#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৪৭)[প্রথম অংশ]
কথা ছিল রবিবার বিকেলে সবাই রাঙামাটি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবে।কিন্তু সেই কথা গাহ্য না করে আরহাম ঠিক করেছে সে আজ সকালেই সবাইকে নিয়ে ঢাকা ফিরবে।এই সিদ্ধান্তের একমাত্র কারণ মুহিত তাশদীদ।এছাড়া এতো দ্রুত রাঙামাটি ছাড়ার আর কোনো কারণ নেই।সে মুহিতের আশেপাশে পরীকে সহ্য করতে পারছে না।একটা সময় তো তাদের মাঝে কিছুমিছু ছিলো।পরী যতোই বলুক পারিবারিকভাবে দেখা হয়েছে,কিন্তু সে নিজেও তো এসবে মৌন থেকে সম্মতি দিয়েছিল।তার মানে অবশ্যই তার মনে একটা সফ্ট কর্ণার আছে মুহিতের জন্য।এই কথাটা ভাবলেই আরহামের মন খারাপ হয়ে যায়।সবার জীবনে কেউ না ছিল,শুধু তার জীবনেই কোনো অতীত নাই।কতো ভালো হতো যদি তারও একটা অতীত থাকতো! তাহলে সেই অতীত নিয়ে সেও পরীকে কাউন্টার অ্যাটাক দিতে পারত।তবে দুঃখজনক হলেও সত্যি,তার জীবনে পরী ব্যতীত আর কোনো নারীর উপস্থিতি কোনোদিনই ছিল না।সে কোনোদিনই এসব মেয়েঘটিত বিষয়ে আগ্রহ দেখায়নি।সে হতাশ হয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।কথা ছিল সে ফাইভ পাশ মেয়ে বিয়ে করে আঙুলের উপর নাচাবে।অথচ কি থেকে যে কি হয়ে গেল!
নবনীতা গাড়িতে উঠেই জানালার পাশ দিয়ে বাইরে দেখতে দেখতে বলল,’আজকের আবহাওয়া অনেক সুন্দর।এমনিতেই ঠান্ডা বাতাস আছে।এসি ছাড়ার কোনো দরকার নাই।’
আরহাম সে কথা পাত্তা না দিয়ে নবনীতার দিকে ঝুকে জানালা বন্ধ করতে করতে নিরেট স্বরে বলল,’আর কাজ নাই খেয়ে দেয়ে।পুরো রাস্তার বালু মুখে মেখে মানুষকে চেহারা দেখিয়ে দেখিয়ে ঘুরি আমরা।আমাদের তো কোনো সিকিউরিটির দরকার নেই।’
নবনীতা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকায়।যেটাই করতে যায়,সেটাতেই সমস্যা।এখন তো তার শ্বাস নিতেও ভয় হয়।দেখা যাবে সে শ্বাস নিতে গেল,আর আরহাম বলল না তুমি এখানে শ্বাস নিতে পারবা না।তখন সে অবাক হয়ে জানতে চাইবে কেন?আরহাম তখন গম্ভীর মুখে উত্তর দিবে-সিকিউরিটি পারপাস।
নিজের চিন্তাভাবনায় তার নিজেরই হাসি পায়।আরহাম তার মুখ দেখেই কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,’কি ব্যাপার?এভাবে পাগলের মতো হাসছ কেন?’
সে দ্রুত মাথা নাড়ে।চারদিক দেখে বলে,’না না কিছু না।’
আরহাম গভীর মনোযোগে তার মুখোভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করে।তার প্রাণবন্ত আর হাস্যোজ্জ্বল মুখটা বলে দিচ্ছে তার মন ভালো।যাওয়ার আগে সে একবারও মুহিতকে দেখেনি,মুহিতও তার কাছে আসে নি।এটাও আরহামের জন্য একটা স্বস্তির বিষয়।সবচেয়ে বড় স্বস্তির বিষয় মুহিত বিবাহিত।বউ বাচ্চা আছে।আরহামের বউ আছে,সাথে একটা রেডিমেড বাচ্চাও আছে।সে তার সিটে বসেই নবনীতার কাঁধে মাথা রেখে হাত টা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’হাতটা একটু টিপে দাও তো পরী।কেমন চিনচিন করছে।’
***
ওয়াজিদ গাড়িতে উঠার আগেই কড়া গলায় আদিকে শাসিয়ে নিল,’তুই যদি আজ আবার বাড়াবাড়ি করিস,তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।আমি রিমির পাশে বসব না।এই নিয়ে তুই আরেকটা কথা বললে আমি অন্য বাসে বাড়ি ফিরব বলে দিলাম।’
আদি তার হাত ধরে টানতে টানতে বাসে উঠল।ভীষণ বিরক্ত গলায় বলল,’আচ্ছা করব না কোনো বাড়াবাড়ি।সবকিছুতে এতো হাইপার হয়ে যাস কেন?চিল ম্যান।’
ওয়াজিদ গজরাতে গজরাতে তার সিটে এসে বসল।একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে যে তারা আজই ফিরে যাচ্ছে।যতো দ্রুত বাড়ি ফিরতে পারবে,ততই তার শান্তি।নয়তো এখানে থাকলে যতোবার সে রিমিকে দেখবে,ততবারই তার মাথা গরম হবে।বাড়ি ফিরেই সে দুইদিন তার ঘর থেকে বের হবে না।এ মুহূর্তে সবকিছু তার অসহ্য লাগছে।এই অসহ্য ভাব কেটে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে কিছুতেই বাড়ি থেকে বের হবে না।
রিমি আড়চোখে একবার তাকে দেখল।আহারে! রিমির কারণে তার মন খারাপ হয়েছে।অথচ রিমি কারো মন খারাপ করতে চায়নি।সে ভাবেনি ওয়াজিদ এমন উদ্ভট বাহানা দিবে।আর দিলেও একবার তো তাকে বলবে! অথচ সে কিছুই বলেনি।বিয়ের পর এমন ভাব করছে যেন রিমি ইচ্ছাকৃতভাবে পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু করেছে।অথচ রিমি নিজেও যে ঘটনার ভুক্তভোগী এই স্বাভাবিক কথাটা তার মাথায় ঢুকছে না।
রিমির মাঝে মাঝে হাসি পায়।ওয়াজিদ যেমন করে পুরোটা দোষ তার উপর চাপিয়ে দিচ্ছে,আসলেই কি সব দোষ তার?ওয়াজিদের কি কোনো ভুল নেই?সে আর এসব নিয়ে ভাবল না।সে খেয়াল করেছে এসব ভাবলেই তার মন খারাপ হয়।এর চেয়ে ভালো সে আর এসবে মাথাই ঘামাবে।এর চেয়ে ভালো চিত্রার সাথে আড্ডা দেওয়া।চিত্রার কথা শুনলেই তার মন ভালো হয়ে যায়।
সব যাত্রীরা গাড়িতে উঠে বসতেই ছোটখাটো ভিআইপি বাসটা সাঁই সাঁই করে যাত্রা শুরু করে ঢাকার পথে।আদি একবার পাশ ফিরে ওয়াজিদকে দেখে।ওয়াজিদ স্বভাবতই বেশ অন্তর্মুখী।কিন্তু এতোটাও না।অথচ আজকাল ছেলেটা ঠিক মতো কথাও বলছে না।সে আলতো করে তার কাঁধে হাত রাখে।গম্ভীর হয়ে বলে,’হয়েছে টা কি তোর?একটু খুলে বল না আমাকে।’
ওয়াজিদ এক ঝাড়ায় তার কাঁধ ছাড়িয়ে নেয়।বিরক্ত হয়ে বলে,’ছাড় তো।ভালো লাগে না এসব।আমারটা আমাকে বুঝতে দে।প্লিজ! সবকিছুতে কথা বলিস না।’
আদি থেমে গেল।আর টু শব্দও করল না।কি অদ্ভুত! সে তার সাথে এমন রূঢ় আচরন করছে কেন?সে তো ভালো কথাই বলেছে।
.
.
.
.
প্রায় দু’সপ্তাহ গড়িয়েছে।সবার জীবনেই ব্যস্ততা বেড়েছে।শুভ্রা পুরোদমে নিজের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে।তার পরীক্ষার আর বারো দিন বাকি।চিত্রকে আজকাল সে খুব একটা সময় দিতে পারে না।চিত্র মামির সাথেই থাকে দিনের বেশিরভাগ সময়।আর শুভ্রা থাকে বই খাতা নিয়ে।মাঝরাতে পড়তে পড়তেই হঠাৎ তার আপাইয়ের কথা মনে পড়ে।তখনই তার দুই চোখ ছাপিয়ে কান্না আসে।আপাই থাকলে এখন তার পাশাপাশি জেগে থাকতো,তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতো।তাকে খুব বেশি আদর দিত,ভালোবাসতো।চিত্র তো মামির মিছেমিছি আদরে মানিয়ে নিয়েছে।শুভ্রা তো নিজেকে মানাতে পারছে না।কিছুতেই মানাতে পারছে না।পরীক্ষার আগের দিনগুলোতে আপাই যেভাবে তার যত্ন করতো,এই যত্ন এখন আর কে করবে?
রাতে পড়ার ফাঁকেই আচমকা সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।তারপরই শক্ত করে নিজের মুখ চেপে ধরে।কি সাংঘাতিক! সে এভাবে কাঁদছে কেন?
রাত তিনটা।শুভ্রা ডুব দিয়েছে মার্কনিকভ’স ল এর মেকানিজমে।বাড়ির সামনের গাছ থেকে কোনো একটা পাখি কর্কশ,কানে ধরা শব্দে ডাকছে।শুভ্রার মোবাইল ফোনটা হঠাৎই শব্দ করে বেজে উঠল।সে তাড়াতাড়ি ফোন হাতে নেয়।স্ক্রিনের নামটা দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে।সে এক লহমায় কল রিসিভ করে সে ফোনটা কানে চাপে।অন্য পাশ থেকে নবনীতা মোলায়েম স্বরে বলে,’এখনো সজাগ শুভি?’
‘হু’
‘পড়ছিস?’
‘হু’
‘পড়ছিস নাকি কাঁদছিস?’
দীর্ঘসময় চেপে রাখা কান্নাটা আর বোধহয় বাঁধ মানলো না।নবনীতার কন্ঠ শুনতেই শুভ্রা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।কান্নার মাঝেই বলল,’তোমাকে ছাড়া আর থাকতে পারছি না আপাই।প্লিজ একটু বাড়ি আসো।বেশি না,একদিনের জন্য।আরহাম ভাইকে একটু বলো না।’
অন্যপাশ থেকে কোনো জবাব এলো না।জবাব দিবে কেমন করে?শুভ্রা তো জানে যে সে নিজেও কাঁদছে।নবনীতা কান্না গিলে কোনোরকমে বলল,’আর রাত জাগিস না শুভি।ঘুমিয়ে যা।সকালে ফোন দিয়ে তুলে দিব আমি।তখন আবার পড়িস।’বলেই সে জবাবের অপেক্ষা না করে ফোন কাটে।
কথা শেষ হওয়ার পরেও নবনীতা আরো দীর্ঘসময় বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে।বুক চিরে কেবল দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।আর চোখ দু’টো একটু পর পর অশ্রুতে ভেসে যায়।সে পেছন ফিরে আরহামকে দেখে।সে নিশ্চিন্তে হাত পা ছড়িয়ে আরামে ঘুমুচ্ছে।অথচ নবনীতা পুরু রাত নির্ঘুম কাটালো।কান্না করে করে তার চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে।শুভ্রার কথা অনেক মনে পড়ছে।সে বাড়ি যেতে চায়।গতকালই আরহামকে এই কথা বলেছিল সে।অথচ আরহাম মুখের উপর মানা করে দিলো।নবনীতা বারান্দার মেঝেতে বসে আলতো করে মাথাটা রেলিংয়ে রাখে।নিজ থেকেই বিড়বিড় করে,’আপাই আছি শুভ্রা।সবসময়ই তোর আর চিত্রর সাথে আছি আমি।’
____
আরহাম তার অফিসেই ছিলো।নানারকম মানুষ এটা সেটা নিজেদের প্রয়োজনে তার কাছে আসছিলো।সে মেকি হাসি ফুটিয়ে সবার কথা শুনল।ভেতরে ভেতরে সব অসহ্য লাগছে তার।এতো বকবক করতে তার ভালো লাগে না।তাও আবার অচেনা মানুষদের সাথে।কিন্তু কি আর করার! এমন পেশায় জড়িয়েছে যে মানুষ ছাড়া তার আর কোনো গতি নাই।
সন্ধ্যার একটু আগেই তোফায়েল তার কাছে এসে বলল,’ভাই,,ভাবির বোন এসেছে আপনার সাথে দেখা করতে।’
আরহাম ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।চঞ্চল গলায় বলে,’কে?শুভ্রা?ভেতরে আসতে বল না।’
শুভ্রা ভেতরে এলো।আরহাম তাকে দেখেই স্মিত হেসে বলল,’কি হয়েছে শুভ্রা?কোনো সমস্যা?ভাইয়াকে বলো।’
শুভ্রা কতোক্ষণ মেঝে দেখে।তারপরই মাথা তুলে ক্ষীণ স্বরে বলে,’আমার পরীক্ষা ভাইয়া।দোয়া করবেন আমার জন্য।’
আরহাম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।এগিয়ে এসে একটা হাত শুভ্রার মাথায় রেখে বলে,’পরীক্ষা ভালো হবে।দোয়া করে দিলাম।যদিও আমার দোয়ায় হিতে বিপরীত হওয়ার চান্স আছে,তবুও করলাম।’
বলেই সে তার মানিব্যাগ থেকে পাঁচটা কচকচে হাজার টাকার নোট শুভ্রার দিকে বাড়িয়ে দিলো।শুভ্রা সেই টাকা নিল না।তার পরিবর্তে আরহামের ডানহাতটা আলতো করে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলল,’ভাইয়া আমার টাকা চাই না।আমার অন্য কিছু চাই।’
আরহাম কপাল কুঁচকায়।
‘সেটা কি?’
‘আমার আপাইকে চাই।আপনি প্লিজ কিছুদিনের জন্য আপাইকে আমাদের বাসায় থাকতে দিন।প্লিজ ভাইয়া।আর কিছু চাইবো না আপনার কাছে।’
আরহাম কয়েক পল তাকে দেখে।তারপরই শান্ত ভঙ্গিতে মুঠোফোন বের করে কোথাও একটা ডায়াল করে।কল রিসিভ হতেই গম্ভীর হয়ে বলে,’ব্যাগ গোছাও।রোকন একটু পরেই গাড়ি নিয়ে আসছে।সে আসলে গাড়িতে উঠে বসবে।’
.
.
.
.
নবনীতা তার ঘরের খাটে শুয়েই কতোক্ষণ গড়াগড়ি খেল।আরশাদ খাটের একপাশে আরামে ঘুমুচ্ছে।আজ সে অনেকগুলো দিন পরে তার এপার্টমেন্টে এসেছে।অবশেষে!! অবশেষে আরহাম তাকে আসতে দিয়েছে।এখানে আসার পর থেকেই সে একটু পর পর খিলখিল করে হাসছে।তার কোনো কারণ ছাড়াই ভালো লাগছে।
সে খাটে শুয়েই মাথা তুলে একবার রিমিকে দেখে।যার চাহনিতে বিষন্নতার ছাপ স্পষ্ট।নবনীতা কপাল কুঁচকে বলে,’কি রে?এমন করে বসে আছিস কেন?কথা বল।তোর আবার কি হয়েছে?’
রিমি উদাস চোখে তার দিকে তাকায়।মলিন মুখে জবাব দেয়,’না তো।কিছু না।’
আজকে বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব ভাব।বিভা এসেছে,রিমি এসেছে।নবনীতাও অনেকদির পর এসেছে।আগে যদিও সে বহুবার এসেছে।তবে রাতে থাকার অনুমতি সে অনেকদিন পরে পেয়েছে।তাই সে রিমিকে সহ ডেকে এনেছে।ভেবেছে দু’জন মিলে জমিয়ে আড্ডা দিবে।অথচ এখানে আসার পর থেকে রিমি মুখে কুলুপ এটে বসে আছে।না নিজ থেকে কিছু বলছে,না নবনীতার কথায় সাড়া দিচ্ছে।
নবনীতা খাট ছেড়ে উঠে দাঁড়াল।রিমির সামনাসামনি দাঁড়িয়ে কোমরে হাত রেখে বলল,’ব্যাপার কি রিমি?তোর কি হয়েছে বল তো।’
‘কিছু না।’
‘মিথ্যো বলবি না।সত্যি সত্যি বল।’
রিমি মাথা তুলে।মলিন সুরে বলে,’বাড়ি থেকে বিয়ে দেখছে আমার।’
‘তো?এটা তো আরো আগের ঘটনা।এখন এতো মন খারাপ করছিস কেন?’
রিমি জবাব দিলো না।নবনীতা তার পাশাপাশি বসে তার কাঁধ জড়িয়ে বলল,’এ্যাই মেয়ে! কি হয়েছে বল না।’
রিমি বলল না।উল্টো হঠাৎই ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলল।নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’কি সর্বনাশ! কাঁদছিস কেন বোকা মেয়ে?কিসের এতো কষ্ট?আমি আছি না?দেখি খুলে বল তো আমাকে ঘটনা টা কি?’
রিমি কাঁদতে কাঁদতেই তাকে জড়িয়ে ধরল।নাক টানতে টানতে বলল,’প্রমিজ কর কাউকে বলবি না?’
‘প্রমিজ কাউকে বলব না।’
.
.
.
.
কলিংবেলটা অনেকক্ষণ হলো বাজছে।নবনীতা কুচি ধরে ছুটে এসে দরজা খুলতেই তব্দা খেল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি ব্যাপার?তোমরা?’
তাসনুভা জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’তোমাকে খুব মিস করছিলাম।তাই চলে এসেছি এখানে।’
আরহাম গট গট করে হেঁটে সোফায় গিয়ে বসল।পাঞ্জাবির দু’টো বোতাম খুলে ক্লান্ত গলায় বলল,’তোমার ছানা পানারা তোমাকে ছাড়া থাকতে পারে না।তাই সবাই কে নিয়ে এলাম।সাথে আদি দামড়া টাও এসেছে।সে নাকি একা থাকতে পারবে না।’
নবনীতা চোখ সরু করে তাকে দেখে।সে কবে এতো ভালো হলো যে সবাইকে খুশি করতে নিজের বাড়ি ছেড়ে নবনীতার এপার্টমেন্টে এসে উঠেছে?সবাই যখন নিজেদের কাজে ব্যস্ত তখন আরহাম হঠাৎই তার এক হাত টেনে বলল,’আসল ঘটনা হচ্ছে আমি নিজেই তোমাকে মিস করছিলাম।তাই বাকিদের অযুহাত বানিয়ে চলে এলাম।কেমন হয়েছে আমার আইডিয়া?’
নবনীতা দাঁত কেলিয়ে বলল,’খুব ভালো।এতো বুদ্ধি নিয়ে ঘুরেন কীভাবে?মাথা ভার ভার লাগে না?’
‘তা একটু লাগে।আমি মানিয়ে নেই আরকি।’
সবাই একটু স্থির হতেই নবনীতা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুজে চওড়া গলায় বলো,’শোন শোন।আমার একটা কথা আছে।’
বলেই সে আরহাম আর আদির দিকে তাকালো।তারা তাকে দেখতেই সে কটমট করে বলল,’আজকে আপনাদের সুশীল বন্ধুর কীর্তিকলাপ শুনাবো।এরপর তাকে কি করা উচিত সেটা আপনারাই বলবেন।’
চলবে-
#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৪৭)[দ্বিতীয় অংশ]
আরহাম বিস্ফারিত নয়নে সামনে দেখে একপ্রকার চেঁচিয়ে উঠে বলল,’কি?ওয়াজিদের সত্যিই বিয়ে হয়েছে?’
নবনীতা কটমট করে জবাব দিলো,’জ্বী।তাও আবার নিজের দোষে।এখন সব দোষ সে আমার বান্ধবীর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে।’
বলেই সে রিমির দিকে তাকায়।রিমি সবার গোল গোল চাহনিতে নিজেকে আরো বেশি দেয়ালের সাথে মিশিয়ে নিল।নবনীতা বলেছিল সে কাউকে কিছু বলবে না,অথচ সে বলল তো বলল,একদম ওয়াজিদের বন্ধুদের সবটা বলে দিলো।এখন কি হবে?সেই তো ওয়াজিদ শোনার পরে তার সাথেই রাগারাগি করবে।রিমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।আবার একটা ঝামেলা বাঁধিয়েছে সে।
আদি ক্ষেপাটে সুরে চেঁচায়,’কি রে?ঐ বেয়াদবটা কি এতো বড়ো ঘটনা ধামাচাপা দিতে চেয়েছিল নাকি?’
‘তাই তো মনে হচ্ছে।’
নবনীতা চুপচাপ ফ্লোরে বিছিয়ে রাখা কার্পেটে গিয়ে বসল।গালের নিচে হাত রেখে বলল,’এটা এক ধরনের অন্যায়।বিয়ে করার পর বলছে বিয়ে মানি না।এটা কেমন কথা?আমার এই বিষয়টা একদমই ভালো লাগেনি।এই ঘটনায় ৯০% দোষ আপনাদের বন্ধুরই।’
আরহাম বিরক্ত হয়ে জানতে চাইল,’এখন উপায় কি?ঐ শালাকে কিভাবে সেটা রিয়েলাইজ করাবো?’
নবনীতা দায়সারা হয়ে জবাব দেয়,’রিয়েলাইজ করানোর দরকার নেই।সে যা চাইছে যেমন চাইছে,সব তেমনই হবে।আমরা কেউ তার এই বিয়ে স্বীকারই করব না।দেখি সে কেমন করে হাসি মুখে সবকিছু মেনে নেয়।’
.
.
.
.
পার্টি অফিসে যাওয়ার পরই আরহাম গালভর্তি হেসে ওয়াজিদকে জড়িয়ে ধরল।ওয়াজিদ আজ অনেকগুলো দিন পরে এখানে এসেছে।আরহামের অতিমাত্রায় ভালো আচরণে সে ভড়কে গিয়ে বলল,’কিরে?ব্যাপার কি?’
‘ব্যাপার কিছু না।আয় বোস।’
সে শান্ত পায়ে সোফায় গিয়ে বসল।আজ তার মন যথেষ্ট ভালো।রাঙামাটি থেকে ফেরার পর কিছুদিন তার মেজাজ খারাপ ছিলো প্রচন্ড।অকারণেই রেগে যাচ্ছিল।এখন তার মেজাজ ভালো।সময়ের সাথে সবকিছুতেই নিজেকে ধাতস্থ করেছে সে।সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিমি নামের ঐ মেয়েটি সামনে এলেই সে দ্রুত সেখান থেকে চলে আসবে।তার সাথে ওয়াজিদের আর কোনো কথা না হলেও চলবে।
আরহাম কিছুক্ষণ নিজেদের নিয়ে কথা বলল।তারপর হুট করেই প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,’আরে তোকে তো সুখবর দেওয়াই হয়নি।’
ওয়াজিদ স্থির চোখে তাকে দেখল।তারপরই অল্প হেসে বলল,’কংগ্রেচুলেশানস।’
আরহাম থতমত খেয়ে বলল,’আমাকে কেন এসব বলছিস?’
‘তো কাকে বলব?তুই বাবা হচ্ছিস এটার জন্য তো তোকেই বলব।’
আরহাম কতোক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে তাকে দেখে।তারপরই হো হো করে কিছুক্ষণ ঘর কাঁপিয়ে হাসে।হাসতে হাসতেই বলে,’ওরে বেকুব! আমি কোনো বাবা টাবা হচ্ছি না।’
‘তাহলে?আর কি সুখবর?’
আরহাম চেয়ার ছেড়ে উঠে ওয়াজিদের পাশাপাশি গিয়ে বসল।বসেই একটা হাত তার কাঁধে রেখে আমোদে গলায় বলল,’জানিস?রিমির তো বিয়ে হচ্ছে।পাত্র আমার খুবই পছন্দ হয়েছে।’
চকিতে পাশ ফিরে ওয়াজিদ।চোখে মুখে সেই চমক রেখেই প্রশ্ন করে,’কি?কার বিয়ে হচ্ছে?’
‘রিমি রিমি।আমার বড় শ্যালিকা।সিদরাতুল মুনতাহা।’
খুবই দ্রুত জবাব দেয় আরহাম।জবাব দিয়েই একবার ওয়াজিদের দিকে আড়চোখে তাকায়।বোঝার চেষ্টা করে তার মতিগতি।ওয়াজিদ ক্ষণকাল চুপ থাকে।তারপরই অত্যাধিক ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,’রিমি বিয়েতে রাজি হয়েছে?’
আরহাম কুটিল হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’অবশ্যই হয়েছে।বয়স কি কম হয়েছে নাকি?রাজি হবে না কেন?পাত্র ভালো,অবশ্যই রাজি হয়েছে।’
ওয়াজিদ আনমনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।মাথার পেছনে একটা হাত রেখে ক্লান্ত স্বরে বলে,’বাহ ভালো।আমার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দিস।’
কথা শেষ করে সে এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।আরহাম কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইলো,’কিরে?কোথায় যাচ্ছিস?মাত্র তো এলি।’
ওয়াজিদ সামনে যেতে যেতে ছোট করে জবাব দেয়,’কাজ আছে।পরে আসবো।’
গাড়িতে বসার পরেই ওয়াজিদ মিনিট দুয়েক চুপচাপ বসে থাকল।হঠাৎই কেমন যে অস্বস্তি হচ্ছে তার! কেন হচ্ছে?রিমির বিয়ের কথা শুনে?রিমি বিয়ে করছে তো কি হয়েছে?করুক বিয়ে।বয়স হয়েছে বিয়ে করবে,এটাই তো স্বাভাবিক।ওয়াজিদ আস্তে করে স্টিয়ারিংয়ে মাথা রাখে।বিষয়টা তার ভালো লাগছে না।বিয়ে করবে মানে?বাকিরা না হয় জানে না,কিন্তু রিমি তো জানে।জেনে বুঝে সে কেন অন্য কাউকে বিয়ে করবে?
ওয়াজিদ বের হতেই আরহাম দ্রুত ফোন হাতে নিল।নবনীতা ফোন করছে।সে কল রিসিভ করেই বলল,’শালা কথা শুনেই বেরিয়ে গেছে।’
নবনীতা অধৈর্য আর ব্যাকুল গলায় জানতে চায়,’বিয়ের কথা শোনার পর কেমন এক্সপ্রেশন দিলো?’
আরহাম মুখ দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে বলল,’তেমন সিরিয়াস কিছু না।ভেরি নরমাল।শুভেচ্ছা জানালো রিমিকে।’
নবনীতা লটকানো মুখে বলল,’ধ্যাত।আমি ভেবেছিলাম কিছু একটা হলেও বলবে।’
আরহাম বিরক্তি জড়ানো কন্ঠে জবাব দেয়,’বলেনি তো কিছু।এখন কি করার আছে?তোমার আইডিয়াই ফ্লপ।ওয়াজিদ হ্যাজ নো ফিলিংস ফর রিমি।’
নবনীতা চুপচাপ হতাশার শ্বাস ছাড়ে।আরহাম গাঢ় গলায় বলল,’আমাদের অন্য কোনো কনক্লুশানে যেতে হবে পরী।এভাবে কিছু হবে না।’
এরপর কি হলো আরহাম জানে না,নবনীতা হঠাৎই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে চেঁচিয়ে উঠে বলল,’আরহাম!! ওয়াজিদ ভাইয়া রিমিকে কল দিয়েছে।’
আরহাম তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।চোখ বড় বড় করে বলে,’কি বলো?সত্যি?’
‘হু।আপনি ফোন রাখুন।আমি একটু ঘটনাটা বুঝে আসি।’
.
.
.
.
রিমি জড় পদার্থের মতো ফোন হাতে বসে আছে।তার হাত অল্প অল্প কাঁপছে।সে চোখ তুলে সামনে দেখল।আদি আর নবনীতা তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে।সে মিনমিনে গলায় বলল,’এবার তো কলটা রিসিভ করি।চারবার দিয়েছে।আর কতো অপেক্ষা করাবো?’
নবনীতা কড়া স্বরে তৎক্ষনাৎ জবাব দেয়,’না।রিসিভ করবি না।আরো দিক ফোন।দশবার দিক।তারপর ধরবি।’
সে দুই কদম এগোয়।একহাত উপরে তুলে রিমিকে চড় মারার ভঙ্গিতে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’ফোন রিসিভ করার পর যদি একটাও মিষ্টি কথা বলেছিস,তবে আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’
আদি তার কথায় সম্মতি জানিয়ে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’হ্যাঁ হ্যাঁ।একদম পাত্তা দিবে না রিমি।তুমি নরম হলেই সে আলগা ভাব দেখানোর সুযোগ পাবে।তুমি তাকে পাত্তাই দিবে না।’
রিমি আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে।কাল রাতে নবনীতা আর আদি মিলে বুদ্ধি বের করেছে তারা ওয়াজিদকে রিমির বিয়ে নিয়ে ক্ষেপাবে।ওয়াজিদকে বলবে রিমির বিয়ে হয়ে যাচ্ছে।মোদ্দাকথা তারা কেউই নিজ থেকে ওয়াজিদকে জানাবে না যে তাদের বিয়ের ব্যাপারটা সবাই জেনে গেছে।উল্টো তারা এমন কিছু করবে যাতে ওয়াজিদ নিজেই উপায়ান্তর না পেয়ে নিজের বিয়ের কথা নিজেই জানিয়ে দেয়।সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ওয়জিদের দুই মিত্র আর নবনীতা আটঘাট বেঁধে নেমেছে।
নয়বার ফোন দেওয়ার পর দশম বারে রিমি কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে।তার সামনে নবনীতা মোটা একটা বই হাতে দাঁড়িয়ে আছে।উদ্দেশ্য-সে বেশি নরম কথা বললেই ঠিক তার মুখ বরাবর বইটা ছুড়ে মারবে।
রিমি একটু শ্বাস টেনে কল রিসিভ করে।কন্ঠ স্বাভাবিক রেখে বলে,’আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।’
ওয়াজিদ সালামের জবাব না দিয়েই থমথমে মুখে প্রশ্ন করে,’তুমি নাকি বিয়ে করছ?’
রিমি মুখ খিঁচে জবাব দেয়,’জ্বী করছি।’
নবনীতা একছুটে তার কানটা রিমির ফোনের সাথে চেপে ধরে।একপক্ষের কথা শুনলে সে ব্যাপারটা ঠিক বুঝবে না।ওয়াজিদ আগের মতো করেই জানতে চাইল,’তোমার কি মনে আছে যে তুমি অলরেডি কারো সাথে বিয়ে করেছ?’
রিমি থমকায়।কিছু সময় চুপ থাকে।নবনীতা আড়চোখে তার দিকে তাকায়।নবনীতাকে অবাক করে দিয়ে রিমি অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,’না আমার মনে নেই।কারণ আমার কোনো বিয়ে হয়ই নি।’
ওয়াজিদ ভড়কে গিয়ে বলল,’হোয়াট?মাথা ঠিক আছে তোমার?বিয়ে হয়নি মানে?দেখো রিমি।আমার মুখ খোলাবে না তুমি।তোমার বিয়ে হয়েছে।কেউ না জানুক।তুমি এটা জানো।’
‘না।কোনো বিয়ে হয়নি আমার।বাপ নেই ,ভাই নেই,কাছের মানুষ কেউ নেই।বর কনের নিজেদের সম্মতি নেই।এটাকে কি বিয়ে বলে নাকি?এই বিয়ে আমি মানিই না।’
সে জবাব দিলো দ্ব্যর্থহীন ভাবে,কোনোরকম জড়তা কিংবা ভয় ছাড়াই।বলতে গিয়েই সে টের পেল কোনোরকম চাপে পড়ে নয়,বরং তার ভেতর থেকেই কথাগুলো বেরিয়ে আসছে।নবনীতার ধমকে সে এসব বলে নি।সে নিজের মনের কথাটুকুই বলেছে।রিমি হাস্যোজ্জ্বল,প্রাণবন্ত।সে কোনো কিছু খুব একটা গায়ে মাখে না।অথচ ওয়াজিদ নামের মানুষটা তার সেই স্বভাবটাকেই তার ব্যক্তিত্বহীনতা ভেবে নিল।রিমি ব্যক্তিত্বহীন না।চটপটে হওয়া মানে ব্যক্তিত্বহীন হওয়া না।এই সোজা কথাটা ওয়াজিদকে বুঝতে হবে।
ওয়াজিদ তার কথার ধরন শুনেই ভ্যাবাচ্যাকা খেল।গোল গোল চোখ করে বলল,’বিয়ে মানো না মানে?’
‘বিয়ে মানি না মানে এই বিয়ে কে বিয়ে বলতেই আমার আপত্তি আছে।আপনি যেমন চান এই বিয়ে নিয়ে কোনো কথা না উঠুক,আমিও চাই।আমি চাই আপনি আপনার রাস্তায় আর আমি আমার রাস্তায় থাকি।’
ওয়াজিদ চুপচাপ তার কথা শুনে।সে থামতেই ওয়াজিদ গম্ভীর গলায় ডাকে,’রিমি।’
‘কি?’
‘হ্যাভ ইউ গন ক্রেজি?রিলিজিয়ন বলতেও একটা জিনিস আছে।আমরা একটা ধর্ম মেনে চলি।সেখানেও কিছু রুলস রেগুলেশনস আছে।ধর্ম মোতাবেক বিয়ে হওয়ার পর আমরা নিজের মর্জি মতো সেই বিয়ের বৈধতা দিতে পারি না।’
‘আপনিই তো বলেছেন যে ধর্মে এমন বাপ ভাইয়ের অনুমতি ছাড়া বিয়ে হয় না।’
ওয়াজিদ বড় বড় শ্বাস টেনে রাগ নিয়ন্ত্রণ করল।তারপর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’তো সেজন্য কি আমি এখন আরেকজনকে বিয়ে করছি?তুমি কোন আক্কেলে বিয়ে তে রাজি হয়েছো?’
রিমি ফোনটা এক কান থেকে সরিয়ে অন্য কানে চেপে ধরল।ভাবলেশহীন হয়ে প্রতিউত্তর করল,’জানি না।’
ওয়াজিদ নিশ্চুপ থাকে কিছুক্ষণ।তারপরই বরফ শীতল কন্ঠে বলে,’তুমি বিয়েটা ভেঙে দাও রিমি।এই মুহুর্তে ভেঙে দাও।’
রিমি হকচকায়।আশ্চর্য হয়ে বলে,’কি বলছেন কি?বিয়ে কেন ভাঙবো?আপনি এসব নিয়ে দয়া করে কোনো কথা বলবেন না।নিজেকে নিয়ে ভাবুন।আমারটা আমাকে ভাবতে দিন।রাখছি।খোদা হাফেজ।’
বলে সে আর জবাবের অপেক্ষা করে না।সাথে সাথে ফোনটা কেটে খাটের উপর ফেলে দেয়।নবনীতা তাজ্জব হয়ে বলে,’কিরে রিমি?তুই কি সত্যি সত্যি রেগে আছিস নাকি?’
রিমি ফ্যাকাশে মুখে মলিন হাসল।ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলো,’নাহ।রাগ হই নি।বলতে গিয়ে আপনাআপনি মুখ ফুটে বেরিয়ে এলো।’
সে গিয়ে চুপচাপ আগের মতো খাটে বসল।খানিকটা দুঃখী,খানিকটা হতাশ,আর খুব বেশি বিচলিত গলায় বলল,’এসব ভালো লাগছে না রে।পরে আবার একটা ঝামেলা হবে।আমার এসব ঝামেলা ভালো লাগে না।’
_______
রিমির ঝামেলা ভালো না লাগলেও রিমির আশেপাশের মানুষদের ঝামেলা বড়ই ভালো লাগে।ওয়াজিদ নিজ থেকে ফোন দেওয়ার পর নবনীতা আর আদি দু’চোখে নতুন করে সম্ভাবনার আলো দেখতে পেল।আরহাম পুরো ঘটনা শুনেই প্রসন্ন হেসে বলল,’এখন মনে হচ্ছে কিছু একটা হলেও হতে পারে।তবে রিমিকে বলবে একদম ছাড় না দিতে।শালা আরেকটু ভুগুক।’
রিমি ছাড় দিবে কি দিবে না এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও রিমির নেই।নবনীতা আর আদি সারাক্ষণ তাকে বুদ্ধি দেয় কি করতে হবে।ওয়াজিদ তাকে এরপরেও বহুবার ফোন দিয়েছে।তারা দু’জন আর কল রিসিভই করতে দেয় নি।
নবনীতা দুই দিন যেতেই আরেকটা বুদ্ধি বের করল।রিমির সার্টিফিকেট সংক্রান্ত কাজে ক্যাম্পাসে যাওয়ার প্রয়োজন ছিলো।সে আরহামকে বলল এই খবরটা যেন ওয়াজিদের কাছে পৌঁছে দেয়।আরহামও চট করে এক মিনিটে অন্য কথার প্রসঙ্গ এনে কথার ফাঁকে ফাঁকে এই বিষয়টাও ওয়াজিদকে জানিয়ে দিলো।
ওয়াজিদ কথাটা শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দিলো না।আরহাম নবনীতার এপার্টমেন্টে ফিরেই বলল,’ধুর ছাতা! শালা কোনো রিয়েকশানই দেয় নাই।’
নবনীতা চায়ের কাপে চা ঢালতে ঢালতে চাপা স্বরে বলল,’আপনার বন্ধু তো আপনাদের মতো বোকা না।সে ঠিকই কাল ক্যাম্পাসে যাবে।অথচ ভাব দেখাচ্ছে তার কিছুই যায় আসে না।’
বলেই সে চায়ের কাপটা আরহামের দিকে এগিয়ে দিলো।আরহাম চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই সন্দিহান গলায় বলল,’তোমার মনে হচ্ছে ওয়াজিদ কাল রিমির সাথে দেখা করার বাহানায় ক্যাম্পাসে যাবে?’
‘অবশ্যই।মনে হয় না।সে অবশ্যই অবশ্যই যাবে।’
আরহাম আরেকটা চুমুক দিয়ে সোফায় হেলান দিয়ে ভাবলেশহীন হয়ে বলল,’আচ্ছা দেখা যাক কি হয়।’
.
.
.
.
রিমি ক্যাম্পাসের ভেতর পা রেখেই কপালের ঘাম মুছে এদিক সেদিক তাকায়।আজকে রোদের তেজ অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু বেশি।আসতে আসতেই সে ঘেমে গেছে।সে একটু জিরিয়ে নিয়ে আবার সামনে এগিয়ে গেল।
সে অনেকখানি এগিয়ে যেতেই আরো একটা গাড়ি এসে থামল ক্যাম্পাসের সামনে।আদি,নবনীতা আর আরিশ হুড়মুড় করে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।নবনীতা চারদিক দেখে বলল,’কি মনে হয়?ওয়াজিদ ভাইয়া কি আসবে?’
আরিশ দ্রুত উপরনিচ মাথা নেড়ে জবাব দেয়,’হু ভাবি।আমার মনে হয় আসবে।গাট ফিলিং আসছে আমার।’
সে কথা শেষ করার আগেই আদি চাপা কন্ঠে চেঁচায়,’ঐ যে ওয়াজিদের গাড়ি।লুকা ভাই লুকা!’
তিনজনই ছুটে গিয়ে গাড়ির পেছনে লুকায়।নবনীতা মাথা বের করে উঁকি দিয়ে সামনে দেখল।গাড়ি থামতেই ওয়াজিদ আস্তে ধীরে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।চোখের সামনে রোদ চশমা চাপিয়ে সে দ্রুত ভেতরে পা বাড়ায়।
নবনীতা বাকি দু’জনকে তাড়া দেয়,’চলো চলো।আস্তে আস্তে ভেতরে যাই আমরা।’
রিমি কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে বের হতে হতে বারোটার মতো বাজলো।সে প্রশাসনিক ভবনের নিচতালায় নেমে একটু সামনে যেতেই কোথা থেকে একটা হাত শক্ত করে তার ডান হাতের কবজি চেপে ধরল।ধরেই একটানে তাকে প্রশানিক ভবনের পেছনে নিয়ে এলো।
নবনীতা দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আরহামের সাথে কথা বলছিলো।আজ তার দুইটা মিটিং আছে মোট।একটা শেষ হয়েছে একটু আগে,আরেকটা একটু পর শুরু হবে।এই অবসর সময়টা সে ব্যস্ত ছিলো নবনীতার সাথে ফোনালাপে।নবনীতা ফোন দিয়েই চটপটে গলায় জানায় ওয়াজিদ নাকি ক্যাম্পাসে এসেছে।সে,আদি আর আরিশও প্রত্যক্ষ দর্শন করার জন্য ক্যাম্পাসে এসেছে।আরহাম তার কথা শুনেই আলগোছে হাসল।কি অদ্ভুত বাচ্চা বাচ্চা কাজ কারবার!
হঠাৎই নবনীতা ফোনের অন্যপাশ থেকে চেঁচিয়ে উঠে,’আরহাম!! ওয়াজিদ ভাইয়া রিমির হাত ধরে টেনে কোথায় যেন নিয়ে গেছে তাকে।’
তার কথা শুনেই আরহাম চমকে উঠে।রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে বলে,’কি বলছ কি?টেনে নিয়ে গেছে মানে?ছিহ!’
‘ধুর।কথা বলার জন্যই নিয়েছে মনে হয়।’
আরহামের মন চাইল বাকিদের মতো এই বাচ্চামো কাজ কারবারে যোগ দিতে।মন চাইছে এখনই ছুটে গিয়ে দেখতে ওয়াজিদ রিমিকে ঠিক কি বলছে।অথচ এমন এক পেশায় সে জড়িয়েছে যেখানে এসব হুটহাট কোথাও যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।সে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’পরী! আমিও দেখতে চাই ওদের।’
নবনীতা মিষ্টি হেসে তাকে আশ্বস্ত করল,’সমস্যা নাই।আমি রেকর্ড করে রাখব।রাতে আপনাকে সব দেখাব।’
____
রিমি চোখ তুলে তার হাত ধরে রাখা ব্যক্তিটাকে একনজর দেখেই চোখ নামিয়ে নিল।ওয়াজিদ ক্ষেপাটে গলায় প্রশ্ন করল,’মোবাইল কোথায় তোমার?’
‘আছে।আমার সাথেই আছে।’
‘আছে সেটা আমিও জানি।দুই দিন ধরে কয় হাজার ফোন দিয়েছি তোমাকে?ধরো নি কেন?’
রিমি মাথা নামিয়েই নিচু গলায় বলল,’ব্যস্ত ছিলাম।’
ওয়াজিদ হঠাৎই খেকিয়ে উঠল,’কিসের ব্যস্ত?কার সাথে এতো ব্যস্ত তুমি?’
বলার পর তার নিজেরই মনে হলো সে একটু বেশি রূঢ় আচরণ করে ফেলছে।অথচ এসবের জন্য সে মোটেও লজ্জিত না।সে আরো বেশি বেশি এমন আচরণ করবে।কিসের এতো ব্যস্ততা তার?বিবাহিত মেয়ে নাকি আবার বিয়ে করবে।দেশে কি আইনকানুন,ধর্ম কর্ম বলতে কিছু নেই?
সে পুনরায় কটমট করে বলে,’বিয়ে টা এখনো ভাঙছ না কেন?বলেছি না ভেঙে দিতে?’
রিমি চোখ তুলে তারই মতো কটমট করে বলল,’কেন ভাঙব?অকারণে বিয়ে কেন ভাঙব?’
ওয়াজিদ আশ্চর্য হলো।ভীষণ ভীষণ আশ্চর্য।সে ক্ষিপ্ত গতিতে ছুটে এসে রিমির দুই কাঁধ চেপে দাঁতে দাঁত পিষে কিড়মিড় করে বলল,’কেন মানে?বিবাহিত হয়ে আরেকটা বিয়ে করবে তুমি?তুমি আমার ওয়াইফ।আমাদের বিয়ে হয়েছে।এতোটাও গোল্ড ফিশের মতো মেমোরি না তোমার যে বারবার এই কথা তোমাকে মনে করাতে হবে আমার।’
রিমি তার কথা শুনেই তাচ্ছিল্য করে হাসল।এক ঝাড়ায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,’বাপ ভাইয়ের সম্মতি ছাড়া কোনো বিয়ে হয় না।এ বিয়ের কোনো বৈধতা নেই।’
ওয়াজিদ ফ্যালফ্যাল চোখে তার দিকে তাকায়।একটু শুকনো ঢোক গিলে ধিমি স্বরে বলে,’তিন কবুল বলে বিয়ে হয়েছে আমাদের রিমি।সব নিয়ম মেনেই হয়েছে।তুমি বিয়েটা অস্বীকার করছ রীতিমতো।ইউ আর বিকামিং সো ডিসরেসপেক্টফুল টুয়ার্ডস মি।’
রিমি উত্তর না দিয়েই সামনের দিকে পা বাড়ায়।ওয়াজিদ দ্রুত হেঁটে তার সামনে এসে দাঁড়ায়।পুনরায় তার হাতটা চেপে ধরে চোখ গরম করে বলে,’সমস্যা কি তোমার?এতো ভাব দেখাচ্ছো কেন?’
রিমি হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,’আপনার সমস্যা কি?বারবার এমন হাত ধরছেন কেন?’
‘ধরতেই পারি।তোমার হাসব্যান্ড হই আমি।’
রিমি ফিচেল হাসে।ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বিড়বিড় করে,’হাসব্যান্ড!’
‘কি হয়েছে?হাসছো কেন?কৌতুক করেছি আমি?বিবাহিত অবস্থায় মেয়েরা আরেক বিয়ে করতে পারে না।এই কথা তুমি জানো না?অলরেডি বিবাহিত হয়ে তুমি ঢ্যাং ঢ্যাং করে আরেক বিয়ে করছ! শোন রিমি,বেহুদা বকবক করে আমি আমার এনার্জি ওয়েস্ট করতে চাই না।তুমি প্লিজ কথা না বাড়িয়ে বিয়েটা ভেঙে দাও।আর কথা বাড়াতে চাই না আমি।’
রিমি তার কথা শুনল।সে থামতেই নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে রিমি সামনের দিকে পা বাড়াল।যেতে যেতে জোর গলায় বলল,’আমার টা আমাকে বুঝতে দিন।আমাকে নিয়ে মাতব্বরি একটু কম করবেন।’
বলা শেষেই সে হনহনিয়ে হেঁটে সামনে চলে গেল।ওয়াজিদ শান্ত,ধাঁরালো চোখে তার প্রস্থান দেখে।তার রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে এসব দেখে।রিমি তার সাথে এমন আচরণ কেন করছে?সে নিতে পারছে না এসব।
রাতে সে আবারো তার নম্বরে ফোন দেয়।অতি আশ্চর্যের বিষয় একটা রিং হয়েই ফোনটা কেটে যাচ্ছে।ওয়াজিদের বিশ মিনিট সময় লাগলো এটা বুঝতে যে রিমি তাকে ব্লক মেরেছে।বোঝার পরেই তার বিশ্বাস হচ্ছিল না।বারবার মনে হচ্ছিল এটা কি সত্যি?রিমি সত্যিই তাকে ব্লক মেরেছে?
সে রাতভর তার ঘরের এ’মাথা ঐ’মাথা পায়চারি করল।আরহাম আর আদি রিমির বিয়ে নিয়ে খুব এক্সাইটেড।এটা সেটা কতো কিছু কিনছে।আর ওয়াজিদ রীতিমতো অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে এসব ভাবতে ভাবতে।মেয়েটাকে সে ভালোবাসে না।কিন্তু মেয়েটা তার বউ।নিজের বউয়ের অন্যত্র বিয়ে জগতের কোনো ছেলের ভালো লাগে?ওয়াজিদের তো একটুও লাগছে না।
সে পরের দুই দিন অনেকভাবে রিমি পর্যন্ত পৌঁছানোর চেষ্টা করল।তার সোশাল মিডিয়ার একাউন্ট গুলো থেকেও সে ওয়াজিদকে ব্লক করেছে।কতো বড়ো বেয়াদব হলে মানুষ এমন কাজ করে?এক তার বান্ধবী,যে কি-না বিয়ের পর সব তেজ একপাশে সরিয়ে সুন্দর করে সংসার করছে।অন্যদিকে সে যে কি না বিয়ের আগে বেকুবের মতোন হাসতো,অথচ বিয়ে হতেই কেমন তেজ দেখানো শুরু করেছে।বিরক্তকর! মেয়েটা অতিমাত্রায় ঘাড়ত্যাড়া।
এক বিকেলে নবনীতার এপার্টমেন্টে ওয়াজিদের পদধূলি পড়ল।নবনীতা তাকে দেখেই সৌজন্যসূচক হেসে বলল,’আসুন ভাইয়া।ভেতরে এসে বসুন।’
ওয়াজিদ ভেতরে আসল না।তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে ভেতরে আসার কোনো ইচ্ছে তার নেই।সে তাড়াহুড়ো করে জানতে চাইল,’তোমার ফ্রেন্ড রিমির বাড়ির এড্রেসটা দাও তো।’
বলার পরেই সে আবার নিজের সাফাই গেয়ে বলল,’আসলে আমার একটা কাজ ছিলো ভার্সিটি সংক্রান্ত।তাই তার বাড়ির এড্রেসটা প্রয়োজন।’
চলবে-