কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৪০

0
71

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৪০)

নবনীতার গায়ে জড়ানো শাড়িটার রং গাঢ় নীল।নীলের মাঝে কয়েক ফোঁটা কালো মেশালে যেমন রং হয়,অনেকটা এমন।সে শাড়ি পরেই চুপচাপ কতোক্ষণ নিজের রুমে বসে থাকল।শূন্য চোখে একবার পুরো ঘরটা দেখল।এখন বিকেল তিনটা বাজে।আরহামদের গাড়ি আর একটু পরেই চলে আসবে।আর তারপর?

নবনীতা মাথা নামিয়ে বড়ো করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।তারপর সে চিরতরে বাড়ির মানুষদের ছেড়ে অন্যত্র চলে যাবে।নিজের ভাবনায় তার নিজেরই হাসি পায়।তার আবার পরিবার ছিল কবে?সে তো সবসময়ই ছন্নছাড়া।তবে তার জীবনে দু’টো অমূল্য রত্ন আছে।এই রত্নগুলোকে সে ভীষণ ভালোবাসে।এদের ছাড়া সে থাকবে কেমন করে?আদৌ কি এদের ছাড়া থাকা তার পক্ষে সম্ভব?

সে মাথা কাত করে একবার আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে।কাল সারারাত সে জেগে ছিল।মিশ্র অনুভূতি গুলো তাকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।একদিকে নতুন জীবনে পদার্পণের কৌতূহল,অন্যদিকে দুই বোনকে ছেড়ে থাকার যন্ত্রণা-সব মিলিয়ে নবনীতার কেমন এলোমেলো লাগে সবকিছু।

শুভ্রা খাবার শেষে তার ঘরে এসে চুপচাপ ফ্লোরে বসল।ঠিক তার পায়ের কাছটায়।তারপর আলতো করে তার কোলে মাথা রাখল।নবনীতা ঈষৎ কেঁপে উঠল।চমকানো গলায় বলল,’কি রে শুভি?কি হয়েছে তোর?’

শুভ্রা ক্ষণকাল চুপ থাকার পর শেষে মৃদু স্বরে বলল,’আমি খুব ভালো করে পড়ব আপাই।তুমি টেনশন করো না।’

নবনীতা স্মিত হাসে।মাথা নামিয়ে শুভ্রার কপালের একপাশে চুমু খেয়ে নরম স্বরে বলে,’জানি তো শুভি।তোরা দুইজনই তো আমার লক্ষী বোন।আপাইয়ের কোনো অভিযোগ নেই তোদের কাছে।শুধু আছে কৃতজ্ঞতা।ছয় বছর তোদের কে যেমন তেমন রাখার পরেও তোদের কাছে আমি পৃথিবীর সেরা মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছি।এই পরী আপাই তার শুভি আর চিত্র’র কাছে খুব বেশি কৃতজ্ঞ।আমার একাকিত্বের জীবনটা রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য পরী আপাইয়ের পক্ষ থেকে শুভি আর চিত্রকে এতো এতো ভালোবাসা।’

শুভ্রা তার কোলে মাথা রেখেই হু হু করে কেঁদে ফেলল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’তোমাকে ছাড়া থাকবো ভাবলেই কান্না পায় খুব।’

***

আরহামদের গাড়ি এসেছে আনুমানিক চল্লিশ মিনিট আগে।আরহাম আসেনি।আদি,আরিশ,তাসনুভা আর রিমি এসেছে।আরহাম তখনো তার মহানগরের অফিসে।কি নাকি জরুরি মিটিং আছে।

নবনীতা ধীর পায়ে হেঁটে হেঁটে সাদেক সাহেবের ঘরে গেল।গিয়েই হালকা করে কাশলো।ঠান্ডা স্বরে ডাকল,’মামা! জেগে আছ?’

সাদেক সাহেব শোয়া অবস্থায় সামান্য মাথা তুলে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,’হ্যাঁ মা।জেগে আছি।আয় না।’

নবনীতা এসে খাটের এক কোণায় বসল।বসেই দ্রুত মাথা নামিয়ে নিল।এই মুহূর্তে কেঁদে ফেলে সে পরিবেশ নষ্ট করতে চায় না।সে আর্দ্র গলায় বলল,’মামা ওরা চলে এসেছে।আরহাম আসলেই আমিও তাদের মাথে চলে যাব মামা।কালকে তাদের বাড়িতে অনুষ্ঠান।বেঁচে থাকলে একেবারে সেখানেই আবার দেখা হবে।’

কথা শেষ করে সে একটু দম নিল।তারপরই একবার নাক টেনে পুনরায় বলতে শুরু করল,’মামা আমি তোমার কাছে চিরকৃতজ্ঞ।তুমি আমার কাছে বাবার মতোই।আমরা তিনবোন কোনোদিনই তোমার ঋণ শোধ করতে পারব না।কখনোই না।শোধ করতে চাইও না।থাকুক,কিছু ঋণ আজীবনই থাকুক মামা।আমরা সেই ঋণের বোঝা নিজেদের উপর নিয়েই বাকি জীবন কাটাতে চাই।বিদায় বেলাতেও তোমার কাছে আরো একটা আবদার করে গেলাম মামা।আমার কলিজা দু’টো কে একটু দেখে রেখো।চিত্র খাবার নিয়ে ভীষণ জ্বালায়।বেশি কিছু করতে হবে না,শুধু একটু ডাক দিয়ে জিজ্ঞেস করবে খেয়েছে নাকি।তাহলেই হবে।’

সাদেক সাহেব স্থির নয়নে কয়েকপল তাকে দেখলেন।মেয়েটা মাথা নামিয়ে নিজের দুই হাত একটানা কচলে যাচ্ছে।দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে কান্না থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।তিনি আদুরে গলায় ডাকলেন,’কাছে আয় পরী।একটু মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।’

নবনীতা যেন এই কথারই অপেক্ষায় ছিল।সাদেক সাহেব কথা ঠিক মতো শেষ করার আগেই নবনীতা তার পায়ের দিক থেকে উঠে তার মুখোমুখি বসে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল।প্রচন্ড আবেগপ্রবণ হয়ে বলল,’আমাকে তুমি মাফ করে দিও মামা।অনেক মুখের উপর কথা বলেছি।ঠাস ঠাস উত্তর দিয়েছি।প্রচুর ভোগান্তি দিয়েছি তোমাদের।আর দিব না।তুমি মনে কোনো কষ্ট রেখ না।প্লিজ মামা,তুমি আমার চিত্র আর শুভি কে একটু দেখে রেখ।’

সাদেক সাহেব একটা হাত তুলে আলতো করে তার মাথায় রাখলেন।সামনে তাকাতেই দেখলেন চৌকাঠে একটি যুবক ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তিনি আন্তরিক গলায় ডাকলেন,’আরে আরহাম! এসো না বাবা।’

চকিতে মাথা তুলে পেছন ফিরে নবনীতা।আহরাম ধীর পায়ে হেঁটে এসে তাদের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ায়।সাদেক সাহেব নবনীতার একটা হাত নিয়ে আরহামের হাতে তুলে দিলেন।আবেগ জড়ানো কন্ঠে বললেন,’এই মিষ্টি মেয়েটার খেয়াল রেখ আরহাম।হয়তো কিছুটা স্পষ্টভাষী,সামান্য জেদি।তবে মন থেকে খুবই সরল।তুমি মেয়েটাকে দেখে রেখো।’

আরহাম জবাবে কেবল আস্তে আস্তে দুইবার মাথা নাড়ল।সাদেক সাহেবের ঘরে আরো কিছুক্ষণ থাকার পর তারা দু’জনই উঠে এলো।নবনীতা শেষ একবার তার ঘরে গিয়ে আলগোছে চারদিকে চোখ বুলায়।হঠাৎই দরজা লাগানোর শব্দে সে কিছুটা চমকে পেছন ফিরে।খানিকটা আশ্চর্যের সুরে বলে,’কি ব্যাপার?দরজা বন্ধ করলেন কেন?’

আরহাম দরজায় ঠেস দিয়েই বাঁকা হাসল।তারপরই একটানে নবনীতাকে তার কাছে এনে নিজে ঘুরে গিয়ে নবনীতাকে দরজার সাথে ধাক্কা দিয়ে দাঁড় করাল।দরজার লকটা পিঠের সাথে লাগতেই নবনীতা দাঁতে দাঁত পিষে খেকিয়ে উঠল,’পাগল নাকি?দেখেন না দরজায় যে লক আছে?এভাবে কেউ ধাক্কা দেয়?ধুর! পিঠটাই ব্যথা হয়ে গেছে।’

আরহাম একপেশে হাসল।হাত বাড়িয়ে নবনীতার চুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো।নবনীতা দুই চোখ সরু করে বলল,’কাহিনি কি?এমন উদ্ভট আচরণ করছেন কেন?মাথা ঠিক আছে?’

আরহাম আচমকাই একহাত তার ঘাড়ের পেছনে নিয়ে তাকে একটানে নিজের একেবারে কাছাকাছি নিয়ে এলো।চোখজোড়া আপনাআপনি বড় হয়ে এলো তার।একপ্রকার নিশ্বাস বন্ধ করে সে জানতে চায়,’হচ্ছে টা কি আরহাম?’

আরহাম জবাব দিলো না।উল্টো নবনীতাকে চূড়ান্ত রকমের হতবাক করে দিয়ে সে তার ওষ্ঠাধরে প্রগাঢ় চুম্বন করে।কতো সময়ের জন্য?নবনীতা জানে না।সে পাথরের মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকল।সে পলক ফেলার পাশাপাশি নিশ্বাস নেওয়াও ভুলে গেছে।তার বিস্ফারিত চোখ জোড়া দেখেই আরহাম স্মিত হাসল।এগিয়ে গিয়ে একই কাজের পুনরাবৃত্তি করল।তার শক্তপোক্ত শরীরটার অকস্মাৎ ঘনিষ্ঠতায় নবনীতা লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নুয়িয়ে পড়ছিল।আরহাম একহাতেই তাকে আগলে নিল।নবনীতা পুরোটা সময় একটা শব্দও করল না।শেষটায় যখন দরজার লকটা ভীষণ জোরালভাবে পিঠে এসে আঘাত করছিল,তখন সে আলতো হাতে আরহামকে একটা ধাক্কা দিলো।

ব্যস এতেই আরহাম চটে গেল।এক ধাক্কায় নবনীতাকে সরিয়ে দিয়ে সে নিজেও দুই কদম পিছিয়ে এলো।নবনীতা অবাক চোখে তার দিকে তাকাতেই সে বিক্ষিপ্ত মেজাজে তার উপর চড়াও হলো।

‘নিজ থেকে কাছে আসি ভালো লাগে না?আর আসবো না যাও।থাকো তুমি নিজের মতো।’

বলেই সে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।নবনীতা এক দৌঁড়ে তার কাছে এসে তার হাতটা টেনে ধরে।তাড়াহুড়ায় উত্তর দেয়,’অদ্ভুত তো! আগে পুরো কথা শুনবেন তো।’

কথা শেষেই সে পেছন ঘুরে।পিঠের উপরে থাকা চুলগুলো সরিয়ে শাড়িটা এক ইঞ্চির মতো নিচে নামিয়ে বিরক্তি ধরা গলায় বলে উঠে,’দেখুন।লকটার সাথে চাপা খেয়ে কি অবস্থা হয়েছে।’

আরহাম একনজর দেখল।তারপরই বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলল,’ওহ আচ্ছা বুঝেছি।’

‘কিন্তু আমি কিছু বুঝিনি।’ ঘুরে দাঁড়িয়ে চোখ মুখ শক্ত করে প্রতিউত্তর করে নবনীতা।এক পা সামনে এসে কাটকাট গলায় বলে,’এসব কি আরহাম?’

আরহাম ভ্রু কুঁচকায়,-‘কি মানে কি?’

সে আবারো দু’জনের দূরত্ব মেটায়।পুনরায় সুপ্ত ইচ্ছেদের লাই দেয়।চুমুতে চুমুতে প্রিয়তমার সমস্ত মুখ সিক্ত করে তবেই দূরে সরে আসে।নবনীতার লজ্জায় রক্তিম মুখখানা দেখেই কুটিল হেসে বলে,’তোমার মনে খুব দুঃখ।দুঃখ গুলো শুষে নিলাম ডার্লিং।এই বাড়িতে এই রুমে এটাই আমাদের লাস্ট রোমান্স।’

নবনীতা মাথা নত করেই বিড়বিড় করে,’ছি! শুষে নিলাম আবার কি?কিসব অ’শ্লীল শব্দ!’

‘অ’শ্লীল শব্দ আবিষ্কারই তো হয়েছে আমাদের মতো কাপলদের জন্য।জামাই বউ অ’শ্লীল কথা বলবে না তো কারা বলবে?তুমি কি জানো পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কৌতুক হলো অ’শ্লীল কৌতুক?একটা শোনাব নাকি ডার্লিং?’

নবনীতা দুই হাত জোর করে নতজানু হয়ে বলল,’মাফ চাই।এসব অ’শ্লীল কথা আমি শুনতেও চাই না।আপনি এসব নিজের কাছেই রাখেন।’

আরহাম হাসতে হাসতে জবাব দেয়,’আমিও এখন বলতে চাই না।বিকেলে এসব জমে না।এসব বলার উপযুক্ত সময় রাত বারোটার পর।বুঝেছ?’

নবনীতা একবার কড়া চোখে তার দিকে তাকায়।তারপরই দরজা খুলে হনহন করে বেরিয়ে যায়।বসার ঘরে আসতেই চিত্রা তার দিকে ছুটে যায়।তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে তার শাড়ির কুচির ভাঁজে মুখ লুকিয়ে বলে,’আপাই তুমি চলে যাচ্ছ?’

নবনীতা আর্দ্র কন্ঠে জবাব দেয়,’চলে যাচ্ছি না সোনা।সপ্তাহে একদিন আসব নে।’

ছোট্ট বাচ্চাটা অসহায় চোখে মাথা তুলে উপরে তাকায়।নবনীতা সেই দৃষ্টি দেখতেই শক্ত করে নিজের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে।ভাঙা কন্ঠে বলে উঠে,’কাঁদে না সোনা।এমন করে কাঁদলে আপাই কি করে তোমায় রেখে যাব বলো?’

আরহাম এগিয়ে এসে চিত্রার মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,’চলো পাখি।তোমাকেও নিয়ে যাই আমাদের সাথে।কয়টা দিন সেখানে থেকে আসবে।’

নবনীতা দ্রুত মাথা নাড়ে।আপত্তি করে বলে,’না না।এটা হয় না।চিত্র এদিকেই থাকবে।’

মিসেস রোকেয়া বড় বড় পা ফেলে সামনে এগিয়ে এলেন।নমনীয় স্বরে বললেন,’আরে চিত্রকে নিয়ে এতো ভেব না।আমি তো আছিই।আমি তাকে দেখে রাখব।দেখি তো চিত্র।মামিমণির কাছে এসো তো।’

চিত্র একবার তাকে দেখে।একবার আরহামকে দেখে।তারপরই হাসি মুখে মিসেস রোকেয়ার কাছে এগিয়ে যায়।মামিমণি কে তার ভীষণ পছন্দ।সে তো চিত্রা কে খুব আদর দেয়।সে এগিয়ে এসেই মিসেস রোকেয়ার হাত ধরে।তিনি সামান্য ঝুঁকে স্নেহমাখা কন্ঠে বললেন,’দেখি তো চিত্র।সুন্দর করে আপাই কে বিদায় দাও তো।’

চিত্র দাঁত বের করে হাসল।একহাত তুলে রিনরিনে স্বরে বলল,’তুমি যাও আপাই।আমি মামিমণির কাছেই থাকব।’

শুভ্রা বিষম খায়।চিত্রা আর মিসেস রোকেয়ার এই মাখো মাখো সম্পর্ক দেখলেই তার চোখ ব্যথা করে।মনে হয় চোখ দু’টো এক্ষুনি খুলে হাতে চলে আসবে।চিত্র কি বোকা?মামি যে একটা গিরগিটি এটা কি সে বুঝে না?পরমুহূর্তেই আবার তার মনে হয় চিত্র তো সত্যিই বোকা,মাসুম বলেই হয়তো ছলনা আর কপটতা বুঝে না।

শুভ্রা চায় ছলনা কিংবা লোক দেখানোর খাতিরে হলেও মামি যেন চিত্রকে আদর করে।শুভ্রাকে আদর দেওয়ার প্রয়োজন নেই।শুভ্রা এখন বড়ো হয়েছে।চিত্র তো ছোট।চিত্রকে একটু ভালোবাসা দিলেই হবে।

নবনীতা এগিয়ে এসে মিসেস রোকেয়ার দুই হাত চেপে অনুনয় করে বলল,’শুভি আর চিত্রকে একটু যত্ন করো মামি।কি কি খেতে চায় রান্না করে খাইয়ে দিও।বাজার লাগলে আমাকে ফোন করে বলো।তবুও বাচ্চা দু’টোকে খাবারের কষ্ট দিও না।’

মিসেস রোকেয়া অপ্রস্তুত হয়ে এখানে সেখানে তাকায়।তার বিগড়ানো মেজাজ আরও বেশি বিগড়ে যাচ্ছে।সবার সামনে পরী এমন করে তাকে বলে দিলো যে খাবারের কষ্ট দিও না।সবাই এখন কি ভাববে তাকে?তিনি চাপা স্বরে জবাব দিলেন,’তুমি এসব ভেবো না।আমি দেখে রাখব।’

নবনীতা সব শেষে শুভ্রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।শুভ্রা মেয়েটা কিছুক্ষণ শব্দ করে কাঁদল।অথচ নবনীতার চোখ দিয়ে পানি বের হলো না।এতো মানুষের সামনে তার কান্না আসে না।গলার কাছটায় সব দলা পাকিয়ে যায়।সে শুভ্রার মাথার হাত বুলিয়ে ছোট্ট করে চুমু খায়।তারপরই আর কোনোদিকে না দেখে বড় বড় পা ফেলে সামনে এগিয়ে যায়।যতই সে এদিকে থাকবে,ততই সে আরো বেশি দুর্বল হবে।সে মন শক্ত করে।নিজেই নিজেকে বোঝায়-মেয়েদের জীবন এমনই হয় নবনীতা।মানিয়ে নেওয়াই জীবন।প্রথমে একটু কষ্ট হবে,তারপর অভ্যাস হয়ে যাবে।মাও তো নিজের ভাই বোন ছেড়ে বাবার বাসায় গিয়েছে।এটাই কি স্বাভাবিক নয়?

গাড়িতে বসেই সে দুই হাতে মুখ চেপে মাথা নামিয়ে কতোক্ষণ দুই চোখ বন্ধ করে রাখল।আরহাম গাড়িতে বসেই সহজ গলায় বলল,’তুমি চাইলে চিত্র আর শুভ্রাকে নিয়েও আসতে পারতে।কালকে রাতেই তো অনুষ্ঠান।তারা একটা দিন থাকতো।সমস্যা কি ছিল?এমনিতেও আজকে সারা রাত সবাই হই হুল্লোড়ের মাঝেই থাকবে।’

নবনীতা চোখ বন্ধ রেখেই নিরেট স্বরে জবাব দেয়,’এতো সহজে সবকিছু হলে তো হতোই।আপনি না খুব প্র্যাকটিক্যাল মানুষ?এতো ইমপ্র্যাকটিক্যাল কথা বলছেন কেমন করে?’

আরহাম ফিচেল হাসল।ব্যাক সিটে গা এলিয়ে দিতে দিতে প্রগাঢ় স্বরে বলল,’চিত্র’র ব্যাপারে আমি ভীষণ ইমপ্র্যাকটিক্যাল।শী ইজ সামথিং সো ডিফরেন্ট।আমি চিত্রকে ভালোবাসি।’

নবনীতা ঠোঁট উল্টায়।কটাক্ষ করে বলে,’ইশশ রে! ভালোবাসা দেখে বাঁচি না।’

আরহামদের বাড়ির সামনে আসতেই মোতাহের দুইবার হর্ণ বাজায়।নবনীতা একনজর চোখ তুলে বাড়ির মূল ফটকের পাশে থাকা নামটা পড়ে-আজিজ ভিলা।

গাড়ি থামতেই আরহাম বেরিয়ে এসে নবনীতার পাশের দরজাটা খুলল।মাথা ঝুঁকিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’আসুন ম্যাডাম।আপনার পদধূলি ফেলে আমাদের ধন্য করুন।’

নবনীতা চুপচাপ সেই হাত ধরে নেমে এলো গাড়ি থেকে।সামনে তাকাতেই দেখল সেই বিশাল অট্টালিকা সম বাড়িটা।কি সুন্দর চোখ ধাঁধানো একটা বাড়ি! নবনীতা কল্পনায় একবার নিজেদের বাড়িটার কথা ভাবল।তাদেরও তো এতো সুন্দর একটা বাড়ি ছিল।আহা! কোথায় গেল সেই দিন গুলো!

সে বাড়ির ভেতর গিয়ে কিছুক্ষণ লিভিং রুমে বসল।তাসনুভা আর আরিশ অনেকক্ষণ তার সাথে বসে গল্প করল।সে মুখে অল্প হাসি ফুটিয়ে তাদের কথার জবাব দিয়েছে।অথচ ভেতরে ভেতরে তার বুক ফেঁটে কান্না আসছে।মন চাইছে গলা ছেড়ে নার্সারি পড়ুয়া বাচ্চাদের মতো কতোক্ষণ কাঁদতে।আফরোজা বেগম এক ফাঁকে এসে তাকে দেখে গিয়েছে।দেখতেই তার চোখ ছানাবড়া।কি সুন্দর এই মেয়ে! নিশ্চয়ই রূপ দেখেই আরহাম গলেছে।পরক্ষণেই তার মনে হলো ধ্যাত,আরহাম তো এসব রূপ টুপ গুনেও না।কি দেখে যে পাগল হয়েছে কে জানে।তিনি এক পলক দেখেই পুনরায় চলে গেলেন।

নবনীতা রাত আটটার দিকে হাত মুখ ধুয়ে আরহামের ঘরে গিয়ে বসল।সে বাথরুমে গিয়ে টানা ত্রিশ মিনিট কেঁদেছে।আরহাম কাজের ফাঁকেই একবার তার চোখ মুখ দেখল।তারপরই কিছু না বলে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।

রাত নয়টার দিকে তাসনুভা আর আরিশের ডাকে নবনীতা নিচে নেমে এলো।আসতেই দেখল বসার ঘরে সবাই এতো এতো কাপড়চোপড় আর অর্নামেন্টস ছড়িয়ে বসে আছে।সে সেখানে উপস্থিত হতেই তাসনুভা চঞ্চল হয়ে বলল,’ভাবি! এসো এসো।দেখো তো কোন শাড়িটা ভালো লাগে তোমার।’

পুরো ঘর ভর্তি শাড়ি আর জুয়েলারি।এতো এতো শাড়ির মাঝে নবনীতার একটি শাড়ি বেছে নিতে কষ্ট হচ্ছিল।সে হয়রান হয়ে বলল,’সবই তো ভালো লাগে।যেকোনো একটা বাছতে পারছি না।’

সে চুপচাপ গোমড়া মুখে তাসনুভার পাশাপাশি এসে বসল।সামনের টি টেবিলটা নানারকম মুখরোচক খাবারে ভর্তি।নবনীতার মায়া হলো।আরো একবার মনে পড়ল চিত্রা আর শুভ্রার কথা।ইশশ বাচ্চাগুলো কতো খুশি হতো এই মজার মজার খাবার পেলে! সেই সাথে সবাই মিলে এতো মজা করছে।চিত্রা আর শুভি তো মানুষ পছন্দ করে খুব।দেখলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতো।

গাড়ির হর্ণের শব্দ কানে যেতেই তাসনুভা খুশি খুশি মুখ করে বলল,’ভাইয়া এসেছে মনে হচ্ছে।’

লিভিং রুমে সবার প্রথমে আরহাম আসেনি।এসেছে একটা ছোট্ট মেয়ে,যে মেয়েটা নবনীতার ভীষণ আদরের।সে ছুটতে ছুটতে সেখানে এসেই নবনীতার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল।নবনীতা হকচকিয়ে ওঠে তাকে দেখল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’চিত্র! তুই?’

‘হু।ভাইয়া নিয়ে এসেছে।’

নবনীতা বোকা বোকা চোখে সামনে তাকায়।আরহাম লিভিং রুমে এসেই নবনীতার অন্যপাশ টায় এসে বসল।তার পেছন পেছন শুভ্রাও ভেতরে এলো।আরিশ তাকে দেখেই একগাল হাসল।যাক,ভাইয়া একটা কাজের কাজ করেছে এতোদিনে।

নবনীতা থমথমে মুখে আরহামের দিকে ফিরল।বিরক্ত হয়ে বলল,’কি দরকার ছিল এসবের?মানুষ কি বলবে?’

আরহাম দায়সারা হয়ে জবাব দেয়,’মানুষের বলা দিয়ে কিছু যায় আসে না।আর এমনিতেও আজ রাতে সবাই এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।রিমিকে ফোন দিয়েছি।রিমি আসছে।ওয়াজিদও আসবে।আমি চাই আজকের দিনটা সবাই যার যার মতো খুশিতে থাকুক।কোনো ঝামেলা আর কান্নাকাটি চাই না আমি।’

নবনীতা মাথা নামিয়ে স্মিত হাসে।ক্ষীণ কন্ঠে বিড়বিড় করে,’ইচ্ছে করে কাঁদি নি।কান্না চলে আসে।কি করব?’

***
ধবধবে সাদা বেবি গাউনটা হাতে নিয়েই আরহাম ভীষণ ভাবনায় পড়ে গেল।একবার গাউন,আর একবার চিত্রাকে দেখে বলল,’বুঝতে পারছি না চিত্র।একবার মনে হচ্ছে পরলে মানাবে ভীষণ,আবার মনে হচ্ছে ফ্যাকাশে রক্তশূণ্যর রোগীদের মতোন লাগবে।’

চিত্রা নিজেও গালের নিচে হাত দিয়ে ভাবনায় মত্ত হয়।লিভিং রুমে সবাই কালকে পরার জন্য শাড়ি আর পাঞ্জাবি সিলেক্ট করছিল।আরহাম অবশ্য চিত্রা আর বিভার কথা ভেবে কয়েকটা বাচ্চাদের জামাও রাখতে বলেছিল।বিভার জন্য নবনীতা একটা জামা বেছে নিয়েছে।সেই জামা সকলের মনঃপুত হয়েছে।কিন্তু বিপত্তি বেধেছে চিত্রার জামা বাছাই করতে গিয়ে।চিত্রার সবকিছুতেই খুতখুতে স্বভাব।যেকোনো জামা পরানোর পরেই সে টালবাহানা শুরু করে এই জামা সে পরবে না,এটা নাকি তাকে গুতায়।

নবনীতা বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে বলল,’যা তোর যেটা ভালো লাগে ঐটা পর।আমার কাছে আসবি না আর।কয়েক ঘন্টার বিষয়,আর সে আছে গুতাগুতি নিয়ে।যা সর তো।’

চিত্রা কথা শুনেই তাকে ভেঙচি কাটে।নবনীতা নিজেও তাকে ভেঙচায়।আরহাম দু’জনের কাজ কর্ম দেখেই মাথা নামিয়ে চাপা স্বরে হাসে।তারপরই সে একটা সাদা গাউন হাতে নিয়ে খুব মনোযোগী হয়ে নেড়েচেড়ে দেখে।

সাদা গাউনটা গায়ে ধরতেই চিত্রা মুখ ফুলিয়ে বলল,’এটাও গুতায়।’

আরহাম কপাল চাপড়ায়।কি একটা জ্বালায় পড়েছে সে! নবনীতা চটে যাওয়া মেজাজে ধমকায়,’তুই তাহলে কালকে একটা মারু হাফপ্যান্ট পরে ঘুরিস চিত্র।এতোই যখন আরাম খুঁজিস তুই,তোর জন্য ঐটাই ঠিক আছে।’

চিত্রা মুখ কুঁচকে অন্যদিকে চোখ সরায়।আরহাম দু’টো জামা হাতে নিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,’অতো কিছু বুঝি না।এই দুইটার মধ্যে যেকেনো একটাই বেস্ট হবে।চিত্র! তুমি দু’টোই পরবে।পরে ভাইয়াকে দেখাবে।ভাইয়া তারপর ডিসাইড করব তুমি কোনটা পড়বে।কেমন?’

চিত্রার এই প্রস্তাব পছন্দ হলো।সে সাথে সাথেই শুভ্রাকে নিয়ে গেস্ট রুমের দিকে ছুটল।শুভি তাকে সুন্দর করে জামাটা পরিয়ে দিবে।তারপর সে আর আরাম ভাই মিলে সিদ্ধান্ত নিবে সে ঠিক কোন জামাটা কালকে পরবে।

তারা দু’জনেই যেতেই নবনীতা কটমট চোখে আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম তার চাহনি দেখেই ভড়কে গিয়ে বলল,’কি ব্যাপার?এমন করে দেখছ কেন?’

নবনীতা চোখের দৃষ্টি আগের মতো রেখেই চাপা কন্ঠে বলে উঠে,’কাল আমার রিসেপশন।কোথায় আমাকে তো একবারো বললেন না যে পরী তুমি যেই শাড়িটা পরবে সেটা একবার ট্রায়াল দিয়ে নাও।চিত্র কে ঠিকই বললেন।আমার রিসেপশন,অথচ আমি কি পরব না পরব সেটা নিয়ে আপনার কোনো চিন্তা নেই।চিন্তা হচ্ছে সব চিত্রকে নিয়ে।এজন্যই তো চিত্র আপনাকে এতো পছন্দ করে।এতো পেম্পার করলে কে না পছন্দ করবে?হুহ।দু’জনের ভাব দেখলে বাঁচি না।’

আরহাম ভ্রু দ্বয় টানটান করে প্রশ্ন করে,’সিরিয়াসলি?তুমি এতো হিংসুটে?আগে তো টের পাই নি।’

নবনীতা মুখ খিঁচে অন্যদিকে ফিরে।আরহাম সোফায় হেলান দিয়ে একহাতে নবনীতার কাঁধ জড়িয়ে ধরে।নবনীতা বাদে কেউ যেন শুনতে না পায় ঠিক এতোটাই নিচু স্বরে হিশহিশ করে বলে,’চলো রুমে চলো।তোমার সাথেও একটু ভাব জমাই।’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে