কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৮+৩৯

0
116

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৮)

গাড়িতে বসেই নবনীতা অস্থিরতা শুরু করল।বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছিল,’কোথায় যাচ্ছি আমরা?কি কাজ?বলুন না।’

আরহাম বিরক্ত হয়ে বলল,’একটু চুপ থাকবে তুমি?কখন থেকে কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করছ।তোমার ঘ্যান ঘ্যানে অতিষ্ঠ হয়ে মোতাহের এক্ষুনি এক্সিডেন্ট করে ফেলবে।’

নবনীতা সাথে সাথে চুপসে গেল।মন খারাপ করে জানালার দিকে মুখ ঘুরিয়ে আরহামের দিকে পিঠ করে বসল।আরহাম ক্লান্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।আবার রাগ হয়ে গেল নাকি?সে সামান্য এগিয়ে এসে নবনীতার ডান হাতের কবজি চেপে ধরল।ধরার সাথে সাথেই নবনীতা হাত ছাড়িয়ে নিল।

আরহাম একটু ঝুঁকে তার কাছে এলো।কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করল,’গাড়িতে কিন্তু মোতাহের আছে।তুমি কি চাও তার সামনেই আমি তোমার কোমর চেপে ধরি?’

নবনীতা আঁতকে উঠে পাশ ফিরে।দ্রুত ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।এক লাফে আরহামের পাশাপাশি এসে বসে।আড়চোখে একবার তাকে দেখেই বিড়বিড় করে বলে,’সেটা করলে কি একা আমার মানহানি হবে?’

‘না আমারও হবে।সেজন্যই তো করলাম না।’

আরহাম চুলে হাত দিয়ে সেগুলোকে টেনে টেনে একটু সেট করল।তারপরই হাত ঘড়িতে সময় দেখে হাই তুলতে তুলতে বলল,’চারটা তিন বাজে।যেতে যেতে সাড়ে পাঁচটা তো বাজবেই।’

তার ধারণা কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে গাড়িটা পাঁচটার কিছু সময় পরেই সাভারে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে গিয়ে পৌঁছাল।আরহাম খানিকটা চমকে উঠে বলল,’কি ব্যাপার! এতো দ্রুত আসলাম কীভাবে?’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে বলল,’আসবেনই তো।ভিআইপি ট্রানজিট ইউজ করলে সবাই সব জায়গায় সময়ের আগেই যায়।আপনি জানেন,এই আপনার একটা গাড়ির জন্য কতোগুলো গাড়িকে বসিয়ে রাখা হয়েছে?’

আরহাম কলার ঠিক করতে করতে বলল,’সো হোয়াট?এখন আবার বলো না যে এটাও অন্যায়।অবশ্যই আমরা ভিআইপি।নরমাল মানুষ আর আমরা কি এক কাতারে পড়ি নাকি?নরমাল মানুষের শত্রু হয় হাতে গোনা।আর আমাদের তো শত্রুর অভাব নাই।আমাদের এমন এক্সট্রা সিকিউরিটিতে থাকতে হয় সবসময়।এসব মেইনটেইন করেই পলিটিশিয়ানদের চলতে হয়।’

নবনীতা অন্যদিকে ফিরে ভেঙচি কাটে।বিদ্রুপ করে বলে,’আপনারা যে খুব ভালো মানুষ।এজন্যই শত্রুর অভাব নাই।’

‘এ্যাই তুমি কি বললে?’

নবনীতা জিভ কাটল।গাড়ি থেকে বের হতে হতে হড়বড় করে জবাব দিলো,’না তো।কিছু তো বলি নাই।’

গার্ডরা গাড়ি থেকে নেমে ঠিকঠাক অবস্থানে দাঁড়াতেই আরহাম আর নবনীতা গাড়ি থেকে নেমে এলো।নবনীতা সামনে তাকাতেই দেখল তারা একটা চাইল্ড হোমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

চাইল্ড হোমের সামনের মূল ফটকে গোটা গোটা অক্ষরে লিখা ‘বাটারফ্লাইজ অরফানেজ হোম’।নবনীতা মন দিয়ে নামটা পড়ল।তারপরই আরহামের সাথে পা মেলাতে মেলাতে বলল,’বাটারফ্লাই কেন?’

আরহাম ঠোঁট উল্টে বলল,’কে জানে! বাবা দিয়েছে এই নাম।আই হ্যাভ নো আইডিয়া ডার্লিং।’

‘এটা আপনার বাবার তৈরি চাইল্ড হোম?’

‘জ্বী।আমরা শুধু জনগণের টাকা মারি না।মাঝে মাঝে আমরা নিজেদের টাকায় জনগণের জন্য করিও।বুঝেছেন?’

আরহামের ভাবসাব দেখেই নবনীতা মুখ খিঁচিয়ে বলল,’হয়েছে হয়েছে।অমন ভালো রাজনীতিবিদ আপনার বাবার সময়টাতেই ছিল।এখনের গুলা সবই টাউট বাটপার।’

আরহাম দুই দিক দেখে দাঁতে দাঁত চেপে চাপা স্বরে বলল,’তাই নাকি?তা কি টাউটারি বাটপারি করেছি আমি?’

সে থামল।পরমুহূর্তেই দাম্ভিকতা দেখিয়ে বলল,’শোনো মেয়ে! আমরা জনগণের টাকা মেরে বড়লোক হয়নি।উই আর রিচ ফ্রম রুটস।খানদানি বড়লোক আমরা।বনেদি পরিবার বোঝ?বনেদি পরিবার থেকে বিলং করি আমরা।আমার দাদা,পরদাদা,পরদাদার পর দাদা-সবাই বড়লোক।আমরা রাজনীতি করি শখের বশে,ক্ষমতার আশায়।নয়তো রাজনীতিতে আমাদের আর কোনো কাজ নেই।জনগণের টাকা মা’রার প্রশ্নই আসে না।অলরেডি যা সম্পদ আছে,পরবর্তী চৌদ্দ প্রজন্ম বসে বসে খেতে পারবে।’

নবনীতা চোখ উল্টে একবার তাকে দেখে।যদিও সে ভুল কিছু বলে নি।বিয়ের পরে নবনীতা আরহামের অগোচরে তার শ্বশুরকে নিয়ে টুকটাক গবেষণা করেছে।রাজনীতিবিদ মানুষ।স্বভাবই নবনীতা কৌতূহলী ছিল এই নিয়ে।তবে তার গবেষণার ফলাফল তার অনুমানের চেয়েও ভালো এসেছে।শেখ আজিজ হোসেন সত্যিকার অর্থেই সৎ এবং নিষ্ঠাবান রাজনীতিবিদ ছিলেন।তাছাড়া রাজনীতিতে আসার আগেই তিনি ব্যবসায় প্রচুর নাম কুড়িয়েছেন।নবনীতার মাঝে মাঝে মনে হয় সে তাকে বাস্তবেও কোনো এক সময় দেখেছিল।অসম্ভব কিছু তো না।তাদের বাড়িতে প্রায়শই বিভিন্ন বড় বড় ব্যবসায়ীরা আসতো তার বাবার সাথে দেখা করতে,কথা বলতে।আজিজ হোসেন তাদের মাঝে একজন হলেও হতে পারেন।

সে চুপচাপ আরহামের পাশাপাশি হেঁটে ভেতরে প্রবেশ করল।চারদিকে চোখ বুলিয়ে পুরো নিচতালা দেখে নিল।নিচ তালায় মূলত বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য স্কুল রুমের ব্যবস্থা করা হয়েছে কয়েকটা।একেবারে দক্ষিণ দিকে বড়োসড়ো একটা রান্নাঘর।সেখানে সবার জন্য এটা সেটা রান্না করা হয়।দোতালা আর তিনতালায় বাচ্চারা থাকে।চারতালা পাচতালা স্টাফদের রুম আর অফিস রুম।

আরহাম ভেতরে এসেই নবনীতাকে বলল,’আমি চার তালায় যাচ্ছি।এসব বাচ্চাকাচ্চার ঘ্যানঘ্যানানি ভালো লাগে না আমার।তুমি তো নিচেই থাকবে তাই না?’

নবনীতা জোরে জোরে উপরনিচ মাথা নাড়ে।প্রয়োজনের চেয়েও উঁচু স্বরে বলে,’অবশ্যই অবশ্যই।’

আরহাম হালকা করে ধমক দিয়ে বলল,’আস্তে কথা বলো।মেয়ে মানুষ এতো জোরে কথা বলে?’

নবনীতা মুখের উপর একহাত রাখল।কন্ঠ খাদে নামিয়ে ফিসফিস করে বলল,’সরি সরি।আর হবে না।’

আরহাম হনহনিয়ে ধুপ ধাপ পা পেলে উপরে চলে গেল।যাওয়ার আগে গার্ড একজন কে ডেকে বলল,’তোমার ম্যামের আশেপাশেই থেকো।’
যদিও আজ সে খুব বেশি চিন্তিত না সিকিউরিটির বিষয়ে।এই এলাকা পুরোটাই তার নিয়ন্ত্রণে।এখানে ঝামেলা বাধানোর মতো দুঃসাহস কেউ করবে না।

সে যেতেই নবনীতা হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।এই লোক সাথে থাকলেই সারাক্ষণ তাকে অবজেকশনের উপর রাখে।এর চেয়ে সাথে না থাকাই ভালো।

সে শাড়ির কুচি সামলে দোতালায় উঠে।দোতালায় আসতেই বাচ্চাদের চিৎকার চেঁচামেচি আর ছুটোছুটির আওয়াজে তার মন ভালো হয়ে গেল।সে ছুটে গেল ভেতরের দিকে।

দোতালায় মোট ষোলো টা রুম।প্রতিটা রুমে ছয়টা করে খাট।প্রতি খাটে দুই জন ঘুমায়।নবনীতা একে একে সবগুলো ঘরে উঁকি দিলো।কিছু কিছু ঘর একদম ফাঁকা।কিছু ঘরে আবার প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত মানুষ।বাচ্চারা সব নানারকমের খেলায় ব্যস্ত।কেউ আবার আরামে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে।

নবনীতা একটা ঘরে উঁকি দিয়েই বেড়ালের মতো গলায় ডাকল,’ম্যাও ম্যাও।কেউ কি আছে?’

ঘরভর্তি বাচ্চারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে।নবনীতা এতোগুলো মিষ্টি মুখ একসাথে দেখেই হেসে ফেলল।অনেক গুলো উৎসুক চোখ অবাক হয়ে আগাগোড়া তাকে পরোখ করে যাচ্ছিল।নবনীতা ধীর পায়ে ভেতরে এলো।উচ্ছ্বাস মাখা কন্ঠে বলল,’আমি বসি তোমাদের সাথে?কি খেলছ তোমরা?’

বাচ্চারা শুরুতে একটু কপাল কুঁচকায়।এতো বড়ো মেয়ে তাদের সাথে খেলবে?সে খেলা জানে?তারা কেউ শুরুতে তার কথা গায়ে মাখল না।ইশারায় বোঝাল এতো বড়ো মেয়ের সাথে তারা খেলবে না।

নবনীতা শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুজে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,’কি হলো?পছন হয়নি আমাকে?’
.
.
.
.
শুভ্রার কেমিস্ট্রি প্রাইভেট থাকে বিকেলে।সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু সামনে যেতেই টয়োটার কালো গাড়িটা ঠিক তার সামনে এসে থামল।সে প্রথমে একটু চমকাল।তারপরই চট করে গাড়ির মালিককে চিনে নিল।আরিশ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে তাকে দেখে বলল,’শুভ্রা! ভাইয়া কি এখনো তোমাদের বাসায়?’

শুভ্রা মাথা নাড়ল।নম্র স্বরে বলল,’না ভাইয়া।ভাইয়া তো আরো আগেই বের হয়েছে আপাই কে সাথে নিয়ে।’

ভাইয়া?কেন যেন ডাকটা মনঃপুত হলো না আরিশের।সে কিছুটা মনঃক্ষুন্ন হলো।গমগমে স্বরে বলল,’ওহ আচ্ছা।ভাইয়ার সাথে একটা কাজ ছিল।’

বলেই সে দ্রুত গাড়ির গ্লাস তুলল।শুভ্রা মাথার ওড়না টেনে ঠিকঠাক মতো দিয়ে চুপচাপ সামনে এগিয়ে গেল।এই বড়লোক এলাকায় রিকশা চলে না।রিকশার জন্য তাকে অনেকটা পথ হাঁটতে হয়।একটু সামনে যেতেই কালো গাড়িটা আবার তার পাশাপাশি এসে থামল।শুভ্রা কৌতূহলী হয়ে পাশ ফিরল।আরিশ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে নিরেট স্বরে বলল,’এসো তোমায় ড্রপ করে দেই।’

তার কন্ঠ কিছুটা অন্যরকম শোনাল।তার চোখ দু’টো রোদচশমার আড়ালে লুকানো।তার অভিব্যক্তি শুভ্রা ঠিক মতো বুঝতে পারছে না।সে জোরপূর্বক সামান্য হেসে বলল,’না না ভাইয়া।আমি চলে যেতে পারব।আপনি কেন আবার ঝামেলা করছেন?’

‘আমি তোমাকে বলেছি আমার ঝামেলা হচ্ছে?’ অত্যন্ত ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করল আরিশ।

শুভ্রা থতমত খেয়ে তার দিকে তাকাল।কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসল।তার কেমিস্ট্রি প্রাইভেটে যেতে সময় লাগে প্রায় আধঘন্টার মতো।ঝিগাতলায় তার কোচিং সেন্টার।আরিশ ঠিক তার কোচিং-এর সামনে এসে ব্রেক কষল।শুভ্রা আশ্চর্য হয়ে বলল,’আপনি কেমন করে জানলেন আমার কোচিং এই বিল্ডিংয়েই?’

আরিশের মন চাইল নিজেই নিজেকে কতোক্ষণ জুতোপেটা করতে।তার কি মাথায় ন্যুনতম বুদ্ধি নেই?সে কোন বুঝে গাড়িটা ঠিক জায়গা মতো এনে থামাল?সে কতোক্ষণ দুই হাত কচলায়।শেষে আমতা আমতা করে বলল,’না মানে এই এলাকায় তো খুব বেশি বিল্ডিং নেই।যেই কয়টা আছে সবই মানুষের থাকার বাসা।এটা দেখে মনে হলো কোচিং থাকলে এটাতেই থাকবে।তাই আরকি।অন্য কিছু না।’

শুভ্রা কিছু একটা বুঝে ফেলার মতো করে মাথা নাড়ল।তারপরই আরিশকে একটা ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা সরূপ একগাল হাসি উপহার নিয়ে দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে এলো।সে নামতেই আরিশ কতোক্ষণ স্টিয়ারিংয়ে মাথা ঠুকল।ভাইয়া ঠিকই বলে।তার মতো গর্দভ আর ব্রেইনলেস এই শহরে কমই আছে।

কোচিং সেন্টারের দরজায় তালা ঝুলানো দেখতেই কপালে ভাঁজ পড়ল শুভ্রার।সে দারোয়ান চাচার কাছে এগিয়ে এসে বলল,’চাচা কোচিং এর দরজা এখনো খুলেননি কেন?সময় তো হয়ে গেছে।’

দারোয়ান লোকটা হাই তুলতে তুলতে অলস ভঙ্গিতে বলল,’লোকমান স্যার আজ পড়াবেন না।কলেজের জরুরি মিটিংয়ে আটকে গেছে।বলেছে আজকের ক্লাস কালকে হবে।’

শুভ্রা চোখ বড় বড় করে বলল,’কালকে হবে মানে?এই কথা আগে জানাবে না স্যার?’

‘আমি কি জানি?আমাকে বলল যারা যারা আসবে তাদের জানিয়ে দিতে।’

শুভ্রা মন খারাপ করে বলল,’ধ্যাত।স্যার সবসময় এমন করে।আমাদের তো দূর থেকে আসতে হয়।একটু আগে জানালে ক্ষতি কি?’

সে বিক্ষিপ্ত মেজাজে কোচিং সেন্টার থেকে বেরিয়ে বিল্ডিংয়ের সামনে এসে দাঁড়াল।আরিশ মাত্রই তার গাড়ি স্টার্ট দিয়েছিল।শুভ্রাকে বিল্ডিংয়ের সামনে দেখেই সে দ্রুত গ্লাস নামিয়ে চমকে উঠে বলল,’কি ব্যাপার?তুমি নেমে আসলে কেন?’

শুভ্রা এগিয়ে যায়।বিরক্ত হয়ে বলে,’আর বলবেন না ভাইয়া।আজ নাকি স্যার পড়াবেন না।দারোয়ান চাচা এইমাত্র জানাল আমাকে।’

আরিশ মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলল,’ওহ আচ্ছা।ব্যাপার না।চলো তোমাকে আবার বাড়ি পৌঁছে দেই।’

শুভ্রা ব্যস্ত ভঙ্গিতে হাত নাড়ল।তাড়াহুড়ো করে বলল,’না না ভাইয়া।প্লিজ।আপনাকে আর কষ্ট করতে হবে না।’

আরিশ শীতল চোখে তাকে দেখে।তারপরই মাত্রাতিরিক্ত ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠে,’সমস্যা নেই।উঠো।’

শুভ্রা বোকা বোকা হেসে গাড়িতে উঠে বসল।সিটবেল্ট বাঁধতে বাঁধতে বলল,’আসলে আমার না গাড়ি ভালো লাগে না।সেজন্য চড়তে চাই না।’

‘গাড়ি ভালো লাগে না?স্ট্রেঞ্জ! তাহলে কি ভালো লাগে?’

‘রিকশা।আমি,আপাই আর চিত্রা মাসের শুরুতে আপাই বেতন পেলে রিকশা তে করে ঘুরতাম।ঐ কথায় আছে না?রিকশার মতো শৌখিন যান আর একটিও নেই।আমাদেরও হয়েছে সেই অবস্থা।রিকশার মতো মজা আর কিছুতেই পাই না।’

আরিশ গাড়ি চালানোর ফাঁকে একবার তাকে দেখল।সে শান্তভাবে কথা বলতে পারে না।কথা বলার সময় অনবরত দুই হাত নাড়ে।এটা অবশ্য আরিশের ভালোই লাগে।সে একগাল হেসে বলল,’তা অবশ্য ঠিক।রিকশায় চড়ার মজাই আলাদা।’

রবীন্দ্র সরোবরের সামনে এসেই আরিশ তার গাড়ির গতি কমালো।চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে পাশ ফিরে শুভ্রাকে দেখেই বলল,’আইসক্রিম খাবে শুভ্রা?’

শুভ্রার মন চাইছিল জোরে জোরে দশবার উপরনিচ মাথা নেড়ে বলতে,’হ্যাঁ ভাইয়া।অবশ্যই খাবো।কেন খাব না?এক্ষুণি কিনে আনুন।’

কিন্তু সেটা সম্ভব না।আপাইয়ের দেবরকে এমন করে বলাটা ভালো দেখায় না।সে মাথা নেড়ে বলল,’না ভাইয়া,খাব না।’

বলার পরেই সে মনে মনে দোয়া করল,’আল্লাহ প্লিজ।আবার যেন খাওয়ার জন্য সাধে।প্লিজ আল্লাহ!’

আরিশ আবারো বলল,’খাও না।এদিকে একটা আইসক্রিম পাওয়া যায়।খুব মজা।তুমি খেলে আমিও একটা খেতাম।’

শুভ্রা মিনমিনে স্বরে কোনোরকমে বলে,’না না ভাইয়া।দরকার নেই।’
ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ চটে আছে।সে মনে মনে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’এতো খাওয়ানোর ইচ্ছে হলে বাইরে গিয়ে কিনে আন না বাপ।এতোবার জিজ্ঞেস করছিস কেন?গিয়ে দু’টো কিনে আনলেই তো পারিস।’

আরিশ সিটবেল্ট খুলতে খুলতে সহজ গলায় বলল,’দাঁড়াও আমি দু’টো নিয়ে আসছি।’

শুভ্রা সাথে সাথে নিজের মুখ চেপে ধরে।কি সর্বনাশ! এই লোকটি অন্তর্যামী নাকি?তার মনের কথা শুনে নিল নাকি কোনোভাবে?কি ভয়ানক ব্যাপার সেপার!

আরিশ কয়েক মিনিট বাদেই দুই হাতে দুই আইসক্রিম নিয়ে ফিরল।গাড়িতে বসেই একটা আইসক্রিম শুভ্রার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে হাসি মুখে বলল,’খেয়ে দেখ তো কেমন?’

শুভ্রা একটু খেয়েই বলল,’ভীষণ ভালো।’

বিনিময়ে আরিশ কেবল প্রশস্ত হাসল।সে হাসিমুখেই টুকটাক কথা বলতে বলতে আইসক্রিম খাওয়া শেষ করল।শুভ্রা তার আইসক্রিমটা শেষ হতেই পাশ ফিরে ঝলমলে হেসে বলল,’থ্যাংক ইউ ভাইয়া।আইসক্রিম টা সত্যিই অনেক মজা।’

মুহূর্তেই মুখের হাসি মিলিয়ে গেল আরিশের।সব তো ঠিকই ছিল।মাঝখানটায় এই ভাইয়া এলো কোথা থেকে?এতো সুন্দর সুন্দর কথার মাঝে এই ভাইয়াটা কোথা থেকে ঢুকে পড়ল?সে দ্রুত গাড়ি স্টার্ট দেয়।মেজাজ যা একটু ফুরফুরা হয়েছিল,এক ভাইয়া শব্দে সব ভেস্তে গেল।

***

আরহাম হিসাবের খাতায় দ্রুত চোখ বুলায়।বাবার মৃ’ত্যুর পর সে ই চাইল্ড হোমের সবকিছু দেখাশোনা করে।তার বাবার খুব শখের প্রতিষ্ঠান এটি।এই চাইল্ড হোমের অসংখ্য বাচ্চাকে তিনি নিজে পরম স্নেহে মানুষ করেছেন।তার উপার্জনের একটা বিরাট অংশ তিনি চাইল্ড হোমের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করেছেন।আরহাম সপ্তাহে কিংবা মাসে একবার হলেও এখানে আসে,সবকিছু তদারকি করে যায়।

হঠাৎই তার আজ মনে হলো তার বউ প্রচন্ড বাচ্চা পাগল।এমন জায়গায় সবচেয়ে বেশি আনন্দ নবনীতাই পাবে।তাই সে আজ তাকে এখানে নিয়ে এসেছে।বাচ্চাকাচ্চার প্যা পু কিভাবে একটা মানুষের কাছে আনন্দের হতে পারে আরহাম জানে না।তার বাবারও এসব পছন্দ ছিল।তার বউয়েরও এসব পছন্দ।মাঝখানটায় তারই এসব আদিখ্যেতা ভালো লাগে না।নিজের উপর সে নিজেই হতাশ।বাবা তার আদর্শ।অথচ বাবার ভালো কোনো বৈশিষ্ট্যই তার ভেতর নেই।

নিচ থেকে বাচ্চাদের কোলাহল শোনা যাচ্ছে।সেই আওয়াজ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে তিড়তিড় করে বাড়ছে।আরহাম বিরক্ত হয়ে ফাইল থেকে চোখ সরায়।তিরিক্ষি মেজাজে ধমকে উঠে,’কি শুরু করেছে এই বাচ্চাগুলো?এটা কি চিড়িয়াখানা?কেউ এদের থামাও।’

তার কথা শুনেই চাইল্ড হোমের একজন স্টাফ খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’আসলে স্যার।ম্যাডামই বাচ্চাদের নিয়ে নিচে নেমেছে খেলার জন্য।আমরা তাই কিছু বলিনি।’

আরহাম সাথে সাথে হাতের ফাইলটা টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ায়।দ্রুত পায়ে হেঁটে যায় রুমের খোলা জানালার দিকে।জানালার ধারে একহাত রেখেই নিচে উঁকি দেয়।দেখতে পায় নবনীতা ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে চাইল্ড হোমের সামনের বিরাট মাঠটায় কি যেন খেলছে।কিছুক্ষণ দেখতেই সে বুঝল খেলাটার নাম কানামাছি।নবনীতা এ’মাথা ঐ’মাথা ছুটছে আর একটু পর পর খিলখিল করে হাসছে।বাচ্চারাও তার পিছু পিছু ছুটছে।কেউ আবার আধো আধো বুলিতে তাকে ডাকছে।এই দৃশ্য দেখতেই আরহামের ঠোঁটে হাসি ফুটল।কি চমৎকার দেখাচ্ছে তাকে! কি অভূতপূর্ব এই দৃশ্য! নবনীতা এক পর্যায়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ঘাসের উপর শুয়ে পড়ল।তারপরই দু’টো ঘাসফুল ছিঁড়ে হাতের মুঠোয় নিল।আরহাম বুকে হাত বেঁধে সে দৃশ্য দেখল।মেয়েটা কি জানে যে সে নিজেই একটা ফুল?

আরহাম চুপচাপ সমস্ত কাজ ফেলে নিচে নেমে এলো।নামতেই দেখল বাচ্চারা মিলে খিলখিল করে হাসতে হাসতে নবনীতার চোখ বেঁধে দিচ্ছে।নবনীতা হাসিমুখ করে বলছে,’আস্তে আস্তে।এতো জোরে কেউ বাঁধে?মাথা ব্যথা হয়ে যাবে আমার।’

তার চোখ বাঁধার পরে একটা বাচ্চা তিন আঙুল সামনে তুলে বলল,’বলো তো কয়টা আঙুল সামনে?’

নবনীতা আন্দাজে বলল,’উমম,তিনটা।’

সাথে সাথে বাচ্চাগুলো চেঁচিয়ে উঠল।হাত পা ছুড়ে বলল,’তুমি চিটিং করেছ।হবে না হবে না।’

নবনীতা কপাল চাপড়ে হতাশ হয়ে বলল,’আরে বাবারে চিটিং করলে কি ঠিকটা বলতাম?না দেখে বলেছি বলেই তো ঠিকটা বলে ফেলেছি।’

বাচ্চারা তার কথা বিশ্বাস করল না।তারা আরো শক্ত করে তার চোখ বাঁধলো।শেষটায় যখন নিশ্চিত হলো সে আসলেই চোখে দেখছে না তখন দুই তিন পাক ঘুরিয়ে তাকে এক ধাক্কা দিয়ে সামনে ছেড়ে দিলো।এই মেয়েটাকে তাদের ভীষণ ভালো লেগেছে।মেয়েটা কতো সুন্দর করে তাদের সাথে খেলা করছে! সে তাদের বলেছে আজ রাতেও সে এদিকে থাকবে।রাতভর লুকোচুরি খেলবে।ইশশ! ভাবতেই তো আনন্দ হচ্ছে তাদের!

নবনীতা দুই দিকে হাত ছড়িয়ে হাতড়ে হাতড়ে আনমনে এদিক সেদিক ছুটে যায়।বাচ্চারা তাকে একটু ছুয়েই অন্যদিকে ছুটে পালায়।আরহাম একটু একটু করে তার দিকে এগিয়ে যায়।একপর্যায়ে একেবারে তার মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়।নবনীতা তার আশেপাশে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই সাথে সাথে শক্ত করে জাপ্টে ধরল তাকে।ধরতেই তার মুখের হাসি গায়েব হলো।সে একহাত আরহামের পিঠে রেখেই খানিকটা বিচলিত হয়ে বলল,’কে?’

আরহাম তার একহাত নবনীতার শাড়ি গলিয়ে তার কোমরে গিয়ে রাখল।নবনীতা আঁতকে উঠে কাঁপা স্বরে বলল,’আরহাম?’

আরহাম অতি সন্তর্পণে তার শাড়িটা কোমর থেকে পিঠ পর্যন্ত তুলে দিলো।নিজেদের দূরত্ব আরো বেশি কমিয়ে নিয়ে গম্ভীর মুখ করে বলল,’আমি ছাড়া তোমায় আর এমন করে কে ধরবে পরী?অবশ্যই এটা আমি।’

নবনীতা লজ্জাবতী গাছের মতো মিইয়ে গিয়ে অতিশয় ক্ষীণ কন্ঠে বলল,’ছাড়ুন না।বাচ্চারা দেখছে তো।’

আরহাম গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’দেখুক।আমার কি?বউকে ধরা কি কোনো পাপ নাকি?’

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৯)

অফিস রুমে এসেই নবনীতা অস্থির হয়ে পাশ ফিরে বলল,’আপনি থাকুন না এদিকে।আমি নিচে যাই প্লিজ।’

আরহাম শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে বিরক্তি মেশানো কন্ঠে বলল,’চুপচাপ আমার সাথে থাকতে বলেছি না?এতো কথা বলছ কেন?’

নবনীতা তার চেয়েও দ্বিগুণ বিরক্তিতে মুখ কুঁচকায়।তাকে অফিস রুমে আনার কি দরকার ছিল?সে কি এখানকার বস নাকি কর্মচারী?শুধু শুধু তাকে চারতালা উপরে এনেছে।

একটু পরেই একজন কর্মচারী তার সাথে তার কোলে করে একটি ছোট্ট বাচ্চাকে সাথে নিয়ে অফিসে এলো।বাচ্চাটার পরনের জামা দেখে বোঝা যাচ্ছে সে একজন ছেলে।বয়স নবনীতা খোলা চোখে অনুমান করল-দুই।বাচ্চার চোখ দু’টো গাঢ় খয়েরি রঙের।

নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলে,’এটা কে?’

আরহাম তার পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়।দুই হাত বগলদাবা করে গম্ভীর হয়ে বলে,’ওর নাম আরশাদ।আসাদের ছেলে।আসাদকে তো নিশ্চয়ই চেনো।সেদিন তোমাকে সিকিউরিটি দিতে গিয়ে তার নিজের জীবন সেক্রিফাইস করতে হয়েছিল।’

নবনীতা ব্যথিত চোখে সামনে তাকায়।এই বাচ্চাটার বাবা নেই?এইটুকু বয়সেই সে এতিম?কি যন্ত্রণাময় হতে যাচ্ছে তার বাকি জীবনটা! বাবা ছাড়া জীবন কেমন সেটা নবনীতার চেয়ে ভালো আর কে জানে?

আরহাম একটু দম নিয়ে বলল,’আসাদের ওয়াইফ ডেলিভারির সময়ই মা’রা গিয়েছিল।তারপর এই ছোট্ট বাচ্চাটা তার কাছেই বড় হচ্ছিল।হি ওয়াজ অ্যাবসোলুটলি আ স্টানিং ম্যান।কিন্তু তার মৃ’ত্যুর পর আরশাদের পৃথিবীতে মা আর বাবা বলতে আর কিছুই রইল না।আসাদের মৃ’ত্যুর পরই এই বিষয়ে আমি জানতে পারি।তারপর খবর নিয়ে জানলাম তার দাদা বাড়িতেও এমন কেউ নেই যে তার দায়িত্ব নিবে।তাই আমরা তাকে এখানে নিয়ে এসেছি।’

মুহূর্তেই শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল নবনীতার।চোখ জোড়া হঠাৎই সেকেন্ডের ব্যবধানে ভিজে ওঠল।সেই আর্দ্র চোখেই সে সামনে থাকা বাচ্চা ছেলেটাকে দেখে।কি নিষ্পাপ মুখটা! তার কেউ নেই।নবনীতার মতো সেও ভীষণ একা।তার বাবাকে খু’ন করা হয়েছে।সেই খু’নের সাখে নবনীতা কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছে।কোনো না কোনোভাবে এই বাচ্চাটার সর্বহারা হওয়ার পেছনে নবনীতা দায়ী।কি যন্ত্রণাময় সে অনুভূতি!

সে এগিয়ে এসে আরশাদ নামের সেই ছোট্ট ছেলেটিকে দুই হাতে আগলে ধরে।একটানে নিজের কোলে এনেই কয়েকটা চুমু খায়।বাচ্চাটা এতো আদুরে কেন?সব বাচ্চাই আদুরে।তবে এই বাচ্চাটাকে নবনীতার কেন যেন বেশিই মায়া লাগছে।সে তাকে নিজের সাথে কতোক্ষণ শক্ত করে জড়িয়ে রাখল।মাথায় হাত বুলিয়ে ইচ্ছে মতো আদর দিলো।সাধারণত ছেলে বাচ্চা গুলো হয় ভীষণ দুষ্টু।অথচ আরশাদ নামের এই বাচ্চাটি বয়সের তুলনায় অতি মাত্রায় শান্ত।এই পুরোটা সময়ে সে একটি বারের জন্যও কাঁদলো না।কেবল ছোট ছোট চোখের পাতা ফেলে বার কয়েক নবনীতাকে মনোযোগ দিয়ে দেখল।

আরহাম হাতঘড়ি তে সময় দেখতেই ব্যস্ত হয়ে বলল,’চলো পরী।আমরা এখন বের হই।ভালোই সময় হয়েছে।’

নবনীতা সিক্ত চোখে তার দিকে তাকায়।আরশাদ তখনও তার বক্ষে চুপটি করে শান্ত বাচ্চাদের মতো ঘাপটি মেরে পড়েছিল।নবনীতা হঠাৎই বাড়াবাড়ি রকমের অনুনয় করে বলল,’আরহাম আমি আরশাদকে আমার সাথে রাখি প্লিজ?প্লিজ আরহাম,মানা করবেন না।আমি আর কখনো আপনার কাছে কিছু চাইব না।প্লিজ প্লিজ প্লিজ।’

আরহাম তব্দা খেল এক কথাতেই।এক প্রকার বিষম খেয়ে বলল,’কি?সাথে রাখবে মানে?এটা আবার কেমন কথা?’

‘সাথে রাখব মানে আরশাদ এখন থেকে আমাদের সাথেই থাকবে।আমি তাকে সবসময় নিজের কাছে রাখতে চাই।’

নবনীতা পুরো কথা গুছিয়ে শেষ করার আগেই আরহাম এক ছুটে তার কাছে এসে ছো মেরে আরশাদকে তার কাছ থেকে নিজের কাছে আনল।তারপরই সে তাকে অন্য স্টাফদের নিকট কোনো রকমে হস্তান্তর করে নবনীতার একহাত চেপে কড়া গলায় বলল,’চলো।দেরি হচ্ছে আমাদের।এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে তুমি আরো পা’গল হয়ে যাবে।’

নবনীতা জেদ ধরল আবারো।আরহামের সাথে পা মেলাতে মেলাতেই বলল,’প্লিজ আরহাম।এইটুকু একটা বাচ্চা।এসব চাইল্ড হোমে সে কেমন করে থাকবে?আসাদের এই পরিনতির জন্য কোনো না কোনোভাবে আমি দায়ী।আমি কিছুটা হলেও তার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে চাই।সামান্য পরিমান হলেও একটা প্রতিদান দিতে চাই।প্লিজ আরহাম!’

আরহাম সেই কথায় বিন্দু পরিমান কর্ণপাত না করে চুপচাপ বড় বড় পা ফেলে গাড়িতে উঠল।নবনীতা ব্যথিত হলো,সেই সাথে অপমানিত বোধ করল প্রচন্ড।আত্মসম্মানে লাগল খানিকটা।এমন এড়িয়ে যাওয়ার বিষয়টা তার গায়ে লেগেছে।তার মন খারাপ করাটা বাড়াবাড়ি কিছু না।সে ঠিক করেছে পুরো গাড়ি সে আর কোনো কথা বলবে না।তার কথার যখন কোনো দামই নেই,তখন বকবক করে সে খামাখা শক্তি অপচয় করবে কেন?

আরহাম তার পেঁচার মতো মুখটা দেখেই গজগজ করে বলল,’মোতাহের স্টেশনে চলো।’

মোতাহের থতমত খেয়ে বলল,’জ্বী স্যার?কোথায় যাব?’

‘স্টেশন।রেলস্টেশনে যাব আমরা।’
আরহাম কথা শেষ করেই নবনীতার দিকে তাকায়।যার সমস্ত মনোযোগ জানালার অন্যপাশে।চোখ জোড়া একনাগাড়ে শুধু বাইরের দৃশ্যই দেখে যাচ্ছে।আরহাম কাঠখোট্টা স্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’আমরা সেখানে গিয়ে সব এতিম বাচ্চাদের ধরে ধরে নিজেদের বাসায় নিয়ে আসব।এসে পেলে পেলে বড় করব।তারপর আমরা পুরো শহরের সব এতিম বাচ্চাদের নিয়ে আসব নিজেদের ঘরে।পেলে পুলে বড় করে তারপরই থামব।কারণ এদের দেখলে আমাদের খুব মায়া হয়।আমাদের মনের ভেতর এতো মায়া যে সেই মায়া মনের মতো ছোট্ট জায়গায় আর জায়গা হচ্ছে না।সেই অবশিষ্ট মায়া এখন আমাদের ব্রেইনে জায়গা নিয়েছে। আমরা শুধু আবেগ দিয়ে ভাবি।বিবেক?সেটা আবার কি?খায় না পিন্দে?’

আরহাম থামল।অপরপক্ষ অতিশয় শান্ত।ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দেওয়া তো দূর,পুরোটা সময়ে একটু নড়ল পর্যন্ত না।আরহাম ফুঁসতে ফুঁসতে একহাতে তার বাহু চেপে কটমট করে বলল,’এ্যাই পরী এদিকে তাকাও।আমার কথার উত্তর দাও।’

নবনীতা সাথে সাথে পাশ ফিরল।বিরক্ত গলায় বলল,’কি উত্তর দিব?স্টেশনের বাচ্চা আর আরশাদ তো এক না।আরশাদের এই পরিনতির পেছনে কোনো না কোনো ভাবে আমি জড়িয়ে আছি।তাকে সবার সাথে মেলাচ্ছেন কেন?’

‘আচ্ছা মেলাব না।তাই বলে তুমি তাকে বাড়ি নিয়ে আসবে?কোথায় রাখবে তাকে?তুমি নিজেও তো অসুস্থ।তাছাড়া এখানে আরশাদ যথেষ্ট যত্নের মাঝে থাকবে।কি দরকার শুধু শুধু বাড়ি এনে ঝামেলা বাড়ানোর?’

নবনীতা ব্যথিত নয়নে তার দিকে তাকায়।মলিন মুখ করে বলে,’ঝামেলা আরহাম?এইটুকু একটা বাচ্চা ঝামেলা হয়ে গেছে?এতোই ঝামেলা যে আপনি তাকে বাড়ি আনার কথা শুনেই এমন তাড়াহুড়ো করে সেখান থেকে ফিরে এলেন?’

আরহাম মহাবিরক্ত হয়ে বলল,’ধুর অতোকিছু বুঝি না।আমি তোমার মতো মহামানব নই।এমন কি আমি সুইট পার্সনের কাতারেও পড়ি না।এসব যার তার জন্য আবেগ কাজ করে না আমার।কি করার আছে বলো?হোয়াট টু ডু নাও?আমি এমনই।আল্লাহ এভাবেই বানিয়েছে আমাকে।’

‘মিথ্যা কথা।আল্লাহ সবাইকে ভালোভাবেই বানায়।দুনিয়াতে আসার পর মানুষ হয় ভালো হয়,নয়তো খারাপ হয়।’

‘ঐ আরকি।এক ই কথা।আমি খারাপ মানুষ।হয়েছে তোমার?অদ্ভুত বিষয় পরী! আরশাদের কথা তুমি জানতে পর্যন্ত না।আমিই তার খোঁজ নিলাম।তাকে তুমি পর্যন্ত পৌঁছালাম।তার ভবিষ্যতের জন্য ভাবলাম।তুমি সেসবের কিছু দেখলে না।তুমি পড়ে আছ কেন তোমাকে তাকে সাথে আনতে দেই নি এই নিয়ে।আরে বাবা সবকিছুতে এতো আবেগ দেখালে হয় না।এমন করতে থাকলে একসময় দেখবে আমাদের বাড়িটা আর বাড়ি থাকবে না,ছোটখাটো চাইল্ড হোম হয়ে যাবে।পৃথিবীতে অনেক বাচ্চাই মা বাবা ছাড়া বড়ো হচ্ছে।এখন আমরা কি তাদের সবাইকে নিজ হাতে বড়ো করতে পারব?এটা হয় না পরী।বি প্র্যাকটিক্যাল।’

নবনীতা তার দিকে না ফিরে পুনরায় বাইরের দিকে চোখ নেয়।মেয়েরা যুক্তিতে হেরে গেলে রেগে যায়।সে নিজেও রেগে আছে প্রচন্ড।কারণ আরহামের যুক্তি খন্ডন করার মতো উপযুক্ত কোনো জবাব তার কাছে নেই।এই কারণে তার মেজাজ আরো বিগড়ে আছে।মন চাইছে টেনে টেনে আরহামের সব কয়টা চুল ছিঁড়তে আর চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে,’ঐ বেটা,এতো যুক্তি দেস কেন?এতো কিছু শুনতে চেয়েছি আমি?’

অথচ সে কিছুই বলল না।ভাব দেখাল যে সে কিছু শুনতেই পায়নি।আরহাম শীতল চাহনিতে একবার তাকে দেখে।তারপরই একেবারে জানালার কাছাকাছি গিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে আনমনে স্ক্রল করা শুরু করে।অনেক হয়েছে।এই মেয়েকে অতিরিক্ত পাত্তা দেওয়াই তার ভুল হয়েছে।এখন সে আর ফিরেও তাকাবে না।যা খুশি করুক।তার কি?তারও প্রেসটিজ আছে।তারও রাগ হয়,জেদ হয়।

নবনীতার এপার্টমেন্টের সামনে গাড়ি এসে থামতেই আরহাম ফোনের স্ক্রিনে আরো মনোযোগী হয়ে দৃষ্টি রাখল।সে তাকাবেই না বামপাশে।নিজে নিজে গাড়ি থেকে নেমে চলে যাক।তার তাকানোর কি আছে?

নবনীতা বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকায়।এই লোক কি অন্ধ নাকি?দেখছে না বাড়ি চলে এসেছে?তাহলে নামছে না কেন?সে কতোক্ষণ নিজে নিজে ছটফট করল।কতোক্ষণ শাড়ির আঁচলের একমাথা নিজের আঙুলে প্যাচালো।শেষে কিছুটা অধৈর্য হয়ে বলল,’বাড়ি এসে গেছে।দেখেছেন?’

আরহাম ফোন চালাতে চালাতেই জবাব দেয়,’হু।দেখেছি।’

‘তাহলে?নামছেন না যে?’

‘স্ট্রেঞ্জ! আমি কেন নামব?তোমার ফ্ল্যাট,তুমি নামো।’

নবনীতা বেশ খানিকটা চমকাল।হতবাক কন্ঠে বলল,’আমি নামব?’

অন্য দিক থেকে গুরুগম্ভীর কন্ঠে জবাব এলো,’হুম।’

নবনীতা একবার শান্ত চোখে তাকে দেখল।তারপরই গাড়ির দরজা খুলে হনহনিয়ে বেরিয়ে এলো।তারপর ইচ্ছেকৃতভাবে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি শব্দ করে দরজাটা বন্ধ করল।আরহাম ফোন চালানোর মাঝেই শব্দ করে হাসল।বিড়বিড় করে বলল,’বেয়াদব একটা।যত কিছুই হোক,তেজ কমে না।’

নবনীতা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতেই সে সামনে ফিরে তাড়া দিলো,’চলো মোতাহের।বাড়ি চলো।’

নবনীতা ধুপধাপ পা ফেলে লিফটে উঠল।সে এখনো বুঝতে পারছে না রাগটা আসলে কে করেছে।সে চুপচাপ গাড়িতে বসেছিল।আরহামের হঠাৎ কি হলো?সে এমন ভাব ধরেছে কেন?নবনীতা বন্ধ লিফটের ভেতরই দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’বউ রাগ করলে কোথায় রাগ ভাঙাবে।আর বেয়াদবটা নিজেই রাগ করে বসে আছে।ধ্যাত!’

সে বাড়ি গিয়ে তাড়াতাড়ি শাড়ি পাল্টে ঢিলেঢালা কাপড় পরল।চিত্রা তখন শুভ্রার সাথে বসার ঘরে বসে কিসব কার্টুন নিয়ে আলাপ করছিল।নবনীতা বাতি নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকল কতোক্ষণ।চোখ বন্ধ করলেই আরশাদ বাচ্চাটার মুখটা মনে পড়ে।সে হাতড়ে হাতড়ে ফোনটা খুঁজে রিমিকে কল দেয়।কল রিসিভ হতেই ক্ষীণ কন্ঠে বলে,’আমার মনটা ভালো নেই রিমি।একটু আজাইরা বকবক করে মন ভালো করে দে তো।’
.
.
.
.
সারাহ ভ্যানিটি ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে তাড়াহুড়ো করে বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল।তার গায়ে নেভি ব্লু রঙের স্লিভলেস টপস।আরহাম গাড়ি থেকে নেমে হনহন করে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছিল।সিঁড়ির কাছে যেতেই সে আর সারাহ মুখোমুখি হলো।সারাহ তাকে দেখতেই ভ্যাবাচেকা খেয়ে এক ধাপ উপরে উঠে গেল।

আরহাম আগাগোড়া তাকে দেখল।কপাল কুঁচকে বলল,’এসব কি পরেছিস?শালীন হয়ে চলতে পারিস না?’

সারাহ বোকা বোকা হেসে এদিক সেদিক দেখে বলল,’স..সরি ভাইয়া।আসলে,,,’

‘যাচ্ছিস টা কোথায় এতো রাতে?’ কাটকাট গলায় প্রশ্ন করে আরহাম।

সারাহ মিনমিনে গলায় জবাব দেয়,’ফ্রেন্ডের বাসায়।’

আরহাম চোয়াল শক্ত করে তাকে দেখে।তারপরই ভরাট পুরুষালী কন্ঠে বলে উঠে,’বেশি বাড় বাড়িস না সারাহ।এতো রাতে বাইরে কি?এগুলো কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়েদের কাজ?যা ঘরে যা।’

সারাহ লটকানো মুখে তাকে দেখল।তারপরই কাঁদো কাঁদো হয়ে ঘুরে দাঁড়াল।অন্তত আরহাম ভাইয়ের মুখের উপর তর্ক করার সাহস তার নেই।সে দুই ধাপ উপরে যেতেই আরহাম কড়া গলায় তাকে একটা ধমক দিয়ে বলল,’এ্যাই শোন! পরের বার থেকে কাপড়চোপড় ভেবে চিন্তে পরবি।এসব যদি আরেকবার দেখি তাহলে বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিব।’

সারাহ আর দাঁড়াল না।মাথা নিচু করে চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেল।আরহাম ভাইয়ের মুখের উপর সে কখনোই কিছু বলে না।বাড়ির বাকিরাও বলে না।

আরহাম নিজেও ঘরে এসে হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলো।রুমে এসে ফোন হাতে নিতেই দেখল নবনীতার দুইটা মিসড কল।সে ফোনটা আস্তে করে খাটের উপর ছুঁড়ে মারল।সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজকে সে ফোন রিসিভ করবে না।সব রাগ কি শুধু নবনীতার একাই আছে?আরহামেরও যথেষ্ট ইগো আছে।সে কোনো সস্তা না।পরীকে এই কথা বুঝতে হবে।

___

চিত্রা রাতে নবনীতার পাশে শুয়েই দুই হাত ছড়িয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল।নবনীতা প্রশস্ত হেসে বলল,’কি সোনা?হঠাৎ এতো আদর দিচ্ছিস যে?ঘটনা কি?’

চিত্রা তার বুকে মাথা গুজে লাজুক হেসে বলল,’শুভি বলেছে তুমি নাকি চলে যাবে?চলে গেলে তো আর আদর দিতে পারব না।তাই দিচ্ছি।’

তার কথা শুনতেই নবনীতার দুই চোখ ভরে এলো।সে চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে জড়ানো কন্ঠে বলল,’না সোনা।আমি চলে গেলেও কয়দিন পর পর এসে এসে আদর নিয়ে যাব। ঠিক আছে?’

চিত্রা মুখ তুলল না।যেভাবে ছিল সেভাবেই পড়ে রইল।নবনীতা তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে স্নেহমাখা কন্ঠে বলল,’চিত্র! তুমি না আমার সোনা বাচ্চা?আপাই চলে গেলে তুমি কিন্তু একটু কম দুষ্টুমি করবে বুঝেছ?শুভি নিজেও তো ছোট মানুষ তাই না?তুমি তাকে জ্বালাতন করবে না।কথায় কথায় কান্না করবে না ন্যাকু বাচ্চাদের মতো।শুভি কে পড়তে দিবে মন মতো।শুভিকে না আমরা ডাক্তার বানাবো?মন মতো না পড়লে ডাক্তার হবে কেমন করে বলো?তুমি শুভির সাথে মিলেমিশে থাকবে।আমার লক্ষী সোনা তুমি।চুলগুলো বারবার এলোমেলো করে ফেলো তুমি।আপাই তোমাকে সুন্দর সুন্দর হেয়ার ব্যান্ড কিনে দিব,তুমি ভালো বাচ্চা হয়ে থাকবে কেমন?তুমি কিন্তু বড়ো হচ্ছ চিত্র।বাচ্চামো একটু একটু করে কমিয়ে নিবে বুঝেছ?’

চিত্রা মাথা নাড়ল।শুভ্রা ঘরে উঁকি দিয়েই ভেতরের দৃশ্য দেখে মন খারাপ করে বলল,’আপাই এগুলো ঠিক না।আমাকে পড়তে বসিয়ে তুমি এখানে চিত্রকে আদর দিচ্ছ।’

নবনীতা মাথা তুলে মিষ্টি হেসে বলল,’আয় না শুভি।তোর কথাই ভাবছিলাম।তাড়াতাড়ি আয়।’

শুভ্রা তাড়াতাড়ি এসে তার পাশে শোয়।নবনীতা চিত্রার মতো তার মাথাতেও হাত ছুঁয়িয়ে বলল,’শুভি রে! পড়াশোনা টা মন দিয়ে করিস।আমি তো আর্কিটেকচার নিয়ে পড়তে চেয়েছিলাম,পারি নি।তুই যেন তোর স্বপ্ন পূরণ করতে পারিস।হেলাফেলা করিস না পড়া নিয়ে।আপাই থাকব না ডাক দেওয়ার জন্য।নিজের তাগিদে পড়বি কেমন?’

শুভ্রা তার কথা শুনেই আচমকা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’কি রে শুভি?কি হয়েছে?’

শুভ্রা কোনোরকমে কান্না থামিয়ে মলিন মুখে বলল,’আপাই আমরা কি ভাইয়া কে বলতে পারি না যে তোমার সাথে যেন আমাদেরও ঐ বাড়িতে নিয়ে যায়?’

নবনীতা আলগোছে হাসে।শুভ্রার গালে হাত রেখে রিনরিনে মেয়েলি কন্ঠে বলে উঠে,’ধুর! কি বোকার মতো কথা বলিস।এসব কি হয় নাকি?’

আজকে সম্ভবত অমাবস্যা।আকাশে চাঁদের কোনো অস্তিত্বই নেই।আবহাওয়া টা মন্দ না।ভালোই।নবনীতা রাতভর দুই বোনকে আদর দিয়ে বোঝাল।সে হয়ত কিছুদিন বাদেই চলে যাবে।বাচ্চাগুলো যে কিভাবে থাকবে তাকে ছাড়া ভাবলেই তার কান্না পায়।তারা তো তাকে ছাড়া মাছটা পর্যন্ত বেছে খেতে পারে না।এই বাচ্চাগুলোকে ছাড়া সেও বা কিভাবে থাকবে?জীবন এতো কষ্টের কেন?সবসময় মেয়েরাই কেন সব ছেড়েছুড়ে চলে যায়?

শুভ্রা আর চিত্রা রাত বাড়তেই ঘুমিয়ে যায়।অথচ নবনীতার চোখে ঘুম নামে না।শুভ্রার মতো তারও মন চায় আরহামকে ফোন দিয়ে বলতে আপনি প্লিজ এই বাচ্চা দু’টোকেও সাথে নিয়ে নিন।কিন্তু এটা সম্ভব না।কিছুতেই সম্ভব না।এতো আবেগ ভালো না।তাকে বাস্তবিক হতে হবে।তার বিয়ে হয়েছে প্র্যাকটিক্যাল থিংকিং পারসনের সাথে।বাচ্চা দু’টো কে সাথে নেওয়া তার পক্ষে সম্ভব না।এটা হয় না।সে তাচ্ছিল্য হেসে বিড়বিড় করল,’বি প্র্যাকটিক্যাল নবনীতা।আবেগ দিয়ে সবকিছু হয় না।’

***

সময় এতো দ্রুত যায় কি করে নবনীতা সত্যিই জানে না।দেখতে দেখতে এক সপ্তাহ কেটে গেছে,তাও চোখের নিমিষে।নবনীতার মনে হলো সে পলক ফেলার আগেই সময় দৌঁড়ে দৌঁড়ে চলে গেছে।সাত দিন কেটে গেছে।অথচ সে তো সেদিন মাত্র বলল তার যেতে আরো অনেক দিন বাকি।

সন্ধ্যার পর থেকেই একটু পর পর তার চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।কাল সে এই বাড়ি ছেড়ে দিবে।চিত্র আর শুভিকে ছেড়ে নতুন বাড়িতে চলে যাবে।ঐ নতুন বাড়িতেই সে সারাজীবন থাকবে।নবনীতা যতবারই এই কথা ভাবে,ততবারই এক ফোঁটা অশ্রু তার অনুমতি ছাড়াই চোখ বেয়ে গাল পর্যন্ত নেমে আসে।

শুভ্রা ভেজা চোখেই তার লাগেজ গোছাচ্ছিল।নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’রাখ তো এসব।কাল গোছানো যাবে।এগুলো দেখলেই আমার কান্না পাচ্ছে।’

বলেই সে খাটে গিয়ে বসল।চিত্রা ড্রয়িং বুকে আপেল আঁকার চেষ্টা করছিল।কিন্তু তার আপেলের একপাশ অন্যপাশের মতো সমান সমান গোল হচ্ছিল না।সে রাবার দিয়ে কয়েক দফা সেটা মুছল,অথচ ফলাফল শূন্য।বার বার একপাশ বেশি গোল,অন্যপাশ চেপ্টা হয়ে যাচ্ছে।শেষে বিরক্ত হয়ে সে হাতের পেন্সিলটা খাটে ছুঁড়ে মারল।

নবনীতা চোখ রাঙিয়ে হালকা ধমক দিয়ে বলল,’এসব কেমন আচরণ চিত্র?এতো রাগ কেন তোর শরীরে?দেখি কি এমন এঁকেছিস?’

সে হাত বাড়িয়ে খাতাটা হাতে নিল।তারপরই ফিক করে হেসে উঠে বলল,’নাহ চিত্র,ভালোই এঁকেছিস।একদম পারফেক্ট আপেল।সত্যিকারের আপেল গুলো তো এমন আঁকাবাঁকা সাইজেরই হয়।খুবই বাস্তবসম্মত আপেল হয়েছে।তোর আরাম ভাইকে এটা দেখাস।সে খুব খুশি হবে।তার আবার বাস্তবসম্মত জিনিস খুব পছন্দ।’

বলতে বলতেই সে আরো এক দফা হাসল।ঠিক তখনই বাড়ির কলিংবেলটা পর পর দুইবার বাজল।নবনীতা হাসি থামিয়ে ভাবুক হয়ে বলল,’এখন কে এলো?দুইবার বেল তো কেবল আরহামই বাজায়।’

তার ভাবনার মাঝেই আরহাম বড় বড় পা ফেলে তার রুমে প্রবেশ করল।তার দুইহাত দিয়ে সে শক্ত করে একটা বাচ্চাকে নিজের সাথে চেপে ধরেছে।ঘরে এসেই সে নবনীতাকে দেখে হাসি হাসি মুখ করে বলল,’ট্যান ট্যানা।দেখো কাকে নিয়ে এসেছি।’

নবনীতা এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।নিশ্বাস বন্ধ করে বলে,’আরশাদ!’

সে ছুটে যায় তার কাছে।এক থাবার আরশাদকে আরহামের কাছ থেকে নিয়ে নিজের কাছে আনে।গালে দু’টো চুমু খেয়ে বলে,’আরেকটা সোনা বাচ্চা আমার!’

আরশাদ বাস্তবিক অর্থেই অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় আলাদা ছিল।তার চোখে মুখে একটা ভিনদেশী বাচ্চাদের ছাপ ছিল।নবনীতা তাকে একনজর দেখেই উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,’আরশাদ একটু বেশিই সুন্দর তাই না?বড় হয়ে নায়ক হবে মনে হচ্ছে।’

আরহাম কপাল কুঁচকাল।নাক ছিটকে বলল,’ইউউউ!!!নায়ক হবে কেন?সে কি অভিনয় করবে নাকি?আরশাদ হবে রিয়েল লাইফ হিরো।ঠিক তার বাবার মতো।’

নবনীতা হাসল।আরশাদকে পুনরায় আরহামের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,’ধরুন একটু।আমি পানি নিয়ে আসছি।’

আরহাম ধরল না।উল্টা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে শুভ্রাকে দেখে বলল,’শুভ্রা,ভাইয়াকে একটু পানি খাওয়াও তো।’
শুভ্রা সাথে সাথেই রান্নাঘরের দিকে ছুটল।আরহাম মাথা নামিয়ে চিত্রাকে দেখেই একটানে তাকে নিজের কোলে তুলল,এলোমেলো চুলগুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে গম্ভীর স্বরে বলল,’কি রে ভাইয়া?চুলগুলো সব এমন এলোমেলো কেন?পরী আপাই ইদানিং আর যত্ন করে তাই না?সারাদিন নিজের রংঢং নিয়ে ব্যস্ত থাকে।’

চিত্রা খিলখিল করে হাসে।দুই দিকে মাথা নেড়ে রিনরিনে স্বরে বলে,’না না।আপাই ই তো বেঁধে দিয়েছে।আমিই দৌঁড়াদৌঁড়ি করে এলোমেলো করেছি।’

আরহাম বিনিময়ে কেবল অল্প করে হাসল।তারপর নবনীতার পাশাপাশি এসে বলল,’কি ম্যাডাম?দিনকাল কেমন চলে?’

নবনীতা আড়চোখে একবার তাকে দেখে।তারপরই মুখটাকে গম্ভীর করে বলে,’চলে।ভালোই চলে।জীবন খুব প্র্যাকটিক্যালি চলছে।নো আবেগ,অনলি বিবেক।’

কথা শেষ হতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো।চোখাচোখি হতেই দু’জন সমস্বরে হেসে ফেলল।নবনীতা হাসির ফাঁকেই ঠোঁট টিপে বলল,’ভালো কথা মনে পড়েছে।আপনার চিত্র সোনাও আজকে একটা প্র্যাকটিক্যাল কাজ করেছে।’

আরহাম কৌতুহলী হয়ে বলল,’সেটা কি?’

নবনীতা খাটের দিকে ইশারা করে বলল,’সে একটা আপেল এঁকেছে।খুবই প্র্যাকটিক্যাল আপেল।একদিক বোঁচা।’
বলেই সে আরো কিছুক্ষণ হাসল।আরহাম চিত্রাকে কোল থেকে নামিয়ে দ্রুত আর্ট বুকটা হাতে নিল।সেখানে একনজর দেখেই গর্ব করে বলল,’সাব্বাশ চিত্র! এই না হলো আমার যোগ্য অনুসারী।’

সে আরাম করে খাটে বসল।তারপর চিত্রার এক হাত টেনে তাকে তার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে বলল,’শোন চিত্র।আরেকটু বড় হ।তারপর তোকে আমি আমার ডান হাত বানাব।তোফায়েল আমাকে বাইরের সব খবর এনে দিবে।আর তুই আমাকে ঘরের ভেতরের সব খবর এনে দিবি।বুঝেছিস?’

চিত্রা বুঝল নাকি বুঝা গেল না।সে কেবল তার কথা শেষ হতেই তার মাথাটা আরামের বুকের সাথে ঠেস দিয়ে দুইহাত আরহামের হাঁটুর উপর রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।আরহাম তাকে একটানে নিজের কোলে বসিয়ে চোখ সরু করে বলল,’তারপর বলো,তোমার চান্দি গরম আপাই এই সাত দিনে কি কি পাকনামি করেছে?’

***

বাড়ির সবাই ইতোমধ্যে ঘুমিয়ে গেছে।নবনীতা আস্তে করে চেয়ার টেনে টেবিলে বসল।এতো আস্তে চেয়ার টানলো যেন কেউ শুনতে না পায়।তারপরই কলম হাতে নিয়ে চটপট লিখা শুরু করল।আজ আর তার ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছে না।মনে যা আসবে,সে সবটাই লিখবে।
*
*
‘আমি আর আরহাম কেউ কাউকে ঘটা করে সরি বলি না।সেরকম তোড়জোড় করে মাফও চাই না।আমরা হুট করেই একজন আরেকজনের সাথে অতিমাত্রায় ভালো আচরণ করা শুরু করি।এই যেমন গত সাতদিন কেউ কাউকে দেখিনি।ফোনে একবার কথা হয়েছিল,তাও বাজার করা নিয়ে।এই সাতদিন দু’জনেই রাগে অভিমানে ফুলে ফুলে লুচি হয়েছি।তার ইগো সে নিজ থেকে আগ বাড়িয়ে কথা বলবে না।আমার ইগো আমি এতোবার ফোন দেওয়ার পরেও সে ফোন তুলেনি,তাই আমিও আর নিজ থেকে কথা বলব না।সাতদিন দু’জনই বিষধর গোখরা সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করে কাটিয়েছি।শেষটায় জনাবের মনে দয়া হলো।সে আর ফোন দিলো না,উল্টো আরশাদকে সহ আমার সম্মুখে এসে উপস্থিত হলো।সে সামনে দাঁড়াতেই কি হলো কে জানে,আমার সমস্ত রাগ এক নিমিষেই পড়ে গেল।মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে গেল।সাতদিনের মন কষাকষি এক সেকেন্ডই ঠিক হয়ে গেল।খুশিতে আমি হলাম বাকুম বাকুম।তারপরই দু’জন অতিমাত্রায় ভালো আচরণ শুরু করলাম।কারণ সরি বলতে আমাদের অনেক আপত্তি আছে।কেউ কারো কাছে ছোট হতে পারব না।তার চেয়ে মিষ্টি মিষ্টি আচরণ করে ক্ষমা প্রার্থনাই আমাদের সমীচীন মনে হয়েছে।

লিখছি আর ঠোঁট টিপে হাসছি।কি ছিলাম আমি,আর কি হয়ে গেলাম?অদ্ভুত বিষয়! আরহাম নিজেও বোধহয় নিজেকে দেখলে আমারই মতো অবাক হয়।কি ছিল সে,আর কি হয়ে গেল।আজ আমাদের বিবাহিত জীবনের চুয়াত্তর দিন পূর্ণ হয়েছে।ভাবা যায়! সেদিনই তো কাঁদতে কাঁদতে বিয়ের জন্য সায় দিলাম।সেই বিয়েরও তিন মাস হয়ে যাচ্ছে।বড়ই আশ্চর্যের বিষয়।তিন মাস না হতেই আমরা দু’টো মানুষ আবিষ্কার করলাম ব্যক্তিজীবনে আমরা যতোই দুই মেরু তে থাকি না কেন,বিবাহিত জীবনে এই দুই মেরু বারবারই একে অন্যকে ভূ-চুম্বকের ন্যায় আকর্ষণ করেই যাচ্ছে।বাড়াবাড়ি রকমের মেল ইগোকে একপাশে সরিয়ে আরহাম ছুটে আসছে ধানমন্ডির এই ছোট্ট ফ্ল্যাট টা তে।আর বাড়াবাড়ি রকমের জেদকে একপাশে সরিয়ে আমি ছুটে যাচ্ছি আরহাম নামের ভীষণ বিরক্তিকর,কিন্তু ভীষণ পছন্দের মানুষটির দিকে।জ্বী,আমি নবনীতা নূর সজ্ঞানে শাহরিয়ার আরহামকে নিজের জীবনসঙ্গী রূপে মেনে নিয়েছি।খুব করে চাইছিলাম যেন আমি তার সাথে মুখ ফুলিয়ে রাখতে পারি,ভাব দেখাতে পারি।কিন্তু আরহামের সাথে বেশিক্ষণ মুখ ফুলানো যায় না।কেবল আমার মন ভালো করার জন্য সে আজ আরশাদকে সেই সাভার থেকে এখানে নিয়ে এসেছে।ভাবা যায়?এই বিষয়টা ভাবলেই আমার মন ভালো হয়ে যায়।

আরহামের অনেক বদঅভ্যাস আছে।তার কিছু কিছু আচরণ দেখলে আমার তাকে রীতিমতো অনুভূতিশূন্য রোবট মনে হয়।কিন্তু পরমুহূর্তেই সে এমন একটা আচরণ করবে,যেটা দেখলে আমার মন আপনাআপনি ভালো হয়ে যায়।

আমি কি দিন দিন ভীষণ আবেগী হয়ে যাচ্ছি?কে জানে?হয়তো বা।আরহামের ভাষায় আমি আজকাল বাংলা সিনেমার শাবানা হয়ে যাচ্ছি,ঠু মাচ ড্রামাটিক,ঠু মাচ ইমোশনাল।কিন্তু আমার কিছুই করার নেই।বাবা মায়ের মৃত্যুর পর এতো যত্ন,এতো গুরুত্ব,এতো পাত্তা আমাকে আর কেউ দেয়নি।চিরায়ত বাঙালি নারীদের মতো আমিও সেই যত্নে আটকে গেছি।এই ছয়টি বছরে আমি মন খারাপ করাই ভুলে গিয়েছিলাম।কারণ যেই মন খারাপে মন ভালো করার মানুষই থাকে না,সেই মন খারাপ করে লাভ কি?এই তিনমাসে আমি আবারো মন খারাপ করা শিখেছি,অভিমান আবারো আমার মনে বাসা বাঁধার সুযোগ পেয়েছে।কারণ আমার অভিমান ভাঙানোর মতো একজন চমৎকার মানুষ আমার জীবনে এসে গেছে।

আমার এই ডায়রিটা যদি কখনো কেউ পড়ে থাকেন তাহলে নিশ্চয়ই আমাকে মাথাখারাপ অথবা পাগল ভাববেন।কারণ ডায়রির শুরুতে আমি আরহামকে মনের আশ মিটিয়ে গালমন্দ করেছি।সেই আমিই আজকের দিনে এসে তাকে চমৎকার মানুষ বলছি।কিন্তু সেদিন আর আজকে,দুইদিনই আমি আমার মনের কথা লিখেছি।

আমার মনের একটি সুপ্ত বাসনা আছে।যদি কোনোদিন আমি সুযোগ পাই আরহামের কাছে কিছু একটা চাওয়ার,তাহলে আমি চাইব আরহাম যেন রাজনীতি ছেড়ে দেয়,সে যেন এই সবকিছু থেকে দূরে সরে আসে।কারণ এই রাজনীতিই তার সমস্ত অমানবিক আচরণের মূল।আমি চাই আরহাম বিজনেসকেই মূল প্রাধান্য দিক।আমার এই দেশের রাজনীতি একদমই ভালো লাগে না।ভালো ভালো মানুষরাও রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর পাল্টে যায়।আমি চাই না আরহাম পাল্টাক।কারণ সে পাল্টে গেলে আমার,নবনীতার পুরো পৃথিবীটাই পাল্টে যাবে।প্লিজ আল্লাহ,আরহামকে তুমি এমনিই রেখো।আর কিছু চাই না আমার।’

~নবনীতা নূর
১০ম কার্তিক,১৪২৯ বঙ্গাব্দ

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে