#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৪৩)
[শরীর ভালো না খুব একটা,একটু পরে রিচেক দিয়ে দিব,আপাতত কষ্ট করে পড়ুন]
ঝলমলে সুন্দর প্রভাত।সূয্যিমামা উঁকি দিয়েছে আরো অনেক আগে।সোনালি রোদের আভা পর্দা ভেদ করে সুন্দর পরিপাটি ঘরটার ভেতরে এসে পড়ছিল।হাতের কাছের মুঠোফোনে আগে থেকেই এলার্ম সেট করা ছিল।নির্ধারিত সময় হতেই সেটা যান্ত্রিক শব্দ তুলে কয়েকদফা বাজলো।মুঠোফোনের মালিক বিরক্তিতে মুখ খিঁচে কোনোরকমে হাতড়ে হাতড়ে সেটা বন্ধ করল।তারপরই একহাত পাশে রেখে অনুমানে কাউকে খুঁজল।যখনই সে টের পেল মস্ত বড় খাটটায় সে বাদে আর কেউ নেই তখন আস্তে আস্তে সে চোখ খুলল।
চোখ খুলেই সবার আগে ফোন হাতে নিয়ে সময় দেখে।তারপরই ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে।নয়টা চুয়াল্লিশ বাজে।এতোক্ষণ ঘুমিয়েছে সে! ধুর এতোক্ষণ কোথায়?ঘুমালোই তো ভোরের একটু আগে।সে গলার স্বর চওড়া করে ডাকে,’পরী! এ্যাই পরী!’
ঘরের বাইরে দেখেই চঞ্চল গলায় উত্তর আসে,’এই তো এদিকে।’
‘কোথায়?ভেতরে এসো।’
নবনীতা বড় বড় পায়ে ভেতরে আসে।তার পরনে গাঢ় সবুজ তাঁতের শাড়ি।আঁচলটা মনে করে কোমরে গুজে রাখা হয়েছে।আরহাম তাকে দেখে শুরুতে হাসল।পরমুহূর্তেই আবার মুখ কুঁচকালো।সেই রকম মুখ করেই বলল,’সারাক্ষণ আসাদের বাচ্চাকে সাথে সাথে নিয়ে ঘুরতে হয়?’
নবনীতা আরশাদকে কাউচের উপর রাখল।সাথে সাথে দিরুক্তি করে বলল,’উহু।বলুন পরীর বাচ্চা।’
বলেই সে আরশাদের দিকে তাকায়।মিষ্টি হেসে বলে,’তাই না রে বাবা?তুমি একটা পরীর বাচ্চা না?’
আরশাদ ছোট ছোট চোখে তার দিকে তাকায়।আরহাম আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে দায়সারাভাবে বলল,’পাক্কা গৃহিণীদের মতো দেখাচ্ছে তোমায়।’
নবনীতা ফিক করে হেসে দিলো।মাথা নেড়ে জানাল,’আমি পাক্কা গৃহিণীই।’
আরহাম আরো একবার মোবাইল ফোনে সময় দেখে।তাড়াহুড়ো করে ওয়াশরুমের দিকে ছুটতে ছুটতে বলে,’ফুফুকে বলো তো খাবার দিতে।কাজ আছে আমার।বের হতে হবে।’
বলেই সে বড় বড় কদমে ওয়াশরুমে যায়।ঝটপট গোসল সেরে একটা ট্রাউজার পরে উদাম শরীরটার উপর কাঁধের দুই পাশে তোয়ালে ফেলে বেরিয়ে আসে।আলমারি খুলতেই টি শার্ট আর ফর্মাল শার্ট গুলো অসহায় চোখে তার দিকে তাকায়।সে লটকানো মুখে সাদা রঙের পাঞ্জাবি টা হাতে নেয়।আফসোস করে বলে,’এই এক ইউনিফর্ম পরতে আর ভালো লাগে না।’
___
তাসনুভা আর আরিশ একটু আগেই খেতে বসেছে।আদি বেরিয়েছে আটটার দিকে।তার কোন আত্মীয় নাকি অসুস্থ।সে তাকে দেখতে বনানীর একটা হাসপাতালে গিয়েছে।
নবনীতা ডায়নিং-এ এসেই একনজর তাসনুভাকে দেখল।তার ফোলা ফোলা চোখ মুখ দেখেই তার মায়া হলো।আহারে! মেয়েটা নিশ্চয়ই কেঁদেছে রাতভর।
তাসনুভা আনমনে চামচ দিয়ে প্লেটে শব্দ করে।তার মনে অভিমানের পাহাড় জমেছে।কাল সে যখন নিজে নিজে ঘুরাঘুরি করছিল,তখন একটা মহিলা তাকে টেনে নিয়ে গেল এক কোণায়।সে মুখের সামনে থেকে শাড়ির আঁচল সরাতেই দেখতে পেল মহিলাটা আর কেউ না,তার মা।
“মা” এই শব্দটা তাসনুভার কাছে কতোখানি মূল্যবান সেটা কি বড় ভাইয়া জানে?তাসনুভা সবসময় বইয়ে পড়েছে,মায়েরা বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে।মায়েদের মতো আপন কেউ হয় না।তাসনুভারও তো একটা মা আছে।তারও তো সেই মায়ের আদর খেতে ইচ্ছে হয়।কিন্তু বড় ভাইয়া সেটা হতে দেয় না।তাসনুভা আর আরিশের ধাঁরও ঘেঁষতে পারে না মা।ভাইয়ার ভীষণ রাগ মায়ের উপর।তাই বলে তাসনুভা একটুখানি মায়ের আদর গায়ে মাখতে পারবে না?
নবনীতা একটা পরোটা তার প্লেটে তুলে দিলো।নরম গলায় বলল,’খাওয়া শুরু করো তাসনুভা।মন খারাপ করে লাভ নেই।এক দুই দিন যাক।সব ঠিক হয়ে যাবে।’
তাসনুভা মাথা তুলে।মন খারাপ করে বলে,’ভাইয়া কালকে আমাকে বলেছে মায়ের নাম মুখে আনলে নাকি এক চড় মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।এটা কি ঠিক হয়েছে?তুমি দেখেছো কাল সে রাগের মাথায় আমাকে চড় মারতে এসেছিল?আমার মনে হয় ভাইয়ার এখনো একটা সাইকিয়াট্রিস্টের প্রয়োজন।’
নবনীতা একটা ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে আরিশের প্লেটে খাবার তুলে দিলো।সারাহ মাত্র চেয়ার টেনে টেবিলে এসে বসেছে।ঘুমে তার চোখ দু’টো ভেঙে যাচ্ছে।সে হাই তুলতে তুলতে নিজেই নিজের প্লেটে খাবার নেয়।
নবনীতা একটা চেয়ার ঘেঁষে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।তাসনুভার দিক থেকে বিষয়টা একরকম।সে কিছুটা আঁচ করতে পারছে।তাদের মা যখন চলে যায়,তখন আরহামের ম্যাচুরিটি ছিল একরকম।আর তাসনুভা ছিল মাত্র দুই বছরের।তার দিক থেকে তার মায়ের কদাকার রূপটা অনুধাবন করা কিছুটা কষ্টসাধ্য।কারণ সে আরহামের মতো নিজ চোখে মায়ের অন্যায় গুলো দেখেনি।এই বিষয়টাই নবনীতা বার বার আরহামকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়।আরহাম এই সোজাসাপ্টা বিষয়টা কেন যেন মানতেই পারে না।কাল সে বাগানে দাঁড়িয়ে গজরাতে গজরাতে বলেছে তাসনুভা যদি ঐ নাম মুখে আনে তাহলে সে তাসনুভাকে সহ ধাক্কা মেরে বাড়ি থেকে বের করে দিবে।এটা কোনো কথা হলো?যেই ভাই বোন দু’টো কে সে এতো বছর যত্ন আর ভালোবাসায় আগলে রেখেছে,ক্ষণিকের রাগের বশে সে তাদেরই এমন কথা বলে দিলো?
একজন মানুষের রাগের আড়ালে মাঝে মাঝে তার অভিমান,তার যন্ত্রণা মিশে থাকে।আরহামের রাগ,তার দুর্ব্যবহার সবকিছুর আড়ালে তার চাপা আর্তনাদ মিশেছিল।যেই আর্তনাদ নবনীতা শুনতে পেয়েছে।সেই আর্তনাদ শোনার জন্য ম্যাচুরিটির প্রয়োজন।অথচ তাসনুভার সেই ম্যাচুরিটি আসেনি।এই কথা আরহাম কবে বুঝবে?
আরহাম পাঞ্জাবির বোতাম লাগাতে লাগাতে ধুপধাপ করে নিচে নামল।এসেই তড়িঘড়ি করে চেয়ার টেনে টেবিলে বসল।ভেজা চুলগুলো এক হাতে ঝাড়তে ঝাড়তে তাসনুভাকে দেখে বলল,’তাস ভাইয়াকে একটা প্লেট দে তো।’
বলার পরেই তার মনে পড়ল কাল রাতে তাসনুভার সাথে তার বাকবিতণ্ডা হয়েছে।আর এক পর্যায়ে সে বলেছে তাসনুভা যেন তাকে আর কখনোই ভাই না ডাকে।অথচ সকালে তাড়াহুড়োয় সে সেই কথা দিব্যি ভুলে গেছে।সে বিরক্তি হলো ভীষণ।নিজেকে মনে মনে একটা অশ্রাব্য গালি দিলো।
তাসনুভা চুপচাপ একটা প্লেট এগিয়ে দেয়।আরহাম গোমড়ামুখে সেটা হাতে নেয়।আড়চোখে একবার তাসনুভার মতিগতি দেখে।প্লেট দিয়েই সে পুনরায় খাওয়াতে মনোনিবেশ করেছে।আরহামের মন চাচ্ছে ঠাস ঠাস তাকে দু’টো চড় দিতে।এইটুকু মেয়ের এতো রাগ কিসের?সে কাকে ভাব দেখায়?আরহামকে?
সে তাচ্ছিল্য করে হাসল।সে কি কম ভাব দেখাতে জানে নাকি?সে একমনে পরোটা ছেড়ে মুখে দেয়।আয়েশ করে পুরোটা খায়।মাঝে একবার চোখ তুলে তাসনুভার লাল লাল হয়ে থাকা মুখটা দেখে।হঠাৎই তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো।তাসনুভার সাথে কথা না বলেই তাসনুভাকে জ্বালাতন করার একটা দারুণ বুদ্ধি তার মাথায় এসেছে।
সে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে আরিশকে জিজ্ঞেস করল,’আরিশ!আজকে ভার্সিটি আছে ভাইয়া?’
অত্যাধিক কোমল কন্ঠ।আরিশ তব্দা খেল।সামনে দেখে বলল,’জ্বী ভাইয়া।আছে।’
‘ওহ।কখন বের হবে?’
‘এই তো খেয়েই বের হবো।’
‘চলো আজ ভাইয়া তোমাকে ড্রপ করে দিব।এই কয়েক মাস তোমার সাথে একবারো ঠিক মতো কথা হয়নি।আমার যে একটা ভাইও আছে ভুলেই গিয়েছিলাম।’
নবনীতা তীর্যক চাহনিতে তাকে দেখল।কথা তো নয়,যেন মুখ থেকে মধু গড়িয়ে পড়ছে।তাসনুভা মুখ ফুলিয়ে সামনে দেখে।আরিশ ভাইয়ার সাথে এতো আদর দেখাচ্ছে কেন বড় ভাইয়া?এতো ভার্সিটিতে ড্রপ করার কি আছে?সে কি কচি খোকা?
আরহাম তার সেই আধার করে রাখা মুখটা দেখেই চওড়া হাসে।তীর একদম জায়গা মতো চুঁবেছে।বেয়াদব টা এখন বুঝুক ভাই মুখ সরিয়ে নিলে কেমন লাগে।সে উঠে গিয়ে আরিশের মাথায় হাত বুলায়।আদরে কন্ঠে বলে উঠে,’এসো এসো।ভাইয়া তোমাকে ড্রপ করে দিব।তুমি হচ্ছো আমার কলিজার ভাই।যত যাই হোক,কখনো ভাইয়ার মুখে মুখে তর্ক করো না।’
শেষ কথাটা সে ইচ্ছাকৃতভাবে টেনে টেনে বলল।আগুন যখন ধরিয়েই দিয়েছে,একটু ঘি ঢেলে দিলে মন্দ হয় না।তাসনুভা মুখ ফুলিয়ে কতোক্ষণ ফুসলো।শেষে যে ঠেসটা তাকেই দিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।দুই ভাই ভালোবাসায় গদো গদো হয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।তারা বেরিয়ে যেতেই তাসনুভা মুখ তুলে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’দেখেছ ভাবি?ইচ্ছে করে আমাকে ঠেস মারার জন্য এসব বলেছে।’
নবনীতার এদের কান্ড দেখেই হাসি পেল।এরা কি বাচ্চা নাকি?কি অদ্ভুত রাগ প্রকাশের ভঙ্গি এদের! সে এর মাঝে কি মতামত দিবে?তার তো কেবল হাসি পাচ্ছে।সে মুখ চেপে হাসল।সহজ গলায় বলল,’বাদ দেও তাসনুভা।দুই দিনেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
.
.
.
.
নূর আহমেদের বুদ্ধিমতী কন্যা নবনীতা নূর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে একজন আদর্শ ঘরনি হবে।যেহেতু এই এক-দেড় বছর সে কোনো চাকরি করছে না,তাই এই পুরোটা সময় সে চুটিয়ে সংসার করবে।রান্না যদিও সে পারে না।রিমি বলেছে সে নাকি জঘন্য রাঁধে।একশব্দে যাকে বলে অখাদ্য।কিন্তু নবনীতা হাল ছাড়ছে না।সে ভেবেছে এখন থেকে সে টুকটাক রান্না শিখবে।
আরহাম আর আরিশ চলে যেতেই সে প্রথমে শুভ্রার নম্বরে ফোন দিলো।তারা কাল রাতেই সাদেক সাহেব আর মিসেস রোকেয়ার সাথে চলে গেছে।শুভ্রা বলছিল আজ নাকি সে কলেজ যাবে না।তাই এই সময়ে ফোন দিতে কোনো সমস্যা নেই।ফোন ধরার পরেই সে প্রশ্নের ঝুলি খুলে বসল।এটা সেটা অসংখ্য বিষয়ে কথা বলার পর সে কুচি সামলে রান্নাঘরে গেল।আরশাদ এখন তাসনুভার সাথে খেলা করছে।নবনীতা এই মুহূর্তে পুরাই অবসর।
রান্নায় সে আনাড়ি হলেও দু’টো জিনিস সে ভালোই বানাতে পারে।এক.পুডিং দুই.ফালুদা।আরহাম ফালুদা খুব পছন্দ করে।সে ভেবে নিয়েছে আজকে সন্ধ্যায় সে ফালুদা বানাবে।
সে রান্নাঘরে পা রাখতেই আফরোজা বেগমের সাথে তার চোখাচোখি হলো।আফরোজা বেগম দ্রুত অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নিলেন।তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে তিনি নবনীতার উপর কিছুটা বিরক্ত।নবনীতা সেসব পাত্তা না দিয়ে এগিয়ে গেল কেবিনেটের দিকে।
রহিমা একমনে পেয়াজ কুচি কুচি করে যাচ্ছে।নবনীতা তাকে ডেকে জানতে চাইল,’খালা বাসায় কি সাগুদানা আছে?’
রহিমা জবাব দেওয়ার আগেই আফরোজা বেগম বলে উঠলেন,’কেন?সাগুদানা দিয়ে তোমার কি কাজ?’
নবনীতা সামনে তাকায়।স্বাভাবিক গলায় বলে,’ফালুদা বানাবো আমি।’
‘এই ভর দুপুরে ফালুদা?’ কিছুটা বিদ্রুপ মেশানো গলায় জানতে চাইলেন আফরোজা বেগম।
নবনীতা কটমট চোখে তার দিকে দেখে।থমথমে মুখে বলে,’এখন বানিয়ে ফ্রিজে রেখে দিব।কয়েক ঘন্টা ঠান্ডা হলে খেতে বেশি ভালো লাগে।’
রহিমা হাতে থাকা পেয়াজটা কেটেই উঠে গিয়ে নবনীতাকে সাগুদানা দিতে উদ্যত হয়।আফরোজা বেগম কর্কশ গলায় বললেন,’রহিমা! তুই কাজ ফেলে উঠে যাচ্ছিস কেন?সবগুলো পেয়াজ আগে কাট।’
নবনীতা সরু চোখে আফরোজা বেগমের মুখখানা অবলোকন করে।তারপরই বুকে হাত বেঁধে কড়া গলায় বলে,’আমি একটা জিনিস চেয়েছি আন্টি।এক মিনিট সময় নষ্ট করে সেটা দিলে খুব বেশি ক্ষতি হয়ে যাবে না।রহিমা খালা,প্লিজ আমাকে সাগুদানাটা বের করে দাও।’
আফরোজা বেগম বিক্ষিপ্ত মেজাজে নিজের কাজে মন দিলেন।কি ত্যাদড় মেয়ে রে বাপ! নিজের টাই আগে করিয়ে নিবে।গুরুজন বলে যে আফরোজা কে মান্য করবে,সেরকম কোনো লক্ষ্মণই তার মাঝে নেই।অথচ তিনি ভেবেছিলেন আরহাম বিয়ে করলে কোনো মিঁও মিঁও করা মেয়েকেই বিয়ে করবে।
নবনীতা সাগুদানার প্যাকেটটা হাতে নিয়েই দ্রুত ফ্রিজ থেকে দুধের বোতল বের করল।চুলার কাছে এসে একটা পাতিলে করে দুধ জ্বাল করতে নিলেই আরেকটা বিপত্তি বাঁধলো।রান্নাঘরে মোট চারটা স্টোভ।তিনটাতে আফরোজা বেগম রান্না করছিলেন।নবনীতা দুধ জ্বাল করার জন্য চুলার কাছে আসতেই তিনি আরো একটা পাতিলে পানি আর আলু নিয়ে সেটা চতুর্থ স্টোভের উপর বসালেন।
নবনীতা তাজ্জব হয়ে তার কাজ দেখল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’এখন এটা কেন বসালেন?আমি দুধ জ্বাল করব কিসে?’
আফরোজা বেগম গমগমে গলায় জবাব দেন,’বিকেলে আমি আলু পুরি বানাবো।তাই আলু সিদ্ধ করতে হবে।’
নবনীতা চোখ পাকিয়ে তাকে দেখে।রাগে তার পুরো শরীর রি রি করছে।এই মহিলা যে ইচ্ছে করে এমন করছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।কিন্তু কেন করছে?নবনীতা তো তার কোনো ক্ষতি করেনি।এমনকি আজই প্রথম তারা এতো কাছ থেকে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে।
সে কতোক্ষণ চুপ থেকে বড় বড় কয়েকটা শ্বাস নিল।থম মেরে কিছুক্ষণ চারপাশ দেখল।তারপরই সোজা লুছনি এনে আলু সেদ্ধর পাতিলটা চুলা থেকে নামিয়ে একপাশে সরিয়ে রাখল।
আফরোজা বেগম চমকে উঠে চেঁচালেন,’এটা তুমি কি করলে?’
নবনীতা দুধের পাতিলটা চুলায় বসাতে বসাতে দায়সারা হয়ে জবাব দেয়,’আপনার পাতিল নামিয়ে আমার পাতিল রেখেছি।’
‘কেন?’
‘কারণ আমাকে ফালুদা বানানোর পর কয়েক ঘন্টা সেটাকে ফ্রিজে রাখতে হবে।তাই আমার কাজ আগে শেষ হওয়া প্রয়োজন।আপনার তো আর আলু সিদ্ধ করে সেটাকে ফ্রিজে রাখতে হবে না।’
খুবই ঝটপট মুখের উপর জবাব।বলতে গিয়ে মেয়েটা একটুও অপ্রস্তুত বোধ করল না,একটুও দ্বিধায় পড়ল না।দ্বিধায় পড়ার কি আছে?এই মহিলা যে ইচ্ছাকৃতভাবে তার কাজে বাগড়া দিচ্ছে সে এটা আরো আগেই বুঝে গেছে।সুতরাং একে মান্য করার কোনো মানে নাই।সবার সাথে এতো আন্তরিকতা সে দেখাতে পারে না।
সে কোনোকিছুতে ভ্রুক্ষেপ না করে নিজের কাজে মন দেয়।আজ সে সবার জন্য ফালুদা বানাবে।বিকেলে সবাই একসাথে বসে সেটা খাবে।সে কাজের ফাঁকেই রহিমা খালাকে ডাক দিয়ে বলল,’খালা রোকন কে বলো তো দুইটা বক্স আইসক্রিম এনে রাখতে।ফালুদার উপর দিব।’
সে কাজ শেষ করতে করতে বেলা গড়ালো।মাঝটায় একবার সে দুপুরের খাবার খেয়েছে আর যোহরের নামাজ পড়েছে।সব কাজ শেষ করে রান্নাঘর ছাড়তে তার সাড়ে তিনটা বাজল।
আরহাম ফিরল বিকেল পাঁচটার দিকে।ফিরেই সে গলা ছেড়ে ডাকল,’পরী! এ্যাই পরী! তাড়াতাড়ি নিচে এসো তো।’
নবনীতা এক ডাকেই চঞ্চল চপলা পায়ে নিচে নেমে এলো।এসেই হাসি মুখে বলল,’আমি ভেবেছি আরেকটু পরে আসবেন।’
আরহাম ক্লান্ত হাসে।চেয়ার টেনে টেবিলে বসে গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে,’কাজ শেষ।তাই চলে এলাম।’
সে ফুচকার প্যাকেট টা তার দিকে এগিয়ে দিলো।ব্যস্ত গলায় বলল,’নেও ধরো।তোমার ফুচকা।আসার সময় চোখে পড়ল,ভাবলাম নিয়ে নেই।অনেক গুলো এনেছি।আমার বেয়াদব বোনটাকেও একটু দিও।’
নবনীতা প্রশস্ত হাসল।প্যাকেট টা টেবিলে রেখে রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,’দাঁড়ান সবাইকে ডেকে দিচ্ছি।’
বিকেলে সবাই হই হই করে ডায়নিং-এ খেতে বসল।আজকের ডাইনিংয়ের মেইন ডিশ নবনীতার বানানো ফালুদা।আরিশ ফালুদা টা দেখেই বলল,’খুব সুন্দর দেখাচ্ছে ভাবি।খেতেও মজাই হবে মনে হচ্ছে।’
সে হাসিমুখে সবাইকে যার যার প্লেটে খাবার বেড়ে দেয়।সবার প্রথমে ফালুদা মুখে দিলো আরহাম।দিয়েই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।চোখ বড় বড় করেই সে নবনীতার দিকে তাকায়।এটা কি ছিল?সে এখন কি করবে?গিলবে নাকি ফেলবে?
একে একে সবাই ফালুদা মুখে নিতেই গোল গোল চোখ করে তার দিকে তাকালো।মুহূর্তেই নবনীতার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।সে ভয়াতুর কন্ঠে বলল,’কি হয়েছে তোমাদের?সবাই এমন করে দেখছ কেন আমায়?’
সবার আগে অ্যাকশনে গেল আরহাম।ওয়াক করে পুরোটা ফালুদা মুখ থেকে বের করে সে পাশের প্লেটো ফেলল।তার পক্ষে এই অখাদ্য গেলা সম্ভব না।যতই সে বউকে কষ্ট দিতে না চাক,এই খাবার খাওয়া হচ্ছে নিজের উপর নিজে অত্যাচার করা।তার দেখাদেখি বাকিরাও সাহস করল।নবনীতা ব্যথিত চোখে তাদের দেখেই নিজেও এক চামচ মুখে নিল।মুখে নিয়েই সে সেকেন্ডের মাথায় সেটাকে উগলে দিলো।মুখে হাত চেপে বলল,’ইসসস ছি! এতো লবন কেন?’
তাসনুভা কাচুমাচু হয়ে বলল,’থাক ভাবি।মন খারাপ করো না।তুমি হয়তো আইসিং সুগারের জায়গায় ভুলে লবন দিয়ে দিয়েছো।’
নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’অসম্ভব।এটা হতেই পারে না।’
সবার মুখ দেখে তার মনে হলো কেউ ঠিকমতো তার কথা বিশ্বাস করছে না।সে চোখ ঘুরিয়ে একবার আফরোজা বেগমকে দেখে যে কি না ঠোঁট চেপে হাসি থামাতে ব্যস্ত।
নবনীতা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’আমি এক্ষুণি প্রমাণ করে দিতে পারব এই কাজ আমার না।’
বলেই সে ছুটল রান্নাঘরের দিকে।আফরোজা বেগম হকচকিয়ে উঠেন।কি সর্বনাশা কথা! প্রমাণ করবে মানে?নবনীতা ফিরে এলো মিনিটের মাথায়।এসেই তার একহাতের মুঠোয় চেপে রাখা ডিভাইসটা সবার সামনে তুলে ধরল।হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’এটাই প্রমাণ করবে যে আমি আইসিং সুগার দিয়েছি না লবন দিয়েছি।’
***
মিনি স্পাই ক্যামেরা।আকারে অতিক্ষুদ্র একটি ডিভাইস।যেটা কিনা খালি চোখে দেখাই যায় না।এই ডিভাইজটা গত কয়েক ঘন্টা করে রান্নাঘরের তাকের ফাঁকে সেট করা ছিল।নবনীতা ল্যাপটপে সেই ডিভাইসের ফুটেজ বের করল।যেখানে পুরোপুরি স্পষ্ট দেখা না গেলেও বেশ ভালোভাবেই বোঝা যাচ্ছে সে ফালুদা বানিয়ে রান্নাঘরে থেকে বেরোনোর পর আফরোজা বেগম তার খাবারে কিছু একটা মিশিয়েছেন।নবনীতা পর পর কয়েকবার ভিডিওটা চালায়।পেছন ফিরে সবাইকে দেখে জোর গলায় বলে,’দেখেছ?আমি তো বলেছি যে আমি এতো বড় ভুল করতেই পারি না।’
আফরোজা বেগমের মনে হলো মস্ত বড়ো আকাশের পুরোটাই তার মাথায় ভেঙে পড়েছে।এই মেয়ে আগে থেকে কেমন করে বুঝে গেল যে তার অনুপস্থিতিতে এমন কিছু হবে?নবনীতা উঠে দাঁড়ায়।আফরোজা বেগমের সামনে দাঁড়িয়েই বুকে হাত বেঁধে চোয়াল শক্ত করে বলে,’সিরিয়াল শুধু আপনি একা দেখেন না।আমিও দেখি।বুঝেছেন?এরপর থেকে আমার পেছনে লাগবেন না বলে দিলাম।’
তাসনুভা আর আরিশ ইয়া বড় চোখ করে তাকে দেখে।আরিশ হতবাক হয়ে বলে,’মাই গড! একে যে তোফায়েল ভাইয়া লেডি ডন ডাকে,একদম ঠিকই ডাকে।’
আদি মাথা দুলিয়ে হাসে।মুখে একহাত চেপে অস্ফুটস্বরে বলে,’ফুফু শকস,নবনীতা রকস।’
আরহাম কতোক্ষণ কাশলো।কি একটা অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়েছে সে।পরী যে মাঝে মাঝে কি করে! এখন সে এখানে কিই বা বলতে পারে?নবনীতা নিজেই তো তার আচ্ছা মতোন ডিটারজেন্ট ছাড়া ধোলাই করে দিয়েছে।আরহাম মাথা নামিয়েই বিড়বিড় করে,’ডেঞ্জারেস মেয়ে মানুষ!’
নবনীতা পেছন ফিরে।সবাই কে দেখে একগাল হেসে বলে,’মন খারাপের কিছু নেই।আমি বড় একটা বাটিতে অর্ধেক ফালুদা আগেই সরিয়ে রেখেছি।আমার রুমে আছে।এক্ষুণি নিয়ে আসছি।’
সে ঝড়ের বেগে তার ঘরে গেল।ফিরলোও ঝড়ের বেগে।এসেই নিজের হাতে বাটিটা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল,’এবার খেয়ে বলো তো কেমন হয়েছে?’
****
আরিশ এক চামচ ফালুদা মুখে দিয়েই প্রসন্ন হেসে বলল,’জিও ভাবি! খুব মজা হয়েছে।’
তাসনুভা নবনীতার ডান হাতে চুমু খেয়ে খুশিতে গদো গদো হয়ে বলল,’একেবারে তোমার মতো মিষ্টি হয়েছে ভাবি।’
নবনীতা জবাবে কেবল মুচকি হাসল।অন্য একটা বাটিতে একটু ফালুদা,জেলি আর আইসক্রিম দিয়ে সেটা আরহামের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে নিজে তার পাশাপাশি চেয়ারে গিয়ে বসল।আরহাম একটু মুখে দিয়েই পাশ ফিরে বলল,’অনেস্ট স্পিকিং,খুব ভালো হয়েছে পরী।’
নবনীতা মাথা নামিয়ে সেই প্রশংসা লুফে নেয়।আরহাম একটু ঝুঁকে ফিশফিশ করে বলল,’পরী ম্যাডাম! একটু শুনুন তো।’
নবনীতাও মাথা নামিয়ে তারই মতোন হিশহিশিয়ে জানতে চায়,’কি স্যার?’
আরহাম ভয় পাওয়ার ভান ধরে বলল,’ম্যাডাম আপনি যে সারাক্ষণ স্পাই ক্যামেরা সাথে নিয়ে ঘুরেন,আমার বেডরুমেও কি কয়েকটা ফিট করে রেখেছেন নাকি?’
নবনীতা মাথা নিচু করে মুচকি হাসল।উপরনিচ মাথা ঝাকিয়ে গর্ব করে বলল,’একদম তাই।বেশি তেড়িবেড়ি করলে আপনি যে একটা ভন্ড নেতা,সেই সত্য সবার সামনে উন্মোচন করে দিব।’
চলবে-