কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৫

0
108

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৫)[প্রথম অংশ]

নোমান সাহেব রাতের খাবার শেষে কেবলই নিজের ঘরে পা রেখেছিলেন।তাসলিমা তখন খাট ঝেড়ে শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।কালকের দিনটা তার জন্য বিশেষ।কাল একজন বাড়িতে আসবে।সে তাসলিমার ভীষণ ভীষণ প্রিয়।

নোমান সাহেব চোখের চশমাটা খুলে খাটের পাশের সাইড বক্সে রাখতেই কোথা থেকে আমেনা খাতুন তার ঘরের সামনে ছুটে এলেন।বন্ধ দরজায় কড়াঘাত করতে করতে চঞ্চল কন্ঠে চেঁচালেন,’নোমান দরজা টা খুলো।নিচে এসে দেখে যাও ঐ ছেলেটা আমার ফাহাদের কি অবস্থা করেছে।’

নোমান সাহেব ধড়ফড়িয়ে উঠলেন।এক দৌঁড়ে ছুটে গেলেন দরজার দিকে।তাসলিমা নিজেও চমকায়।ফাহাদের আবার কি হয়েছে?তাকে কিছু করার মতো দুঃসাহস কে দেখাবে?নোমান সাহেব আমেনা খাতুনের পিছু পিছু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই তাসলিমাও দ্রুত তাদের অনুসরণ করলেন।দোতালার খোলা করিডোরে আসতেই নিচের দৃশ্য দেখে তার কদম শ্লথ হয়।থমকে যায় সবকিছু।চোখ গিয়ে আটকায় নিচতালার ওপেন স্পেসে দাঁড়ানো সুঠাম দেহী যুবকের দিকে।

আরহাম একহাতে ফাহাদের কলার ধরে তাকে টানতে টানতে তার বাড়ির ভেতর এনেই সজোরে ফ্লোরে ছুড়ে মারল।ফাহাদ নিভু নিভু নিস্তেজ চোখে একবার মাথা তুলে তাকে দেখার চেষ্টা করল।তার মুখ দিয়ে থেমে থেমে একটু পর পর র’ক্ত বের হচ্ছে।সারা শরীরে ধুলো মেখে নোংরা হয়ে আছে।

আমেনা খাতুন সিঁড়ি থেকে নেমেই আবারো ছুটে গেলেন সেদিকে।কাঁদতে কাঁদতে তার চোখ ফুলে গেছে।খালেদ সাহেব আজ বাড়ি নেই।জরুরি কাজে শহরের বাইরে গিয়েছেন।এমন একটা দিনে আজিজ হোসেনের রগচটা ক্ষেপাটে ছেলেটা তার ছেলেকে মা’রতে মা’রতে অর্ধমৃত করে তার বাড়ির দুয়ারে এনে ফেলেছে।ছেলেটার চোখের হিংস্রতা দেখেই আমেনা মিইয়ে গেলেন।কি জ্বলজ্বলে আর র’ক্তিম দু’টো চোখ! যা থেকে ঠিকরে ঠিকরে পড়ছে আগ্নেয়গিরির লাভা।

আরহাম দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে যায়।মাটিতে হাত পা ছেড়ে লুটিয়ে পড়া যুবকটির কলার টেনে তাকে কোনোরকমে উঠে বসায়।তারপরই তার পুরো বাড়ির লোকের সামনে ঠাটিয়ে তার দুই গালে পর পর দু’টো চড় মারে।আমেনা বেগম আঁতকে উঠেন।ছুটে গিয়ে মেঝেতে বসে দুই হাতে ফাহাদ কে জড়িয়ে ধরেন।অনুনয় করে বলেন,’ছেড়ে দাও বাবা।আর মেরো না।ম’রে যাবে আমার ছেলেটা।’

আরহাম ক্ষেপাটে সুরে গর্জন তুলে,’ম’রে যাক।আমার কি?মর’লে একটা আবর্জনা দূর হবে।’

নোমান সাহেব আশ্চর্য হয়ে তার কাজকর্ম দেখে।কতোখানি বেপরোয়া হলে একটা ছেলে তার প্রতিপক্ষকে তারই বাড়িতে এসে মারতে পারে! তিনি এগিয়ে যান।গলা খাকারি দিয়ে জোর গলায় ধমকে উঠে বলেন,’এসব কি?এটা একটা একটা ভদ্র মানুষের বাসা।রাত বিরাতে এসব কি শুরু করেছ তুমি?’

আরহাম তার কন্ঠ শুনতেই সেদিকে তাকায়।তার শানিত আর রক্তিম চাহনি দেখেই নোমান সাহেব কিছুটা ভড়কে গেলেন।তাসলিমা নিশ্বাস বন্ধ করে সিঁড়ির কিনারায় এসে দাঁড়ান।আরহাম ফোঁপাতে ফোঁপাতে মুখ খিঁচে গালি দেয়,’ঐ কু’ত্তার বাচ্চা! তোর মতো কু’ত্তা এখন আমাকে ভদ্রলোকের সংজ্ঞা শেখাবে?তুই কোথাকার ভদ্রলোক হ্যাঁ?’

নোমান সাহেব তার এক কথাতেই দমে গেলেন।অপমানে আর লজ্জায় দ্রুত মাথা নামিয়ে নিলেন।চোরা চোখে একবার এদিক সেদিক দেখলেন।বাড়ির বাকি সদস্যদের দৃষ্টিও তার দিকে।বাড়িভর্তি লোকের সামনে ছেলেটা তাকে নির্দ্বিধায় যা নয় তাই বলছে।জনাব আজিজ হোসেনের নম্রতা ভদ্রতার ছিটেফোঁটাও তার মাঝে নেই।

আরহাম তার লজ্জিত মুখটা দেখেই পৈশাচিক আনন্দ পায়।তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠে বলে,’অন্যের বউ নিয়ে সংসার করিস।তুই আবার আমাকে ভদ্রতা শেখাস?তা কোন ভদ্রলোক অন্যের বউকে নিয়ে সংসার পাতে আমাকে একটু বল তো।শা’লা নিজেও চরিত্রহীন আর ভাতিজাও হয়েছে একটা চরিত্রহীন।দুই বিয়ে করেছে,তার মাঝে একটাও টিকে নাই।টিকবে কেমন করে?এমন নষ্ট বাড়িতে কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে সংসার করতে পারে?যতোসব নষ্টা মানুষের আখড়া!’

নোমান সাহেব দাঁতে দাঁত পিষে তাকে সাবধান করল।রাগত স্বরে কঠিন গলায় বললেন,’চুপ করো তুমি।তুমি যে চরম বেয়াদব আর বেপরোয়া সেটা আমি জানি।নিজের আচরণে আর সেটা প্রমাণ করতে হবে না।ফাহাদ কে কেন মেরেছ তুমি?ক্ষমতা পেয়েছ বলে যা খুশি তাই করবে নাকি?’

‘হ্যাঁ,যা খুশি তাই করব।তুই পারলে ঠেকা।আর তোর ভাতিজা কে বলবি পরের বার যদি আমার বাড়ির কারো দিকে হাত বাড়ায়,তাহলে এই শরীরটা আর শরীরের জায়গায় থাকবে না।কে’টে কু’চি কু’চি করে বুড়িগঙ্গায় ভাসাব।জারজ বেজন্মা কোথাকার! আমার ঘরের দিকে হাত বাড়ায়।কত্তো বড় কলিজা!’

আরহাম চিবিয়ে চিবিয়ে তার ক্রোধটুকু ঢেলে দিয়েও ক্ষ্যান্ত হয় না।একবার বড় করে শ্বাস নিয়েই পুনরায় কর্কশ গলায় চেঁচিয়ে উঠে,’আমি আজিজ হোসেন না।তার মতো নমনীয় আচরণ আমার থেকে আশা করবি না।আমি কোনো দয়ার ভান্ডার না।আরেকবার আমার পরিবারের দিকে হাত বাড়াবি,তো সব কয়টা কে জুতা পেটা করব।শা’লা ইতরের দল!’

তাসলিমা কাঁপতে থাকা শরীরে দুই ধাপ নিচে নেমে এলেন।আরহাম অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিক চোখ নিতেই তার সাথে তার চোখাচোখি হলো।তাসলিমা সঙ্গে সঙ্গেই ঝর ঝর করে কেঁদে দিলেন।

আরহাম শান্ত হলো।স্থির দৃষ্টিতে কয়েক পলক তাকে দেখল।থেমে থেমে বড় করে দু’টো শ্বাস নিল।দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মাথা নামিয়ে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করল।নিজেই মনে মনে বলল,’দুর্বল হবি না আরহাম।প্লিজ দুর্বল হবি না।এই মহিলার সামনে তুই দুর্বল হবি না।’

আরহাম আবারো সামনে তাকায়।তাসলিমা হেঁচকি তুলতে তুলতেই আরো দুই ধাপ নেমে এলেন।আরহাম ফ্যালফ্যাল করে কতোক্ষণ তাকে দেখে।তারপর দেখে তার পোশাক।এটা কি পরেছে?শাড়ি?অথচ বাবা তাকে কতো বলত শাড়ি পরতে।সে বছরে ছ’মাসে একবার পরত।শাড়ি নাকি ওল্ড ফ্যাশন।এখন কেমন করে শাড়ি পরছে?এখন সেটা ওল্ড হয়নি?

আরহাম আর এক মুহূর্ত দাঁড়াল না।কিছুক্ষণ আগের আবেগ অনুভূতি সব মাটিচাপা দিয়ে সে এক দলা থুথু মেঝেতে ফেলল।তারপরই তাসলিমার দিকে একটা ভৎসনার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সাথে সাথে এক প্রকার ছুটে সেখান থেকে বেরিয়ে এলো।

গাড়িতে বসেই সে দুই হাত স্টিয়ারিংয়ে রেখে কতোক্ষণ সেখানে মাথা ঠুকল।এই মহিলাকে দেখলে তার এমন পাগল পাগল লাগে কেন?কেন সে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়?এতো বছরেও কি সে তাকে পুরোপুরি ঘৃণা করতে পারে নি?এখনো কি মনের গহীনে কোথাও তার প্রতি আরহামের দুর্বলতা রয়ে গেছে?

রোকন একটু দূরেই দাঁড়িয়েছিল।আরহাম গাড়িতে বসতেই সে ছুটে এলো গাড়ির কাছে।ব্যস্ত হয়ে জানতে চাইল,’সব ঠিক আছে ভাই?’

আরহাম উত্তর দিলো না।কেবল তড়িঘড়ি করে ড্রাইভিং সিট থেকে নেমে পেছনের সিটে গিয়ে বসল।তারপরই কতোক্ষণ নিরব থেকে শেষটায় ভারি গলায় বলল,’তুই ড্রাইভ কর রোকন।আমি করলে এক্সিডেন্ট হয়ে যাবে।’
.
.
.
.
শুভ্রা দীর্ঘসময় তার আপাইকে জড়িয়ে ধরে নিশ্চুপ হয়ে পড়ে রইল।নবনীতা কাঁপা কাঁপা হাতে তার মাথায় হাত বুলায়।জড়িয়ে আসা গলায় ধীরে ধীরে বলে,’আমি ঠিক আছি তো শুভি।এতো ভয় পাচ্ছিস কেন বল তো?’

শুভ্রা জবাব দেয় না।উল্টো নিজের শরীরটা আরো বেশি গুটিয়ে নেয়,ছোট্ট বেড়াল ছানার মতো টেনে টেনে আপাইয়ের শরীরের মিষ্টি ঘ্রাণ নেয়।যদিও এখন তার শরীরে কেবল ঔষধ আর স্যানিটাইজারের ঘ্রাণ মিশে আছে,তবুও সবকিছুকে ছাপিয়ে শুভ্রা তার পরী আপাইয়ের অস্তিত্ব অনুভব করতে পারে।

নবনীতা তার মাথায় একহাত রেখেই পাশ ফিরে চিত্রা কে দেখে।চিত্রা এখনো নবনীতাকে স্পর্শ করে নি।এমনকি তার খাটেও বসে নি।সে দাঁড়িয়ে আছে তার পাশাপাশি,তার থেকে একটু দূরে।নবনীতা মিষ্টি হেসে তাকে কাছে ডাকল।

‘চিত্র! এ্যাই চিত্র! আপাইয়ের কাছে আসবে না?এসো এসো!’

চিত্র এক পা এগোয়।পিট পিট করে চোখের পাতা ফেলে রিনরিনে গলায় বলে,’তুমিই আমার আপাই?’

নবনীতা হাসে।হাস্যোজ্জ্বল মুখে জবাব দেয়,’জ্বী সোনা।আমিই তোমার আপাই।কেন?আমাকে কি আর চেনা যাচ্ছে না?’

চিত্রা তার দিকে আরেকটু এগিয়ে এলো।একবার আগাগোড়া তাকে দেখে গম্ভীর হয়ে বলল,’তোমাকে মমি দের মতো লাগছে আপাই।’

নবনীতা তার কথা শুনেই খিলখিল করে কতোক্ষণ হাসল।একহাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে তার কপালে চুমু এঁকে বলল,’হ্যাঁ রে সোনা।আপাতত কিছু দিন মমি হয়েই থাকতে হবে।এখন বলো,তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?’

চিত্রা দুই দিকে মাথা নেড়ে প্রশস্ত হাসল।নবনীতার জীর্ণ বুকে ঝাপিয়ে পড়তে পড়তে চঞ্চল গলায় বলল,’না,একটুও পাচ্ছি না।’

শুভ্রা বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে নেয়।নিজের আর আপাইয়ের মাঝে চিত্রাকে জায়গা দিতে দিতে মেজাজ দেখিয়ে বলে,’এসেছে।সবকিছুতে ভাগ বসাতে এসে গেছে।’

নবনীতা দুই বোনকেই জড়িয়ে ধরল।শুভ্রা দরজার দিকে দেখতে দেখতে ভয়াতুর কন্ঠে বলল,’ডাক্তার অথবা নার্সরা যদি দেখে কথা বলতে এসে আমরা রীতিমতো খাটে উঠে শুয়ে গিয়েছি,তাহলে সব ক’টাকে রামধমক দিবে।’

নবনীতা স্মিত হেসে দুই জনের মাথায় হাত ছোঁয়ায়।গাঢ় স্বরে বলে,’কিচ্ছু হবে না।কেউ কিছু বলবে না।তোরা থাকলে আমি আরো দ্রুত সুস্থ হবো।’

মাতৃত্ব একটা অদ্ভুত বিষয়।যে গর্ভে ধারণ করে সে জননী,আর যে লালন পালন করে বড়ো করে সে মা।নারীস্বত্তার চমৎকার দিকগুলোর একটি হলো মেয়েরা জননী না হয়েও মা হতে পারে।মেয়েদের মধ্যে অন্তর্নিহিত হিসেবে এই গুণটি উপস্থিত থাকে।পাঁচ বছরের ছোট্ট মেয়েটিও যখন দুই মাসের একটি বাচ্চাকে কোলে তোলার বায়না ধরে,তখনও তার মাঝে একটা অদ্ভুত মাতৃত্ব কাজ করে।মেয়েরা আক্ষরিক অর্থে মা হওয়ার আগেও বহুবার মা হয়।

নবনীতাও তার ব্যতিক্রম না।যেই দু’টো প্রাণকে ঘিরে তার জীবন আবর্তিত হচ্ছে,তাদের নিকট সে মায়ের চেয়ে কম কিছু না।আক্ষরিক অর্থে সে তাদের বোন।অথচ চিত্রা নামের ছোট্ট মেয়েটির নিকট আপাই আর মা শব্দটির মাঝে কোনো উল্লেখযোগ্য পার্থক্য নেই।তার জীবনে মা বলতে যেই স্বত্তাটি উপস্থিত তার নাম পরী।যে তাকে বুকে চেপে মানুষ করেছে,যে নিজে না খেয়ে তাকে খাইয়েছে,যে তার সব পছন্দের খেলনা কিনে দিয়েছে,যে নিজের এলোমেলো চুল ফেলে তার চুল বেঁধে দিয়েছে।যে নিজের ভাগের মজাদার খাবার টুকুও চিত্রাকে খাইয়েছে।মা কেমন হয় চিত্রা জানে না।কখনো জানতে ইচ্ছেও হয় নি।মা শব্দের যে সংজ্ঞা আছে,সেই সংজ্ঞার সাথে তো তার আপাইয়ের সংজ্ঞা মিলে যায়।তাহলে চিত্রা কেন মা কে খুঁজবে?তার তো আপাই আছে তাই না?

এই কয়টা দিন চিত্রা কোনোকিছু ভালো মতো খায়নি।হসপিটালের বেডে যেই মেয়েটা লাচার হয়ে পড়েছিল,সেই মেয়েটা খাইয়ে না দিলে চিত্রার কোনো খাবার মজা লাগে না,সে ঘুম না পাড়ালে তার ঘুম আসে না।এতোগুলো দিন পর চিত্রা তাকে পেতেই একেবারে আষ্টেপৃষ্টে তাকে জড়িয়ে ধরল।বাচ্চা বাচ্চা গলায় বায়না ধরে বলল,’পরী! আজকে তুমি আমাকে খাইয়ে দিবে কেমন?

নবনীতা তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একগাল হেসে উত্তর দিলো,’অবশ্যই।আমার দুইটা কলিজার টুকরাকেই আজকে আমি খাইয়ে দিব।ডাক্তার যা খুশি বলুক।আমি আজ আমার বোনদের নিজ হাতে খাওয়াব।’

____

পরের দিন রাতে নবনীতার কেবিনে ছোট ছোট পা ফেলে একজন কিশোর উপস্থিত হলো।তাকে দেখেই নবনীতার দুই চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠল।সে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,’শাহাদাত তুমি?’

শাহাদাত শান্ত হয়ে আরো দু’পা সামনে আসে।তার চোখ মুখ স্বাভাবিক।তাকে একেবারে সুস্থ দেখাচ্ছে।সে এগিয়ে এসে নবনীতার ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল,’আপনে তাইলে আসমানের হুর না?’

নবনীতা ভড়কে গিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল,’কি?আমি কেন হুর হতে যাবো?’

‘প্রথম দিন আপনেরে দেইখা হুরই ভাবছিলাম।আপনে কোনো কারণ ছাড়াই আমারে টাকা দিসিলেন।এমনে তো মাইনষে অকারণে কেউ কারো লেগ্গা কিছু করে না।তাই।’

নবনীতা একগাল হাসে।পরক্ষণেই আবার চোখ মুখ শক্ত করে বলে,’লেগ্গা আবার কেমন কথা?বলো কেউ কারো জন্য কিছু করে না।’

শাহাদাত মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,’কেউ কারো জইন্য কিছু করে না।’

‘জইন্য না জন্য।’

‘জ্বে,জন্য।’

‘জ্বে না,জ্বী।’

শাহাদাত হাঁফ ছেড়ে বলে,’জ্বী।’

শুভ্রা আর চিত্রা কেবিনের একপাশের সোফায় বসে তার কথা শুনছিল।সে থামতেই শুভ্রা উঠে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত চেপে বলল,’কি সর্বনাশ! এর আর এর বোনের উচ্চারণে তো ভয়াবহ সমস্যা।’

নবনীতা কড়া গলায় বলল,’এ্যাই শাহাদাত।তুমি এখন থেকে শুদ্ধ করে কথা বলবে বুঝেছ?’

‘জ্বে আফা।’

‘আবার জ্বে!’

‘জ্বী আফা।’

‘আফা না।বলো আপা।না না আপা না।বলো আপাই।বলো তো দেখি।’

শাহাদাত হাই তুলতে তুলতে জবাব দেয় আপাই।

রিমি এসেছে গুনে গুনে তিন মিনিট পরে।বরাবরের মতোই বিভা তার কোলে।সে কেবিনে এসেই শাহাদাত কে দেখে মৃদু হাসল।তারপর বিভাকে দেখে বলল,’কি বিভা?এটা কে?’

বিভা নিজের আঙুল নিজেই কা’মড়াতে কা’মড়াতে জবাব দেয়,’বাইয়া।’

রিমি বিরক্ত হয়-‘উহু,বাইয়া না মনা।বলো ভাইয়া।’

শাহাদাত এগিয়ে এসে তাকে কোলে নিল।অবাক হয়ে বলল,’বিভা এতো সুন্দর হইছে কেমনে?বিভারে বিদেশি বাচ্চাগো মতোন লাগতাছে।’

তার কথা শুনেই পেছন থেকে নবনীতা চাপা স্বরে ধমক দেয়,’লাগতাছে কি শাহাদাত?বলো লাগছে।’

শাহাদাত কাচুমাচু মুখ করে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার তাকে দেখে।কি অদ্ভুত সমস্যা এসে জুটেছে তার ঘাড়ে! সে এতো শুদ্ধ কেমন করে বলবে?এই জীবনে সে কোনোদিন এতো শুদ্ধ বলেনি।তাও বস্তির বাকিদের তুলনায় সে কতো সুন্দর করে কথা বলে! তবুও এই সুন্দর আপাটার তার কথা পছন্দ না।সে সিদ্ধান্ত নিল যতক্ষণ সে তার সামনে থাকবে ততক্ষণ সে মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে।কোনো শব্দই করবে না,না মুখ ফুটে কিছু বলবে।

রাত বাড়তেই নবনীতা এদিক সেদিক দেখে।আনমনেই একজনকে খুঁজে।সেই যে সেদিন বেরিয়েছে,এরপর আর একবারো তার কেবিনে আসেনি।এতো অদ্ভুত কেন মানুষটা?এক মুহূর্তে এতো বেশি যত্ন দেখিয়ে পরমুহূর্তেই এমন পাল্টে যায় কেন?এই তিনদিন নবনীতার কীভাবে কেটেছে,সে কেমন ছিল-একবারো কি এসব জানতে ইচ্ছে হয়নি তার?অথচ নবনীতার জ্ঞান ফেরার পর সে যেই যত্ন দিয়ে তাকে আগলে নিয়েছিল,পরের তিনটে দিন নবনীতা চাতক পাখির মতো সেই যত্নের অপেক্ষা করতো।অথচ মানুষটা একবারো এলো না।এসে অস্থিরতা দেখালো না।চঞ্চল হয়ে জিজ্ঞেস করল না হাই সেনোরিটা! কেমন আছ তুমি?

নবনীতার অভিমান হয়।অল্প স্বল্প কষ্টও হয়।এতো দায়সারা মানুষ হয়?সেদিনই তো বড় গলায় বলল কোনো ভয় নেই,সে আছে।তাহলে এই তিনটে দিন সে কেন এলো না?কেন তার উদ্ভট কাজকর্মে নবনীতার মন ভালো করে দিলো না?সে কি বুঝে না সে না এলে নবনীতার তার কথা মনে পড়ে?সেও তো নবনীতার পরিবার।সে নিজের মুখেই এ’কথা বলেছে।পরিবার ছাড়া যে নবনীতার ভীষণ একা একা লাগে এই কথা কি তার অজানা?

নবনীতা বড় করে দুই বার শ্বাস টানে।সে আর এসব ভাববে না।এতোকিছু ভাবার কি আছে?তাদের কোনো প্রেমের বিয়ে হয়নি যে জামাই তাকে চোখে হারাবে।যেই পরিস্থিতিতে বিয়ে হয়েছে,সেই তুলনায় সে ভালোই আছে।অন্তত সম্মানের সাথে বেঁচে তো আছে।এটাই অনেক।নেতা শ্রেণির লোকদের কাছ থেকে সে এর চেয়ে ভালো আর কি আশা করে?এরা হয়ই এমন হিপোক্রেট।

বার বার বোঝানো স্বত্বেও মন তার কথা বুঝে না।ঘুরে ফিরে বার বার তার মন খারাপ হয়ে যায়।তার কষ্ট হয়।কেমন খালি খালি লাগে।মনে হয় সব আছে,তাও কিছু একটা নেই।

চলবে-

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৫)[দ্বিতীয় অংশ]
[রিচেক নেই]

আকাশে এক ফালি চিকন চাঁদ মোহনীয় দ্যুতি ছড়াচ্ছে।চাঁদের আকার দেখে মনে হচ্ছে এর বয়স বেশিদিন হবে না।এক ফালি চাঁদ যেন উচ্ছ্বসিত তরুণীর প্রাণখোলা হাসির প্রতীক।

ছাদের কার্ণিশ ঘেঁষে বসে থাকা যুবক হাতে থাকা সিগারেটে শেষ টান দেয়।তারপরই সেটাকে মাটিতে ছুড়ে এক পা দিয়ে পিষে ফেলে।তারপর উদ্ভ্রান্ত চোখে আকাশ দেখে।এক ফালি চাঁদ আর তার সাথে অসংখ্য মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা।আরহাম কিছুক্ষণ আকাশ দেখেই চোখ নামিয়ে নেয়।আনমনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বুকের বা পাশটা পোড়াচ্ছে ভীষণ।সেদিকে ঝড় হচ্ছে,কালবৈশাখীর তান্ডবে সবকিছু চুরমার হচ্ছে,অনুভূতির টানাপোড়েনে ভীষণ হাঁপিয়ে উঠেছে সে।সে হাতড়ে হাতড়ে পকেট থেকে একখানা ছবি বের করে।ছবিটা বেশ পুরোনো।গত সতেরো বছরে সে বহুবার রাগের মাথায় ছবিটা দুমড়ে মুচড়ে মুষ্টিবদ্ধ করেছে,পুড়ে ফেলতে চেয়েছে,ছিঁড়ে ফেলতে চেয়েছে।কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো এক অজানা কারণে সে ছবিটা ছিঁড়তে পারে নি।ছবিটা পাঁচজন মানুষের সুখী সংসারের ছবি।পাঁচটা প্রাণের একই ছাদের নিচে থাকার ছবি।

আরহাম একহাতে নিজের চুল টেনে ধরে।নিজেই কতোক্ষন নিজের হাঁটুতে কিল ঘুষি মা’রে।সে কেন অতীত থেকে বের হতে পারছে না?কেন সে একটু একটু করে স্বাভাবিক হতে গেলেই পরমুহূর্তেই অনেক বেশি অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে?

আদি ছাদের দরজায় এসে দাঁড়ায়।দুই হাতে তার কফির মগ।সেখান থেকে ধোঁয়া উঠছে।সে নিঃশব্দে এগিয়ে এসে আরহামের পাশটায় গিয়ে বসল।হাতের মগটা তার দিকে এগিয়ে দিলো।আরহাম পাশ ফিরে একবার মগটা দেখেই বিনা বাক্য ব্যয়ে সেটা হাতে নিল।

‘আরহাম!’

নিরবতা ছাপিয়ে আদির প্রথম সম্বোধন।

আরহাম তার দিকে না ফিরেই জবাব দেয়,’হু?’

‘কি হয়েছে ভাই?এই ক’দিন ধরে দেখছি।কেমন এলোমেলো হয়ে আছিস।কি হয়েছে?আমাকে বল।’

আরহাম জবাব দিলো না।কেবল সময় যেতেই নিচে দেখে আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

আদি তার কাঁধে হাত রাখে।নিরেট স্বরে প্রশ্ন করে,’তুই বলেছিলি ফাহাদের সাথে বাড়াবাড়ি করবি না।সেই তো বাড়াবাড়ি করলি।এভাবে কেউ কাউকে মা’রে?যদি ম’রে যায়?’

আরহাম এক ঝাড়ায় নিজের কাঁধ থেকে তার হাত সরায়।গজরাতে গজরাতে উত্তর দেয়,’মর’লে ম’রুক।আমার কি?ম’রার জন্যই মে’রেছি।ম’রে যাক।ফাহাদের বাড়ির সবাই ম’রে যাক।খুশি হবো আমি,শান্তি পাব খুব।’

আদি প্রতিউত্তর না করে চুপচাপ আকাশ দেখে।আরহাম কতোক্ষণ নিজের হাত কচলায়,কতোক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে এপাশ ওপাশ দেখে।তারপরই গম্ভীর হয়ে বলে,’শুরুতেই এতো এগ্রেসিভ হইনি।ঐ ফাহাদই প্রথমে স্ল্যাং ইউজ করেছে।পরী আর আমার ম্যারিড লাইফ নিয়ে নোংরা ওয়ার্ড ইউজ করেছে।আই সয়্যার।নয়তো এমনভাবে জীবনেও মা’রতাম না।’

‘ফাহাদ তো এমনই।তুই তো জানিসই।যাক গে,সে ম্যারিড লাইফ নিয়ে বললেই কি?তার নিজেরই তো দুই দুইটা বিয়ে ভেঙেছে।তাকে মে’রেছিস,এই নিয়ে নো কমেন্টস।কিন্তু নিজের সংসারে অশান্তি করছিস কেন?রোজ রোজ হসপিটালে যাচ্ছিস,রাতের পর রাত কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখছিস।অথচ তার ঘুম ভাঙার আগেই চলে আসছিস।এই আচরণের মানে কি?’

আদির উদগ্রীব আর প্রশ্নাত্মক চাহনি দেখেই আরহাম ফিচেল হাসল।মাথা চুলকে বলল,’কোনো মানে নেই।বউকে এতো পাত্তা দেওয়া ভালো বিষয় না।সেজন্য পাত্তা দিচ্ছি না।একবার তো দেখা হয়েছেই।এতো রোজ রোজ কথা বলার কি আছে?পুরোপুরি সুস্থ হোক।এরপরই কথা বলব।’

‘অদ্ভুত! রোজ রোজ গিয়ে দেখে আসছিস।কিন্তু বলছিস পাত্তা দেওয়া ভালো না।এটা কেমন কথা?’

‘আমার দেখা আমি দেখছি।আমি চাই না নবনীতা জানুক আমি রোজ রোজ হসপিটালে যাচ্ছি।’

আদি মাথার একপাশে হাত চেপে বিভ্রান্ত হয়ে বলল,’তুই যে কি ভাবিস আর কি করিস তুই ই জানিস।তোর কাজকর্ম মাঝে মাঝে আমার মাথায় ধরে না।’

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে রাতের গভীরতা বাড়ে।সময় তখন রাত নয়টা একুশ।আকাশ কালো হয়ে এসেছে।রূপালি চাঁদের রোশনাই একটু বেড়েছে বোধহয়।আরহাম কফি শেষ করে টেনে টেনে দ্বিতীয় সিগারেট টা শেষ করার পর ছাদের রেলিং থেকে নেমে এলো,ঠেস দিয়ে বাঁকা হয়ে দাঁড়ালো।একটা ঢোক গিলে কিছু কথা বলার প্রস্তুতি নিল।গুছিয়ে সে কথা বলতে পারে না।তবুও চেষ্টা করছে আজ যেন গুছিয়ে সবটা বলতে পারে।আদি তার মতিগতি বুঝতেই তাকে সময় দিলো।অপেক্ষা করল তার নিজ থেকে কিছু বলার।

আরহাম দুই হাত বগলদাবা করে দাঁড়ায়।নিস্তব্ধ রাতের নিরবতা কাটিয়ে গাঢ় পুরুষালি কন্ঠে বলতে শুরু করে,’তাসলিমা যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায়,তখন আমি ক্লাস সেভেনে।আরিশ বোধহয় ওয়ান অথবা টু তে,ঠিক মনে নেই।আর তাস তখনো বাচ্চা।দুই বছর বয়স।মা যেই সময়টাতে আমাদের ছেড়ে চলে গেল সেই সময়টাতে আমার আশেপাশের মানুষরা এতো নোংরা নোংরা কথা বলতে শুরু করল যে আমি মেন্টালি আনস্টেবল হতে শুরু করলাম।জানি তুই সবটা জানিস,তবুও বলছি।মায়ের এই নোংরা রূপটা আমি কেন জানি সহ্যই করতে পারি নি।আমার বুক ফেটে কান্না আসতো।সেই সময়টা একটু একটু করে আমার মাঝে কি হলো জানি না,জগতের সকল নারীদের প্রতি আমার মন বিষিয়ে এলো।দেখলেই গা ঘিন ঘিন করত।মন চাইতো এক চড় মেরে হাত পা বেঁধে বাড়িতে এনে ফেলে রাখি।নারী স্বাধীনতা আর নারী শিক্ষার কথা শুনতেই নাক ছিটকে দূরে সরে আসতাম।সেই থেকে পণ করলাম আমি বিয়ে করলে ফাইভ পাশ কোনো মেয়েকেই বিয়ে করব,প্রয়োজনে অশিক্ষিত গণ্ডমূর্খ মেয়ে বিয়ে করব।তবুও এমন মেয়ে বিয়ে করব না যার এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো,কিংবা যে খুব হাইলি এম্বিশাস হয়।সেই ধারণা নিয়ে একটা দীর্ঘসময় কাটিয়ে দিয়েছি।তারপরই আমার জীবনে পরী এলো।উচ্চশিক্ষিত,প্রচন্ড রকমের মেধাবী,সেই সাথে ফিউচার নিয়ে হাইলি এম্বিশাস।সাথে আবার প্রতিবাদী,তেজস্বী,প্রখর আত্মসম্মানে ভরপুর।মোদ্দাকথা আমার চাহিদার ঠিক বিপরীত একটা স্বত্তা।আমার তাকে প্রথম দেখাতেই কেমন ত্যাদড় আর বেয়াদব মনে হয়েছে।তবে একটা সময় নবনীতার বাইরে আমি তার আরেকটি রূপ দেখলাম।সেই রূপের নাম পরী আপাই।একটি অনাথ মেয়ে,যে দায়িত্ব নিয়েছিল আরো দু’টো অনাথ মেয়ের।নিজের বোনদের যেই ভালোবাসায় সে মুড়িয়ে রেখেছিল,তাতে তাকে বোন কম আর মা মনে হতো বেশি।আমি সেই পরী আপাই কে প্রথম দিনেই পছন্দ করে ফেললাম।দিন গেল,মাস গেল।কিন্তু সেই পরী আপাই তার মুগ্ধতা ছড়ানো বন্ধ করল না।আমি ধীরে ধীরে তার ব্যক্তিত্বের প্রত্যেকটা দিক মেনে নিতে শুরু করলাম।তার প্রতিবাদ,তার আত্মসম্মান,তার সবকিছু।আমাকে গু*লি থেকে বাঁচানো,চূড়ান্ত রকমের সাহসী হয়ে ফাহাদকে জনসম্মুখে চড় মা’রা,বিভা আর শাহাদাতের দায়িত্ব নেওয়া-সবকিছু মিলিয়ে পরী সত্যিকার অর্থেই প্রমান করে দিলো সে আসলেই পরী।আমি সেই পরীকে পছন্দ করলাম।পছন্দ করলে অবশ্য দোষ ছিল না।আমি তাকে বাড়াবাড়ি রকমের পছন্দ করলাম।সেই পছন্দকে ইনফ্যাচুয়েশনের নাম দিলাম।সেই বাড়াবাড়ি পছন্দের জের ধরে আমি নিজে তাকে চাকরি দিলাম।তার স্বাবলম্বী হওয়ার লড়াইয়ে আড়ালে তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।হঠাৎই আমার মনে হলো আমি তো মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়ার ঘোর বিরোধী।আমি কেন তার সাহায্য করছি?একবার সরে এলাম,একবার জড়িয়ে গেলাম।দোলাচালে ভুগতে ভুগতে অতিষ্ঠ হয়ে শেষ পর্যন্ত পরাজয় মেনে নিলাম।মেনে নিলাম পরীর প্রতি এই দুর্বলতা আর কখনোই কাটবে না।পরীর সাথে আমার বিয়ে হলো।সংসার জীবনে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমার স্ত্রী ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে।তার মাঝে রাগ অভিমান দুঃখ সবই আছে।সংসার জীবন চলল কিছুদিন।সে আমাকে মেনে নিল,আমি তাকে।এর মাঝেই এমন একটা বাজে ঘটনা ঘটল।আমি এই কয়েকটা দিন পাগল পাগল হয়ে কাটিয়েছি।মনে হচ্ছিল একমাত্র আমার ওয়াইফ হওয়ার অপরাধে মেয়েটা শাস্তি পেল।তুই জানিস,এসব ইনফ্যাচুয়েশন,লাইক,ফিলিংস,সিম্পেথি,,এসবকিছু আসলে ভুয়া।আসল কথা হলো পরী কে আমি ভালোবাসি।এটা আমি টের পাই তখন যখন পরী আমার হাতে মাথা রেখে ঘুমাতো আর আমি ছ্যাবলার মতো ড্যাব ড্যাব করে তাকে দেখতাম।দ্যাট টাইম আই ফেল্ট আমারই বিবাহিত স্ত্রী কে আমি ভালোবেসে ফেলেছি।স্ট্রেঞ্জ তাই না?মানুষ বছরের পর বছর চেষ্টা করেও বউকে ভালোবাসতে পারে না,আর আমি যখন তাকে ভালোবেসে ফেললাম,তখনই ভয়ে দুই কদম পিছিয়ে গেলাম।এখন আমার নিজেকে চোর চোর মনে হয়।মনে হয় পরীর সামনে যাবো,আর চট করে ধরা পড়ে যাব।পরী তখন আমার ইমোশানস,আমার ভালোবাসাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আমাকে দূর ছাই করে তাড়িয়ে দিবে।পরীও বাকি মেয়েদের মতো ভাব ধরবে।দাম দিবে না আমাকে।এই বিচ্ছিরি ফিলিংস এভয়েড করার জন্য আমি তার সামনে যাই না।এমনিতেও অনেক বেফাঁস কথা বলে ফেলেছি তার সামনে।আর না।পরীকে আমি এখন থেকে কম কম পাত্তা দিব।এটাই আমার ফাইনাল ডিসিশন।’

আদি আদর্শ শ্রোতার ন্যায় তার পুরো কথা শুনল।কথা শেষ হতেই সে হো হো করে হেসে ফেলল।আরহাম ভড়কে গিয়ে বলল,’হাসছিস কেন?মাথায় সমস্যা তোর?’

আদি তক্ষুনি হাসি থামাল না।উল্টো আরো কিছুক্ষণ হেসে তারপর পেটে হাত চেপে বলল,’সিরিয়াসলি?বউকে ভালোবেসে বউয়ের থেকে পালাতে এই আমি তোকেই দেখছি।মানে তুই প্রেমে পড়বি,কিন্তু কিছুতেই অন্যজনের সামনে সেই প্রেম স্বীকার করবি না।মানে জেদ আর গোড়ামিরও তো একটা সীমা থাকে।’

আদি হাসি থামিয়ে আরহামের দিকে দেখল।তার চোখ মুখ শক্ত।বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে রেখে সে সামনের দৃশ্য দেখছে।আদি সমস্ত হাসি ঠাট্টাকে একপাশে সরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল,’দেখ ভাই।এতো কিছু বুঝি না।তবে যা বুঝি তা থেকে বলছি তুই যেমন করে ভাবছিস বিষয়টা একদমই এমন না।সব মেয়েই যে ভালোবাসার বিনিময়ে অবহেলা করবে এমনটা মোটেই না।আর আমার অবজারভেশন বলে নবনীতাও তোকে পছন্দ করে।মেইবি তার অনুভূতি তোর মতো প্রখর না,বাট শী ফিলস ফর ইউ।আমি হাসপাতালে তার চোখে মুখে তোর জন্য টান দেখেছি।তুই সামনে আসতি না,আর সে তোকে খুঁজত।মুখে বলত না,তবে খুঁজত।তার মধ্যে আমি অস্থিরতা দেখেছি আরহাম।দয়া করে নিজের জেদ আর গোয়ার্তমির জের ধরে নিজের ঘরটা ভাঙিস না।আজ রাতে যখন যাবি তখন নবনীতার কেবিনের ভেতরে ঢুকে তাকে দেখে আসবি।প্লিজ আরহাম।গিভ লাইফ অ্যানাদার চান্স।আমার মন বলে একসময় এই মেয়েটা তোকে তোর চাইতেও দ্বিগুণ ভালোবাসবে।প্লিজ ভাই।জেদ ধরিস না।’
.
.
.
.
হাসপাতালের একেবারে সামনে ঝুলানো ঘড়িটা বারোটা বাজতেই ডং ডং শব্দ করে চারদিক আন্দোলিত করল।চারদিকের ভীড় সময়ের সাথে কমে আসছে।আপন আত্মীয় ছাড়া প্রায় সবাই-ই হসপিটালে ছেড়ে চলে এসেছে।সিনিয়র ডাক্তার রা সবাই নিজেদের চেম্বারে বসে হালকা ঝিমুচ্ছিলেন।নার্সরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত।

কেবিন নাম্বার ছয় তখন ফাঁকা।একটু আগেই সবাই বেরিয়ে গিয়েছে।তেইশোর্ধ অভিমানী তরুণী তখন মাথা নিচু করে নিজের জীর্ণ হাতটা বার বার দেখে যাচ্ছিল।এই নিয়ে চারদিন তার বৈধ পুরুষ তার সামনে আসে না।কথা নাই,বার্তা নাই।এমনকি কোনো ঝগড়াও নাই।তবুও সে আসে না।এই বেয়াদবির মানে কি?নবনীতা কোনোদিন এমন বেয়াদবি করেছে তার সাথে?অকারণে এমন গায়েব হয়ে গেছে?বিবাহিত স্ত্রীর প্রতি এমন উদাসীন আচরণ কতোটা অসম্মানজনক সে কি জানে?

বারোটার একটু পরে আরহাম এক প্রকার ছুটতে ছুটতে হাসপাতালে এলো।তার শরীর অল্প বৃষ্টিতে সামান্য ভিজে গেছে।সে কেবিনের সামনে এসে গা ঝাড়া দিলো।কাঁচের দরজায় আনমনে চোখ রাখতেই দেখল কেবিনের ভেতরের মেয়ে মানুষটি তখনও জেগে আছে।

আরহাম আস্তে করে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।ভেতরে আসতেই তার সাথে নবনীতার চোখাচোখি হতো।নবনীতা সেকেন্ডের মাথায় চোখ সরিয়ে নিল।এতো গুলো দিনে তার আসার সময় হয়েছে?সে আর সেদিকে তাকাবেই না।বসে থাকুক একা একা।সে কোনো কথাই বলবে না।

আরহাম তার হাতে থাকা প্যাকেট টা নবনীতার চোখের আড়াল করে চুপচাপ টুলে গিয়ে বসল।তার মাথার চুলগুলো বৃষ্টির পানিতে অর্ধেক ভিজে গেছে।তার আজ মন ভালো।অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকার পর সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে প্রাণ খুলে সংসার করবে।এরপর যা হবে দেখা যাবে।

সে টুলে বসতেই একবার সামান্য ঝুকে নবনীতার মুখটা দেখল।নবনীতা তার চাহনি বুঝতেই আরো বেশি অন্যদিকে মুখ সরিয়ে নিল।আরহাম সেসব গায়ে মাখল না।একটু এদিক সেদিক দেখে সেই চিরায়ত স্বরে বলে উঠল,’হাই সেনোরিটা! কেমন আছ?’

মুহূর্তেই নবনীতার চোখ খুশিতে ছলছল করে উঠল।কতোদিন এই ডাক শুনেনি সে! সে মাথা তুলল না।তবে ঘাড় ঘুরিয়ে সোজা হয়ে বসল।আরহাম সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে আবারো প্রশ্ন করল,’কেমন আছ গো পরী আপাই?একটু তাকাও আমার দিকে।একটু দেখি,কথাবার্তা বলি।রাত বিরেতে বর কে কেউ ফিরিয়ে দেয় বলো?’

নবনীতা চোখ নামিয়ে দু’হাত কচলাতে কচলাতে জবাব দেয়,’ফিরিয়ে তো দেইনি।এসেছেন।বসে থাকুন।আমার কি?’

‘তোমার অনেক কিছু।তুমি আমাকে দেখবে।মিষ্টি হেসে জবাব দিবে।কথা বলবে।এমন থম মেরে বসে আছ কেন শুনি?’

নবনীতা মিনমিনে গলায় উত্তর দেয়,’জানি না।’

‘পরী! এ্যাই পরী।’

আদুরে সম্বোধনে কানে যেতেই নবনীতার ভেতরটা আন্দোলিত হয়।মনে হয় কোনো একটা আনন্দের জোয়ার সমস্ত শরীর দিয়ে বয়ে গেছে।সে মাথা নামিয়েই ক্ষীণ কন্ঠে জানতে চায়,’কি হয়েছে?’

‘রাগ হয়েছ পরী?’

‘হয়েছি বোধ হয়।’

‘কতোখানি?’

নবনীতা চাপা স্বরে হাসল।লাজুক কন্ঠে বলল,’অনেক খানি।’

আরহাম নিজেও হাসল।কৌতূহলী হয়ে বলল,’উই আর বিহেভিং লাইক ম্যারিড কাপলস।রাইট?’

নবনীতা অবাক হয়ে বলল,’বিহেভিং মানে?উই আর ম্যারিড।কিসব আবোল তাবোল বকছেন!’

‘নাহ।দেখলাম তোমার মনে আছে নাকি।’

‘যতোসব আজগুবি কথাবার্তা।’

আরহাম একটা তপ্ত নিশ্বাস ছাড়ে।চোখ তুলে নবনীতার মলিন মুখখানা দেখে।যদিও এখন তাকে মলিন দেখাচ্ছে না।তাকে দেখাচ্ছে ভীষণ চটপটে আর আনন্দিত।এই আনন্দের কারণ কি?সে এসেছে বলেই মেয়েটা এতো খুশি হয়েছে?কে জানে!

আরহাম একটু এগিয়ে এসে নবনীতার কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করল,’তোমার জন্য একটা জিনিস এনেছি।আমি গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি জিনিসটা তোমার পছন্দ হবেই হবে।’

নবনীতা চোখ পাকায়।উদগ্রীব হয়ে শুধায়,’সেটা কি?’

আরহাম তার পিঠের কাছে থাকা হাতটা বের করে সামনে আনে।স্বচ্ছ পলির ভেতরে থাকা লোভনীয় জিনিসটা দৃষ্টিগোচর হতেই নবনীতা হসপিটাল বেডে শুয়ে থেকেই চেঁচিয়ে উঠে,’ফুচকা!!!’

আরহাম দ্রুত তার ঠোঁটে আঙুল চেপে ঈষৎ ধমকে উঠে,’আস্তে আস্তে! মানুষ দেখলে কি বলবে?মাঝরাতে কেউ এভাবে চেঁচায়?’

নবনীতা এক ঝাড়ায় তার হাত সরিয়ে নেয়।খুশিতে গদো গদো হয়ে বলে,’দেখুক গিয়ে।আমার বরের সাথে আমি চেঁচাই না লাফাই,তাতে লোকের কি?’

কথা শেষ করেই সে জ্বলজ্বল চোখে আরহামের হাতে থাকা ফুচকার প্যাকেট টা দেখে।দেখেই একবার ঠোঁট ভিজিয়ে খুশিতে বাকবাকুম হয়ে বলে,’প্লিজ আরহাম।এক্ষুণি আমায় দিন এটা।’

আরহাম চোখ সরু করে আগাগোড়া তাকে দেখে।তারপরই বিদ্রুপ করে বলে,’এহহহ শখ কতো! এতো সহজে দিয়ে দিব?তুমি জানো এই ফুচকার জন্য আমাকে কতো কষ্ট করতে হয়েছে।এই রাতে সব দোকান বন্ধ।খুঁজতে খুঁজতে তোমার ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত যেতে হয়েছে।বৃষ্টিতে ভিজে মাইলের পর মাইল পাড়ি দিয়ে এটা আনতে হয়েছে আমার।এতো সোজা না।’

নবনীতা তার কথা শেষ হওয়ার আগেই তার একহাত জড়িয়ে ধরল।সুর টেনে বলল,’সেজন্যই তো আপনাকে এতো পছন্দ করি।আপনার মতো ভালো মানুষ এই দুনিয়ায় কয়টা আছে বলুন?’

আরহাম একহাত বাড়িয়ে নবনীতার একগাল টেনে চাপা স্বরে বলল,’বাপরে! পাম পট্টি তো ভালোই দিতে পারো দেখছি।পুরাই সুবিধাবাদী।’

নবনীতা দুই হাত এক করে আকুল কন্ঠে আর্জি জানাল,’প্লিজ আরহাম।খেতে দিন।’

‘দিব।তবে শর্ত আছে।’

নবনীতা তাড়াহুড়ো করে বলল,’সব শর্তে রাজি।একবার তো দিন।’

আরহাম ফুচকার প্যাকেট খুলতে খুলতে আড়চোখে তাকে দেখে বলল,’ইশশ রে! আগ্রহ দেখো না ম্যাডামের।’

***

‘তোমার শর্ত হলো তুমি সুস্থ হলে দশবার কানে ধরে উঠবস করবে।’

‘সেকি! কেনো?’

আরহাম চোয়াল শক্ত করে জবাব দিলো,’আমার অবাধ্য হওয়ার জন্য।তোমাকে বলেছিলাম চোখের সামনে থাকতে আমার।তুমি অতি পাকনামি করে আরেক জায়গায় গিয়েই ভেজাল করেছ।সুস্থ হতেই তুমি দশবার কান ধরে উঠবস করবে।গট ইট?’

নবনীতা দ্রুত মাথা নাড়ল।তাড়াহুড়ো করে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।ডিল।দশবার না,শরীর ভালো থাকলে বিশবারও করতে পারি।কোনো সমস্যা নেই।এখন প্লিজ এটা দিন।’

আরহাম ফুচকার সাথে ওয়ান টাইম প্লেট আর চামচও এনেছে।প্লেটে সবকিছু ঢেলে সে ফুচকা বানাতে বানাতে বলল,’যতক্ষন না বানানো হচ্ছে ততক্ষণ একটানা বলতে থাকো-আমি একটা পাকনা।পাকনামি করতে গেলেই আমি বিপদে পড়ি।ভবিষ্যতে আমি একটু কম পাকনামি করব।’

তার কথা শুনেই নবনীতা খিলখিল করে হেসে ফেলল।তারপরই মাথা দুলিয়ে ছোট বেলার স্বরবর্ণ শেখার মতো করে একনাগাড়ে তোতাপাখির মতো বলা শুরু করল, ‘আমি একটা পাকনা।পাকনামি করতে গেলেই আমি বিপদে পড়ি।ভবিষ্যতে আমি একটু কম পাকনামি করব। আমি একটা পাকনা।পাকনামি করতে গেলেই আমি বিপদে পড়ি।ভবিষ্যতে আমি একটু কম পাকনামি করব। আমি একটা পাকনা।পাকনামি করতে গেলেই আমি বিপদে পড়ি।ভবিষ্যতে আমি একটু কম পাকনামি করব।………..’

আরহাম ফুচকা বানাতে বানাতেই মাথা নামিয়ে কতোক্ষণ হাসল।শেষটায় হাসি থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,’তুমি কি জানো তুমি যে একটা জোকার?’

নবনীতা মাথা নাড়ল।গালভর্তি হেসে বলল,’জ্বী জানি।সেটাও রিসেন্টলি হয়েছি।আপনার সাথে থাকতে থাকতে।’

আরহাম শেষ ফুচকাটা বানাতে বানাতে ভাবুক হয়ে বলল,’সেটা অবশ্য ঠিক।তোমার সাথে থাকতে থাকতে আমারও নিজেকে ইদানিং জোকার লাগে।’

নবনীতা ফুচকা খেতে গিয়েই দেখল তার দুই হাতের কোনোটাই অবসর নেই।আরহাম তার ফুচকায় টক ভরতে ভরতে বলল,’থাক হয়েছে।আমি খাইয়ে দিচ্ছি।’

‘উমমম।হচ্ছে না।শুধু ঝাল টক কেন দিচ্ছেন?মিষ্টিটাও দিন সাথে।’

আরহাম তাজ্জব বনে গিয়ে কতোক্ষণ তাকে দেখল।এই অবস্থাতেও এতো আয়োজন করে খেতে হয়?তারপরই হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে দু’টো টকই একটু একটু মিশিয়ে তার দিকে ফুচকা টা এগিয়ে দিলো।

নবনীতা প্রথম ফুচকা টা মুখে নিয়েই এমন প্রসন্ন প্রতিক্রিয়া দেখালো যে আরহামের তাকে দেখেই হাসি পেল।সে একই ভাবে দ্বিতীয় ফুচকা টা বানিয়ে তার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বলল,’নিন ম্যাডাম এটাও নিন।’

নবনীতা খেতে খেতেই আরহামের দিকে দেখে বলল,’আপনিও একটা খান না।খুব মজা।খেলেই মন ভালো হয়ে যাবে।’

‘থাক।তুমিই খাও।আমার এসব ভালো লাগে না।’

নবনীতা আর জোরাজুরি করল না।ফুচকা খেতে সে কাউকেই জোরাজুরি করে না।খেলে খাবে,না খেলে নাই।বেঁচে যাওয়া ফুচকা খাওয়ার জন্য তো সে আছেই।সে সমস্ত ফুচকা শেষ করে আনন্দ আপ্লুত হয়ে বলল,’উফফফ! মন মেজাজ সব ভালো হয়ে গেছে আমার।আপনার মতোন স্বামী হচ্ছে ইহজনমের সৌভাগ্য বুঝেছেন?’

নিজের কথায় তার নিজেরই হাসি পায়।আরহাম আশ্চর্য হয়ে কয়েক পলক তাকে দেখেই ফিক করে হেসে দিলো।নবনীতা জিভ কাটলো।বোকা বোকা হয়ে বলল,’একটু বেশি বলে ফেলেছি তাই না?’

জবাবে আরহামও মিষ্টি হেসে বলল,’হু।আমারও তাই মনে হচ্ছে।’

বাকি রাতটা দু’জনের কেউই আর ঘুমালো না।আরহামকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নবনীতা নিজেই রাতভর শত রকমের কথা বলে গেল।এই চারদিন কি হয়েছে,শাহাদাত কি কি উদ্ভট কাজকর্ম করেছে,চিত্রা আর বিভা কয়বার নিজেদের মধ্যে চুলাচুলি করেছে-সবকিছু।আরহাম ধৈর্যশীল শ্রোতার মতো একমনে সবটা শুনে গেল।দেখে গেল নবনীতার আড়ালে ঘাপটি মেরে বসে থাকা বাচাল মেয়েটিকে।এই মেয়ে এতো কথা বলতে জানে?এতো বকবক করতে পারে সে?অদ্ভুত! তাকে দেখে আরহামের একবারো মনে হয়নি সে এতোখানি চঞ্চল।

ভোরের একটু আগেই নবনীতা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।অথচ আরহাম গালের নিচে একহাত রেখে একটানা ঘন্টার পর ঘন্টা তাকে দেখে গেল।মেয়েটা কি জানে আরহাম তাকে কতোখানি ভালোবাসে?সে কি জানে তার এই সামান্য শখ পূরণের জন্য আরহাম বৃষ্টি বাদল উপেক্ষা করে কতোখানি পথ পাড়ি দিয়েছে?

সে নবনীতার একটা হাত নিজের হাতে নেয়।মাথা নুয়িয়ে সেখানে ছোট করে চুমু খায়।নিজ থেকেই খানিকটা আবেগী হয়ে বলে,’আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি পরী।এই সম্পর্কে আমি আমার একশো পারসেন্ট দেব।আই প্রমিজ।

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে