#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৪৮)
রিমি গোসল শেষে বেরিয়ে বিভার কাছে গিয়ে বসল।বিভার শরীরটা কাল রাত থেকে গরম।জ্বর আসবে মনে হচ্ছে।সে হাত দিয়ে তার তাপমাত্রা পরোখ করল।ছোট্ট মাথাটায় হাত বুলিয়ে বলল,’খারাপ লাগছে সোনা?’
বিভা চুপটি করে তার কোলে মাথা রাখে।রিমি গলা উঁচু করে ডাকে,’আম্মু।এ্যাই আম্মু! বিভার গা টা ধরে দেখো তো।কেমন গরম গরম লাগছে।’
কাবেরী আহমেদ এলোমেলো পা ফেলে ঘরে এলেন।রিমির কথার জবাব না দিয়েই বিভাকে কোলে তুলে বললেন,’দেখি তো পাখি কি হয়েছে তোমার।’
তিনি তাকে নিয়ে তার ঘরে চলে গেলেন।রিমি চুপচাপ খাটে গিয়ে বসে।হঠাৎই ডোরবেল বেজে উঠল।কাবেরী রুম থেকে চেঁচালেন,’যা তো রিমি।দেখ কে এসেছে।’
রিমি বিরক্ত হয়ে শোয়া থেকে উঠে বসল।নাক মুখ কুঁচকে বসার ঘর পর্যন্ত হেঁটে এসে কোনোরকমে দরজা খুলল।দরজা খুলতেই সে চমকে উঠল।ভড়কে যাওয়া কন্ঠে বলল,’আপনি?’
ওয়াজিদের হিমশীতল দৃষ্টি কয়েক মিনিট তাড়িয়ে তাড়িয়ে তাকে দেখল।রিমি সেই চাহনিতেই দ্বিগুণ বিচলিত হলো।ওয়াজিদ একটা তপ্ত নিশ্বাস ছেড়ে গুরুগম্ভীর গলায় বলল,’তুমি কি আমাকে ব্লক দিয়েছ রিমি?’
রিমি দ্রুত ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।সে কখন ব্লক দিলো?নিশ্চিত এগুলো আদি আর নবনীতার কাজ কারবার।সে পুনরায় সামনে দেখে।কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে,’জ্বী না।আমি এমন কিছু করিনি।’
ওয়াজিদ সেই প্রসঙ্গ আর টানলো না।জানতে চাইল,’তোমার নাকি কাল কিসব ব্রাইডাল শাওয়ার?’
‘আমি সেসব কিছু জানি না।বাকিরা জানে।’
‘তুমি তাহলে বিয়েটা ভাঙছ না?’
রিমি অস্বস্তিতে কতোক্ষণ নিজের পরনের জামাটা খাঁমচে ধরে।কি বিরক্তিকর অনুভূতি! সে কোনোরকমে বলে,’আপনি এখন আসুন।’
ওয়াজিদ হতভম্ব চোখে তার দিকে তাকায়।অপমানে তার সমস্ত শরীর ঝনঝন করছে।কান দু’টো গরম হয়ে মনে হচ্ছে এখনই ধোঁয়া বেরিয়ে যাবে।কি সুন্দর অপমান করে দিলো তাকে! সে ঘরের ভেতর পা ও দেয়নি।এখনই বলছে আপনি এখন আসুন।সে চোখ মুখ শক্ত করে বলে,’তোমার বলতে হবে না।আমি এমনিতেও তোমার বাসায় বসতে আসিনি।কথা বলতে এসেছি।’
‘কথা শেষ?’
ওয়াজিদ কোনোরকম উত্তর না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়।যেমন বড় বড় পায়ে সে এসেছিল,তেমন বড় বড় পায়ে সে বেরিয়ে গেল রিমিদের চারতালা বাড়ি থেকে।
.
.
.
.
আরহাম বাড়ি ফিরতেই আদি তাড়াতাড়ি তার পাশাপাশি সোফায় গিয়ে বসল।আরহাম চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করল,’সমস্যা কি তোর?’
‘সমস্যা তো অনেক।আপাতত একটাই সমাধান কর।’
‘সেটা কি?’
আদি হাই তুলতে তুলতে বলল,’রিমির জন্য একটা নকল পাত্র জোগাড় করে দে।’
আরহাম তাজ্জব হয়ে বলল,’কি?কি করব?’
‘পাত্র জোগাড় করবি।’
‘কেন?’
‘ওয়াজিদ নাকি তার সাথে দেখা করবে।’
আরহাম বড় বড় চোখ করে বলল,’সত্যি?সে এমন কিছু বলেছে?’
‘হ্যাঁ।আমাদের তো কিছু বলে না।নবনীতাকে বলেছে তাকে যেন রিমির উড বি এর নম্বর দেয়।’
আরহাম সোফায় হেলান দিয়ে বিরক্ত গলায় বলল,’তো পরী বলে দেক যে তার কাছে নম্বর নেই,দেওয়া সম্ভব না।’
আদি খ্যাক করে উঠে বলল,’কেন কেন?সম্ভব না কেন?তুই বুঝতে পারছিস না।এটা প্ল্যানেরই একটা অংশ।আমরা দেখতে চাই ওয়াজিদ কেমন রিয়েকশান দেয়।এজন্য এসব করাটা জরুরি।’
তার কথা শুনেই আরহাম ফিক করে হেসে দিলো।আস্তে করে তার কাঁধে একটা চড় মেরে হাসতে হাসতে বলল,’এ্যাই তোর বয়স কতো রে?এমন টিনএজ দের মতোন কাজ কেন করছিস?’
‘এতো কিছু বুঝি না।তুই একটা নকল পাত্র জোগাড় করে দে।তাও কালকের মধ্যে।ব্যাস এটাই শেষ কথা।’
আরহাম পড়েছে মহা বিপাকে।শুরুতে ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলেও সময় গড়াতে সে বুঝল বাকিরা সত্যিই চাইছে সে যেন কাউকে নকল পাত্র বানিয়ে ওয়াাজিদের সামনে হাজির করে।নতুন খেলনা গাড়ির জন্য আরিশ যেমন বায়না ধরত,রাতে বাড়ি ফিরে নকল জামাই এনে দেওয়ার জন্য সে তেমনই বায়না ধরল।এতে নাকি খুব মজা হবে।ওয়াজিদ নাকি তাকে দেখেই লুচির মতো ফুলবে।
আরহাম আশ্চর্য হয় এদের কাজকর্ম দেখে।এমন পাগলামো শুরু করেছে কেন এরা?এখন সে নকল জামাই পাবে টা কোথায়?এসব কি হয় নাকি?রাতে নবনীতা ফোন দিয়েও তাকে এই কথাই বলল।তার নাকি এমন একটা নকল জামাই লাগবে ওয়াজিদকে আরো বেশি ক্ষেপানোর জন্য।আরহাম আশ্চর্য হয়ে বলল,’তুমিও কি এসব পাগলের দলে নাম লিখিয়েছ?এরা সব ক’টার মাথায় সমস্যা।’
নবনীতা ফোন কানে চেপেই সামান্য শব্দ করে হাসল।
‘ভালোই লাগছে আমার।বিশেষ করে আপনার বন্ধুর বিষয়টা।আসলে বিয়ে জিনিসটাই অদ্ভুত তাই না?কবুল বলার পরেই মানুষ কেমন পাল্টে যায়।অন্য মানুষটার জন্য আপনাআপনিই কেমন ভালো লাগা কাজ করে মনের ভেতর।তাই না?’
আরহাম চাপা হাসল।
‘হুম।ঠিকই বলেছ।’
কিছুসময় চুপ থেকে সে আবার ডাকল,’পরী।’
‘হু?’
‘তোমাকে মিস করছি।তোমার কথা মনে পড়ছে।’
অন্যপাশের মানুষ টা অষ্টাদশী কন্যার ন্যায় লজ্জায় মিইয়ে গিয়ে উত্তর দেয়,’জ্বী।আমারও মনে পড়ছে।’
‘কি মনে পড়ছে?’
সে হাসল।কোনোরকমে বলল,’সব।’
‘পরী’
‘হু?’
‘একটু বলো তো।’
‘কি বলব?’
‘যেটা আমি শুনতে পছন্দ করি।’
নবনীতা কন্ঠ পরিষ্কার করে বলল,’আমি আপনাকে ভালোবাসি।এত্তো এত্তো ভালোবাসি।’
‘আবার।’
‘আমি আপনাকে ভালোবাসি।’
‘আবার’
নবনীতা ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ে।খানিকটা বিরক্ত হয়ে বলে,’আই লাভ ইউ।আর বলতে পারব না।’
‘কেন বলতে পারবে না?তুমি বলেছিলে সত্যি কথা দিনে একশোবার বলা যায়।তুমি মাত্র তিনবার বলেছ।’
নবনীতা তার কথার ধরন শুনেই হেসে ফেলল।
‘কিছু খেয়েছ?’
‘জ্বী।আপনি?’
‘হু খেয়েছি।ঔষধ?’
‘নাহ।এখন খাবো কথা শেষ করে।’
আরহাম অলস ভঙ্গিতে বলল,’তোমার না আজ ফিরে আসার কথা ছিল?আসোনি কেন?’
‘শুভিটা বড্ড কান্নাকাটি করে।একটা পরীক্ষা শুরু হলেই তারপর আমি চলে আসবো।’
‘ওহ’
‘রাগ হয়েছেন?’
‘ঐ তো।একটুখানি।তুমি আর আরশাদ নেই তো।ঘরটা কেমন খালি খালি লাগে।’
নবনীতা ফোনটা কানে চেপেই স্মিত হাসল।ঘাড় ঘুরিয়ে খাটের মাঝামাঝি শুয়ে থাকা ছোট্ট ছেলেটার ঘুমন্ত মুখশ্রী দেখেই আরো এক গাল হেসে বলল,’আরশু আপনাকে চেনে জানেন?আজ আমরা গ্যালারি তে ছবি দেখছিলাম।আপনার ছবি আসতেই সে খুশিতে লাফিয়ে উঠল।হাত নেড়ে নেড়ে কতো কিছু যে বলল,কিছুই বুঝি নি।আমার মনে হচ্ছে আরশু তার বাবাকে চিনে গেছে।’
নবনীতা আশা করেছিল অন্যপাশ থেকে একটি হাসিখুশি উত্তরের।তার সেই আশায় জল ঢেলে দিয়ে আরহাম অত্যাধিক শীতল কন্ঠে বলে উঠল,’আরশাদ আমার ছেলে না।সে কেন আমাকে বাবা বলবে?আমি নিজের বাচ্চার মুখে বাবা শুনতে চাই।কোনো এডপ্টেড চাইল্ডের মুখে না।’
‘আরহাম!’
‘হোয়াট?’
‘এভাবে কেন বলছেন?’
‘তো কিভাবে বলব?নিজের সন্তান নিজেরই হয়।আমার যার তার জন্য এতো মায়া আসে না।তুমি দেখাও না আরশাদের জন্য মায়া।আমি তো বারণ করি নি।আমাকে আবার এসব বাবা টাবা বানিয়ে আহ্লাদ শুরু করছ কেন?অসহ্য লাগে আমার এসব।’
‘ওহ।’
‘এখন তো তুমি রাগ করছ।’
‘রাগ করি নি।কষ্ট পেয়েছি।’
‘কষ্ট পেলেও কিছু করার নেই।এটাই আমি।নো গুড ভাইবস,নো ফেইক ইমোশানস।’
নবনীতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।জানালা দিয়ে হেমন্তের সুন্দর বাতাস তার এপার্টমেন্টের ছোটো খাটো ঘরটায় আসছে।সেই বাতাসে কেমন এতটা মন খারাপের ভাব আছে।বাতাসটা গায়ে লাগতেই তার মনখারাপ ভাব আরো বেড়ে যায়।
‘গুড নাইট।ঘুম পাচ্ছে আমার।কয়েকটা কাজ আছে হাতে।সেগুলো শেষ করে ঘুমুতে হবে।ফোন রাখছি।’
কোনোরকম বলেই ফোন কাটল আরহাম।সে যা বলেছে তার জন্য সে আফসোস করছে না মোটেও।বাবা ডাকটা অনেক মাহাত্ম্যপূর্ণ।সে পরীর মতো দয়ার ভান্ডার না।তার কিছু সমস্যা আছে।তাকে যে কেউ বাবা ডাকবে এই বিষয়ে তার তীব্র আপত্তি আছে।তার ঔরসজাত সন্তান ছাড়া অন্য কেউ কেন তাকে বাবা ডাকবে?এতো আবেগ তার নেই।পরীর ভেতর এতো আবেগ থাকলে সে আহ্লাদ দেখাক।আরহামকে কেন জড়ায় এসবে?
.
.
.
.
গ্রীন লঞ্জের সামনে এসেই ওয়াজিদ হাত ঘড়িতে সময় দেখে।এতোক্ষণে তো ঐ ছেলের এসে পড়ার কথা।সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে লিফটে উঠল।আজ সে একজনের সাথে দেখা করতে এসেছে।তার নাম দিপ্ত।পেশায় একজন প্রকৌশলী।তার আরো একটি পরিচয় আছে।সে ওয়াজিদের বিবাহিত স্ত্রীকে বিয়ে করতে চায়।কি বিচ্ছিরি ব্যাপার সেপার!
সে সিক্সথ ফ্লোরে এসেই ডানে বায়ে মাথা নেড়ে তার বুক করে রাখা টেবিলটা খুঁজল।টেবিলটা চোখে পড়তেই সে দ্রুত পায়ে সেখানে এগিয়ে যায়।গিয়েই দেখে টেবিলের একটা চেয়ারে একজন ছেলে মাথা নিচু করে বসে আছে।
ওয়াজিদ কাটকাট স্বরে ডাকে,’এক্সকিউজ মি।তুমি কি দিপ্ত?’
ছেলেটা মাথা তোলে।কোনোরকমে জবাব দেয়,’জ্বী আমি।’
ওয়াজিদ তীক্ষ্ণ চোখে তাকে আগাগোড়া পরোখ করল।সে একটা হালকা রঙের টিশার্ট পরেছে।হাতে স্মার্ট ওয়াচ।গলার দিকে সানগ্লাস ঝুলিয়ে রাখা।তার মুখটাও ভীষণ প্রানবন্ত।তাকে প্রথম দেখাতেই সুপুরুষ মনে হয়।চেহারায় একটা বড়োলোকি ঠাঁট বাট আছে।থাকবে না কেন?সে তো বড়লোকই।এজন্যই তো রিমি নিজের স্বামী ফেলে তাকে বিয়ে করতে মত দিয়েছে।প্রথম দর্শনেই ওয়াজিদের কেমন হিংসা হলো ছেলেটিকে দেখে।
সে চুপচাপ তার চেয়ারে গিয়ে বসল।সে ভেবেছিল সে অনেক গুছিয়ে কথা বলবে।কিন্তু দীপ্তকে দেখার পর থেকে তার আর কোনো সুন্দর কথা বের হচ্ছে না মুখ দিয়ে।তার রীতিমতো বিরক্ত লাগছে এই ছেলেকে।সে কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই জানতে চাইলো,’রিমির সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।রাইট?’
দিপ্ত মাথা তুলে।আপ্রাণ চেষ্টা চালায় নিজের অসহায় চাহনি গোপন করার।সে কোনো রিমিকে চিনেই না।সে আরহামের কাছে গিয়েছিল তার একটা সমস্যার কথা জানাতে।সে পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার।সে পড়াশোনা করেছে আর্কিটেক্ট নিয়ে।তার ডিজাইন যথেষ্ট ভালো হওয়া স্বত্তেও রাজনৈতিক কোনো ব্যক্তির রেকমেন্ডেশনের অভাবে সে বড় কোনো কাজ পাচ্ছে না।এই সমস্যার কথা জানাতে সে শাহরিয়ার আরহামের কাছে গিয়েছিল।তারপর কোথা থেকে কি হলো,আরহাম তাকে এক নতুন ঝামেলায় ফাঁসিয়ে দিলো।বলল তাকে নাকি একদিনের জন্য পাত্র সাজার অভিনয় করতে হবে।কি উদ্ভট বিষয়! উপায়ন্তর না পেয়ে দিপ্ত এ আজগুবি কাজে শামিল হয়েছে।এখন কোনোরকমে কেটে পড়তে পারলেই তার জন্য ভালো।
সে ছোট করে বলল,’জ্বী।’
ওয়াজিদ নিজের শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে কোনোরকম ভূমিকায় না গিয়ে বলল,’রিমিকে তুমি বিয়ে করতে পারবে না।রিমি অলরেডি ম্যারিড।আমাদের ধর্মে বিবাহিত মেয়েরা স্বামী বেঁচে থাকতে তালাক ব্যতীত অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে না।রিমির কোনো তালাক হয়নি,আর তার স্বামী বেঁচেও আছে।সুতরাং সে আর কাউকে বিয়ে করতে পারবে না।’
‘রিমির স্বামী কে?’
ওয়াজিদ এক পলক স্থির দৃষ্টিতে তাকে দেখল।তারপরই গম্ভীর হয়ে বলল,’আমি।শী ইজ মাই ওয়াইফ।তুমি আজকেই বিয়েটা ভেঙে দিবে।রিমি আমার স্ত্রী।তুমি কেন তাকে বিয়ে করবে?দেশে কি আইন আদালত কিছু নেই?’
দিপ্ত একবার নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখল।তারপরই নিচু স্বরে বলল,’ডু ইউ হ্যাভ এনি প্রুফ যে রিমি তোমার ওয়াইফ?’
ওয়াজিদ সাথে সাথে চোখ তুলে।তড়াক করে উঠে দাঁড়িয়ে দিপ্তর কলার চেপে ধরে চেঁচায়,’কি?কিসের প্রুফ দেব আমি?আমাকে তোমার মিথ্যেবাদী মনে হয়?আমার আর রিমির বিয়ে হয়েছে।সবচেয়ে বড় প্রুফ রিমি নিজে।রিমি এই কথা অস্বীকার করতে পারবে?’
দিপ্ত হকচকিয়ে গেল।সে কল্পনা করেনি ভরা রেস্টুরেন্টে ওয়াজিদ এই কাজ করবে।লজ্জায় সে মাথা নামিয়ে নিল।অথচ ওয়াজিদ আশপাশের তোয়াক্কা না করেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ওয়ার্নিং দিচ্ছি।যতো দ্রুত পারো বিয়েটা ভেঙে অন্য পথ দেখ।নয়তো বিষয়টা তোমার জন্য ভালো হবে না বলে দিলাম।’
বলেই সে হনহন করে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে এলো।তার মাথা সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে গরম হচ্ছে।এতো অসহ্য লাগছে কেন সবকিছু তার?গাড়িতে বসেই সে টেনে টেনে শ্বাস নেয়।চোখ বন্ধ করতেই তার একটা দৃশ্য মনে পড়ল।
তার মুখোমুখি সোফাতে একটা মেয়ে বসে আছে।সবুজ রঙের জামাটা তার শরীর অনুপাতে বেশ ঢিলা।কাচুমাচু মুখ।চোরা দৃষ্টিতে একবার ওয়াজিদক দেখেই সে দ্রুত মুখ নামিয়ে নেয়।মাঝবয়সী লোকটা তাকে কবুল বলতে বলায় সে মিনমিনে স্বরে তিনবার কবুল বলল।তারপর?তারপর সে ধর্ম মোতাবেক ওয়াজিদের স্ত্রীয়ের মর্যাদা পেল।অথচ মেয়েটি এখন বলছে সে এই বিয়ে মানে না।এটাও কি সম্ভব?সে কেমন করে পারছে আরেক লোকের সাথে বিয়ে করতে?ওয়াজিদ তো জীবনেও এমন কিছু করতে পারত না।
গাড়ির সিটে মাথা রেখেই সে দু’টো ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ল।এই কাটকাট কথা বলা রিমিকে তার ভালো লাগছে না।এই রিমিকে সে চায় না।সে চায় প্রানবন্ত,হাস্যোজ্জ্বল,আর সবকিছুতে ভুল করে ফেলা সেই বাচ্চাসুলভ আচরণের মেয়েটিকে।এই কঠিন মুখ করে রাখা মেয়েটাকে তার একদমই ভালো লাগে না।
বাড়ি ফেরার পর মোবাইল হাতে নিয়ে তার মন আরো এক দফা খারাপ হলো।আজ নাকি কিসব ব্রাইডাল শাওয়ার।সবাই রিমির বাড়িতে গিয়ে সুন্দর সুন্দর ছবি তুলছে।নবনীতা পুডিং বানিয়েছে,ফালুদা করেছে।আদি চাওমিন রান্না করেছে।সবাই মিলে আনন্দ করছে।ওয়াজিদ ছবিগুলো জুম করে শুধু রিমির মুখোভঙ্গি দেখল।মেয়েটা কি খুশি?সত্যিই সে বিয়ে করে ফেলবে?কবুল বলার সময় একবারো তার ওয়াজিদের কথা মনে পড়বে না?ওয়াজিদ তো তার হাসবেন্ড।মনে পড়া উচিত।
_____
পরের দিন বিকেলে শীলা আক্তার একটা সুন্দর মাল্টি কালারের জামদানি গায়ে জড়িয়ে খুব সুন্দর করে সাজলেন।ওয়াহিদুল সাহেবও আলমারি ঘেটে একটা সুন্দর পাঞ্জাবি বেছে নিলেন।
শীলা নিজের সাজগোছ শেষ করে ওয়াজিদের কাছে এলেন।এসেই তাকে তাড়া দিয়ে বললেন,’তুমি এখনো রেডি হও নি?চলো চলো দ্রুত রেডি হও।আমাদের দেরি হচ্ছে।’
ওয়াজিদ মাথা তুলে নিচু স্বরে বলল,’আমি না গেলে হয় না মা?তোমরা যাও প্লিজ।’
শীলা তার কথায় আপত্তি জানিয়ে দ্রুত মাথা নেড়ে বললেন,’না না।তোমাকেও আসতে হবে।চলো চলো।এক্ষুনি রেডি হবে।’
ওয়াজিদ এক প্রকার বাধ্য হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল।তিরিক্ষি মেজাজে নিজের আলমারির দিকে এগিয়ে গেল।আজ নাকি রিমির গায়ে হলুদ।কাল তার বিয়ে।রাগে ওয়াজিদের সমস্ত শরীর রি রি করছে।ঐ বদমাশ দিপ্ত তার মানে বিয়েটা ভাঙেনি।কতো বড়ো সাহস! যাকগে,সেও দেখে নিবে এই বিয়ে কেমন করে হয়।
এখন আবার রিমির মা ফোন দিয়ে তাদের সবাইকে দাওয়াত দিয়েছে হলুদে আসার জন্য।হলুদের আয়োজন নাকি তাদের বাড়ির ছাদে করা হয়েছে।আশেপাশের পরিচিত কয়েকজন আত্মীয় স্বজনদের নিয়েই সম্ভবত আজকের আয়োজন।শুধু আশেপাশের মানুষরা এলে ওয়াজিদের পুরো পরিবারকে বলল কেন?সে কি তাদের প্রতিবেশী লাগে?
শীলা আক্তার আর ওয়াহিদুর সাহেবের উৎসাহ দেখে ওয়াজিদের মনে হচ্ছে হলুদটা বোধহয় তার।এতো আনন্দ কেন দেখাচ্ছে তারা?ওয়াজিদের অস্বস্তি কেবল বেড়েই যায় তরতর করে।আর কতো সহ্য করবে সে?নিজের বউয়ের হলুদ! এই জিনিসও তাকে চুপচাপ সহ্য করতে হবে?
তারা রিমিদের বাড়ি গিয়ে পৌঁছায় সন্ধ্যা সাতটায়।ছাদে পা রাখার পরেই সবার প্রথমে তার চোখ যায় রিমির দিকে।সে পরেছে একটা বাসন্তী রঙের শাড়ির।দু’জনের দৃষ্টি মিলতেই ওয়াজিদ একটা শুকনো ঢোক গিলে।কি আশ্চর্য! মেয়েটাকে এতো সুন্দর দেখাচ্ছে কেন?এতো দিন যাবত সে তাকে দেখছে।কই কখনো তো এতো সুন্দর দেখায়নি তাকে।
সে চুপচাপ চেয়ারে গিয়ে বসে।তার নির্নিমেষ দৃষ্টি স্টেজে বসে থাকা মেয়েটার দিকে।মেয়েটা খুব সম্ভবত তার এই ধাঁরালো আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির খপ্পরে পড়ে কিছুটা ঘাবড়ে গেছে।তাতে ওয়াজিদের কিছুই যায় আসে না।সে তার হাজব্যান্ড।এই কথাটা রিমি ভুলে যায় নাকি?তার এমন দেখাতে কোনো দোষ নেই।সে একশোবার দেখবে।রিমি মানা করার কে?
সবাই একে একে রিমিকে হলুদ ছোঁয়াল।নবনীতা হঠাৎই ব্যস্ত পায়ে ওয়াজিদের সামনে এসে বলল,’ভাইয়া! আপনি রিমিকে হলুদ ছোঁয়াবেন না?’
ওয়াজিদ কপাল কুঁচকে বলল,’কেন?আরহাম আদি কেউ তো তাকে হলুদ দেয়নি।’
‘আগে আপনি শুরু করুন না।’
ওয়াজিদ কথা বাড়াল না।সে সোজা হেঁটে স্টেজে গিয়ে রিমির পাশ ঘেঁষে বসল।রিমি চমকে উঠে একটু বাম পাশে সরে এলো।ওয়াজিদ দাঁত কিড়মিড় করে তার কোমর চেপে একটানে তাকে নিজের কাছে নিয়ে এলো।রিমি আঁতকে উঠে পাশ ফেরে।ওয়াজিদ সামান্য হলুদ হাতে নিয়েই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’এতো নক্তামি করবে না রিমি।দূরে যাচ্ছো কেন?তোমার আর আমার সম্পর্ক এমন ভাব ধরার সম্পর্ক না।’
রিমি এক টানে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে কটমট চোখে বলল,’আমাদের সম্পর্ক খ্যাক খ্যাক করে হাসার মতো কিছুও না।দূরে থাকবেন আমার থেকে।মাতব্বরি একটু কম করবেন।’
ওয়াজিদ খেঁকিয়ে উঠে বলল,’একশোবার মাতব্বরি করব।কি করবে তুমি?’
‘কেন মাতব্বরি করবেন?আপনি আমার কে?’
ওয়াজিদের চটে যাওয়া বিক্ষিপ্ত মেজাজ তার সহ্যের সকল বাঁধ ভাঙতেই দাবানলের মতো দাউদাউ করে জ্বলে উঠল।সে গদি ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল,’আমি তোমার কে মানে?আমি তোমার হাসব্যান্ড।হাসব্যান্ড মানে স্বামী।মানে বর,মানে জামাই।বুঝেছ?হাসব্যান্ড হই তোমার।তোমার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে।সজ্ঞানে কবুল বলে বিয়ে হয়েছে।তুমি আমার ওয়াইফ।আমি একশোবার মাতব্বরি করব।আমার সেই অধিকার আছে।’
চলবে-