#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৪৯)
‘রাঙামাটি যাওয়ার পর আমি আর রিমি পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম।তারপর একটা নিরাপদ জায়গায় খোঁজে আমরা একজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম।কিছু ভুলবোঝাবুঝি হওয়াতে উনার মনে হলো আমাদের উদ্দেশ্য খারাপ।আর তাই উনি মসজিদের ইমাম ডেকে আমাদের বিয়ে পড়ালেন।সেই হিসেবে আমি আর রিমি হাসব্যান্ড ওয়াইফ।’
ওয়াজিদ তার কথা শেষ করে মাথা তুলে সোজাসুজি সামনে তাকালো।তার সামনে তার মা বাবা আর রিমির বাবা মা বসে আছে।তাদের চার জোড়া চোখ ওয়াজিদের উপর নিবদ্ধ।ওয়াহিদুল সাহেব গম্ভীর হয়ে বললেন,’এতো বড়ো কথাটা তাহলে তুমি এতোদিন গোপন করলে কেন?’
ওয়াজিদ ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে বলল,’ভীষণ ফ্রাস্টেটেড ছিলাম।মাথা কাজ করছিল না।বুঝতে পারছিলাম না কি করা উচিত।তাই হঠকারিতা দেখিয়ে ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছি।ভেবেছিলাম বিষয়টা গোপন রাখব।জানি পুরোটাই আমার ভুল।আই অ্যাম সরি ফর দ্যাট।বিয়ের মতো সেনসিটিভ ইস্যু আসলে গোপন রাখা যায় না,রাখা উচিতও না।আমি ভালো করে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টা নিয়ে ভাবিনি।আমি জানি আমি ভুল।আমি লজ্জিত তার জন্য।’
শীলা কড়া গলায় বললেন,’তাহলে এখন?এখন তুমি কি চাইছো সেটা বলো।’
ওয়াজিদ ঘন ঘন শ্বাস ছেড়ে নিজের মাথা নামিয়ে নেয়।দুই হাতে নিজের চুল টেনে ধরে গাঢ় স্বরে বলে,’আমি চাইছি এই বিয়েটা মেনে নিয়ে সবকিছু এখানেই সমাধান করতে।দিপ্তর সাথে তার বিয়েটা ভেঙে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।কারণ অনিচ্ছাকৃত ভাবেই ঠিক,কিন্তু আমাদের বিয়েটা তো হয়েছে।তাই আমি চাইছি রিমিও যেন বিয়েটা মেনে নেয়।এটা নিয়ে আর কোনো বাড়াবাড়ি না হোক।’
‘তার আগে বলো তুমি বিয়েটা মানছো তো?’ কাটকাট গলায় প্রশ্ন ছুড়লেন ওয়াহিদুল সাহেব।
ওয়াজিদ উপরনিচ মাথা নাড়ে।ছোট করে বলে,’হু।মানছি।’
আরহাম সোফার একপাশে পায়ের উপর পা তুলে বসেছিল।তাদের কথা শেষ হতেই সে বাজখাঁই গলায় চেঁচাল,’এতো বড় ঘটনা তুই কোন আক্কেলে গোপন রেখেছিস?রেখেছিস তো রেখেছিস,এখন যখন তোর কথা মতো রিমি একটা জীবন বেছে নিয়েছে,তাতে তোর সমস্যা টা কোথায়?’
ওয়াজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকাল।শক্ত মুখ করে জবাব দিলো,’সমস্যা এটাই যে রিমি আমার ওয়াইফ।আমি আমার ওয়াইফের আরেকটা বিয়ে মানতে পারছি না।তোর কোনো সমস্যা?’
আরহাম বাঁকা হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’না।আমার কোনো সমস্যা নেই।’
কাবেরী আহমেদ খানিকটা বিচলিত হলেন।যদিও ঘটনা গুলো যে ঘটবে,এই নিয়ে তিনি আগে থেকেই অবগত ছিলেন।কিন্তু এখন যখন ব্যাপারগুলো চোখের সামনে হচ্ছে,তিনি কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেলেন।তিনি বড় বড় চোখে সামনে থাকা ছেলেটাকে দেখেন।কি সুন্দর সুপুরুষ একটা মুখ! এই সুন্দর মুখের বলিষ্ঠ দেহের ছেলেটার সাথে রিমির বিয়ে হয়েছে?তিনি তো ভাবতেই পারছেন না বিষয়টা।নবনীতা তাকে অনেক আগে জানিয়েছে রিমির বিয়ের ব্যাপারটা।কিন্তু তিনি একবারো ভাবেন নি যে ছেলেটা বিয়ের জন্য রাজি হবে,কিংবা এই সম্পর্ককে নিজ থেকে স্বীকৃতি দিবে।অথচ তার ধারণা কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে ছেলেটা অকপটে সবটা স্বীকার করে নিল।তিনি দু’চোখ ভরে ছেলেটাকে দেখেন।আহা! কি সুদর্শন! কি অমায়িক!
****
ওয়াহিদুল সাহেব রিমির ঘরে এসেই সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে গলা খাকারি দিলেন।সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে তার দিকে তাকায়।তিনি খানিকটা এগিয়ে এসেছে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বললেন,’আমার মন হয় ওয়াজিদের বিয়ের ব্যাপারটা যে আমরা আগেই জানি,এটা তাকে না জানালেই ভালো হয়।সে ভীষণ প্রেসটিজিয়াস এসব ব্যাপারে।সে যদি জানতে পারে আমরা জেনে বুঝে শুধুমাত্র তাকে জব্দ করার জন্য এতো ভাবে তাকে ভোগান্তি দিয়েছি,তাহলে সে কষ্ট পাবে।আর আমার ছেলেকে তো আমি চিনি।একবার রাগ হলে কয়েক সপ্তাহ ধরে সে মন খারাপ করে রাখে।কাউকে কিছু বলে না,নিজে নিজে কষ্ট পায়।তাই এই বিষয়টি আমরা নিজেদের মধ্যে রাখলেই ভালো হয়।’
নবনীতা খাট থেকে নেমে দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’জ্বী আঙ্কেল।আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।আমরা কেউ ভাইয়াকে কিছু জানাবো না।’
ওয়াহিদুল সাহেব আরো কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।তিনি যেতেই বাকিরা পুনরায় নিজেদের আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে গেল।তাদের এখন আরো একটা কাজ করতে হবে।তাদের ওয়াজিদের সামনে দিপ্তকে রিফিউজ করার নাটক করতে হবে।দেখাতে হবে যে তারা ওয়াজিদের কথার প্রেক্ষিতে রিমির অন্যত্র ঠিক হওয়া বিয়েটা ভেঙে দিয়েছে।সেজন্য গুছিয়ে তাদের আরো কিছু মিথ্যা বানাতে হবে।
আরিশ কপালে হাত চেপে বলল,’বাপ রে! এখন তো আমারও অন্তত জলিলের মতোন বলতে ইচ্ছে হচ্ছে একটা মিথ্যা কথা বললে অনেকগুলো মিথ্যা কথা বলার সমান মিথ্যা কথা বলা হয়ে যায়,তবুও মিথ্যা মিথ্যাই থেকে যায়।’
নবনীতা তার হাতের কাছে থাকা কুশনটা আরিশের দিকে ছুড়ে মেরে ধমক দিয়ে বলল,’যা তো তুই।বের হ এখান থেকে।মাথা ঘুরাচ্ছে আমার এতোবার মিথ্যা শুনতে শুনতে।’
আরিশ দাঁত কেলিয়ে বেরিয়ে গেল।নবনীতা কান চেপে বলল,’কি অদ্ভুত! এখনো কথা গুলো আমার কানে বাজছে।’
.
.
.
.
নবনীতা আর আদি তাদের পরিকল্পনায় একশো পার্সেন্ট সফল হয়েছে।ওয়াজিদকে কিছু বুঝতে না দিয়েই তারা দিপ্তর ব্যাপারটা পুরোপুরি মিটিয়ে দিয়েছে।
সেদিন সন্ধ্যায় ওয়াজিদ আরো বেশি কিছু সময় রিমিদের বাড়িতে ছিল।সে যখন জানাল এই বিয়ে কিংবা রিমি,কাউকে মেনে নিতেই তার আপত্তি নেই,তখনই সবাই তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে নিয়ে মাতামাতি শুরু করল।ওয়াজিদ এই ব্যাপারে কোনো কথা বলেনি।রিমির অন্য কোথাও বিয়ে হচ্ছে না,এটাই তার জন্য শান্তির।বাদ বাকি যা খুশি হোক,এতে তার আপত্তি নেই।
সবার সম্মতিতে তার আর রিমির পুনরায় বিয়ে করার জন্য আরো একটি দিন ধার্য করা হয়েছে।যেহেতু তারা রেজিস্ট্রি করে বিয়ে করেনি,তাই আইনত তাদের সম্পর্কের কোনো বৈধতা নেই।পাশাপাশি তাদের বিয়েটাও স্বাভাবিক ভাবে হয়নি।তাই তাদের অভিভাবকরা মিলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুনরায় সকলের সামনে তাদের বিয়ে হবে।সেই হিসেবে কালকে তার বিয়ে।
রিমির সাথে ইদানিং তার সামান্য কথা হয় ফোনে।রিমির আচরণ আগের তুলনায় বেশ স্বাভাবিক।তবে ওয়াজিদের মনে হয় আগের সেই রিমি যেন হুট করেই কোথাও হারিয়ে গিয়েছে।ঐ রিমিকে ওয়াজিদ মিস করে,তার ছটফটে চঞ্চল স্বত্তাটি ওয়াজিদের ভীষণ প্রিয়।অথচ এই বিষয়টা সে তখন টের পেল,যখন তার সেই চঞ্চল ভাবটা গভীর কোনো মহাসাগরের তলদেশে তলিয়ে গেল।
***
‘রিমি! এ্যাই রিমি! ঘুম থেকে উঠ।আজ না তোর বিয়ে?’
নবনীতা রিমির ঘরে এসে তার খাটের কাছে এসে কোমরে হাত রেখে দাঁড়ায়।রিমি কপাল কুঁচকে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,’প্লিজ যা।ঘুমটা নষ্ট করিস না।’
‘যাব মানে?আজ না তোর বিয়ে?’
‘তো?এখনো অনেক সময় বাকি।ওরা বাড়ি ছাড়ার দশ মিনিট আগে ডেকে দিস।উঠে রেডি হয়ে যাবো।’
নবনীতা কপালে একহাত চেপে অবাক হয়ে বলল,’সেকি কথা! তুই কি মার্কেটে যাচ্ছিস যে তোকে দশ মিনিট আগে ডেকে দিব?উঠ,তাড়াতাড়ি উঠ।’
সে কোনোরকমে তার হাত ধরে টানতে টানতে তাকে শোয়া থেকে তুলে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসালো।রিমি চোখ ডলতে ডলতে তন্দ্রাচ্ছন্ন গলায় বলল,’বাজে কয়টা?আমার তো মনে হচ্ছে মাত্র সকাল হলো।ধুর! মন চাইছে বিয়ে ক্যানসেল করে আরো কতোক্ষণ ঘুমাই।’
রিমির বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন তাদের বাড়ির ছাদেই করা হয়েছে।তাদের বাড়িটা যথেষ্ট বড়।ছাদেও ভালোই জায়গা আছে।কাল রাতে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের লোকজন এসে খুব সুন্দর করে তাদের বাড়ির ছাদটা সাজিয়েছে।এখন আর ছাদে উঠে মনে হয় না এটা কারো বাড়ি,মনে হচ্ছে এটা কোনো কনভেনশন হলের আউটডোর সেকশন।
রিমিকে সাজাতে বসিয়ে নবনীতা তাড়াহুড়ো করে নিজের বাড়িতে আসল।আরহাম আজ সকাল থেকেই তার এপার্টমেন্টে।সে চিত্রা আর শুভ্রাকে রেডি করে নিজের ঘরে এসে আলমারি থেকে একটা মেরুন রঙের শাড়ি বের করল।
আজকের শাড়িটা একটু ভারি।শাড়ি পরতে তার সময় লাগল বিশ মিনিট।এই বিশ মিনিট এক জোড়া চোখ তাকে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল।নবনীতা কাঁধের কাছটায় সেফটিপিন গেঁথে সামনে দেখে বিরক্ত গলায় বলল,’এবার তো চোখ টা সরান।কি একটা অবস্থা!’
আরহাম খাট ছেড়ে উঠে এসে একটানে নবনীতাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল।তার হাত যখন নবনীতার শাড়ি গলিয়ে তার উদর স্পর্শ করতে মরিয়া,তখনই নবনীতা আঁতকে উঠে দুই হাত জোড় করে বলল,’না না।এখন না প্লিজ।অনেক কষ্টে পিন আপ করেছি আরহাম।’
আরহাম আচমকাই উন্মত্ত হয়ে তার সারা মুখে চুম্বন করে।তারা অকস্মাৎ উন্মাদনায় নবনীতা হকচকিয়ে উঠল।সে একটু ছাড়া পেতেই কোনোরকমে বলল,’সবাই এখন দরজা ধাক্কানো শুরু করবে।এখন না প্লিজ।’
আরহাম অধৈর্য হয়ে বলল,’তো কখন?’
নবনীতা তার চেয়েও অধৈর্য হয়ে জবাব দেয়,’বিয়েটা আগে শেষ হোক।বাড়ি ফিরে নেই।এরপর ভাবা যাবে।’
আরহাম হাতের বন্ধন আরো জোরাল করল।নবনীতার গালে নাক ঘষে ভারি গলায় বলল,’এরপর ভাবা যাবে মানে?আজ নাকি সেটা বলো।’
‘আচ্ছা আচ্ছা আজই।’
‘আরশাদকে কি করবে?’
নবনীতা নিজ থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে দুষ্টুমি করে বলল,’আরশাদ এখানেই থাকবে।’
‘ইসস ছিহ!’
‘ওমা।ছি এর কি আছে?এইটুকু বাচ্চা।আর সে তো ঘুমিয়েই থাকে।সমস্যা কি?’
আরহাম নাক ছিটকে বলল,’ইসস।তোমার কোনো লজ্জাশরম নাই নাকি?আমি এসব পারব না।বাচ্চাকাচ্চার সামনে ইসস।ওয়াক থু।আরশাদকে আজকের মতো শুভ্রার কাঁধে চাপিয়ে দাও।’
কথা শেস করেই সে নবনীতাকে ছেড়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।আদি একটু আগে ফোন দিয়ে বলল তারা নাকি বেরিয়েছে।এতোক্ষণে তো চলে আসার কথা।সে আরো একবার তাকে ফোন দিয়ে বলল,’কিরে?কোথায় তোরা?আমরা সবাই রেডি।তাড়াতাড়ি আয়।’
ওয়াজিদের শেরওয়ানির রং অফ হোয়াইট।রিমির গাঢ় লাল লেহেঙ্গার সাথে এটা বেশ মানানসই।সকাল থেকেই তার কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত লাগছে।শুরু থেকে ঘটনা গুলো সব মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে।কি থেকে কি হয়ে গেল।চট করেই ওয়াজিদ সংসারের জালে জড়িয়ে গেল।যাকগে।যা হলো ভালোই হলো।রিমির সাথে অবশেষে তার বিয়েটা তো হচ্ছে।বউকে পরেও ভালোবাসা যাবে।ভালোবাসার জন্য গোটা জীবন পড়ে আছে।আপাতত বউকে অন্য কারো বউ হওয়া থেকে আটকানো গেছে এটাই অনেক।
রিমির সাজ শেষ হতেই সে চুপচাপ স্টেজে গিয়ে বসল।ওয়াজিদদের গাড়ি আরো আগেই এসেছে।চারদিকে মানুষ জনের হৈচৈ।ওয়াজিদ বসেছে রিমির মুখোমুখি।তাকে দেখতেই রিমির হাসি পেল।সে দ্রুত মাথা নামিয়ে মিটমিট করে হাসল।তার কেন হাসি পাচ্ছে সে জানে না।শুধু মন চাচ্ছে ওয়াজিদের হাতে একটা রুমাল ধরিয়ে দিয়ে বলতে,’এটাকে একটু পুরান দিনের জামাইদের মতো মুখের উপরে চেপে ধরুন তো।দারুণ লাগবে আপনাকে।’
সে মাথা নামিয়ে কতোক্ষণ নিঃশব্দে হাসে।দুপুরের একটু পরেই কাজি এনে পুনরায় শরিয়ত মোতাবেক সমস্ত নিয়ম মেনে ওয়াজিদ আর রিমির বিয়ে পড়ানো শেষ হয়।বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপারে সই করার মাধ্যমে রিমি আইনতভাবে একদম পাকাপোক্ত ভাবে ওয়াজিদের সহধর্মিণীর পরিচয় পেল।বিয়ের কাজ শেষ হতেই ওয়াজিদ উঠে এসে রিমির পাশাপাশি বসল।
আদি হাসি হাসি মুখ করে তাদের দেখল।আরহাম তার কাঁধে নিজের কাঁধ দিয়ে ধাক্কা দিয়ে কুটিল হেসে বেসুরা গলায় গান ধরল,
‘বন্ধু যখন বউ লইয়া,
আমার বাড়ির সামনে দিয়া,
হাইট্টা যায়।
বুকটা ফাইট্টা যায়।’
বলেই সে নিজে নিজে কতোক্ষণ হাসে।আদি বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বলল,’হাসার কিছু নেই।আমার সময় এলে আমিও বিয়ে করব।’
আরহাম মুখে সেই হাসির রেখা ধরে রেখেই বলল,’ওহহ ভালো কথা।তোর ইজমার কি খবর?গ্র্যাজুয়েশন শেষ?’
‘হু।কতো আগেই তো।দুই বছর আগেই শেষ।’
‘তো?বিয়ে করছিস কবে?’
আদি নিরুদ্বেগ হয়ে বলল,’কে জানে?নেক্সট ইয়ার প্রবাবলি।’
****
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হতেই সবাই স্টেজে এসে দাঁড়াল।আরহাম একটা সোফায় বসে পাঞ্জাবির কলার ঠিক করতে করতে গলা উঁচু করে বলল,’ক্যামেরা ম্যান কোথায়?ডাক দে তো।সবার একটা ছবি তুলে দিতে বল।’
তাসনুভা গালে হাত রেখে সবার দিকে তাকায়।আদি হেঁটে এসে তার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’চলো বাচ্চা।স্টেজে চলো।’
সে দ্রুত মাথা নেড়ে জানাল সে স্টেজে যাবে না।স্টেজে উঠতে তার কষ্ট হবে।
আদি তার ডান হাত ধরে বলল,’তোমার কোনো কষ্ট হবে না।আমি নিয়ে যাবো তোমায়।চলো।’
তাসনুভা তবুও দিরুক্তি করে বলল,’না না আমি যাব না।তোমরা যাও।’
‘তুমি না গেলে আমিও যাব না।’
তাসনুভা খানিকটা বিরক্তি,খানিকটা প্রসন্ন হেসে বলল,’আচ্ছা আচ্ছা যাচ্ছি।’
আরিশ তার অন্য হাতটা লুফে নিয়ে গাঢ় স্বরে বলল,’চল চল।ভাইয়াও ধরছি।এক লাফে উঠে আয়।’
তাসনুভা একটা সোফায় বসতেই আদি তার পেছনে এসে দাঁড়াল।বিভা এখানে সেখানে ছুটোছুটি করছিল।ওয়াজিদ তাকে কোলে তুলে বলল,’এ্যাই দুষ্টু।তুমি এখানে বসো।’
নবনীতা আশেপাশে কোনো সোফা খালি না পেয়ে আরহামের পায়ের কাছে বসে তার হাঁটুতে পিঠ দিয়ে হেলান দিলো।আরহাম বাঁকা হেসে বলল,’গুড।এটাই হচ্ছে বউদের জায়গা বুঝেছ?’
নবনীতা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে।ডান হাতে আরহামের পেটে একটা কিল মেরে কটমট করে বলে,’কথা একটু কম বলেন।যতোসব উল্টাপাল্টা কথা!’
আয়নায় নবদম্পতিদের মুখ দেখা বর্তমানে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার একটি অংশ।রিমি কাবেরী আহমেদের হাত থেকে আয়নাটা একটানে নিজের হাতে নিতে গিয়েই বিপত্তি বাঁধালো।তার একটানে আয়নাটা ওয়াজিদের মুখের উপর গিয়ে পড়ল।ওয়াজিদ গোল গোল চোখে কপাল ডলতে ডলতে তার দিকে তাকায়।রিমি দ্রুত জিভ কাটে।মিনমিন করে বলে,’সরি ভাইয়া।একদমই দেখতে পাইনি।নেভার মাইন্ড।’
ওয়াজিদ কতোক্ষণ জ্বলজ্বল চোখে তাকে দেখে।তারপরই হঠাৎ শব্দ করে হেসে ফেলে।মাথা নামিয়ে চাপা স্বরে বলে,’এখন ঠিক আছে।তোমাকে এভাবেই ভালো লাগে আমার।’
আরিশ চোখ মেলে নিজের বসার জন্য জায়গা খুঁজে।স্টেজের একেবারে বামপাশে শুভ্রা চিত্রাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তার অন্য পাশটা খালি।আরিশ কি সেখানে গিয়ে দাঁড়াবে?শুভ্রা কিছু মনে করবে না তো?
তার ভাবনার মাঝেই শুভ্রা নিজ থেকে তাকে ডাকল।হাত নেড়ে বলল,’আসুন না ভাইয়া! এখানে দাঁড়ান।জায়গা আছে তো।’
আরিশ মাথা নিচু করে স্টেজে উঠে।বিড়বিড় করে নিজে থেকেই প্রশ্ন করে,’কোথায় জায়গা আছে?স্টেজে নাকি তোমার মনে?তোমার মনে হলে ভেবে দেখতে পারি।’
ক্যামেরা মান তার এঙ্গেল ঠিক করল।আরহাম আরশাদকে তার এক কোলের উপর বসিয়ে তার চুল ঠিক করতে করতে নবনীতাকে খোঁচা দিয়ে বলল,’ছেলেটার চুলটাও তো একটু সুন্দর করে আঁচড়ে দাও নি।আবার বড় বড় কথা বলো।দেখো তো কেমন লাগছে চুলগুলো।’
নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’আমার কি দোষ?সে সারাক্ষণ চুল টানে।’
আরহাম সে কথার উত্তর না দিয়ে আরশাদকে দেখে।তারপরই তার মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে সামনে দেখাতে দেখাতে বলে,’দেখি তো আমার নায়ক ছেলে,,একটু সামনে তাকাও তো।তোমার সুন্দর মুখটা দেখিয়ে আমাদের এই ছবিখানা ধন্য করো।’
বলেই সে একহাত নবনীতার কাঁধে রাখল।নবনীতা তার একহাতে আলতো করে আরশাদের পা দু’টো জড়িয়ে ধরল।শিলা আক্তার তাদের দেখেই হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,’খুব সুন্দর আরহাম।একদম পারফেক্ট ফ্যামিলি মনে হচ্ছে।’
সবাই ক্যামেরার লেন্সে মনোযোগ দেয়।আর ঠিক তখনই ক্যাননের লেটেস্ট মডেলের ডিএসএলআর ক্যামেরায় খ্যাচ খ্যাচ শব্দ করে বন্দি হলো অনেকগুলো হাস্যোজ্জ্বল মুখের সম্মিলিত ছবি।
সময় সামনে অগ্রসর হবে।পৃথিবীর চলমান রীতিনীতিতে পরিবর্তন আসবে।ক্যালেন্ডারের পাতায় অনেকগুলো বছর কেটে যাবে।কিন্তু এই স্মৃতিগুলো চিরকাল অ্যালবামের পাতায় বন্দি থাকবে।অলস দুপুরে কিংবা ক্লান্ত বিকেলে জীবনের গতিময়তায় যখন তারা হাঁপিয়ে উঠবে,তখন এই ছবি গুলো দেখে তারা নষ্টালজিয়ায় ফিরে যাবে।মনে হবে-‘এই তো আমরা।কতো প্রাণবন্ত! কতো উচ্ছ্বসিত! কতো সুন্দর ছিল আমাদের সেই জীবন।’
*****সমাপ্ত******[দ্বিতীয় অধ্যায়]
[এরই সাথে গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি টানলাম।আমার পরিকল্পনা ছিলো আরহাম আর নবনীতার সম্পর্কে একটা কনক্লুশান টানার।সেই সাথে বাকিদের ঘটনাও কিছুটা সামনে এগোনোর।সবটাই হয়েছে।তাই দ্বিতীয় অধ্যায়ের সমাপ্তি এখানেই সমীচীন মনে হয়েছে।
খুব শীগ্রই তৃতীয় অধ্যায় শুরু হবে।খুব সম্ভবত সেটাই হবে গল্পের শেষ অধ্যায়।একটু বড়ও হবে তৃতীয় অধ্যায়টা।পাঠকরা চাইলে এখানেও সমাপ্তি ধরে নিতে পারেন।আবার চাইলে তৃতীয় অধ্যায়ও পড়তে পারেন।তবে আগেই জানিয়ে রাখি,তৃতীয় অধ্যায়ে রাজনীতির বিষয়বস্তু পুরোদমে ফিরে আসবে।সুতরাং যারা রাজনীতি পছন্দ করেন না,তারা এখানেই গল্পের সমাপ্তি ধরে নিতে পারেন।]