#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৫৪)
[রিচেক নাই একদমই।আধঘন্টা পর রিচেক দিচ্ছি]
ঘুম ভাঙতেই সূর্যের কড়া আলোতে ইজমার কপাল কুঁচকে এলো।কাল রাতে সে বেশ দেরিতে ঘুমিয়েছে।আদি ছিল প্রায় তিনটা পর্যন্ত।আজ হয়তো আবার আসবে একটু পরেই।
সে ঘুম থেকে উঠে চোখ ডলতে ডলতে চারপাশ দেখে।দরজার দিকে কাউকে আসা যাওয়া করতে দেখা যাচ্ছে না।তার ওয়াশরুমে যেতে হবে।প্রায় মিনিট দুইয়ের মতোন অপেক্ষা করে সে সিদ্ধান্ত নিল সে নিজের থেকেই ওয়াশরুমে যাবে।ফ্রেকচার হওয়া হাতটা একনজর দেখে সে আস্তে ধীরে বেডের এক কোণা পর্যন্ত এসে বসে।একটা পা সাবধানে মেঝেতে রেখে তার উপর হালকা করে ভর দেয়।ভাঙা হাত সামলেই অতি সাবধানতার সাথে অন্য পা মেঝেতে রেখে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।হালকা একটু উঠতেই তার শরীর ব্যথায় ভেঙে আসে।মুখ থুবড়ে ফ্লোরে পড়ার আগেই শক্ত একটা হাত তার কনুইয়ের কাছটা চেপে ধরে।
ইজমা ঘাড় বাঁকা করে তার পাশে থাকা মানুষটাকে দেখে।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলে,’ওয়াশরুমে যাচ্ছিলাম আমি।’
ইফাজ তার হাত ছাড়ল না।তবে সামান্য খানিকটা পিছিয়ে নিজেদের দুরত্ব বাড়িয়ে বলল,’সিস্টার কেউ ছিল না আশেপাশে?’
‘জ্বী না।’
‘ওয়াশরুমে যাবে?’ একেবারে ঠান্ডা গলায় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে জানতে চায় সে।
ইজমা মাথা নাড়ে।একেবারে ধিমি আওয়াজে বলে,’জ্বী।’
ইফাজ তার হাতে থাকা রিপোর্ট টা বেডসাইড টেবিলের উপর রাখে।তারপর ভাবলেশহীন হয়ে বলে ‘আচ্ছা চলুন।দরজা পর্যন্ত নিয়ে যাচ্ছি।’
ইজমা চুপচাপ হেঁটে তার সাথে ওয়াশরুম পর্যন্ত গেল।ইফাজ তাকে সেখানে ছেড়ে পুনরায় তার বেড পর্যন্ত হেঁটে আসে।খুব মনোযোগ দিয়ে রিপোর্ট চেক করে।ইজমার হাতের অবস্থার উন্নতি হয়েছে।আর কিছু দিনেই হয়তো টুকটাক নাড়াচাড়া করতে পারবে।
ইজমা বের হলো গুনে গুনে তিন মিনিট পরে।ইফাজ ঘাড় ঘুরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,’আসতে হবে?’
‘না হবে না।নিজেই পারব আমি।’
চট করে সামনে ফিরে সে।রিপোর্টের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলে,’গুড।’
ইজমা শম্বুক গতিতে হেঁটে খাটে গিয়ে বসে।ইফাজ অবলীলায় নিঃসংকোচে তার কপালে হাত ছোঁয়ায়,মুখে আগের মতোন গাম্ভীর্য ধরে রেখে বলে,’সিস্টার বলছিল কাল নাকি একটু জ্বর জ্বর ছিল?এখন তো মনে হয় সুস্থ আছেন।টেম্পারেচার নরমালই মনে হচ্ছে।’
ইজমা দ্রুত মাথা নাড়ে।তার চেয়েও দ্রুত জবাব দেয়,’জ্বী জ্বী।এখন আর তেমন জ্বর নেই।’
ইফাজ আরো কিছুক্ষণ থেকে কয়েকটা ঔষধ নতুন সংযোজন করে পুরোনো কিছু ঔষধ প্রেসক্রিপশন থেকে বাদ দিলো।তারপরই সেটা ইজমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,’আপনার ফ্রেন্ড কে এটা দিবেন আজকে আসলে।মনে থাকবে তো?’
‘জ্বী থাকবে।’
ইফাজ হনহন করে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল।ইজমা হাতড়ে হাতড়ে নিজের ফোন খুঁজে কতোক্ষণ আনমনে স্ক্রল করল।তার আবার ঘুম পাচ্ছে।আরো একবার ঘুমুতে ইচ্ছে করছে।ইজমা বড় করে দুইবার হাই তোলে।তার হঠাৎই মনে হলো সে এখন হসপিটালে আর তার এখন যখন খুশি ঘুমানোর অনুমতি আছে।সে সিদ্ধান্ত নিল সে এখন আবার ঘুমুবে।কতোক্ষণ ঘুমুবে?যতোক্ষণ না আদি এসে ভিত্তিহীন কৌতুকে হাসাতে হাসতে তার চোখ ঝাপসা করে দিবে,ঠিক ততোক্ষণ।
.
.
.
.
‘নিলয়!নিলয়!’
ঢিলেঢালা পোশাকের তরুণী মেয়েটা দ্রুত বেগে ছুটতে ছুটতে সামনে এগিয়ে আসে।তার মাথায় চাপানো ঘোমটা বাতাসের দাপটে অবস্থানচ্যুত হয়েছে।সে দৌড়ের মাঝেই আবার নিজের স্কার্ফ ঠিক করে।
দৌড়ে দৌড়ে তার শ্বাস উঠে গেছে।তবে এতো কিছুতে মুখের হাসি বিলীন হয় নি।নিলয় খানিকটা বিরক্ত হয়।পেছন ফিরে কপাল কুঁচকে বলে,’সমস্যা কি?’
প্রভাতি তার নাগাল পেতেই মাটির দিকে ঝুকে নিজের দুই হাঁটুতে হাত রেখে বড় বড় শ্বাস টানে।সেই অবস্থাতেই অস্পষ্ট আওয়াজে বলে,’তোমাকে সেই কখন থেকে ডাকছি’
‘আমি শুনেছি।’
‘শুনলে সাড়া দাওনি কেন?’
‘সামনে বড় ভাইরা ছিল তাই।’
‘কেন?বড় ভাইরা থাকলে কি হয়েছে?আমি তোমার হাত ধরেছি নাকি কোনো অসভ্যতা করেছি?’
‘যাই হোক।সবকিছুতে এতো কেন খুঁজবে না।নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছো।এখন এতো কেন খুঁজবে না।সিনিয়রদের নজর থেকে যতোটা পারো বেঁচে চলবা।একবার টার্গেট হলেই জীবন শেষ।’
প্রভাতি তার কথা শুনেই চোখ বাঁকা করে তার দিকে তাকায়।ঠোঁট উল্টে বলে,’বাপরে! এতো কিছু মেনে চলার পরেও তো তুমি থাবড় চটকটা খাচ্ছো রোজ রোজ।’
যদিও তার কথায় নিলয়ের অপমানিত বোধ করার কথা ছিল,কিন্তু সে অপমানিত বোধ করল না।উল্টো কথার ধরন শুনেই ফিক করে হেসে ফেলল।মাথা চুলকে বোকা বোকা হেসে বলল,’আমি তো থাবড় চটকটা খেয়েই শিখেছি প্রভা।’
প্রভাতি হাঁটার গতি কমায়।ভীষণ কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়,’আচ্ছা তারা সবসময় তোমার সাথেই এমন করে কেন?তুমি তাদের কোন বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছো শুনি?’
***
হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে মিষ্টি মুখের মেয়েটা ইজমার মুখোমুখি এসে থামে।তার মুখে অমায়িক আর স্নিগ্ধ হাসি।কিছু মানুষের দর্শনই যেন শুভ্রতা ছড়ায়।ইজমার মনে হলো তার সামনে থাকা মেয়েটিও তাই।সে এসে থামল,আর ইজমার মনে হলো একেবারে ঠান্ডা একটা বাতাস তার গা ছুঁয়ে গেল।সে মিষ্টি হেসে শুধায়,’তাসনুভা! রাইট?’
ধূসর রঙের জামায় নিজেকে আবৃত করে রাখা মেয়েটা জোরে জোরে উপরনিচ মাথা নাড়ে।মুখের সেই অতিসুন্দর হাসি ধরে রেখেই বলে,’জ্বী।আমিই তাসনুভা।’
‘কেমন আছো তাসনুভা?’
‘আমি ভালো আছি।’
সে থামল।নিজ থেকেই আবার মলিন মুখে বলল,’কিন্তু তুমি ভালো নেই।’
তার বিষন্ন মুখশ্রী দেখেই ইজমা স্মিত হাসে।ব্যান্ডেজে মুড়ানো হাতটা দেখে খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,’দেশে এসেই একটা উটকো ঝামেলায় পড়ে গেলাম দেখেছো?’
আদি দুই হাতে দু’টো আইসক্রিম নিয়ে কেবিনে আসল।স্ট্রবেরি ফ্লেভারের আইসক্রিম টা ইজমার দিকে আর চকোলেট ফ্লেভারের আইসক্রিম টা তাসনুভার দিকে বাড়িয়ে তাড়া দিয়ে বলল,’ধরো,তাড়াতাড়ি খাও।নয়তো গলে যাবে।’
ইজমা একহাতে আইসক্রিম নিয়ে চোখ পাকিয়ে বলল,’তোর জন্য আনিস নি?’
‘নাহ।আমার খেতে ইচ্ছে হচ্ছে না।’
‘যাহ মিথ্যুক।’
‘সত্যি।’
আদি ক্লান্ত হেঁটে ইজমার পায়ের কাছটায় বসে।তাসনুভা আইসক্রিম খেতে খেতে দু’জনের দিকে একবার একবার করে তাকায়।আদি আজ তাকে নিজের সাথে হসপিটালে নিয়ে এসেছে।সে জানতো না যে ইজমা নামের মেয়েটা দেশে এসেছে।জানার পরেই জোরাজুরি শুরু করল সেও যাবে ইজমাকে দেখতে।ইজমাকে দেখেই তার চোয়াল ঝুলে গেল।পুরোদস্তুর ভিনদেশীদের মতোন দেখতে একটা মেয়ে।গায়ের রং মাত্রাতিরিক্ত উজ্জ্বল।চুলগুলো বাদামি।মেয়েটা এতো সুন্দর যে তাসনুভার মনে হলো তাকে বাড়ি এনে শো কেসে সাজিয়ে রাখতে।ইজমা যখন চোখের পাতা মেলে স্থির হয়ে কিছু দেখে,তাসনুভার মনে হয় জলজ্যান্ত কোনো পুতুল চোখের সামনে বসে আছে।পরী ভাবির পর তাসনুভার দেখা সবচেয়ে সুন্দর মেয়ে এই ইজমা।এতো শুভ্র গায়ের রং তাসনুভা খুব কমই দেখেছে।
ইজমা তার হাতে থাকা আইসক্রিম টা অর্ধেকের মতো শেষ করে বাকিটা আদির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’নে একটু খা।’
আদি সরু চোখে তার দিকে তাকায়।সন্দিহান গলায় বলে,’খেতে বলছিস?’
‘হ্যাঁ।খা।’
আদি ডান হাতের উপর ভর দিকে সামনের দিকে ঝুকে।ইজমা সোজা সরল মনে হাতের আইসক্রিমটা তার মুখের কাছাকাছি এনে দেয়।আদি একবার চোখ তুলে কুটিল হাসে।তারপরই বড় করে হা করে পুরোটা আইসক্রিম এক কামড়ে নিজের মুখে নেয়।ইজমা প্রথমে বিস্ময়ে হকচকিয়ে উঠে,তারপরই অবস্থা বুঝে চেঁচিয়ে উঠে,’আদির বাচ্চা!! পুরোটা নিতে বলি নি।দে,আমার আইসক্রিম দে।’
বলেই সে একহাত দিয়ে আদির গালের দুই পাশ চেপে ধরে।উদ্দেশ্য সে আদিকে কিছুতেই চিবুতে দিবে না।আদি একহাতে ইজমার হাতটা সরাতে সরাতে হাসিতে গড়াগড়ি খায়।ইজমা দাঁত কিড়মিড় করে চেঁচায়,’ফাজিল! তোকে পুরোটা খেতে বলেছি?এগুলা ঠিক না।’
এক ঝাড়ায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আদি গপাগপ আইসক্রিম টা শেষ করে।ইজমা থমথমে মুখে প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে তাকে দেখল।তারপরই হঠাৎ দু’জন খিলখিল করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।ইজমা দুম করে আদির পিঠে একটা কিল বসিয়ে বলল,’বেয়াদব! তোকে আর কখনো কিছু সাধবো না।নাদান কোথাকার!’
‘সাধিস না।কে বলেছিল তোকে সাধতে?’
তাসনুভা গোল গোল চোখে তাদের দু’জনকে দেখে।এই বন্ধুত্ব,এই খুনশুটি তার দারুণ লাগছে দেখতে।কতো সুন্দর তাদের বন্ধুত্ব।কতোখানি আপন তারা নিজেদের! কোনো সংকোচ কিংবা দ্বিধা কিছুই নেই।তাসনুভার এমন কোনো বন্ধু নেই।এমন কেউ তাসনুভার জীবনে নেই যার সাথে তাসনুভা এমন খ্যাক খ্যাক করে হাসতে পারবে।স্কুলেও কখনো কোনো মেয়ে নিজ থেকে তার সাথে বন্ধুত্ব করেনি।তাকে দেখলেই সবাই ভয়ে দূরে সরে যেত।কি আশ্চর্য ব্যাপার! হাঁটতে অক্ষম হওয়া কি এতো ভয়ানক কিছু যে একারনে তাকে ভয় পেয়ে দূরে সরে যেতে হবে?
‘এ্যাই বাচ্চা! আইসক্রিম গলে যাচ্ছে তো।’
আদির ডাকে তাসনুভার ধ্যান ভাঙে।সে নড়েচড়ে উঠে দেখল তার আইসক্রিম গলে তার আঙুল চুয়ে চুয়ে পড়ছে।সে তাড়াহুড়ো করে হাতটা উপরে তুলে আঙুলে লেগে থাকা আইসক্রিম টুকু খেয়ে নেয়।খেতে গিয়ে নিজের নাক ভরায়।ইজমা একগাল হেসে তার গাল স্পর্শ করে বলে,’আসলেই তো বাচ্চা তুমি।মিষ্টি একটা বাচ্চা।’
তাসনুভা একটু লজ্জা পেল বোধহয়।ইজমার কথা শুনেই সে লজ্জাবতী গাছের ন্যায় কিছুটা মিইয়ে গেল।নিচু গলায় বলল,’আমি বাচ্চা নই।’
আদি পকেট থেকে একটা টিস্যু বের করে সেটা তাসনুভার হাতে দিলো।তাসনুভা জিজ্ঞাসু হয়ে তাকে দেখতেই সে নরম গলায় বলল,’হাত মুখ নাক সবকিছু তো আইসক্রিম মেখে ভরিয়েছো।এটা দিয়ে মুছে নাও আপাতত।বাইরে গেলে তখন পানি দিয়ে আবার ধুয়ে নিও।’
ইজমা ডান পা দিয়ে আস্তে করে আদির হাঁটু বরাবর একটা লাথি মেরে বলল,’তাসনুভাকে টিস্যু দিচ্ছিস,আমার টিস্যু কোথায়?আমারও তো হাত মুখ ভরেছে।’
আদি চোখ বাঁকিয়ে তাকে দেখে।ঠোঁটে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে দরজার সামনে দেখতে দেখতে বলে,’ঐ যে দেখ,তোর জন্য পাপোশ রাখা আছে।তুই গিয়ে ঐটাতে একটু মুখ ঘষা দে যা।তোর আবার কিসের টিস্যু?পাপোষই তোর টিস্যু।’
.
.
.
.
মেয়েটির পোশাক অত্যন্ত মার্জিত।গায়ে চাপানো চুড়িদারের রং একেবারে হালকা আকাশি।শরৎের আকাশে যেমন নীলের মাঝে ভাসা ভাসা শুভ্র তুলার মতো কিছু মেঘ থাকে,তার পরনের জামাতেও এমন সাদা মেঘের অস্তিত্ব আছে।চুড়িদারের উপরে আছে ধবধবে সাদা ওড়না।সাদা কাপড় সহজে ময়লা হয়,চকচকে ভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়না।মেয়েটির ক্ষেত্রে বিষয়টা এমন হয়নি।তার ওড়না একেবারেই সাদা।তার চুলের একপাশে বেণী করা।মুখে একটা সৌজন্য সূচক স্বচ্ছ হাসি,চোখে খেলা করছে অদ্ভুত দিপ্তী।সে দুই হাত টেবিলে রেখে মাথা সামান্য সামনে ঝুকায়।সুমিষ্টি রিনরিনে কন্ঠে বলে,’আপনি কি বেশি ব্যস্ত ভাইয়া?’
তার মুখোমুখি চেয়ারে বসে থাকা যুবকের দৃষ্টি স্থির,সামান্য সন্দিহানও বটে।জহুরি চোখে সে কয়েকবার তাকে পরোখ করে।নাহ,খুবই সহজ সরল আর বোকাসোকা মনে হচ্ছে মেয়েটাকে।সে গম্ভীর গলায় থমথমে মুখে জবাব দেয়,’না,আপাতত ব্যস্ত নই।’
মেয়েটির হাসি প্রশস্ত হয়।সে আগের চেয়েও উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে,’আমার নাম প্রভাতি রহমান।’
তার কথায় যুবকের কপাল কুঞ্চিত হয়।সে খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,’তোমার নাম জেনে আমার কি কাজ?’
প্রভাতি থতমত খেয়ে কোনোরকমে বলল,’না এমনিই।পরিচয় দিলাম আরকি।’
মেয়েটা নিজের দুই বেণী দুই হাতে ধরে কতোক্ষণ কিছু একটা ভাবে।মনে মনে কথা সাজায়।তবে শব্দভান্ডার তার অতো সমৃদ্ধ না।সে অনেকটা সময় খচখচ করে শেষে অধৈর্য হয়ে নিজের ব্যাগ হাতড়ে একটা ছবি বের করে।তারপরই সেটা তার সামনে থাকা যুবকটার সম্মুখে বাড়িয়ে দেয়।
একটানে ছবিখানা নিজের হাতে নেয় আরহাম।দেখতে পায় ছবিতে ঠিক তিনজন মানুষের অস্তিত্ব।একটা মাঝবয়সের লোক বসা,তার কোলে একটা এক দেড় বছরের বাচ্চা মেয়ে।মেয়েটা হাত নাড়ছে।পাশেই একটা ছেলে গালে হাত রেখে দু’জনকে দেখছে।ছবির মান তেমন একটা ভালো না।সাদা কালো,ঝাপসা।কিন্তু আরহাম সেই ছবিটাই খুটিয়ে খুটিয়ে চোখ বড় করে দেখল।এক পর্যায়ে ভীষণ চঞ্চল হয়ে বলল,’এটা তো আমি।এই যে আমি,পাশে আমার বাবা।আর কোলের মেয়েটা,,’
সে থামে।কোলের মেয়েটার নাম তার মনে নেই।প্রভাতি গালের নিচে হাত রেখে প্রফুল্ল কন্ঠে জবাব দেয়,’আর কোলের মেয়েটা প্রভাতি।এই যে আমি প্রভাতি।’
আরহাম গোল গোল চোখে অবাক হয়ে তাকে দেখে।অতীতের স্মৃতি একটু ঝাপসা ভাবে তার মনে পড়ছে।সম্ভবত দুই হাজার এক সালের দিকের ঘটনা।শাহবাগের ঐদিকটায় নাসরিন নামের এক ভদ্রমহিলা ফুল বিক্রি করত।হঠাৎই একদিন শোনা গেল নাসরিন বেঁচে নেই।উল্কাবেগে ছুটে আসা লোকাল বাসের চাকার পিষ্টনে তার মৃ’ত্যু হয়েছে।নাসরিন বিধবা ছিল।তার বয়সও তেমন বেশি ছিল না।তার একটা ফুটফুটে সুন্দর কন্যা সন্তান ছিলো।শেখ আজিজ তখন মহানগর ০৪ এর সংসদ সদস্য।এই খবর কানে যাওয়া মাত্রই তিনি বস্তিতে নাসরিনের থাকার জায়গাতে ছুটে যান।দেখতে পান পৃথিবী ছাড়ার পূর্বে নাসরিন একটা সুন্দর প্রাণ এই পৃথিবীর বুকে রেখে গেছে।আজিজ হোসেন অত্যন্ত ভালোবাসায় বাচ্চা মেয়েটিকে কোলে তুলে নেন।লোক মুখে তার কানে খবর এলো মেয়েটির নাকি কোনো নাম নেই।নাসরিন নাকি তাকে বাবু বলেই ডাকতো।তার বাবার নাম ছিলো রহমান।আজিজ হোসেন তার একটা পুর্নাঙ্গ নাম দিলেন-প্রভাতি রহমান।কারণ তার মনে হয়েছিল এই মেয়ে সকালের সূর্যের মতোই স্নিগ্ধ,দীপ্তমান।প্রভাত থেকে প্রভাতি।তারপর গোটা জীবন নাসরিনের অভাগা মেয়েটি এই নাম নিয়েই চলল।তাকে আজিজ হোসেন সেদিনই নিজের চাইল্ড হোমে নিয়ে আসেন।সানশাইন অরফানেজ সেন্টারের খোলা বারান্দায় তিনি তাকে কোলে নিয়ে বসেন।তার পাশাপাশি ছোট ছোট পা ফেলে একজন বালক এসে দাঁড়ায়।আজিজ সাহেব তার হাত টেনে তাকে তার পাশে বসায়।ছেলেটির চোখে বিস্ময়।বাবা মানুষটা এতো অদ্ভুত কেন?কেমন যেন অদ্ভুত রকমের ভালো।সে তার বাবার মতো হতে চায়।সে সবাই কে ভালোবাসতে চায়।
বুকের চিনচিন ব্যথায় তার মস্তিষ্ক সচল হয়।সে খানিকটা নড়েচড়ে উঠে নিজেকে সামলায়।একটু কেশে জমে যাওয়া কণ্ঠনালী পরিষ্কার করে।তারপরই সামনে তাকায়।বাস্তবতায় ফিরতেই তার মন আরো খারাপ হয়।সে বাবার মতো হতে পারেনি।বাবার কিয়দংশও সে পায়নি।সে বাবার মতো মানুষের অন্তরের নেতা হতে পারে নি।সে পারেনি রাস্তার কোনো ছাপোষা কে পরম স্নেহে নিজের কোলে ঠাই দিতে।
সে কিছুটা আবেগী হয়।সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে একটু এগিয়ে এসে প্রভাতির মাথায় স্নেহের হাত বুলায়।অনেক চেষ্টার পরেও তার কন্ঠ কিছুটা জড়িয়ে যায়।সে খানিকটা ব্যাকুল হয়ে বলে,’তুমি সেই ছোট্ট প্রভা?’
ব্যাকুল হয় প্রভাতি নিজেও।জোরে জোরে মাথা নেড়ে সে জানায় সেই প্রভাতি।সঙ্গে আরো কিছু কথা নিজ থেকে যোগ করে।
‘আর আপনি আরহাম ভাই।ছোট বেলা থেকেই সব কিছুতে রাগে লাল হয়ে যাওয়া আরহাম ভাই।’
আরহাম স্মিত হাসে।পরক্ষণেই ব্যস্ত হয়ে বলে,’আরে তুমি কি খাবে?তোফায়েল! এ্যাই তোফায়েল এদিকে আয় তো।’
প্রভাতি দ্রুত হাত নেড়ে জানায়,’না না ভাইয়া।আমি কিছু খাব না।’
সে তাকে মৃদু ধমকে উঠে,’চুপ করো তো।খাবা না আবার কি?খেতেই হবে।আমার এখানে আসলে খেয়ে যেতে হয় জানো না?’
প্রভাতি আর জোরাজুরি করল না।আরহাম নিজের মন মতো কয়েকটা খাবার তোফায়েল কে দিয়ে আনার ব্যবস্থা করে।তারপরই ডেস্কের সাথে হেলান দিয়ে পেপার ওয়েট ঘোরাতে ঘোরাতে বলে,’তো প্রভাতি।তুমি তো বোধ হয় এখন আর অরফানেজ সেন্টারে থাকো না।তাই না?’
‘জ্বী ভাইয়া।আমি সাবলেট থাকি।রামপুরায়।’
‘পড়ছো কিসে?’
‘জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়।’
‘যাক।ভেরি গুড।’
প্রভাতি জবাবে সামান্য হাসল।ক্ষণকাল গড়াতেই চাপা কন্ঠে বলল,’আপনাকে একটা কথা বলার ছিল ভাইয়া।’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ বলো না।কোনো সমস্যা নেই প্রভা।তুমি যেকোনো সমস্যা আমাকে বলতে পারো।তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে নাকি?’
‘না না।আমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
‘তাহলে?’
‘আমার ফ্রেন্ডের সমস্যা হচ্ছে।’
‘কি সমস্যা?’ আরহাম ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়।
প্রভাতি চেহারায় সামান্য ভাবগাম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে।অত্যন্ত শান্ত হয়ে বলে,’নিলয় নামে আমার একজন বন্ধু আছে।সে আর আমি একই ঘাটের মাঝি।তারও মা বাবা কেউ নেই।নিলয় একটু সরল প্রকৃতির ছেলে।অনেকটা ধার্মিকও বটে।আবির,দ্বীপ তাদের তো নিশ্চয়ই চেনেন।আপনাদের দলেরই ছেলে।তারা নিলয় কে শুরু থেকেই অকারণে র্যাগ দিতো।নিলয়কে মারধর করলেও বা কি?তার তো দুই কুলে কেউ নেই।নিলয়ের দাঁড়ি থাকা নিয়েও তাদের সমস্যা।নিলয় একবার তাদের প্রতিবাদ করাতে তাকে শিবির বলে পুলিশের হাতে তুলে দিলো।অথচ নিলয়ের রাজনীতির সাথে কোনো সম্পৃক্ততা নেই।সে সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক মানুষ।কিন্তু তা স্বত্বেও শুধুমাত্র ভাইদের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে টু শব্দ করার অপরাধে নিলয়কে সাতদিন জেলে থাকতে হলো।তারপর থেকে সে আর কোনো প্রতিবাদই করে না।বড় ভাইরা যাই করে সব মেনে নেয়।নিলয়ের না হয় অভিযোগ করার জায়গা নাই।কিন্তু আমার তো অভিযোগ করার জায়গা আছে।আমার তো আরহাম ভাই আছে।তাই আমি এতো গুলো বছর পর আপনার কাছে ছুটে এলাম।কারণ আমি জানি পুরো পৃথিবী নোংরা রাজনীতি তে জড়িয়ে গেলেও আরহাম ভাই এমন কিছু করবে না।আজিজ আঙ্কেলের ছেলে তো তারই মতো হবে তাই না?’
তার কথা শুনেই আরহাম বিষম খায়।একহাত মুখে চেপে কতোক্ষণ কাশে।প্রভাতি আশ্চর্য হয়ে শুধায়,’কি হয়েছে ভাইয়া?পানি খাবেন?’
আরহাম কাশি থামানোর চেষ্টা করতে করতে জবাব দেয়,’না না দরকার নেই।’
প্রভাতি তার কাশি পুরোপুরি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করে।সে একটু স্থির হতেই তার দিকে ভীষণ উৎসাহী চোখ মেলে দেখে বলে,’ভাইয়া! আপনি কিছু বলবেন না তাদের?নিলয় ছেলেটার কিন্তু কোনো দোষ নেই।’
আরহাম চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলল।প্রভাতির প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী মুখটা দেখেই তার ভেতরটা সামান্য আন্দোলিত হয়।সে গাঢ় এবং জোরাল গলায় তাকে আশ্বস্ত করে,’অবশ্যই।অবশ্যই আমি তাদের কিছু বলব প্রভা।তুমি আমাকে বিচার দিয়েছ,আর আমি সেটা শুনব না সেটা কি করে হয়?তোমার বন্ধুকে বলে দিবে তার আর কোনো চিন্তা নেই।আমি আমার ছেলেদের বলে দিব।তুমি নিশ্চিন্ত থাকো প্রভাতি।’
চলবে-