কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৫২+৫৩

0
23

#কোনো_এক_শ্রাবণে [তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫২)

ওয়াজিদ বাড়ি ফিরল অত্যন্ত বিক্ষিপ্ত মেজাজে।আরহামের উপর তার ভয়ানক রকমের রাগ হচ্ছে,রাগের চেয়েও বেশি অভিমান হচ্ছে।অমন দুম করে মুখের উপর বলে দিলো সে তার সংসারে অশান্তি করছে?ওয়াজিদ তার সংসারে ঝামেলা বাধাচ্ছে?নাকি সে নিজেই অমন কাজ করছে?একে তো সে নিজে যা খুশি তা করছে,তার উপর ওয়াজিদকে খোঁচা দিয়ে কথা বলছে।ওয়াজিদ ফোস ফোস করে কয়েকটা শ্বাস ছেড়ে দরজার লক ঘুরিয়ে বাড়ির ভেতর এলো।আরহামকে সে ভালোর জন্যই সাবধান করেছে।সে ইদানিং যা করছে,তার নিজের দোষেই তার সংসারে ঝামেলা হবে।হোক গিয়ে।ওয়াজিদের কি?সে ঐ বেয়াদবের কোনো বিষয়ে এখন থেকে নাক ই গলাবে না।থাকুক সে তার মতো।সে আর তার নোংরা রাজনীতি।এসব ছাড়া তার জীবনে আর আছে টা কি?

সে বসার ঘর পর্যন্ত হেঁটে আসতেই কোথা থেকে সামান্য তরল সবেগে ছুটে এসে তার গায়ে পড়ল।ওয়াজিদ লাফিয়ে উঠে দুই কদম পিছিয়ে গেল।বুকে আর বাহুতে হাত রেখে তরলটুকু স্পর্শ করেই বুঝল এটা পানি।সে ঘাড় ঘুরিয়ে এ’পাশ ঐ’পাশ দেখে।

নিহাদ দেয়ালের ওপাশ থেকে মাথা বের করে বসার ঘরে উঁকি দেয়।তার দুষ্টুমি ভরা মুখটা দেখতেই ওয়াজিদ চোখ পাকায়।নিহাদ তার খালাতো বোনের ছেলে।সে এগিয়ে এসে খপ করে তার হাতটা ধরে তাকে নিজের মুখোমুখি এনে দাঁড় করালো।চোখ পাকিয়ে বলল,’কিরে নিহাদ?তুই কখন এলি?দিয়া কোথায়?’

নিহাদ নিজের আঙুল কা’মড়াতে কা’মড়াতে মাথা নেড়ে বলল,’মাম্মাম নানুমনির ঘরে।’

‘মাম্মাম নানুমনির কাছে,আর তুই এই সুযোগে ওয়াটার গান দিয়ে আমার শার্ট ভেজাচ্ছিস?’

ওয়াজিদের খানিকটা ধমক মেশানো কন্ঠে ভীত হয়ে নিহাদ সঙ্গে সঙ্গে হাত নেড়ে বলল,’না না।আমি তোমাকে ভেজাতে চাইনি মামা।মামানি আমাকে বলেছে তুমি আসলে যেন তোমার উপর ফায়ারিং করি।’

ওয়াজিদ কোমরে হাত রেখে মুখ বাঁকা করে বলল,’ওহহ,এইসব তোর মামানির কাজ।তো সে কোথায় এখন?’

‘তোমার ঘরে।’

‘আমার ঘরে?কি করে?’

‘জানি না।ঢুকতে দেয় না।’

ওয়াজিদ ঠোঁট উল্টে তাড়াতাড়ি সামনের দিকে এগিয়ে যায়।তারপরই কিছু একটা ভেবে পুনরায় পিছিয়ে এসে নিহাদের হাত থেকে ওয়াটার গান টা নিয়ে মুচকি হেসে বলে,’দাঁড়া! কিছুক্ষণের জন্য এটা আমাকে দে।’

বলেই সে ধুপধাপ পায়ে সিঁড়ি ডিঙিয়ে দোতালায় উঠল।দোতালার পূর্ব পাশে তার রুম।রুমের সামনে এসেই সে দেখল দরজা চাপিয়ে রাখা।সে আস্তে করে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে উঁকি দেয়।

রিমি খাটের এক পাশে বসে আছে।দরজার দিকে পিঠ করে আছে বিধায় সে কি করছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না।ওয়াজিদ নিঃশব্দে দরজা ঠেলে ভেতরে এলো।

হঠাৎ পিঠে সামান্য পানি ছলকে পড়তেই সে লাফিয়ে উঠে।পানির উৎস খুঁজতে পেছন ফিরতেই ওয়াজিদ তার হাতের ওয়াটার গানটা রিমির মুখ বরাবর তাক করে আরো কয়েক দফা ফায়ারিং করল।রিমি কতোক্ষণ ভ্যাবলার মতো তাকে দেখল।তারপরই চটজলদি নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে বলল,’এসব কি?আপনি কি নিহাদের মতো বাচ্চা হয়ে গেছেন?’

ওয়াজিদ মুখে হাসি ধরে রেখেই গুনে গুনে তিন পা সামনে এগোয়।চাপা কন্ঠে উত্তর দেয়,’হ্যাঁ হয়েছি।তোমার সমস্যা?’

বলেই সে রিমির মুখে আরো একবার গান দিয়ে পানি ফেলল।রিমি দ্রুত নিজের মুখ ঢেকে নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে বলল,’ধ্যাত! ভাল্লাগে না সবসময়।’

ওয়াজিদ থমথমে মুখে তাকে দেখে।তারপরই গম্ভীর হয়ে বলে,’আচ্ছা আমি চলে যাচ্ছি।তুমি থাকো এদিকে।’

রিমি দ্রুত মুখের সামনে থেকে হাত সরায়।তার সামনে থাকা টগবগে যুবকটির দরজার দিকে এগিয়ে যাওয়া পদযুগল দেখেই ছুটে গিয়ে তার একটা হাত চেপে ধরে।অত্যন্ত তাড়াহুড়ো করে বলে,’আহা! আপনি আবার মন খারাপ করছেন কেন?এভাবেই বলেছি।আপনার ঘর ছেড়ে আপনি যাবেন কেন?বোকা নাকি?’

ওয়াজিদ চোখ তুলল।মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে নিচু স্বরে বলল,’হুম।তোমার সাথে থেকে থেকে একটু বোকাই হয়েছি বোধহয়।’

সে হেঁটে গিয়ে খাটের ধার ঘেঁষে বসল।রিমি কিছুক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে হঠাৎই কিছু একটা মনে পড়তেই এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।ভ্রুদ্বয় আপনাআপনি কুঁচকে নিল ওয়াজিদ।এই মেয়ে হঠাৎ এমন ছুটোছুটি শুরু করেছে কেন?

রিমি ফিরল তিন মিনিট পরে,হাতে একটা পানির গ্লাস নিয়ে।সে হাঁপাতে হাঁপাতে গ্লাসটা ওয়াজিদের সম্মুখে বাড়িয়ে দেয়।কোনোরকমে শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে বলে,’নিন।পানি খান।’

‘আশ্চর্য! পানি কেন খাবো?আমার কি পিপাসা পেয়েছে নাকি?’

‘পিপাসা না পেলেও খেতে হবে।মা বলেছে আপনি বাড়ি আসলেই যেন আপনাকে এক গ্লাস পানি এনে দেই।’

ওয়াজিদ স্মিত হেসে গ্লাসটা হাতে নিল।ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করে প্রসন্ন হেসে বলল,’গুড গার্ল।এবার একটু চুপচাপ এখানে এসে বসো।’

রিমি এক ডাকেই তার পাশাপাশি এসে বসল।ওয়াজিদের পাশ ঘেঁষে বসতে তার ভালো লাগে।বিয়ের পর সারাদিন তার বরের পেছন পেছন ঘুরতে ইচ্ছে করে।শুরুতে ওয়াজিদ কিছুটা এড়িয়ে চলতো তাকে।এখন অবশ্য সেই জড়তা অনেকটাই কেটে গেছে।এখন দু’জন বেশ সময় নিয়ে গল্প করে।গল্পের কোনো সুনির্দিষ্ট বিষয়বস্তু নেই।এমনিই যা মাথায় আসে,তাই নিয়ে এদের আলোচনা।ওয়াজিদকে তার ভীষণ ভালো লাগে।তাকে দেখামাত্রই রিমির চিৎকার ছুড়ে বলতে ইচ্ছে করে,’আপনাকে আমার এত্তো বেশি ভালো লাগে।আপনার আমাকে কেমন লাগে?’

তখন নিশ্চয়ই ওয়াজিদ মুখ কুঁচকে বলেবে,’আমার তোমাকে একদমই ভালো লাগে না।’ এই না শোনার ভয়ে রিমি এখন পর্যন্ত নিজের মনের কথা চেপে রেখেছে।প্রত্যাখ্যানে রিমির ভীষণ ভয়।

ওয়াজিদ খাটের উপর ছড়িয়ে রাখা কাগজপত্র গুলো দেখে জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,’এসব আবার কি?’

রিমি ঘাড় ঘুরিয়ে দুইটা কাগজ হাতে নেয়।কাগজের দুই পাশ নেড়ে চঞ্চল গলায় বলে,’এগুলো আর্ট পেপার ওয়াজিদ।’

‘বাপরে! তুমি কি আর্ট করা শুরু করবে নাকি?ফিজিক্স থেকে ডিরেক্ট আঁকাআঁকিতে!’

রিমি শব্দ করে হাসল।দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’ধুর না।আমি এসব আর্ট করতে জানি না।আমি তো আপনার ছবি স্কেচ করব ভাবছি।’

‘সর্বনাশ! এতো মানুষ থাকতে আমিই কেন তোমার জঘন্য এক্সপেরিমেন্টের শিকার হবো?’

রিমি গালভর্তি হেসে বলল,’কারণ আপনি হচ্ছেন আমার স্বামী।স্বামী ছাড়া অন্য লোকের স্কেচ আমি কেন করব?আমার তো পাপ হবে।’

ওয়াজিদ কতোক্ষণ গোল গোল চোখ করে তাকে দেখল।তারপরই আচমকা হো হো করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতেই পেটে একটা হাত চেপে বলল,’আল্লাহ! তুমি যে কিসব বলো! অন্য লোককে আঁকবে না পাপের ভয়ে।আর স্কেচ যে করছ,এটা কি খুব পূণ্যের কাজ?’

‘অতোকিছু বুঝি না।কিন্তু আমি কয়েকটা টিউটোরিয়াল দেখেছি।এবার মনে হচ্ছে আমি আপনাকে এঁকেই ফেলব।এঁকে একদম তাক লাগিয়ে দিব।’

ওয়াজিদ ক্লান্ত শরীরটা খাটে এলিয়ে দিয়ে আরো কিছুক্ষণ হাসল।হাসতে হাসতেই ঘাড় বাঁকা করে পাশ ফিরে বলল,’এক কাজ করো।তুমি এখনই স্কেচিং শুরু করে দাও।এই যে আমি শুয়ে আছি।তুমি এখন আমাকে দেখে দেখে টাইটানিক মুভির মতো একটা স্কেচ শুরু করো।’

রিমি গালের নিচে হাত রেখে ওয়াজিদের হাসিখুশি মুখটা দেখে।তারপরই ঠোঁট টিপে বলে,’ছিহ! কিসব অশ্লীল কথা!’

ওয়াজিদও বিনিময়ে একগাল হাসি উপহার দিয়ে বলল,’উহু।আমি রোজের মতো জামাকাপড় খুলছি না।তুমি বরং শার্ট প্যান্ট পরা লোকের স্কেচই করো।’

রিমি খিলখিল করে আর্টপেপারটা খাটে রেখে বলল,’আপনি যে এমন হাসিখুশি সেটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না।’

‘বাইরে থেকে বোঝার তো প্রয়োজন নেই।ভেতর থেকে বুঝো।তাহলেই হবে।’
.
.
.
.
আদি হন্তদন্ত হয়ে কেবিনের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।মলিন চোখ জোড়া তার দর্শন পেতেই ভাঙা গলায় বলল,’হেই ড্যুড।লুক এ্যাট মি।’

আদি সামনে দেখেই মুখ হা করে বলল,’কিরে কিরে! এতো খানি ইঞ্জুরড হলি কেমন করে?নিজ থেকে দৌঁড়ে গিয়ে গাড়ির নিচে শুয়ে গিয়েছিলি নাকি?’

সে দ্রুত হেঁটে ইজমার মুখোমুখি হয়ে বসল।একটু আগে একটা অপরিচিত নম্বরের কল রিসিভ করার পর সে জানতে পেরেছে ইজমা দেশে ফিরেছে।ফিরে নাকি আবার এক্সিডেন্টও করে ফেলেছে।আদি সেই খবর পেতেই এক প্রকার ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে এসেছে।

ইজমা তার সুন্দর মুখখানা অমাবস্যার গভীর রজনীর ন্যায় কালো করে বলল,’আর বলিস না এই কথা।সিএনজিতে ছিলাম।পেছন থেকে ট্রাক এসে উড়িয়ে দিলো।’

‘বলিস কি?ডেঞ্জারাস ব্যাপার।বেঁচে আছিস যে এটাই তো অনেক।’

‘অবশ্যই।প্রথম ধাক্কা খেয়ে তো মনে হচ্ছিল অর্ধেক মনে হয় আল্লাহর কাছে চলেই গিয়েছি।’

বলেই সে সামান্য হাসার চেষ্টা করল।আদি চেহারায় একটা দুঃখ দুঃখ ভাব ফুটিয়ে বলল,’আহারে! তোর খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না?’

‘দুইটা ফ্রেকচার! তুই বুঝিস?শরীর ব্যথায় শেষ।কষ্ট না হয়ে কি আরাম হবে?’

‘থাক থাক।ব্যাপার না।সুস্থ হয়ে যাবি।’

আদি কথা শেষ করেই নিজের মুখোভঙ্গি পাল্টে কিছুটা ধমকের সুরে বলল,’দোষ তো তোরও আছে।দেশে আসবি,এই কথা আগে জানাবি না?জানালে তো আমিই এয়ারপোর্টে যেতাম তোকে রিসিভ করতে।’

‘সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম তোকে।তোকে জানিয়ে দিলে সারপ্রাইজ হতো?এসব যে হবে তা তো ভাবিনি।’

‘বেশ হয়েছে।পাকনামি করলে এমনই হয়।এখন পড়ে থাক ভাঙা হাত নিয়ে পনেরো দিন।’

ইজমা কেবিনের শুভ্র রঙের দেয়ালে চোখ রেখে বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।দীর্ঘসময় বসে থাকতে থাকতে তার কোমরে যন্ত্রণা হচ্ছে।হাত দু’টোতে থেমে থেমে একটু পর পর ব্যথা শুরু হয়।

আদি তার যন্ত্রণায় কাঁতর মুখটা দেখেই করুণ স্বরে বলল,’কিরে ইজমা?বেশি কষ্ট হচ্ছে?’

‘ঐ তো একটু।’

আদি তার অক্ষত হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল।তার উপর নিজের আরেকটা হাত রেখে গাঢ় স্বরে বলল,’ব্যাপার না।এই তো কিছুদিন।এরপরই সুস্থ হয়ে যাবি।’

ইজমা বিনিময়ে মিষ্টি হাসল।সে হাসির মাঝেই কোমল গলায় বলল,’তুই চলে এসেছিস না?তোকে দেখেই তো আমার মন ভালো হয়ে গেছে।এতোক্ষণ কেমন এতিম এতিম লাগছিল।এখন অনেক ভালো লাগছে।’

‘কি অদ্ভুত! আমি কি তোর বাপ নাকি?আমাকে দেখেই তোর এতিম ভাব কেটে গেল! পাগল নাকি রে তুই?’

ইফাজ কেবিনের সামনে এসে ভেতরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে দরজার কাছেই কিছুক্ষণ দাঁড়ালো।সম্ভবত এটাই সেই ছেলে যাকে ইজমা ফোন দিয়েছিল।ছেলেটার মুখটা চেনা চেনা লাগছে।হয়তো দেখেছে কোথাও।

ইজমা একহাতে তার মুখের সামনে উড়ে আসা চুলগুলো সরিয়ে নিয়ে বলল,’তোর ভরসায় এতো বছর পর দেশে এসেছি আদি।ভাবলাম তুই চলে এলে আর সুযোগ পাব না।তাই তুই থাকতে থাকতেই বাংলাদেশ দেখতে চলে এলাম।ভালো করেছি না বল?’

আদি মাথা চুলকে বলল,’তা অবশ্য ভালোই করেছিস।কিন্তু আমি নিজেই তো শরনার্থী।তোকে কোথায় জায়গা দিব?’

‘উহু।আমার থাকা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।আমার রিলেটিভস আছে এখানে।তুই বল তোর দিনকাল কেমন যাচ্ছে?তোর ঐ আদরের বাচ্চার কি খবর?’

‘তাসনুভা?আরে আর বলিস না।তোর কথা বললাম তাকে।সে বলল সে তোর সাথে দেখা করতে চায়।’

‘তাই নাকি?তুই বলিস নি তুই যে তার আর তার ভাইয়ের কথা বলতে বলতে আমার কানের পোকা সব বের করে ফেলিস?’

***

তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে
নিবিড় নিভৃত পূর্ণিমানিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে
মম জীবন যৌবন, মম অখিল ভুবন
তুমি ভরিবে গৌরবে নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে||

সুমিষ্ট নারী কন্ঠের চমৎকার সংগীতের শব্দে দরজা পর্যন্ত এসেই পদযুগল থমকে গেল আরহামের।সে অত্যন্ত সাবধানে কোনো শব্দ না করে ভেতরে উঁকি দিলো।

নবনীতা জানালা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।তার দুই হাত এক করা।চুলগুলো পুরোপুরি উন্মুক্ত।সেই উন্মুক্ত অবাধ্য কেশ তাকে বারংবার জ্বালাতন করছে।নবনীতা সেই জ্বালাতনে অতিষ্ঠ হলো না।তার কোমল,স্নিগ্ধ,অতিমাত্রায় মিষ্টি মুখশ্রী দৃষ্টিগোচর হতেই আরহাম চওড়া হাসল।ছোট ছোট পায়ে এগিয়ে ঠিক তার পাশাপাশি গিয়ে দাঁড়াল।

নবনীতা তার অস্তিত্ব টের পেতেই নড়েচড়ে উঠল।কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’আপনি এসেছেন! সরি,আমি খেয়াল করিনি।’

আরহাম তার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরল।মাথা নিচু করে তার আঙুলের ভাঁজে পর পর কয়েকটা চুমু খেল।নবনীতা সদ্য প্রেমে পড়া কিশোরীর ন্যায় লজ্জায় কিছুটা আড়ষ্ট হয়।মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলে,’দরজা খোলা।রহিমা খালা পাশের ঘরে কাজ করছে।’

‘করুক।তুমি গান থামালে কেন?গাও না।অনেক ভালো লাগছে শুনতে।কার গান এটা?’

‘এটা রবীন্দ্র সংগীত।’

‘ওহহ আচ্ছা।সুন্দর তো।গাও তুমি।’

নবনীতা জানালা দিয়ে পুনরায় বাইরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।আকাশের এক ফালি বাঁকা চাঁদ,নিস্তব্ধ নিশুতি,নবনীতা,আর পাশে তার প্রিয়তম।গান গাইতে এর চেয়ে চমৎকার পরিবেশ আর কি হতে পারে?সে আগের মতো করেই পুনরায় গান ধরে,

জাগিবে একাকী,তব করুণ আঁখি,
তব অঞ্চলছায়া মোরে রহিবে ঢাকি।
মম দুঃখবেদন, মম সফল স্বপন
মম দুঃখবেদন, মম সফল স্বপন
তুমি ভরিবে সৌরভে নিশীথিনী-সম
তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম
তুমি রবে নীরবে||

সে গান শেষ করতেই আরহাম হাততালি দিয়ে বলল,’চমৎকার! দারুণ হয়েছে পরী।তুমি এখন থেকে রোজ রাতে আমায় একটা করে গান শোনাবে।ঠিক আছে?’

বলেই সে তার পকেট থেকে চার-পাঁচটা বেলি ফুল বের করে নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’বাগানে পড়েছিল।দেখেই তোমার জন্য নিয়ে এলাম।’

নবনীতা আলগোছে হাসল।খুব সাবধানে ফুলগুলো হাতের মুঠোয় নিল।তারপর নাকের কাছে এনে টেনে টেনে ঘ্রাণ নিল।বেলী হওয়া দরকার ছিলো ফুলের রানী।এতো সুন্দর ঘ্রাণ,এতো বেশি শুভ্রতা ছড়ানো ফুল থাকা স্বত্তেও গোলাপ নিয়ে মানুষ এতো মাতামাতি করে কেন?তারা কি বেলীর সুঘ্রাণে অদ্ভুত রকমের প্রশান্তি খুঁজে পায় না?সেই প্রশান্তি কি অন্য কোনো ফুলের ঘ্রাণে আছে?

আরহাম হাতমুখ ধুয়ে খাটে বসতেই নবনীতা চুপচাপ হেঁটে এসে তার পাশাপাশি বসল।আরহাম জিজ্ঞাসু হয়ে তার দিকে তাকাতেই সে তার মাথাটা আরহামের কোলে রেখে বেড়াল ছানার মতো গুটিশুটি মেরে শু’য়ে পড়ে।বুকটা আচমকাই ধ্বক করে উঠে তার।মনে হচ্ছে হৃদসম্পন্দ হঠাৎই থেমে গেছে।সে একটা ঢোক গিলে কাঁপা কন্ঠে বলে,’কি হয়েছে পরী?তোমার কি মন খারাপ?’

জড়ানো কন্ঠে অতি ক্ষুদ্র উত্তর আসে,’জ্বী।’

‘কেন?কেউ কিছু বলেছে?’

‘নাহ।এমনিই।’

আরহাম নিশ্চিন্ত হয়ে হাঁফ ছাড়ে।নবনীতা তার হাতটা নিজের মাথায় রেখে ক্ষীণ কন্ঠে বলে,’মাথায় হাত বুলিয়ে দিন আরহাম।’

আরহাম তার কথা শুনতেই একগাল হাসল।অত্যন্ত যত্নে,সীমাহীন ভালোবাসায় সে সহধর্মিণীর মাথায় হাত ছোঁয়ায়।এই মেয়েটাকে সে কতোখানি ভালোবাসে সেটা কি সে জানে?কোনোদিন সেই ভালোবাসা মাপতে পারবে সে?জীবনের বিভিন্ন অধ্যায়ে আরহাম বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছে।এই চমৎকার মেয়েটির সান্নিধ্যে সে সুপুরুষ ব্যতীত অন্য কোনো ভূমিকা পালন করে নি।মেয়েটি তার কাছে সদ্য প্রস্ফুটিত পদ্ম ফুলের ন্যায়।সে তাকে তেমন ভাবেই যত্ন করেছে।তার ছলনা,কপটতা,স্বার্থপর আচরণের কোনোটাই এই নিষ্পাপ মেয়েটিকে ছুঁতে পারেনি,আরহাম ছুঁতে দেয় নি।সে মাথা নামিয়ে তার কপালে,চোখের পাতায়,গালে গাঢ় করে চুমু খায়।চব্বিশে পৌঁছে যাওয়া মেয়েটা সেই আদর পেতেই আবেশে চোখ বুজে নেয়।

দূর আকাশে মেঘ জমা হচ্ছে।ঘন কালো মেঘ একত্রিত হচ্ছে কালবৈশাখীর তান্ডব চালানোর জন্য।সেই তান্ডবে একটি স্বচ্ছ,সুন্দর আর নির্মল সংসার ভেঙে চুরমার হবে।নবনীতার স্বপ্ন গুলো গ্যাস বেলুনের মতো হাওয়া ছেড়ে দূর আকাশে মিলিয়ে যাবে।সেই তান্ডবের গর্জন নবনীতার কান অব্দি এখনো পৌঁছায়নি।সাজানো গোছানো,স্বপ্নের ন্যায় সুন্দর সংসারটা তুমুল ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হতে অপেক্ষা মাত্র কয়েক দিবসের।
.
.
.
.
পাবলিক ট্রান্সপোর্ট প্রভাতির জন্য এক আতঙ্কের নাম।সামনের দিকে মহিলাদের জন্য বরাদ্দকৃত সিটগুলো পেলে তো হলোই।নয়তো সেই ছেলে মানুষদের ঠেলেঠুলে বাসে ঝুলে ঝুলে মেসে ফিরতে হয়।

আজ প্রভাতির ভাগ্য সুপ্রসন্ন হয়নি।সে বাসের ভেতর এক পা রেখেই আঁতকে উঠে।হেল্পার শালাটা বলেছে ম্যাডাম বাস একদম খালি।তাড়াতাড়ি উঠুন।সেও গাধির মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বাসে উঠেছে।কিন্তু উঠার পর মনে হচ্ছে এখানে সুঁচ ঢোকানোর জায়গাও নেই।সে কটমট চোখে হেল্পার ছেলেটার দিকে তাকায়।হেল্পারের মনোযোগ অবশ্য তার দিকে নেই।সে বাসের দরজায় দাঁড়িয়ে মাথা বের করে চিৎকার ছুড়ছে,’রামপুরা রামপুরা।আরো পাঁচটা সিট খালি।’

প্রভাতির মেজাজ গরম হয়।সে খ্যাক খ্যাক করে বলল,’এ্যাই ছেলে!মিথ্যা কথা বলো কেন?কোথায় সিট আছে বাসে?আর নতুন মানুষ এলে দাঁড়াবে কোথায়?দাঁড়ানোর জায়গাও তো নেই এখানে।’

হেল্পার ছেলেটা তার কথার কোনো তোয়াজ করল না।একেবারে সস্তা মানের কৌতুকের মতো সবকিছু উড়িয়ে দিয়ে সে পুনরায় বাসে মানুষ তোলার কাজে লেগে পড়ল।প্রভাতি আশাহত হয়ে একটু সামনে এগিয়ে শক্ত করে ধরার মতোন একটা অবলম্বন খুঁজল।

‘প্রভাতি!তুমি?’

সে ঘাড় ঘুরায়।অত্যন্ত বিস্ময় মাখা কন্ঠে শুধায়,’নিলয়! তুমি?’

নিলয় দ্রুত তার সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।চোখ দিয়ে নিজের সিটের দিকে নির্দেশ করে বলল,’বসো না প্রভাতি।আমি একটু সামনেই নেমে যাব।তুমি বসো।’

প্রভাতি এক বলাতেই সে প্রস্তাব লুফে নিল।তাড়াহুড়ো করে নিলয়ের সিটটা দখল করেই হাঁফ ছেড়ে বলল,’থ্যাঙ্কু নিলয়।তোমায় নাম ধরে ডাকছি বলে কিছু মনে করো না।আসলে আমার একটা বছর ড্রপ গিয়েছিল তো।সেই হিসেবে আমরা সমবয়সীই।’

নিলয় অমায়িক হেসে তার দিকে তাকায়।
‘নাহ প্রভাতি।আমি কিছু মনে করিনি।’

প্রভাতি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে সময় দেখল।নিলয় দাঁড়িয়েছে একদম তার পাশাপাশি।এটাতে তার ভালোই হয়েছে।অন্য কোনো ছেলে তার গা ঘেঁষে দাঁড়াতে পারছে না।

‘প্রভাতি! তুমি কি রামপুরাই নামছ?’

‘হুম।তুমি?’

‘বাড্ডায়।’

প্রভাতি কতোক্ষণ উসখুস করল।তারপর মাথা তুলে বলল,’প্রভাতি নামটা খুব বিশাল।তুমি আমাকে প্রভা বলেই ডাকো।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।প্রভা বলেই ডাকব।’

‘তার আগে বলো কোনটা বেশি সুন্দর?প্রভাতি নাকি প্রভা?’

নিলয় হাসল।মাথা চুলকে বলল,’দু’টোই সুন্দর প্রভা।দু’টোরই একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে।আমি না হয় যখন যেটা মুখে আসে সেটাই বলব।’

প্রভাতির এই প্রস্তাব পছন্দ হলো।সে মাথা নেড়ে পা দুলিয়ে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।দু’টোই বলবে।আগে বলো,কাল ভার্সিটি যাচ্ছো?আমি কিন্তু কালও তোমার ডিপার্টমেন্টের সামনে আসবো বলে দিলাম।’

বাস বাড্ডা পর্যন্ত আসতেই নিলয় লাফিয়ে লাফিয়ে কোনোরকমে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।গরমে আর মানুষের ভীড়ে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল।এখন খোলা রাস্তায় এসে তার কিছুটা আরাম লাগছে।

‘নিলয়! নিলয়! দাঁড়াও।’

গলির মাথা থেকে একটু ভেতরে যেতেই স্বল্প পরিচিত কন্ঠের ক্রমাগত সম্বোধনে নিলয় ঘুরে দাঁড়ালো।আশ্চর্য হয়ে বলল,’প্রভা তুমি?’

প্রভাতি ছুটতে ছুটতে তার সামনে এলো।দৌড়ে দৌড়ে সে হাঁপিয়ে উঠেছে।নিলয়ের কাছাকাছি এসেই সে সামান্য ঝুকে দুই হাটুতে হাত রেখে শ্বাস টানতে টানতে বলল,’তুমি যাওয়ার পর কেমন কেমন যেন লাগছিল বাসে।তাই নেমে চলে এসেছি।’

‘অদ্ভুত তো।আমি কি রোজ তোমার সাথে থাকি নাকি?কেমন কেমন লাগার কি আছে?’

‘জানি না।’

‘এখন?মাঝপথে যে নেমে গেলে,এখন বাড়ি যাবে কেমন করে?’

প্রভাতি দাঁত দিয়ে কতোক্ষণ নিজের নখ কা’মড়ায়।তারপর কংক্রিটের রাস্তা দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে,’তুমি এখন কোথায় যাবে?’

‘হোটেলে যাব।খিদে পেয়েছে খুব।’

‘আমাকেও তাহলে তোমার সাথে হোটেলে নিয়ে যাও।’

‘তুমি হোটেলে যাবে?সেখানে তো মেয়ে তেমন কেউ যায় না।তোমার আনইজি লাগবে না?’

‘আনইজি লাগবে কেন?তুমি আছ না আমার পরিচিত?তাছাড়া আমি খেতে যাচ্ছি না।তুমি খাবে,আর আমি বসে থাকব।’

নিলয় সূক্ষ্ম চোখে আগাগোড়া মেয়েটাকে পরোখ করে।তার পরনে গাঢ় টিয়া আর সাদার মিশেলে একটা সাদামাটা কুর্তি।মুখে প্রশস্ত হাসি।আচরণ অতিমাত্রায় মিশুক প্রকৃতির।সে ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে বলল,’আচ্ছা চলো।আমার ভীষণ খিদে পেয়েছে।খাওয়া শেষ করে বাকি কথা বলছি।’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে[তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৫৩)

ভাতের প্লেট টা টেবিলের উপর রাখার শব্দেই নিলয়ের হুশ ফিরে।সে একনজর প্লেট টা দেখেই সেটা টেনে নিজের আরো কাছাকাছি আনে।তারপরই কোনোদিকে না দেখে বড় বড় লোকমা তুলে সেটা খেতে আরম্ভ করে।

প্রভাতি গালের নিচে হাত রেখে তার কর্মকাণ্ড দেখে।তারপর আনমনেই হাসে।নিলয়কে এখন বাচ্চাদের মতোন দেখাচ্ছে।সে সবজির বাটিটা ধীরে সুস্থে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’নাও সবজি খাও।মুরগি অথবা মাছ খাবে না?শুধু সবজি দিয়ে কিভাবে খাবে?’

নিলয় দ্রুত বাম হাত নেড়ে বলল,’না না।আমি আর কিছু খাবো না।চলবে আমার।’

‘আরে এতো কিপ্টেমি করতে হবে না।আজ বিল আমিই দিব।’

নিলয় হাতে তোলা লোকমাটা পুনরায় প্লেটে রেখে মাথা তুলে বলল,’কেন?তুমি কেন দিবে?’

‘এভাবেই।দিলে কোনো সমস্যা?’

‘সমস্যা না বলছ?চেনো না,জানো না একজনের বিল তুমি কেন দিবে?’

‘চিনি না কোথায়?একই ভার্সিটিতে পড়ি।বিল পরিশোধ করার জন্য এইটুকু চেনাজানাই যথেষ্ট।’

প্রভাতি নিজ থেকে ওয়েটারকে ডেকে ডিম ভুনা আর মুরগির মাংসের তরকারি নিল।বাটি দু’টো নিলয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’নাও।এটা খাও।পরে কথা বলবে।’

নিলয় আড়চোখে একবার তাকে দেখল।তারপর আবার নিজের খাওয়ায় মন দিলো।তার খাবার শেষের দিকে আসতেই প্রভাতি সহজ গলায় প্রশ্ন করল,’তোমার বাড়িতে কে কে আছে?এখানে কি মেসে থাকো নাকি বাসায়?’

নিলয় থামল।এক ঢোক পানি গিলে প্রভাতির দিকে দেখে বলল,’মেসে থাকি।পাঁচজন মিলে।’

‘ওহ।’
‘তুমি কিন্তু আমার প্রথম প্রশ্নের জবাব দাও নি।’

নিলয় পুরোপুরি খাওয়া শেষ করল।তারপর গিয়ে বেসিনের সামনে থেকে হাত মুখ ধুলো।ওয়েটারের থেকে একটা টিস্যু নিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,’আমার বাড়িতে কেউ নেই।আমি একাই।’

‘মা বাবা কেউ নেই?’

‘নাহ,বাবা অনেক আগে মারা গেছে।মা মারা গেছে দুই বছর আগে।’

প্রভাতি প্রথমে কিছুক্ষণ মলিন মুখ করে নিলয় কে দেখল।তারপরই তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে মিষ্টি হেসে বলল,’হ্যান্ডশেক করো।আমারও কেউ নেই।একদম তোমার মতো।’

নিলয় তার হাতটা দেখল,তবে ধরল না।কেবল চোখ সরু করে বলল,’তুমি থাকো কার সাথে?’

‘আমি?আমি সাবলেট থাকি।মাধ্যমিক পর্যন্ত অনাথ আশ্রমে ছিলাম।কলেজে উঠার পর নিজেই টুকটাক আয় করি।তখন থেকেই আলাদা থাকি।’

‘ওহ।’

প্রভাতি সত্যি সত্যিই সেদিন পুরো বিল দিলো।নিলয়ের দুপুরের খাবার বাবদ যতো টাকা খরচ হলো,তার পুরোটাই সে বহন করল।নিলয় তাজ্জব হয়ে বলল”তুমি আমার বিল কেন দিচ্ছ?আমি কি বেকার নাকি?আমি নিজেও টিউশন করাই।’

‘উহু।আমি এমনিই দিয়েছি।তুমি খুব সুন্দর করে ভাত খাও।আমার দেখতে ভালো লেগেছে।’

‘ভাত খাওয়াতে সৌন্দর্য থাকে?’

‘হু।থাকে।’

নিলয় সবার আগে বেরিয়ে এলো হোটেল থেকে।প্রভাতি এলো তার পিছু পিছু।পিঠের ব্যাগটা সে বুকের সাথে চেপে ধরেছে।নিলয়ের বড় বড় পায়ের সাথে পা মেলানো তার জন্য কষ্টকর।তাই সে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে তার পাশাপাশি এসে বলল,’তুমি কি আমার উপর বিরক্ত হচ্ছো?’

নিলয় বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে হাঁটার গতি আরো বাড়াতে বাড়াতে জবাব দেয়,’না হচ্ছি না।’

প্রভাতি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’আসলে ক্লাসে আমার সাথে কেউ কথা বলে না তো,তাই তোমার পেছন পেছন ঘুরছি।তুমি জানো,ভার্সিটিতে আমাকে কেউ পাত্তা দেয় না।’

নিলয় থামল।পেছন ফিরে অবাক হয়ে বলল,’কেন?কেউ পাত্তা দেয় না কেন?’

‘কারণ আমি দেখতে অনেক ক্ষেত।এখানে সবাই স্মার্টদের তোয়াজ করে।আমি তো গেঁয়ো,তাই কেউ আমার সাথে কথা বলে না।’

বলেই সে বোকা বোকা হাসে।নিলয় লক্ষ করে কথাটা বলতে গিয়েই মেয়েটার চোখ ছলছল করে উঠেছে।এই চোখের ভাষা নিলয় কিছুটা বুঝে।বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ছাপোষা দের টিকে থাকা একটু কঠিন।প্রভাতি ভুল কিছু বলে নি।মা বাবা ছাড়া জীবন কোনো কুকুর বিড়ালের জীবনের চেয়ে ভালো কিছু না।শীতের রাতে রাস্তার ধাঁরের ল্যাম্পপোস্টের নিচে থাকা কুকুরটা যেমন অসহায়,পিতা মাতাহীন সন্তান মস্ত বড় পৃথিবীতে ঠিক ততোটাই অসহায়।নিলয় সেই অসহায়ত্বের যন্ত্রণা বুঝে।প্রভাতি মেয়ে মানুষ,তার কষ্ট নিলয়ের চেয়ে খানিকটা বেশিই হওয়ার কথা।অথচ মেয়েটার চোখে মুখে সেই কষ্টের ছিটে ফোঁটাও নেই।

প্রভাতি একটা টেম্পু ডেকে দ্রুত লাফিয়ে লাফিয়ে তার একটা সিট নিজের দখলে নিল।নিলয় নিঃশব্দে টেম্পুতে উঠে তার মুখোমুখি এসে বসল।প্রভাতি কপাল কুঁচকে বলল,’তুমি কেন উঠেছ?রামপুরার টেম্পু এটা।’

‘জানি।আমি রামপুরাই যাচ্ছি।কাজ আছে আমার।’

মিনিট দশেকের মাথায় ভাঙাচুরা টেম্পুটা রামপুরা এসে পৌঁছায়।প্রভাতি হাসি হাসি মুখ করে টেম্পু থেকে নেমে আসে।নিলয় একহাত পকেটে গুজে জানতে চায়,’বাসা কোনদিকে তোমার?’

‘এই তো।সামনে গিয়ে বাম দিকে।’

বলা শেষ করেই সে একগাল হেসে রাস্তার একপাশের ছোট একটা গলির দিকে এগিয়ে যায়।নিলয়ের মন চায় তাকে পিছু ডেকে বলতে,’এই প্রভা শুনো! তুমি মোটেও ক্ষেত না।তুমি ভীষণ মিষ্টি।যাদের ডায়বেটিস আছে,তাদের উচিত তোমায় এড়িয়ে চলা।’

সে ততক্ষণ তাকে দেখল যতক্ষণ না তার অবয়ব ছোট হতে হতে একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।সে চোখের আড়াল হতেই নিলয় ব্যস্ত হয়ে রাস্তার দুই পাশ দেখে।তাকে এখন বাড্ডার বাস ধরে উল্টো পথে বাড়ি ফিরতে হবে।
.
.
.
.
রাত একটা তিপ্পান্নো।টিকটিক শব্দ করে দেয়াল ঘড়ি চলছে।চারপাশ এতো নিরব যে সেই শব্দও কর্ণকুহরে বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।নবনীতা মেঝের এক কোণায় চুপচাপ গুটিশুটি মেরে বসে আছে।নোনা জল গাল বেয়ে থুতনি পর্যন্ত নামতেই সে দ্রুত সেটা মুছে নেয়।তার হাত দু’টো অল্প অল্প কাঁপছে।আজ সে একটি জঘন্য আর দুঃসাহসিক কাজ করেছে।

আরহাম আর সে আজ একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল।আরহামের কোনো এক কলিগের ভাইয়ের বিয়ে।উত্তরার একটা নামি দামি রিসোর্টে সেই বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে।নবনীতা যেহেতু আরহামের সহধর্মিণী,তাই সেই সূত্রে সে নিজেও সেই বিয়েতে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল।

ভিআইপি দের সবকিছুই ভিআইপি।নবনীতার মনে হলো বড়লোক আর ভিআইপি শব্দ দু’টোর মাঝে বিশাল পার্থক্য।তার বাবাও তো শিল্পপতি ছিলো।কোথায় তারা তো কখনো এসব প্রটোকল ফোটোকল মেনে চলেনি।সে মুখ চেপে হাসল।আসলে এগুলো সব জনগণের টাকা মেরে পেট ফুলিয়েছে তো,তাই মনের ভেতর এতো ভয়।দেশে কি আর বিত্তমান মানুষ নেই?কই তারা তো এতো হাই সিকিউরিটি মেইনটেইন করে চলে না।

রিসোর্টে পা রেখেই নবনীতা ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখল।কতো জাকজমকপূর্ণ আয়োজন! দেখেই বোঝা যাচ্ছে,অর্থ ব্যয়ে কোনোরকম কার্পন্য করা হয়নি।সে হালকা গোলাপি রঙের মসলিনের শাড়িটার কুচি আর আঁচল সামলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

বিয়েতে আরহাম বাদেও আরো অনেক নেতা শ্রেণীর মানুষদের দেখা মিলল।নবনীতা সরু চোখে তাদের প্রত্যেককে দেখল,বোঝার চেষ্টা করল তাদের মতিগতি।আচমকাই তার চোখ গিয়ে আটকায় একটা ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত মাঝবয়সী ভদ্রলোকের দিকে।তার চেহারার অর্ধেক দেখেই নবনীতা কপাল কুঁচকে নেয়।তার কেন মনে হচ্ছে এই মুখটা তার খুব চেনা?

একটা শুকনো ঢোক গিলে নবনীতা এগিয়ে যায় সামনের দিকে।হঠাৎই লোকটা ঘুরে দাঁড়াল।নবনীতা আঁতকে উঠে তার দিকে তাকায়।চোখ জোড়া আপনাআপনি বড় হলো তার।মনে হলো সমস্ত শরীর ভেঙে আসছে।শরীরের সমস্ত জোর কোনো এক অদৃশ্য শক্তি টেনে নিচ্ছে।মেঝেতে ভর দেওয়ার মতো জোর টুকুও তার নেই।মাঝবয়সী লোকটার মুখশ্রী দেখেই তার মস্তিষ্ক পুনরায় কিছু ভয়াবহ অসহনীয় স্মৃতিদের স্মরণ করল।নবনীতা কম্পমান হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে।কি অসহ্য এই যন্ত্রণা! কি অসহ্য সবকিছু!

লোকটার সাথে তার দৃষ্টি বিনিময় হতেই তার চোখ ছলছল করে উঠে।সে ঘৃণার দৃষ্টিতে একনজর তাকে দেখেই কোনোরকমে বলল,’রহমান চাচা! আপনি?’

পাথরের মতো কতোক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকার পর তার কি হলো সে জানে না,আচমকাই সে ছুটে গিয়ে সশব্দে তার ডানগালে কষিয়ে একটা চড় বসাল।

জালালুর রহমান তার এমন আচরণে স্তব্ধ হয়ে কতোক্ষণ তাকে দেখলেন।তারপরই ধীরে ধীরে একটা হাত তুলে নিজের গালে ছোঁয়ালেন।এই মেয়েটা তাকে চড় মেরেছে?কি অদ্ভুত! এর কি মাথা নষ্ট?

তার হতভম্ব,অবিশ্বাস্য দৃষ্টির বিন্দু পরিমান তোয়াক্কা না করে মেয়েটা ক্রোধে রক্তিম হয়ে চেঁচিয়ে উঠল,’তুই একটা খু’নী।তুই আমার মা বাবাকে মেরেছিস।তুই একটা জানো’য়ার।’

***

‘পরী! দরজা টা কি তুমি খুলবে নাকি আমি ভাঙব?’

দরজার ওপাশের পুরুষালি কন্ঠ টা দীর্ঘসময় ধৈর্যধারণ করে শেষটায় কিছুটা ধমকে উঠল।অথচ সেই ধমকে ভেতরে থাকা মেয়েটার কোনো হেলদোল হলো না।

ঠান্ডা ফকফকা মেঝেতে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে সে সিলিং এর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।জালালুর রহমান কে সে রহমান চাচা বলেই চিনতো।তাদের বাড়িতে এই লোকের রোজ রোজ আসা যাওয়া ছিল।বাবার বিরাট ব্যবসার কিছু অংশে রহমানের শেয়ার ছিল।নবনীতা তাদের বসার ঘরে প্রায়ই তাকে দেখেছে।

নূর আহমেদের বিরাট কারবার।ব্যবসায় বিশাল নামডাক,সম্পদের পরিমান প্রতিবছর শেষে বাড়ছে বৈ কমছে না।অট্টালিকার মতোন বিশাল বাড়ি,টাকা পয়সা,কিছুরই তো অভাব নেই।তার এই আড়ম্বরপূর্ণ জীবন তার সহকর্মীদের সইলো না।তারা উঠে পড়ে লাগল তার সম্পদ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য।এই প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে প্রাণ হারাতে হলো নূর আহমেদ এবং তার স্ত্রীর।তিনটা প্রাণ রাতারাতি নিজেদের মা বাবা হারিয়ে এলোমেলো,উদ্ভ্রান্ত আর ছন্নছাড়া জীবনে পদার্পন করল।কতোকিছু হয়ে গেল জীবনে।নবনীতার শ্বাস রোধ হয়ে আসে সেই দুঃসহ স্মৃতি মনে করতে গিয়ে।মনে হয় অতীতের স্মৃতি গুলো সব চোখের সামনে ভাসছে।আচ্ছা,এমন কেন হয়?আমরা যা কিছু ভুলে যেতে চাই,তাই কেন বারবার আমাদের কল্পনায় এসে আমাদের কষ্ট দেয়?

আরহাম আবারো দরজা ধাক্কায়,এবার একটু জোরে,অন্যবারের তুলনায় বেশ অধৈর্য হয়ে।পরী আজ কি করেছে পরী নিজেও জানে না বোধহয়।একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে সে একটা মানুষকে গাল ফাটিয়ে চড় মেরেছে।সেই মানুষটা স্বয়ং জালাল আঙ্কেল।মানে এই মেয়ে আরহামের মানসম্মান বলে আর কিছু বাকি রাখবে না।জালাল আঙ্কেল কি গলির কোনো পাতি নেতা যে মন চাইল আর মেরে দিলাম?এই মেয়ের কি কোনো কান্ডজ্ঞান বলতে নেই?এতোকিছুর মাঝে সে আরহামকে একবার ডাকে পর্যন্ত নাই।মহান কাজ শেষ করেই সে হনহনিয়ে রিসোর্ট ছেড়ে বেরিয়ে গেছে।আরহামের এখনো সবকিছু বিশ্বাস হচ্ছে না।কেমন বোকা বোকা লাগছে সবকিছু।

নবনীতা দরজা খুলল আরো আধঘন্টা পরে।তার চোখ মুখের করুণ অবস্থা দেখেই আরহাম নিজের রাগ ভুলে গেল।আঁতকে উঠে বলল,’পরী! কি হয়েছে তোমার?তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

নবনীতা কোনো উত্তর না দিয়ে রোবটের মতোন হেঁটে খাটের এক কোণায় গিয়ে বসল।আরহাম ধীর কদমে তার পাশাপাশি এসে বসে।অনেক ভেবে চিন্তে তার একটা হাত নবনীতার হাতের উপর রেখে শান্ত গলায় বলে,’তুমি এই কাজ কেন করেছ পরী?এসব হঠকারিতা তো তোমার সাথে যায় না।তুমি কেন এই কাজটা করলে?’

নবনীতা আস্তে করে নিজের মাথাটা মেঝের দিকে ঝুকায়।নিজের পা দু’টো দেখতে দেখতে ভাঙা গলায় অতি ক্ষীণ আওয়াজে বলে,’আপনি সেদিন আপনার মা কে আপনার বাড়িতে দেখে রিভলভার হাতে নিয়েছিলেন কেন?সেদিনও তো চারপাশে অনেক মানুষ ছিল।তবুও কেন আপনি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন নি?’

আরহাম ভড়কে গিয়ে উত্তর দেয়,’সেটা তো অন্য হিসাব।তুমি তো সবটা জানো।’

‘আমি আপনার সবটা জানি।আপনি জানেন না,কখনো জানতে চাননি।তাই জানেন না।’

কাটকাট উত্তরটা আরহামের ঠিক পছন্দ হলো না।সে কপালে ভাঁজ ফেলে পাশ ফিরে একবার মেয়েটা মুখভঙ্গি দেখে।

‘জালাল আঙ্কেল তোমাদের পাস্টের সাথে সামহাউ কানেক্টেড?’

নবনীতা কান্না থামানোর প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে জবাব দেয়,’হুম।বাবার বিজনেস পার্টনার।আপনার ঐ গুরু,ঐ জানোয়ারটাই ঠান্ডা মাথায় আমার মা বাবাকে মেরেছে।’

বলা শেষে সে শব্দ করে কেঁদে ফেলল।একহাত দিয়ে মুখ চেপে বলল,’আপনি এই ধরনের লোকদের আদর্শ মানেন,যারা অন্যের সম্পদ দখল করে নিজেরা সবকিছু ভোগ করে?’

আরহাম একটু কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করল।থমথমে মুখ করে বলল,’জালাল আঙ্কেল কার জায়গা দখল করেছে সেটা আমি জানবো কেমন করে?উনি নিশ্চয়ই আমাকে এসব বলে নি।তাছাড়া তোমার বাবার বিজনেস পার্টনার হয়েছে মানে তো এটা না যে উনিই তার হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত।তুমি এমন সিলি সিলি কথা বলছ কেন?’

নবনীতা ঝাপসা চোখে তার মুখের দিকে তাকায়।কাঁপা স্বরে থেমে থেমে বলে,’আপনার মনে হচ্ছে এতো বড় কথা আমি স্রেফ অনুমান করে বলছি?’

‘জানি না।তবে তোমার কাজটা আজ আমার ভালো লাগেনি।’

‘আরহাম আপনি এমন কেন?’

আরহাম তার থেকে চোখ সরিয়ে সোজা হয়ে বসল।কাঠখোট্টা স্বরে বলল,’আমি এমনই।’

সে থামল।পুনরায় নিরবতা ছাপিয়ে বলল,’আমি জালাল আঙ্কেলের ব্যবসায়িক ব্যাপারে কিছুই জানি না।এমনকি চট্টগ্রামে যে তার ব্যবসা আছে এটাও আমি জানি না।তাছাড়া এখন এসব জেনে কি লাভ পরী?যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।এখন এসব পুরোনো কাসুন্দি ঘাটলে তো তোমার মা বাবা ফেরত আসবে না তাই না?’

নবনীতা তার অশ্রুদের চোখ বেয়ে নামার সুযোগ দিলো না।তার আগেই হাত বাড়িয়ে চোখ মুছে নেয়।তার দুর্বল লাগছে ভীষণ।সে দুর্বল গলায় সামান্য জোর এনে বলল,’আপনার কাছে তার অপরাধ কেমন লাগছে আমার জানা নেই।কারণ আমার ধারণা আমি যেমন করে আপনার দুঃখ কষ্ট অনুধাবন করতে পারি,আপনি সেটা কখনোই পারেন না।আপনি কোনোদিনই বুঝবেন না সে আসলে কি করেছে।কারণ নিজেকে ছাড়া আপনি আর কাউকে বুঝেন না।তবুও আপনার জন্য বলে রাখি,যেটাকে আপনি অতীত কিংবা পুরোনো কাসুন্দি বলে উড়িয়ে দিচ্ছেন,সেই অতীত তিন তিনটা মানুষের জীবন উজাড় করে দিয়েছে।মা বাবার সাথে সাথে তিনটা মেয়ের শৈশব কৈশোর সবকিছুর মৃত্যু হয়েছে।আপনি খুব অবলীলায় বলে দিলেন তোমার বাবা মা।চাইলে আমিও সেদিন বলতে পারতাম আপনার বাবা মা।আমি বলিনি।আমি,,’

নবনীতা পুরো কথা শেষ করার আগেই আরহাম বিরক্তিতে চ কারান্ত শব্দ করে বলল,’আহা পরী! শুধু শুধু এতো প্যাচাচ্ছ কেন সবকিছু?আমি তেমন কিছুই বলিনি।আমি শুধু বলছি এতো বছর আগের ঘটনার সাথে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।তুমি আমাকে এসবের সাথে কেন জড়াচ্ছ?’

‘অদ্ভুত! জড়ালাম কখন?’

‘এই যে জালাল আঙ্কেলের বিষয়ে তুমি আমার সাথে রাগ হচ্ছো?আই ডোন্ট নো হিজ পাস্ট এক্টিভিটিজ।তার কারণে তুমি আমার সাথে মিস বিহেভ কেন করছ?’

নবনীতা ব্যথিত চোখে তার দিকে তাকায়।ঝাপসা চোখ জোড়া আরহামের দিকে মেলে দিয়েই একটা শ্বাস টেনে বলে,’আপনি বুঝেন না কেন করছি?আপনি তো ঐ জালালকে পীর মানেন।তার সব কথা শুনেন।আপনার মাথায় চব্বিশ ঘন্টা ঐ লোক বুদ্ধি দেয়।ঐ জানো’য়ারের বুদ্ধিতে আমার হাসবেন্ড চলে।এটাই কি মিস বিহেভ করার জন্য যথেষ্ট না?’

‘ঐ লোক তো আমাকে আরেকজনকে মেরে তার ঘরবাড়ি দখল করার বুদ্ধি দিচ্ছে না।’

নবনীতা তাচ্ছিল্য করে হাসল।বিদ্রুপের সুরে বলল,’নাহ সেই বুদ্ধি দিচ্ছে না।তবে কিভাবে আরেকজনকে মেরে নিজে গদিতে টিকে থাকতে হয় সেটা ঠিকই শিখিয়ে দিচ্ছে।আপনি পাল্টে যাচ্ছেন আরহাম।’

‘বাজে বকবে না।’

‘আমি তো বাজেই বকি।’

নবনীতা আরো কিছু বলার জন্য ছটফট করছিলো,কিন্তু শারীরিক দুর্বলতায় সে আর মুখ খোলার জোর পেল না।তার মনে হচ্ছে তার ইন্দ্রিয় সমূহ অচল হয়ে যাচ্ছে।আরহাম একটা হাত তুলে তার গাল স্পর্শ করল।একটু এগিয়ে এসে নিজেদের দুরত্ব মিটিয়ে নিতেই তার ব্যবহৃত পারফিউমের কড়া ঘ্রাণে নবনীতার গা গুলিয়ে এলো।দুই সেকেন্ড চোখ মুখে খিঁচে আচমকাই সে এক ধাক্কায় আরহামকে তার সামনে থেকে সরিয়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটে যায়।গিয়েই শব্দ করে বমি করে।
আরহাম তার এহেন কর্মকান্ডে হকচকিয়ে গেল।এক লাফে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বড় বড় পায়ে সামনে যেতে যেতে বলল,’এ্যাই পরী! কি হয়েছে তোমার?অদ্ভুত! আমি কি এতোই খারাপ যে কাছে আসতেই তোমার বমি পাচ্ছে?’

নবনীতা দুই হাত বেসিনে চেপে মাথাটা যতোটা সম্ভব ঝুকিয়ে কতোক্ষণ কাশলো।তার শরীর আজ মাত্রাতিরিক্ত দুর্বল।সে দ্রুত মুখে পানির ঝাপটা দেয়।মুখে পানি ছিটিয়ে আয়নার দিকে তাকাতেই তার মাথা ঘুরপাক খায়।মনে হচ্ছে এখনি সে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যাবে।আরহাম ব্যস্ত পায়ে তার পেছনে এসে দাঁড়ায়।একটা হাত তার পিঠে রেখে কোমল গলায় বলে,’কি হয়েছে তোমার?কিছু তো খেলেই না দাওয়াতে।বমি করছো কেন?’

নবনীতা তার অস্তিত্ব টের পেতেই তার পিঠটা আরহামের বুকের সাথে ঠেস দিয়ে টেনে টেনে দু’টো শ্বাস নেয়।তার কাঁপতে থাকা হাত দু’টো আরহাম চট করে নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।একহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরে শুধায়,’খারাপ লাগছে পরী?’

নবনীতা দু’চোখের পাতা বুজে রেখেই মূর্ছা যাওয়া গলায় বলল,’আমাকে একটু খাট পর্যন্ত নিয়ে যাবেন আরহাম?মাথা ঘুরছে আমার ভীষণ।’

আরহাম তাকে পাজাকোলা করে তুলে নেয়।বাড়তি কোনো প্রশ্ন ছাড়াই চুপচাপ তাকে নিয়ে এনে খাটের একপাশে শোয়ায়,মনে করে চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দেয়।নবনীতা দুর্বল হাতে পাশের জায়গাটা দেখিয়ে বলল,’আপনিও আসুন।’

আরহাম জড় পদার্থের মতো টানটান হয়ে শোয়।নবনীতা তার প্রশস্ত পুরুষালি বক্ষে ঝাপিয়ে কতোক্ষণ নাক টানে।নিঃশব্দ অশ্রু বিসর্জন এক পর্যায়ে হেঁচকিতে রূপ নেয়।নবনীতা তার বন্ধন আরো শক্ত করে জড়ানো গলায় বলল,’আমার বাবা মা বলে আপনি আমার দুঃখটা অনুধাবন করতে পারছেন না হয়ত।যাক সমস্যা নেই।পৃথিবীর কয়জনই বা অন্যের যন্ত্রণা নিজে অনুভব করতে পারে?কিন্তু আপনি যাদের সাথে উঠা বসা করছেন নিয়মিত,তারা সবাই কোনো না কোনো ভাবে এসব পাপের সাথে জড়িয়ে আছে।আপনি এই পাপিষ্ঠদের ভীড়ে নিজেকে ঠিক রাখতে পারবেন না আরহাম।এটা সম্ভব না।আপনি দয়া করে নিজেকে গুটিয়ে নিন।আমি হয়তো খুব বেশি কিছু চাইছি,কিন্তু আমার অনুরোধ আপনার কাছে,আপনি এসব থেকে সরে আসুন।আমি চাই না অনেক গুলো বছর পর আপনিও তাদের মতো অমানুষ হয়ে উঠেন।আপনি ছাড়া আমার কেউ নেই আরহাম।’

শেষে বাক্যে অসহায়ত্ব ছিল,একজন স্ত্রী’র আকুল আবেদন ছিল।আরহাম একটা গাঢ় শ্বাস ছেড়ে দুই হাতে নবনীতাকে জড়িয়ে ধরল।চাপা স্বরে বলল,’শ্বাস টানছো কেন তুমি?ইনহেলার দিব?ডাক্তারের কাছে যাবে?’

নবনীতা চোখ বুজেই জবাব দেয়,’নাহ।আপনার কাছে থাকব আমি।আপনি ঐ রহমানের সাথে আর কথা বলবেন না।’

‘আচ্ছা বলব না।’

‘আমার কসম।’

‘আচ্ছা।’

রাত বাড়ে।নবনীতা নাক টানতে টানতে এক সময় তার প্রিয়তমর বুকে গুটিশুটি মেরেই গভীর ঘুমে অসাড় হয়।আরহামের চোখে ঘুম নামে না।টিক টিক করে চলতে থাকা ঘড়ির কাটা তার হৃদস্পন্দন আরো বাড়ায়।জালালুর রহমানের এমন অন্যের সম্পদ দখলদারির বিষয়টি সে আরো আগেই জানতো।তবে পরীর জীবনের সাথে এই লোক এমনভাবে জড়িয়ে থাকতে পারে,সেটা তার কল্পনাতীত ছিল।পরী দুঃখ পেয়েছে।পরীকে দুঃখ দিতে সে চায় না।কিন্তু পরী যেই কথা বলছে সেটাও তার পক্ষে মানা সম্ভব না।রাজনীতি ছেড়ে দিবে?এও কি সম্ভব?সে তাহলে এতো বছর কিসের জন্য এতো কষ্ট করল?রাজনীতি করলে কি এতো ভালো থাকা যায়?আরহাম যদি রাজনীতি ছেড়েও দেয়,তাহলে সেই জায়গায় অন্য কেউ এসে বসবে।নিঃসন্দেহে সে আরহামের চেয়েও বেশি অসৎ হবে।এতে দেশের তো কোনো উন্নতি হবে না।তাহলে খামোখা আরহাম কেন ক্ষমতা ছেড়ে দিবে?

হঠাৎই পিঁক পিঁক শব্দে তার ধ্যান ভাঙে।তাড়াহুড়ো করে সে ফোনটা হাতে নেয়।স্ক্রিনে ভাসা নম্বরটা দেখেই সে একটা শুকনো ঢোক গিলে পাশ ফিরে নবনীতার ঘুমন্ত মুখখানা পর্যবেক্ষণ করে।তারপরই অতি সন্তর্পণে তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে চাদরটা তার গায়ের উপর টেনে দিয়ে খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।তাড়াহুড়ায় কলটা রিসিভ করে নবনীতা যেন ঘুমন্ত অবস্থাতেও শুনতে না পায়,ততোটা ক্ষীণ কন্ঠে বিড়বিড় করে,’জ্বী আঙ্কেল বলুন।আমি শুনছি।’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে