#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৪৫)
সাদা রঙের মিনি বাসটা রাঙামাটি গিয়ে পৌঁছুলো সকাল সাড়ে নয়টা নাগাদ।গাড়ি থামতেই সবাই নড়ে চড়ে উঠল।আরহাম নবনীতার কাঁধে মাথা রাখা অবস্থাতেই তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখে প্রশ্ন করে,’এসে গেলাম নাকি?চাকা ঘুরে না কেন?’
নবনীতা আড়চোখে তার দিকে তাকায়।থমথমে মুখে বলে,’জ্বী।এসে পড়েছি।এবার মাথাটা সরান।কাঁধ ব্যথা হয়ে গেছে আমার।’
রিমি বাস থামতেই সবার আগে দৌঁড়ে দৌঁড়ে বেরিয়ে এলো।এসেই বড় করে দু’টো শ্বাস নিল।আহা! মুক্ত বাতাসের ঘ্রাণ! কাল রাতটা তার কিভাবে কেটেছে সেই জানে।কয়েকবার তো মনে হচ্ছিল সে বমি করেই দিবে।পরে অবশ্য ওয়াজিদের আতঙ্কিত মুখটা দেখেই সে বহু কষ্টে বমি চেপে রেখেছিল।পুরো বাসে তার চেয়েও ছোট ছোট মানুষরা বমি করছে না,আর সে বমি করছে।কি জঘন্য আর লজ্জাজনক ব্যাপার! যদিও দুই তিনবার সে ওয়াক ওয়াক করেছে,কিন্তু বমি আসেনি।ওয়াজিদ দ্বিধান্বিত হয়ে প্রশ্ন করেছিল,’বাস থামাতে বলব?একটু বের হয়ে পানি খাবে?’
রিমি শুধু মাথা চেপে উত্তর দিয়েছে,’নাহ,দরকার নেই।’
—
‘এখন কেমন লাগছে রিমি?’
পেছন থেকে ওয়াজিদের আওয়াজ শুনতে পেয়েই রিমি ঘুরে দাঁড়ায়।সামান্য হেসে জবাব দেয়,’আগের চেয়ে অনেক ভালো।’
ওয়াজিদ সৌজন্যসূচক হেসে সামনে এগিয়ে গেল।মেয়েটির উপর শুরুতে রাগ হলেও শেষে তার ফ্যাকাসে মুখটা দেখে তার ভীষণ মায়া হয়েছে।ইশশ! মেয়েটা নিজেও তো ভীষণ কষ্ট পেয়েছে! ভোরের একটু আগে তার ক্লান্ত মাথাটা সে এলিয়ে দিয়েছিল ওয়াজিদের কাঁধে।ওয়াজিদ কিছু বলেনি।শুধু ঠান্ডা কন্ঠে একবার বলেছিল,’বেশি খারাপ লাগলে আমাকে জানাবে।দু’মিনিট বাস থামালে এমন কিছু ক্ষতি হয়ে যাবে না।’
রিমি পাশ ফিরে একবার ওয়াজিদকে দেখে।যে কি না ধীর পায়ে সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছে।এই লোকটিকে রিমি কি বিশেষণ দিয়ে বিশেষায়িত করবে?নিখাঁদ ভদ্রলোক?অত্যন্ত ধৈর্যশীল?নাকি ভীষণ অমায়িক?কে জানে।তবে সে এইটুক জানে এই মানুষটা অনেক আলাদা।তার জায়গায় অন্য লোক থাকলে এতোদিনে রিমি নিশ্চিত দু’টো চড় খেয়ে ফেলত।ওয়াজিদ আক্ষরিক অর্থে ভদ্রলোক বলেই রিমি এখন পর্যন্ত কোনো চড় থাপ্পড় খায়নি।
নবনীতা গাড়ি থেকে নেমে চারদিক দেখে বলল,’ইশশ! কি সুন্দর!’
চারদিকে শুধু পাহাড় আর পাহাড়।সবুজে সবুজে মিশে একাকার অবস্থা।মাথার উপর গাঢ় নীল আকাশ।আরহাম গাড়ি থেকে বের হতেই মিলিটারি দের একটি গাড়ি তাদের সামনে এসে থামল।নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’আর্মিদের গাড়ি কেন?’
আরহাম আড়মোড়া ভেঙে জবাব দেয়,’পাহাড়ি এলাকা।সিকিউরিটি পারপাস।’
‘ওহহ।’
গাড়ি থেকে সবার প্রথমেই যে লোকটা বেরিয়ে এলো,তার উচ্চতা চোখে পড়ার মতো।উঁচা,লম্বা,পেটানো শরীর।এক দেখায় বলা যায় লোকটা সুদর্শন।সে গাড়ি থেকে নামতেই আরহাম তার বুকের পাশের ব্যাচটা দেখে।সেখানে লিখা মুহিত তাশদীদ।তিনি সামনে এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করলেন।হাস্কি স্বরে বললেন,’ওয়েলকাম স্যার।আমি মেজর মুহিত।এই দুইদিন আপনাদের সব সিকিউরিটির দায়িত্ব আমার।আপনাদের যেকোনো প্রয়োজনে আমাকে ইনফর্ম করতে পারেন।’
আরহাম জবাবে কেবল স্মিত হাসল।মুহিত তার থেকে চোখ সরিয়ে তার পাশে থাকা মেয়েটাকে দেখে।দেখতেই তার চোখ স্থির হয়।তার সাথে চোখাচোখি হতেই মেয়েটা দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়।মুহিত একটা শুকনো ঢোক গিলে।একবার মেয়েটার মুখ,আরেকবার তার হাত দু’টো দেখে।যেই হাতে সে শক্ত করে নিজের কুচি চেপে ধরেছে।
আদি ডাকতেই আরহাম কথা বলতে বলতে তার দিকে এগিয়ে গেল।নবনীতা পড়েছে এক অথৈ সাগরে।এই সাগরের নাম অস্থিরতার সাগর।কি বিচ্ছিরি আর বিব্রতকর মুহূর্ত! মুহিত গলা খাকারি দেয়।ঠান্ডা গলায় জানতে চায়,’হাই মিসেস নবনীতা।কেমন আছো?’
আবারো একরাশ অস্বস্তি।নবনীতা ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলো,’জ্বী ভালো।’
‘বাসার বাকিরা কেমন আছে?’
‘জ্বী ভালো আছে।’
মুহিত স্মিত হেসে বলল,’অবশেষে তাহলে তুমি বিয়ে করেই নিলে।গুড।গুড চয়েজ।গুড ডিসিশন।পাত্র আমার চেয়েও বেশি পাওয়ারফুল পারসন আই মাস্ট সে।’
নবনীতা অন্যদিক দেখতে দেখতে কন্ঠ স্বাভাবিক করে বলল,’জ্বী।আপনি না বললেও আমি জানি।’
‘সেটা ঠিক।তবে তুমি যেটা জানো না তা হলো আমিও বিয়ে করে নিয়েছি।একটা ছোট্ট ছেলেও আছে।’
নবনীতা অল্প হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’দারুন ব্যাপার।সংসার জীবনের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।’
‘তোমাকেও।’
‘ধন্যবাদ।’
নবনীতা কোনোরকমে উত্তর দিয়ে সামনে হেঁটে যায়।মুহিত চট করে পেছন ঘুরে প্রশ্ন ছুড়ে,’তুমি বলেছিলে রাজনীতিবিদ তোমার একদমই পছন্দের না।’
নবনীতা থামে।কথাটা কেন যেন গায়ে গিয়ে লেগেছে।সে পেছন ফিরেই কটমট করে বলল,’রাজনীতিবিদ পছন্দ না।তবে সেটা বর হলে অন্য বিষয়।আরহামকে আমার পছন্দ।আপনি আমার পছন্দ নিয়ে না ভেবে নিজের পছন্দ নিয়ে ভাবুন।’
বলেই সে বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে যায়।কি অদ্ভুত বিষয়! এই লোক এখন এসব কথা তুলছে কেন?দেখছে না নবনীতার ইতোমধ্যে বিয়ে হয়ে গেছে।এখন এসব কথা তুলে লাভ আছে?উপরন্তু তার নিজেরও সংসার আছে।তার উচিত নিজের বউ বাচ্চা নিয়ে ভাবা।এখন এসব কথা বলার কোনো মানেই নেই।
সে এগিয়ে গিয়ে আরহামের একহাত জড়িয়ে ধরে।আরহাম কপাল কুঁচকে সন্দিহান গলায় জানতে চাইল,’ঘটনা কি বলো তো?তুমি হঠাৎ এতো ভালো ব্যবহার করছ কেন?তোমার হুটহাট পতিব্রতা আচরণ আমার ভীষণ ভয় লাগে কেন জানি।’
নবনীতা ঠোঁট চেপে হাসল।নিজের মাথাটা আলতো করে আরহামের কাঁধে রেখে সামনে হাঁটতে হাঁটতে হাসি হাসি মুখ করে বলল,’ঘটনা কিছুই না।এমনিই মন চাইছে দু’জন মিলে হাঁটতে।আমি না আপনার অর্ধাঙ্গিনী?অর্ধেক অঙ্গ ছাড়া আপনি চলবেন কেমন করে শুনি?’
.
.
.
.
সানশাইন অরফানেজ সেন্টার।প্রায় একশো শতাংশ জমি নিয়ে পুরো অরফানেজ হোমটা বানানো হয়েছে।সামনে সুন্দর একটা বাগান।একপাশে স্কুল,স্কুলের সামনে খেলার মাঠ।আরেক পাশে থাকার জায়গা।সবমিলিয়ে জায়গাটা দেখতে ভালোই লাগে।
নবনীতা অরফানেজ সেন্টারের নাম দেখেই ঠোঁট উল্টে বলল,’বাপরে! অরফানেজ সেন্টারের নাম তো খুব ইউনিক।আপনার বাবা মনে হয় খুব এস্থেটিক মানুষ ছিলেন।বাটারফ্লাই,সানশাইন-দু’টো নামই ভীষণ এস্থেটিক।’
আরহাম তার কথা শুনেই খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠে বলল,’আমার বাবা যদি জানতো ভবিষ্যতে তার দেওয়া নাম নিয়ে কেউ এতো কৌতূহল দেখাবে,তাহলে বাড়ির নামটাও আজিজ ভিলা না দিয়ে এস্থেটিক কিছু একটা দিতো।’
বলেই সে আরো কিছুক্ষণ হাসে।নবনীতা চোখ পাকিয়ে কেবল একনজর তাকে দেখলো।সবকিছু নিয়ে হাসি ঠাট্টা করাই বোধহয় আরহামের স্বভাব।সে কতো সুন্দর একটা কথা বলেছে,আর আরহাম সেটাকে স্রেফ উপহাস করে উড়িয়ে দিলো।
অরফানেজ হোমের একদম কাছাকাছি কয়েকটা কটেজ আছে।সবাই ক্লান্ত শরীরটা টেনে কোনোরকম হেঁটে এসে যার যার কটেজে গিয়ে বিশ্রাম করল।আরহাম ঘরে ঢুকেই ধাম করে খাটে শুয়ে হাত পা ছড়িয়ে কতোক্ষণ শ্বাস নিল।নবনীতা কটেজে আসা মাত্রই সে মুখ খিঁচে বিরক্ত হয়ে বলল,’কাল রাতে আমি একটুও ভালো করে ঘুমুতে পারিনি।তোমার কাঁধ এতো শক্ত! বাপরে বাপ।হাড্ডি ছাড়া তো কিছুই নেই শরীরে।খেয়ে খেয়ে মাংস বাড়াবে বুঝেছ?তাহলে আরাম করে ঘুমানো যাবে।’
নবনীতা তীক্ষ্ণ চোখে তাকে পরোখ করল।কিছুক্ষণ চুপ থেকে শেষে দুষ্টুমি করে বলল,’মাংস বাড়ার একটা সাইড ইফেক্টও আছে।আপনি তখন আর হুটহাট ঘরে ঢুকেই আমাকে কোলে তুলতে পারবেন না।একটু রয়ে সয়ে তারপর কোলে নিতে হবে।’
আরহাম সাথে সাথে চোখ খুলে।গোল গোল চোখ করে নবনীতাকে দেখে তব্দা খেয়ে বলে,’কি বললে তুমি?’
নবনীতা আর উত্তর দিলো না।সে খুব ভালো করেই জানে আরহাম তার কথা শুনেছে।শুনেছে বলেই এমন প্রতিক্রিয়া দিচ্ছে।
আরহাম তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।এক ছুটে নবনীতা কাছে গিয়ে তার থুতনি উঁচু করে বড় বড় চোখ করে বলে,’সিরিয়াসলি?তুমি ইদানিং লাগাম ছাড়া কথা বলছ পরী।আমার কিন্তু লজ্জা লাগে এসব।’
নবনীতা ঠোঁট উল্টে বলল,’আরে বাবারে! কতো লজ্জা আপনার! আর আপনি যখন রাতে বাড়ি ফিরে ঘর ভর্তি লোকের সামনে ডাকেন এ্যাই পরী! রুমে এসো তো।তখন লজ্জা লাগে না?’
‘না লাগে না।কারণ জামাই একশোটা কারণে বউকে ডাক দিতে পারে।কেন ডাকছে সেটা মানুষ কি করে জানবে?মানুষ কি আমার রুমে ঢুকে বসে আছে নাকি?’
নবনীতা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলল,’জ্বী বুঝেছি।আপনিই ঠিক।এবার ছাড়ুন আমায়।’
আরহাম তাকে ছাড়ল না।উল্টো আচমকাই তাকে কোলে তুলে একপেশে হেসে বলল,’ছাড়ার জন্য তো ধরিনি ডার্লিং।’
নবনীতা আঁতকে উঠে চারপাশ দেখে চাপা স্বরে চেঁচায়,’কি সর্বনাশ! এখনই?’
‘হ্যাঁ তো কি হয়েছে?’
‘কেউ ডাকলে?’
‘ডাকুক।সব ক’টা আ বিয়াত্তা।এগুলো ডাকলেও পাত্তা দিব না ব্যাস।এরা কেমন করে বুঝবে ম্যারিড লাইফের মজা?’
নবনীতা তার বচনভঙ্গি দেখেই ফিক করে হেসে ফেলল।সে তার সেট করে রাখা চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলল,’এখন লজ্জা করে না?’
‘নাহ করে না।তোমার আর আমার মাঝে লজ্জা নামের কোনো ফাংশন নেই।গট ইট?’
***
বিকেলে সবাই মিলে অরফানেজ সেন্টারের সামনের খোলা মাঠটায় গিয়ে পৌঁছায়।একেবারে খোলা মাঠ,উপরে উন্মুক্ত আকাশ,থেমে থেমে বাতাস বইছে।আবহাওয়াটা এক শব্দে চমৎকার।
বাচ্চারা চোখ মেলে এক ঝাঁক আগন্তুক দের দেখে।এরা নাকি দুই দিন এখানেই থাকবে।এই মানুষগুলোকে তাদের ভালোই লাগছে।কতো সুন্দর হেসে হেসে আদর দিচ্ছে তাদের।তাদের অভাবের জীবনে সবচেয়ে বেশি অভাব বোধহয় এই আদরটুকুর ই।
আজকে রাতে বেশ ভালো রান্নার আয়োজন করা হয়েছে।আরহাম আগেই জানিয়ে রেখেছিল এই ব্যাপারে।সেই রান্নার ঘ্রান একটু পর পর এসে নাকে লাগছে।রিমি নাক টেনে টেনে বলল,’বিরিয়ানি তে ঝাল বেশি হয়েছে।’
আদি ভড়কে গিয়ে বলল,’কি আশ্চর্য! গন্ধ শুনে স্বাদ বুঝে গেছ তুমি?’
রিমি বোকা বোকা হেসে জবাব দেয়,’জ্বী ভাইয়া।আমার ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় অনেক শক্তিশালী।আমি শুঁকে শুঁকেই সব টের পেয়ে যাই।’
ওয়াজিদ তার কথা শুনেই মাথা নামিয়ে চাপা কন্ঠে বিড়বিড় করে,’তুমি তো টের পাবেই।ভাল্লুকদের ঘ্রাণ ইন্দ্রিয় এমনিতেও স্তন্যপায়ীদের মধ্যে সবচেয়ে প্রখর।’
আদি রিমির দিকে দেখে দাঁত কেলিয়ে বলল,’তোমার মতো মানুষই তো রোজার সময় দরকার।আমরা রান্না করব।আর তুমি গন্ধ শুঁকে বলে দিবা কি কম হয়েছে।দারুণ একটা ব্যাপার!’
‘না ভাইয়া।এখানে একটা সমস্যা আছে।’
‘আবার কি সমস্যা?’
‘আমি ঝাল,তেতো আর টকের বিষয়টা বুঝত পারি।কিন্তু লবনের বিষয়টা কেবল গন্ধ শুঁকে বলতে পারি না।’
আদি আশাহত হলো।মাটিতে থাকা কয়েকটা ঘাস ছিঁড়ে দূরে ছুড়ে মেরে বলল,’ধ্যাত! তুমি তো তাহলে আসল জিনিসটাই পারো না।’
.
.
.
.
সবাই বিস্তীর্ণ মাঠটায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছে।বাচ্চারা এখানে সেখানে ছুটোছুটি করছে।আদি মাথা তুলে আকাশ দেখে।খোলা আকাশে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা গুলো দেখে সে ভরাট গলায় বলে,’আহা কি সুন্দর আবহাওয়া! কেউ একটা সুন্দর গান গাও না।এ্যাই ওয়াজিদ।তুই ই একটা গান গা।তাক লাগিয়ে দে আমাদের।দেখিয়ে দে তোর লুকানো প্রতিভা।’
ওয়াজিদ বিরক্ত হয়ে বলল,’বাজে বকিস না তো।এসব গান টান আমি পারি না।’
শুভ্রা প্রফুল্ল স্বরে বলল,’আপাই কিন্তু দারুণ গান গায়।একদম সত্যি কথা।’
সাথে সাথেই সবাই নবনীতাকে চেপে ধরল একটা গান গেয়ে শোনানোর জন্য।নবনীতা বোকা বোকা হেসে বলল,’আরে ধ্যাত! আমি এতোও ভালো গাই না।’
‘যাই পারো।একটা গেয়ে শোনাও।’
নবনীতা আর বেশি মানা করল না।সে গালের নিচে হাত রেখে কতোক্ষণ ভাবল।আরহামের স্থির দৃষ্টি তার দিকেই নিবদ্ধ।সে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকে দেখছে।সে কি গান গায় এটা শোনার জন্য সে উদগ্রীব।নবনীতা কতোক্ষণ ভেবেচিন্তে একটা গান মনে করল।তারপরই সুমিষ্ট কন্ঠে অল্প স্বল্প সুর তুলে গাইলো,
Chaahe tum kuchh na kaho maine sun liya
Ki saathi pyaar ka mujhe chun liya
Chun liya… maine Sun liya haa!
Pehla nasha, pehla khumar
Naya pyaar hai naya intezar
Kar loon main kya apna haal
Aye dil-e-bekaraar
Mere dil-e-bekaraar
Tu hi bata… mm..
আরহাম তব্দা খেয়ে তার দিকে তাকায়।সে না হিন্দি পারে না?তাহলে এখন সে কোন দেশের গান গাইছে?আমেরিকার নাকি কানাডার?সে চাপা স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’সব বুঝেও না বুঝার ভান ধরে।বেয়াদব একটা!’
***
সেই রাতে তারা বেশ জমিয়ে আড্ডা দিলো।রাতে খাওয়া দাওয়া শেষেও যে যার মতো হেঁটে বেড়ালো।সেনাবাহিনীর লোকজন আশেপাশেই আছে।তাই ভয়ের কোনো কারণ নেই।আরহাম নিজেই বলেছে সবাই মন মতো ঘুরতে।যেকোনো প্রয়োজনে মুহিতকে সবকিছু জানাতে।
নবনীতা,শুভ্রা আর চিত্রা বাচ্চাদের নিয়ে ব্যস্ত ছিল।তারা তাদের সাথে লুকোচুরি,রক পেপার সিজার,কানামাছির মতো ছেলেমানুষি খেলা খেলছিল।মাঝে মাঝে এই বাচ্চাদের বাহানায় নিজেদের শৈশবে পরিভ্রমণ করালে মন্দ হয় না।আরহাম ব্যস্ত ছিল কালকের দিনের প্রস্তুতি নিয়ে।সে চাইছে কালকে এদিকে একটা পিকনিকের আয়োজন করতে।বাচ্চাগুলো ছুটোছুটি আর খেলাধুলার সুযোগ পাবে।সেই সাথে তারা নিজেরাও ভালো সময় কাটাতে পারবে।সে রান্নাঘরে গিয়েই ব্যস্ত হয়ে বলল,’সবকিছু পরিমান মতো আছে তো?না হলে আমাকে জানাবে কিন্তু।’
বাকিরা বেরিয়েছে নৈশ ভ্রমণের উদ্দেশ্যে।সারাহ ফোন দিয়ে নানারকম শর্ট স্ন্যাপ নিচ্ছিল।আদি তার ফোনের ছবিগুলো দেখে প্রসন্ন হেসে বলল,’বাহ! তোমার ফোনের ছবি গুলো চমৎকার হয়েছে।মেইল করে পাঠিয়ে দিও তো আমাকে।’
তাসনুভা তার হাঁটুতে কিল বসাল।দাঁত কিড়মিড় করে নিচু স্বরে বলল,’তুমি যদি আর একবারো সারাহ-র সাথে কথা বলো,তাহলে আমি আর জীবনেও তোমার সাথে কথা বলব না।’
আদি এক হাতে তার হুইলচেয়ারের হাতল আর অন্যহাতে নিজের কান ধরে মাথা ঝুকিয়ে বলল,’সরি সরি।এই যে কানে ধরলাম।আর হবে না বাচ্চা।তবুও তুমি মনে কষ্ট নিও না।’
রিমি নেটওয়ার্কের আশায় সামনে হাঁটতে হাঁটতে একদম পাহাড়ের ধাঁর ঘেঁষে দাঁড়ালো।কয়েকবার ফোনটা নেড়ে চেড়ে পুনরায় কানে চেপে বলল,’হ্যালো হ্যালো।শুনছো তো তোমরা?আমি ঠিক আছি।এ্যাই আব্বু।শুনো কথা?’
ওয়াজিদ তার পেছন পেছন এগিয়ে আসে।খানিকটা ধ’মকের সুরে বলে,’এখানে কেন এসেছ?এদিকে তো লোকজন কেউ নেই।সবাই অন্য দিকে।এদিক থেকে সরে এসো।পাহাড়ি এলাকায় এতো একা একা ঘুরা ভালো না।’
রিমি হঠাৎ তার আওয়াজ শুনেই লাফ দিয়ে উঠে।তারপরই পেছন ফিরে বড় বড় চোখ করে বলে,’ওহহ আপনি।ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি।’
সে চটপটে হয়ে সামনে পা বাড়ায়।হঠাৎই তার জুতোটা স্লিপ কেটে তার এক পা রাস্তা থেকে ছিটকে নিচের দিকে গিয়ে পড়ল।রিমি তাল হারাতে হারাতে এক চিৎকার দিলো,’ওয়াজিদ ভাইয়া বাঁচান!’
ওয়াজিদ চমকের পিলে পেছন ফিরে।সে কিছু বুঝে উঠার আগেই রিমি তার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান দেয়।টান খেতেই ওয়াজিদ আঁতকে উঠে চিৎকার দেয়,’এটা কি করছ তুমি?’
রিমি তাল হারিয়ে সোজা পাহাড়ের গা বেয়ে নিচে নেমে এলো।পুরোটা সময় সে শক্ত করে ওয়াজিদের হাত চেপে রাখল।মরলে সে একা মরবে কেন?জীবনসঙ্গী যেমন আছে,তেমন একটা মরণসঙ্গীও থাকা দরকার।যার সাথে শান্তিতে মরা যায়।ওয়াজিদ হবে তার মরণসঙ্গী।
ওয়াজিদ বিক্ষিপ্ত মেজাজে খেঁকিয়ে উঠে,’একটা চড় দেবো বেয়াদব।আমাকে টানলে কেন?’
পাহাড়ের উচ্চতা খুব বেশি না।তবে বেশ ঢালু পাহাড় হওয়াতে গড়াতে গড়াতে দু’জন বেশ দূরে কোথাও গিয়ে থামল।একটা শক্ত ভূমিতে নিজের অস্তিত্ব টের পেতেই ওয়াজিদ এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।রিমি তখনও মাটিতে।সে তাকে তুলল না।উল্টো খেঁকিয়ে উঠে বলল,’পুরাই ফালতু মাথাখারাপ আকামলা একটা মেয়ে।নিজে একা পড়ছিলে,আবার আমাকে সাথে টেনেছো কেন?সহ্যেরও একটা সীমা থাকে।’
রিমি উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের ধুলো ঝাড়ে।কাচুমাচু মুখ করে বলে,’সরি ভাইয়া।ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।তাই এমন করেছি।নেভার মাইন্ড প্লিজ।’
‘একদম ঠাটিয়ে চড় দেব বেয়াদব।এখন এই জায়গা থেকে আমি তাদের কাছে ফিরব কেমন করে?’
ওয়াজিদ পকেট হাতড়ায়।তারপরই হতাশ হয়ে মাথা নাড়ে।যা ভেবেছে তাই,মোবাইলটা গড়িয়ে কোথাও পড়ে গেছে।অবশ্য মোবাইল থাকলেও বা কি?এই জায়গায় তো নেটওয়ার্কও পাওয়া যাবে না।সে রাগে ফুসতে ফুসতে চারদিক দেখে।এই অন্ধকারে সে এই মেয়েটিকে নিয়ে কোথায় যাবে?এতো রাতে খারাপ মানুষের ভয় তো আছেই।সেই সাথে আছে হিং*স্র জন্তু,জানোয়ারের ভয়।সে কতোক্ষণ নিজের চুল টেনে শেষে খপ করে রিমির হাতটা ধরে সামনে হাঁটা শুরু করল।রিমি অবাক হয়ে বলল,’সেকি!কোথায় যাচ্ছি আমরা?’
ওয়াজিদ পেছন ফিরে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’আর একটাও কথা বলবে না।নয়তো এদিকেই ফেলে রেখে চলে যাব।ছাগল কোথাকার! গর্দভ একটা!’
রিমি একহাত মুখে চেপে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’না না,আর কিছু বলব না।তবুও আমাকে আপনার সাথে সাথে রাখুন।’
ওয়াজিদ দ্রুত কদম ফেলে সামনে এগোয়।কেবল একটা ঘর পেলেই হবে।অন্তত আজ রাত টা কাটানোর জন্য।অবশেষে আধঘন্টার মতো হাঁটার পর সে উঁচু টিলার উপর একটা বাঁশের ঘর দেখতে পেল।দেখেই তার মুখে হাসি ফুটল।সে রিমিকে টিলার নিচে দাঁড় করিয়ে কড়া গলায় বলল,’দাঁড়াও আগে দেখে আসি ভেতরে কেউ আছে নাকি।চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো।আমি ডাকলে তারপর এসো।’
সে ধুপধাপ পায়ে বাড়িটার দিকে এগিয়ে যায়।কয়েকবার কড়াঘাত করতেই একটা বৃদ্ধ ব্যক্তি দরজা খুলল।ওয়াজিদ তাকে দেখেই সালাম দিলো।অমায়িক কন্ঠে বলল,’আসলে আমরা একটা বিপদে পড়েছি।আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি।আপনি কি আজকে রাতের জন্য আমাদের এদিকে থাকতে দিবেন?ভোর হতেই আমরা চলে যাব।’
লোকটা আগাগোড়া তাকে দেখেই সূচালো চোখে প্রশ্ন করে,’আমরা মানে?তুমি আর কে?’
ওয়াজিদ আঙুল তুলে রিমিকে দেখায়।রিমি বৃদ্ধ লোকটাকে দেখা মাত্রই হাত তুলে হাই দেয়।ওয়াজিদ সামনে ফিরে জোরপূর্বক সামান্য হেসে প্রতিউত্তর করে,’জ্বী।আমি আর আমার ওয়াইফ।’
সে খুব ভালো করে জানে অন্য পরিচয় দিলে তাদের কিছুতেই এখানে জায়গা দেওয়া হবে না।তারচেয়ে ভালো আপাতত জামাই বউ পরিচয় দিয়ে কোনোরকমে রাতটা পার করে দেওয়া।সকাল হলেই তারা বেরিয়ে যাবে এখান থেকে।
তার বুদ্ধিতে কাজ হয়েছে।লোকটা তাদের অবস্থা দেখে মায়া করে তাদের ঘরে জায়গা দিলো।ওয়াজিদ ঘরে এসেই হাত মুখ ধোয়ার জন্য চাপকলের কাছে গেল।আর রিমি গিয়ে বসল বসার ঘরের বেতের সোফায়।বাড়িতে কেবল দু’জন মানুষ থাকে।বৃদ্ধ লোক আর তার স্ত্রী।
রিমি সোফায় বসতেই বৃদ্ধা মহিলা এক গ্লাস পানি হাতে এগিয়ে এলেন।রিমি তাকে দেখে মিষ্টি করে হাসল।বৃদ্ধা জানতে চাইলেন,’কয় মাস হয়েছে তোমার বিয়ের?নাকি অনেক বছর আগেই বিয়ে করেছ?’
রিমি পানি খাওয়ার মাঝেই বিষম খেল।কাশতে কাশতে দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’আরে না না।আমরা কোনো জামাই বউ না।আমাদের কারো বিয়েই হয়নি এখনো।’
বৃদ্ধা মহিলাটি হঠাৎই চেঁচিয়ে উঠে বললেন,’কি?তোমরা বিবাহিত নও?’
রিমি ভয়ে ভয়ে ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।কাচুমাচু মুখে বলে,’না।আমরা পরিচিত কিন্তু বিবাহিত নই।’
____
হট্টগোলের শব্দ কানে যেতেই ওয়াজিদ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো।বসার ঘরে আসতেই বৃদ্ধ লোকটা তাকে দেখামাত্র গর্জে উঠল,’মিথ্যুক! মেয়ে নিয়ে রঙ্গতামাশা করতে এসে পরিচয় দেও জামাই বউ বলে?এটা কি আমার বাড়ি,নাকি কোনো আবাসিক হোটেল?নষ্টামি করার আর জায়গা পাও না?’
ওয়াজিদ হতভম্ব হয়ে তার কথা শুনে।তারপরই চোখ সরিয়ে রিমির কাচুমাচু মুখটা দেখে।এরপর চুপচাপ মাথা নামিয়ে নেয়।গর্দভটা নিশ্চিত আরেকটা গর্দভগিরি করেছে।
***
রাত তখন কয়টা সে হিসেব ওয়াজিদের নেই।সে চোখ নামিয়ে বাঁশের ঘরটার মেঝে দেখে।তারপরই একটা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে।সে বার বার বোঝাতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে এই মেয়েটার সাথে তার কিছুই নেই।পাহাড় থেকে পড়ে গিয়ে তারা বিপদে পড়েছে,তাই সাহায্য চেয়েছে।তারা যেন তাকে সাহায্য করে এজন্যই সে মিথ্যে বলেছে।নয়তো তার অন্য কোনো উদ্দেশ্য নেই।দরকার পড়লে আজ রাতটা সে দরজার সামনে থেকেই কাটিয়ে দিবে।তার এতেও কোনো সমস্যা নেই।
কিছুতেই যখন কিছু হচ্ছিল না,তখন সে তাদের কাছে আরহামের পরিচয় দিলো।জানাল যে তারা আরহামের সাথেই এসেছে।তার কথায় কাজ তো কিছু হলোই না,উল্টো বৃদ্ধ লোকটি চটে গিয়ে বলল,’তোর এমপির নাম তোর কাছেই রাখ।তোর ব্যবস্থা আমি করছি।এখন থেকে আর মিথ্যা বলে নষ্টামি করতে হবে না।আমি তোর পাকাপোক্ত ব্যবস্থা করছি দাঁড়া।কত্তোবড় সাহস! আমার সাথে বাহাদুরি করে।’
তারপরই তিনি এই রাতের মাঝে কোথা থেকে একজন লোক সাথে নিয়ে বাড়ি ফিরল।ওয়াজিদ কথাবার্তায় বুঝল লোকটা কোনো মসজিদের ইমাম।যে এসেছে তাদের বিয়ে পড়াতে।কি অদ্ভুত আর নাটকীয় বিষয়! আদির অনেক শখ ছিলো এরকম গ্রামবাসীর খপ্পরে পড়ে বিয়ে করার।অথচ সেই শখ ওয়াজিদের জীবনে বাস্তবতায় রূপ নিয়েছে।আশ্চর্য বিষয়! স্রষ্টা তো আদিকে এভাবে বিয়ে করালেও পারতো।ওয়াজিদের সাথে এমন হচ্ছে কেন?সে কি দোষ করেছে যে এমন বিচ্ছিরি পরিস্থিতিতে তার বিয়ে হতে হবে?কেন জগতের সব বিব্রত পরিস্থিতি ওয়াজিদের ঝুলিতে এসে জমা হয়?
সে নির্বিকার হয়ে কবুল বলে।কবুল বলার পরেও তার বিশ্বাস হচ্ছিল না তার যে বিয়ে হয়ে গেছে।এসব কি?এগুলো কোনো বিয়ে হলো?মা নাই বাপ নাই,কেউ নাই।কেবল কবুল বলল আর বিয়ে হয়ে গেল?এটাও কি সম্ভব?
সে চোখ তুলে রিমিকে দেখে।রিমি মাথা তুলে চোরা চোখে সামনে দেখতেই ওয়াজিদের চোখ মুখের অবস্থা দেখে দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়।কি ভয়ংকর সে চাহনি! এতো ভয়ংকর ভাবে তাকিয়ে আছে কেন এই লোক?ওয়াজিদ একহাত মুঠ করে দাঁত কিড়মিড় করে।এখন কেবল সময়ের অপেক্ষা।একবার এই ছাগলটাকে হাতের কাছে পাক।চড় মেরে এর বাপের নাম যদি ভুলিয়ে না দেয়,তবে সেও ওয়াজিদ না।
চলবে-
#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৪৬)
বিক্ষিপ্ত মেজাজে ছোট্ট ঘরটাতে ঢুকেই ওয়াজিদ ফুসতে ফুসতে রিমির দিকে তাকায়।রিমি তার উপস্থিতি টের পেতেই মিনমিনে স্বরে বলল,’মিথ্যে বলেছেন সেটা তো আমাকে আগে জানাবেন নাকি?’
ওয়াজিদ তার দিকে তেড়ে এসে চেঁচায়,’আর একটা কথা যদি বলো না,এদিকেই গলা চেপে ধরব।অপদার্থ গাধা কোথাকার!’
রিমি আড়চোখে একবার তাকে দেখে।পরক্ষণেই চোখ নামিয়ে তাকে ভেঙচি কাটে।ভাব এমন দেখাচ্ছে যেন এই বিয়েতে সে একাই কষ্ট পেয়েছে।আর রিমির খুব আনন্দ হচ্ছে।রিমি নিজেও তো এমন পরিস্থিতি চায় নাই।ঐ লোক কি নিজের কোনো দোষ খুঁজে পাচ্ছে না?বিষয়টা অনেকভাবেই কাটানো যেত।জামাই বউ বলার দরকার টা কি ছিল?
ওয়াজিদ অনেকক্ষণ ঘরের এই মাথা থেকে ঐ মাথা পায়চারি করে।শেষটায় বড় বড় কদমে রিমির মুখোমুখি বসে এক আঙুল তুলে কড়া গলায় বলল,’শোনো রিমি।এভাবে কোনো মানুষের বিয়ে হয় না।বিয়েতে কনের বাবা অথবা ভাইয়ের সম্মতি লাগে।মূল কথা যারা বিয়ে করছে তাদের সম্মতি লাগে।দু’জনের পরিবারের সামনে কবুল বললে তবেই সেটা বিয়ে হয়।এভাবে মাঝরাতে লোক ডাকিয়ে বিয়ে পড়ালে সেটাকে বিয়ে বলে না।অন্তত আমার এটাকে বিয়ে বলে মনে হয় না।আমি এটাকে বিয়ে হিসেবে গণ্যই করছি না।যাই হোক,সে কথা পরে।এখন যেটা বলব সেটা মন দিয়ে শুনো।কাল যখন আমরা আমাদের কটেজে ফিরব,তখন তুমি কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলবে না।একদম টু শব্দও করবে না।আমি সব বলব।আর তুমি চুপ থাকবে।ভুলেও বিয়ের কথা মুখে আনবে না।আমাদের কোনো বিয়ে টিয়ে হয়নি।
রিমি কোনোরকম চোখ তুলে তাকে দেখে।তারপরই জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে,’ওকে ওকে।নো প্রবলেম।’
ওয়াজিদ খাট থেকে উঠে জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে অত্যন্ত বিরক্তি ধরা কন্ঠে বলে,’তোমাকে কিছু বলে নিজের শক্তি অপচয় করতেও আমার রুচিতে লাগে।বললে তো কাজ হবেই না,খামোখা আমার শক্তি খরচ হবে।শুধু এইটুকু বলছি,তুমি আমার থেকে দূরে দূরে থাকবে।আগেও বলেছি,এখনও বলছি।বাট এখন আমি সিরিয়াস।প্লিজ রিমি,হাত জোড় করছি।দূরে থাকো তুমি।তোমাকে দেখলেই আমার মেজাজ খারাপ হয়।’
রিমি মাথা নামিয়ে বেডশিটের প্রিন্ট দেখে।যদিও খারাপ লাগা উচিত না,কিন্তু কোনো একটা অজানা কারণে তার খারাপ লাগছে।এমন দুম করে বলে দিলো তার থেকে দূরে থাকতে?রিমি কি ছ্যাচড়া?গায়ে পড়া স্বভাবের?নয়তো এমন করে বলল কেন?সে কেবল ছোট করে জবাব দিলো,’আচ্ছা ঠিক আছে।’
ওয়াজিদ কতোক্ষণ তার চুল টানে।কতোক্ষণ তার মুখটা দুই হাতে চেপে ধরে বড় বড় নিশ্বাস ছাড়ে।বলে তো দিয়েছে যে সে এসব মানে না।কিন্তু তারপর কি?এতো বড় একটা বিষয় সে কতদিন ধামাচাপা দিবে?আদৌ কি সেটা সম্ভব?ওয়াজিদের মস্তিষ্ক বলে এটা সম্ভব না।কোনো না কোনো ভাবে একদিন মানুষ এটা জানবেই।এরপর কি হবে?সে দ্রুত মাথা নাড়ে।আর এসব ভাবতে পারবে না।ভাবলেই তার মাথা ব্যথা হয়।
ভোরের আলো ফুটতেই সে তাড়াহুড়ো করে বাঁশের ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।রিমিকে ডাকার প্রয়োজন বোধ করল না।রিমি তো দেখছেই সে বেরিয়ে যাচ্ছে।তার উচিত নিজ থেকে তার পেছন পেছন ঘর থেকে বেরিয়ে আসা।ওয়াজিদ কেন ডাকবে তাকে?এতো তোষামোদি সে করতে পারবে না।
রিমিকে অবশ্য তোষামোদ করার কিছু নেই।সে নিজেই চুপচাপ বেরিয়ে এলো।ওয়াজিদ চোখ মেলে চারদিক দেখে নিজেদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করে।তারপরই অনুমানে খানিকটা সামনে এগোয়।
পাহাড়ি উঁচু নিচু রাস্তায় রিমির চলতে কষ্ট হচ্ছিল।সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’একটু আস্তে হাঁটুন না।’
ওয়াজিদ পেছন না ফিরেই সামনে যেতে যেতে জবাব দিলো,’পারব না আস্তে হাঁটতে।দ্রুত কটেজ যেতে হবে।আস্তে হাঁটা সম্ভব না।’
সে ইচ্ছাকৃতভাবে তার হাঁটার গতি বাড়ায়।রিমি যেতে যেতে এই টিলা ঐ টিলার সাথে হোঁচট খায়।হোঁচট খেতেই মুখ দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে।ওয়াজিদ ঘাড় ঘুরিয়ে একবারও তাকে দেখল না।
পাক,আরো কয়েকটা ব্যথা পাক।সে ব্যথা পেলে ওয়াজিদ পৈশাচিক আনন্দ পায়।হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা এসে ওয়াজিদ সঠিক পথ খুঁজে পেল।সে কেবল একবার পেছন ফিরে বলল,’তাড়াতাড়ি এসো।রাস্তা পেয়ে গেছি।’
রিমি একপ্রকার ছুটতে ছুটতে তাকে অনুসরণ করে।হঠাৎই পায়ে খানিকটা যন্ত্রণা শুরু হতেই সে মাথা ঝুকায়।মুহূর্তেই তার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হয়।সে চওড়া গলায় চেঁচায়,’ভাইয়া!!! আমার পা দেখুন।’
ওয়াজিদ পেছন ফিরে।এগিয়ে না এসে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকেই প্রশ্ন করে,’সমস্যা কি?আবার কি হয়েছে?’
রিমি কোনোরকমে পা টা তুলে বলল,’আমার পায়ে জোঁক ধরেছে ভাইয়া।দেখুন রক্ত খেয়ে খেয়ে কি অবস্থা করেছে পায়ের।’
ওয়াজিদ তার কথা শুনল।তারপরই সামনে ফিরে হনহন করে হেঁটে যেতে যেতে বলল,’খেয়ে ফেলুক।সব রক্ত খেয়ে ফেলুক।আরো তো কতো মানুষ আছে।কই তাদের তো কিছু হয় না।জোঁক শুধু তোমাকেই কেন ধরে?পুরাই অসহ্য লাগছে আমার।’
‘ভাইয়া! এখন কি করব?’
‘জানি না আমি কি করবে।আমি কিছু করতে পারব না।’
সে বড়ো বড়ো পায়ে সামনে হেঁটে যায়।তার এখন কটেজে গিয়ে একটু বিশ্রাম নিতে হবে।মাথা এমনিতেও যথেষ্ট গরম।এখন আর অন্য ঝামেলা সে সহ্য করতে পারবে না।
রিমি শূন্য চোখে তার প্রস্থান দেখে নেয়।তার অজান্তেই তার দুই চোখ ভরে এসেছে।সে তাড়াতাড়ি চোখ মুছে।ধ্যাত! এইটুকুতে কেউ রাগ করে?সে নিজেকে বোঝায় ওয়াজিদের ভাইয়ের মন খারাপ,তাই সে এমন আচরণ করেছে।নয়তো সে ঠিকই এগিয়ে এসে রিমির ব্যাপারটা ভালো করে দেখতো।
সে দ্রুত তার পেছন পেছন ছুটে।চোখ দু’টো তবুও যে কেন বারবার ভরে আসছে কে জানে!
***
রিমি আর ওয়াজিদের অনুপস্থিতি সবার আগে টের পেল আদি।সারারাত এদিক সেদিক ঘুরাঘুরির পর ভোরের দিকে তারা যখন সবাই সবার কটেজে ফিরে এলো,তখন দু’জনকে না দেখতে পেয়ে সে খানিকটা চিন্তিত হলো।প্রায় দশ মিনিট এখানে সেখানে খোঁজাখুঁজির পর সে নিশ্চিত হলো ওয়াজিদ সত্যিই আশেপাশে কোথাও নেই।
সে খানিকটা দ্বিধায় পড়ল।আরহামকে কি এখনই জানিয়ে দিবে?নাকি আরেকটু অপেক্ষা করবে?আরিশ আর তাসনুভা তো ঘুমিয়ে কাদা।আরহামকে বললে সে আবার অকারণে অস্থিরতা দেখাবে।আচ্ছা মুহিত কোথায়?তার থেকে সাহায্য নেওয়া যায়।
আদি দ্রুত মিলিটারি টেন্টের দিকে ছুটে।মুহিত তখন টেন্টের বাইরেই ছিলো।তার ঘুম ভেঙেছে একটু আগে।আদি তাকে দেখতেই বড় বড় পা ফেলে তার কাছে গেল।বিচলিত গলায় বলল,’এক্সকিউজ মি মুহিত।আমি আমার ফ্রেন্ড ওয়াজিদকে অনেকক্ষণ যাবত দেখছি না।কটেজে ফেরার পর থেকে সে আর সাথে আরেকজন মেয়ে মিসিং।তুমি কি একটু দেখবে ব্যাপারটা?’
মুহিত সাথে সাথে সামনে যেতে যেতে বলল,’কতোক্ষণ আগের ঘটনা?এসো তো,আমার সাথে এসো।দেখছি আমি ব্যাপারটা।’
মুহিতের খুব বেশি মাথা ঘামাতে হলো না এই ব্যাপারে।একটু সামনে আসতেই আনুমানিক দুইশো মিটার দূরত্বে একটা ছেলের অবয়ব দেখতে পেয়ে সে দ্রুত দূরবীনে চোখ রাখে।তারপরই সেটা আদির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে,’দেখো তো।এটা তোমার বন্ধু না?’
আদি দূরবীন টা চোখের উপর ধরেই চঞ্চল হয়ে বলল,’আরে হ্যাঁ।এটাই ওয়াজিদ।’
সে দূরবীনটা মুহিতের নিকট ফিরিয়ে দেয়।ওয়াজিদের আসা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না।সে নিজেই দৌড় লাগায় সামনের দিকে।ওয়াজিদের কাছাকাছি এসেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’তুই কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?’
ওয়াজিদ গুরুগম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,’রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম।তাই ফিরতে দেরি হয়েছে।’
‘আর রিমি?রিমি কোথায়?’
‘আছে।পেছনেই আছে।’
বলে সে আর দাঁড়ায় না।আগের চেয়েও দ্রুত গতিতে হেঁটে কটেজের দিকে চলে যায়।এখানে থাকলেই সে উল্টাপাল্টা বলে ফেলবে।তার চেয়ে ভালো কটেজে কতোক্ষণ ঘুমিয়ে মনটাকে একটু ঠান্ডা করা।
রিমি ফ্যাকাশে হেসে সামনের দিকে হেঁটে এলো।আদি কপাল কুঁচকে বলল,’ঘটনা কি বলো তো?ওয়াজিদ এমন থম মেরে আছে কেন?হয়েছে টা কি?’
সে দ্রুত মাথা নেড়ে জানায়,’এমন কিছু না ভাইয়া।রাস্তা হারিয়ে গিয়েছিলাম আমরা।’
‘ওহহ আচ্ছা।’
রিমি নিজ থেকেই করুণ স্বরে ডাকে,’ভাইয়া!’
‘হু?’
‘ভাইয়া একটা সমস্যা হয়েছে।’
‘সেটা কি?’
রিমি নিজের পা দেখায়।কাচুমাচু হয়ে বলে,’জোঁক সব রক্ত খেয়ে নিচ্ছে।’
আদি আঁতকে উঠে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে।চোখ বড় বড় করে বলে,’আল্লাহ! এসব কি?’
‘এসব জোঁক।রক্ত খেয়ে শরীরের সাথে লেগে থাকে।লবন ছিটিয়ে এদের শরীর থেকে আলাদা করতে হয়।’
আদি দ্রুত নাক চেপে ধরে।মুখ খিঁচিয়ে বলে,’ইসস!! কি বিচ্ছিরি! বমি পাচ্ছে আমার।’
‘বমি পেলে নাক ধরছেন কেন?’
আদি মাথা তুলে।নাক চেপে ধরেই বলে,’আমি পোকার শরীর দেখেই তার ঘ্রাণ বুঝে ফেলি।এই পোকাটার গন্ধ ভালো না।’
***
নবনীতা ঘুম ভাঙার পরেই চুপচাপ হেঁটে কটেজের বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।আজকে তার ঘুম একটু দেরিতেই ভেঙেছে।আরহাম আরো অনেক আগে উঠেছে।সে ব্যস্ত কিসব রান্নাবান্না নিয়ে।কালকে আসার পর থেকে এই পর্যন্ত সে পাঁচবারের উপরে জামা পাল্টেছে।তার বডি স্প্রে-র গন্ধে ঘরে ঢোকা যায় না।একটা বডি স্পে তো বোধ হয় মাখতে মাখতে শেষই করে ফেলেছে।টি শার্ট গুলো খুলে খুলে যেখানে খুশি সেখানে ফেলে রেখেছে।এই পুরো ঘর গোছাতেও তো নবনীতার আধঘন্টা লাগবে।
সে সবকিছু গুছিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।তাদের পাশের ঘরে শুভ্রা আর চিত্র ঘুমিয়েছে।সে লক ঘুরিয়ে ঘরের ভেতর উঁকি দিতেই দেখল তারা কেউ ঘরে নেই।নিশ্চয়ই বাচ্চাদের কাছে গিয়েছে।কোমর সমান চুলগুলোকে একহাতে পেঁচিয়ে কোনোরকমে ক্লাচারে পুরে সে তার কটেজ থেকে বের হলো।
দূরে আরিশকে দেখা যাচ্ছে।সে আকাশের ছবি তুলছে খুব মনোযোগ দিয়ে।আদি মোবাইলে একটানা বকবক করেই যাচ্ছে।নবনীতার সাথে চোখাচোখি হতেই সে হাত তুলে হাই দেয়।নবনীতা জবাবে কেবল মুচকি হাসে।
বেলা বাড়তেই সবাই দুপুরের খাবারের জন্য মাঠে এসে জড়ো হলো।শুধু ওয়াজিদ ছাড়া।আরহাম কপাল কুঁচকে বলল,’ঘটনা কি?ওয়াজিদ কোথায়?’
আদি মাথা চুলকে বলল,’কে জানে! তার নাকি ঘুম পাচ্ছে খুব।একটু পরে নাকি আসবে।’
রিমি মলিন মুখে ওয়াজিদের কটেজের দিকে তাকায়।সে আছে বলেই সম্ভবত খেতে আসতে চাইছে না।জিনিসগুলো যে হুট করে কেমন হয়ে গেল,সে নিজেও কিছু বুঝতে পারছে না।তার নিজেরও কেমন কান্না কান্না পাচ্ছে।সে ভেবে রেখেছে সে বাসায় গিয়ে মন মতো কাঁদবে।আপাতত এসব কান্না একটু চেপে রাখাই ভালো।
____
সবাই দুপুরে খাওয়ার পর পুনরায় চারদিকে হাঁটাহাঁটি করছিল।নবনীতা চিত্রার হাতটা টেনে ধরে কড়া গলায় বলল,’এভাবে ছুটছিস কেন?পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবি তো।’
চিত্রা সে কথা গায়ে মাখলো না।সে ছুটে এসে নবনীতাকে জাপ্টে ধরে বলল,’আপাই তুমি না বলেছিলে আমরা কোথাও বেড়াতে গেলে একসাথে ছবি তুলব?’
নবনীতা তার থুতনিতে হাত রেখে দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’আরে তাই তো।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।এই শুভি এদিকে আয় তো।’
শুভ্রা হাসিমুখে এগিয়ে আসে।নবনীতা আরিশকে ডেকে মিষ্টি হেসে বলল,’ভাই আমাদের তিন বোনের একটা সুন্দর ছবি তুলে দাও তো।আমরা আবার নতুন করে অ্যালবাম সাজাবো।’
আরিশ তারই মতো মিষ্টি হেসে ক্যামেরা সেট করে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়।কয়েকটা ছবি তোলার পরেই চিত্রা দু’জনকে ফেলে সামনের দিকে ছুটে যায়।
কালো রঙের টিশার্ট টা পেছন থেকে কেউ টেনে ধরতেই আরহাম পেছন ফিরে।চোখ পাকিয়ে জানতে চায়,’কিরে চিত্র! জামা ধরে টানিস কেন?জানিস না আমার টিশার্ট গুলো আমার কতো পছন্দের?’
চিত্রা তার হাত চেপে তাকে সামনে টানতে টানতে বলল,’তাত্তারি আমার সাথে এসো।’
সে তাকে টেনে নিয়ে আরিশের সামনে দাঁড় করায়।রিনরিনে গলায় বলে,’আমাদেরও অনেক গুলো ছবি তুলে দাও আরু।আমরা আমাদের নতুন অ্যালবামে সব জমাবো।’
আরিশ তার কথা শুনেই মুচকি হাসল।এই মিষ্টি বাচ্চাটা তাকে ভালোবেসে ছোট্ট করে আরু বলে ডাকে।এই সম্বোধনটা আরিশের বেশ ভালো লাগে।সে ক্যামেরার এঙ্গেল ঠিক করতে করতে বলল,’ওকে বস।এখনই তুলে দিচ্ছি।’
আরহাম আর চিত্রা অগনিত ছবি তুলল।একেক ছবির একেক পোজ।নবনীতা কপাল চাপড়ে বলল,’কি একটা অবস্থা! আপনি তো আমার সাথেও এতো গুলো তুলেননি।আর চিত্রর সাথে এতো গুলো?’
আরহাম মুখ কুঁচকে বলল,’তুমি কি চিত্র’র মতো এতো কিউট নাকি?নয়তো তোমার সাথেও তুলতাম।তুমি হচ্ছো প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টারদের মতো।কেমন জানি অদ্ভুত।দেখলেই মনে হয় রেগে আছো।’
***
নবনীতা একশো বারের উপরে দরজা ধাক্কায়।অথচ আরহাম দরজা খোলা তো দূর,একবার সাড়া পর্যন্ত দিলো না।নবনীতা পড়েছে বিপাকে।সে পুনরায় অনুনয় করে ডাকলো,’আরহাম! প্লিজ দরজা টা অন্তত খুলুন।আমার কথা তো শুনুন।’
আজ আবার একটা ঝামেলা হয়েছে।বিকেলে নাস্তার জন্য অনেকরকম স্ন্যাকস বানানো হচ্ছিল।হঠাৎই মুহিত তার পাশে এসে বলল,’তুমি না ফুচকা খুব পছন্দ করো?তাই আমি তোমার জন্য সেটার ব্যবস্থাও করেছি।যদিও এখানকার ফুচকা ঢাকার মতো এতো মজা না।তবুও কাজ চালিয়ে নেওয়া যায়।খেয়ে দেখতে পারো।’
নবনীতা বিব্রত হয়ে তার দিকে তাকায়।ভদ্রতার খাতিরে সামান্য হেসে জবাব দেয়,’জ্বী ধন্যবাদ।’
একটু এগিয়ে সামনে দেখতেই তার চোখ কপালে উঠল।যেই ভয়টা সে পেয়েছিল সেটাই হয়েছে।আরহাম তাকে আর মুহিতকে একসাথে দেখে নিয়েছে।দূরের একটা গাছের নিচে সে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে।তার স্থির,অতিমাত্রায় শীতল দৃষ্টি নবনীতার দিকে নিবদ্ধ।সে বোকা না।দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানো তার জন্য অসম্ভব কিছু না।নবনীতা চোরা চোখে আবারো তাকে দেখে।কি অদ্ভুত! সে এতো ভয় পাচ্ছে কেন?সে তো কোনো অন্যায় করেনি।মুহিত তো তার প্রেমিক না।তাহলে এতো ভয় কিসের?
সে ভয় পাচ্ছিল আরহামের প্রতিক্রিয়া নিয়ে।আরহাম যদি কিছু করে?যদি উল্টাপাল্টা কিছু বলে পরিস্থিতি নষ্ট করে তখন?তখন নবনীতার চেয়ে অপ্রীতিকর অবস্থায় আর কেউ পড়বে না।সে এক প্রকার ছুটতে ছুটতে আরহামের কাছে যায়।গিয়েই তার একটা হাত লুফে নিয়ে অত্যন্ত কোমল কন্ঠে অনুনয় করে,’প্লিজ আরহাম।আপনি মুহিতকে কিছু করবেন না প্লিজ।’
আরহাম আশ্চর্য হয়ে তার দিকে তাকায়।তার কথা শুনেই তার সমস্ত শরীর ঝনঝন করে উঠেছে।সে বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠল,’সিরিয়াসলি?তুমি এখনো তোমার সেই মেজর কে নিয়ে ভাবছ?’
নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’কি অদ্ভুত! তাকে নিয়ে কখন ভাবলাম?শুধু বললাম আপনাকে মাথা ঠান্ডা রাখতে।মুহিত,,’
আরহাম এক ঝাড়ায় নিজের হাত সরিয়ে নেয়।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’চুপ করো তো।সারাক্ষণ কানের কাছে মুহিত মুহিত শুনতে ভালো লাগে না।থাকো তুমি তোমার মুহিতকে নিয়ে।নিশ্চিন্তে থাকো।আমি কিছু করব না।যা খুশি করো তুমি।’
বলেই সে হনহনিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।নবনীতা শাড়ির কুচি চেপে ধরে ছুট লাগায় তার পেছন পেছন।আরহাম পেছন ফিরে কর্কশ কন্ঠে চেঁচায়,’একদম আমার ঘরে আসবে না।তোমার মুখটা দেখতেও অসহ্য লাগছে আমার।’
বলা শেষ করে নিজের রুমে গিয়ে সেই যে সে দরজা বন্ধ করেছে,তারপর দুই ঘন্টায়ও আর খোলার নাম নেই।নবনীতা দুই ঘন্টা যাবত তার দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে একপ্রকার ক্লান্ত।সে শেষমেশ একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’আমি দরজার সামনেই আছি।আপনার যদি একটু করুণা হয় এই মেয়েটার জন্য,তাহলে দয়া করে দরজা টা খুলবেন।নয়তো সারারাত এভাবেই থাকুন।’
একমিনিট যেতেই খট খট শব্দে দরজা খুলে।নবনীতা বড় বড় করে দু’টো শ্বাস ছেড়ে ভেতরে পা রাখে।আরহাম দরজা খুলেই পুনরায় খাটে গিয়ে শুয়েছে।
নবনীতা ধীর পায়ে হেঁটে তার পাশটায় গিয়ে বসল।তার চুলে হাত ছুয়িয়ে নিচু স্বরে ডাকল,’আরহাম! ও আরহাম! কথা তো শুনুন।’
‘কি শুনব?তোমার প্রেমকাহিনী শুনতে আমি আগ্রহী নই।’
‘আগ্রহী না হলেও শুনতে হবে।’
সে এক লাফে উঠে বসে।দ্রুত কদমে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।নবনীতা তার মতিগতি বুঝতেই ছুটে গিয়ে তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল।গাঢ় স্বরে বলল,’না না।এখন যাওয়া যাবে না।’
আরহাম মুখ খিঁচে তার হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল।বিরক্ত গলায় বলল,’ভালো লাগে না তো।সরো তুমি।বিরক্ত লাগছে ভীষণ।বালের ম্যারিড লাইফ।আমি আগেই ভালো ছিলাম।’
বলেই সে নিজেকে বন্ধনমুক্ত করে।নবনীতাও নাছোড়বান্দা।সে পুনরায় শক্ত হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে।নরম গলায় বলে,’একটা গান গাই?’
আরহাম উত্তর না দিয়ে কেবল সটান দাঁড়িয়ে থাকল।নবনীতা মুচকি হেসে সুমিষ্ট কন্ঠে কেবল দুই লাইন গাইলো,
‘আভি না যাও ছোড় কার,[এখনই ছেড়ে যেও না,]
ইয়ে দিল আভি ভারা নেহি।[আমার মন এখনো ভরে নাই]
.
.
.
.
ঘরের এক কোণায় হলদে রঙের বাতি জ্বলছে।নাতিশীতোষ্ণ হৃদয় জুড়ানো বাতাস পর্দা ঠেলে ঘরের ভিতর প্রবেশ করছে।অগ্রহায়ণ শুরু হবে কিছুদিন বাদেই।বাতাসে শীতের আগমনী বার্তা স্পষ্ট বিদ্যমান।
চব্বিশ বছর বয়স্কা মেয়েটি আস্তে করে তার স্বামীর বক্ষস্থলে মাথা রাখে।তারপরই শক্ত করে দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে।সে অনুভব করে এই মুহুর্তটা তার ভীষণ প্রিয়।এই যে বিষন্ন আর বিক্ষিপ্ত মনটা হুট করেই কেমন ভালো হয়ে গেছে,এই ব্যাপারটা তার খুব ভালো লাগে।অন্যপাশের মানুষটাও তো আচমকাই ঠান্ডা হয়ে গেছে।মেয়েটির চেয়ে তো তার অনুভূতি আলাদা কিছু না।
মেয়েটি মুচকি হেসে বলতে শুরু করে,’তো এটা হলো আমার গল্প।যেই গল্পটা আপনাকে শুনতেই হবে।আমি ছিলাম একেবারের বাস্তবতার ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া একজন মানুষ।বাবা নেই,মা নেই।শুধু আছে দু’টো ছোট্ট বোন আর মাথার উপর এত্তো এত্তো দায়িত্বের বোঝা।আমি ভীষণ উদ্ভ্রান্ত ছিলাম।জীবন তার করুণতম রূপ আমার সামনে মেলে দিয়েছিল।তারপর আমার জীবনে একজন মানুষের আগমন হলো।সে এলো আর কি হলো জানি না।আমি হুট করেই নিজের কৈশোরে ফিরে গেলাম।যেই কৈশোর আমার জীবন থেকে অনেক আগেই চলে গিয়েছিল।আমি অভিমান করা শিখলাম,আমি গাল ফুলানো শিখলাম।আমি সব শিখে গেলাম।আমি নিজেকে চূড়ান্ত রকমের আবেগী নারী রূপে আবিষ্কার করলাম।অথচ আমি ছিলাম ভীষণ মজবুত,প্রখর আত্মসম্মানে ভরপুর।পরে বুঝলাম,আত্মসম্মান কমে নি।আমিই নতুন একটা আমিকে খুঁজে পেয়েছি।এই আমিটাকেও আমার ভালো লাগে খুব।আপনি জানেন,যার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে তাকে আমার কতোখানি ভালো লাগে?এই যে সে মন খারাপ করল,আমি নিজে ছটফট করতে করতে হয়রান হয়ে যাচ্ছি।কারণ তার মনে কষ্ট দিতে আমার ভালো লাগে না।আমি কি করে তাকে বুঝাই সে ব্যতীত আমার জীবনে আর কেউ নেই?কি করে বোঝাই সে ছাড়া আমার এতো যত্ন আর কখনো কেউ করেনি?কি করে বুঝাই তার মতো করে কেউ কখনো আমার জন্য ভাবে নি।মাঝরাতে কাকভেজা হয়ে যেই মানুষটা আমার জন্য ফুচকা হাতে হসপিটালে এসেছিল,তাকে কি করে কষ্ট দিব আমি?আমি কেমন করে তাকে বুঝাই তাকে আমি কতোখানি ভালোবাসি?ভালোবাসা কি মুখের স্বীকারোক্তি তে বোঝানো যায়?নাকি আচরণে বোঝাতে হয়?সে কি আমার আচরনে বুঝে না আমি তাকে কতোখানি ভালোবাসি?’
আরহাম চুপচাপ তার কথা শুনল।নবনীতা থামতেই সে কাঁপা স্বরে বলল,’তুমি আমাকে ভালোবাসো পরী?’
নবনীতা মাথা না তুলেই জবাব দেয়,’হু বাসি।’
সময় গড়ায়।আচমকা নবনীতা ফুপিয়ে উঠে।তার হাতের বন্ধন আরো শক্ত করে ক্রন্দনরত স্বরে বলে,’আমি এজন্য আপনাকে বারণ করিনি যে আপনি মুহিতকে কিছু করলে আমার তার জন্য কষ্ট হবে।আমি এজন্য বারণ করেছি কারণ আপনি কিছু করলে সেই ঘুরে ফিরে আপনারই সমস্যা হবে।আপনি কেন বুঝতে চান না?সবকিছুতে হঠকারিতা ভালো না।’
আরহাম সেসব কিছু শুনলো না।সে আগের মতোই বলল,’আমায় ভালোবাসো পরী?’
নবনীতা মাথা তুলে।একহাতে তার খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি গালে হাত রেখে অন্য গালটায় প্রগাঢ় চুমু খায়।ঘোরলাগা কন্ঠে বলে,’হুম বাসি।একশোবার বাসি।’
‘তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো?’
‘জ্বী।সত্যিই।’
‘আবার বলো তো।’
নবনীতা আলগোছে হাসে।একবার বড়ো করে শ্বাস টেনে বলে,’জ্বী আমি নবনীতা নূর,চিত্র আর শুভির পরী আপাই,তাসনুভা আর আরিশের পরী ভাবি,আর আপনার পরী সত্যিই আপনাকে এতো এতো এতো বেশি ভালোবাসি।আপনি চাইলে আমি একশোবার এই কথা বলতে পারব।কারণ সত্য কথা দিনে একশোবার বলা যায়।’
আরহাম তার কথা শুনেই শব্দ করে হাসল।নবনীতা চোখ মুছে বলল,’আপনি সেদিন একটা কথা ভুল বলেছিলেন।আপনি বলেছিলেন আপনার মা আমার চেয়েও ভাগ্যবতী কারণ তিনি স্বামী হিসেবে খুব ভালো কাউকে পেয়েছিলেন।কিন্তু আজ আমি বলছি আমি আপনার মায়ের চেয়েও বেশি ভাগ্যবতী কারণ আপনার মা জীবনের শেষ পর্যন্ত সেই ভালোবাসা ধরে রাখতে পারেনি।কিন্তু আমি পারব।আমি সারাজীবন এই ঘর,সংসার এই সবকিছুকে ধরে রাখব।এই যত্ন ভালোবাসা সবকিছুতে আমার লোভ জন্মেছে।আমি আর এসব ছাড়ছি না আরহাম।’
চলবে-