#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৪২)
কার্তিকের রজনী।রাত বাড়তেই হেমন্তের ঠান্ডা আর হৃদয় জুড়ানো বাতাস বইতে শুরু করেছে।আচ্ছা,বসন্তকে কেন ঋতুরাজ বলা হয়?সবচেয়ে সুন্দর ঋতু তো হেমন্ত।না আছে কাঠফাটা রোদ,না আছে শরীর হিম করা অতিশীতল শৈত্য প্রবাহ।কেবল মন প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা পবন,আর সেই সাথে স্বচ্ছ একখানা আকাশ।এতো চমৎকার একটা ঋতু কেমন করে ঋতুরাজ হওয়ার দৌড় থেকে বাদ পড়ল?বড়ই ভাবনার বিষয়।
রাত তখন কয়টা সেই খবর কারো নেই।ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা যুবকটা একটা সিগারেট শেষ করেই পুনরায় দ্বিতীয় সিগারেট হাতে নেয়।তপ্ত নিশ্বাস আর অদৃশ্য অনলে তার ভেতর জ্ব’লে পু’ড়ে ছাড়’খার হয়ে যাচ্ছে।সে সামনে দেখে।দূর থেকে অজানা কোনো পাখির ডাক ভায়োলিনের সুরের মতো ভেসে ভেসে আসে।আচ্ছা ভায়োলিনের সুর কিসের প্রতীক?বিষাদের?নাকি বিরহের?
নবনীতা শম্বুক গতিতে হেঁটে ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ায়।একটু আগেই একটা বিশাল ঘটনা ঘটে গেছে।সে মাথা নামিয়ে তার দুই হাত দেখে।হাত দু’টো এখনো কাঁপছে তার।
তারা সবাই খাওয়া শেষে যে যার মতো হাঁটছিল।হঠাৎ আরহামের খেয়াল হলো আশেপাশে কোথাও তাসনুভা নেই।স্বাভাবিকভাবেই তার উদগ্রীব আর সন্দেহপ্রবন মন এই বিষয় টা স্বাভাবিক ভাবে নিল না।সে ব্যস্ত হলো তাসনুভাকে খোঁজা নিয়ে।খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে সে দেখতে পায় তাসনুভা ইয়ার্ডের এক মাথায় দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে।সেই মানুষটা তাসনুভান গাল ছুঁয়ে,হাত ধরে তাকে আদর দিচ্ছে।
এই পর্যন্ত সব ঠিকই ছিল।কিন্তু এরপরের ঘটনা গুলো ঘটল খুব দ্রুত।আরহাম সেই মানুষটার মুখ দেখতেই উন্মাদের মতো ছুটে গেল তার দিকে।তার পেছন পেছন আদি আর ওয়াজিদও ছুটল।আরহাম বিনা কিছু ভেবে তার কোমরে গুজে রাখা রিভলবার টা তাক করল মানুষটার কপাল বরাবর।গর্জে উঠে বলল,’তোমার সাহস কি করে হয় আমার বাবার বাসায় ঢুকে আমার বোনকে ছোঁয়ার?’
ইয়ার্ডের দিকে হট্টগোল কানে যেতেই নবনীতা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসে।সামনের দৃশ্য একবার দেখতেই তার চোখ কপালে উঠে।কি সর্বনাশ অবস্থা! আরহাম রিভলবার তাক করেছে,তাও একটা মাঝবয়সী মহিলার দিকে।আদি আর ওয়াজিদ গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে চেঁচায়,’সর আরহাম! মাথা খারাপ তোর?ঘরে যা।প্লিজ ঘরে যা।’
আরহাম তার চেয়েও দ্বিগুণ জোরে চেঁচায়,’যাব না।এর সাহস কি করে হয় আমার বাবার বাড়িতে পা রাখার?একে মেরে এর চ্যাপ্টার ক্লোজ করে এরপরই আমি যাব বাল।’
ওয়াজিদ তাকে টানতে টানতেই বিরক্ত গলায় বলল,’তোর পাগলামির কি কোনো শেষ নেই আরহাম?দয়া করে বিষয়টা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যাওয়ার আগেই ভেতরে যা।’
সে সেসব তোয়াক্কা করে না।পুনরায় ছুটে যায় সামনের দিকে।দাঁতে দাঁত পিষে বলে,’আমাকে উগ্র হতে বাধ্য করবে না।বের হও আমার বাড়ি থেকে।’
নবনীতা ছুটে গেল।চোখ বড় বড় করে কড়া স্বরে বলল,’এসব কি হচ্ছে আরহাম?এভাবে কেউ কারো সাথে কথা বলে?’
‘এ্যাই মেয়ে! তুমি আমাকে জ্ঞান দিবে না বলে দিলাম।পাত্তা দেই বলে সবকিছুতে মতামত দিতে আসবে না।অসহ্য লাগে আমার।’
এতোদিনের কোমল আচরণ।তারপরই এমন ভৎসনা! নবনীতা শূন্য চোখে তার দিকে দেখে দুই পা পিছিয়ে আসে।রিমি আর শুভ্রা ঠিক তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।সে শাড়ির আঁচলটা খাঁ’মচে ধরে মাথা নামিয়ে নিল।ওয়াজিদ আর আদি মিলে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক করল।মাঝবয়সী মহিলাটা আর্দ্রচোখে একবার তাসনুভাকে দেখে।তারপর দেখে আরিশকে,যে বসে আছে দূরের একটা চেয়ারে।যার উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি এখানে সেখানে ঘুরপাক খাচ্ছে।মহিলাটা চোখ তুলে নবনীতাকে দেখল।যাওয়ার আগেই কোমল স্বরে বলল,’তুমি আরহামের স্ত্রী?’
সে সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে।মুখ ফুটে আর কিছু বলার প্রয়োজনীয়তা বোধ করে না।মহিলাটা একটু পরেই নিরবে চলে গেল।কিন্তু সবকিছু সেখানেই মিটমাট হলো না।আরহাম চড়াও হলো তাসনুভার উপর।দুই ভাইবোনের মাঝে কথা কাটাকাটি হতে হতে সেটা চরমে রূপ নিল।আরিশ কেবল নিষ্ক্রিয় দর্শকের মতোন সবটা দেখল।নবনীতা দেখল তাদের তিনজনকে।তাসনুভার কথা শুনতেই সে বুঝে গেছে মহিলাটা তাদের মা।এরপর আরহাম যখন বাগানের কয়েকটা গাছে কিল ঘুষি মেরে হনহন করে বাড়িতে চলে গেল,তারপর আদিও তাকে সামান্য কিছু কথা সংক্ষেপে বলল।নবনীতা শুনল,বুঝতে পারল ব্যাপারটা একান্তই তাদের পারিবারিক বিষয়।
____
ছাদের দরজা পেরিয়ে নবনীতা দুই কদম ভেতরে আসে।আরহাম পেছন না ফিরেই কাটকাট গলায় চেঁচায়,’আর এক পা ও সামনে আসবে না।জ্ঞান চাই না আমার।নিজের জ্ঞান নিজের কাছেই রাখো।’
নবনীতা তার কথায় ভ্রুক্ষেপ করল না।উল্টো হেঁটে এসে তার মাথাটা আলতো করে আরহামের পিঠে রাখল।হাত বাড়িয়ে পেছন থেকেই তাকে জড়িয়ে ধরল।আরহাম আশ্চর্য হয়ে মাথা তুলল।সে আশা করেনি নবনীতা এতো কিছুর পর তাকে এসে নিজ থেকে জড়িয়ে ধরবে।কিছুক্ষণ তাজ্জব হয়ে থাকার পর সে কিছুটা ধাতস্থ হলো।তার মনে হলো তার চটে যাওয়া মেজাজটা একটা মিষ্টি আলিঙ্গনেই কেমন হুট করে শান্ত হয়ে গেছে।কি অদ্ভুত! আমাদের মনের তোলপাড়,বিধ্বস্ত অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমরা কতোরকম পন্থা অবলম্বন করি।অথচ সামান্য একটা আলিঙ্গনই যথেষ্ট আমাদের বিক্ষিপ্ত মস্তিষ্ককে মুহুর্তেই শান্ত করে দেওয়ার জন্য।
আরহাম একটু স্থির হয়েই অনুতপ্ত স্বরে বলল,’আমি আজকেও তোমার সাথে রূঢ় আচরণ করেছি পরী।এজন্য এখন আমার কষ্ট হচ্ছে।আমার একটা বাজে স্বভাব আছে।আমি একজনের রাগ আরেকজনের উপর ঝাড়ি।প্লিজ তুমি বুঝে নিও।’
নবনীতা চোখ বন্ধ করেই প্রগাঢ় স্বরে জবাব দেয়,’জ্বী।সমস্যা নেই।আমি বুঝতে পেরেছি।’
কিছুক্ষণ সেভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর নবনীতা তাকে ছেড়ে দিয়ে তার পাশাপাশি এসে দাঁড়াল।ঠান্ডা গলায় বলল,’মাঝে মাঝে মনের কথা খুলে বললে মন হালকা হয় আরহাম।বিশ্বাস না হলে চেষ্টা করে দেখতে পারেন।’
আরহাম কতোক্ষণ দুই হাত ভাঁজ করে দাঁড়ায়।তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ছাদের মেঝেতে গিয়ে বসে।তার দেখাদেখি নবনীতাও তার পাশাপাশি বসল।আরহাম সামনে দেখতে দেখতে বলল,’একটু আগে যেই মহিলাটা আসল,সে সম্পর্কে আমার মা হয়।জানো?’
নবনীতা ছোট করে জবাব দিলো,’জ্বী,দেখেই বুঝতে পেরেছি।’
আরহাম দু’টো ঢোক গিলে।কতোক্ষণ নিজের মাথার চুল নিজেই টানে।আনমনে কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।নবনীতা তার কাঁধে হাত রেখে তাকে ডাকল।আরহাম পাশ ফিরতেই সে তার কোলের দিকে চোখ নামিয়ে বলল,’শুভির যখর মন খারাপ হয়,তখন সে আমার কোলে মাথা রেখে সবকিছু খুলে বলে।সে বলেছে কোলে মাথা রেখে নিজের দুঃখের কথা বললে নাকি বেশি ভালো লাগে।আপনি একটু চেষ্টা করে দেখুন তো।’
আরহাম তার কথা শুনেই ফিচেল হাসল।বাধ্য স্বামীর মতো এক বাক্যেই তার মাথাটা নবনীতার কোলে রেখে কোমল গলায় বলল,’আমি বলা শুরু করার আগেই বুঝতে পারছি এভাবে কথা বললে আমি বেশি শান্তি পাব।’
সে থামে।একটু কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে,’বাবার সাথে মায়ের বিয়ে হয়েছিল পারিবারিক ভাবে।আমার বাবা বেশ অভিজাত বংশের সন্তান ছিলেন।স্বাভাবিক ভাবেই সে সময়ে এমন বড়লোকদের বিয়ে হতো মফস্বলের স্বল্পশিক্ষিত কোনো সুন্দরী মেয়ের সাথে।আমার বাবার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।মফস্বলের একটি অল্পবয়স্কা মেয়ের সাথে তার বিয়ে হলো।মেয়েটি প্রাথমিকও পাশ করতে পারেনি।বুঝতেই পারছো,কতো অল্প বয়সে তাদের বিয়ে হয়েছিল।কিন্তু আমার বাবা ছিলেন পৃথিবীর চমৎকার মানুষদের একজন।অন্তত আমার তাই মনে হয়।বাবা বিয়ের পর তথাকথিত পুরুষদের মতোন নিজের স্ত্রীকে কেবলই বংশ বাড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন নি।আমার বাবা তাকে নিজের অর্ধাঙ্গিনী ভেবে তার মন বোঝার চেষ্টা করেছিলেন।জানতে চেয়েছিলেন সে কি চায়,তার কি ইচ্ছে।আমার মা তোমার চেয়েও বেশি সৌভাগ্যবতী ছিলো।কারণ তিনি স্বামী রূপে একজন নিরেট ভদ্রলোককে পেয়েছিল।আমার মা পড়তে চেয়েছিল,বাবা তাকে পড়ালেন।খুন্তি আর হাড়ি পাতিলের জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে তাকে একটা সুন্দর জীবন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।যেখানে সংসার জিনিসটাকে তার জঞ্জাল মনে হবে না।মনে হবে সংসার আসলে জীবনের একটা নেয়ামতের মতো।মা গ্রেজুয়েশন শেষ করল।পাশাপাশি সংসারও সামলালো।রান্নাবান্না সব মা নিজেই করতো।কিন্তু জিনিসগুলো সময়ের সাথে পাল্টে যাওয়া শুরু করল।আমি ছোট থাকতেও মা ভীষণ সংসার কেন্দ্রিক ছিল।পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের সংসারের জন্যও ভীষণ নিবেদিত ছিল মা।কিন্তু যতোই বড় হচ্ছিলাম,দেখছিলাম মা’র আর সংসারে মনোযোগ নেই।বাবার শাড়ি পরা খুব পছন্দ ছিল,অথচ মা একদমই শাড়ি পরত না।তাকে নাকি শাড়ি পরলে গেঁয়োদের মতো দেখায়।রান্নাবান্নাও মা আর আগের মতো করত না।সংসারে তার কোনো মনোযোগই ছিল না।তার সমস্ত মনোযোগ তার বন্ধু বান্ধব আর ক্যারিয়ার নিয়ে।বাবা তার পরিবর্তন লক্ষ্য করলেন,অত্যন্ত ভালোবাসা দিয়ে তাকে বোঝালেন।ফলাফল শূন্য।মা এসব বললেই চটে যেত।বলত বাবা নাকি তার ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করছে।বিষয়টা হাস্যকর তাই না?যে তোমাকে স্বাধীনতার সংজ্ঞা শেখালো,তাকেই তুমি স্বাধীনতার জ্ঞান দাও?’
আরহাম কিছুসময়ের জন্য থামল।নবনীতা একটা হাত বাড়িয়ে তার মাথায় হাত বুলায়।চুলের ফাঁকে আঙুল চালাতে চালাতে আর্দ্র কন্ঠে বলে,’পানি আনব আরহাম?’
আরহাম জবাবে কেবল ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।তারপর টেনে টেনে বড়ো করে কয়েকটা শ্বাস নেয়।এখন যেই কথা গুলো সে বলবে সেগুলো বলার জন্য তার শক্তি প্রয়োজন,অনেক বেশি মানসিক শক্তির প্রয়োজন।তাকে দ্ব্যর্থহীন ভাবে প্রত্যেকটা ঘটনা বলে যেতে হবে।সে একটু দম নিয়ে আবারো বলতে শুরু করল,’যাকগে।সংসারে টুকটাক ঝামেলা হয়ই।সেটা বড় বিষয় না।আমার বাবাও বিষয় টা স্বাভাবিক ভাবেই নিলেন।কিন্তু পরবর্তীতে বাবার জীবনে একটা ভয়াবহ দুর্যোগ নেমে এলো।টানা কয়েকমাস অসুস্থ থাকার পর বাবা একটা ফুল মেডিকেল চেক আপ করান।তারপর জানতে পারেন তার শরীরে ক্যা’ন্সার বাসা বেঁধেছে।তাও বোন ম্যারো ক্যান্সার।তুমি কি জানো ক্যান্সারের মধ্যে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা কোন দুইটা ক্যান্সারে হয়?
লিউকেমিয়া আর বোন ম্যারো ক্যান্সারে শরীরে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা অনুভূত হয়।অস্থিমজ্জার ক্যান্সারে শরীরের প্রত্যেকটা হাড়ে এতো বেশি যন্ত্রণা হয় যে তোমার কাছে মনে হবে এমন ভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে তো মরে যাওয়াই তুলনামূলক ভালো।সেই যন্ত্রণা আমি মুখে বলে বোঝাতে পারব না।আমি নিজেও সেই যন্ত্রণা টের পাইনি।আমার বাবার মতো সরল সোজা আর পরোপকারী মানুষটা সেই যন্ত্রণা ভোগ করেছেন।মা শুরুতে কিছুদিন কাঁদল,তারপরই হঠাৎই কেমন স্বাভাবিক হয়ে গেল।বাবার কেমোথেরাপি শুরু হলো।শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ দেহের মানুষটা হঠাৎই কেমন দুর্বল হয়ে পড়লেন।সারাদিন হসপিটালের বেডে শুয়ে শুয়ে কাঁ’তরাতেন।মা কখনো সেখানে যেত,কখনো বা যেত না।দুই মাস যেতেই মা এতো স্বাভাবিক আচরণ করা শুরু করল যেন স্বামীর ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টা খুবই সাধারণ।হতেই পারে এমন।অতো দুঃখের কিছু নেই।কিন্তু আমি মানতে পারলাম না।আমার প্রাণের চেয়েও প্রিয় বাবার এই মুমূর্ষু দশা আমি ছেলে হয়ে সহ্য করতে পারলাম না।রাত দিন ভুলে আমি হসপিটালে পড়ে রইলাম।
বাবার সহকর্মী ছিল নোমান আঙ্কেল।তার সাথে আগেই মা’র যোগাযোগ ছিল।তিনি রাজনৈতিক নানা কাজে আমাদের বাড়ি আসতেন।তখন থেকেই পরিচয়।বাবার অসুস্থতায় সেই পরিচয় আরো বাড়ল।বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে নোংরামিতে রূপ নিল।আমার বাবা যখন শয্যাশায়ী,তখন আমার মা ফাইভস্টার হোটেলে তারই সহকর্মীর সাথে গিয়ে রঙ্গতামাশায় ব্যস্ত থাকতেন।সেই খবর আমাদের কানে এলো বাবারই অন্য সহকর্মীদের মাধ্যমে।আমার বাবা কেমোথেরাপির মতোন মরণ যন্ত্রনায় ও এতো ভেঙে পড়েন নি,যতোটা ভেঙে পড়েছিলেন মায়ের এই জঘন্য প্রতারণার খবরে।আমার পুরো পৃথিবী এলোমেলো হয়ে গেল।লোক জানাজানিতে মায়ের অবশ্য ভালোই হলো।উনি প্রকাশ্যে নোমানের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পেলেন।হাসপাতাল বেডে থাকা অবস্থাতেই মা আর বাবার ডিভোর্স হলো।আমি অসহায় চোখে সবটা দেখলাম।একবার ভাবলাম কিছুই বলব না।তারপরই আবার কি হলো জানি না,মা যেদিন আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যায় সেদিন আমি ছুটে গিয়ে তার পা জড়িয়ে ধরলাম।হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললাম,’প্লিজ মা।আমাদের এতো বড় শাস্তি দিও না।প্লিজ মা,একটু দয়া করো।এভাবে আমাদের ফেলে দিও না।বাবার এই অবস্থা,তুমি চলে গেলে আমাদের আর থাকবে কি?প্লিজ মা।এই কাজ করো না।আমাদের হ্যাপি ফ্যামিলিটা তুমি ভেঙে দিও না।মানুষের এতো এতো তিরষ্কার আর নোংরা কথায় আমরা বাঁচবো কেমন করে?আমাদের তিনজনের জন্য হলেও তুমি ঐ লোককে বিয়ে করো না।একটু রহম করো আমাদের।’ মা কিন্তু সেদিন আমার এই আকুল আর্জি কানে তুলেনি।সংসার,স্বামী,সন্তান সবকিছুকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে মা হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলেন আজিজ ভিলার চৌকাঠ ছেড়ে।সেই সময়ের যন্ত্রণা আমি তোমাকে বোঝাতে পারব না।তুমি হয়তো জানো বোন ম্যারো ক্যান্সারের কোনো চিকিৎসাই নেই।কেমোথেরাপি দিলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের মতো বাঁচা যায়।এরপরই নিশ্চিত মৃত্যু।আমার বাবা হসপিটালের বিছানায় শুয়ে সেই মৃত্যুর দিন গুনছিল।আর আমি হচ্ছিলাম দিনে দিনে বদ্ধ উন্মাদ।স্কুলে গেলেই নোংরা নোংরা কথা বলে ব্যাচমেটরা বুলিং করতো।মানসিকভাবে ট্রমাটাইজ হয়ে যাচ্ছিলাম।ঐদিকে বাবার অবস্থা দিনকে দিন আরো খারাপ হচ্ছিল।তুমি হয়তো তাকে দেখো নি,তুমি হয়তো তাকে চেনো না।কিন্তু তুমি কি তার যন্ত্রণার একাংশও অনুভব করতে পারছ পরী?যদি অনুভব করতে পারো তাহলে বুঝবে স্রষ্টা তাকে আক্ষরিক অর্থেই মরণ যন্ত্রনা দিয়েছিলেন।বলিষ্ঠ দেহের,ক্ষমতাসীন মানুষটা যে কি-না ব্যবসার ক্ষেত্রে,রাজনৈতিক অঙ্গনে রীতিমতো দাপিয়ে বেড়াতো,সেই মানুষের প্রভাবশালী জীবনটা বন্দী হলো হাসপাতালের একটা ছোট্ট কেবিনে।নিজ স্ত্রীয়ের প্রতারণা,সন্তানদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ,মৃত্যুর দিকে একটু একটু এগিয়ে যাওয়া-সবমিলিয়ে আমার বাবা একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছিলেন।আয়নায় নিজের কদাকার রূপটা তার সহ্য হতো না।আমি সেই কষ্ট কাছ থেকে দেখেছি।আমি আমার জীবনের শেষ কান্নাটুকু তখনই কেঁদেছি।তুমি জানো,আমার স্কুল রেজাল্ট যথেষ্ট ভালো ছিল।কিন্তু সেই ঘটনার পর আমি ফিজিক্স আর ম্যাথে ফেইল করলাম।কারণ আমার ব্রেইনে নতুন করে কিছু প্রসেসই হতো না।তাসলিমা নামের অকৃতজ্ঞ মেয়ে মানুষটি পুনরায় বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াল।সদ্য বিবাহিত স্বামীর সাথে দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়াতে লাগল।অন্যদিকে তাকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসা মানুষটা হসপিটাল বেডে ধুকে ধুকে মরছিল।ছয়মাস পর শুনলাম আমার মা অন্তঃসত্ত্বা।তার জীবনে সুখের কোনো অভাব নেই।ফেসবুকের পাতায় পাতায় তিনি সেই সুখ বর্ণনা করতেন,তার সুখী দাম্পত্যের ছবি দেখাতেন।অথচ ঠিক সেই সময়ই পৃথিবীর কোনো এক প্রান্তে তিনজন অনাথ তাদের সদ্য গত হওয়া বাবার লা’শ সামনে নিয়ে নিষ্প্রাণ হয়ে বসেছিল।আমার বাবা এক বুক যন্ত্রনা নিয়ে পৃথিবী ছাড়লেন।যাওয়ার আগে আমার সারা মুখে চুমু খেলেন।সেটাই ছিল,আমার জীবনের শেষ আদর।বাবা আমাকে অথৈ সাগরে ফেলে চলে গেলেন।শুরুতে খুব কাঁদলাম,এরপর চোখের পানি সব শুকিয়ে এলো।বাবার মৃ’ত্যু সহ্য হচ্ছিল না।দুই দুইবার সুইসাইড এটেমপ্ট নিলাম।আল্লাহ বাঁচিয়ে নিল প্রতিবারই।ওয়াজিদ আর আদি খুব বেশি সাপোর্ট দিলো।আমি এক বছর ড্রপ দিলাম।ভালো রেজাল্ট থাকা স্বত্তেও ছেলে দু’টো আমার সাথে ড্রপ দিলো।আমি ছয়মাস সাইকিয়াট্রিস্টের অবজারভেশনে ছিলাম।ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরলাম।তবে মনে মনে মেনেই নিলাম জগতের সবচেয়ে নোংরা কীট হলো মেয়ে মানুষ।তারপর দিন গেল।আরিশ আর তাসনুভা তাদের বেঈমান অকৃতজ্ঞ মা কে মিস করতো।কথায় আছে না?পাপ বাপ কেও ছাড়ে না।তাসলিমারও তাই হয়েছে।বিয়ের এক দুই বছর যেতেই নোমান তার রূপ পাল্টালো।তাসলিমাকে সংসারের জঞ্জালে বেঁধে দিলো।তার হুটহাট বাড়ি থেকে বেরোনো বন্ধ করল।মোদ্দাকথা একেবারে চার দেয়ালের গৃহিনী জীবনে তাসলিমা বন্দি হলো।তখনই সে টের পেল প্রথম স্বামীর কাছে যেই সম্মান আর ভালোবাসা পাওয়া যায়,তার কিয়দংশও দ্বিতীয় স্বামীর কাছে পাওয়া যায় না।সে এরপর নিজের ভুল বুঝে আমাদের কাছে ফিরে আসতে চাইল।আমি সাথে সাথে তাকে তাড়িয়ে দিলাম।ফিরে আসবে মানে?কিসের জন্য ফিরে আসবে?বাবাই যখন আর নেই,তখন তার ফিরে আসা দিয়ে কি হবে?আমাদের ঘর যখন একবার ঘটা করে ভেঙেই গেছে,তখন আর নতুন করে তাকে ঘরে তোলার প্রয়োজনটা কি?তুমি জানো বাবার মৃত্যুর পর আমি যখন যখন একটু একটু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছিলাম,তখন আরিশ আর তাসনুভা পুরাই অবহেলার মধ্যে দিয়ে বড় হচ্ছিল।তাসনুভা খেলতে গিয়ে দোতালার সিঁড়ি থেকে সোজা নিচে গিয়ে পড়ল।সুস্থ সবল মেয়েটা হাঁটার ক্ষমতা হারালো।র’ক্তমাখা শরীরটা দুই ঘন্টা সেভাবেই ফ্লোরে পড়ে থাকার পর বাড়ির একজন পরিচারিকার নজরে এলো।আমাদের তো অর্থের অভাব ছিল না।তাহলে তাসনুভার ছোট্ট শরীরটা এমন অবহেলায়,রাস্তার কোনো পশুর মতো কেন পড়েছিল বলতে পারো?
কারণ আমাদের একটা মায়ের অভাব ছিল।মায়ের অভাবে সংসার টা তছনছ হয়ে গেল।তাসনুভার এই ঘটনার পর আমি নড়ে চড়ে বসলাম।বুঝতে পারলাম এই সংসারের হাল আমাকে ধরতেই হবে।আমি ব্যবসার কাগজে হাত দিলাম,রাজনীতিতে পা দিলাম।শপথ নিলাম বাবার পরিশ্রম করে দাঁড় করানো ব্যবসা কিছুতেই গুড়িয়ে যেতে দিব না।অনুভূতিশূন্য হয়ে জীবনের একটা দীর্ঘসময় পার করলাম।আর তারপর আজকের এই আরহামের জন্ম।আরিশ আর তাসনুভার খুব দয়া হয় তাসলিমার প্রতি।কিন্তু আমার হয় না।কারণ আমি তার আসল চেহারা দেখেছি।এখনের চেহারাটা তো নকল।নিজের করা ভুলের অনুশোচনা করছে সে।কিন্তু সেই সময়ের চেহারা যদি তুমি দেখতে,তাহলে তুমি জীবনেও তাকে মাফ করার কথা মুখে আনতে না।আমি এই জীবনে কোনোদিনও তাকে মাফ করব না।সে যদি আমার কৈশোর ফিরিয়ে দিতে পারে,আরিশ আর তাসনুভার শৈশব ফিরিয়ে দিতে পারে,তবে মাফ করার কথা ভাবতে পারি।অন্যথায় আমি তাকে কোনোদিনই মাফ করব না।সবকিছুর মাফ হয় না।সবকিছুর পরিশেষে ইটস ওকে বলে রফাদফা করা যায় না।অন্তত আরহাম তার বাবার সাথে সেই বেঈমানী করবে না।যেই বাড়ির চৌকাঠ ছেড়ে তাসলিমা হনহনিয়ে বেরিয়ে গেছে,এই চৌকাঠ সেদিনই তার জন্য হারাম হয়ে গেছে।আমি আমার বাবার বাড়ি,এমনকি তার এক আনা সম্পদেও তাসলিমাকে ভাগ বসাতে দিব না।এটাই আমার শেষ কথা।আমি এই জীবনে তাকে মাফ করব না।তার জন্য যদি শুনতে হয় আমি পাষণ্ড সন্তান,তবে তাই হোক।আমি আমার মায়ের চোখে নির্দয় হতে রাজি,কিন্তু বাবার চোখে বেঈমান হতে রাজি না।আমার বাবা আমার হৃদয়ের একটি অংশ।শেখ আজিজ এখনো বেঁচে আছেন তার সন্তানের বক্ষপিঞ্জরের একটি অংশে।তিনি চিরকাল সেখানেই থাকবেন।আমি তাকে আমার প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।’
রাতের গভীরতা তখন আরো বেড়েছে।আরহাম কথা বলা বন্ধ করেছে অনেক আগে,কিন্তু নবনীতার হুশ ফিরল আরো অনেক পরে।সম্বিৎ ফিরতেই সে চোখ মুছে,মাথা ঝুকায়।আরহামের কপালের একপাশে প্রগাঢ় চুমু খায়।জড়ানো কন্ঠে বলে,’আই অ্যাম সো প্রাউড অফ ইউ আরহাম।আপনি সেদিন বললেন আমি নাকি ফাইটার।এখন আমার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে আপনিও একজন ফাইটার।আরিশ আর তাসনুভা যদি কোনোদিন এই সবগুলো কথা শুনে তাহলে তারাও এটাই বলবে।আমার তো মনে হচ্ছে এক্ষুনি তাদের ডেকে কথা গুলো বলি।আপনি ঠিক বলেছেন আরহাম।সব অপরাধের ক্ষমা হয় না।আমিও এই ব্যাপারে সহমত।সবকিছুর পরিশেষে একটা ক্ষমা প্রার্থনা অতীতের যন্ত্রণা লাঘব করতে পারে না।তবে আমি চাই আপনি একটু ঠান্ডা মাথায় বিষয় গুলো হ্যান্ডেল করুন।আপনি বেশি হাইপার হয়ে যান তো।সেজন্য মানুষ আপনাকেই ভিলেন ভাবে।আপনি না রাজনীতি করেন?আপনার তো জানার কথা যে যতো সিম্পেথি অর্জন করতে পারে,জনগনের পাল্লা তার দিকেই ভারি থাকে।আপনি তাহলে এগ্রেসিভ হয়ে আপনার মায়ের দিকের পাল্লা ভারি করছেন কেন বলুন তো?’
আরহাম মাথা তুলে তাকে দেখে।তার বিস্মিত বিমুগ্ধ চাহনি দেখেই নবনীতা ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়,’কি হয়েছে?’
সে চট করে উঠে বসে।নবনীতার দুই হাত আগলে নিয়ে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে প্রচন্ড আবেগ আপ্লুত হয়ে বলে উঠে,’বিশ্বাস করো পরী,আমাকে এমন করে কেউ কোনোদিন বলেনি।কসম কেটে বলতে পারি কেউ কোনোদিন আমার দিকটা বুঝেনি।তুমি প্রথম ব্যক্তি যে আমার পার্সপেক্টিভ থেকে বিষয়টা ভেবেছ।’
নবনীতা হাসল।একহাত ছাড়িয়ে নিয়ে আরহামের চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,’আমি যে আপনার বউ,তাই আপনার প্রাসপেক্টিভ থেকে ভেবেছি।আপনি কি জানেন,আপনার পাজরের হাড় থেকেই যে আল্লাহ আমাকে বানিয়েছে?’
আরহাম তার কথা শুনেই একগাল হাসল।তারপরই মাথা নামিয়ে নিল।তার মুখে বিষন্নতার স্পষ্ট ছাপ।নবনীতা একটু থেমে ডাকল,’আরহাম!’
‘হু?’
‘এদিকে তাকান।’
আরহাম চোখ তুলে।ঠিক নবনীতার চোখ বরাবর তাকায়।নবনীতা তার খোঁচা খোঁচা দাড়িভর্তি গালে একহাত রেখেই খানিকটা এগিয়ে যায়।এগিয়ে এসে গতকালকের মতো করেই প্রগাঢ় চুমু খায়।আরহাম প্রথমে চমকাল,তারপরই ধাতস্থ হয়ে একটানে দু’জনের দুরত্ব টুকু মিলিয়ে নিল।নবনীতা কয়েক দফা চুমু খেয়েই সরে এসে একগাল হেসে দুষ্টুমির ছলে বলল,’আপনি কাল আমার দুঃখ কষ্ট শুষে নিয়েছিলেন।আমি আজ আপনার দুঃখ কষ্ট শুষে নিলাম।হয়েছে না হিসাব বরাবর?’
আরহাম তার গালে হাত রেখেই মিষ্টি করে হাসল।নবনীতার দুই হাতে কয়েকটা চুমু খেয়ে গাঢ় স্বরে বলল,’যেদিন চিত্রর সাথে তোমাকে দেখেছি,সেদিনই উপলব্ধি করেছি,আমার চেনাজানার বাইরে মেয়ে মানুষের আরো একটি স্বরুপ আছে।তুমি মা না হয়েও চিত্র’র মা হয়ে উঠেছিলে।নিজের মা কে দেখার পর তোমার এই অসাধারণ রূপটা আমার ভীষণ ভালো লেগেছে।মনে হলো আমার মা জন্ম দিয়েও মা হতে পারে নি,আর পরী জন্ম না দিয়েও মা হয়ে উঠতে পেরেছে।সেই পরী আপাইকে আমি বড্ড ভালোবাসি।’
নবনীতা চটপট প্রশ্ন করল,’আর আপনার সেনোরিটা কে?তাকে ভালোবাসেন না?’
আরহাম স্মিত হাসল।নবনীতার উড়তে থাকা চুল গুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে চাপা স্বরে বলল,’ঐটাকেও একটু একটু বাসি বোধহয়।’
নবনীতা দুই হাতে তার কাঁধ জড়িয়ে ধরল।সহজ গলায় বলল,’মন খারাপ করে না আরহাম।জীবন এমনই।দুঃখে কষ্টে জর্জরিত হতে থাকার পর হঠাৎই সুখের দেখা পেয়ে আত্মহারা হয়ে যাওয়ার নামই জীবন।আমরা অনেকটা সময় মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়েছি।এখন আমরা সুখে থাকব,ভালো থাকব।তাই না বলুন?’
আরহাম আচমকাই তার দুই হাত শক্ত করে চেপে ধরল।আকুল হয়ে বলল,’পরী! আমি জানি আমি কোনো ভালো মানুষ নই।ভীষণ এলোমেলো,রুক্ষভাষী আর কাঠখোট্টা স্বভাবের লোক আমি।তোমার মতো মিষ্টি আর ধৈর্যশীল হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।কিন্তু তা স্বত্তেও তুমি কি গোটা জীবন আমাকে সহ্য করে নিতে পারবে?এই ত্রুটিপূর্ণ আমি টার সাথেই এক মনে সংসার করে যেতে পারবে?বলো না।আমি কিন্তু চিরকাল এমনই থাকব।হয়তো তোমার সান্নিধ্যে কিছুটা শুধরে যাব।কিন্তু তোমার মতো এতো ভালো হতে পারব না।তুমি এই মাথাগরম লোকটার সাথে পুরো জীবন কাটাতে পারবে পরী?হু?’
নবনীতা কপাল কুঁচকায়।আরহামের মতো করেই কড়া স্বরে বলে,’কাটাতে পারব মানে?বিয়ে হয়েছে আমাদের।এখন এসব পারব নাকি পারব না,এসব কথার কোনো মানে নেই।বিয়ে যখন হয়েছে,সংসার তখন করতেই হবে।ঘর করব না বলতে কোনো শব্দ নেই।ঘর করতে হবে।হবেই হবে।’
তার কথা শেষ হতেই দু’জন সমস্বরে হেসে ফেলল।আরহাম এক লাফে তড়াক করে উঠে দাঁড়াল।গা ঝাড়া দিয়ে একটা হাত নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়েই চঞ্চল কন্ঠে বলল,’উঠে এসো সেনোরিটা।’
নবনীতা হাসিমুখে সেই হাতটা ধরে উঠে দাঁড়ায়।ঠিক মতো দাঁড়ানোর আগেই আরহাম তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিল।নবনীতা আঁতকে উঠে বলল,’সর্বনাশ! বাচ্চাগুলো এখনো সজাগ।দেখে ফেললে?’
আরহাম বিরক্তিতে মুখ খিঁচে বলল,’রাখো তো তোমার বাচ্চাকাচ্চার চিন্তা।এতো কিছু খেয়াল করতে পারব না।দেখলে দেখুক।আমার কি?’
নবনীতা দুই হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরল।মুচকি হেসে বলল,’কি অদ্ভুত বিষয় তাই না?দুঃখ বিলাশ করতে এসে আমরা প্রেম নিবেদনে ব্যস্ত হয়ে গেলাম।হিহিহি।’
আরহাম মাথা নাড়ল।বিজ্ঞের মতোন ভাব নিয়ে বলল,’এগুলো কেমিস্ট্রির ল’অব রোমান্স।তুমি ফিজিক্সের মানুষ এসব বুঝবে না।’
‘আচ্ছা তাই নাকি?তো শুনি একটু আপনার ল অব রোমান্স।’ হাস্যোজ্জ্বল মুখে জানতে চাইল নবনীতা।
আরহাম ভাব নিয়ে বলল,’ল অব রোমান্সের চতুর্থ সূত্র অনুযায়ী দুঃখ কষ্টের সাথে ভালোবাসার সম্পর্ক সমানুপাতিক।যত বেশি তুমি কাঁদবে,ততবেশি তোমার ভালোবাসতে মন চাইবে।এটাই সাইন্স।চাইলে তোমার মোটা মোটা বইগুলোতে লিখে রাখতে পারো।’
নবনীতা খিলখিল করে কতোক্ষণ হাসল।তার সাথে সাথে আরহাম নিজেও কিছুক্ষণ হাসল।অতীতের সকল দুঃখ কষ্ট,পাওয়া-না পাওয়া কে পেছন ফেলে আরহাম হালকা মনে সামনে এগিয়ে গেল আর নবনীতাকে উপহার দিলো একটি চমৎকার সুন্দর রজনী।
চলবে-