কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৭

0
110

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৭)

রিমি বিভার হাত ধরে ছুটতে ছুটতে হাসপাতালের ভেতরে এলো।বাইরে ফোঁটায় ফোঁটায় বৃষ্টি হচ্ছে।সে হসপিটালে এসেই পিছলে গেল খানিকটা।তারপরই আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল।মাথা নামিয়ে বিভাকে দেখেই মিষ্টি হেসে বলল,’দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে কেমন লাগে বিভু?’

বিভা দাঁত কেলিয়ে জানায়,’কুব মজা।’

রিমি তাকে নিয়েই হাসপাতালের মাঝে ছুট দেয়।হাসপাতাল এখন একদমই ফাঁকা।সে হাসতে হাসতে বলল,’আয় আমরা স্কেটিং করি।বিভা বিনিময়ে কেবল প্রাণখোলা হাসল।বাচ্চাদের হাসির শব্দ পৃথিবীর চমৎকার শব্দগুলোর একটি।সেই হাসির ঝংকারে হাসপাতালের নিচ তালার খোলা জায়গাটা আচমকাই কেমন উৎসবমুখর হয়ে উঠল।

ওয়াজিদ দাঁড়িয়ে ছিল ক্যান্টিনের দরজার কাছে।চৌকাঠে হেলান দিয়ে সে স্থির চোখে একবার দু’জনকে দেখে।রিমি আর বিভা মনের আনন্দে ছুটে যাচ্ছিল এই মাথা থেকে ঐ মাথা।ওয়াজিদ চোখ মুখ কোঁচকায়।এটা আবার কেমন পা’গল?হাসপাতালে এমন দৌঁড়াদৌঁড়ি কে করে?

_____

উষান গলায় ঝুলানো ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে কয়েকবার এঙ্গেল ঠিক করল।এই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে সে আটকা পড়েছে একটা হসপিটালে।তার ক্যামেরা টা ওয়াটার প্রুফ না।পানি পড়লেই নষ্ট হওয়ার আশংকা আছে।সে বেরিয়েছিল ছবি তোলার উদ্দেশ্যে।ফটোগ্রাফি তার শখ।অবেলার বৃষ্টি সেই শখে পানি ঢেলে দিয়েছে।সে বিরক্ত হয়ে হাসপাতালে ঢুকে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিল।

হঠাৎই নিচতালার একটি দৃশ্যে তার চোখ আটকায়।খোলা জায়গায় একটি অল্প বয়সী মেয়ে একটি ছোট বাচ্চাকে নিয়ে মনের আনন্দে ছুটোছুটি করছে।তাদের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখেই উষানের মুখে হাসি ফুটল।সে ছবি তোলার জন্য একটি পারফেক্ট সিনারিও পেয়ে গেছে।সে সাথে সাথে ক্যামেরা অন করল।ভেবে নিল তাদের অগোচরেই সে তাদের কিছু ছবি তুলবে।দুই টা ছবি তুলতেই সে রিমিকে ডাকল,’এক্সকিউজ মি আপু।একটু শুনবেন?’

রিমি হাসি মুখেই ঘাড় ঘুরিয়ে পেছন ফিরে।সহজ গলায় জানতে চায়,’হ্যাঁ হ্যাঁ বলো।’

উষান ক্যামেরা হাতে এগিয়ে আসে।সৌজন্যসূচক হেসে বলে,’আমি শখ থেকেই ফটোগ্রাফি করি। আমি আপনাদের দু’টো ক্যান্ডিড ছবি তুলেছি।এখন চাচ্ছি নির্দিষ্ট পোজে তুলতে।আপনি কি কয়েকটা পোজ দিবেন যেন প্রোপার একটা মোমেন্ট ক্রিয়েট হয়?’

রিমি দ্রুত মাথা নাড়ে।প্রাণবন্ত হেসে বলে,’অবশ্যই অবশ্যই।মাই প্লেজার।’

উষান একগাল হেসে বলল,’আপু আপনার নাম?’

উচ্ছ্বসিত তরুণী মিষ্টি হেসে জবাব দেয়,’সিদরাতুল মুনতাহা।ডাকনাম রিমি।’

ওয়াজিদ সমস্ত মুখ বিকৃত করে তাকে দেখল।রতনে রতন চিনে,আর পা’গলে পা’গল চিনে।সে অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করে,’যতোসব পা’গলের আখড়া! হাসপাতালে এসেছে মোমেন্ট ক্রিয়েট করতে।’

‘এক্সকিউজ মি ভাইয়া।’
উষানের ডাক শুনেই সামনে তাকায় ওয়াজিদ।খানিকটা বিচলিত হয়ে বলে,’আমাকে ডাকছ?’

‘জ্বী ভাইয়া।আসলে আপনার পজিশন একদম পারফেক্ট।আপনি কেবল আমি রেডি হতে বললেই রিমি আপু আর বিভার দিকে তাকাবেন।তাহলে ব্যাকগ্রাউন্ড টা খুব ভালো আসবে।’

ওয়াজিদ তাজ্জব হয়ে বলল,’কি অদ্ভুত! আমায় কেন এসবে আনছ?তোমরা তুলো না তোমাদের ছবি।’

‘আমরা তুললেই তো হবে না।ছবিটা এস্থেটিক হতে হবে।সেজন্য আপনাকেও ফ্রেমে আসতে হবে।’ ত্যাড়ামি করে জবাব দিলো রিমি।

ওয়াজিদ বিরক্ত হয় ভীষণ।সে কড়া করে কিছু বলে না দেখে সবাই যা খুশি তাই করে তার সাথে।যাই হোক,অল্পতে রে’গে যাওয়া তার স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ।সে বুকে হাত বেঁধে থমথমে মুখে বলল,’এক মিনিটের বেশি দাঁড়াতে পারব না।যা করার তাড়াতাড়ি করো।’

যদিও সে এক মিনিট দাঁড়াবে বলেছে,কিন্তু মনোযোগ দিয়ে বিভা আর রিমিকে দেখা শুরু করার পর তার মনে হলো আরো কিছুক্ষণ দাঁড়ালে মন্দ হয় না।দু’জনকে ভালোই দেখাচ্ছে।

ছবি তোলার পর রিমি এগিয়ে যায় উষানের দিকে।আগ্রহী হয়ে বলে,’দেখি ভাইয়া।ছবি গুলো দেখাও তো।’

দু’জন ব্যস্ত হলো ছবি দেখা নিয়ে।ওয়াজিদ হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে সামনে এগিয়ে এসে বিভাকে কোলে তুলে নিল।মিষ্টি স্বরে জানতে চাইল,’কেমন আছ বিভা?’

বিভা শুধু মাথা নাড়ল।রিমি পাশ ফিরে বলল,’আপনি বিভুকে নিয়ে উপরে যান না।আমি একটু পরে আসছি।’

ওয়াজিদ তার দিকে ফিরে গম্ভীর হয়ে বলল,’কোনো দরকার নেই।তুমি কাজ শেষ করো।একসাথেই যাব।’
.
.
.
.
‘আফু।আমার রাস্তায় থাইক্কা অভ্যেস।আমি ঘর বাড়িত ঘুমাইতাম পারি না।’

কথার ধরনেই আরহাম মাথা নামিয়ে হেসে ফেলল।শাহাদাত তাকে দেখেই মুখ কাচুমাচু করে বলল,’ভাইয়া।কিছু কন না সুন্দরী আফুরে।আমি এতো বড়ো বাসাত থাকতে পারুম না।’

নবনীতা মুখ শক্ত করে কড়া চোখে তার দিকে তাকায়।গম্ভীর হয়ে বলে,’থাইক্কা আবার কি শাহাদাত?থেকে বলবে।তোমাকে না বলেছি সুন্দর করে কথা বলতে?সেই তো অশুদ্ধ ভাষাতেই কথা বলছ।’

‘জন্মের থেক্কা,থুক্কু থেকে,,জন্মের থেকে আমি এমনেই কথা কইতাছি আপা।গত তিনদিন মেলা চেষ্টা করছি।আমার পক্ষে সম্ভব না।শুদ্ধ আমার মুখের তে বাইর ই হয় না।কি করুম?তাও তো বস্তির বাকি পোলাদের থেক্কা আমার কথা ভালা।বিশ্বাস না হলে আপনে গিয়া দেইখা আসেন।’

একপ্রকার হাঁপিয়ে উঠে কথা গুলো বলল শাহাদাত।নবনীতা জবাবে কেমন চোখ পাকিয়ে একবার তাকে দেখল।তাকে সে বলেছিল শুদ্ধ করে কথা বলতে আর তার বাড়িতে এসে থাকতে।অথচ দু’টো প্রস্তাবের একটাও শাহাদাতের পছন্দ হয়নি।সে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে এমন বন্ধ ঘরে থাকতে পারবে না।তার নামি দম বন্ধ হয়ে যায়।

নবনীতা একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশ দেখে।ছোটখাটো একটা মিটিং রুম হয়ে গেছে তার কেবিন টা।আরহাম,আদি,ওয়াজিদ,রিমি,শুভ্রা,চিত্রা,বিভা,শাহাদাত মোটামুটি সবাই তার কেবিনে আছে।তারা কথা বলছিল শাহাদাত আর বিভার থাকা নিয়ে।

নবনীতা চাইছিল শাহাদাত তার কাছেই থাকুক।কিন্তু শাহাদাতের নাকি তার বাসায় মন টিকে না।দশ তালার উপর থেকে তার কিছুই ভালো লাগে না।ঘরে বসে কোনো খেলাই তার ভালো লাগে না।সে বড় হয়েছে একভাবে।বন্ধুদের সাথে কাবাডি,হাডুডু ,ক্রিকেট,ফুটবল এসব খেলেই সে একটা লম্বা সময় পার করেছে।এখন এই বন্ধ জীবন তার ভালো লাগে না।তার নিজেকে বন্দি বন্দি লাগে।বার বার কোথাও ছুটে যেতে মন চায়।এই ইট পাথরের দেয়ালে আবদ্ধ জাকজমকের জীবন তাকে বিমুগ্ধ করে না।উল্টো তার মনে হয় এমন বন্ধ ঘরে তার দ’ম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

ওয়াজিদ তার অবস্থা কিছুটা উপলব্ধি করতেই গম্ভীর হয়ে বলল,’আমার মনে হয় শাহাদাত কে কোনো বোডিং স্কুলে দিয়ে দিলেই ভালো হবে।মাসে একবার সে বাড়ি আসবে,আর বাকি সময়টা তার স্কুলের বন্ধুদের সাথে থাকবে।এতে করে সে আর একাকিত্ব অনুভব করবে না।বিভিন্ন কো কারিকুলাম এক্টিভিটিজে অংশ নিবে,খেলাধুলা করবে।বোডিং স্কুলের ডিসিপ্লিনের মাঝে পড়ে গেলে কথাবার্তা এমনিতেই সুন্দর হয়ে যাবে।আমার অন্তত তাই মনে হয়।আর সত্যি বলতে নবনীতার বাসায় সে আসলেই কমফোর্ট ফিল করবে না।এর চেয়ে বোডিং স্কুলই বেটার অপশন।সমবয়সীদের সাথে থাকবে।তারও মন ভালো থাকবে।আর সবমিলিয়ে এটাই বেস্ট হবে।’

আরহাম তার কথা শুনেই ডান হাত দিয়ে একটা তুড়ি বাজিয়ে বলল,’বেস্ট ভাই।এর চেয়ে সুন্দর সলিউশন আর হতেই পারে না।একদম সবদিক দিয়ে পারফেক্ট।’

সে থামল।পাশ ফিরে নবনীতাকে দেখে কপাল কুঁচকে বলল,’কি ম্যাডাম?আইডিয়া কেমন লেগেছে?’

নবনীতা গালের নিচে হাত দিয়ে একটু ভাবল।তারপরই শাহাদাতকে দেখে দুই চোখ সরু করে বলল,’সত্যিই তুমি আমাদের বাসায় থাকতে চাও না?’

শাহাদাত দ্রুত দুই দিকে মাথা নাড়ে।নবনীতা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,’তাহলে আর কি?থাকো তুমি বোডিং স্কুলে।বেতের বারি যখন পড়বে পিঠের উপর ধাম ধাম,তখন আবার আমার কথা মনে করবে না কিন্তু।’

শাহাদাত এক সেকেন্ডও দেরি না করে মুখের উপর ঠাস করে জবাব দিলো,’ঐ বন্ধ ঘরে থাকার থেইক্কা পিডা খাওন আরো ভালা।’

তার কোনোরকম ভণিতা ছাড়া স্পষ্ট অকপট জবাবে নবনীতা ভড়কে গেল।আরহাম পুরো ঘর কাঁপিয়ে হো হো করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতেই বলল,’শাহাদাত রকস,পরী শকস!’

আদি আর ওয়াজিদও তার কথায় ফিক করে হেসে ফেলল।হাসি সংক্রামক।দেখা গেল আস্তে আস্তে নবনীতা বাদে পুরো কেবিনের সবাই ই চাপা স্বরে হাসা শুরু করল।নবনীতা চোখ পাকিয়ে সবাইকে দেখে।তারপরই গজ গজ করে বলে,’ঠিক আছে বাপ।থাক তোর যেখানে খুশি।আমার বাসায় তোকে থাকতে হবে না।’

শাহাদাত হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।কৃতজ্ঞতা স্বরূপ দুই হাত সামনে তুলে বলল,’অনেক ধন্যবাদ আপা।’

নবনীতা তার থেকে চোখ সরায়।রিমি আর বিভা তখন কাউচে বসে অদ্ভুত একটা খেলা খেলছিল।এই খেলার নাম নবনীতা জানে না।শুরুতেই দু’জনে ভন ভন করে কিছু একটা বলে।তারপরই হঠাৎ কি হয় কে জানে,দু’জনেই একসাথে তাদের মুখ চেপে ধরে।নবনীতা তাদের দেখেই বিড়বিড় করল,’আরেক পা’গল!’

সে কন্ঠ চওড়া করে ডাকে,’রিমি!’

রিমি তার দিকে ফিরল।ভ্রু উঁচিয়ে বলল,’কি?’

‘বিভুকে নিয়ে কি ভেবেছিস তুই?’

রিমি দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’কি আর ভাববো?বিভু আমার কাছেই থাকবে।তোর বাড়িতে এমনিতেও অনেক মানুষ আছে।আমার বাড়িতে শুধু আমি,আব্বু আর আম্মু।বিভা আসার পর থেকেই ঘরটা একটু প্রাণ ফিরে পেয়েছে।আব্বু তো রোজ বিভার সাথে খেলা করে।আম্মু আবার এটা সেটা কতো কিছু বানায় তার জন্য।আমি বড়ো হওয়ার পর আম্মু আব্বু একদম একা হয়ে গিয়েছিল।এখন বিভা আসাতে ঘরটা একটু ভরা ভরা লাগে।আমি তাকে আমার কাছেই রাখতে চাই।’

কথা শেষ করেই সে বিভার কপালে একটা চুমু খায়।ওয়াজিদ আড়চোখে একবার তাকে দেখল।মেয়েটার একটা চমৎকার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাকে বারবার মুগ্ধ করে।সেটা হলো তার সরলতা।একেবারে স্বচ্ছ সুন্দর আর নির্ঝঞ্ঝাট মেয়ে মানুষ।ওয়াজিদ একমুহূর্তে তার সাথে রাগ হলেই পরমুহূর্তে তার মনে হয় থাক বাচ্চা মানুষ,বুঝে নি হয়তো।বিভা নামের সম্পূর্ণ অচেনা কন্যা শিশুটির প্রতি তার এই মাতৃসম আচরণ ওয়াজিদের মনে দাগ কাটে।এতো সহজে কি কোনো একটি মেয়ে একটি ছোট্ট শিশুর দায়িত্ব নিতে পারে?নবনীতার প্রতি মেয়েটার ভালোবাসাও চোখে পড়ার মতো।ওয়াজিদের মাঝে মাঝে মনে হয় মেয়েটা বড্ড সরল।অন্তত এই সুবিশাল আর স্বার্থপর পৃথিবীতে একা চলার মতো যেই ধূর্ততা প্রয়োজন সেটা তার মাঝে নেই।

আলোচনা চলল আরো বিশ মিনিটের মতো।শেষে সিদ্ধান্ত হলো শাহাদাত কে ভালো মানের কোনো বোডিং স্কুলে ভর্তি করানো হবে।আর বিভা থাকবে রিমির সাথে।নবনীতা শেষ একবার শাহাদাতের দিকে দেখে কড়া গলায় বলল,’আমি তো মুখে বলেছি।বোডিং স্কুলে গিয়ে কথা না শুনলে আর এমন বিচ্ছিরি ভাষায় কথা বললে বেতের বারি একটাও মাটিতে পড়বে না।’
.
.
.
.
ব্যস্ততায় আর জীবনের গতিময়তায় কেটে গেছে আরো কিছু দিন।নবনীতা এখন কিছুটা সুস্থ।ঠিক মতো নিজে নিজে হাঁটাচলা করতে পারে।জখমও শুকিয়ে এসেছে প্রায় সবগুলো।কেবল কাঁধ আর হাতের একটা জায়গা এখনো পুরোপুরি শুকায়নি।তবে শরীরের চিনচিন ব্যথা অনেকখানিই কমে গেছে।

তার হসপিটালের দিনগুলো ভালোই কাটে।সেদিনের পর থেকে সে রোজ রাতে এক প্লেট করে ফুচকা খেয়েছে।আরহাম নিজ হাতে সেগুলো কিনে এনে বানিয়েছে।নবনীতার ইদানিং নিজেকে কোনো উচ্চমাধ্যমিকে পড়ুয়া কিশোরী মনে হয়।মনে হয় সে শুভ্রার সমবয়সী হয়ে গেছে।আরহাম সামনে থাকলে সে এতো বকবক করে! চলে গেলেই তার হুশ হয়।মনে হয় ধ্যাত! বেশি কথা বলে ফেলেছি।

যত্ন জিনিসটা ভীষণ অদ্ভুত।বহুদিন যত্ন না পেতে পেতে যখন শরীরটা যত্নের সংজ্ঞাই ভুলে যায়,তখন হুট করেই সামান্য যত্নে শরীর মন দু’টোই জুড়িয়ে যায়।নবনীতা অনেক গুলো বছর পর যত্ন পাচ্ছে।কেউ একজন রোজ ঘুমের আগে তার পিঠের পেছনে থাকা বালিশটা খাটে রেখে একহাত চেপে তাকে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে।কেউ একজন রোজ এক ঘন্টার জন্য হলেও তাকে দেখে যাচ্ছে।তার শিয়রে বসে একমনে তার কথা শুনে যাচ্ছে।নবনীতার মনে হচ্ছে তীব্র খরা উপেক্ষা করে হঠাৎই তার জীবনে মুষলধারে বৃষ্টি নেমে এসেছে।সে সুখী।সংসার জীবন নিয়ে তার এখন পর্যন্ত খুব বেশি অভিযোগ নেই।শুরুর দিকে কয়েকটা অভিযোগ ছিল।তবে এই কিছুদিনে সে সেসব ভুলে নতুন উদ্যমে সংসার জীবন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।বিয়ে যখন হয়েই গেছে তখন এতো তেড়িবেড়ি করে লাভটা কি?আর যাই হোক,আরহাম তো এতো বেশি জ’ঘন্যও না যে তার সাথে এক ছাদের নিচে ঘর করা যাবে না।

***

‘কোনো এক আহাম্মক বলেছিল-ফার্স্ট ইম্প্রেশন ইজ দ্যা বেস্ট ইম্প্রেশন।অর্থাৎ প্রথম দেখায় আমাদের একজন মানুষ কে কেমন লাগে,সেটার উপরই নির্ভর করে বাকি জীবন আমাদের তাকে কেমন লাগবে।এই কথাকে আমি লিখিত ভাবে অস্বীকার করলাম।আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে,তাকে প্রথম দর্শনে আমার বিন্দু পরিমানও ভালো লাগে নি।মনে হয়েছিল এর মতোন শিক্ষিত গোয়ার আর দু’টো নেই।এরপর যতগুলো সাক্ষাৎ হলো,কোনো সাক্ষাৎেই আমার তাকে ভালো লাগল না।মনে হলো এই যুগে এসেও এই মূর্খ এসব আদিম যুগের চিন্তাভাবনা নিয়ে বেঁচে আছে কেমন করে?আমার তাকে এতোই অপছন্দ হলো যে আমার ছোট্ট বোনকে যখন সে কোলে তুলে আদর করতো,তখন আমার ব্রহ্মতালু অব্দি জ্বলে উঠতো।তারপর নানা ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের বিয়ে হলো,সেটাও একপ্রকার বাধ্য হয়ে।চারিদিকের এতো এতো কথায় একপ্রকার নিজের কাছে নিজে হেরে গিয়েই সিদ্ধান্ত নিলাম এই গোয়ারকে আমি বিয়ে করব।

মূল কাহিনী শুরু হলো বিয়ের পর।বিয়ের আগে আমি যেই মানুষটিকে দেখামাত্রই নাক ছিটকাতাম,বিয়ের পর আমি আবিষ্কার করলাম মানুষটা আসলে নাক ছিটকানোর মতো এতোটা খারাপও না।বিবাহিত জীবনে সে এখন পর্যন্ত আমার জন্য কি কি করেছে তার একটা লিস্ট দেই-

★সে আমাকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দিয়েছে।
★সে আমার আর আমার পরিবারের দায়িত্ব নিয়েছে,তাও হাসিমুখে।
★সে আমাকে চমৎকার চমৎকার কিছু শাড়ি কিনে দিয়েছে,যেগুলো গায়ে জড়ানোর পর নিজেরই নিজেকে অপ্সরা মনে হয়।
★সে জ্বরের প্রকোপে ভুলভাল প্রলাপ করতে থাকা আমিটা কে পরম যত্নে আগলে নিয়েছিল।কয়েক রাত সে আমার কথা ভেবে নির্ঘুম কাটিয়েছে।
★মেয়েদের পড়াশোনার কথা শুনলেই যার গায়ে ফো’সকা পড়ে,সেই লোকটাই আমাকে স্কুলে চাকরি করার অনুমতি দিয়েছিল।
★সে আমার সম্মান রক্ষার্থে রীতিমতো এলাহি কান্ড বাঁধিয়েছে।
★আমার রান্নায় লবনের পরিমান মাত্রাতিরিক্ত বেশি হওয়া স্বত্তেও সে বলেছে আমি নাকি ভালোই রান্না করেছি।
★সে দুই রাত ধরে হসপিটালে কাটিয়েছে যেন জ্ঞান ফিরলেই সবার প্রথমে আমি তাকে দেখতে পাই।
★সে শাহাদাতের সমস্ত খরচ বহন করেছে।এটার কারণও স্রেফ আমার মনের খুশি।কারণ আমার জামাই নিজের পরিবারের মানুষ ছাড়া আর কারো জন্য দরদ দেখায় না।
★সে ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করে ভেজা শরীর নিয়ে আমার জন্য ফুচকা হাতে হসপিটালে এসেছে।

আরো কিছু বাদ যেতে পারে।কারণ আমার আবার আজকাল শর্ট টাইম মেমোরি লস হচ্ছে।অনেক কিছুই ভুলে যাচ্ছি আমি।

তো যাই হোক,এই হলো অতি সংক্ষেপে আমার সংসার জীবনের বিবরণ।আমার স্বামীর নাম কি লিখতে হবে?যাকগে,লিখেই দেই।তার নাম শাহরিয়ার আরহাম।তার ভাষ্যমতে এই শহরে এমন কেউ নেই যে তাকে চিনে না।কথা অবশ্য সত্য।এমপি মানুষ,তাকে মোটামুটি সবাই ই চেনে।

উপরের কথা গুলো স্রেফ আবেগের বশে লিখি নি।এসব লিখার সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য আছে।এবার আসি মূল কথায়।আমার জামাইয়ের যেমন ভালো ভালো গুন আছে,তেমন তার কিছু মারাত্মক খারাপ গুনও আছে।এর মধ্যে প্রথম তার মুখের ভাষা।তার মুখের কথা শুনলে মাঝে মাঝে আমার মন চায় মাটি ফাঁক করে ভেতরে চলে যাই।সেদিন সে চেয়ারের সাথে উষ্টা খেল।খেতেই পারে,খুব স্বাভাবিক বিষয়।কিন্তু এরপর সে চেয়ারকে এমন বিচ্ছিরি একটা গালি দিলো যে আমার মনে হলো আমার কান দু’টো কে একটু ওযু করিয়ে আসি।
এই গেল মুখের ভাষা।এবার আসি তার মেজাজ নিয়ে।তার মুড সুইংয়ের কাছে মেয়ে মানুষও ফেইল।ধরা যাক বিকাল পাঁচটার দিকেই সে আমাকে সেনোরিটা ডেকে ডেকে আহ্লাদে গদো গদো হচ্ছে।পাঁচটা দশেই কিছু একটা হলো আর সে রীতিমতো রাসেলস ভাইপারের মতো ফণা তুলে আমাকে ছো’বল মারতে উদ্যত হলো।মানে তার যে কখন কি হয় সেই জানে।গতকাল মুঠোফোনে আমাদের তুমুল ঝগড়া হলো।ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি ধৈর্য হারা হয়ে যা নয় তাই বলেছি।সেই বলার প্রেক্ষিতে সেও আমাকে যা না তাই বলেছে।শেষে বলল সে নাকি আর ঘরই করবে না আমার সাথে।বলেই কল কেটে দিলো।এরপর সারারাত আমি অনুশোচনায় ছটফট করেছি।তারপর সকালে উঠে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে তার সমস্ত অবদান আমি একটা একটা করে ডায়রিতে টুকে রাখব।যখনই তার উপর আমার প্রচন্ড রাগ হবে,তখনই আমি ডায়রি খুলে এগুলো পড়ব আর রাগ কমাবো।বুদ্ধিটা দারুণ না?

যাকগে।আর কথা না বাড়াই।তবে আমার অল্প দিনের সংসার জীবনের অভিজ্ঞতা বলছে আমার জনাব আজই বাড়িতে আসবেন আর দরজা খুলতেই দুষ্টু হেসে বলবেন-‘হাই সেনোরিটা!কেমন আছ?তুমি নাকি কাল আমায় ভীষণ মিস করেছ?তাই চলে এলাম দেখা করতে।’

নবনীতা নূর
২রা কার্তিক,১৪২৯ বঙ্গাব্দ

ডায়রির এইটুকু লিখা হতেই বাড়ির কলিং বেলটা পর পর দু’বার বেজে উঠল।সেই শব্দেই চেয়ারে বসে থাকা তেইশের তরুণীটি তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো।মুহূর্তেই তার ঠোঁটে হাসি ফুটল,চোখ জোড়া হলো চঞ্চল।হাতের কলমটা টেবিলে ছুড়েই সে ছুটে যায় দরজায় দিকে।

মিসেস রোকেয়া দরজা পর্যন্ত যাওয়ার আগেই সে চেঁচিয়ে উঠে,’দাঁড়াও মামি।আমি দরজা খুলব।’

মিসেস রোকেয়া অবাক হলেন।তারপরই তাজ্জব বনে গিয়ে দুই কদম পিছিয়ে এলেন।চোখ মেলে দেখলেন মেয়েটার মুখের সেই স্বচ্ছ হাসি।চোখ দু’টো এতো উজ্জ্বল দেখাচ্ছে কেন?এতো দুরন্তপনা তার মধ্যে বাসা বেঁধেছে কবে?

সে চটপট দরজা খুলে।অন্যপাশে দাঁড়ানো মানুষটি থমথমে মুখে তার দিকে তাকায়।নবনীতা প্রশস্ত হাসে।অন্যদিকের মানুষটা অনেকক্ষণ চুপ থেকে শেষটায় গম্ভীর হয়ে বলে,’হাই সেনোরিটা কেমন আছ?’

নবনীতা হাসিমুখে জবাব দেয়,’ভালোই আছি।আসুন,ভেতরে আসুন।’

আরহাম ভেতরে এলো।চুপচাপ সোফায় গিয়ে বসল।মিসেস রোকেয়া পানির জগে হাত দিতেই নবনীতা একটানে সেটা নিজের হাতে নিয়ে গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,’এটা আমি দিচ্ছি মামি।তুমি খাবার বেড়ে দাও।’

মিসেস রোকেয়া নিঃশব্দে রান্নাঘরে চলে এলেন।তার ভেতরটা কেন জানি জ্বলছে।এতো সুখে আছে পরী?এতো গুছিয়ে সংসার করছে?ঐ বড়লোক,পয়সাওয়ালা,ক্ষমতাধর ছেলেটা এতো মেয়ে ফেলে পরীর মতো সাধারণ আর ছাপোষা একটি মেয়েকে বিয়ে করে নিয়েছে?পরীর ঝুলিতেও আল্লাহ এতো সুখ জমা রেখেছিল?আশ্চর্য ব্যাপার!

পানি খাওয়া শেষ হতেই নবনীতা হাত বাড়িয়ে বলল,’দিন গ্লাস দিন।’
আরহাম গ্লাস দিলো না।উল্টা নবনীতার হাত ধরে একটানে তাকে নিজের উপর এনে ফেলল।নবনীতা আঁতকে উঠে বলল,’সর্বনাশ! মামি এক্ষুণি রান্নাঘর থেকে বের হবে।’

আরহাম সে কথা গায়ে মাখল না।উল্টা তার পিঠে হাত বুলিয়ে তার গালে নাক ঘষতে ঘষতে প্রগাঢ় স্বরে বলল,’তুমি নাকি কাল আমায় ভীষণ মিস করেছ?তাই চলে এলাম দেখা করতে।’

নবনীতা মুচকি হাসল।মাথা নামিয়ে নিচু স্বরে বলল,’হ্যাঁ করেছি।কিন্তু আপনি বলেছিলেন আপনি আর সংসার করবেন না আমার সাথে।সেটার কি হলো?’

‘সেটা আবেগের ঠেলায় বলেছি।সংসার করব না বলতে কোনো শব্দ নেই।বিয়ে হয়েছে,এখন সংসার করতেই হবে।ভালো লাগে না বলতে কিছু নেই।না লাগলে লাগাতে হবে।তবুও সংসার ছাড়া যাবে না।’

মিসেস রোকেয়ার উপস্থিতি টের পেতেই নবনীতা ছিটকে দূরে সরে এলো।পাঁচ মিনিট পর শুভ্রাও কলেজ আর কোচিং শেষ করে বাড়ি এসে পৌছুলো।নবনীতা চিত্রাকে ডেকে খাওয়ার টেবিলে বসাল।প্রথা এখনো ভার্সিটি থেকে আসেনি।সে ইদানিং সময় মতোই বাড়ি ফিরছে।কয়দিন এমন সুন্দর ভাবে থাকবে কে জানে! নবনীতার আবার তাদের বেশি ভালো রূপটাও হজম হচ্ছে না।

গত পরশু সকালে সে হসপিটাল থেকে রিলিজ পেয়েছে।তারপর বাড়িতে আসার পর থেকেই সে সাংঘাতিক রকমের যত্ন ভালোবাসা পাচ্ছে।মিসেস রোকেয়ার যত্ন দেখলেই তার চোয়াল ঝুলে যায়।মন চায় সাহস করে একদিন বলেই দিতে,’মামি তুমি এখনো অভিনয়ের জন্য অডিশন দিচ্ছো না কেন?দিলে তুমি নির্ঘাত সিলেক্ট হয়ে যাবে।’

আজকেও একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।সবাইকে খাবার বেড়ে দেওয়ার পর মিসেস রোকেয়া নিজ হাতে চিত্রাকে ভাত মেখে খাওয়ালেন।নবনীতা যদিও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি,কিন্তু শুভ্রা এই দৃশ্য দেখতেই পলক ফেলা ভুলে গেল।দেখার পর থেকে সেই যে সে মুখ খুলেছে আর বন্ধ করার নাম নেই।নবনীতা আলতো করে তার মাথায় একটা গাট্টা মেরে ধমক দিলো,’মুখ বন্ধ কর শুভি।’

শুভ্রা সঙ্গে সঙ্গে মুখ বন্ধ করল।মিসেস রোকেয়া ডাল আনার জন্য আবার রান্নাঘরে যেতেই শুভ্রা হড়বড় করে বলল,’এটা আমাদের মামি রোকেয়া?নাকি অন্য কারো সাথে অদল বদল হয়ে গেছে?আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না আপাই।’

নবনীতা ঠোঁট টিপে হাসল।এক লোকমা ভাত মুখে তুলে খেতে খেতে বলল,’পাওয়ার অফ মানি শুভি।টাকাই সকল সুখের মূল বুঝেছিস?এজন্যই তো বলি,মন দিয়ে পড়াশোনা কর।প্রতিষ্ঠিত হয়ে টাকা পয়সা কামাই কর।তখন দেখবি জগতের সবাই তোকে কুর্নিশ করছে।’

****

খাওয়া শেষ হতেই নবনীতা তার ঘরে গেল।আরহাম আড়মোড়া ভেঙ্গে তার ঘরে এসেই ধাম করে বিছানায় গিয়ে পড়ল।নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’সমস্যা কি?আস্তে বসা যায় না?’

‘না,যায় না।’

আরহাম ফোন স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো।নবনীতাকে তাড়া দিয়ে বলল,’চলো তো।তাড়াতাড়ি একটা সুন্দর শাড়ি পরে রেডি হও।এক জায়গায় যাবো আমরা।’

নবনীতা আশ্চর্য হয়ে জানতে চায়,’সেকি! কোথায় যাচ্ছি আমরা?’

‘সেটা তো গেলে দেখতে পারবেন ম্যাডাম।এখন তাড়াতাড়ি রেডি হন।’

নবনীতাকে গভীর ভাবনায় ফেলে দিয়ে আরহাম আবার ফোন চালাতে মশগুল হলো।নবনীতা আলমারি খুলেই চিন্তায় পড়লো।এতো এতো শাড়ি! সে কোনটা পড়বে?

সে শেষ পর্যন্ত সাদা আর নীলের মিশেলে একটা শাড়ি বেছে নেয়।আলমারি বন্ধ করে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেটাকে গায়ের উপর ফেলে দেখে।তারপরই পেছন ফিরে আরহামকে ডেকে বলল,’আরহাম! এটা সুন্দর না?’

আরহাম ফোন থেকে চোখ তুলে।গম্ভীর হয়ে বলে,’হুম সুন্দর।’

শাড়ি পরতে নবনীতার সময় লাগলো মাত্র ছয় মিনিট।যেহেতু এটা সিল্কের শাড়ি না,তাই অন্য কেউ কুচি ধরার প্রয়োজনও নেই।সে নিজে নিজেই পুরোটা শাড়ি পরল।তারপর ড্রেসিং টেবিলের সামনের টুল টেনে তাড়াহুড়ো করে সেখানটায় বসল।তার সামনে ড্রেসিং টেবিল ভর্তি জিনিস।সে যেদিন হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ হয়েছে,সেদিন বিকালেই একজন ডেলিভারি ম্যান এসে এসব দিয়ে গেছে।নবনীতা তাজ্জব হয়ে জানতে চায় এসব কে পাঠিয়েছে?ডেলিভারি ম্যান জানাল শাহরিয়ার আরহাম আগেই সবকিছুর পিল পে করে দিয়েছেন।

নবনীতা একেবারে অল্প সাজলো।তবে একদমই প্রসাধনীমুক্ত থাকলো না।জামাইয়ের সাথে ঘুরতে গেলে একটু আধটু সাজাই লাগে।নয়তো এতোগুলো জিনিস কি ডেট এক্সপায়ার্ড হয়ে নষ্ট হবে নাকি?

সে টুল ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখল আরহাম তার একদম পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।সে কিছুটা হকচকায়।আরহাম তাকে দেখেই নিজের পকেট থেকে কয়েকটা নেতিয়ে পড়া বেলি ফুল বের করে তার সম্মুখে বাড়িয়ে দিলো।নবনীতা বোকা বোকা হয়ে ফুলগুলো দেখে।আরহাম শুরুতে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।পরে সমস্ত জড়তা কাটিয়ে গাঢ় স্বরে বলে উঠে,’শুভ্রা বলছিল তোমার নাকি বেলি ফুল ভীষণ পছন্দের?তাই বাগান থেকে তুলে নিয়ে এসেছি।এখন আবার বলবে না এগুলার এমন বেহাল দশা কেন।পাঞ্জাবির ভেতরে চাপা পড়ে এই অবস্থা হয়েছে।নাও তোমার কাছে রাখো এগুলা।

নবনীতা বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকায়।আরহাম দ্রুত তার হাত টেনে ধরে সবগুলো ফুল তার হাতের মুঠোয় গুজে দিলো।তারপর চোখ তুলে নবনীতাকে দেখতেই সে থতমত খেল।তাজ্জব হয়ে বলল,’সেকি! তোমার চোখ এমন পানিতে টইটম্বুর কেন?তুমি কাঁদছ?কি সর্বনাশ! ফুল নেতিয়ে গেছে দেখে তুমি কাঁদছ?তুমি,,,’

সে কথা শেষ না করতেই নবনীতা আচমকা এক কদম সামনে এসে শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরল।সেই হাতের বন্ধন এতোই সুদৃঢ় ছিল যে কিছু সময়ের জন্য আরহাম নিজেই নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না।সে রোবটের মতো সটান দাঁড়িয়ে রইল কতোক্ষণ।পরে যখন হুশ হলো,তখন তার চেয়েও জোরালভাবে সে তাকে জড়িয়ে ধরল।আদুরে গলায় বলল,’কি হয়েছে পরী?কাঁদছ কেন বলো তো।’

নবনীতা তার বুকে নিজের মাথা টা চেপে ধরেই শব্দ করে হেসে ফেলল।কান্না মুছতে মুছতে মিষ্টি স্বরে বলল,’আমাকে কখনও কেউ এভাবে ফুল দেয় নি আরহাম।কখনো কেউ এমন করে যত্ন করেনি।সত্যি বলছি।আমার বিশ্বাস হচ্ছে না আমার জীবনেও যত্নের মতো সুন্দর বিষয়টি এসে গেছে।আমার একদমই বিশ্বাস হচ্ছে না।’

সে এভাবেই কতোক্ষণ তার স্বামীর বক্ষস্থলে মিশে রইল।শেষটায় বাচ্চা বাচ্চা গলায় ডাকল,’আরহাম! ও আরহাম!’

আরহাম স্মিত হেসে বলল,’জ্বী ম্যাডাম বলুন।’

‘আপনি এমনই থাকবেন প্লিজ।ঠিক আছে?’

আরহাম আরো একদফা হাসল।নবনীতার মুখটা দুই হাতের আজলে নিয়ে তার দুই চোখের পাতায় চুমু খেয়ে বলল,’ওকে বস।এমনই থাকব।তুমিও এমনই থেকো।শুধু ঝগড়া একটু কম করো কেমন?’

নবনীতা মাথা নামিয়ে লাজুক হাসল।ক্ষীণ স্বরে বলল,’দেখা যাক।’

আজ তার মন মাত্রাতিরিক্ত ভালো।সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাড়ি এসেই সবার প্রথমে সে ডায়রি খুলে বসবে আর চটপট সেখানে নতুন করে যোগ করবে-

★সে আমার জন্য বাগান থেকে এতোগুলা বেলি ফুল পেড়ে এনেছে।ওহহ হ্যাঁ,সে আজ আমার চোখের পাতায় চুমু খেয়েছে,শেষে আবার কপালেও।কে বলে প্রথম ইম্প্রেশনই সব?আমি সেই আহাম্মকের গুষ্টি মা’রি।

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে