কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৬

0
13

#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৬)

সকাল হতেই ডিউটিরত নার্স নবনীতার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে কেবিনে এলেন।আরহাম তখনও নবনীতার শিয়রে বসে চুপচাপ তাকে দেখছিল।কেবিনে নার্স আসতেই সে নড়েচড়ে বসে।দ্রুত পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করে আনমনে তার উপর স্ক্রল করে।নার্স নিশ্চয়ই ভাবছে সে তার বউয়ের প্রেমে মাতোয়ারা।এখন তাকে এমন একটা ভাব নিতে হবে যেন নার্সের মনে হয় বউয়ের দিকে তার কোনো মনোযোগই নেই।সে তো বউকে দেখছে না,সে দেখছে ফোন।

আনুমানিক সাতটা নাগাদ সে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো।হাসপাতালের প্রশস্ত করিডোর তখন জনমানবশূন্য।কেউ নেই আশেপাশে।শুধু ডাক্তার আর নার্সরা একটু পর পর হেঁটে হেঁটে নিজেদের কেবিনে যাচ্ছিল।আরহাম কয়েক দফা হাই তোলে।করিডোরে রাখা চেয়ারগুলোর একটিতে বসে মাথা নামিয়ে কতোক্ষণ ঝিমায়।

হঠাৎ তার মনে হলো সে বাদেও এই করিডোরে আরো কেউ আছে।সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলল সে।পাশ ফিরতেই দেখল করিডোরের শেষ মাথায় কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে।তার পা দু’টো দেখা যাচ্ছে।আরহাম সাথে সাথে চোখ তুলে উপরে তাকায়।তাজ্জব হয়ে আবিষ্কার করে মহিলাটির পরিচয়।

মা শব্দটা বড়ই অদ্ভুত।কেবল একটা অক্ষর,অথচ কতো গভীরতা মেশানো এই শব্দে।আরহামের জীবনেও তো মা শব্দটা কম অর্থপূর্ণ না।মা তাকে বাস্তবতা শিখিয়ে গেছে।মা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে সব মা-ই মমতাময়ী হয় না।তার কাছে তো আরহাম গোটা এক জীবনের শিক্ষা পেয়েছে।

আরহাম দুই হাত মুঠ করে উঠে দাঁড়ায়।তার দুই চোখ হঠাৎই দপ দপ করে অগ্নিশিখার ন্যায় জ্বলে উঠেছে।কপালের রগগুলো তার অনিচ্ছায় ফুলে ফেপে যাচ্ছে।দাঁত কিড়মিড় করছে,হাত নিশপিশ করছে।কেন এই মহিলা বারবার সামনে আসছে?কেন তাকে দুই দন্ড শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না?কেন তাকে বাধ্য করছে সীমা লঙ্ঘন করতে?

সে সামনে আগায় না।কেবল দূর থেকেই দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’এদিকে কি?দূরে যাও।’

তাসলিমা দ্বিধান্বিত হয়ে দুই পা সামনে বাড়ায়।কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে নিলেই আরহাম দুই হাত কানে চেপে চেঁচায়,’কাছে আসবে না।দূরে যাও।অসহ্য লাগে আমার তোমাকে।’

তাসলিমা সেখানেই থেমে গেলেন।আর সামনে আসার চেষ্টা করলেন না।শুধু কাঁপা স্বরে ডাকলেন,’আরহাম! আমার বাবা!’

আরহাম দুই পা পেছায়।হঠাৎই তার কন্ঠস্বর পাল্টে যায়।কানে হাত চেপেই সে নরম গলায় বলে,’প্লিজ তুমি যাও।ভালো লাগছে না আমার।’

তাসলিমা গেলেন না।তবে ব্যথিত গলায় বললেন,’অনেক কষ্টে এই পর্যন্ত এসেছি বাবা।বাড়িতে মিথ্যা অযুহাত দিয়েছি।তুমি আমাকে এখন তাড়িয়ে দিবে?আমি তোমার মা।’

আরহাম একহাত মাথায় চেপেই দুর্বল গলায় বলল,’আমি উল্টাপাল্টা কিছু করে হাসপাতালের পরিবেশ নষ্ট করতে চাই না।যাও এখান থেকে।মাথা গরম করবে না আমার।’

তাসলিমার হঠাৎ রাগ হলো।মনঃক্ষুন্ন হলো ভীষণ।ছেলে তার সামনে দাঁড়িয়ে এমন রূঢ় আচরণ করছে?তিনি এগিয়ে আসতে আসতে কন্ঠে জোর দিয়ে বললেন,’তুমি আমাকে এভাবে তাড়াতে পারো না আরহাম।আমি তোমাদের মা।তুমি আমার দু’টো ছেলেমেয়ে কে আমার থেকে দূরে সরাতে পারো না।তাদের দেখার অধিকার আমার আছে।তুমি আর কত বছর ধরে তাদেরকে তাদের মায়ের কাছ থেকে দূরে রাখবে?এটা কি অন্যায় না?’

‘অন্যায়?তোমার মুখে তুমি ন্যায় অন্যায়ের কথা বলছ?তোমার কি লজ্জা শরম কিছু নেই?’ চমকের পিলে প্রশ্ন করে আরহাম।সে টের পাচ্ছে তার দুর্বলতা কেটে যাচ্ছে।সেই জায়গায় একটু একটু করে ক্রোধ এসে জমা হচ্ছে।অতীতের জ’ঘন্য স্মৃতি সব মাথাচারা দিয়ে উঠছে।নির্ঘুম থাকার দরুণ ঈষৎ লাল হয়ে থাকা চোখজোড়া হঠাৎই ক্রোধানলে জ্বলে উঠে রক্তিম আভা ধারণ করল।আরহাম চিবিয়ে চিবিয়ে বলে উঠল,’নির্লজ্জ হওয়ারও একটা সীমা থাকে।তুমি সেই সীমাও পার করে ফেলেছ।তুমিই আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছ।এখন এসব কেন করছ?ভাল্লাগে না এসব।যাও তুমি।’

তার ফুঁসতে থাকা মুখটা দেখেই তাসলিমার দুইচোখ ভরে এলো।এতো ঘৃণা তার জন্য?এতো ভৎসনা দুই চোখে?তিনি একটু দম নিলেন।ভগ্ন কন্ঠে বললেন,’তুমি,আরিশ আর তাসনুভা আমার সন্তান।এই সম্পর্ক তুমি অস্বীকার করতে পারবে?আরিশ আর তাসনুভার মাথে তুমি আমার দেখা করতে দাও না।কতোখানি পা’ষাণ হয়েছ তুমি একবার দেখেছ?’

আরহাম তার কথা শুনেই শব্দ করে হেসে ফেলল।সেই তাচ্ছিল্যের হাসি মুখে মেখেই বলল,’আমি পা’ষাণ?তুমি আমাদের ছেড়ে গিয়েছ।আমরা তোমায় ছাড়ি নি।আমার বোনের এই অবস্থার জন্য তুমি দায়ী।আমাদের জীবনের এই ছন্নছাড়া অবস্থার জন্য তুমি দায়ী।আমাদের এতো অপমান,এতো হেনস্তা,এতো যন্ত্র’ণা সবকিছুর জন্য তুমি দায়ী।আমাদের আর তোমাকে প্রয়োজন নেই।তুমি যাও।আমার মেজাজ খারাপ হওয়ার আগে তুমি যাও।’

‘যাব না।দেখি তুমি কি করতে পারো।আমি দেখতে চাই আমার সন্তান ঠিক কতোখানি হিংস্র হতে পারে।’

তাসলিমা ঠিক তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।দুইজনের দৃষ্টি মিলতেই আরহাম দ্রুত চোখ নামিয়ে নেয়।সমস্ত শরীর গিজ গিজ করছে।অসহ্য লাগছে সবকিছু।মা কে প্রহার করা কি মহাপাপ?হয়তো।আরহাম তো এমন কিছু করতে চায় না।কিন্তু এই মহিলা কেন সামনে আসে বারবার?সে সামনে আসলেই আরহাম অনুভব করে সে আসলে কোনোদিনই অতীত ভুলতে পারেনি।ঐ এক জায়গায় আরহাম বারবার আটকে যায়,সবকিছু থমকে যায়।মহিলাটা কাছে এলেই সে দমে যায়।একমুহূর্তে রাগ হলে পরমুহূর্তেই আবার অন্যরকমের দুর্বলতা জেঁকে ধরে তাকে।সে মাথা নামিয়ে হসপিটালের ফ্লোর দেখে।দুই হাত মুঠ করে চাপা স্বরে বলে,’প্লিজ।তুমি যাও।যেখান থেকে এসেছ সেখানে ফিরে যাও।আমি নিয়ন্ত্রণ হারাতে চাই না,পরিবেশ নষ্ট করতে চাই না।তুমি যাও।কক্ষনো কোনোদিনও সামনে আসবে না।প্লিজ,এবার আমাদের একটু শান্তি দাও।’

তাসলিমা ছলছল চোখে তাকে দেখে।হাত তুলে দুই চোখ মুছেন।ক্রন্দনরত স্বরে বলে উঠেন,’মা অপরাধ করেছি।সেই জন্য তুমি অনেক বছর অভিমান করেছ আরহাম।মা কে শাস্তি দিয়েছ।তোমাদের কাছেও আসতে দাও নি।যন্ত্রণা কি আমার কম হয়েছে তোমাদের ছাড়া?এবার অন্তত সব ভুলে যাও বাবা।মা কে একটু তোমাদের দেখার সুযোগ দাও,একটু কথা বলার সুযোগ দাও।একটি বারের জন্য ক্ষমা করে দাও।’

ক্ষমা-সবটা কানে যেতেই আপনাআপনি চোখ বড় হয়ে উঠল তার।সে খানিকটা চেঁচিয়ে উঠে বলল,’ক্ষমা?কিসের ক্ষমা?তোমাকে ক্ষমা করার আমি কে?তোমাকে যেই মানুষটা ক্ষমা করতে পারত সে একমাত্র আমার বাবা।বাবাই যখন আর বেঁচে নেই,তখন এই ক্ষমা দিয়ে আমি করব টা কি?আমি বেঈমান না।আমি আমার বাবার কষ্টগুলো ভুলিনি।আমি কোনোদিনই তোমাকে মানতে পারব না।আরিশ আর তাসনুভাকেও মানতে দিব না।তোমার ন্যাকা কান্না আমার অসহ্য লাগে।যাও তুমি এখান থেকে।’

তাসলিমা কান্না মুছতে মুছতেই একবার চোখ তুলে তাকে দেখলেন।তারপরই কি মনে করে একহাত বাড়িয়ে তার গালে রাখলেন।ব্যাস,এতেই খেই হারালো সে।চমকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাড়ায় তার হাত সরিয়ে নিল আরহাম।চাপা স্বরে গর্জে উঠে বলল,’একদম মে’রে ফেলব গায়ে ধরলে।’

‘আরহাম!’

‘রাগ উঠাবে না আমার।যাও এখান থেকে।’

তাসলিমার বদ্ধ ধারণা তার আদরের সন্তান কখনোই তার গায়ে হাত দিবে না।তিনি এগিয়ে এসে আরহামের মাথায় হাত ছোয়ালেন।তার মসৃণ চুলের ভাজে আঙুল চালালেন।আরহাম বিস্মিত হয়ে কয়েক পল তাকে দেখে।তারপরই তাসলিমার বদ্ধমূল ধারনা কে ভুল প্রমাণ করে সে চোয়াল শক্ত করে এক ধাক্কায় তাকে পেছনের দিকে সরিয়ে দেয়।

তাসলিমা সেই জোরাল ধাক্কায় তাল সামলাতে ব্যর্থ হয়ে মেঝের দিকে হেলে পড়লেন।পুরোপুরি নিচে পড়ার আগেই দু’টো হাত শক্ত করে তাকে চেপে ধরল।একটানে তাকে উঠে দাঁড় করালো।তাসলিমা পেছন ফিরে তাকে দেখেই জড়ানো কন্ঠে বললেন,’নওফেল! তুমি?তোমাকে না নিচে থাকতে বলেছিলাম?’

কিশোর ছেলেটা তার কথার জবাব না দিয়ে সোজা সামনের দিকে তাকায়।তার শান্ত চোখ জোড়ার সাথে অন্যপাশের মানুষটার র’ক্তিম চোখজোড়া মিলতেই তার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।

আরহাম তাকে আগাগোড়া পরোখ করে।সাদা রঙের টি-শার্ট,ব্ল্যাক জিন্স,হাতে স্মার্ট ওয়াচ,গলার কাছে সানগ্লাস ঝুলানো,চুলগুলো খুব সুন্দর করে কেটে রাখা।একেবারে সাদামাটা হেয়ার কাট।চোখ দু’টো কার মতো?আরহাম বড়ো বড়ো শ্বাস টেনে একটা ঢোক গিলে।চোখ দু’টো আরিশের মতো।

সে এগিয়ে যায়।গলা খাকারি দিয়ে অত্যন্ত কর্কশ স্বরে চেঁচায়,’এ্যাই ছেলে! তোর মা কে নিয়ে এক্ষুনি বিদায় হ এখান থেকে।যা যা।গেট লস্ট।’

নওফেল স্থির চোখে আরো একবার তাকে অবলোকন করে।তারপরই ঠান্ডা স্বরে বলে,’আমার মা কেন বলছ?সে কি তোমার মা না?’

আরহাম অত্যাধিক খিটখিটে হয়ে ধমক দিলো,’ঐ শালা! তুই আমাকে সম্পর্ক শিখাবি?একটা থা’প্পড় দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিব।এইটুকু ছেলে আমাকে সম্পর্ক শেখাতে এসেছে! যা তোর মা কে নিয়ে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হ।’

‘কেন?হাসপাতাল কি তুমি কিনে নিয়েছ?’

নওফেলের ত্যাড়া জবাবে আরহামের মেজাজ আরো বিগড়ায়।সে তেড়ে এসে কিছু বলার আগেই কোথা থেকে ওয়াজিদ ছুটে এসে ঠিক নওফেলের সামনে এসে দাঁড়াল।সে দাঁড়াতেই নওফেল আরহামের চোখের আড়াল হলো।আরহাম তাকে সরাতে সরাতে বলল,’দেখি সর তো ওয়াজিদ।এর সাথে আমি কথা বলছি।’

ওয়াজিদ তাকে জাপ্টে ধরল।পেছন ফিরে খানিকটা চঞ্চল হয়ে বলল,’নওফেল প্লিজ তুমি সোনা মা কে নিয়ে যাও এখান থেকে।প্লিজ।’

আরহাম তার দুই হাত সরাতে সরাতে খেকিয়ে উঠে বলল,’কিসের সোনা মা হ্যাঁ?বা’লের কথা বলছ।বা’লের আবেগ দেখাস। ঘোড়ার আ’ন্ডা সোনা মা আমার! বল তাসলিমা।ন’ষ্টা তাসলিমা।অন্য লোকের সাথে রঙ্গ তামাশা করা মহিলা।’

তাসলিমা দুই হাত মুখে চেপে দুই কদম পেছালেন।নওফেল ম্লান মুখে তার দিকে তাকায়।তারপরই আবার চোখ নামিয়ে নেয়।ওয়াজিদ একহাতে আরহামের মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে উঠে,’আরহাম স্টপ ইট ফর গড সেক।বাড়াবাড়ি করছিস।থাম।প্লিজ।এটা হসপিটাল।’

আরহাম থামল না।উল্টা ওয়াজিদের চেপে রাখা হাতের নিচ থেকেই মুখ দিয়ে অস্পষ্ট স্বরে চেঁচাল।তার কথা ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছিল না।ওয়াজিদ তাকে জাপ্টে ধরে অনুনয় করল,’প্লিজ ভাই পায়ে ধরি।এখনো তেমন লোকজন নেই।লোক জানাজানি হলেই আবার মিডিয়ার ঝামেলায় গিয়ে পড়বি।প্লিজ।অনুরোধ করছি তোকে।তুই থাম।’

নওফেল শক্ত করে তার মায়ের হাত চেপে ধরে।তারপরই কোনোদিক না দেখে সোজা হেঁটে যায় তিনতালার সিঁড়ির দিকে।সেই হাতটা সে ছাড়ল নিচে নেমে গাড়ির লক খোলার সময়।

প্রথমেই সে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে বসে স্টিয়ারিং দখলে নেয়।তারপরই গাড়ির গ্লাস নিচে নামিয়ে তাসলিমাকে দেখে বলল,’মা দয়া করে গাড়িতে উঠে বসো।অনেক হয়েছে।’

তাসলিমা উদ্ভ্রান্তের ন্যায় এদিক সেদিক দেখে ভঙ্গুর পায়ে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসে।বসেই ব্যাক সিটে গা এলিয়ে দুই চোখ বন্ধ করে।নওফেল স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে পেছন ফিরে স্বাভাবিক হয়ে বলল,’মা,আই নো আরহাম লোকটা ভীষণ রুড।বাট আই ডোন্ট থিংক হি হ্যাজ ডান এনিথিং রং।লাইক তার জায়গা থেকে চিন্তা করলে আমার তাকে খুব একটা খারাপও লাগে না।মানে তুমি ভাবো,সে কিন্তু ভুল কিছু বলে নাই।তুমিই তো সব ছেড়ে বাবার কাছে এসেছিলে।তাহলে এখন কেনো তাদের কথা ভাবছ?ইজ ন্ট ইট সাউন্ডস সো উইয়ার্ড?কেমন অদ্ভুত শোনাচ্ছে না বিষয়টা?’

নওফেল উত্তরের আশায় তাসলিমার মুখের দিকে তাকায়।অথচ তাসলিমার এলোমেলো দৃষ্টি গাড়ির বাইরের পার্কিং লটে।দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর চোখে কিছু একটা দেখছে।কিন্তু আসলে সে কিছুই দেখছে না।নওফেল বুঝতে পারল মা আর তার কথার জবাব দিবে না।সে আর ঘাটায় না।মা কে তার অনেক কিছুই বলতে ইচ্ছে হয়।মায়ের করা ভুল গুলো কি নওফেল উপলব্ধি করতে পারে না?পারে তো।অবশ্যই পারে।তার বয়স হচ্ছে।সে আর কচি বাচ্চা না।আশপাশের মানুষ যা বলবে তাই চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করার বয়স তার নেই।সে বড় হচ্ছে।ভালো মন্দ সে বোঝে।মা বাবার অন্যায়ও সে বুঝে।মা বাবা যেটা করেছে নওফেল ছোট বেলায় সেটাকে সমর্থন করলেও বয়স বাড়তেই সে উপলব্ধি করেছে এটা অন্যায়।স্পষ্ট অন্যায়।শাহরিয়ার আরহামকে তার একটা সময় অসহ্য লাগতো।মনে হতো এই ছেলের জন্য মা এতো কাঁদে! অথচ এখন আর তার তাকে অসহ্য লাগে না।উল্টো মনে হয় তার এমন ঘৃণা করাটাই কি স্বাভাবিক না?মায়ের এমন হাউমাউ কান্নাও এখন তার কাছে স্রেফ প্রকৃতির প্রতিদান বলে মনে হয়।মা অনেক গুলো মানুষকে কাঁদিয়েছে।এখন প্রকৃতি মাকে কাঁদাবে।এটাই তো নিয়তি।এতে এতো মন খারাপের কি আছে?
.
.
.
.
আদি ঘুম থেকে উঠে খুব বেশি সকালে।ভোরের সাথে সাথে।তারপরই বাগানে গিয়ে কতোক্ষণ বাড়ির লোকজনের সাথে কথা বলে।তার দেশে আসার পর টাইমজোন নিয়ে ভীষণ সমস্যা হচ্ছে।আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের প্রায় ১১/১২ ঘন্টা সময়ের ব্যবধান।আদি যখন ঘুমায়,তারা তখন সজাগ।আবার সে যখন সজাগ,তারা তখন ঘুমে।এজন্য ইদানিং সে খুব ভোরে ভোরে উঠে।তারপরই ঘন্টা লাগিয়ে ফোনে কথা বলে।

তাসনুভা এই বিষয়টা অনেকদিন যাবত খেয়াল করছে।সে সকাল সকাল ঘুম ভাঙতেই মদিনা খালাকে বেল বাজিয়ে তার ঘরে ডাকল।সে ঘরে আসতেই মিষ্টি হেসে বলল,’খালা আমাকে একটু হুইলচেয়ারে বসিয়ে দাও না প্লিজ।’

মদিনা হাসিমুখেই তাকে ধরে ধরে চেয়ারে বসায়।তাসনুভা ঘুম ঘুম চোখে বারান্দায় যায়।বারান্দায় যেতেই তার চোখ যায় বাগানে।আদি বাগানের এক ধারে মাটিতে বসে ফোনে কথা বলছে।তার একহাত ফোনে,অন্যহাতে সে একটার পর একটা ঘাস ছিঁ’ড়ছে।

তাসনুভা গলা উঁচিয়ে ডাকে,’ভাইয়া,ও ভাইয়া!’

আদি ফোন কানে চেপেই মাথা তুলে উপরে তাকায়।ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্ন করে,’কি ভাইয়া?’

‘এতো সকালে বাগানে কি করো?’

আদি ফোনটা কানের কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে গলা খাঁড়া করে বলল,’বাড়ির ফোন।কথা বলছি।’

তাসনুভা শুনতে পেরেই মাথা নাড়ল।চটপটে স্বরে বলল,’ওহ আচ্ছা বুঝেছি।’

আদি আরো আধঘন্টা কথা বলল।তাসনুভা ঘরে এসে তার এলোমেলো চুল গুলো আঁচড়ে সুন্দর করে দু’টো বেণী করল।হাত মুখ ধুয়ে টেবিলের উপর থেকে একটা বই হাতে নিল।কাগজে কলমে এখন সে পড়াশোনা থেকে বিচ্ছিন্ন।উচ্চমাধ্যমিক শেষ করার পর সে আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেয়নি।নিতে ইচ্ছেও হয়নি।এই হুইলচেয়ারে করে রোজ রোজ নিচে নামা,তারপর গাড়িতে উঠা,তারপর গাড়ি থেকে নেমে আবার হুইলচেয়ার,তারপর আবার ক্লাসে যাওয়া।সবকিছু মিলিয়ে তার প্রচন্ড ক্লান্ত লাগে।সে ঘরে থেকেই টুকটাক বই পড়ে।ফিকশন তার খুব ভালো লাগে।ইংলিশ ড্রামার উপর লেখা বইও তার ভীষণ প্রিয়।তার সবচেয়ে পছন্দের ড্রামা ম্যাকবেথ।এই নিয়ে বহুবার সে এটার লিখিত বই পড়েছে।আজও সে কি মনে করে সেই বইটাই হাতে নিল।আদি বেশ ব্যস্ত পায়ে নিজের ঘরে যাচ্ছিল।যাওয়ার পথেই অন্যমনস্ক হয়ে তাসনুভার ঘরের দিকে চোখ যেতেই সে থামল।দ্রুত দুই কদম পিছিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে তাকে দেখল।

বারান্দার পর্দা গুলো হালকা বাতাসে উড়ছে।ভোরের অল্প আলোতে পুরো ঘর আলোকিত হয়েছে।হিমেল বাতাসের ঝাপটা তাসনুভার মুখে এসে লাগছে।সে মনোযোগী হয়ে বই পড়ছে।আদি তাকে ডাকতে গিয়েও আর ডাকল না।সে ভাবছে সে তার অজান্তেই তার একটা ছবি তুলবে।ক্যান্ডিড ছবি যাকে বলে।পরে তাসনুভার জন্মদিনে সেটা বাঁধাই করে তাকে গিফট করবে।আইডিয়াটা মাত্রই তার মাথায় এসেছে।

সে দ্রুত ক্যামেরা অন করে চটপট তার কয়েকটা ছবি তুলে নিল।ছবিগুলো তার মনঃপুত হয়েছে।প্রথম দেখাতেই ভালো লাগছে।ছবি তোলে শেষ হতেই সে ভেতরে উঁকি দিয়ে গলা খাকারি দেয়,’হেই বাচ্চা! আসি?’

সঙ্গে সঙ্গে চোখ তোলে তাসনুভা।উচ্ছ্বসিত হয়ে বলে,’এসো এসো।’

আদি এক পা ভেতরে আসতেই তাসনুভা আগ বাড়িয়ে বলল,’আজ হসপিটালে যাবে?’

‘হু।যাব বোধহয়।’

‘ভাবিকে কবে নাগাদ ডিসচার্জ করা হবে তুমি জানো?’

‘নাহ।সেটা বলতে পারছি না।’

তাসনুভা চটপটে হয়ে বলল,’তুমি জানো,ভাইয়া যে ভাবিকে বাড়িতে আনার প্ল্যান করছে?’

আদি ভ্রু কুঁচকায়।-‘তাই নাকি?’

‘হু।আমার তাই মনে হচ্ছে।’

আদি ফিচেল হাসল।মাথা নামিয়ে মৃদু স্বরে বলল,’আসুক।বাড়িতে সব ব্যাচেলর।বউটউ আসলে মজাই হবে।কি বলো?’
.
.
.
.
বাংলায় প্রবাদ আছে-দুধের মাছি।অর্থাৎ সুসময়ের বন্ধু।কিছু মানুষের আগমন হয় আমাদের জীবনের ভীষণ ভালো সময় গুলোতে।ভালো সময় ফুরিয়ে যেতেই তারাও ফুরিয়ে যায়।নবনীতার সুখী সংসারেও দু’টো দুধের মাছির আগমন হয়েছিল।সেটাও সে হসপিটালে থাকা অবস্থায়।

কোনো এক সকালে মিসেস রোকেয়া আর তার কন্যা প্রথা কাচুমাচু করে হাসপাতালের তৃতীয় তালায় এসে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়াল।আরহাম প্রথম দেখায় তাদের চিনতে পারে নি।যখন তারা পরিচয় দিলো,তখন সে ছুটে গেল তাদের কয়েকটা কথা শোনানোর জন্য।এরা কি আদৌ মানুষের কাতারে পড়ে? সাদেক সাহেবের মতোন একটা অসুস্থ মানুষকে ফেলে এরা কেমন করে চলে যেতে পারল?

সে কিছু বলতে পারে নি।ওয়াজিদ তাকে থামিয়ে নিয়েছে।ঠান্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলেছে হাসপাতালে তামাশা করার কোনো মানে নেই।আরহাম আর কিছু বলে নি।যদি কিছু বলারই হয়,তবে পরী বলবে।সে চুপচাপ করিডোরের এক কোণার চেয়ারে গিয়ে বসল।একটু পরে তার আবার বাইরে বের হতে হবে।

মিসেস রোকেয়া প্রায় দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করলেন।নবনীতার ঘুম ভাঙার পর তাকে কেবিনে ডাকা হলো।এই পুরাটা সময় তিনি দু’হাত কচলে সটান দাঁড়িয়ে থাকলেন,অপেক্ষা করছিলেন তার ঘুম ভাঙার।

তিনি আর প্রথা কেবিনে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আরহাম নিজেও বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।সে আজকে ফ্যাক্টরিতে যাবে।গত সপ্তাহে একবারো যাওয়া হয় নি।সে বের হওয়ার আগেই ওয়াজিদ তার কাঁধে হাত চাপল।মোলায়েম গলায় বলল,’মেজাজ ঠান্ডা রাখবি।ঠিক আছে?’

আরহাম একপেশে হাসল।মাথা নেড়ে জানাল,’ওকে ব্রো।যেমনটা তুমি বলবে।’

****

কাজ শেষ করে আরহাম ফিরেছে বিকাল নাগাদ।কেবিন পর্যন্ত যাওয়ার আগেই শিলা নামের একজন নার্স তাকে দেখেই ব্যস্ত হয়ে বলল,’স্যার আপনি এসেছেন?ম্যাম সেই তখন থেকে আপনার খোঁজ করছে।’

আরহাম মাথা নামিয়ে ম্মিত হাসে।তারপরই গম্ভীর হয়ে জানতে চায়,’কেন?এনি প্রবলেম?শরীর খারাপ নাকি?’

‘না স্যার।তেমন কিছু না।মতিন স্যার একটু আগেই তার রিপোর্টস চেক করেছেন।সবকিছু ঠিকই আছে।’

আরহাম আর কথা না বাড়িয়ে সোজা ছয় নম্বর কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।কাঁচের দরজায় চোখ রাখতেই দেখল ভেতরে নবনীতা এক মনে নিজের হাত দেখে যাচ্ছে।

আরহাম ভেতরে ঢুকতেই সে কিছুটা চমকাল।তারপরই হম্বিতম্বি করে বলল,’একটা জরুরি কথা ছিল।’

আরহাম তার ঠিক সামনাসামনি বসল না।সে গিয়ে বসল রুমের এক পাশে থাকা কাউচে।বসেই কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করল,’আবার কি কথা?’

নবনীতা কতোক্ষণ ইতস্তত করল।তারপরই ক্ষীণ স্বরে বলল,’আজকে মামি আর প্রথা এসেছিল হসপিটালে।’

‘হু।এরপর?’

‘এরপর আর কি?মাফ টাফ চাইল।বলল মামার কথা নাকি মনে পড়ে খুব,আমাদের কথাও মনে পড়ে।ঐ বাড়িতে নাকি মন টিকে না।মামিরও দিন দিন শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে।প্রথা,,,,’

‘মোদ্দাকথা,তোমার মামি আর তোমার বোন আবার তোমাদের কাছে ফিরে আসতে চায় তাই তো?’ মাঝপথে নবনীতাকে থামিয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করল আরহাম।

নবনীতা আস্তে করে উপরনিচ মাথা নাড়ে।মৃদুস্বরে জবাব দেয়,’জ্বী।সেটাই বলল।’

‘আর তুমি?তুমি কি বললে?’

নবনীতা আড়চোখে তাকে দেখে।ভাবুক হয়ে বলে,’সোজাসুজি কিছু বলিনি।আপনার ফ্ল্যাট।আপনাকে জিজ্ঞেস না করে বলতে ইচ্ছে হয় নি।আফটার অল আমি তো আপাতত চাকরি টা কন্টিনিউ করতে পারছি না।আপনিই তো সব খরচ দিচ্ছেন।আমি কেমন করে মামিকে থাকার অনুমতি দিব?’

আরহাম গম্ভীর হয়ে বলল,’এতো গভীরে গিয়ে ভাবার দরকার নেই।তোমার মন চাইলে রাখো।কি?তোমার মন চায়?’

নবনীতা ম্লান হেসে মাথা নাড়ে।নমনীয় স্বরে বলে,’আসলে মামির অনেক অনেক অন্যায় আছে।আমি জানি।কিন্তু মামি কখনো আমাদের তাড়িয়ে দেয়নি।মামির বাড়িতে খুব সুখে ছিলাম,তা না।কিন্তু মামি তো তার বাড়িতে জায়গা দিয়েছে।এই একলা শহরে ঐ ঠাই টাও মূল্যবান ছিল।রান্নাও তো সব মামিই করত।কতোগুলো বছর এক সাথে থেকেছি! মামি অমন করে কাঁদলো,আমার মায়া হচ্ছে ভীষণ।’

আরহাম অবাক হলো ভীষণ।চোখ বড় বড় করে বলল,’ডু ইউ রিয়েলি থিংক যে ঐ মহিলা মন থেকে কান্না করেছে?তুমি কি এতোই স্টুপিড?তোমার মনে হয় উনি সত্যিই এসব মন থেকে বলছেন?’

নবনীতা অবাক হলো এর চেয়েও বেশি।চোখে মুখে সেই আশ্চর্য ভাব ধরে রেখেই বলল,’আপনি কি করে জানেন মামি মন থেকে বলেছে নাকি অন্য উদ্দেশ্যে বলেছে?মামির সাথে তো আপনার দেখাই হয়নি।এর আগেই সে কেমন বুঝে গেছেন?’

আরহাম আশ্চর্য হয়।মেয়েটা তার থেকে কথা গোপন করছে।মামির বাড়াবাড়ি অন্যায় গুলো অতি সন্তর্পণে আরহামের কাছ থেকে আড়াল করে যাচ্ছে।অথচ সে কি জানে যে শুভ্রা আরো আগেই সবকিছু আরহাম কে বলে দিয়েছে?

নবনীতা অন্যমনস্ক হয়ে বাইরের দিকে দেখতে দেখতে বলল,’আমি তো আর সবসময় ঐ বাড়িতে থাকতে পারব না।আপনার বাড়িতে যেতে হবে।তো তখন বাড়িতে কেউ তো একজন লাগবে যে রান্নাবান্না করবে।তাছাড়া মামির বাসাতে এতোবছর ছিলাম।মুখের উপর না তো করতে পারি না।মামার ওয়াইফ মামি।মামারও তো কথা বলার জন্য একজন মানুষ প্রয়োজন।অনেক কিছু একসাথে ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি মামি আর প্রথা থাকলেই মনে হয় ভালো হবে।আর আমি জানি,মামি এই বাড়িতে থাকলে আর কোনো খারাপ আচরণ করবে না।’

‘কেন বলো তো?এতো গাট ফিলিং কি করে হচ্ছে তোমার?’

নবনীতা পাশ ফিরে আরহামকে দেখল।দেখতেই মুখে হাসি ফুটিয়ে ন্যাকা গলায় বলল,’কারণ আপনি যে আমার জামাই তাই।নবনীতাকে মামি পাত্তা না দিলেও আরহামের বউকে মামি ভীষণ পাত্তা দিবে,খুব বেশি যত্ন করবে।আমার অন্তত তাই মনে হয়।’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে