঁষে একটা ছেলে জড়োসড়ো হয়ে বসা।তার শরীরে কোনো হেলদোল নেই।মাথাটা হাঁটুর সাথে ঠেকানো।যতোটা সম্ভব নিজেকে গুটিয়ে রাখা অবয়বটি দেখতেই হাউস কিপার শামসুল ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে গেলেন।সামনে এসে কিছুটা নত হয়ে ডান হাত দিয়ে তাকে ডাকলেন।
বরফের মতো জমে যাওয়া শরীরটা স্পর্শ করতেই আপনাআপনি চোয়াল ঝুলে যায় শামসুলের।মুহূর্তেই ছিটকে দূরে সরে আসলেন তিনি।কি সাংঘাতিক!এতো শক্ত কেন তার শরীর?প্রথমেই যেই চিন্তাটা মাথায় আসলো,সেটা এক ঝাড়ায় মাথা থেকে সরালেন তিনি।শামসুল আবার এগিয়ে গেলেন।একটা শুকনো ঢোক গিলে কম্পমান হাতে ছেলেটার হাঁটুর উপর পড়ে থাকা হাত স্পর্শ করলেন।তার মনে হলো এটা কোনো হাত নয়,বরং একটা স্টিলের টুকরো।অত্যন্ত শীতল আর জড় পদার্থের মতো শক্ত।
আর্তচিৎকার দিকে কয়েক পা পিছিয়ে আসেন শামসুল।তার মাথা ঘুরছে,সমস্ত শরীর দুলছে।দুই হাত মাথায় চেপে তিনি চিৎকার ছুড়েন,’কে আছো এখানে?জলদি ছাদে এসো।দেখে যাও কি সর্বনাশ হয়েছে!’
পরের ঘটনা গুলো ঘটে গেল খুব জলদি।হল ভর্তি ছেলে সব ছাদে গিয়ে জড়ো হলো।হল প্রভোস্টকে জরুরি ভিত্তিতে ডাকা হলো ছাদে,পুলিশ কল করা হলো।পুলিশ এসেই সবাইকে সরাতে চাইলেন।বাঁধ সাধে বাকি ছাত্ররা।তারা সরবে না।আধঘন্টা তর্কাতর্কির পর নিলয়কে হাসপাতালে নিতে হবে আর মূল ঘটনার খোলাসা করতে হবে এই মর্মে পুলিশের হাতে নিলয়কে হস্তান্তর করা হলো।ঢাকা মেডিকেলে যাওয়ার পর কর্তৃব্যরত চিকিৎসক প্রথম দেখাতেই জানিয়ে দিলেন,’হি ইজ নো মোর।তিন ঘন্টা আগেই সে মারা গেছে।’
ডান গালে আরো একটা জোরাল চড় খেয়ে আবির ছিটকে পড়ে দেয়ালের দিকে।আরহাম হিংস্র শ্বাপদের মতো ছুটে যায় তাকে আরো এক দফা প্রহার করার জন্য।তার আগেই কোথা থেকে জালালুর রহমান দৌড়ে এসে তাকে জাপটে ধরলেন।জোর গলায় বললেন,’না আরহাম।ডোন্ট ডু দিস।থামো তুমি।’
আরহাম থামল না।জোর খাটিয়ে নিজেকে বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,’থামতে পারব না আঙ্কেল।লাই পেয়ে পেয়ে মাথায় উঠে গেছে এরা।কোন সাহসে এরা নিলয়কে মারধর করল?অনুমতি দিয়েছিলাম আমি?দিস ইজ টু মাচ।মারধর করল বুঝলাম।কিন্তু এই শীতের রাতে তাকে ছাদে দাঁড় করিয়ে রাখলো পানিশমেন্ট হিসেবে?এতো বড় কলিজা এদের হলো কীভাবে আমি দেখতে চাই।’
তার গর্জনে জালালুর রহমান মুখ খিঁচে নিলেন।তাকে পেছনের দিকে টানতে টানতে বললেন,’মাথা ঠান্ডা করো আরহাম।যা হওয়ার হয়ে গেছে।সবকিছু ঘেটে ফেলছ তুমি।একটু শান্ত হও।’
আরহামকে শান্ত করতে জালালুর রহমানের কিছুটা বেগ পেতে হলো।আজ প্রথমবার তার মনে হলো শেখ আজিজ পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে যান নি।তার সামনে বসে থাকা ছেলেটা কিঞ্চিৎ পরিমান হলেও বাবার মতাদর্শকে নিজের মাঝে ধারণ করে।এতোদিনের এতো মগজ ধোলাইয়ের পরেও আরহাম নিজের স্বকীয়তা হারায়নি।ধপ করে চেয়ারে বসেই সে একহাতে চুল টেনে বলল,’ছেলেটা মা’রা গেছে।আমি এটা সহ্য করতে পারছি না।না সে আমার বিরুদ্ধে কিছু করেছে,না সে আমার বিরুদ্ধে কিছু বলেছে।না সে কোনো সরকার বিরোধী কাজ করেছে।তাহলে কেন আমারই দলের ছেলেরা তাকে মারল?আমি হজম করতে পারছি না।আমি নিতে পারছি না।সারারাত ঠান্ডায় জমে একটা ছেলে মা’রা গেল।আমারই আসনে,আমারই দলের ছেলেরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে।আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।রাজনীতিতে ভালো কিছু নেই মানলাম।আমরাও কোনো সাধু সন্ন্যাসী না।তাই বলে আমরা তো কোনো পশুও না।এমন পাশ’বিক জন্তু জানো’য়ারের মত কাজ মানুষ কিভাবে করে?’
জালাল সাহেব বাঁকা চোখে তার অস্থির উদ্ভ্রান্ত আচরণ পরোখ করে।সে ঘামছে,তার কন্ঠ কাঁপছে।সেই কন্ঠে অনুতাপ আছে,সহানুভূতি আছে।এই সহানুভূতি জালালুর রহমানের জন্য সুখকর না।কিসের এতো দরদ?আরহাম কি এতো গুলো দিনেও নিজেকে মনুষ্যত্বের একেবারে নিম্নস্তরে নামাতে পারে নি?কি এমন শুভ শক্তি তাকে পরিবেষ্টন করে রেখেছে যেই শক্তির কাছে জালালুর রহমানের সব জল্পনা কল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে?আরহাম এতোটা মানবিক হচ্ছে কেন?অসম্ভব ভালো মানুষের সন্তান বলেই কি তার ভেতরটা এখনো পুরোপুরি কলুষিত হয়নি?
তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে আবিরকে দেখলেন।আবিরের সমস্ত মুখ রক্তিম,চোখ দু’টো টকটকে লাল,মুষ্টিবদ্ধ হাত একটু একটু কাঁপছে।অপমানে তার মস্তক নত।ঘরভর্তি মানুষের সামনে ভাই তাকে এভাবে মেরেছে?সে কি কোনো ছাপোষা নাকি?তার বাবারও যথেষ্ট নাম ডাক আছে।এমন সবার সামনে চড় খাওয়ার মতো নগন্য কীট সে না।
জালালুর রহমান ঘন ঘন শ্বাস ফেলে পুনরায় আরহামের দিকে মনোনিবেশ করলেন।
‘আরহাম একটু পর সাংবাদিক রা তোমার অফিস ঘিরে ফেলবে।তোমাকে একটা বক্তব্য অবশ্যই রাখতে হবে এই ঘটনা নিয়ে।তুমি কি সেটা নিয়ে কিছু ভেবেছ?’
আরহাম ঘোলাটে চোখে সামনে তাকায়।কন্ঠে সমস্ত ক্রোধ উগড়ে দিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’ভাবার কি আছে?বলব এই জানো’য়ার গুলোকে জেলে পুরে রাখতে।এরা সাধারণ মানুষের জন্য বিপজ্জনক।এরা খাঁচাতেই সুন্দর।’
‘আহা,র্যাশনালি চিন্তা করো আরহাম।হঠকারিতা করো না।’
‘পারব না র্যাশনালি চিন্তা করতে।মাথা কাজ করছে না আমার।মন চাইছে সবগুলো কে গু’লি করে মা’রতে।’
জালালুর রহমান আলতো করে তার একটা হাত আরহামের কাঁধে রাখলেন।আরহাম যেন নড়ে উঠল সামান্য,তবে পাশ ফিরল না।
নিরবতা ছাপিয়ে তিনি ভরাট গলায় বললেন,’তুমি ক্যামেরার সামনে বলবে নিলয়ের মৃ’ত্যু সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক।শীতে না,বরং হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে সে।’
চকিতে মাথা তুলে আরহাম।বিস্ফারিত,অবিশ্বাস্য চোখে পাশ ফিরে এক প্রকার চেঁচিয়ে উঠে,’কি?’
‘শান্ত হও।যা বলছি,ভেবে চিন্তেই বলছি।এতে তোমারই লাভ।’
এক ঝাড়ায় নিজের কাঁধ ছাড়ায় আরহাম।জালালুর রহমান লক্ষ্য করলেন তার হিংস্র মুখটা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আরো বেশি ভয়ংকর দেখাচ্ছে।সে গর্জন করে উঠে,’পা’গল নাকি?এতোটা স্বার্থপর হতে পারব না আঙ্কেল।একেবারে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার একটা খু’নকে আমি কিছুতেই নরমাল ডেথ বলতে পারব না।পাবলিক কি অন্ধ নাকি?তারা কি গাঁ’জা খায়?এসব করে আমি নিজেরই ভাবমূর্তি নষ্ট করব।’
‘আর এসব না করলে তুমি নিজেই নিজের তরী ডুবাবে।তুমি যদি এটাকে নেহাৎ স্বাভাবিক মৃত্যু বলে না আখ্যা দাও,তারপর এ জাতীয় সমস্ত তদন্ততে তোমাকে সম্মতি দিতে হবে।’
‘হ্যাঁ,তো দিব।সমস্যা কি?’
জালালুর রহমান ভড়কে গেলেন ভীষণ।তড়িঘড়ি করে বললেন,’না।এতে তোমারই বিপদ আরহাম।তোমার দলের লোকরাই তোমার বিরুদ্ধে যাবে।তুমি এটা করতে পারো না আরহাম।রাজনীতিতে তোমার একার সিদ্ধান্ত বলে কিছু নাই।যেহেতু দলের হয়ে মনোনীত হয়েছ,তাই দলের প্রতি তোমার দায়বদ্ধতা আছে।’
দুই হাতে মুখ চেপে আবারো মাথা নামায় আরহাম।নুয়ানো মস্তকেই কোনোরকম ক্ষীণ স্বরে বলে-‘ভালো হচ্ছে না আঙ্কেল।বিষয়টা একদমই ভালো হচ্ছে না।’
জালাল সাহেব তার পিঠে হাত বুলায়।তাকে ভরসা দেওয়ার ভঙ্গিতে বলে,’হতাশ হয়ো না আরহাম।যেভাবে বলছি সেভাবে করো।দেখবে ভালোই হবে।তাছাড়া নিলয় কে তো কেউ জেনেবুঝে মারেনি।এমন পানিশমেন্ট তো কত ছেলেই পায়।কেউ কি ওমনভাবে মরে যায়?নিশ্চিত নিলয়ের অন্য কোনো সমস্যা ছিল আগে থেকে।’
আরহাম উত্তর দেয় না।তার বুক ধড়ফড় করছে।প্রভার মুখটা মনে পড়ছে।প্রভা সেদিন তার অফিসে এসেছিল।হাতে লাড্ডুর প্যাকেট।বলছিল নিলয়কে নাকি সে বিয়ে করবে।এই কথা নাকি সে কেবল আরহামকে জানিয়েছে,আর কাউকে না।আরহাম জানতে চাইল,’কেন কেন?আমিই কেন?’
প্রভা হাসল।লাজুক মুখে বলল,’ভাইয়া।আপনি ছাড়া তো এমন অভিভাবক শ্রেণির আর কাউকে আমি চিনি না।আপনি আমার কথায় ঐ ছেলেদের ধমক দেওয়াতেই তো নিলয়কে তারা জ্বালাতন করা বন্ধ করেছে।তাই শুধু আপনাকেই জানালাম।দোয়া করবেন ভাইয়া।’
‘আমার দোয়ায় কাজ হবে?’ সরু চোখে প্রশ্ন করে সে।
প্রভাতি জোরে জোরে মাথা নাড়ে,’অবশ্যই হবে।কেন হবে না?সাফ মনে দোয়া করলে সব দোয়াই কবুল হয় ভাইয়া।’
‘মন টাই তো সাফ না প্রভা।’
‘জ্বী ভাইয়া?বুঝিনি।’
আরহাম দ্রুত মাথা নাড়ল,’না না কিছু না।’
বুকের সূক্ষ্ম যন্ত্রণায় তার ঘোর কাটে।বাস্তবে ফিরতেই তার যন্ত্রণা আরো বাড়ল।প্রভার আশা পূরণ হয়নি।আরহাম কিভাবে তার মুখোমুখি দাঁড়াবে?কিভাবে সে স্পষ্ট খু’নকে স্বাভাবিক মৃ’ত্যুর তকমা দিয়ে ধামাচাপা দিবে?
পরীর মুখটা আচমকাই মনসপটে ভেসে উঠে।আঁতকে উঠে চোখ খুলে আরহাম।অজান্তেই একহাত বুকে গিয়ে ঠেকে।পরীর সাথে একটু কথা বলতে পারলে ভালো হতো।সে দ্রুত পকেট হাতড়ায়।ব্যস্ত হয়ে বলে,’আমাকে একটা ফোন করতে হবে এখুনি।’
জালালুর রহমান শক্ত করে তার হাতটা চেপে ধরলেন।জানালার কাঁচ গলিয়ে সামনে দেখতে দেখতে বললেন,’এখন না।নিউজ রিপোর্টার রা সবাই চলে এসেছে।পরে ফোন করবে।’
.
.
.
.
হাসপাতালের খোলা করিডোরে আজ ভীষণ ভীড়।অন্যান্য দিনের তুলনায় লোকসংখ্যা চোখে পড়ার মতো বেশি।এদের সবাই কাছাকাছি বয়সের,বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া।সবার মৃদু গুঞ্জনে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছে।করিডোরের একেবারে মাঝামাঝি অবস্থানে একটি স্ট্রেচার,স্ট্রেচারে শোয়ানো একটা মৃ’তদেহ।
ডাক্তার ইউসুফ মৃ’তের ফাইল ঘেটে জানতে চাইলেন,’এই ছেলেটার কি কোনো গার্ডিয়ান নেই?লাশ হস্তান্তর করার জন্য তো অভিভাবকের সাক্ষর লাগবে।অথচ এখনও তো কেউ আসে নি।’
সোনালী পাড়ের গাঢ় লাল কাতান শাড়ির আঁচল মেঝেতে গড়াচ্ছে।কোনোরকমে বুকের কাছটা ঠিক করে একহাতে কুচি চেপে সে উন্মাদের মতো ছুটে যায় হাসপাতালের মূল ফটকের দিকে।মানুষজন সব ঘুরে ঘুরে তাকে দেখল।তার চোখ ভেজা।কাজল লেপ্টে তাকে কেমন ভয়ানক দেখাচ্ছে।ছুটতে ছুটতেই সে কয়েক দফা ফুপিয়ে উঠে।
করিডোরে এসেই আচানক তার পা থামল।এমন ভাবে থামল যে তার চলার শক্তিটুকু ফুরিয়ে গেল।মনে হচ্ছে আর সামনে এক পা বাড়ালেই সে মুখ থুবড়ে পড়বে।তার কন্ঠরোধ হয়ে আসে,শ্বাস প্রশ্বাস থেমে যাওয়ার উপক্রম।নিজের হৃদস্পন্দন নিজেই শুনতে পায় সে।মুহূর্তেই অক্ষিকোটর ভরে উঠে নোনা জলে।
বিধ্বস্ত,এলোমেলো আর ভঙ্গুর পায়ে প্রভাতি সামনে এগিয়ে আসে।তার পা কাঁপছে,সমস্ত শরীর ঝংকার তুলে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার মতোন অবস্থা।চোখ ঝাপসা হচ্ছে বারবার।ঘোলা চোখে সে সামনে থাকা স্ট্রেচারটা দেখে।তার সাহস হচ্ছে না ঐটুকু পথ পাড়ি দিয়ে মৃ’তদেহর মুখের উপর থেকে কাপড় সরাতে।কাপড় সরানোর পরের দৃশ্যটুকু সে সহ্য করতে পারবে তো?
প্রভার কষ্ট করতে হয়নি।আচানক বাতাসের দাপটে নিথর হয়ে পড়ে থাকা দেহের উপর থেকে কাপড় সরল।দৃশ্যমান হলো নিলয়ের নীল হয়ে যাওয়া হেলদোল বিহীন দেহ।তার সমস্ত শরীর নীল,রক্ত জমাট বেঁধে গেছে।ঠোঁট উল্টানো।চোখ অল্প খোলা।প্রভাতি চোখ বন্ধ করে সঙ্গে সঙ্গে।কি বিভৎস দৃশ্য।
সময় গড়ায়।হঠাৎই সব ভুলে সে ছুটে যায় মুর্তির মতো শুয়ে থাকা মানবশরীর টার দিকে।গিয়েই লুটিয়ে পড়ে তার জীর্ণ বক্ষে।সেই প্রথম যখন তাকে জড়িয়ে ধরেছিল,ঠিক তেমন ভাবে।কাঠের তক্তার মতো শক্ত বক্ষে মাথা রেখেই সে হাউমাউ করে উঠে।তার চোখের বাঁধ খুলেছে।ঝরঝর করে নোনাজল তার গাল বেয়ে নেমে আসছে।কান্নার দরুন তার শ্বাসরোধ হয়ে আসছে।তার চোখের পানি নিলয়ের বুক ভাসাচ্ছে।ঐ সেদিন যেমন ভাসিয়েছিল,ঠিক তেমন।কিন্তু সেদিনের মতো আজ আর কেউ আলতো হাতে তাকে জড়িয়ে ধরল না।বলল না,’প্রভা কি করছ এসব?এতো মানুষের সামনে কেউ এমন করে?’
প্রভা নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে।তার আর্তনাদ,আহাজারি আর গগনবিদারী চিৎকারে করিডোরের পরিবেশ থমথমে হয়ে উঠেছে।প্রভা মানুষের দিকে তাকালো না।সে তার বন্ধন আরো গাঢ় করে।মাথাটা শক্ত করে নিলয়ের বুকের সাথে চেপে ধরে রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে বলে,’নিলয়! তুমি এভাবে কথার খেলাপ করতে পারো না নিলয়।এতো স্বপ্ন দেখিয়ে তুমি এভাবে চলে যেতে পারো না।তুমি কেন এভাবে আমায় মেরে ফেলছ নিলয়?একবার চোখ খুলো।আমাকে এমন অন্তহীন অপেক্ষায় রেখে তুমি চলে যেতে পারো না।এই দেখো,আমি তোমার দেওয়া শাড়ি পরেছি।তুমি এভাবে এই অবস্থায় চলে যেতে পারো না নিলয়।কাউকে এমন মরণযন্ত্রনা দেওয়ার অধিকার তোমার নেই।তুমি দয়া করো আমায়,একটু রহম করো নিলয়।এতো জঘন্যভাবে তোমার জীবন শেষ হতে পারে না।আল্লাহ! এই দুঃখ আমি কিভাবে সহ্য করব?’
প্রভাতি চোখ তুলে।নিলয়ের গালে একটা কালচে দাগ।মেরেছে নিশ্চয়ই।ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে তার।আলতো হাতে সেই আঘাতটুকু ছুঁয়ে দিলো প্রভা।এই শেষ দেখা।আর কোনোদিন তাদের দেখা হবে না।কোনোদিন না।প্রভার সমস্ত শরীর অদ্ভুতভাবে কেঁপে ওঠে।তার চারপাশ কেমন ঘোলা আর অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগে সে শেষ একবার নিলয়ের মুখটা দেখে।নিভু নিভু চোখে অস্পষ্ট বুলি আওড়ায়,’বিদায় নিলয়।আমাদের আর কোনোদিনও দেখা হবে না।তুমি ভালো থেকো তোমার পরবর্তী জীবনে।মরে গিয়ে বোধহয় তুমি বেঁচেই গেছ।আমি আর বাঁচলাম কোথায়?’
চলবে-
#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৫৮)
[একটা কাজ আছে বলে রিচেক দেইনি।রাতে বাড়ি ফিরে রিচেক দিবো।আপাতত একটু কষ্ট করুন।]
আরহামের গাড়িটা হাসপাতালে মূল ফটকে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেলা ঘনায়।হাসপাতাল তখনো লোকে লোকারণ্য।একটা মানুষও যায়নি।পোস্টমর্টেম নিয়ে কিছুক্ষণ আগে অথোরিটি আর সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছিল।সেই ঝামেলার মিটমাট হয়েছে।নিলয়ের লা’শ ম’র্গে পাঠানো হয়েছে।সেখানে তার শরীর কেটে কুটে ছি’ন্নভি’ন্ন করা হবে।তারপর একটা পূর্ব পরিকল্পিত রিপোর্ট বেরিয়ে আসবে যেখানে লিখা থাকবে অপমৃ’ত্যু নয়,বরং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া ব্যাহত হয়ে খুবই স্বাভাবিক মৃ’ত্যু হয়েছে তার।তারপর সবকিছু এক নিমিষেই ঠান্ডা হয়ে যাবে,চাপা পড়ে যাবে নিলয়ের নিদারুণ আর্ত’নাদ,চাপা পড়ে যাবে সমস্ত অন্যায়।
প্রভাতি ফ্লোরে বসেছিল।তার চোখের দৃষ্টি ভীষণ শান্ত।দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দুই পা গুটিয়ে নিয়েছে সে।মাথাটা হাঁটুর উপর ফেলে রাখা।দুই হাতে পা দু’টো চেপে ধরেছে।চোখ দু’টো এখন আর ভিজে নেই।বরং শুকিয়ে কটকট করছে।টকটকে লাল নেত্রযুগল অবশ্য জানান দিচ্ছে যে একটু আগেও সে হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে।ছেলে বুড়ো থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডাক্তার নার্স সবাই যেতে যেতে একনজর চোখ বাঁকা করে তাকে দেখল।তবে কেউ এগিয়ে এসে কিছু জানতে চাইল না।
আরহাম তার লোকবল নিয়ে হাসপাতালে আসতেই চারপাশ থেকে সব সরে দাঁড়ায়।প্রভাতি সবার আগে তার পা দেখে।খুব বড় বড় পা ফেলে সে সামনের দিকে হেঁটে আসছে।সাথে সাথে মাথা তুলে সে।দেখতে পায় অত্যন্ত নির্বিকার চিত্তে আরহাম সামনে এগিয়ে আসছে।তবে তাকে একেবারেই ভাবলেশহীন মনে হচ্ছে না।তার দৃষ্টি অস্পষ্ট।একটা চাপা আতঙ্কে তার মুখ আধার দেখাচ্ছে।
প্রভাতি সাথে সাথে উঠে দাঁড়ায়।বড় করে একটা শ্বাস ছেড়ে তীব্র বেগে তার দিকে ছুটে যায়।তাকে দেখতেই আরহামের পা থামল।সে নিজেও থমকে গেল।শুকনো একটা ঢোক গিলে সে প্রভাতির দিকে চোখ মেলল।
প্রভাতি তার সামনে এসেই পুনরায় কান্নায় ভেঙে পড়ল।দ্রুত চোখ মুছে নিয়ে বাচ্চাদের মতোন অসহায় গলায় বলল,’ভাইয়া ওরা নিলয়কে মে’রে ফেলেছে ভাইয়া।সত্যি সত্যি মে’রে ফেলেছে।’
তার রক্তিম বিধ্বস্ত মুখটা দেখতেই আরহাম একেবারে দমে গেল।দপদপ করে জ্বলতে থাকা প্রদীপটা যেমন করে নিভে যায়,সেও ঠিক তেমন করে নিভে গেল।ভেতরটা কেমন অস্থির লাগছে।সে আসতেই পুনরায় সেখানে একটা জটলা বাঁধলো।
ঈষৎ কাঁপা হাতটা প্রভাতির মাথায় রাখে আরহাম।আপাতত এইটুকু সান্ত্বনাই সে তাকে দিতে পারে।প্রভাতি মাথা নামিয়ে নেয়।নাক টেনে বলে,’আপনি দয়া করে এদের এমন শাস্তি দিন যে আর কাউকে যেন নিলয়ের মতো করে মর’তে না হয়।’
আরহাম স্থির চোখে তাকে দেখল।আস্তে করে তার মাথা থেকে নিজের হাত সরিয়ে নিল।তার কন্ঠ খচখচ করছে।একবার কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে একেবারে ঠান্ডা স্বরে সে বলল,’কাকে শাস্তি দিব?আগে তো এটা প্রমাণ হতে হবে যে নিলয় কে খু’ন করা হয়েছে।তার আগে কিভাবে কাউকে শাস্তি দিব?’
প্রভাতি হতবাক হয়ে তাকে দেখে।তার ফ্যালফ্যাল চোখের দৃষ্টিতে আরহাম অপ্রস্তুত হয়ে উঠে।প্রভাতি চোখের দৃষ্টি এমন রেখেই বলল,’আপনি এসব কি বলছেন ভাইয়া?প্রমাণ মানে?ঐ আবির আর তার বন্ধু বান্ধবরা তাকে মেরে ছাদে রেখে এসেছে।বলেছে সারারাত ছাদে দাঁড়িয়ে থাকতে।তার আগে তারা তাকে মেরেছে।এতো যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরেই সে,,’
প্রভাতি আর কথা শেষ করতে পারল না।তার আগেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।পরের কথা সে আর বলতে পারবে না।তার মুখ দিয়ে সে কথা বের হতে চায় না।বলতে গেলেও বারবার থেমে যায় সে।
আরহাম সোজা সটান হয়ে দাঁড়ায়।দুই হাত বুকে ভাঁজ করা।মুখোভঙ্গি বোঝা মুশকিল।অবশেষে কিছুটা নমনীয়,কিছুটা দৃঢ় কন্ঠে সে জবাব দিলো,’আমার মনে হয় না শীতের কারণে তার কোনো সমস্যা হয়েছে।যতটুকু মনে হচ্ছে,তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে।শীতে সে কেনো মরবে?স্টেশনে ফুটপাতে যারা থাকে তারা কি মরে যাচ্ছে নাকি?নিলয়ের মৃত্যু আমার স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে প্রভা।’
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে আরহামের মনে হলো তার কন্ঠরোধ হয়ে আসছে।গলা ছিঁড়ে যাচ্ছে,তবুও সে একটানে পুরো কথা শেষ করল।শেষ করেই আর কোনোদিক না দেখে সে মর্গের দিকে এগিয়ে যায়।সে জানে প্রভাতির কাছে তার ভাবমূর্তি পুরোপুরি ভাবে নষ্ট করে দিয়েছে সে।যেই চোখে প্রভাতি তার জন্য অনেক বেশি সম্মান আর ভালোবাসা ধরে রেখেছিল,সেই চোখ দু’টো এখন পূর্ণ হবে সীমাহীন ঘৃণা আর বিতৃষ্ণায়।আরহাম সচক্ষে সেই ঘৃণা দেখতে চায় না।প্রভাতির ফ্যাকাশে,পরাজিত মুখটা সে আর কখনোই দেখতে চায় না।প্রভাতি তাকে বীরপুরুষ ভাবতো।সে তো কোনো বীরপুরুষ না।প্রভাতির ভুল ভেঙেছে।এখন তার মুখোমুখি হতেও আরহামের অস্বস্তি হচ্ছে।সে একটা তপ্ত শ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে যায়।আচ্ছা আজ হঠাৎ বুকটা এতো পোড়াচ্ছে কেন?
.
.
.
.
সব ঝায় ঝামেলা শেষ করে আরহাম বাড়ি ফিরল রাত দশটায়।সদর দরজা পেরিয়ে সে এক পা সামনে দিতে না দিতেই দোতালার সিঁড়ির পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা চেঁচিয়ে উঠল,’এসব কি আরহাম?’
আরহাম চোখ তুলে।শান্ত চোখে নবনীতার থমথমে কাঠিন্যে ভরা মুখটা দেখে।সব জেনেও না জানার ভান ধরল সে।আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি মানে?কি হয়েছে আবার?’
নবনীতা ধুপধাপ পায়ে সিঁড়ি ভাঙে।একপ্রকার ছুটে যায় তার দিকে।মুখোমুখি হতেই দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’আপনি জানেন না কি?আপনি আজ এসব কি বলেছেন?আপনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’
আরহাম হাত বাড়িয়ে আলতো করে তার কাঁধ চেপে তাকে নিজের সামনে দেখে সরায়।খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,’যাও সরো তো।রোজ রোজ এসব ভালো লাগে না।রেস্ট করব আমি।’
সে আরো দুই পা সামনে যেতেই নবনীতা অকস্মাৎ উঁচু স্বরে চেঁচায়,’আরহাম!!’
আরহাম ঘুরে দাঁড়ায়।হতবাক হয়ে বলে,’পাগল তুমি?এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন?’
‘চেঁচাবো না?আপনি এসব কি করেছেন?বাড়াবাড়িরও একটা সীমা থাকে আরহাম।’
‘কি করেছি আমি?শীতের রাতে এক ছেলে ম’রে গেছে।তাতে আমার কি করার আছে?’
‘ম’রে গেছে মানে?’ চোখ ভিজে উঠল নবনীতার।
‘বলুন মে রে ফেলেছে।একটা দেশে আইনকানুন থাকার পরেও কি করে ছেলেরা এমন দুঃসাহস দেখাতে পারে?আপনাকে আগেই বলেছিলাম এদের লাই দিবেন না।আপনি শুনেন নি আমার কথা।’
‘চুপ থাকো তো তুমি।সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান ভালো লাগে না।’
নবনীতা আশ্চর্য হয়।ব্যথিত চোখে সামনে দেখে বলে,’আপনি এতো খারাপ?এতোদিন ধরে আমি আপনার ঘর করছি?’
কথাটা আরহামের গায়ে লাগল ভীষণ।সে এগিয়ে এসে দুই হাতে নবনীতার কাঁধ চেপে ধরল।দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’কি সমস্যা তোমার?তোমার কোন ক্ষতি করেছি আমি?’
এক ঝাড়ায় নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নবনীতা।খানিকটা চেঁচিয়ে উঠে বলে,’আমাকে স্বর্গে রেখে মানুষকে ন’রকের দিকে ঠেলে দেওয়ার কি মানে?এমন সংসার আমি চাই নি।এমন সুখ আমি চাই নি।আমি সুখে আছি বলে কি আমি বাকিদের টা দেখব না?আপনি দিন দিন জঘন্য হয়ে যাচ্ছেন আরহাম।’
আরহাম আবারো তার দুই কাঁধ চেপে ধরল।প্রচন্ড রাগে তার মুখ রক্তিম দেখাচ্ছে।চোখ দু’টো আগুনের ফুলকির মতো জ্বলে আবার নিভে যাচ্ছে দপ করে।তার হিংস্র মুখটা দেখেই নবনীতার চোখ ছলছল করে উঠল।সে ভাঙা গলায় বলল,’একবার আয়নায় নিজের মুখটা দেখুন।দেখুন কতোটা জঘন্য দেখাচ্ছে আপনাকে।’
‘আমি তো জঘন্যই।এখন তো আমাকে জঘন্য লাগবেই।বিয়ের অনেক দিন হয়ে গেছে না?এখন তো আর আমাকে ভালো লাগবে না।এক মানুষ কে তো আবার তোমাদের বেশি দিন ভালো লাগে না।’
নবনীতা চমকে তার দিকে তাকায়।সে কি বলল এটা?কি বলল এখন?সে কি বোঝাতে চাইল নবনীতা দ্বিচারিতা?সে অস্ফুটস্বরে আবারো জানতে চায়,’কি বললেন আপনি?’
আরহাম গজরাতে গজরাতে বললো,’কেন তুমি শুনো নি?’
সে আর কথা বাড়ালো না।শুধু নিজেদের দুরত্ব খানিকটা কমিয়ে জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখ মেলে বলল,’আমায় রাগাবে না পরী।বউ আছো বউয়ের মতো থাকো।বেশি বাড় বাড়বে না বলে দিলাম।আমার রাজনৈতিক জীবন আমায় বুঝতে দাও।তুমি ঘরের জিনিস,ঘর নিয়েই ভাবো।’
সে থামল।চোখ তুলে নবনীতার মুখ দেখার আগেই সপাটে একটা চড় এসে পড়ল তার গালে।আরহাম হতভম্ব হয়ে সামনে তাকায়।দেখে নবনীতার ঘৃণাভরা দৃষ্টি তারই উপর নিবদ্ধ।সে তাকাতেই নবনীতা চেঁচিয়ে উঠে,’সহ্যের সীমা থাকে আরহাম।আপনি সব সীমা লঙ্ঘন করে ফেলছেন।বউ আমি,কোনো পুতুল নই।’
সে চোখ মুছে আরো কিছু বলল।আরহাম শুনলো না।তার হতভম্ব দৃষ্টি তখনো নবনীতার দিকে।স্তব্ধ হয়ে একহাতে নিজের গাল ছোঁয় সে।পরী তাকে চড় মেরেছে?সে আড়চোখে রান্নাঘরের দিকে দেখে।রহিমা আর আফরোজা বেগম মাথা বের করে গোল গোল চোখ করে তাকে দেখছে।তার একরোখা,জেদি আর গোয়ার পুরুষালী স্বত্তাটি এই অপমান নিতে পারল না।বউ তাকে চড় মারবে?তাও আবার বাড়ির মেইডদের সামনে?
সে দাঁতে দাঁত চেপে সামনে এগিয়ে যায়।একটানে নবনীতাকে তার কাছে এসে ডান হাতে তার দুই গাল চেপে ধরে।ক্রোধে ফেটে পড়ে চেঁচিয়ে উঠে,’একদম মেরে ফেলব আমার সাথে এমন আচরণ করলে।আমায় চড় মারো কোন সাহসে তুমি?তোমার চাকর লাগি আমি?আমার খাও,আমার পরো,আবার আমার সাথেই এমন বেয়াদবি করো।’
তার হাতের চাপে নবনীতার গাল ভেঙে এলো।সে দুই হাতে আরহামের হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে চিৎকার করে উঠল,’ছাড়ুন।বাড়িভর্তি মানুষের সামনে সিনক্রিয়েট করবেন না।’
‘আমি সিনক্রিয়েট করছি?তুমি শুরু করেছ এসব।খাইয়ে পরিয়ে আদর সোহাগ দিয়ে তোমার সাহস বাড়িয়েছি আমি।ডানা গজিয়েছে তাই না?ডানা সব ছেটে দিবো বলে দিলাম।’
দু’জনের উচ্চবাচ্যে আদি আর আরিশ দৌড়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে।তাসনুভার ঘুম ভেঙেছে একটু আগে।সে তড়িঘড়ি করে হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে ঘরের বাইরে আসতেই সামনের দৃশ্য দেখে থমকে গেল।নবনীতা তার একহাত দিয়ে পুনরায় সজোরে চড় বসালো আরহামের গালে।সেই শব্দ দেয়ালে দেয়ালে বাড়ি খেয়ে একেবারে আরহামের কানের কাছে এসে ঠিকরে পড়লো।
আরিশ সঙ্গে সঙ্গে একহাত মুখে চেপে ধরে।ভয়াতুর চোখে দুই কদম এগিয়ে ভাইয়ের মুখটা দেখার চেষ্টা করে।আরহামের চোয়াল ঝুলে গেছে।তার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম।পরী তাকে এভাবে সবার সামনে চড় মারছে?এতো বড়ো স্পর্ধা সে কি করে দেখাচ্ছে?আরহাম কে কি তার খুব সুপুরুষ মনে হয়?
সে খেই হারালো।খেই হারিয়ে যা করার ঠিক তাই করল।সেকেন্ডের মাথায় তার দুই হাত নবনীতার গলা চেপে ধরে।ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে সে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’একদম জানে মেরে ফেলব যদি এতো বড় সাহস আর দেখিয়েছ তো।কোন সাহসে চড় মারছ তুমি?এতো গায়ের জোর আসে কোথা থেকে?চলো তো আমার টাকাতেই।নিজের তো কোনো মুরদ নাই।’
নবনীতার শ্বাসরোধ হয়ে আসে।কথা সব জড়িয়ে গিয়ে গলার কাছে এসে থেমে যায়।সে টেনে একবার শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল।চোখ দু’টো তার পানিতে টইটম্বুর।মানুষ এতো হিংস্র হয়?এতো হিংস্র মানুষের পক্ষে হওয়া সম্ভব?সে না তার স্ত্রী?তাকে না সে ভালোবাসে?
আদি কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল।হুশ হতেই দিগবিদিক ভুলে ছুটে গেল।দুই হাতে আরহামের হাত ছাড়াতে ছাড়াতে চেঁচিয়ে উঠে বলল,’গলা ছাড় আরহাম।এখনি ছাড়।পাগল নাকি তুই?ছাড় বলছি।’
সে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে টেনে আরহামের হাত দু’টো নিজের হাতের দখলে নেয়।আরহাম তখনও সামনে দেখতে দেখতে চেঁচিয়ে যাচ্ছে,’বেঈমানের জাত! কি দেই নি আমি তাকে?তার পরিবারকে পর্যন্ত আমি চালাচ্ছি।তার এক পয়সার রুজি আছে যে এতো বড় বড় কথা বলছে আমার সাথে?কি যোগ্যতা আছে তার শুনি?’
সঙ্গে সঙ্গে নবনীতার দুই চোখ ভরে উঠল।নোনা জলে চিকচিক করতে থাকা অক্ষিকোটরের দিকে দেখেই তাসনুভার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল।ভাবির চোখ,তার চোখের এই দৃষ্টি ভীষণ অচেনা ঠেকল তার কাছে।ভাবি কি কখনো এমন করে ভাইয়াকে দেখেছে?এই চাহনির কোথাও কি ভাইয়ার জন্য তার ভালোবাসা অবশিষ্ট আছে?
নবনীতা কান্নাটুকু গিলে কিছু একটা বলার জন্য এগিয়ে এলো।তার আগেই আরহাম সমস্ত গায়ের জোর দিয়ে তাকে একটা ঝাক্কা দিলো।সঙ্গে সঙ্গে ছিটকে সে টি টেবিলের উপর গিয়ে পড়ল।তাসনুভা চিৎকার করে উঠল,’ভাবি!’
তাল হারিয়ে ফেলা শরীরটা আছড়ে পড়ল টি টেবিলের উপর।মাথাটা গিয়ে ঠেকল একেবারে টেবিলের কোণায়।সে স্তব্ধ,হতভম্ব।মুখ দিয়ে কথা বলার মতো কোনো শক্তি নেই।
আদি চিৎকার করে উঠল,’আরহাম! আর ইউ সিক?পাগল হয়েছিস তুই?’
আরহাম সেই কথা গায়ে মাখল না।উল্টো বাজখাঁই গলায় চেঁচিয়ে উঠল,’আমি ঠিকই আছি।এতোদিন ঠিক ছিলাম না।যাকে তাকে মাথায় তুলে রেখেছিলাম।যার জায়গা যেখানে তাকে সেখানে রাখা উচিত।এর জায়গা এখানেই।আমার পায়ের কাছে।’
বলেই সে আদির দুই হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।হাঁটু মুড়ে সামান্য ঝুঁকে নবনীতার মুখোমুখি হয়ে বলে,’এ্যাই পরী! তোমার কি যোগ্যতা আছে শুনি?এক টাকাও তো কামাই করো না।চলো তো সব বরের টাকায়।এই শাড়ি,এই গয়না,এই আভিজাত্য সব তো আমার বদৌলতেই পেয়েছ।তোমার কি যোগ্যতা আছে আমার বউ হওয়ার শুনি?’
সে একহাতে নবনীতার গলার নেকলেসটা টেনে ধরল।তাচ্ছিল্য করে বলল,’দুই লক্ষ ছাপ্পান্ন হাজার টাকা দাম পড়েছে এটার।এই ছয় বছরে কোনোদিন একসাথে এতো টাকা দেখেছ?’
নবনীতা নিশ্চুপ,নিরুদ্বেগ।একবার চোখ তুলে তাকালো পর্যন্ত না।যেভাবে আরহাম তাকে ছুড়ে মেরেছে,সেভাবেই বসে থাকল।কপাল কেটে গলগল করে চটচটে তরল গড়াচ্ছে একপাশ ঘেঁষে।সে বসে আছে একটা পুতুলের মতো।না পলক ফেলছে,না কিঞ্চিৎ নড়ছে।
আরিশ গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসে।মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতেই দেখে ভাবির কোলের উপর রাখা হাত দু’টোতে একটু পর পর টপটপ করে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি পড়ছে।তার মায়া হলো ভীষণ।ভাবি তাদের কতোখানি ভালোবাসে সেটা সে আর তাসনুভার চেয়ে ভালো কে বুঝে?সে জড়ানো গলায় কিছুটা অনুরোধ করে বলল,’প্লিজ ভাইয়া।দয়া করে থামো।ভালো লাগছে না আমার।’
আরহাম খেঁকিয়ে উঠল,’কেন থামব?কি করিনি আমি তার জন্য?তার মামা আমার কি লাগে?তবুও তাদের সব খরচা দিচ্ছি না?তার মনের শখ পূরণের জন্য কি না করেছি আমি?আরশাদ কে পর্যন্ত এডোপ্ট করেছি।আরশাদ আমার কি লাগে?তাও তাকে নিজের ছেলের পরিচয় দিয়েছি।কি না করেছি তার মন ভালো করার জন্য?নিজের খামখেয়ালি তে সে আমার বাচ্চাটাকে মে’রে ফেলেছে।তবুও তো কোনোদিন খোঁটা দেইনি।কোনোদিন কটু কথা বলিনি। বিয়ের এতোগুলা দিনে সে বলতে পারবে যে তাকে কোনোদিন ফুলের টোকা দিয়েছি?তাকে অতিরিক্ত ভালোবেসেছি তো,তাই মূল্য দিতে শিখেনি।আসলে যোগ্যতার চেয়ে বেশি কিছু মানুষ ডিজার্ভই করে না।পায়ের জিনিস তুলে এনে জোর করে মাথায় বসিয়ে দিলেই তো হয় না।মাথায় থাকার মুরোদও তো থাকতে হয় নাকি?’
নবনীতা মাথা নামিয়েই ফিচেল হাসল।তার সত্যি সত্যি হাসি পাচ্ছে।নিজেকে কেমন নোংরা কীট মনে হচ্ছে।সে আরেকদফা এলোমেলো হাসে।চোখ দু’টো কেন বার বার ছলছল করছে বুঝে আসে না।
আরহাম আবারো ঝুকল।পুনরায় নবনীতার দুই গালে চেপে ধরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’এতো যখন আমাকে অসহ্য লাগে,তখন আমার ছায়া থেকে বেরিয়ে দুনিয়াতে চলতে শেখো না।তখন দেখবে দুনিয়া কি জিনিস।হায়নারা তো সব খুবলে খাবে।তখন বুঝবে বর কি জিনিস।’
নবনীতা উদ্ভ্রান্ত চোখে তার দিকে তাকায়।তার কপালের গভীর ক্ষত দেখতেই আরহাম নড়েচড়ে উঠে।নবনীতা আচমকাই ফিক করে হেসে দিলো।আরহাম ভড়কে গিয়ে বলল,’কি হয়েছে?পাগলের মতো হাসছো কেন?’
সে হাসি থামালো না।মুখে সে হাসি ধরে রেখেই বলল,’খুশিতে হাসছি।আমার অনেক খুশি লাগছে তাই হাসছি।’
আরহামের দৃষ্টি স্থির হলো।একটু আগের রাগ সব বরফের মতো গলে গেল।সাথে সাথে নবনীতার গাল ছেড়ে দিলো সে।তার স্নায়ুর অস্থিরতা থেমেছে।এতোক্ষণে তার হুশ ফিরেছে।কিন্তু তার মনে হলো হুশ না ফিরলেই বোধহয় ভালো ছিল।কারণ যা কিছু ঘটানোর ছিল,সে ঘটিয়ে ফেলেছে।সারাদিনের যত রাগ তার ভেতরে জমা হয়েছিল,সবটা সে ভুল মানুষের উপর উগড়ে দিয়েছে।
সে শীতল চাহনিতে নবনীতার মুখ দেখে,সেই সাথে দেখে তার কপাল।কপালের ক্ষতটা দেখতেই তার বুক মোচড় দিয়ে উঠে।সে তাকে মেরেছে?এতো রূঢ় সে কিভাবে হলো?এতো পাষাণ তো সে কখনো নিজের মায়ের সাথেও হয়নি।
আবারো শব্দ করে হেসে দিলো নবনীতা।অথচ আরহামের মনে হলো এর মতো মলিন আর করুন হাসি পৃথিবীতে আর দু’টো নেই।হাসির মাঝেই আচমকা ফুপিয়ে উঠলো নবনীতা।সাথে সাথে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরে সে।না না সে কাঁদবে না।কিছুতেই কাঁদবে না।শত চেষ্টার পরেও সে নিজেকে দমাতে পারল না।হঠাৎ দুই হাতে মুখ চেপে বিকট স্বরে চিৎকার করে উঠল সে।আরহাম একটা ঢোক গিলে সামান্য পিছিয়ে আসে।নবনীতার এই ভয়ংকর ক্রন্দনরূপ তার সহ্য হচ্ছে না।মনে হচ্ছে বুকের ভেতর কেউ কেরোসিন ঢেলে আগুন দিয়ে দিয়েছে।সে একহাত বাড়িয়ে তার গাল ছুঁয়ে দিতে চাইল,প্রগাঢ় চুম্বনে তার সমস্ত অভিমান ভেঙে দিতে চাইল।কিন্তু তার আগেই নবনীতা জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল।তার সমস্ত শরীর তখনো থরথর করে কাঁপছে।অথচ তার মনে হলো সে একটা অনুভূতি শূন্য মৃ’ত লাশ।যাকে একটু আগে তারই স্বামী গলা টিপে মে’রে ফেলেছে।
চলবে-