#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৫৬)[প্রথম অংশ]
[রিচেক নাই।আপাতত কষ্ট করে পড়ুন]
টিক টিক টিক।ছন্দোময় গতিতে চলতে থাকা ঘড়ির কাটা সময় মতো জানান দিলো রাত এখন কাঁটায় কাঁটায় তিনটা।হেমন্তের সমাপ্তি।শীতের আগমনী বার্তা স্বরূপ ঠান্ডা,শরীর হিম করা বাতাস পর্দা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করছে।সেই বাতাসে রুগ্ন,বিমূঢ় নারী কায়াটি অল্প অল্প কাঁপছে।তার শিয়রে বসে থাকা পুরুষ যখনই নিজের স্ত্রীর কম্পমান শরীরটা দেখলো,তখনই পরম স্নেহে তাকে জড়িয়ে ধরল।নিজের দুই হাতের আলতো আলিঙ্গনে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।
আরহাম ঘোর লাগা কন্ঠে ডাকে,’পরী!’
কিছুসময় শান্ত থেকে মেয়েটি জবাব দেয়,’জ্বী।’
‘কবে টেস্ট করিয়েছ?’
‘কিছুদিন আগে।পরশু হাসপাতালে গিয়েছিলাম শিউর হওয়ার জন্য।’
সে শুরুতে কিছুটা বিরক্ত হলো,তারপর খুব বেশি রাগ হলো।
‘এতো কিছু করে নিলে,অথচ আমাকে একবার বললেও না?’
নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে নবনীতা কোনোরকমে উত্তর দেয়,’আপনি কোনো যোগাযোগ করেননি।’
আরহাম সারোষ চোখে তাকে দেখল।তার থমথমে মুখখানা দেখেই নবনীতা প্রশ্নাত্মক চোখে তার দিকে তাকায়।আরহাম রাগ ঝাড়ল না।নবনীতাকে টেনে দু’জনের দূরত্ব আরো কিছুটা ঘুচিয়ে নিয়ে বলল,’এই খবর জানলে অবশ্যই যোগাযোগ করতাম।তোমার উচিত ছিল জানানো।আমার উচিত এখন রাগ হওয়া।’
বলতে বলতেই তার মুখ রক্তিম হয়।নবনীতা ঈষৎ কাঁপতে থাকা হাতে তার গাল ছোঁয়।আরহামের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি তার আঙুলে চুবছে।সে এক দুইদিন আগেই শেভ করেছে বোধহয়।নবনীতা একবার বড় করে শ্বাস টেনে বলল,’তাহলে রাগ করুন।’
‘রাগ আসছে না।তোমার মুখটা দেখলে আমার রাগ পড়ে যায়।বড্ড দুর্বল লাগে নিজেকে।’
আরহাম নিঃসংকোচে কোনোরকম জড়তা ছাড়া জবাব দেয়।পরীর প্রতি তার সীমাহীন দুর্বলতা,এই কথা কি সে অস্বীকার করতে পারবে?অস্বীকার করেও লাভ নেই।পুরো জগৎ জানে সে পরীর প্রতি দুর্বল।এই দুর্বলতার কোনো সূচনা কিংবা সমাপ্তি নেই।যেই দুর্বলতা তাকে তার মেল ইগো ছাড়তে বাধ্য করেছে,যেই দুর্বলতার কাছে পরাস্ত স্বীকার করে সে বারবার মেয়েটির কাছে ফিরে যাচ্ছে,এই দুর্বলতাকে অস্বীকার করা বোকামি ছাড়া কিছুই না।
নবনীতার চোখে ঘুম নামল আরো কিছুক্ষণ পরে।আরহাম খুব যত্নে সাদা রঙের নকশিকাঁথাটা তার গায়ের উপর চাপায়।তার গায়ের ওমে নবনীতা নিজেকে আরো গুটিয়ে নেয়।তার মুখ জুড়ে প্রশান্তির হাসি দেখেই আরহাম বুঝল এই সামান্য উষ্ণতা নবনীতার আরাম লাগছে।সে তাকে আর বিরক্ত করে না।থাক একটু ঘুমোক।মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে এই কয়দিন সে একদমই ঠিক মতো নিজের যত্ন করেনি।আচ্ছা মেয়ে মানুষ এতো স্পর্শকাতর কেন?এতো নাজুক স্বত্তা! সামান্য অবহেলাতেই কেমন মূর্ছা যায়।
আরহাম একহাতে তার কপালের সামনে থাকা চুল সরায়।এগিয়ে এসে খুবই আলতো করে চুমু খায়।মেয়েটার ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখশ্রী তার বড্ড মায়া লাগে।আচ্ছা সে কি হকিংয়ের বর্ণনাকৃত কোনো কৃষ্ণগহ্বরের অতলে তলিয়ে যাচ্ছে?যেই দুর্দমনীয় আকর্ষণে পরী তাকে টানছে সে আকর্ষণ ছিন্ন করার জো কি তার আছে?আরহাম কেন ছুটে এলো তার কাছে?না এলেও তো পারতো।থাকতো যে যার মতো।কিন্তু সে পারেনি।সবকিছুর শেষে সে হেরে যাচ্ছে।পরী ভালো নেই,এই বাক্য তার সহ্য হয় না।পরী কেন ভালো থাকবে না?পরীকে ভালো থাকতে হবে।জীবনে এতো যন্ত্রণা ভোগ করার পর মেয়েটি মন্দ থাকতে পারে না।আরহাম তাকে মন্দ থাকতে দিবে না।
সে আবারো আলতো করে চুমু খায়।নবনীতার ঘুম ভাঙবে এই ভয়ে সে আর তার পাশ ঘেঁষল না।শুধু নির্নিমেষ চাহনিতে ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে দেখল।পরী মা হচ্ছে।আর সে হচ্ছে বাবা।কথাটা একদিক দিয়ে ভাবতে গেলে খুবই সাধারণ,অন্যদিকে ভীষণ রকম অসাধারণ।সে সত্যিকার অর্থে বাবা হচ্ছে।তার ঔরসজাত সন্তান নিজের অস্তিত্বের জানান দিয়েছে।আরহামের খুশি লাগছে।ভীষণ ভীষণ খুশি।মন চাইছে কোনো একটা খোলা মাঠে গিয়ে কতোক্ষণ চিৎকার করতে।সে রাতভর ভাবল।নিজেকে নিয়ে,পরীকে নিয়ে,তাদের অনাগত সন্তানকে নিয়ে।ভাবতে ভাবতেই তার ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হয়।
দূর থেকে আযানের ধ্বনি ভেসে আসে।আরহাম মাথা নামিয়ে নবনীতার কানের কাছে এসে ফিসফিস করে,’পরী! পরী! আযান দেয়।নামাজ পড়বে না?তোমার তো স্রষ্টার উপর অন্ধবিশ্বাস।যাও তাকে ডেকে এসো।’
***
বাম হাতের কালচে হয়ে উঠা স্থানে বার্নল লাগাতেই ইজমা নড়ে উঠল সামান্য।তারপরই আবার ডানহাত মুখে চেপে যন্ত্রণা টুকু গিলে নেয়।
ইফাজ মলম লাগানোর ফাঁকেই আড়চোখে একবার তাকে দেখে।তারপর আবার নিজের কাজে মন দেয়।পু’ড়ে যাওয়া অংশটুকুতে বার্নল লাগাতে লাগাতে সে শান্ত কিন্তু খানিকটা অবিশ্বাস্য হয়ে প্রশ্ন করে,’এতোখানি পুড়ে গেল,আর আপনি টেরও পেলেন না।আপনি কি আদৌ কোনো মানুষ?’
ইজমা লজ্জায় মাথা নোয়ায়।দরজার কাছে নার্সরা উঁকি দিয়ে তাকে দেখছে আর মিটমিট করে হাসছে।তাদের চাহনিতে ইজমা ভৎসনার আভাস পায়।ছিহ ইজমা!এমন মরার মতো কেউ ঘুমায়?
আজ হাসপাতালে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে।তাও আবার তার কেবিনে।কেবিনের ডান দিকে থাকা এসিতে হুট করে আগুন ধরে গেছে।আগুনের ধোঁয়া চোখে পড়তেই সবাই এর উৎস খোঁজা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।যখন সবাই আবিষ্কার করলো তিনতালার তিনশো ছয় নম্বর কেবিনেই আগুন লেগেছে,তখন দলবেঁধে সব সেখানে জড়ো হলো।আর তখনই ডজনখানেক মানুষ আবিষ্কার করল যার ঘরে আগুন লেগেছে সে দিব্যি ঘুমুচ্ছে।কি আশ্চর্য!কি অদ্ভুত! তার কি শরীরে তাপের আঁচ লাগছে না?
ইজমার ঘুম ভেঙেছে কারো হ্যাঁচকা আর জোরাল টানে।সে হকচকিয়ে উঠল।চোখ মেলতেই দেখল তার মুখোমুখি ইফাজ দাঁড়িয়ে আছে।যার চোখ দু’টো ভীষণ ক্রোধান্বিত।ইজমা তাকে দেখতেই সে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’পাগল নাকি?উঠে আসুন।আগুন লেগেছে কেবিনের এসিতে।’
ততক্ষণে অবশ্য অনেকেই দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে পানি ঢালা শুরু করেছে।ইজমা এ দৃশ্য দেখেই আঁতকে উঠে।তার মাথা কাজ করছে না।বড্ড বোকা বোকা হয়ে সে সবকিছু দেখে।হঠাৎই তার চোখ পড়ল তার নীল রঙা ব্যাগটা সাইডবক্সের উপরে।ব্যাস,আর কোনো কিছু না ভেবে সে থাবা বসায় ব্যাগের উপর।ইফাজ আঁতকে উঠে চেঁচায়,’আর ইউ ক্রেজি?’
আগুনের আঁচ লেগে হাত পুড়িয়েছে সে।ইফাজ কতোক্ষণ স্তব্ধ হয়ে তাকে দেখল।মনে হচ্ছে আগুন জ্বলছে তার মাথায়।এই মেয়ে কি গর্দভ নাকি?তার রাগ কমতে সময় নিল।আর রেগে কি হবে?যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।
সে মলম মাখিয়ে উঠে দাঁড়ায়।ইজমা অসহায় চোখে নিজের হাতটা দেখে।গতকালই ব্যান্ডেজ খুলেছিল হাতের।কাল হয়তো সে ডিসচার্জও পেয়ে যাবে।কিন্তু জখম আর পিছু ছাড়ল না তার।এই পোড়া আবার কয়দিন তাকে জ্বালায় কে জানে?
ইফাজ দরজার কাছে যেতেই সে পিছুডাকে,’এ্যাই ছেলে!’
সে অবাক হয়।পেছন ফিরে জানতে চায়,’আমাকে ডাকছেন?’
‘জ্বী।’
পুনরায় পেছন ফিরে সামনে এগিয়ে আসে সে।তার সন্দিহান দৃষ্টি দেখেই ইজমা হাসল।হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,’আপনাকে ধন্যবাদ।’
‘কেন?আপনাকে ঘুম থেকে জাগানোর জন্য?’
ইজমা আরো একদফা হাসল।দিরুক্তি করে বলল,’মোটেও না।সুন্দর করে অয়েন্টমেন্ট লাগানোর জন্য।’
‘আর আপনাকে ধন্যবাদ ঘুম থেকে উঠার জন্য।আপনার যা ঘুম!’
শেষ বাক্যে খানিকটা ব্যাঙ্গ,খানিকটা কটাক্ষের সুর।ইজমা সেটা গায়ে মাখল না।কেবল শব্দ করে একটু হাসল।ইফাজ অন্যমনস্ক হয়ে এদিক ওদিক দেখতেই হঠাৎ তার হাসি দেখে থামল।এই প্রথম সে আবিষ্কার করল মেয়েটার গালে টোল পড়ে।হাসলে সেটা আরো বেশি বোঝা যায়।সে চোরা চোখে দুইবার তাকে দেখে।তারপরই নিজের কাজে বিস্মিত হয়।সে এমন চোরের মতো তাকে দেখছে কেন?কি অদ্ভুত!
সে দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান নেয়।মেয়েদের হাসিতে আটকানোর মতো ফালতু জিনিস এই পৃথিবীতে আর দু’টো নেই।জীবনে একবার সে এই ভুল করেছে।আর না।আর যদি এই ভুল করে তাহলে সে একটা ছাগল,ইয়া বড়ো রামছাগল।
.
.
.
.
নিলয়ের জ্বর হলো।ভীষণ জ্বর।তার ঘরে থার্মোমিটার নেই।তবে নিজের কপালে হাত রেখে সে অনুমান করল একশো তিনের কম হবে না কিছুতেই।মাথায় হাত চেপেই সে কিছুক্ষণ কাশে।কাশতে কাশতে তার শ্বাস উঠল।সে কোনোরকমে দুই হাতে ভর গিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসার চেষ্টা করল।ফলাফল শূন্য।
চার পায়ের কাঠের চৌকিতে শুয়ে সে এপাশ ওপাশ গড়াগড়ি খায়।কিচ্ছু ভালো লাগছে না।মুখ কেমন তেতো হয়ে আছে।বিকেলের দিকে তার জ্বর আরো বাড়ল।ছোট্ট খুপরির মতোন ঘরটায় সে যন্ত্রনায় কতোক্ষণ ছটফট করল।তার গা কাঁপিয়ে জ্বর।অথচ এই এতো বড় পৃথিবীতে তার মাথায় পানি দেওয়ার মতোন মানুষ নেই।কি অদ্ভুত না?তার হৃদয়ে চিনচিন ব্যথা অনুভূত হয়।মায়ের কথা মনে পড়ে ভীষণ।মায়ের মতো ভালো এই জগতে আর কেউ বাসতে পারে?
কলিং বেল বাজল।পাশের ঘরের শফিক দরজা খুলল।নিলয়ের চোখদু’টো আধো আধো বুজে রাখা।নিভু চোখে সে দেখল শফিক বড় বড় পা ফেলে তার ঘরে আসছে।এসেই ভীষণ তাড়াহুড়ো করে বলল,’এ্যাই নিলয়!তোর ভার্সিটি ফ্রেন্ড এসেছে।তোর সাথে দেখা করতে।’
নিলয় যন্ত্রনায় কাঁতরাতে কাঁতরাতে দুই চোখ মেলে।মুমূর্ষু কন্ঠে কোনোরকমে আওড়ায়,’কে এসেছে?’
মিষ্টিমুখো মেয়েটি একটা প্যাকেট হাতে তার ঘরে এলো।নিলয় তাকে দেখেই আঁতকে উঠল।জ্বর আর শরীরের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে সে ধড়ফড়িয়ে উঠল।বড় বড় চোখ করে বলল,’প্রভা! তুমি?’
শফিক বেরিয়ে গেছে।নিলয় তবুও মাথা নামিয়ে হিশহিশ করে বলল,’তুমি কেন এখানে এসেছ?আশেপাশে সব ছেলে।ভয় করেনি তোমার?’
প্রভাতি নির্বিকার।জানতে চায়,’ভয় কেন করবে?’
‘যদি কোনো বিপদ হতো?’
‘বিপদ কেন হবে?তুমি আছো না?অপরিচিত ছেলেদের ভীড়ে একজন তো আমার পরিচিত।তার ভরসায় চলে এসেছি।’
নিলয় একপেশে হাসল।খুবই রুগ্ন আর বিমুঢ় দেখায় সে হাসি।হাসির দমকেই সে বলল,’আর আমি যদি এই মুহূর্তে তোমার ভরসা টা ভেঙে দেই প্রভা।তখন?’
প্রভাতির ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে।তীর্যক চাহনিতে একবার নিলয়কে দেখে পরক্ষণেই আবার মুচকি হেসে বলল,’ভেঙে দিলে আর কি করার?ভাঙলে ভাঙবে আরকি।আমি আমার জীবনে খুব বেশি ভালো কিছু আশাও করি না।’
তার কথার ধরনেই নিলয় ভীত হয়।দ্রুত হাত নেড়ে সাফাই দেয়,’ছি ছি।তুমি আমায় ভুল বুঝছ! আমি তো মজা করছিলাম।’
‘আমিও মজাই করছি।’ ফিক করে হেসে দেয় প্রভাতি।
নিলয় কিছুটা আশ্বস্ত হলো।পুনরায় চৌকিতে গা এলিয়ে প্রশ্ন করল,’বাড়ি কিভাবে পেলে?’
‘অনেক কষ্টে তোমার ছবি দেখিয়ে খুঁজে বের করেছি।’
‘সাংঘাতিক ব্যাপার!’
নিলয় নিজ থেকেই বলল,’আমার ভীষণ জ্বর প্রভা।’
‘জানি।তুমি আসোনি,কিছু জানাওনি আমাকে।আমি বুঝে নিয়েছি।’
সে উঠে গিয়ে একটা বালতিতে পানি এনে তাকে জলপট্টি দেয়।নিলয় প্রশান্তিতে চোখ বুজে।বন্ধ চোখেই বিড়বিড় করে বলে,’তোমায় ধন্যবাদ প্রভা।আমার ভীষণ ভালো লাগছে।’
প্রভাতি কিছুক্ষণ চুপ থাকলো।তারপরই হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল,’এখন আমি যেটা করব সেটা তোমার আরো বেশি ভালো লাগবে।’
চোখ খুলে কপাল কুঁচকায় নিলয়।
‘সেটা কি?’
উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণের মেয়েটা অকস্মাৎ তীব্র বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার পুরুষালি বক্ষে।নিলয় কিছুটা চমকায়,তবে মুখে কিছু বলে না।সে জানতো এই দিন আসবে।তবে এতো দ্রুত আসবে সেটা ধারণা করেনি।সে তাকে সরাল না।কিন্তু খানিকটা ধমকের সুরে বলল,’হচ্ছে টা কি প্রভা?পাশের ঘরে মানুষ আছে।এগুলো কেমন বাচ্চামো?’
সে তাকে ছাড়লো না।উল্টো আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,’ছাড়ব না।আমি বাচ্চাই।’
নিলয় তাকে লাই দেয়,তার বাচ্চামো কে প্রশ্রয় দেয়।সে ভীষণ অবাক হলো যখন দেখল প্রভাতির চোখের পানিতে তার পরনের শার্ট ভিজে যাচ্ছে।হকচকিয়ে উঠে একহাতে প্রভাতিকে সরাতে চায় সে।ব্যস্ত হয়ে বলে,’এ্যাই প্রভা তুমি কাঁদছো কেন?’
প্রভাতি সরল না।হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দিলো,’আমি খুশিতে কাঁদছি।মানুষ পাওয়ার খুশিতে আমার কান্না এসে গেছে।আমি একা নই নিলয়।আমার কেউ একজন আছে।এর চেয়ে খুশির আর কি হতে পারে?
.
.
.
.
নবনীতার দিন যাচ্ছিল কোনোরকম।ভালো খারাপ মিলিয়ে।সে স্বামীর ঘরে ফিরেছে বেশ কিছুদিন হয়েছে।তার স্বাস্থ্য একদমই ভালো থাকে না ইদানিং।শরীর খারাপ,মাথাব্যাথা,বমি বমি ভাব সবকিছু যেন লেগেই আছে।দিনের বেশির ভাগ সময়ই সে শুয়ে বসে কাটায়।আরশাদকেও ঠিক মতো কোলে নিতে পারে না।বাচ্চা ছেলেটা একা একাই খেলে।নবনীতার তার জন্য মায়া হয়।
আজ দুপুর থেকেই তার মাথাব্যথা,অন্য দিনের চাইতেও প্রকট।সে কতোক্ষন ঘরের এই মাথা ঐ মাথা পায়চারি করে।তারপর ধপ করে খাটে বসে মিনিট দশেক ঝিমায়।একটা ঘুমের ঔষধ খেয়েই চাদর টেনে কোনোরকমে নিজের চোখ বুজল সে।
সে ভেবেছিল তার ঘুম বেশি গাঢ় হবে না।অথচ সে ঘুমালো ছয় ঘন্টারও বেশি।ঘুম ভাঙতেই সে প্রথমে আবিষ্কার করল ঘড়িতে এই মুহূর্তে নয়টা পয়তাল্লিশ বাজছে।আর তারপর আবিষ্কার করল আরহাম তার শিয়রে বসা।বসে বসে সে ঝিমুচ্ছে।নবনীতা স্মিত হেসে উঠে বসল।
উঠে বসতেই তার কেমন অদ্ভুত অনুভূত হয়।খানিকটা বিচলিত হয়ে সে শরীরের উপর থেকে চাদর সরায়।সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠে নবনীতা।তার দৃষ্টি তার পায়ের দিকে।চিকন ধারায় তরল গড়িয়ে তার পা বেয়ে নামছে।কম্পিত হাতে একটা ঢোক গিলে ডান হাতে লাল রঙা তরল স্পর্শ করে সে।বুঝতে বাকি নেই এই চটচটে তরল রক্ত বৈ কিছু না।সে ভয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাত গুটিয়ে নিল।মৃদু আর্তনাদ করে ডাকলো,’আরহাম! আরহাম!’
এক ডাকেই তন্দ্রা ছুটে গেল আরহামের।ধড়ফড়িয়ে উঠে সে নিজেও আতঙ্কিত হয়ে চেঁচায়,’কি হলো?খারাপ লাগছে?’
নবনীতা টলমল চোখে ইশারায় তাকে তার পা দেখায়।কাঁপা স্বরে কোনোরকমে বলে,’আ-আমার ব্লিডিং হচ্ছে আরহাম।দেখুন রক্তে আমার সমস্ত শরীর ভেসে যাচ্ছে।’
সে আর বেশি কিছু বলতে পারল না।তার আগেই তার দুর্বল শরীরটা ঢলে পড়ল আরহামের প্রশস্ত বক্ষে।আরহাম তাকে জড়িয়ে ধরে স্তব্ধ হয়ে কতোক্ষণ বসে থাকল।মস্তিষ্ক কাজ করছে না তার।এসব কি হচ্ছে?হুশ ফিরতেই সে আরেক দফা হোঁচট খায়।তারপরই গলা ছেড়ে চিৎকার করে,’আরিশ! এক্ষুনি নিচে যা আরিশ।মোতাহের কে বল গাড়ি বের করতে।’
চলবে-
#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৫৬)[দ্বিতীয় অংশ]
হাসপাতালের করিডোর তখন শান্ত।দুই একটা মানুষ বাদে আশেপাশে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না।ব্যস্ত নগরী ঢাকা পড়েছে সুনশান নিরবতায়।চারদিকে কেমন অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য! হৃদয়ে বিরাজ করছে ভয়ানক নিস্তব্ধতা।
আরহাম করিডোরে পাতা বেঞ্চিতে বসে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।তার মুখোমুখি অন্যপাশে আরিশ দাঁড়ানো,একটা পা দেয়ালে ভর দেয়া।তার মুখটা গুমোট।আসার পর থেকে আর কোনো শব্দ করেনি সে,কোনো কথাও তুলেনি।যা বোঝার সে বুঝে গিয়েছে।আদি দাঁড়ানো করিডোরের অন্য মাথায়।এক প্রকার দৌড়ের মাঝে এখানে এসে পৌঁছেছে সে।তার মাথা এখনো ঝিমঝিম করছে।একহাতে কোনোরকমে মাথার বা পাশটা চেপে ধরে সে।
আরহাম আনমনে নিজের চুলে হাত ছোঁয়ায়।তারপর আরো একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে নিস্তব্ধ পরিবেশটা আরো বেশি ভারি করে।পরীর মিস ক্যারেজ হয়েছে।ছোট্ট ভ্রুণটা খুব বেশিদিন নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারেনি।অতি ক্ষুদ্র মাংসপিন্ডটি চাকা চাকা রক্তের দলা হয়ে নিঃশেষ হয়ে গেছে।বিলীন হয়েছে আরহাম আর নবনীতার ছোট্ট সংসারের স্বপ্ন।আহা! ঘুম ভাঙার পর মেয়েটা যখন সবকিছু জানবে তখন তার কেমন লাগবে?একটা সামান্য ঘুমের ঔষধ থেকে এতোকিছু হয়ে গেছে শোনার পর তার কেমন লাগবে?নিশ্চয়ই নিজের উপর ভীষণ রাগ হবে তার,অভিমানে আরহামের মুখোমুখি হবে না।দিনরাত ভুলে সারাক্ষণ শুধু কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাবে।বাচ্চা তো তার ভীষণ প্রিয়।রাস্তার ধারে পড়ে থাকা ছোট্ট প্রাণের জন্য যার মায়া হয়,নিজের গর্ভের সন্তান হারানোর কষ্টে কি তার ভেতরটা হাহাকার করে উঠবে না?
আরো এক দফা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে আরহাম।সামিউল সাহেব তাকে ডাকছেন তার চেম্বারে।উঠে দাঁড়িয়ে কোনোরকমে ভঙ্গুর পায়ে শরীরটা টেনে নিয়ে সে চেম্বারে গিয়ে ধপ করে একটা চেয়ার টেনে বসে।
সামিউল স্থির চোখে একনজর তাকে পরোখ করে।তারপর একটু কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে,’নবনীতা সিস্টিক ফাইব্রোসিসের পেশেন্ট।এটা জন্মগত এবং জিনগত রক্তশূন্যতা জনিত ব্যথি।তার রক্তশূণ্যতার সমস্যা অনেক আগের।নবনীতা নিজেই প্রতিমাসে রক্ত নিয়ে বেঁচে থাকে।কনসিভ করার জন্য কিছু শর্ত লাগে।ডোন্ট ইউ থিঙ্ক শী নেভার রিয়েলি হ্যাড দ্য এবিলিটি টু গিভ বার্থ?’
আরহাম মাথা নামায়।চুপচাপ নিজের হাত দেখে।তার দীর্ঘশ্বাসে পরিস্থিতি আরো বেশি গুমোট হচ্ছে।
‘আমি তার রিপোর্ট দেখেই আন্দাজ করেছিলাম শেষ পর্যন্ত সম্ভবত সে এই বাচ্চাটা ধরে রাখতে পারবে না।কিন্তু তোমাদের আনন্দে বিঘ্ন ঘটাতে চাই নি।নবনীতা আজ এই হাই পাওয়ারের ঘুমের ঔষধ না খেলে খুব সম্ভবত এই মেকি আনন্দে তোমরা আরো একমাস বিভোর থাকতে।কিন্তু আজ যা হয়েছে সেটা হওয়ারই ছিলো আরহাম।শী ক্যান নট,শী নেভার ক্যান।তুমি তাকে সুন্দর করে বোঝাও।এই স্টেজে মেয়েদের মানসিক অবস্থা বেশ জটিল থাকে।নবনীতার জন্য বিষয় গুলো আরো জটিল।তুমি তাকে নিজের মতো করে সামলাও।আফটার অল তোমার ওয়াইফ।পারবে না?’
আরহাম চুপচাপ উঠে দাঁড়ালো।তার কোনো কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।ভেতরে সব দলা পাকিয়ে যাচ্ছে।কেবল যেতে যেতে সে সংক্ষেপে জবাব দিলো,’পারব।’
.
.
.
.
নিলয়ের শরীর কিছুটা ভালো।সকাল থেকে নিজের কাজ সব নিজেই করতে পারছে।আসলে মনের সাথে শরীরের একটা সমানুপাতিক সম্পর্ক আছে।যেদিন আমাদের মন ভালো থাকে,সেদিন শরীরও ভালো থাকে।আজ তার মন ভালো।তাই শরীরের জ্বরটা খুব বেশি অনুভূত হচ্ছে না।
পুরোনো একখানা চেক প্রিন্টের শার্ট গায়ে চাপিয়ে সে আস্তে আস্তে নিচে নেমে আসে।কেচি গেট থেকে বেরিয়ে গলির রাস্তায় পা দিতেই সে দেখল তার থেকে সামান্য কয়েক হাত দূরে প্রভাতি দাঁড়ানো।সে অবাক হয় খানিকটা।চোখ বড় বড় করে বলে,’প্রভা তুমি?এতো দ্রুত এসে গেছ?বলো নি কেন?ফোন কেন দাও নি?তুমি তো বলেছিলে দশটার পরে আসবে।তাই আমিও সেভাবে বের হয়েছি।অথচ এখন দেখছি তুমি দশটা না বাজতেই হাজির।’
জবাবে প্রভাতি কেবল মুচকি হাসে।এগিয়ে এসে নিলয়ের উষ্ণ হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিতে নিতে বলে,’এমনিই বলিনি।আমার অপেক্ষা করতে ভালো লাগে।’
‘তাই?অপেক্ষা করতে ভালো লাগে?’
‘হু।’
‘অপেক্ষা কোনো ভালো জিনিস?’
প্রভাতি জোরে জোরে মাথা নাড়ল।
‘অবশ্যই।এই যেমন আমি দাঁড়িয়েছিলাম এতোক্ষণ।বার বার গেটের সামনে কেউ এলেই আমার মনে হতো এটা তুমি।মনে হলেই আমার মন অস্থির হয়ে উঠতো।এই অস্থিরতা টা ভীষণ ভালো।তুমি জানো না হুমায়ুন আহমেদ কি বলেছেন?’
‘কি বলেছেন?’
‘অপেক্ষা হলো মানুষের বেঁচে থাকার টনিক।জীবনে যদি অপেক্ষাই না থাকতো,তাহলে আমরা বেঁচে থাকতাম কীভাবে?’
নিলয় কথা বাড়ালো না।শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পাশ ফিরে প্রভাতির মুখটা দেখল।কি স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে আজ তাকে! হতে পারে নিলয়ের চোখের ভুল।তাকে রোজ যেমন লাগে এমনই লাগছে।কিন্তু নিলয়ের তাকে আলাদা লাগছে।কারণ প্রভাতি মেয়েটার সাথে তার সখ্যতা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।এখন আর তাকে কেবলই বন্ধু বলে আখ্যা দেওয়া যায় না।সে বন্ধুর চেয়েও একটু বেশি।একটু না,অনেকখানি বেশি।
প্রভাতি মোড় থেকে সিএনজি ঠিক করে।আজ তারা রমনা যাচ্ছে।নিলয় সিএনজিতে বসেই উসখুস করতে করতে বলল,’ভাড়াতেই তো অনেক টাকা চলে যাবে।’
প্রভাতি বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়।
‘যাক।টাকা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না।আমার কাছে জমানো টাকা আছে।’
কথা শেষ করে সে বেশ স্বাভাবিক ভাবে নিলয়ের কপালে হাত ছোঁয়ায়।স্মিত হেসে বলে,’বাহ।জ্বর অনেকটা কমে গেছে।’
বিনিময়ে নিলয় কেবল একগাল হাসল।এসবই হচ্ছে ছুতো।বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর প্রভা দশবারের ও বেশি নিলয়ের কপালে হাত রেখে এমন করে জ্বর মেপেছে।নিলয় জানে সে জ্বর মাপছে না।সে কেবল হুট করে সবার সামনে নিলয়ের কপাল ছোঁয়ার একটা সুযোগ খুঁজছে।
তারা রমনায় পৌঁছুলো আরো চল্লিশ মিনিট পর।যাওয়ার পরেই প্রভাতি ছুটে গিয়ে একটা বেঞ্চ দখল করে।
ভীষণ দুরন্ত আর ডানপিটে এই মেয়েটা স্বভাবে নিলয়ের একেবারে বিপরীত।তবুও মেয়েটাকে ভীষণ মায়া লাগে।মনে হয় একটুখানি ভালোবাসা আর স্নেহের বাণীতে মেয়েটা গলে যায়।এতো সরল কেন এই মেয়েটা?নিলয় এই সরলতায় আটকে গেছে।প্রভাতি সবসময় বলে নিলয়কে পেয়ে তার জীবনের একাকীত্ব কেটেছে।নিলয়েরও মন চায় চিৎকার করে বলতে,’শোনো প্রভা! তুমি আসার পর আমার পুষ্পবিহীন বাগানে সুন্দর একটা ফুল ফুটেছে।আমি রোজ সেই ফুলের যত্ন নেই।ফুলটা বড্ড বেশি আদুরে!’
‘প্রভা! আমরা বিয়ে করছি কবে?’
প্রভাতি কথার মাঝেই আচমকা এমন প্রশ্ন শুনে ভড়কে গেল।আশ্চর্য হয়ে পাশ ফিরে জানতে চাইল,’কি?কি করছি আমরা?’
নিলয় নির্বিকার।পুনরায় ভাবলেশহীন হয়ে বলে,’বিয়ে।শুধু শুধু অকারণে বিয়ে টা পিছিয়ে লাভ কি?দু’জনই যখন রাজি,তখন বিয়ে টা করে নিলেই হয়।’
প্রভাতি বিষম খায়।কাশতে কাশতে কেবল ফ্যাল ফ্যাল চোখে নিলয়কে দেখে।কি বলল নিলয়?তারা বিয়ে করবে?সময় গড়ায়।অথচ তার চোখের বিস্ময় কাটে না।প্রভার সত্যি সত্যি বিয়ে হবে?তারপর বাস্তবিক অর্থে তার মাথার উপর একটা স্থায়ী ছাদ হবে।অন্তত একজন মানুষ থাকবে যাকে প্রভা জোর গলায় নিজের বলতে পারবে।স্বজনবিহীন জীবনে এই বিয়ের প্রস্তাবটা কি এক নিমিষেই হজম করার মতো?
.
.
.
.
“তুমি যাও যাও যাও,
পরিচিত কোনো ডাকে,
বাড়ি ফিরে এসো সন্ধ্যে নামার আগে।
পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ আধার ঘনালে নীড়ে ফিরে আসে।অথচ আমার ভেতরে থাকা ছোট্ট প্রাণটা নীড়ে ফেরেনি।মায়ের সাথে অভিমান করে সে চিরতরে হারিয়ে গেছে।আমার একটা ভুল,একটা খামখেয়ালি তে আমার বাচ্চাটা শেষ হয়ে গেল।এই যন্ত্রণা আমি কোথায় রাখি?কেমন করে এটা আমি সহ্য করব যে সে আর নেই।সে আমার বিবাহিত জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বস্তু ছিল।আমি নিজের দোষে তাকে হারালাম।আরহাম যত যাই বলুক,আমি জানি দোষটা আমারই।
আমার ছোট্ট সোনামণি,
তুমি কি মায়ের সাথে অভিমান করেছ?মা একটু সচেতন হলে নিশ্চয়ই তোমার সাথে এমন হতো না।তোমাকে মা দেখিনি।কিন্তু তুমিও তো মায়ের আদরের বাচ্চাই ছিলে।তুমি জানো বিগত সাতদিন মা ঘুমুতে পারিনি।অনুশোচনা আর অনুতাপে দ’গ্ধ হচ্ছি প্রতিনিয়ত।আমার বাচ্চাটা আর নেই।আমি আর পেটে হাত রেখে মুচকি হাসার কোনো কারণ পাই না।আমি কিভাবে এই যন্ত্রণা বাকিদের বোঝাই?
আরহাম আমাকে খুব করে বোঝায়।তার একটা কথা,যাকে দেখিনি তার জন্য এতো কাঁদার কি মানে?আমি কেমন করে বোঝাই স্রষ্টা মায়েদের এভাবেই বানিয়েছেন।আমরা আমাদের গর্ভের সন্তানকেও ততখানি ভালোবাসি,যতখানি ভালোবাসি আমাদের সামনে থাকা সন্তানকে।
সন্তান হারানোর এই যন্ত্রণা আমি তাও সহ্য করে নিচ্ছিলাম।তারপর সেদিন রিপোর্ট দেখে জানলাম আমার যা শারিরীক অবস্থা,তাতে আমার পক্ষে কনসিভ করা সম্ভব হলেও পুরোপুরি নয় মাস একটা বাচ্চাকে সুস্থ ভাবে নিজের গর্ভে রাখার সক্ষমতা আমার নেই।এই জিনিসটা আমায় পুরোপুরি ভেঙে দিয়েছে।আরহামের একটা সন্তানের ভীষণ ইচ্ছে।আমি এই ইচ্ছে পূরণ করব কীভাবে?আমি কি কোনোদিনই মা হতে পারব না?নয় মাস একটা বাচ্চাকে নিজের মধ্যে ধারণ করার যে অনুভূতি সেটা কোনোদিন আমার জীবনে আসবে না?আমার জীবন এমন কেন?সবকিছুই এমন আধা আধা কেন আমার জীবনে?
আমি সহ্য করতে পারছি না এই মানসিক যন্ত্রণা।আরহাম মুখে যতই বলুক,আমি জানি উনিও ব্যাপারটাতে কষ্ট পেয়েছেন।উনার তো সন্তান চাই।এখন উনি কি করবে?আরেকটা বিয়ে করবে?এরপর আমি কোথায় যাব?আমার কি হবে?আমার তো কেউ নেই।”
এইটুকু লিখে সে থামে।কান্নার দমকে তার হেঁচকি উঠে যাচ্ছে।সে সামনে এগোতে পারছে না।কলমটা বন্ধ করে সে মুখ চেপে আরো কিছুক্ষণ টেনে টেনে শ্বাস নেয়।
আরহাম নিঃশব্দে ঘরে প্রবেশ করে।সে জানতো আসার পর এমন কিছুই হবে।পরীর এই রোজ রোজ কান্নাকাটি নতুন কিছু না।সে চুপচাপ তার খাটে গিয়ে বসল।কারো অস্তিত্ব টের পেতেই নবনীতা মাথা ঘুরিয়ে তাকে দেখে।তারপর ক্লান্ত পায়ে হেঁটে তার মুখোমুখি গিয়ে বসে।আরহাম চোখ তুলে একবার তার মুখটা দেখল।পরে আবার মাথা নামিয়ে নিল।
বেডশিটে আনমনে আঁচড় কাটতে কাটতে আরহাম বলল,’আমি অবাক হচ্ছি পরী।কোন মেয়ে কে আমি বিয়ে করেছি,আর কোন মেয়ের সাথে আমি সংসার করছি।তুমি এতো দুর্বল পরী! একটা সামান্য বিষয়ে এমন ভেঙে যাচ্ছ?’
‘সামান্য বিষয়?আমার কখনো বাচ্চা হবে না।এটা সামান্য বিষয়?’
‘হবে না বিষয় টা এমন না।আপাতত হচ্ছে না।কয়েক বছর অপেক্ষা করি।এরপর তো হতেও পারে।’
‘আমি জানি হবে না।’
‘তুমি সব জানলে আর আমার সাথে কথা বলছ কেন?তুমি যা জানো তা নিয়েই থাকো।’
নবনীতা চাপা স্বরে বলল,’আমার কপালে আসলে সুখই নাই আরহাম।’
আরহাম মৃদু হাসল।একহাতে নবনীতার একটা হাত টেনে ধরে বলল,’মন খারাপ করে না পরী।অনেক তো কান্নাকাটি করেছ।এখন এসব ভুলে যাও।আগের মতো মন দিয়ে সংসার করো।বাচ্চা নিয়ে অতো তাড়া কিসের?এখনো তো পঁচিশও হয়নি।সাতাশ আটাশ বয়স পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতেই পারি তাই না?’
নবনীতা এক মনে তার কথা শুনল।সে কথা শেষ করতেই নবনীতা অকস্মাৎ তার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল।অষ্টাদশী মেয়েদের ন্যায় নাক টেনে টেনে ভীষণ আবেগী হয়ে বলল,’আরহাম আমার যদি আটাশেও বাচ্চা না হয় তাহলে কি আপনি আমাকে ছেড়ে দিয়ে আরেকটা বিয়ে করবেন?’
আরহাম হকচকায়।পরক্ষণেই আবার স্থির হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে।তার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,’হুম করব।তুমি না পারলে আরেকজন লাগবে না?আমি তো বিয়েই করেছি বাচ্চার জন্য।’
চকিতে মাথা তুলে নবনীতা।তার অবিশ্বাস্য চাহনি দেখেই আরহাম ফিক করে হেসে দিলো।নবনীতা পুনরায় তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,’আমি শেষ হয়ে যাব আরহাম।সত্যি সত্যি শেষ হয়ে যাব।আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই।’
আরহাম তাকে টেনে নিজের আরো কাছাকাছি আনে।তার মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে কপালে দীর্ঘ চুম্বন খেয়ে বলে,’পরী! অবশ্যই আমরা সবাই চাই আমাদের একটা সুন্দর সংসার হোক,সন্তান হোক।সবাই চায়।আমি চাই,তুমি চাও।এটা স্বাভাবিক তাই না?কিন্তু এর মানে এই না যে শুধু সন্তানের জন্যই আমরা স্ত্রীকে চাই।মেয়েদের দৃষ্টিভঙ্গি জানি না,তবে আমার মনে হয় ছেলেরা সংসারে একটু শান্তি চায়।পিচ অব মাইন্ড যেটাকে বলে।আমি ঘরে এলাম,এসে দেখলাম তুমি খাবার সাজিয়ে আমার অপেক্ষা করছো,,আমার শরীর খারাপ,তুমি আমার যত্ন করছ,,আমার মন ভালো না,তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে আমার মন ভালো করে দিচ্ছ,,এই জিনিস গুলো খুব প্রিশিয়াস পরী।অবশ্যই আমি চাই আমার সন্তান হোক,আমাকে বাবা বলে ডাকুক।কিন্তু তার চেয়েও বেশি আমি তোমাকে চাই।তুমি সবসময় বলতে না যে পৃথিবীতে মানুষ কখনোই সব পায় না।এই পাওয়া না পাওয়ার মাঝে আমি না হয় তোমাকেই বেছে নিলাম।এবার খুশি?’
নবনীতা তাকে ছাড়ল না।উল্টো হাতের বন্ধন আরো বেশি জোরাল করে বলল,’আর যদি আমি মা’রা যাই,তাহলে কি আপনি আরেকটা বিয়ে করবেন?’
****
গাঢ় লাল কাতানের শাড়িটা গায়ের সাথে ধরেই প্রভাতি মুচকি হাসে।ঘড়ির কাঁটাতে সময় তখন রাত আটটা।তার তৈরি হতে হতে নয়টা বাজবে।আর কাজি অফিসে যেতে হয়তো দশটার মতো বাজবে।
আজ তার আর নিলয়ের বিয়ে।তাও আবার এই রাতে।এই সিদ্ধান্ত নিলয়ের।দিনে তার একটা পরীক্ষা আছে।তাই সে ভেবেচিন্তে সময় ঠিক করেছে রাতে।প্রভাতি অবাক হয়ে বলল,’এই রাতে কাজি অফিস খোলা থাকবে?’
নিলয় ভাব দেখিয়ে বলেছে,’কাজি অফিস দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা খোলা থাকে।’
প্রভাতির অবশ্য তৈরি হতে এতো সময় লাগল না।সে নয়টার আগেই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।রাস্তায় নেমেই সে এদিক সেদিক দেখে লোকাল বাসের খোঁজ করে।নাহ,এই সময়ে বাস পাওয়া যাবে না।টেম্পু পাওয়া যেতে পারে।
টেম্পুতে উঠেই সে কতোক্ষণ নিলয়কে গালমন্দ করল।এটা কোনো সময় হলো বিয়ে করার?বাস নাই,কিচ্ছু নাই।একটু পরেই আবার তার মন ভালো হয়ে গেল।আজ তার বিয়ে।এটা ভাবলেই তার লজ্জা লাগে,আনন্দ হয়।উফফ,রাস্তাটা আজ এতো বড় মনে হচ্ছে কেন?গন্তব্য এতো দূরে কেন?আর অপেক্ষা করতে পারছে না প্রভা।
কাজি অফিসের সামনে এসেই প্রভাতির চোখ আপনাআপনি বড় হলো।সে ভেবেছিল নিলয় তার আগে আসবে।কিন্তু নিলয় আসেনি।করিডোরে পাতা বেঞ্চ গুলো একদম ফাঁকা।
সে চুপচাপ হেঁটে বেঞ্চে গিয়ে বসে।অফিসের পিওন তাকে দেখেই এগিয়ে গেল।নিচু স্বরে জানতে চাইল,’বিয়ে করবে তুমি?’
সে চকিতে মাথা তুলে।সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে বলে,’জ্বী।’
‘বর কোথায় তোমার?’
‘আসেনি এখনো।আসবে একটু পর।’
লোকটা চলে গেল।প্রভাতি বেঞ্চে হেলান দিয়ে রাস্তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।সময় যতো গড়াচ্ছে,ঠান্ডা তত বাড়ছে।সে তাড়াতাড়ি ব্যাগ থেকে একটা শাল বের করে গায়ে জড়ায়।খানিকটা বিরক্ত হয়ে নিলয়ের নম্বরে ফোন দেয়।আজ সকালের পর তার সাথে আর প্রভাতির কথা হয়নি।
নিলয়ের ফোনটা বন্ধ।প্রভাতির বিরক্তিভাব দ্বিগুন হলো।সে থমথমে মুখে দুই হাত বগলদাবা করে বসে থাকলো।নিলয় আসলে সে দশ মিনিট তার সাথে কোনো কথা বলবে না।এতো দায়িত্ব জ্ঞানহীন মানুষ হয়?
সে অপেক্ষা করে।রাত দশটা থেকে এগারোটা,এগারোটা থেকে বারোটা হলো।কাজি অফিসের বাইরে লোক সমাগম একেবারেই কমে এল।একসময় কেবল অবশিষ্ট রইল প্রভাতি আর অফিসের পিওন।প্রভাতি একটা নিশ্বাস ছেড়ে আবারো রাস্তার দিকে তাকায়।তার বুকে হাতুড়ি পেটার মতো শব্দ হচ্ছে।নিলয় এখনো আসছে না কেন?কি হয়েছে তার?তার চোখ ফেটে কান্না আসছে।সে আবারো অপেক্ষা করে।সরল সোজা মেয়েটা টের পেল না তার এই অপেক্ষা আমরণ।নিলয় ফিরবে না,কোনোদিনই ফিরবে না।এই অপেক্ষার কোনো অন্ত নেই।প্রভাতির অপেক্ষার কোনো শেষ নেই।যেই অজানা গন্তব্যে নিলয়ের আত্মা পাড়ি জমিয়েছে,সেখান থেকে আর কারো পক্ষে ফেরা সম্ভব না।আজ পর্যন্ত কোনো জীব সেখান থেকে ফিরে আসতে পারে নি,কোনোদিন পারবেও না।
চলবে-