কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৪১

0
83

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৪১)

‘আমার মনে হচ্ছে আরশু যখন বড়ো হবে,তখন মেয়েরা লাইন ধরে তার পেছন পেছন ঘুরবে।’

আরশাদকে কালো রঙের একটা আরামদায়ক পোশাক পরানোর পরেই গোল গোল চোখ করে কথাটা বলে উঠল নবনীতা।আরহাম ঘরের এক কোণার ইজিচেয়ারে হালকা দুলতে দুলতে তাদের দিকে তাকায়।এখন সময় রাত দুইটা তিন।অথচ বাড়ির কারো চোখে ঘুম নেই।পুরো বাড়ির হই-হুল্লোড় দেখে মনে হচ্ছে এখন সবে মাত্র সন্ধ্যা হয়েছে।

নিচ থেকে আরিশ আর তাসনুভার কানে ধরা শব্দ ভেসে আসছে।চিত্রা অবশ্য কিছুক্ষণ আগেই ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।কিন্তু বিভা এখনো সজাগ।শুভ্রা হতাশ চোখে তার দিকে দেখেই অনুরোধের সুরে বলল,’ঘুমা না রে মা।এতোক্ষণ কিভাবে সজাগ আছিস?’

রিমি ব্যস্ত পুরো বাড়ির ডেকোরেশন নিয়ে।এই ডেকোরেশনের চক্করে পুরো বাড়ির এ’মাথা সে’মাথা ঘুরতে গিয়ে সে ওয়াজিদের সাথে কয়েক দফা বারি খেয়েছে।রিমির মনে হয় সে দিনে যতবার পানি খায়,তার চেয়েও বেশি বারি খায়।একটা ধাক্কা খাওয়ার পরে মাথা তুলে কিছু বলার আগেই ওয়াজিদ ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলে উঠে,’নেভার মাইন্ড রিমি।’

বাগানের একেবারে পেছনের দিকে রান্নাবান্নার আয়োজন করা হয়েছে।আদি কতোক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়েছিল।শেষে মশার কা’মড় আর প্যান প্যান শব্দে অতিষ্ঠ হয়ে সে বাড়ির ভেতরে এসেছে।এসেই সে তাসনুভার মুখোমুখি সোফায় বসল।তাসনুভা হাই তুলতে তুলতে চারপাশ দেখছিল।আদি তাকে দেখতেই চোখ বড় বড় করে বলল,’কি ব্যাপার বাচ্চা?তুমি এখনো ঘুমাও নি কেন?দেখছ না চিত্রা ঘুমিয়ে গেছে?তোমারও উচিত ঘুমিয়ে পড়া।’

তাসনুভা একগাল হাসল।সমস্ত মুখে সেই হাসি ধরে রেখেই বলল,’ভাইয়া।আমি কিন্তু আর বাচ্চা নেই।চিত্রার সাথে আমার তুলনা চলে না।’

আদি একহাত নেড়ে বলল,’অতো কথা বুঝি না।তোমাকে সেই জন্মের পর থেকে দেখছি।একেবারে যেদিন তুমি হও সেদিনও আম্মু আব্বু আর আমি গিয়েছিলাম হসপিটালে।আম্মু তোমাকে কোলে নিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলছিল দেখো দেখো! আরহামের কতো সুন্দর একটা বোন হয়েছে।
আমি তখন ফাইভে পড়ি বোধহয়।ওয়াজিদ আর আমি তখন যা টানাটানি করতাম তোমাকে নিয়ে!’

বলতে বলতেই সে হেসে ফেলল।তাসনুভা অবাক হয়ে বলল,’সত্যি?ওয়াজিদ ভাইয়াও এমন করত?’

‘তো?করত মানে?সে সারাক্ষণ বাড়ি আসলেই তোমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতো।আমরা বাগানে ক্রিকেট খেলতাম।আর সে শান্তিপ্রিয় মানুষ তোমাকে কোলে নিয়ে বসে থাকতো।আসলে ওয়াজিদ হচ্ছে মেয়েদের তথাকথিত গ্রীন ফ্ল্যাগ।যোগ্য পুরুষ হওয়ার সব যোগ্যতাই তার আছে।ওয়াজিদ তো ছিল সোনা মায়ের সবচেয়ে প্রিয় বাচ্চা।সারাদিন সোনা মায়ের কথা মতো চলত।সোনা মা যেই আদর করতো তাকে!’

আদি থামল।কথায় কথায় সে অনেকটা বলে ফেলেছে।তার মনে হচ্ছে তার আরো আগেই লাগাম দেওয়া উচিত ছিল।কিন্তু সে দেয়নি।সে মাথা তুলে চোরা চোখে তাসনুভার দিকে তাকায়।দেখতে পায় তাসনুভার মুখের হাসি কমতে কমতে একটা সময়ে এসে একেবারে মিলিয়ে গেছে।সেই জায়গায় কেমন একটা বিষাদের ছাপ ফুটে উঠেছে।আদি নিজেই নিজের উপর বিরক্ত হলো।সে কি লাগাম দিতে জানে না?কি দরকার ছিল পুরান কথা বলে মেয়েটার মন খারাপ করার?সে কথা ঘুরানোর উদ্দেশ্যে নিজ থেকেই আবার বলল,’সে যাই হোক।তুমি সত্যিই আমার কাছে একটা বাচ্চা।আমেরিকা যাওয়ার আগেও যখন তোমায় দেখেছিলাম,তখনও বাচ্চা ছিলে।এখনো বাচ্চাই লাগে।বুঝেছ বাচ্চা?’

***

আরশাদ পিটপিট চোখে সামনে থাকা মেয়েটাকে দেখে।নবনীতা খুশি হয়ে বলে,’দেখুন আরহাম,সে কিভাবে আমার দিকে তাকায়।আমার মনে হচ্ছে আরশাদ আমাকে চিনে ফেলেছে।তাই না আরহাম?’

আরহাম ব্যবসার কাগজ গুলোতে চোখ বুলাতে বুলাতে ছোট করে জবাব দেয়,’হু।’

নবনীতা একহাতে আরশাদের চুলগুলো ঠিক করে।তারপরই আগের মতো চঞ্চল কন্ঠে বলে উঠে,’আরশু কিন্তু এখনই নায়কদের মতোন দেখতে।আমার তো মন চায় তাকে নায়ক বানাতে।কিন্তু আমি ভেবেছি তাকে আমি নায়ক বানাবো না।কারণ এতে করে তার বিয়ে দিতে সমস্যা হবে।এতো মেয়ের সাথে ঘেঁষাঘেঁষি করার পর কোন ভালো মেয়ে তার সাথে বিয়ে করবে শুনি?আমি ঠিক ভেবেছি না আরহাম?’

আরহাম পাতা উল্টাতে উল্টাতে গম্ভীর গলায় বলল,’হু।’

‘আমি একটা অদ্ভুত বিষয় লক্ষ করেছি আরহাম।শুনতে চান?’

‘হু’

‘আমি লক্ষ করলাম আরশাদের সাথে আসাদের নামেরও এতো মিল নেই যত মিল আপনার নামের সাথে আছে।আরহাম আরশাদ।শুনতেই কেমন ভালো লাগে তাই না?’

‘হু’

‘আরশাদ যখন বড় হবে তখন দেখবেন ফেসবুক আইডিতে ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্টের জ্বালায় টিকতে পারবে না।মেয়েরা বড্ড জ্বালাবে আমার সোনা বাচ্চাটাকে! কিন্তু কি আর করার?আমার আরশুকে আল্লাহ বানিয়েছেই এতো সুন্দর।হোয়াট টু ডু নাও? হিহিহি।’

‘হু’

নবনীতা কপাল কুঁচকায়।পাশ ফিরে সরু চোখে আরহামকে দেখে।যার সমস্ত মনোযোগ তার সামনের টি টেবিলে ছড়িয়ে রাখা কাগজগুলোর উপরে।সে কি আদৌ কিছু শুনছে নাকি খামোখাই এক নাগাড়ে হু হু বলে যাচ্ছে?

নবনীতা চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করে,’আমার নাম কি আরহাম?’

‘হু।’

‘আমি আপনার কি হই?’

‘হু’

‘আপনি একটা গর্দভ।’

‘হু’

নবনীতা খিল খিলিয়ে হাসল কিছুক্ষণ।তার হাসির শব্দ শুনেই আরহাম চোখ তুলল।অবাক হয়ে বলল,’কি হয়েছে?হাসছ কেন?’

নবনীতা সাথে সাথেই হাসি বন্ধ করে মুখ গোমড়া করে বলল,’কিছু না।আপনি কাজ করুন।কথায় কথায় না বুঝে হু হু করার দরকার নেই।’

বলেই সে আবার আরশাদের দিকে মন দেয়।গালের নিচে হাত রেখে বিমুগ্ধ কন্ঠে বলে,’এ্যাই আরশু।সত্যি করে বলো তো তুমি কি আসাদের বাচ্চা নাকি ভিনদেশের কোনো পরীর বাচ্চা?সত্যি করে বলবে কিন্তু।’

আরহাম ভারি গলায় ডাকল,’পরী! শুনো তো?’

‘কি?’ জবাব এলো খুবই কাঠখোট্টা স্বরে।

আরহাম শেষ একবার কাগজ গুলো তে চোখ বুলিয়ে ইজিচেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।চুপচাপ খাটে গিয়ে বসে আরশাদের হাতটা টেনে ধরে ভাবুক হয়ে বলে,’তো কি বলছিলা তুমি?আরশাদ কিসের মতো হয়েছে দেখতে?আবার বলো তো।এখন মন দিয়ে শুনব।’

নবনীতা তীক্ষ্ণ চোখে কতক্ষণ তাকে দেখে।দুই মিনিট সময় যেতেই সে পুনরায় নতুন উদ্যোমে বলতে শুরু করে,’বলছিলাম যে আরশু বড় হলে মেয়েরা তাকে খুব জ্বালাবে।আমি কিন্তু আমার ছেলেকে একদমই যেন তেন মেয়েদের সাথে মিশতে দেব না বলে দিলাম।’
.
.
.
.
সকাল হতে না হতেই আরহাম কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।লিভিং রুমে পা দিতেই সে দেখল তাসনুভা সোফাতে মাথা রেখেই ঘুমিয়ে গেছে।রিমি ঘুমাচ্ছে তার পাশাপাশি সোফাতে।ওয়াজিদ আর আদিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।

সে দ্রুত বাড়ি থেকে বের হয়।আদি বাগানে বসে রোজকার মতো ফোনে কথা বলছিল।আরহাম এগিয়ে এসেই কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করে,’ওয়াজিদ কোথায়?’

আদি কান থেকে ফোন সরিয়ে চটপটে গলায় জবাব দেয়,’কে জানে?কোথায় নাকি চারটে বিড়ালের বাচ্চা পাওয়া গেছে অসুস্থ অবস্থায়।ওয়াজিদ সাহেব সেখানে গিয়েছেন তাদের রেসকিউ করতে।’

আরহাম তার কথা শুনেই নাক ছিটকে গালি দিলো,’শা’লা! এই দেশে মানুষের জীবনেরই কোনো দাম নাই।আর সে এসেছে বিলাইয়ের বাচ্চাকে রেসকিউ করতে।কি একটা অবস্থা! এতো আবেগ আসে কোথা থেকে?’

আদি স্মিত হাসে।পুনরায় মাথা নামিয়ে মুঠোফোনের কথোপকথনে মশগুল হয়।আরহাম সামনে যেতে যেতে বিরক্তিতে বিড়বিড় করে,’আরেক প্রেমিক পুরুষ! সারাদিন শুধু প্যাক প্যাক করে।’

সে পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে ব্যস্ত হয়ে কাজের তদারকি করে।আজকের পুরোটা দিন ভীষণ ব্যস্ততায় যাবে তার।সে কাজের ফাঁকেই তার খুব বেশি কাছের সহকর্মীদের ফোনকল দেয়।আরো একবার আন্তরিক হয়ে রাতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানায়।

নবনীতারও ঘুম ভেঙেছে খুব সকালে।রাত তিনটার একটু পরে তার চোখ লেগে এসেছিল।এরপর আর কিছু মনে নেই তার।এখন বাজে ভোরটা পাঁচটা ছাব্বিশ।সে উঠেই দ্রুত ওযু করল।নতুন বাড়িতে আজ তার প্রথম দিন।একটা সুন্দর সূচনা বাধ্যতামূলক তার জন্য।সে নামাজ পড়েই আরশাদকে দেখে।বাচ্চাটা হাত পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে।নবনীতা ছুটে যায় তার দিকে।গিয়েই দু’টো চুমু খায় কপালে।সে কি আরশাদকে একটু বেশিই ভালোবাসে না?হয়তো বাসে।তাতে কি?সে তো তারই বাচ্চা।নবনীতা অন্তত তাই ভাবে।নিজের বাচ্চাকে ভালোবাসা কোনো অন্যায় না।

সে তাড়াতাড়ি সেরেলাক গুলে তার ঘরে আসে।আরশাদ তিনঘন্টা ধরে কিছু খায়নি।বেলা বাড়তেই রিমি ছুটতে ছুটতে তার ঘরে এলো।এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’কি রে তুই রেডি হবি কখন?’

নবনীতা বিচলিত হয়ে জবাব দেয়,’এখন কেন?অনুষ্ঠান না বিকেলের দিকে শুরু হবে?’

‘বিকেলে হবে কিন্তু তোকে তো সাজতে হবে সুন্দর করে।তাই তোর আগে আগেই রেডি হতে হবে।’

নবনীতা কপালে হাত রেখেই কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল,’প্রায় তিনমাস আগে হওয়া বিয়ে নিয়ে এতো আদিখ্যেতা একটু বেশি বেশি হচ্ছে।এতো কাহিনি করতে ভালো লাগে না।’

‘তোর লাগে না কিন্তু আমাদের লাগে।’

নবনীতা মুখ খিঁচে জানতে চায়,’তাসনুভা কাল বলছিল কে নাকি আসবে সাজাতে?এটা কি সত্যি?’

রিমি উপরনিচ মাথা নাড়ে।দ্রুত জবাব দেয়,’হু,মেক আপ আর্টিস্ট।আমাদের সবাইকেই সাজাবে।’

নবনীতা অসহায় চোখে এদিক সেদিক তাকায়।মেক আপ জিনিসটা আসলে মন্দ না।সাজানোর পর তো মানুষকে ভালোই দেখায়।সমস্যা হলো মেক আপের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা।নবনীতার তো পিঠ ধরে যায় বসতে বসতে।কি যে যন্ত্রনা! সে পাশ ফিরে একবার অপেন ক্লসেটে ঝুলানো তার মাল্টি কালারের শাড়িটা দেখে।শাড়িটার বেশির ভাগ জুড়েই আছে গাঢ় লাল রং।কেবল ব্লাউজের অংশে সামান্য সবুজ,নীল আর কালোর মিশ্রণ আছে।শাড়িটা সুন্দর,বেশ সুন্দর।

***

শীলা আক্তার তার জামদানি শাড়িটার আঁচল নিয়ে ভীষণ ঝামেলায় পড়েছেন।শাড়ির আচলটা বার বার মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।তিনি ঠিক মতো হাঁটতেও পারছেন না।হঠাৎই কোথা থেকে একটি মেয়ে এসে মাটি থেকে তার আঁচল টা তুলে নিজের হাতে নেয়।মিসেস শীলা চমকে ঘুরে দাঁড়ান।পেছন ফিরতেই গোলগাল মুখের মেয়েটিকে দেখে বললেন,’আরে! তুমি আবার কষ্ট করে তুলতে গেলে কেন?’

মেয়েটা মাথা নেড়ে জবাব দেয়,’না আন্টি সমস্যা নেই।’

শীলা এগিয়ে গেলেন।জানতে চাইলেন,’নাম কি তোমার মা?’

মেয়েটা হাসিমুখেই উত্তর দিলো,’সিদরাতুল মুনতাহা।ডাকনাম রিমি।’

মিসেস শীলা আন্তরিক ভঙ্গিতে হাসলেন।বললেন,’বাহ খুব ভালো নাম।’

ওয়াজিদ পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বাড়ির ভেতরে আসতেই দোতালার দৃশ্য থেকে থমকে গেল।চোখ বড় বড় করে আবিষ্কার করল মা যেই মেয়েটার সাথে কথা বলছে সে আর কেউ না-রিমি।সে নিচ তালার বসার ঘর থেকেই উপরে দেখে চেঁচায়,’সাবধানে কথা বলো মা।এই মেয়ে নিশ্চিত আবার কোনো না কোনো অঘটন ঘটাবে।’

রিমি চোখ পাকায়।গরম চোখে একবার ওয়াজিদকে দেখে।এতোক্ষণ পর্যন্ত তো সে একটাও অঘটন ঘটায় নি।সে রেলিংয়ে হাত রেখে নিচের দিকে ঝুঁকে।চটে যাওয়া মেজাজে বলে,’আজ আমি কি অঘটন ঘটিয়েছি শুনি?’

দোতালার রেলিংয়ে খুবই নড়বড়ে অবস্থায় একটা ফুলের ঝুড়ি রাখা ছিল।ফুলগুলো কাজে লাগানো হয়েছে,তবে ঝুড়িটা এখনও নেওয়া হয়নি।রিমির হাত লাগতেই সেটা এক নিমিষে রেলিং থেকে ছিটকে নিচে গিয়ে পড়ল।ঘটনা এতো দ্রুত ঘটল যে রিমি কিছু ঠাহর করার আগেই সেই বিশালাকৃতির ঝুড়িটা ওয়াজিদের মাথায় গিয়ে পড়ল।

হকচকিয়ে উঠে দুই হাতে মুখ চেপে ধরে রিমি।এটা কি হলো?কেমন করে হলো?দুনিয়ার সব ভুল কেন সে ওয়াজিদের সামনেই করে?ওয়াজিদ মুখ থেকে ঝুড়ি সরানোর আগেই সে দ্রুত শিলা আক্তারের হাতে তার শাড়ির আঁচল গুজে দিয়ে ভোঁ দৌড় দিলো তাসনুভার ঘরের দিকে।

ওয়াজিদ মাথার উপর থেকে ফুলের ঝুড়ি সরিয়ে কটমট চোখে উপরে তাকায়।তারপরই তিরিক্ষি মেজাজে চেঁচায়,’ঐ আহাম্মক নিষ্কর্মা টা কোথায় মা?’

শীলা আক্তার চোখ পাকিয়ে ছেলেকে দেখেন।মৃদু ধ’মকে উঠে বলেন,’এসব কেমন কথা ওয়াজিদ?এভাবে কথা বলে কেউ?এক্সিডেন্টালি হয়ে গেছে।তুমি এতো রাগ হচ্ছো কেন?’

ওয়াজিদ ফুসতে ফুসতে জবাব দিলো,’আর কতো শান্ত থাকব?তুমি একে চিনো না।সারাক্ষণ একটা না একটা গর্দভগিরি করতেই থাকে এই মেয়ে।শী ইজ সাচ আ ননসেন্স।আমাকে দেখলেই এর পাগলামি এক ডিগ্রী বেড়ে যায়।তুমি দয়া করে এই বেকুবটার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকবে।’

কথা শেষ করেই সে হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেল।শীলা আশ্চর্য হয়ে তার ছেলের কাজকর্ম দেখেন।এই ছেলে তো যথেষ্ট ধৈর্যশীল।সেই সাথে চাপা স্বভাবের।সে একটি মেয়েকে এমন করে ধমকাচ্ছে,বিষয়টা আসলেই অবিশ্বাস্য।

মিসেস শীলা আর কথা না বাড়িয়ে তাসনুভার ঘরে গিয়ে বসলেন।ঘরে যেতেই তিনি দেখলেন কনেসহ সবাই সেদিকেই আছে।নবনীতার সাজ একটু আগেই শেষ হয়েছে।তাসনুভা মাত্র সাজার জন্য বসেছে।মিসেস শীলা ঘরে আসতেই তাসনুভা গালভর্তি হাসল।তারপর নবনীতার দিকে ফিরে পরিচয় করালো,’ভাবি এটা শীলা আন্টি।ওয়াজিদ ভাইয়ার আম্মু।’

নবনীতা প্রশস্ত হেসে তার কাছে এগিয়ে যায়।আন্তরিক কন্ঠে জানতে চায়,’কেমন আছেন আন্টি?’

মিসেস শীলাও জবাবে প্রসন্ন হেসে জানালেন,’ভালো আছি মা।খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।’

তিনি খাটে গিয়ে রিমির পাশাপাশি বসলেন।রিমি তাকে দেখেই বোকা বোকা হাসে।মিসেস শীলা সহজ হয়ে জানতে চায়,’তুমি সাজবে না রিমি?’

ছটফটে তরুণী চপলা কন্ঠে উত্তর দেয়,’জ্বী আন্টি।তাসনুভার পরেই আমি সাজবো।’

বিভা দৌড়ে দৌড়ে তার কাছে আসে।এসেই তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ে।রিমি তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় জানতে চায়,’কি রে বিভু?হাঁপিয়ে পড়েছিস?’

মিসেস শীলা কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়,’তোমার ভাইয়ের মেয়ে নাকি?’

রিমি বিভাকে দেখতে দেখতেই হাসি মুখে জবাব দিলো,’না আন্টি।আমার কোনো ভাই নেই।’

‘তাহলে?এটা কে?’

রিমি একটা দম নেয়।বিভার চুলে আঙুল চালাতে চালাতেই একে একে সব ঘটনার বিশদ বর্ণনা দেয়।কিভাবে নবনীতা বিভাকে পেল,কিভাবে নবনীতার কাছ থেকে সে বিভাকে নিল,কিভাবে বিভা তার পরিবারের স্থায়ী সদস্য হয়ে উঠল-সবকিছু সে একে একে খুলে বলে।শীলা আক্তার অভিভূত হয়ে মন্ত্রমুগ্ধের তার সেই কথা শুনেন।কি সাবলীলভাবে মেয়েটা ঘটনাটা বর্ণনা করছে! যেন বিষয়টা খুবই সাধারণ।অথচ তার মনে হলো এই বিষয়টা অত্যন্ত অসাধারণ।একটা অবিবাহিত মেয়ে নিঃসংকোচে একটি সম্পূর্ণ অপরিচিত বাচ্চাকে মেয়েকে লালন পালনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে,এই বিষয়টা সত্যিই চমৎকার।মিসেস শীলা টের পান মেয়েটিকে তার ভালো লাগছে।একটু বেশিই ভালো লাগছে।

***

শাড়ি পরবে না জামা পরবে এই নিয়ে পুষ্পিতা নূর অনেক বেশি দ্বিধাদ্বন্দে পড়েছিল।তার শাড়ি পরার ইচ্ছে ছিল।তবে আপাইয়ের চোখ রাঙানির ভয়ে সে সেটা মুখ ফুটে বলতে পারছিল না।কিন্তু আপাই নিজে তাকে বলেছে সে যেন আজ শাড়িই পরে।তাই আজ সে শাড়ি পরেছে।তাও আবার তার পছন্দের গাঢ় মেজেন্টা রঙের।

আরিশ তাসনুভা আর সারাহ-র একটার পর একটা ছবি তুলতে তুলতে শেষে ক্লান্ত হয়ে বলল,’আর পারব না।তোরা ক্যামেরা ম্যানকে দিয়ে তোলা।আমার পক্ষে আর সম্ভব না।’

সারাহ নিজেও কয়েকটা ছবি তুলে নাক মুখ কুঁচকে বিরক্তি বিরক্তি ভাব ধরে সেখান থেকে চলে এলো।আরিশ দূর থেকে আরহাম আর নবনীতার একটা ছবি তুলে।তাদের দু’জনকে বেশ ভালো দেখাচ্ছে।

শুভ্রানী তার প্রিয় রঙের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে ছোট ছোট পায়ে সামনে এগোয়।সে আজ উঁচু জুতা পরেছে,ছোট ছোট পা ফেলার এটাই কারণ।আরিশ অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিক দেখতে গিয়ে তাকে দেখল এবং দেখার পর চটপট আরো কয়েক পলক তাকে দেখে নিল।তারপরই চোখ সরিয়ে নিল।ভেতরটা সেই কবে থেকে খচখচ করছে।এটা কি ঠিক হচ্ছে?সে নিজ মনে আপনাআপনি বিড়বিড় করে,’মাত্র উচ্চমাধ্যমিক আরিশ।একটু লজ্জাশরম রাখা উচিত শরীরে।’
তক্ষুনি আবার মনের গহীন থেকে অন্যরকম উত্তর আসে-‘আরে সারাজীবন কি আর উচ্চমাধ্যমিকে থাকবে নাকি?ক’দিন বাদেই তো গ্রেজুয়েশন লেভেলে চলে যাবে।

‘আরিশ ভাইয়া!’

ডাক শুনেই পেছন ঘুরে সে।বিষন্ন মুখে আবিষ্কার করে তাকে ডেকেছে শুভ্রা।সে লটকানো মুখে সামনে এগিয়ে যায়।জানতে চায়,’কি হয়েছে?’

‘আমার,চিত্র’র আর রিমি আপুর একটা ছবি তুলে দিন না প্লিজ।’

আরিশ বিরস মুখে ক্যামেরা সেট করে।লটকানো মুখেই চটপট কয়েকটা ছবি তুলে।শুভ্রা ছবি গুলো দেখেই খুশি হয়ে বলে,’খুব সুন্দর হয়েছে ভাইয়া।’
আরিশ মুখ খিঁচে দ্রুত সেখান থেকে কেটে পড়ল।এখানে থাকলেই এই মেয়ে ভাইয়া ভাইয়া করতে করতে কানের পোকা বের করে ফেলবে।

***

নবনীতা অনেকটা সময় স্টেজে বসে থাকার পর শেষে অধৈর্য হয়ে উঠে এলো।এতোক্ষণ বসে থাকা যায় নাকি?পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে তার।সে স্টেজ থেকে নেমে সামনে এগিয়ে যায়।

আরহাম তখন প্রবীণ নেতাদের সাথে কুশল বিনিময় করছিল।নবনীতাকে দেখতেই সে এগিয়ে গেল।হাত ধরে টানতে টানতে বলল,’তোমাকেই খুঁজছিলাম।চলো পরিচয় করাই।’

নবনীতা বিরক্তি জড়ানো মুখে কোনোরকমে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে সবার সাথে পরিচিত হলো।বেশভূষায় তো বেশ এলিট শ্রেণীর মানুষ মনে হচ্ছে।অথচ সব ক’টার পেট জনগনের টাকা মেরে ফুলে ফেঁপে ঢোল হয়েছে।সে বেখেয়ালি চোখে চারদিক দেখে।আরহাম খানিকটা আফসোসের সুরে বলে,’তোমাকে তো জালাল আঙ্কেলের সাথে দেখা করাতে পারলাম না এখনো।আঙ্কেল শহরে নেই।শহরে আসলে একদিন ইনভাইট করব নে।’

নবনীতা আড়চোখে তাকে দেখেই গটগট করে বলল,’বাপরে বাপ! এই জালাল আঙ্কেলের নাম শুনতে শুনতে আমি ক্লান্ত।’

‘উহু,তুমি বুঝতে পারছ না।আঙ্কেলই আমাকে সবকিছুতে পরামর্শ দেয়।’

নবনীতা সোজাসুজি তার দিকে ফিরে।থমথমে মুখে জবাব দেয়,’বুঝেছি।আপনার ধ্বংসের কারিগর তাহলে আপনার ঐ জালাল আঙ্কেলই।’

আরহামের এই উত্তর একদমই পছন্দ হলো না।সে তীব্র আপত্তি করে জানাল,’একদমই না।সে আমাকে রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝিয়েছে।আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।’

নবনীতা আর কথা বাড়ায় না।সে লক্ষ্য করেছে রাজনীতিবিদ দের মধ্যে একটা কমন ফিচার থাকে।সেটা হলো তারা নিজেরা যেটা ভাবে,নিজেরা যা বুঝে সেটাকেই তারা চিরন্তন সত্য রূপে গ্রহণ করে।এর বাইরে অন্য কারো বোঝানো তে তারা কান দেয় না।

রাত একটু বাড়তেই আরিশ গলা ছেড়ে ডাকল,’ভাইয়া ভাবি।ডাইনিং-এ এসো।আরহাম মোবাইল ফোনে সময় দেখেই বলল,’মাত্র নয়টা বিশ।এনিওয়েজ,খেয়ে নেই চলো।

___

মহানগর অফিসের সাধারণ সম্পাদক মোসাদ্দেক হক।তার মেয়ের নাম শায়লা।শায়লার বয়স খালি চোখে অনুমান করাটা কষ্টসাধ্য।একবার তাকে দেখাচ্ছে খুবই ছোট,আবার হুট করেই মনে হচ্ছে সে এতোটাও ছোট না।

বাগানের একদিকে খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে।খাবারের টেবিল গুলো নির্দিষ্ট দূরত্বে রাখা হয়েছে।উপরে খোলা আকাশ,চারদিকে মরিচবাতির হলুদাভ রোশনাই-সবমিলিয়ে চারদিক ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে।আরহাম সেখানে আসতেই শায়লা এক দৌড়ে এগিয়ে যায়।আহ্লাদী স্বরে বলে,’কেমন আছেন ভাইয়া?’

নবনীতা তখন মাত্রই চেয়ার টেনে খেতে বসেছে।তার একপাশে তাসনুভা,অন্যপাশে আরিশ।চিত্রা আর বিভা আরো অনেক আগেই খেয়ে নিয়েছে।শুভ্রা আর রিমি বসেছে তাসনুভার পাশাপাশি চেয়ারে।টেবিলের সবগুলো চোখ খাঁড়া হয়ে আরহাম আর শায়লা কে দেখছিল।তাসনুভা নবনীতার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে,’মোসাদ্দেক আঙ্কেলের মেয়ে।খুবই ন্যাকা আর গায়ে পড়া স্বভাবের।’

নবনীতা সরু চোখে সামনে দেখতে দেখতেই জবাব দেয়,’সেটা তো দেখতেই পারছি।’

আরিশ মাথা কাত করে।সাবধানী গলায় বলে,’দেখলেই তো হবে না।ডাইরেক্ট একশানে যেতে হবে।দেখো ভাইয়া কেমন হেসে হেসে কথা বলছে।এটা তো একদমই মেনে নেওয়ার মতো না।’

নবনীতা কটমট করে বলল,’সেটাই তো।মেয়ে মানুষ ভাল্লাগে না তো এমন হেসে হেসে কথা বলার কি আছে?ঢং দেখলে বাঁচি না।’

শায়লা হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়াল।আরহাম মনে মনে দুইটা খাস বাংলা গালি ঝেড়ে তার হাতের সাথে নিজের হাত মিলাল।তাদের পাশেই মোসাদ্দেক হক দাঁড়িয়ে আছেন।এই পরিস্থিতিতে হাত মেলানোই উত্তম।হাত মিলিয়েই সে নাক ছিটকে হাতটা সরিয়ে নেয়।নবীনতা চোখের অনলে কতোক্ষণ তাকে ভ’স্ম করল।চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’ইশশ রে! মুখের হাসি থামেই না।’

আরিশ গমগমে স্বরে বলল,’ভাবি এটা কিন্তু একদমই ভালো লক্ষ্মণ না।’

তাসনুভা ঝুঁকল।কন্ঠ খাদে নামিয়ে হিশহিশ করল,’ঠিকই তো।আজ হাত ধরেছে।কাল অন্যকিছু ধরলে?’

নবনীতা চোখ বড় বড় করে আঁতকে উঠে।আরিশ চেঁচিয়ে উঠে বলল,’কি!! কি বললি তুই?অন্য কিছু মানে?ইস ছি!’

তাসনুভা বোকা বোকা হয়ে জবাব দেয়,’জড়িয়ে ধরার কথা বলেছি।এমন অদ্ভুত রিয়েক্ট করছ কেন?’

আরিশ ভ্যাবাচেকা খেয়ে দমে গেল।নবনীতা ঘাড় ঘুরিয়ে কড়া চোখে একবার তার দিকে তাকায়।মাথায় আস্তে করে একটা গাট্টা মেরে বলে,’খালি নেগেটিভ চিন্তা ভাবনা মাথায় ঘুরে তাই না?’

তিনজনই পুনরায় সামনে তাকায়।আরিশ আর তাসনুভার চিন্তাধারায় এক বালতি পানি ঢেলে আরহাম শায়লা চোখের আড়াল হতেই সামনের টেবিলে থাকা টিস্যুবক্স থেকে টিস্যু নিয়ে দ্রুত হাত মুছে।মুছেই বিড়বিড় করে আরো কিছু গালি ঝাড়ে।

মুহূর্তেই চোখ জোড়া আনন্দে ঝলমল করে উঠে নবনীতার।জীবনে এই প্রথম আরহামের ‘আই হেইট ওম্যান’ কোয়ালিটি টা নবনীতার মন কেড়েছে।ঠিকই তো আছে।অন্য মেয়ে কেন হাত ধরবে তার?
আরহাম তাদের টেবিলের দিকে এগিয়ে যায়।চেয়ার টেনে ধপ করে বসে বিক্ষিপ্ত মেজাজে বলে উঠে,’আই হেইট দৌজ শাহবাগীজ।অতিমাত্রায় বাল পাকনা মেয়ে মানুষ আমার জাস্ট অসহ্য লাগে।বাট হোয়াট টু ডু?পলিটিক্যাল ক্যারিয়ার ঠিক রাখতে হলে এসব সহ্য করতেই হবে।’

নবনীতা গালের নিচে হাত রেখে কতোক্ষণ তাকে দেখে।নিজেও মনে মনে উত্তর দেয়,’ইয়েস ইয়েস।অন্যের বর নিয়ে হাতাহাতি করা পাকনিদের আমারও পছন্দ না।আপনার সাথে এ ব্যাপারে সহমত আমি।’

সে দুই দিক ফিরে আরিশ আর তাসনুভাকে দেখে।তারপরই গর্ব করে চাপা স্বরে বলে উঠে,’দেখেছ আমার বর কতো ভালো?এমন ছেলে তোমরা আর দু’টো পাবে?’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে