কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৪৪

0
67

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৪৪)[প্রথম অংশ]

তাসনুভা অমলেটের অপেক্ষায় রান্নাঘরের সামনে বসেছিল।আফরোজা বেগম তার নিজের কাজে ব্যস্ত।তাসনুভার কথা শুনার সময় তার নেই।সে কি এই বাড়ির ঝি নাকি?

আদি আপেল খেতে খেতে সিঁড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছিল।নবনীতা সম্ভবত তার ঘরে আরশাদকে খাওয়াচ্ছে।রান্নাঘরের দরজায় তাসনুভাকে দেখতেই সে থামল।এগিয়ে এসে বলল,’ব্যাপার কি?এদিকে কি কাজ?’

তাসনুভা গালের নিচে হাত রেখে ক্লান্ত গলায় বলল,’হঠাৎ অমলেট খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।ফুফুকে বলেছি করে দিতে।’

‘তো?এখনো ভাজা হয় নি?’

‘ফুফুর অন্য কাজ আছে।সেটা শেষ করে তারপর আমাকে অমলেট করে দিবে।’

অতি ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর করে সে।আদি তাড়াতাড়ি আপেল খাওয়া শেষ করেই নিজের টি শার্টে হাত মুছতে মুছতে বলল,’চলো।ভাইয়া করে দিচ্ছি।’

তাসনুভা অবাক হয়।চোখ গোল গোল করে জানতে চায়,’তুমি রান্না পারো?’

‘ঐ আরকি।অমলেট টা অন্তত করে নিতে পারি।’

আদি দ্রুত পায়ে কিচেনে গেল।ফ্রাইপেন টা হাতে নিয়েই চুলায় বসিয়ে স্টোভ অন করল।আফরোজা বেগম ছুটে এসে ব্যস্ত গলায় বললেন,’আরে তুমি করছ কেন?আমি তো বললাম অবসর হয়ে আমিই করে দিব।’

আদি তার দিকে ফিরল না।ফ্রাইপেনে তেল ঢালতে ঢালতে সেদিকে দেখেই বলল,’একটা অমলেট খাওয়ার জন্য একটা মানুষ এতোক্ষণ বসে থাকবে?দুই মিনিটের ব্যাপার।আপনি আপনার কাজ করুন।আমি করে নিচ্ছি।’

সে কি খুব সূক্ষ্মভাবে আফরোজা কে একটা খোঁচা দিলো?চটপট শুনিয়ে দিলো যে তুমি চাইলেই দুই মিনিটে কাজ টা করে নিতে পারতে।করো নি কারণ তোমার করতে ইচ্ছে হয় নি।তিনি কথা না বাড়িয়ে নিজের কাজে মন দিলেন।যা খুশি করুক।তার কি?

তাসনুভা হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।সন্দিহান গলায় বলল,’তোমার বানানো অমলেট খেতে ভয় হচ্ছে।’

‘কেনো বলো তো?’

‘তোমাকে দেখে কোনোভাবেই মনে হয় না তুমি রান্না জানো।’

আদি চোখ পাকায়।কপট রাগ দেখিয়ে বলে,’আমার ট্যালেন্ট নিয়ে এতো বড়ো সন্দেহ?যাও,আজ আমি তোমাকে অমলেটের সাথে এগ নুডলসও করে খাওয়াব।’

তাসনুভা ঠোঁট উল্টে বলল,’বাপরে! অমলেট,আবার সাথে এগ নুডলসও।পুরাই হাই প্রোটিন খাবার দাবার।’
.
.
.
.
‘আমার মামিকে তোমার কেমন লাগে তাসনুভা?’

আদির বানানো নুডলস এক চামচ মুখে দিয়েই তাসনুভার দিকে দেখে প্রশ্ন করল নবনীতা।
আদি আজকে একটা চমৎকার নুডলস রান্না করেছে।অনেকটা চাওমিন স্টাইলে।নবনীতা মুখে দেওয়া মাত্র স্বীকার করেছে আদির রান্নার হাত বেশ ভালো।

এই মুহূর্তে তারা চারজন লিভিং রুমের সোফাগুলোতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।সবার হাতেই নুডলসের বাটি।

তাসনুভা প্রশ্ন শুনেই মুখ ভেঙচিয়ে বলল,’জাস্ট অসহ্য লাগে।একটুও ভালো লাগে না।’

নবনীতা ঝুকল।গম্ভীর হয়ে জানতে চাইল,’কিন্তু কেন?’

‘কেন মানে?উনি তোমাদের সাথে অনেক অন্যায় করেছে।ভালো লাগার কি আছে?’

‘কেন?কেন ভালো লাগবে না?উনি তো চিত্র কে খুব আদর করে।এটা দেখে তো তোমার ভালো লাগা উচিত।তাই না?’

তাসনুভা মুখ বাঁকা করে বলল,’ঐটাতো ভন্ডামি।উনি ফাপড়ে পড়ে বাধ্য হয়ে চিত্রাকে আদর করছে।যেন ঐ বাড়িতে তাদের থাকতে দেওয়া হয়।উনি মন থেকে তাকে ভালোবাসে না।ভাইয়ার সাথে তোমার বিয়ে হয়েছে বলেই এতো আদর দেখাচ্ছে।’

নবনীতার এই উত্তর পছন্দ হলো না।সে বিরক্তিতে চ-কারান্ত শব্দ করে বলল,’উহু।সেটা তোমার ভাবার বিষয় না।আমার মামি আমার সাথে অতীতে কি করেছে সেটা দিয়ে তোমার কি?তুমি কি কখনো নিজের চোখে তাকে আমার সাথে বাজে ব্যবহার করতে দেখেছ?’

তাসনুভা তাজ্জব হয়ে বলল,’অদ্ভুত তো! সে এখন কেন তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করবে?তোমার সাথে বাজে ব্যবহার করলে তো উনারই সমস্যা।কিন্তু আমি জানি উনি কোনো ভালো মানুষ না।’

‘অবশ্যই উনি ভালো মানুষ।উনি চিত্র কে খুব আদর করে।এটা দেখে আমরা বলতেই পারি উনি ভালো মানুষ।চিত্রও তো উনাকে পছন্দ করে তাই না?’ জোর গলায় উত্তর দেয় নবনীতা।

তাসনুভা বোকার মতো ফ্যালফ্যাল চোখে কতোক্ষণ তাকে দেখে।তারপরই আশ্চর্য হয়ে বলে,’কি অদ্ভুত কথা বলছ ভাবি! তুমি নিজে তার আসল রূপটা দেখেছ।তাও বলছ সে ভালো মানুষ।চিত্রার পার্সপেক্টিভ থেকে তুমি কেন তাকে জাজ করছো?তার আসল রূপ চেনার জন্য শুভ্রা আর তোমার পার্সপেক্টিভ থেকে জাজ করতে হবে।’

নবনীতা তার উত্তর শুনেই প্রসন্ন হাসল।তারপর হঠাৎই সেই হাসি মিলিয়ে নিল।চোখ মুখ শক্ত করে গুরুগম্ভীর স্বরে বলল,’ঠিক যেমন চিত্রার সাথে কেমন আচরণ করছে এটা দেখে আমার মামির স্বরূপ বিচার করা যায় না,তেমনি তোমার সাথের আচরণ দেখে তোমার মায়ের স্বরূপ বিচার করা যাবে না।তোমার মা কেমন সেটা জানতে হলে আরহামের চোখ দিয়ে দেখতে হবে,আরহামের পার্সপেক্টিভ থেকে ভাবতে হবে।’

আদি তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে সামনে তাকায়।বিস্ফারিত নয়নে আবিষ্কার করে এতোক্ষণের এতো কথার মূল উদ্দেশ্য আসলে অন্যকিছু।কি চমৎকার উপমায় মেয়েটা সবটা বিষয় এই পর্যন্ত এনেছে! সে দ্রুত তার বাটিটা টি-টেবিলে রেখে তাদের কথোপকথনে মনোযোগ দেয়।

তাসনুভা একটু ভড়কে গেল।পরক্ষণেই আবার মলিন মুখে বলল,’তার মানে তুমিও মানছো ভাইয়া তার সাথে যা করেছে সেটা ঠিক?’

‘এক শব্দে যদি জবাব দেই তাহলে বলব হ্যাঁ,সেটাই ঠিক।তোমার মা কে ভালোবাসার মতো কোনো গুন তার মাঝে আছে নাকি আমার জানা নেই।’

তাসনুভা আশাহত হয়ে মাথা নামিয়ে নেয়।আরিশ শান্ত চোখে একবার নবনীতাকে দেখে,আরেকবার দেখে তাসনুভা কে।মায়ের প্রতি তার কখনোই ভাইয়ার মতো বিদ্বেষ কাজ করে না।তবে মা আদর দিলেই আরিশ সেই আদর গায়ে মেখে নিবে,এতোটাও আবেগী সে না।যে চলে গেছে,সে চলে গেছে।আবার কেন ফিরে আসবে?তার সাথে আরিশদের সম্পর্ক সেদিনই শেষ যেদিন সে তাদের ফেলে চলে গিয়েছে।আরিশের তো জীবনেও ইচ্ছে হয় না তার হাতে আদর নেওয়ার।যেই মহিলা তাকে ব্যস্ততার অযুহাত দেখিয়ে জীবনে একবারো স্কুলে নিয়ে যেতে পারে নাই,সেই মহিলার জন্য কিসের এতো দরদ?আরিশের তো এতো দরদ আসে না।

মা কে নিয়ে ভাইয়া যে রোজ রোজ গালমন্দ করে এটা আরিশের ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ না।গালি দিবে কেন?মা তো।চলে গেছে,এখন এই নিয়ে কথা না বললেই তো হয়।কিন্তু না,ভাইয়া প্রতিদিন দুই বেলা মনে করে তাকে গালি দিবে।আরিশ চায় ঐ মহিলাকে নিয়ে ভালো মন্দ কোনো কথাই না উঠুক বাড়িতে।কিন্তু সে অন্ধ না।তাসলিমা নামের সেই চরম অকৃতজ্ঞ মেয়ে মানুষের জন্য আরিশ তার ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক নষ্ট করবে না।এই ভাই ছিল বলেই আরিশ আর তাসনুভা আজ বহাল তবিয়তে আছে।ভাই যদি শক্ত হাতে সংসারের হাল না ধরত,ব্যবসার দায়িত্ব কাঁধে না নিত,তাহলে কতো আগেই বাড়িঘর সব নিলামে তুলে তারা রাস্তায় গিয়ে বসত।ভাইয়ের কাছে সে কৃতজ্ঞ।একটা লম্বা সময় মানসিক ট্রমার ভেতর দিয়ে যাওয়া ছেলেটা নানা ঘটনায় নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত করেছে।অথচ এই খোলসের ভেতর একজন অসহায়,মানসিক যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হতে থাকা মানুষ ছিল।যাকে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে এই পছন্দ আসতে হয়েছে।সেই পরিশ্রমী,উদ্যোমী আর প্রখর বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষটিকে আরিশ ভালোবাসে।আরহাম নামের নেই ক্ষেপাটে লোকটিকে আরিশ খুব বেশি ভালোবাসে।ভাইয়ের সাথে রূঢ় আচরণ সে কোনোদিনই করতে পারবে না।সে জায়গায় তাসলিমার মতোন মানুষদের জন্য ভাইয়ের সাথে দুর্ব্যবহার?সত্যিই হাস্যকর বিষয়।

নবনীতা একবার গলা খাকারি দিয়ে বলতে শুরু করল,’মামি আমাদের সাথে এই ছয়টা বছর খুব একটা ভালো আচরণ করেনি।সবসময় কেমন অবজ্ঞাই করেছে মামার বাসার থাকি,মামার টাকায় খাই।খোঁটা তো দিবেই।তাই না?আমি আর শুভ্রা সেই খোঁটা শুনেছি।বুঝতে পেরেছি তাদের সংসারে আমাদের আগমন তার খুব একটা পছন্দ হয়নি।ছয় ছয়টা বছর কোনোরকমে পড়েছিলাম।কয়েকবার মুখে মুখে উত্তর দিয়েছি অতিষ্ঠ হয়ে।নিজে উপার্জন করে সংসারে টাকা দিয়েছি।কিন্তু ঐতো দিনশেষে মামির সংসার তো মামির ই ছিল।আমরা ছিলাম উটকো ঝামেলা।সেই মামি কে আমি আর শুভ্রা চিনি।সেই অবহেলা ভৎসনা আমরা সহ্য করেছি।আমরা জানি আমাদের মামি কোনোদিনই ভালোবাসেনি।অথচ দেখো,চিত্র কিন্তু দিব্যি তার সাথে মিশে যাচ্ছে।চিত্রকে সে খুব স্নেহ করে।কারণ আমার বিয়ে খুব ক্ষমতাসীন কারো সাথে হয়েছে।এখন আর পরী কিংবা তার বোনদের সাথে দুর্ব্যবহার করা চলবে না,তাই করছে না।’

নবনীতা এইটুকু বলে থামল।কয়েকটা শ্বাস ফেলে একটু জিরিয়ে নিল।তারপরই পুনরায় ঠান্ডা স্বরে বলতে শুরু করল,’ধরো আজ থেকে দশ বারো বছর পর কোনো একদিন আমি মন খারাপ করে বললাম মামির বাড়িতে আমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করে থাকতে হয়েছে,মামি আমাদের উঠতে বসতে প্রচন্ড অপমান করেছে।আর ঠিক তখনই চিত্র উঠে দাঁড়িয়ে তীব্র বিরোধ করল যে না,এটা হতেই পারে না,মামি এসব করতেই পারে না,আমি মামিকে নিয়ে ভুলভাল বলছি।তখন আমার কেমন লাগবে বলো তো?’

তাসনুভা মাথা নামিয়ে তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।আরিশ চোখ তুলে তার ভাবভঙ্গি দেখে।তারপরই পুনরায় নবনীতার কথায় মন দেয়।মেয়েটা অত্যন্ত গুছিয়ে কথা বলতে পারে।ভাইয়ার উচিত ঘেউ ঘেউ না করে ভাবির কাছ থেকে ঠান্ডা গলায় কথা বলা শেখা।তাহলে ভাইয়ারও জীবনের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

‘তোমার ভাইয়া অতীতের কোনো এক সময়ে খুব জঘন্য একটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল।তুমি অবশ্যই সেটা জানো।সেই সময়টা তুমি দেখোনি,ঠিক যেমন আমার কঠিন সময়টা চিত্রা দেখেনি।দেখেছে,তবে ভবিষ্যৎে মনে থাকবে না।তোমার মায়ের আসল রূপ তোমার ভাইয়া দেখেছে।যাই হোক।তুমি যথেষ্ট বুঝদার।শুধু এইটুকু বুঝে নিও যে মানুষটা নিজের শয্যাশায়ী স্বামী,তিনটে ফুটফুটে সন্তান ফেলে অন্যত্র বিয়ে করে নিতে পারে,সে কোনোদিনই নিজের সন্তানদের ভালোবাসতে পারে না।তার বর্তমান স্বামী যদি ভালো হতো,তাহলে সে তোমাদের দিকে ফিরেও তাকাতো না।অন্তত তার মতো স্বার্থপর মানুষের জন্য তোমার ভাইয়াকে ভুল বুঝো না।তোমার ভাইয়া বাকিদের জন্য কি করেছে জানি না।তোমাদের জন্য যথেষ্ট করেছে।এইটুকু কৃতজ্ঞ তোমাদের তার কাছে থাকা উচিত বলে মনে করি।’

অত্যন্ত দ্ব্যর্থহীন ভাবে জোর গলায় পুরোটা কথা শেষ করে নুডলসের বাটি হাতে নবনীতা উঠে দাঁড়ায়।তার বচনভঙ্গি কিছুটা কড়া হয়েছে।কিন্তু তার কাছে এটাই সমীচীন মনে হয়েছে।একটা পুরোদস্তুর স্বার্থপর মহিলার জন্য তাসনুভা তার ভাইয়ের সাথে বাজে আচরণ কেন করবে?সে কি জানে না ভাই তাদের কতো ভালোবাসে?নবনীতা মিষ্টি মিষ্টি কথায় মানুষের মন জয় করতে ইচ্ছুক না।যা তার কাছে উচিত মনে হয়,সে তাই বলে।

****

আরহাম বাড়ি ফেরার দশ মিনিট পরেই টেলিভিশন ছেড়ে বসল।আজ একটা রেকর্ডেড টক-শো প্রচার করা হবে তার।তাও আবার মূলধারার একটি চ্যানেলে।এই নিয়ে সে ভীষণ এক্সাইটেড।সে রিমোটের বাটন চেপে ভলিউম বাড়ায়।

নবনীতা আড়চোখে একবার তার কাজকর্ম দেখে।ভলিউম বাড়িয়ে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত করা হয়েছে।আর চার বাদ রেখেছে কেন?সেটাও দিয়ে দিতো।সে সেদিকে খেয়াল না দিয়ে পুনরায় তাসনুভার দিকে তাকায়।দু’জনে চোখাচোখি হতেই সে কড়া স্বরে বলে,’বড্ড অলস তুমি।’

সে আজ তাসনুভার নার্স শাহানা খাতুনের সাথে কথা বলেছে।তিনি বললেন তাসনুভার উচিত একটু দাঁড়ানোর চেষ্টা করা।শুরুতেই হয়তো পারবে না,তবে কয়েকবার চেষ্টা করলেই তাসনুভা ওয়াকিং স্টিকের সাহায্যে হাঁটতে পারবে।এই কথা শোনার পরেই নবনীতা কোমর বেঁধে নেমেছে তাসনুভাকে তার নিজের পায়ে দাঁড় করানোর মিশনে।

তাসনুভা হতাশ।ভীষণ হতাশ।সে পারে না নিজের পায়ে দাঁড়াতে।অনেক চেষ্টা করেছে।দাঁড়ানোর আগেই তার সমস্ত শরীর মাটিতে পড়ে যেতে চায়।সে কোনো ভাবেই দাঁড়াতে পারে না।অথচ ভাবি এই কথা মানতেই চাইছে না।বলছে সে নাকি চাইলেই হাঁটতে পারবে।কি হাস্যকর কথা! দাঁড়াতেই জান যায়,আর সে নাকি হাঁটবে।ভাগ্যিস দৌঁড়াবে বলে নি।

নবনীতা পুনরায় তার একহাত ধরে টান দিলো।জোর গলায় বলল,’দেখি দেখি আবার দাঁড়ানোর চেষ্টা করো।’

তাসনুভা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার হাতে ভর দিয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল।ফলাফল আগের মতোই।সে ধাম করে পুনরায় হুইলচেয়ারে গিয়ে পড়ল।আরহাম টেলিভিশনের পর্দা থেকে চোখ সরিয়ে বসার ঘরের খোলা জায়গায় তাদের কাজকর্ম দেখে।পরীর উপর তার মেজাজ গরম হচ্ছে।শুধু শুধু কি দরকার বাচ্চা মেয়েটাকে কষ্ট দেওয়ার?পরী কি কোনো ডাক্তার?সে জানে তাসনুভা কখন হাঁটবে?যত্তোসব! টেনে টেনে তাসনুভার হাল বেহাল করে দিচ্ছে এই মেয়ে।আরহাম কিছু বলতে গিয়েও বলল না।বললেই তাসনুভার উপর তার রাগ শেষ হয়ে যাবে।সে গো ধরেছে এই রাগ অভিমান সে নিজে আগ বাড়িয়ে শেষ করবে না।যা খুশি হোক।টেনে টেনে হাত লম্বা করে ফেলুক।তাও সে কিছু বলবে না।

একবার দুইবার তিনবার।অনেক গুলো চেষ্টার পর অবশেষে একবার তাসনুভা কোনোরকমে পা টা মেঝেতে ছোঁয়ায়।নবনীতা আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার দেয়,’আরহাম! তাসনুভা ফ্লোরে পা দিয়েছে।’

আরহাম সাথে সাথে সেদিকে ফিরে।নবনীতা তাসনুভার কাঁধ থেকে ধীরে ধীরে হাত সরায়।উৎসাহী গলায় বলে,’তুমি পারবে তাসনুভা।তুমি অবশ্যই পারবে।’

তাসনুভা চোখ মুখ খিঁচে মাটিতে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে।দুই সেকেন্ড কোনোরকম থাকার পড়েই পুনরায় তার শরীরটা নিচের দিকে হেলে পড়ে।

আরহাম তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।সামনে ছুটতে ছুটতে নিশ্বাস বন্ধ করে চেঁচায়,’পড়ে যাবি তাস।একটু জোর খাটিয়ে দাঁড়িয়ে থাক।পড়িস না প্লিজ।’

তাসনুভা পুরোপুরি পড়ে যাওয়ার আগেই শক্তপোক্ত হাত জোড়া তীব্র বেগে ছুটে এসে তার কাঁধের দুই পাশে হাত রেখে তাকে আগলে নেয়।তাসনুভা গোল গোল চোখে তার দিকে তাকায়।দৃষ্টি বিনিময় হতেই আরহাম চোখ সরিয়ে নেয়।সে একটু দূরে সরতে নিলেই তাসনুভা এক ঝাপে তাকে জড়িয়ে ধরল।হু হু করে উঠে বলল,’ছাড়বে না ভাইয়া।’

আরহাম থামল।না ছাড়ল,না ধরল।কেবল সটান দাঁড়িয়ে থাকল চুপচাপ।তাসনুভা একহাতে চোখ মুছে বলল,’আই অ্যাম সরি।’

আরহাম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।ছোট করে বলে,’ইটস ওকে।এখন ছাড়।’

‘না ছাড়ব না।’

‘কেন ছাড়বি না?’

‘কারণ আমার কথা এখনো বাকি।’

‘কি কথা তোর?’

তাসনুভা তার হাতের বন্ধন আরো শক্ত করে।মৃদু হেসে গাঢ় স্বরে বলে,’আই লাভ ইউ ভাইয়া।এই অধমকে এই বারের মতো ক্ষমা করে দাও।আর কখনো ঐ ব্যাপারে তোমার সাথে বেয়াদবি করব না কথা দিচ্ছি।’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৪৪)[দ্বিতীয় অংশ]

অতিমাত্রায় বিচলিত মন যখন হুট করেই অতিমাত্রায় প্রফুল্ল হয়ে উঠে,তখন ব্যক্তির পক্ষে আবেগ নিয়ন্ত্রণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।আরহামের সম্ভবত এমন কিছুই হয়েছে।তাসনুভার এতো মিষ্টি সুরে মাফ চাওয়া,আর তার চেয়েও মিষ্টি সুরে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করা তাকে ভীষণ ভীষণ আনন্দ দিয়েছে।তার মন এতো বেশি ভালো হয়ে গেছে যে সেই রাতে সে ঘন্টার পর ঘন্টা তার বোনকে নিয়ে হাঁটার অনুশীলন করেছে।

তাসনুভা কেবল দুইবার সেকেন্ডের জন্য দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে।অন্য সকল বার সে ব্যর্থ হয়েছে।কিন্তু আরহাম হতাশ হয়নি।একটা নতুন আশার আলো তার চোখে এসে ভীড় করেছে।সে স্বপ্ন দেখে তাসনুভা অবশ্যই হাঁটতে পারবে।হয়তো খুব শীগ্রই সেদিন আসবে না।তবে একদিন না একদিন এই মেয়েটা পুনরায় নিজের পায়ে দাঁড়াবে।আরহামের বিশ্বাস সেই দিন আসবেই।

আজ সে হুট করেই একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে।নবনীতা রাতে ঘরে আসা মাত্র সে মাথার পেছনে হাত রেখে আধশোয়া থাকা অবস্থায় বলল,’তোমার জিনিসপত্র সব গোছাও পরী।’

নবনীতা চমকায়।দুই চোখ বড় বড় করে বলে,’সেকি! কেন?’

আরহাম গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো,’তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিব।আর ভালো লাগে না তোমাকে।’

নবনীতা কপাল কুঁচকে কতোক্ষণ তাকে দেখে।তারপরই আবার মাথা নেড়ে অন্য কাজে মন দেয়।আরশাদ একটু আগে ঘুমিয়েছে।সে ঘরে এলেই পুরো ঘর এলোমেলো করে দেয়।নবনীতা তাড়াতাড়ি ফ্লোর থেকে তার খেলনাগুলো হাতে তুলে।আরহাম আশ্চর্য হয়ে বলল,’এ্যাই পরী! তুমি আমাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছো না কেন?’

নবনীতা খেলনা গুলো যথাস্থানে রাখতে রাখতে গম্ভীর হয়ে বলল,’কারণ আপনাকে সিরিয়াসলি নেওয়ার মতো কিছু নেই।’

আরহাম আড়চোখে তাকে দেখে।নবনীতা সব কাজ শেষ করে তার মুখোমুখি বসে ব্যস্ত হয়ে বলল,’এখন ঘটনাটা কি একটু খুলে বলুন তো স্যার।’

আরহাম তার একহাত টেনে তাকে নিজের উপর ফেলল।কপালের চুলগুলো সরিয়ে সেখানে ছোট ছোট দু’টো চুমু খেল।নবনীতা মাথা তুলে সরু চোখে জানতে চাইল,’এটা আমাকে ভালো না লাগার নমুনা?’

বলতে বলতেই দু’জন একসাথে হেসে ফেলে।নবনীতা তার মাথাটা আরহামের বুকে ফেলে কিছুক্ষণ তার নিশ্বাসের শব্দ শুনে।তারপরই নিজ থেকে ডাকে,’আরহাম!’

‘হু?’

‘রাগ একটু নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করবেন।সেই সাথে মুখের ভাষা সংযত রাখবেন।বড্ড বেশি গালমন্দ করেন আপনি।’

আরহাম ফিচেল হাসল।মুখে সেই হাসি ধরেই জবাব দিলো,’আচ্ছা।চেষ্টা করব,বাকিটা জানি না।’

সে নবনীতার দুই কাঁধে হাত চেপে তাকে সোজা করে বসালো।দু’জনের চোখাচোখি হতেই সে একপেশে হেসে বলল,’আসো,কাছে আসো।তোমাকে পেয়ে একটু মন ঠান্ডা করি।’
.
.
.
.
মোটামুটি সাইজের লাগেজটা কানায় কানায় কাপড় দিয়ে পূর্ণ হতেই নবনীতা কপাল চাপড়ে বলল,’কি সাংঘাতিক ব্যাপার! দুই দিনের সফরে এতো কাপড়?’

আরহাম বিরক্ত মুখে তার দিকে তাকালো।কাপড় গুলো চেপে চেপে কোনোরকমে লাগেজের চেইন বন্ধ করল।তারপরই সামনে হাঁটতে হাঁটতে বলল,’হ্যাঁ,আমার একটু বেশিই কাপড় লাগে।’

‘কেন?আপনি কি আরশাদ?আরশাদই না দশ মিনিট পর পর প্যান্ট ভিজিয়ে নষ্ট করে।’

আরহাম মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করে।কাল রাতে সে চট করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা সবাই দুই দিনের জন্য রাঙামাটি যাবে।রাঙামাটিতে তার বাবার একটা এনজিও আছে,বাচ্চাদের জন্য প্রতিষ্ঠা করা একটা স্কুল আছে।তার মনে হচ্ছে আরিশ আর তাসনুভাকে এই জিনিস গুলো দেখানো প্রয়োজন।তাদের জানানো প্রয়োজন তাদের বাবা কতো অসাধারণ একজন মানুষ ছিলেন।সে ভ্রমণ উপলক্ষে ব্যাগ ভর্তি টিশার্ট আর ট্রাউজার নিলো।এই দুই তিন দিন সে পাঞ্জাবি তে হাতও দিবে না।টি-শার্ট পরবে,আর তার পরে ভরে ভরে বডি স্প্রে মাখবে।

নবনীতা আলমারি থেকে তিনটা শাড়ি বের করে গলার স্বর চওড়া করে বলল,’সব তো আপনার জামা দিয়েই ভর্তি।আমার শাড়ি কেমন করে নিব?’

আরহামে তার হাতের শাড়ি তিনটা দেখে।দেখেই মুখ কুঁচকে বলে,’এতো শাড়ি কেন?একটা নাও।দুই দিনেরই তো ব্যাপার।’

নবনীতা মুখ শক্ত করে একনজর তাকে দেখে।তারপরই এগিয়ে এসে লাগেজের চেইন খুলে অনেক কষ্টে চেপে চেপে শাড়ি তিনটে ভেতরে জায়গা করে রাখে।আরহাম তাকে মৃদু স্বরে ধমকে উঠে বলল,’আমার আয়রন করা কাপড় গুলো নষ্ট হচ্ছে।’

নবনীতাও কটমট চোখে উত্তর দিলো,’হোক।’

‘তুমি একটুও সম্মান করো না আমাকে।’

‘জ্বী।আর আপনি অনেক করেন।’

‘সম্মান বউরা করে।জামাইরা না।’

‘বাপরে! এই ফতোয়া কে দিলো আপনাকে?নাকি আপনি নিজেই বানিয়েছেন?’

আরহাম তর্কে গেল না।তার মেজাজ এখন যথেষ্ট ভালো।পরীর সাথে ক্যাচ ক্যাচ করে সে মন মেজাজ খারাপ করতে চায় না।আজ রাত তিনটায় তারা যাত্রা শুরু করবে।এখন বাজে রাত নয়টা দুই।সে হঠাৎই ব্যস্ত পায়ে নবনীতার দিকে এগিয়ে যায়।খপ করে তার হাতের কবজি চেপে ধরে বলে,’চলো তো।এক জায়গায় যেতে হবে আমাদের।এক্ষুনি।’

নবনীতা আশ্চর্য হয়ে শুধায়,’সেকি! কোথায় যাবো আমরা?

আরহাম সেই কথার উত্তর না দিয়ে টেনে টেনে তাকে গাড়িতে নিয়ে বসালো।আজ আর মোতাহের ড্রাইভ করছে না।রাতে বাড়ি থেকে বের হলে আরহাম নিজেই ড্রাইভ করে।

নবনীতা গাড়িতে বসেই একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল।কোথায় যাচ্ছি,কেন যাচ্ছি,কি করতে যাচ্ছি,আরহাম কেন তাকে সহ নিয়ে যাচ্ছে,কি হয়েছে,কেন হয়েছে কতো কিছু! আরহাম মহাবিরক্ত হয়ে বলল,’একটু চুপ করবে তুমি?’

বলেই সে মিউজিক প্লেয়ারে গান ছাড়ে।গান ছাড়তেই তার মনে হলো এই পরিস্থিতিতে একটা সুন্দর গান ছেড়ে পরীর কাছে তার মনের ভাব প্রকাশ করাই যায়।একটু বোঝানোই যায় যে পরী তার কাছে ঠিক কেমন।যেহেতু মুখ দিয়ে সে মধুমাখা কথা বলতে পারে না।সেক্ষেত্রে গান দিয়েই কাজ চালানো উত্তম।

সে অনেক ঘেটে একটা গান বের করল।এই গানটা সে শুনেছিল ‘রুস্তম’ নামের একটি ভারতীয় সিনেমা দেখতে গিয়ে।তার ভার্সিটি জীবনের শেষের দিকের ঘটনা।সিনেপ্লেক্সে একটা মুভি বেশ নাম করেছিল।আদি,সে আর ওয়াজিদ মিলে অতি উৎসাহে সেই মুভি দেখতে গিয়েছিল।মুভি শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ যেতেই আরহামের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।যতই মুভি সামনে এগোয়,পঁচিশের টগবগে যুবকের কপালের রগ তত বেশি দৃশ্যমান হয়।মুভির মূল বিষয়বস্তু কি আরহাম জানে না।তবে তার কাছে এটা স্রেফ পরকীয়ার প্রমোশন বলে মনে হয়েছে।

গল্পের নায়ক রুস্তম একটি মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করে।সে পেশায় একজন নেভি অফিসার।তার জাহাজে থাকাকালীন অবস্থায় তারই সহধর্মিণী তার অগোচরে তার সহকর্মীর সাথে পরকীয়ার সম্পর্কে জড়ায় আর ব্যক্তিত্বহীন ছ্যাবলা রুস্তম তার বউকে ঠাটিয়ে দু’টো চ’ড় মারার জায়গায় তার সহকর্মীকেই মেরে দেয়।তারপর সে নিজের স্ত্রীকে ক্ষমা করে দিলো।বাহ! কি অসাধারণ বিচার! আরহাম শেষের সিনটুকু দেখেই দাঁতে দাঁত পিষে বলল,’আমার রিভলভার টা দে তো ওয়াজিদ।রুস্তম,তার নষ্টা বউ আর সাথে প্রোডিউসার বদমাশটাকেও গু’লি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আসি।’

“kaheen kisi bhi gali mein jaaun main
teri khushboo se Takraaun main
har raat jo aata hai mujhe
wo khwaab tu…

tera mera milna dastoor hai
tere hone se mujhme noor hai
main hoon soona sa ek aasmaan
mehtaab tu…

O karam khudaya hai
tera pyar jo paaya hai
tujhpe marke hi toh
mujhe jeena aaya hai

O tere sang yaara
khushrang bahara
tu raat deewani
main zard sitaara

O tere sang yaara
khushrang bahara
main behta musafir
tu Thehra kinara”

বেশ সময় নিয়ে পুরোটা গান শেষ হলো।আরহাম আড়চোখে একবার তার স্ত্রীকে দেখে।মেয়েটা কি বুঝল এই কথা গুলো যে সে তাকে উৎসর্গ করেছে?
সে বুঝল নাকি বোঝা গেল না।কারণ নবনীতার দৃষ্টি গাড়ির গ্লাস গলিয়ে রাস্তার দিকে নিবদ্ধ।আরহাম কপাল কুঁচকে আরো একটা গান বাজায়।

Aisa dekha nahi khoobsurat koi
Jism jaise Ajanta ki murat koi
Jism jaise nigahon pe jadoo koi
Jism nagma koi jism khushboo koi

Jism jaise mehakti hui chandni
Jism jaise machalti hui ragini
Jism jaise ke khilta hua ik chaman
Jism jaise ke suraj ki pehli kiran

Jism tarsha hua dilkasho dilnashin
Sandli sandli marmari marmari

Husan-e-jaana ki tareef mumkin nahi
Husan-e-jaana ki tareef mumkin nahi
Afreen afreen afreen afreen
Tu bhi dekhe agar toh kahe humnashin
Afreen afreen afreen afreen

Husan-e-jaana ki tareef mumkin nahi

Husan-e-jaana ki tareef mumkin nah

এই গানেরও পটভূমি আছে।রাহাত ফাতেহ আলি খানের গানের সিরিজ শুনতে গিয়ে সে এই গানটা শুনেছে।তারপরই সে কয়েকবার এই গানটা পর পর প্লে করেছে।তার ধারণা কোনো নারীর সৌন্দর্য বর্ণনার জন্য এর চেয়ে চমৎকার গান আর হতেই পারে না।পরী যে সত্যিই তার কাছে অপ্সরীর ন্যায় এই কথাটা পরীকে গানে গানে বুঝিয়ে দেওয়া যেতে পারে।

অথচ তার ভাবনায় এক বালতি পানি ফেলে নবনীতা যেভাবে ছিল সেভাবেই বসে রইল।কি আশ্চর্য! জামাই এতো সুন্দর সুন্দর গান বাজাচ্ছে,আর বেয়াদব মেয়েটা কোনো পাত্তাই দিচ্ছে না।তার খটকা লাগল।সে সঙ্গে সঙ্গে পাশ ফিরে জানতে চাইল,’এ্যাই মেয়ে! তুমি হিন্দি জানো?অথবা উর্দু?’

নবনীতা জানালা থেকে চোখ সরিয়ে পাশ ফিরে।ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দেয়,’না জানি না।’

আরহাম চটে যাওয়া মেজাজে চেঁচায়,’কেন জানো না?’

‘অদ্ভুত তো!উর্দু আর হিন্দি কি আমার মাদার ল্যাঙ্গুয়েজ নাকি ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ যে জানতেই হবে?’

আরহাম থমথমে মুখে তাকে দেখে।বোয়াদবটা হিন্দি জানে না।তাহলে সে কার জন্য এতোক্ষণ গান বাজালো?তার মন চাইছে এক্ষুনি তার গাল বরাবর একটা চড় মেরে বলতে,’বলদের বাচ্চা! প্রতিবেশী দেশের ভাষা যে জানিস না,বর্ডারে ঘুরতে গিয়ে বিএসএফ এর খপ্পরে পড়লে তখন কি করবি?কিভাবে তাদের বুঝাবি যে তুই ক্রিমিনাল না?তখন তো ঠিকই হাত নেড়ে নেড়ে বলতে হবে,’হামকো কুচ মাত কারো।হাম বেগুনাহ হ্যায়।’
সে আর কিছু বলল না।কেবল লটকানো মুখে ড্রাইভিং চালিয়ে যাচ্ছিল।

আরহামের মুঠোফোন বেজে উঠল একটু পরেই।সে ফোন তুলে কতোক্ষণ হ্যালো হ্যালো করল।নেটওয়ার্কের সমস্যা,কিছু শোনা যায় না।ওয়াজিদের ফোন।জরুরি কারণ ছাড়া ওয়াজিদ ফোন দেয় না।সে দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।পুনরায় গলা ছেড়ে বলে,’হ্যালো হ্যালো! আরে বাল তুই হ্যালো হ্যালো করছিন কেন?আমার কথা শুনিস নাকি এটা বল।’

সে গাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেই নবনীতা মুচকি হাসে।গাড়ির জানালায় হাত রেখে মাথাটা হাতের উপর রেখে সে আরহামকে দেখতে দেখতে সুর তুলে,’

Ek din aap yu hamako mil jaaege
Phul hi phul raaho me khil jaaege
Maine sochaa na thaa
Ek din zindagi itni hogi hasi
Jhumegaa aasamaa gaaegi ye zami
Maine sochaa na thaa..

***

‘শুভি আর চিত্র আমাদের সাথে যাবে মানে?’

একপ্রকার বিক্ষিপ্ত মেজাজে প্রশ্ন ছুড়ল নবনীতা।আরহাম এক লাফে শুভ্রার ঘরের খাটে উঠে দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’তারা যাবে কারণ একা একা ঘুরতে আমার ভালো রাগে না।ট্যুর একমাত্র জিনিস,যেখানে আমি মানুষ পছন্দ করি।মানুষ ছাড়া সফর জমে না।আমি চিত্র আর শুভ্রাকেও আমার সাথে নিতে চাই।আর তারা অবশ্যই আমার সাথে যাবে।

নবনীতা চোখ পাকিয়ে চওড়া গলায় বলল,’সবকিছুতে এতো গা ছাড়া ভাব ভালো লাগে না।শুভ্রার এইচএসসি পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিয়েছে।এখন সে ঘুরতে যাবে?পড়াশোনা এতো সহজ বিষয়?’

‘উহু।শুভ্রা সব পারে।সে তো আমার মতো পরীক্ষার রুটিন হাতে পেয়ে পড়তে বসা মানুষ না।সে আগেই পড়া গুছিয়ে নিয়েছে।তাই না শুভ্রা?’

আরহামের প্রশ্ন শুনেই শুভ্রা বোকা বোকা হাসল।আপাই যেভাবে চোখ দিয়েই তাকে জ্বালিয়ে দিচ্ছে,এমতাবস্থায় সে আর নিজ থেকে কিছু বলতে চায় না।পরে দেখা যাবে সব ছেড়ে আপাই তার পেছনে লাগবে।

আরহাম গম্ভীর হয়ে প্রশ্ন করল,’আচ্ছা বলো তো সাইন থেটা বাই কস থেটা সমান সমান কতো?’

শুভ্রা ঠোঁট টিপে হাসল।নিচু স্বরে বলল,’টেন থেটা।’

আরহাম নবনীতার দিকে দেখে কড়া গলায় বলল,’দেখেছ?শুভ্রা সবই পারে।আর দুইদিনে পড়ে সে কোনো বিদ্যাসাগর হয়ে যাবে না।পড়াশোনার পাশাপাশি জীবনে ভ্রমণেরও দরকার আছে।’

নবনীতা হতাশ হয়ে দু’টো দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছে আলমারির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,’এ্যাই শুভি-চিত্র! তোমরা কি কি জামা নিবে দেখে নাও তাড়াতাড়ি।’
.
.
.
.
আরহাম বহুবছর পরে মিনি বাস দিয়ে ট্যুরে যাচ্ছে।শেষ গিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে।এরপর আর যাওয়া হয়নি।অনেকবছর পর আজ আবার যাচ্ছে।সাথে দুইটা অন্য গাড়িও অবশ্য যাচ্ছে।তবে ভ্রমণের জন্য না,নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য।

আরহাম তোফায়েল আর তামজিদকেও তাদের সাথে নিয়েছে।জীবন,জীবনের ভাই রোকন,সারাহ,রিমি,ওয়াজিদ মোদ্দাকথা কেউ বাদ যায়নি।বাদ গিয়েছে শুধু পরীর আদরের বাচ্চা আরশাদ।রাঙামাটিতে এখন প্রচন্ড ঠান্ডা আবহাওয়া।নবনীতা নিজেই দোলাচালে ভুগছিলো এই নিয়ে।শেষে সে ঠিক করেছে আরশাদ এই দু’টো দিন চাইল্ড হোমেই থাকুক।আরহাম এতো করে চাইছে একটু মন মতো সময় কাটাতে,সে এখন আরশাদকে নেওয়ার কথা বললেই সে শেয়ালের মতো খ্যাক খ্যাক করে উঠবে।আর সে চায়ও না কিছু বলতে।সবকিছুতে সে অবুঝের মতোন আচরণ করতে পারে না।মাঝে মাঝে নিজেদের একান্ত সময়েরও প্রয়োজন আছে।

সবাই আনুমানিক পৌনে তিনটার দিকে আরহামদের বাড়ির গেইটের একটু সামনে এসে দাঁড়াল।তাসনুভার মন আজকে ভীষণ ভালো।কতোদিন পর তারা ঘুরতে যাচ্ছে।কি মজার ব্যাপার! আদি নিজের একটা সেলফি তুলেই ইনস্টায় পোস্ট করল।ওয়াজিদ বাঁকা চোখে একনজর তাকে দেখল।বিরক্ত হয়ে বলল,’তোর হাইব্রিড বান্ধবীকে পাঠাবি না ছবি?’

আদি হাসতে হাসতে জবাব দেয়,’নাহ,পোস্ট তো দিয়েছি।সেখান থেকেই দেখে নিবে।’

রিমির ক্যাবটা পৌঁছুলো সবচেয়ে দেরিতে।গাড়ি থামতেই সে হন্তদন্ত হয়ে নেমে এলো।নামতে গিয়েই সবার প্রথমে সে ওয়াজিদের জুতোর উপরে ভুলবশত নিজের পা রাখল।ওয়াাজিদ এক ঝাড়ায় নিজের পা তার পায়ের নিচ থেকে বের করে হনহনিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।রিমি ভীষণ লজ্জিত হলো।আদি দু’জনের অবস্থা দেখেই স্মিত হেসে রিমিকে বলল,’কোনো ব্যাপার না রিমি।এমন একটু আকটু হয়ই।’

গাড়িতে বসার সময় সবাই যার যার জায়গা মতো বসল।আরহাম নবনীতা,আরিশ তাসনুভা,শুভ্রা চিত্রা,তোফায়েল তামজিদ,জীবন রোকন।বিপত্তি বেধেছে আরেক জায়গায় গিয়ে।কথা ছিলো রিমি আর সারাহ বসবে একসাথে আর ওয়াজিদ আর আদি বসবে একসাথে।

কিন্তু গাড়িতে উঠামাত্রই আদি একপ্রকার ধাক্কাধাক্কি করে সারাহ-র পাশের সিটটায় গিয়ে বসল।ওয়াজিদ চোখ পাকিয়ে বলল,’সমস্যা কি তোর?তোর আমার পাশে বসার কথা ছিলো।’

আদি সেই কথা পাত্তা না দিয়ে সারাহ-র দিকে ফিরে বলল,’আমার তোর পাশে বসার শখ নেই।আমি এখানেই বসব।’

আরহাম পেছনে ফিরে তাকে দেখেই তিরিক্ষি মেজাজে চেঁচায়,’সমস্যা কি তোর?এতো জ্বালাস কেন সবকিছুতে?তুই এদিকে বসলে রিমি কোথায় বসবে?’

‘কেন?ওয়াজিদের সাথে।সিম্পল হিসাব।’ চটপট জবাব দেয় আদি।

ওয়াজিদ আঁতকে উঠে।কি সর্বনাশা কথা! ঐ পাগলটার সাথে সে বসবে?সে চোখ বড় বড় করে বলে,’কি?রিমি আমার সাথে বসবে?’

‘হু।এনি প্রবলেম?যা গিয়ে চুপচাপ বয়।’

ওয়াজিদ বিরক্ত হয়ে আরহাম কে ডাকল,’আরহাম! আদিকে কিছু বল।’

আরহাম পেছন না ফিরেই নাক মুখ কুঁচকে বলল,’পারব না।তোদের ঝামেলা তোরা মিটমাট কর।আমাকে টানবি না।’

ওয়াজিদ কতোক্ষণ ইতিউতি করল।শেষটায় যখন দেখল আদি তার কথায় অনড় তখন সে হতাশ হয়ে রিমিকে দেখে বলল,’যাও,ভেতরে যাও।’

‘আমি জানালার পাশে থাকব?’

‘হু।আমি জানালার সাইডে থাকলে আজ আর ঘুমাতে পারব না।সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে কখন তুমি ধাক্কা দিয়ে আমায় নিচে ফেলে দাও।তোমার তো আবার রেকর্ড ভালো।এজন্যই ভয় হয়।’

রিমি খুশি খুশি মনে উইনডো সিট দখল করে নেয়।ওয়াজিদ একটু দূরত্ব রেখে তার পাশটায় গিয়ে বসে।তাসনুভা লুচির মতোন ফুলতে ফুলতে পেছন ফিরে।সারাহ কানে হেডফোন গুজে গান শুনছে।আদি তাকে দেখতেই সে চটে গিয়ে বলল,’এতোই মেয়ে মানুষের সাথে বসার হলে রিমি আপুর সাথে গিয়ে বসতে,আমার সাথে এসে বসতে।ঐ চুন্নিটার পাশেই কেন বসতে হবে তোমার?’

আদি চোখ টিপে হিশহিশ করে বলল,’আরে তুমি বুঝবে না।আমি আরেকটা বিয়ের ফুল ফোটানোর পরিকল্পনা করছি।সেজন্য এটা করা লাগতো।’

‘সাংঘাতিক! তুমি সারাহ কে বিয়ে করবে?’

‘ধ্যাত! পাগল নাকি? তুমি এতো কথা বলো না তো বাচ্চা।শুধু ঘাড় বাঁকা করে বাম পাশের মানুষদের কাজকর্ম দেখো।’

বাস ছেড়েছে বেশ কিছুক্ষণ হয়েছে।রিমি শুরুতে খুবই বকবক করল।তার বকবকে ওয়াজিদের কান ধরে যাচ্ছিল।হঠাৎই সে কেমন চুপচাপ হয়ে গেল।ওয়াজিদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।যাক,এখন একটু ঘুমানো যাবে শান্তিতে।

আধঘন্টা পর যখন ওয়াজিদের চোখ একেবারে লেগেই আসছিল,তখন পাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠটি রিনরিনে স্বরে তাকে ডাকল,’ওয়াজিদ ভাইয়া!’

ওয়াজিদ ঘুমের ঘোরে বলল,’হু?’

‘আমার ভীষণ বমি পাচ্ছে ভাইয়া।’

সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে ওয়াজিদ।আঁতকে উঠে পাশ ফিরে বলে,’কি?কি পাচ্ছে তোমার?’

রিমি কাচুমাচু মুখে উত্তর দেয়,’বমি।বন্ধ গাড়িতে বেশিক্ষণ থাকলে আমার বমি পায়।অন্য সময় এক দুই ঘন্টা পরে বমি পেত,আজ বেশি আগে আগে পাচ্ছে।’

ওয়াজিদ ধড়ফড়িয়ে উঠে দাঁড়ায়।আতঙ্কিত কন্ঠে চেঁচায়,’আরহাম! সে নাকি বমি করবে!’

আরহাম গাড়ি ছাড়তেই ঘুমে তলিয়ে গেছে।নবনীতা ওয়াজিদের কন্ঠ শুনেই উঠে দাঁড়ায়।উদগ্রীব হয়ে জানতে চায়,’আয়হায়! বেশি খারাপ লাগছে?’

ওয়াজিদ অপ্রস্তুত হয়ে ডানে বায়ে দেখে বলল,’না না।তুমি বসো।আমি দেখছি।’

বাস ড্রাইভার বরকত উদ্দীন কোনোরকমে একটা পলিথিনের জোগাড় করল।ওয়াজিদ সেটা হাতে নিয়েই মুখ খিঁচে বলল,’নেও বমি করো।’

‘এখন আসছে না।’

‘তো কখন আসবে?’ ভীষণ অধৈর্য শোনায় যুবকের কন্ঠ।

‘আমি জানি না।’

‘আচ্ছা জানতে হবে না।আমি ধরেছি।বমি আসলে আমাকে একটা ধাক্কা দিও।তাহলেই হবে।’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে