#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৩৪)[প্রথম অংশ]
‘ভাই।স্কুলের সিসি টিভি ক্যামেরা গুলো আগেই নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।ঘটনার কোনোরকম ফুটেজ সিসিটিভি তে ধরা পড়েনি।’
তোফায়েল ঠান্ডা গলায় কথা বলেই সামনে তাকায়।তার থেকে কয়েক হাত দূরে আরহাম দাঁড়িয়ে আছে।তার একহাত দেয়ালে।তোফায়েল থামতেই আরহাম পেছন ফিরে তাকে দেখল।থমথমে মুখে বলল,’ফুটেজের কোনো প্রয়োজন নেই।আমি জানি এই কাজ কার।’
ক্ষণিকের নিরবতা।কিছু সময় বাদেই নিরবতা ভেঙে তোফায়েলের প্রশ্ন,’আপনি কিছু করবেন না তাকে ভাই?’
আরহাম ধীর পায়ে হেঁটে করিডোরের এক পাশের চেয়ারে বসে।মাথা নিচু করে মেঝে দেখে।অতিশয় শীতল কন্ঠে জবাব দেয়,’না,করব না।আপাতত পরীর জ্ঞান ফিরুক একবার।এখন আমার অন্যকিছুতেই আগ্রহ নেই।পরী সুস্থ হোক।তারপর ঐ রাস্কেলের সাথে আমার বোঝাপড়া হবে।’
তোফায়েল জবাবে কেবল একবার মাথা নাড়ল।ভাই গতকাল থেকে হাসপাতালে।মাঝে একবার ঘন্টাখানেকের জন্য পার্টি অফিসে এসেছিল।তারপর বাড়ি গিয়ে গোসল সেরে আবারও এখানে।তোফায়েল ইদানিং টের পাচ্ছে তার তথাকথিত ‘আই হেইট ওম্যান’ টাইপের বড় ভাই সময়ের সাথে সাথে ‘আই লাভ পরী’ টাইপের বড় ভাইয়ে রূপান্তরিত হচ্ছে।তার বিশ্বাস হয় না সামান্য একটা মেয়ের জন্য ভাই এতো বেশি ব্যস্ত হচ্ছে,এতো বেশি আবেগ ঝরাচ্ছে।আরহাম প্রতিশোধ আর পাল্টা জবাবে বিশ্বাসী।অথচ সেই আরহাম তার স্ত্রীর মুমূর্ষু অবস্থায় ক্ষণিকের জন্য তার প্রতিশোধ কে পাশে সরিয়ে স্ত্রীয়ের সুস্থতার কথা ভাবছে,বিষয়টা সত্যিই আশ্চর্য হওয়ার মতো।তোফায়েল আশ্চর্য হয়েই তাকে দেখে।দিনরাত পরী পরী করার পরেও ভাই বড় গলায় বলে,’পরীর প্রতি আমার কোনো ফিলিংস কাজ করে না।’
তোফায়েলের তখন চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে,’ফিলিংস কাজ না করতেই এতো পাগলামি,যখন কাজ করবে তখন কি করবেন?’
.
.
.
.
রিমি সিসিইউ এর দরজার কাছে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ।সে একটু আগেই এসেছে।নবনীতাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে ট্রান্সফার করা হয়েছে।যদিও এখনো তার জ্ঞান ফিরেনি,কিন্তু তার অবস্থার উন্নতি হয়েছে।ডাক্তার মতিন আহমেদ আশ্বাস দিয়েছেন আজ অথবা কাল তার জ্ঞান ফিরতে পারে।
রিমির একহাতে বিভার ছোট্ট হাত বন্দি।সে নিজের অন্য হাতের আঙুল খেতে খেতে এদিক সেদিক দেখছিল।ওয়াজিদ মাত্রই হসপিটালে পা রেখেছে।কাল রাতে চলে যাওয়ার পর সে আর আসেনি এদিকে।সন্ধ্যা নামতেই তার মনে হলো তার আরেকবার সেখানে যাওয়া উচিত।একটু সশরীরে গিয়ে খবর নেওয়া উচিত।সে তৃতীয় তালায় আসতেই সবার আগে রিমিকে দেখল।দেখতেই এগিয়ে এসে অত্যন্ত অমায়িক কন্ঠে জানতে চাইল,’নবনীতার এখন অবস্থা কি রিমি?কিছু জানো?’
রিমি চোখ সরিয়ে তাকে দেখল।মৃদুস্বরে বলল,’জ্বী ভাইয়া।এখন নাকি একটু ভালো অবস্থা।কেবিনে শিফট করা হয়েছে।’
‘ওহহ আচ্ছা।’
চোখ নামিয়ে বিভাকে দেখতেই ওয়াজিদ পুনরায় প্রশ্ন করে,’বিভা কিছু খেয়েছে?’
‘জ্বী।খাইয়ে এনেছি।’
ওয়াজিদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে করিডোরে রাখা চেয়ার গুলোর দিকে দৃষ্টি রেখে বলল,’ওখানে গিয়ে বসো না।কতোক্ষণ আর দাঁড়িয়ে থাকবে?বিভার ও তো পায়ে ব্যথা হবে।তুমি তাকে নিয়ে সেখানে গিয়ে বসো।’
রিমি তার এক কথাতেই সেখানে গিয়ে বসল।বিভাকে বসালো তার ডান পাশে।ওয়াজিদ এক নজর তাদের দেখেই সামনে এগিয়ে যায়।ফিরে আসে দুই কাপ চা আর দু’টো বাটার বান হাতে।এসেই ঠিক রিমির মুখোমুখি দাঁড়ায়।এক কাপ চা আর একটা বান তার দিকে বাড়িয়ে গাঢ় স্বরে বলে,’নাও রিমি।এটা খেয়ে নাও।’
রিমি অবাক হয়ে মাথা তোলে।বিস্মিত মুখে প্রশ্ন করে,’এসব কেন?’
‘তুমি কিছু খেয়ে এসেছ?’
‘না খাইনি।’
‘জানি।সেজন্যই নিয়ে এসেছি।একেবারে অড টাইম একটা! নিজেও কিছু খাইনি।ভাবলাম তোমার জন্যও নিয়ে আসি।’ খুবই সাবলীল ভঙ্গিতে জবাব দেয় ওয়াজিদ।আরহাম তখন ঘন্টাখানেকের জন্য পার্টি অফিসে গিয়েছে।নবনীতার কেবিনের সামনে তখন শুধু সে আর রিমি।আর সাথে বিভা।শুভ্রা আর চিত্রা বোধ হয় একটু পরে আসবে।
সন্ধ্যায় এক কাপ চা আর সাথে বাটার বান অথবা বিস্কুট-ওয়াজিদের প্রিয় খাবার গুলোর একটি।সন্ধ্যায় চা না খেলে তার অস্থির লাগে।চা কেনার পরেই তার মনে হলো সেখানে রিমিও আছে।সেও নিশ্চয়ই কিছু খায়নি।তার জন্য আরেক কাপ চা নিলে মন্দ হয় না।যেই ভাবা,অমনি কাজ।সে নিজের পাশাপাশি রিমির জন্যও চা আর বান নিল।
রিমি বিষন্ন মুখে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে ওয়ান টাইম চায়ের কাপে হাত রাখে।সে হাত রাখার পরেও ওয়াজিদ সেটা ছাড়ল না।সন্দিহান গলায় বলল,’ঠিক মতো ধরেছ তো?ছাড়ব?নাকি ছাড়লেই সব চা তোমার গায়ে গিয়ে পড়বে?দেখো কিন্তু,আবার শরীর পু’ড়ে ফেলো না।আমি কিন্তু তখন নেভার মাইন্ড বলে সবকিছু মিটমাট করতে পারব না।’
মন খারাপের দিনেও তার কথা শুনে রিমির হাসি পেল।সে হালকা শব্দ করে হাসল।চায়ের কাপটা ঠিক মতো ধরে স্বচ্ছ গলায় বলল,’না ভাইয়া।ঠিক মতোই ধরেছি।আপনি ছাড়ুন।’
ওয়াজিদও বিনিময়ে স্মিত হেসে কাপটা ছেড়ে দিলো।রিমির বাম পাশটায় বসে বাটার বান টাও তার হাতে দিলো।রিমি চায়ের কাপে একটা চুমুক দিয়েই বলল,’বাহ! খুব মজা তো চা টা!’
‘হু।আমার ভীষণ প্রিয়।হসপিটালের ক্যান্টিন থেকে আনি নি।হাসপাতালের সামনের এক টং দোকান থেকে এনেছি।’
রিমি হাসল।বলল,’দারুন মজা।’
চা আর বান খাওয়া শেষেই রিমি কাপটা দুমড়ে মুচড়ে একহাতে নিল।ওয়াজিদ চোখ পাকিয়ে তাকে দেখল।তার মতিগতি ঠাহর করার চেষ্টা করল।রিমি এক চোখ বন্ধ করে ডাস্টবিনের দিকে নিশানা ঠিক করে।তার লক্ষ্য কাপটা সেখানে ছুড়ে মারার।সে আরো একবার ঠিক মতো সব দেখেই সেটাকে সজোরে ছুড়ে মারে ডাস্টবিনের দিকে।ওয়ান টাইম কাপটা রিমিকে চূড়ান্ত মাত্রার হতাশ করে দিয়ে উড়তে উড়তে একজন ভদ্রলোকের গায়ে গিয়ে পড়ল।ভদ্রলোক করিডোর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কোথাও যাচ্ছিলেন।কিছু একটা উড়ে তার গায়ে পড়তেই তিনি হকচকিয়ে ওঠলেন।
রিমি নিজেও হতবাক,হতাশ আর চূড়ান্ত রকমের বিস্মিত হয়ে উঠে দাঁড়ায়।কাঁদো কাঁদো হয়ে মাঝবয়সী লোকটার দিকে তাকায়।মিনমিনে স্বরে বলে,’সরি আঙ্কেল।লক্ষ্য ভ্রষ্ট হয়েছে।সিস্টেক হয়ে গেছে।’
ওয়াজিদ কতোক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে তাকে দেখে।সব কাজেই একটা মানুষ ভুল করতে পারে এটা সে রিমিকে না দেখলে বিশ্বাসই করত না।সে মাথা নামিয়ে ফিক করে হেসে দেয়।চাপা স্বরে রিমিকে বলে,’নেভার মাইন্ড-এটা বাদ গেছে।এটাও বলে দাও।’
রিমি ত্যাড়ছা চোখে একবার তাকে দেখে।মাথা নিচু করে ভেঙচি কাটে।পরক্ষণেই আবার সে যার গায়ে কাপ ছুড়েছে তাকে দেখে বিনয়ী স্বরে বলে,’সরি আঙ্কেল।প্লিজ রাগ হবেন না।’
লোকটা রাগ হলো না।উল্টো তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাপটা তুলে যথাস্থানে ফেলল।তারপরই দ্রুত গতিতে হেঁটে যেতে যেতে রিমিকে একবার দেখে বলল,’সমস্যা নেই মা।আমি রাগ হইনি।’
রিমি নিশ্চিন্ত হয়ে চেয়ারে বসে।বিভা একটু পর পর হাই তুলছে।ওয়াজিদ জানতে চায়,’তাকে আবার এনেছ কেন?হসপিটালে কতো জীবানু।বাচ্চা মানুষ।অসুস্থ হয়ে গেলে?’
রিমি বিভাকে নিজের সাথে চেপে ধরে।চঞ্চল হয়ে জবাব দেয়,’আরে ভাইয়া।আম্মু আর আব্বু বাসায় নেই।নানুর বাসায় গিয়েছে।কোথায় রেখে আসবো বলেন?তাই সাথেই নিয়ে এসেছি।আর যা দুষ্টু এটা! শুধু দুষ্টুমি করে।তাই নিজের সাথেই রাখি।’
‘তোমার কাছে থাকলে দুষ্টুমি করে না?নাকি তোমার দুষ্টুমি দেখেই ঠান্ডা হয়ে যায়?নিজের দুষ্টুমি ভুলে যায়।’ হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে ওয়াজিদ।
রিমি আড়চোখে একবার তাকে দেখেই চোখ সরিয়ে নেয়।তারপরই আবার লাজ শরমের মাথা খেয়ে আরো দুইবার তাকে দেখে।তার লাজ শরম আরেকটু কম হলে ভালো হতো।তখন সে সোজাসাপটা বলে দিতে পারত,’শুনেন ওয়াজিদ ভাই,আপনি মুখটা কে গোমড়া করে না রেখে সবসময় এমন হাসবেন।আপনাকে হাসি মুখে দেখতে খুবই ভালো লাগে।প্রয়োজনে এই হাসির বিনিময়ে আপনি আমাকে টুকটাক ভিল্লাও দিতে পারেন।আই উইল নেভার মাইন্ড।হুহহ!’
বিভার মাথায় একটু হাত বুলাতেই সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।তার ঘুমন্ত মুখটা দেখেই রিমি চতুর্থবারের মতো হাই তুলল।হাসি আর কান্না সংক্রামক।এই কথা রিমি আগেই শুনেছে।তবে তার মাঝে মাঝে নিজেকে দেখলে মনে হয় ঘুমও সংক্রামক।তার সামনে কেউ ঘুমালেই তার শরীর ভেঙে ঘুম আসে।এখনো ঘুমে সে চোখ খোলা রাখতে পারছে না।
কিছু সময় যাবত নিজের সাথে বোঝাপড়া করার পর রিমি হাল ছেড়ে দিলো।মাথাটা সামান্য পেছনের দিকে এলিয়ে দিয়ে সে চোখ বন্ধ করল।মিনিট বিশেক সেভাবে থাকার পরই আচমকা তার মাথাটা আলতো করে এসে ওয়াজিদের কাঁধে গিয়ে ঠেকে।ওয়াজিদ নিজের কাঁধে তার মাথা দেখতেই থতমত খায়।সে অস্বস্তিতে খানিকটা নড়েচড়ে উঠে।তার এখন কি করা উচিত?মেয়েটা তো ইচ্ছে করে এমন করে নি।ঘুমের ঘোরে এমনটা হয়েছে।ওয়াজিদের কি তাকে সরিয়ে দেওয়া উচিত?নাকি যেভাবে আছে সেভাবেই বসে থাকা উচিত?
মিনিট দুয়েক উসখুস করার পর ওয়াজিদ সিদ্ধান্ত নেয় রিমির যতোক্ষণ না ঘুম ভাঙে,সে ততক্ষণ এভাবেই বসে থাকবে।রিমির মুখটা ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল! ক্লান্ত দেখেই হসপিটালের মতো জায়গায় অবেলায় ঘুম দিয়েছে।এই অবস্থায় তাকে সরানোর কোনো মানে নেই।থাকুক,এভাবেই থাকুক।একটু ঘুমাক।
রিমি মেয়েটি কে নিয়ে সে কখনোই সেভাবে ভাবে নি।তবে তার মন বলে মেয়েটা ভীষণ ভালো।সে যে ভীষণ ভালো তার একটা প্রমাণ হলো বিভার প্রতি তার স্বচ্ছ আর নির্মল ভালোবাসা।বিভার সাথে তার কোনো র’ক্তের সম্পর্ক নেই।তবুও মেয়েটি কে সে নিজের কাছে রেখেছে।সব সময় সাথে নিয়ে নিয়ে ঘুরছে।এতোটুকু করার জন্য একজন মানুষের একটি চমৎকার হৃদয় থাকা প্রয়োজন।সেই চমৎকার হৃদয় রিমির কাছে আছে।নবনীতার প্রতি তার ভালোবাসা নির্ভেজাল,নিঁখাদ।ওয়াজিদ জানে সে খুবই ভালো মেয়ে।কেবল খানিকটা চঞ্চল,এই যা।
রিমি আরাম করে ঘুমায়।আর ওয়াজিদ সোজা হয়ে চুপচাপ বসে থাকে।না একটু নড়ে,না একটু পেছনে হেলান দিয়ে বিশ্রাম করে।এই ঘুম দীর্ঘসময় স্থায়ী হবে না।মানুষ বাড়তেই রিমির ঘুম ভাঙে যাবে।ওয়াজিদ তখন সরে আসবে।
***
শুভ্রা প্রাইভেট থেকে বেরিয়েছে সন্ধ্যা সাতটার দিকে।দুপুরের প্রাইভেট টা আজ স্যারের সমস্যার কারণে সন্ধ্যার দিকে পড়ানো হয়েছে।সে বেরিয়ে একটু সামনে আসতেই টয়োটার সেই কালো রঙের গাড়িটা একদম তার পাশ ঘেঁষে থামল।চমকে শুভ্রা দুই কদম পেছায়।এক নজর গাড়িটা দেখতেই সে চিনে নেয় এটা কার গাড়ি।
আরিশ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখেই সহজ গলায় বলল,’হাই মিস শুভ্রা!’
তার পাশের সিটে চিত্রা বসা ছিল।আরিশের অভিবাদন শুনে সেও তাকে অনুসরণ করে বলল,’হাই মিস শুভ্রা!’
শুভ্রা তার কন্ঠ শুনেই মাথা ঝুকায়।আশ্চর্য হয়ে বলে,’কি রে তুই?’
আরিশ তার হয়ে জবাব দেয়,’হু।আমিই নিয়ে এসেছি তাকে।তুমি এখন ঝটপট পেছনে গিয়ে বসো।’
শুভ্রা চোখ গোল গোল করে বলে,’আমরা কি হসপিটাল যাচ্ছি?’
‘হু’
শুভ্রা দ্রুত চিত্রার পাশে এসে গাড়ির দরজা খুলে।ভিতরে ঢুকে চিত্রাকে কোলে নিতে নিতে বলে,’আমি সামনেই বসব।পেছনে কেউ নেই।একা একা বসতে ভালো লাগে না।’
আরিশ স্মিত হাসল।স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখেই সামনে দেখতে দেখতে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।সামনেই বসো।সিটবেল্ট বেঁধে নাও দ্রুত।’
শুভ্রা তাড়াহুড়ো করে সিটবেল্ট বাঁধে।চিত্রাকে ঠিক মতো নিজের কোলে বসিয়ে আরিশের দিকে ফিরে বলে,’আপাইয়ের কি জ্ঞান ফিরেছে?আরহাম ভাইয়া কিছু বলেছে আপনাকে?’
‘নাহ এখনো বোধহয় ফিরে নি।ভাইয়া এমন কিছু এখন পর্যন্ত বলে নি আমাকে।’
শুভ্রা মুখখানা আধার করে জবাব দেয়,’ওহহ আচ্ছা।’
আরিশ ড্রাইভিংয়ের মাঝেই নিজের সাফাই গেয়ে বলল,’আসলে আমি ধানমন্ডির এদিক দিয়েই যাচ্ছিলাম।তো পরে ভাবলাম চিত্রা কেও সাথে নেই।এরপরে আবার ভাবলাম চিত্রাকে নিলে তুমি বাড়ি এসে তাকে খুঁজবে।তাই ভাবলাম তোমাকেও নিয়ে নেই।এছাড়া আর কোনো কারণ নেই এদিকে আসার।’
শুভ্রা মাথা নিচু করে উত্তর দেয়,’জ্বী ভাইয়া।জানি।আপনাকে ধন্যবাদ আমাদের কথা ভাবার জন্য।’
আরিশ তার দিকে না ফিরে ড্রাইভিং-এ মনোনিবেশ করে,স্বস্তিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।শুভ্রা তাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু ভাবছে না সেটা খুবই স্বস্তির বিষয়।কিন্তু যেটা স্বস্তির বিষয় না তা হলো সে ইদানিং শুভ্রাকে নিয়ে বেশি বেশি ভাবছে।একবার সে ভাবনা মাথায় এলেই তার কেমন নিজের উপর রাগ ধরে যায়।শুভ্রা মাত্র উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ে।বাচ্চা একটা মেয়ে।তাকে নিয়ে আরিশ কেন ভাববে?সে কি বিকৃত মস্তিষ্কের নাকি?যতসব উল্টাপাল্টা চিন্তাভাবনা!
তারা হসপিটালে পৌঁছায় আরো চল্লিশ মিনিট পরে।শুভ্রা সেখানে গিয়েই দেখল করিডোরে মোটামুটি সবাই উপস্থিত।আরহাম আর আদি একটু আগেই এসেছে।আরহাম ফোনে কারো সাথে কথা বলছে।তাদের পাশাপাশি দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওয়াজিদ।তার নাক বরাবর একটা চেয়ারে রিমি বসা।যে কিনা ঘুম থেকে উঠেও একের পর এক হাই তুলেই যাচ্ছে।
আদি একনজর ওয়াজিদ কে,আরেক নজর রিমিকে দেখে।দেখেই ঠোঁট টিপে হাসে।তার গা জ্বালানো হাসিতে রীতিমতো বিরক্ত হয়ে ওয়াজিদ প্রশ্ন করে,’সমস্যা কি তোর?এমন মিটমিট করে হাসছিস কেন?মানসিক সমস্যা আছে তোর?’
আদি হাসি থামায় না।উল্টো আলতো করে ওয়াজিদের কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলে,’সমস্যা তো কিছু না দোস্ত।আবার বলতে গেলে অনেক সমস্যাই আছে।যাই হোক,আমার তো জ্যোতিষীর চোখ।অনেক কিছুই দেখতে পাচ্ছি আমি।উমমম ওয়াজিদ! নট ব্যাড।গুড চয়েস।আমি এপ্রুভাল দিয়ে দিলাম যাহ।’
ওয়াজিদ এক ঝাড়ায় তার কাঁধ থেকে আদির হাত সরায়।নাক মুখ খিঁচে বলে উঠে,’কি যা তা বলছিস।পুরাই একটা ফাউল তুই!’
কথা শেষ করে পুনরায় সে বিরক্তিতে মুখ কুঁচকায়।করিডোরে সবার প্রথমে এসেছিল আদি।ওয়াজিদ তখন মাথা নামিয়ে ফোন স্ক্রল করছিল।আদি তাকে আর তার কাঁধে রিমির মাথা দেখেই চটপট তাদের একটা ছবি তুলে নিল।ছবি তোলা শেষ হতেই সে এগিয়ে এসে টিপ্পনী কেটে বলল,’বাহ ওয়াজিদ।হসপিটালেই শুরু করে দিয়েছিস নাকি?ভেরি রোমান্টিক ব্যাপার সেপার!
ওয়াজিদ চোখ তোলে।অবাক হয়ে বলে,’মানে?রোমান্টিকের কি আছে এদিকে?’
‘হয়েছে হয়েছে।আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়া এতো সোজা না।আমি সব বুঝি।তুমিও গোপনে গোপনে ভালোই রোমান্টিক দেখছি।’
ওয়াজিদ আর কথা বাড়ায় না।আদিকে কিছু বোঝানোর চেয়ে নিজের মাথায় নিজে বারি দেওয়া আরো ভালো।আদি এসব ব্যাপারে কিছুই বুঝতে চায় না।
রিমি ঘুম ভাঙার পরেই নিজের মাথা অন্য কারো কাঁধে আবিষ্কার করল।সে অবাক হয়ে গেল যখন দেখল কাঁধটা ওয়াজিদের।তার বিস্ময়ভাব দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।একটু পরেই সে খেয়াল করল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে তার মুখ থেকে লালা বের হয়ে ওয়াজিদের কাঁধের কাছটা খানিকটা ভিজিয়ে দিয়েছে।ওয়াজিদ থমথমে মুখে একবার তাকে আর একবার নিজের কাঁধ দেখে।তারপরই বিড়বিড় করে অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলে পকেট থেকে টিস্যু বের করে কাঁধের দিকটা মুছে নেয়।
রিমি নিজেও দ্রুত তার মুখের আশপাশ মুছে নিল।ওয়াজিদ চেয়ার ছেড়ে উঠে হনহন করে সামনে এগিয়ে যায়।আদি নিজেও হেলেদুলে তার পেছন পেছন এগিয়ে আসে।তার কাঁধ জড়িয়ে ধরে দাঁত কেলিয়ে বলে,’ব্যাপার না বন্ধু।আজ লালা ফেলে কাঁধ ভিজিয়েছে।কাল ভালোবাসার বৃষ্টিতে হৃদয় ভেজাবে।এভাবেই তো সবকিছু হয়।এভাবেই তো প্রেম ভালোবাসা ফাংশন করে।বুঝিস না কেন?’
ওয়াজিদ কটমট চোখে তার দিকে তাকায়।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’সবসময় এসব ফাইজলামি ভালো লাগে না কিন্তু।অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছিস তুই।’
চলবে-
#কোনো_এক_শ্রাবণে[দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৩৪)[দ্বিতীয় অংশ]
একটা ফুলে ফুলে ভরে থাকা বাগান।নিস্তব্ধ নিশুতি রাত।চারিদিকে ঘোর অন্ধকার।সেই অন্ধকারের চেয়েও বেশি অন্ধকার কিশোরী মেয়েটির ভবিষ্যৎ।সে দাঁড়িয়ে আছে মূর্তির মতো।মাথার উপর এক ফালি চাঁদ।সেই চাঁদও তার মতোই অসহায়।একটু দূরেই একজন মাঝবয়সী লোক মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।পরনের কাপড়টি র’ক্ত মেখে কেমন যেন দেখাচ্ছে।দৃশ্যটা বাজে,খুব বেশি বাজে।
মাঝবয়সী লোকটার লাগাতার ছু’রিকাঘাতে অবসন্ন শরীরটা হঠাৎই একটু নড়েচড়ে উঠে।ঘোলাটে আর বিবর্ণ চোখ তুলে সে সামনে দেখে বলে,’পরী! তুমি আমার সাহসী মেয়ে।ভয় পাবে না।পালাও মা।দূরে কোথাও পালাও।তোমাকে বাঁচতে হবে।ছোট ছোট দু’টো বোনের জন্য তোমায় বাঁচতে হবে।পালাও।’
লোকটার কথা জড়িয়ে যায়।রক্ত জমাট বেঁধে শরীরের এদিক সেদিক লেপ্টে থাকে।এসবের মাঝেই তিনি পুনরায় ক্ষীণ কিন্তু দৃপ্ত কন্ঠে বলে উঠেন,’তুমি পারবে পরী।তোমাকে পারতেই হবে।বাবা হয়তো বাঁচবো না।কিন্তু তুমি থাকবে।তুমি আমার সাহসী মেয়ে।ভয় পেয় না।পালাও মা।এক্ষুনি পালাও।’
কিশোরী মেয়েটি দুই হাত মুখে চেপে ছিটকে দুই কদম সরে আসে।তার চোখের পানিতে তার নিজের বুক ভেসে যাচ্ছে।সে কি করবে?কোথায় যাবে?এই বিশাল পৃথিবীতে সে কেমন করে টিকে থাকবে?সে তো একা না।আরো দু’টো ছোট্ট প্রাণ তার দিকে চেয়ে আছে।
বহুবার চেষ্টা করার পর সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনে।বাস্তবতায় ফিরে আসতেই সে টের পায় বাবা মা আর বেঁচে নেই।বাবার ঘোলাটে চোখটা দীর্ঘসময় ধরে পলক ফেলছে না।শরীরের নড়চড় বন্ধ হয়ে গেছে।সে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না।চার মাসের ছোট্ট বোনটাকে বুকে চেপে ধরে সে ছুটে পালায় বাড়ির বাইরে।ছুটতে ছুটতে তার পা ধরে আসে।তার স্কুল পড়ুয়া এগারো বছর বয়সী বোনটি হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠে,’আর পারছি না আপাই।আর না।’
সে থামে।কংক্রিটের খড়খড়ে রাস্তায় ধপ করে বসে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।একটু শান্ত হতে নিলেই কানে বাজে-পালাও! পালাও!পালাও!’
এক হাত কানে চেপে কিশোরী মেয়েটি টেনে টেনে কয়েকবার শ্বাস নেয়।জীবনের যেই নতুন সংগ্রামে সে নেমেছে,সেই সংগ্রাম সম্পর্কে সে সামান্য কিছুও জানে না।সে একহাতে চার মাসের বাচ্চা মেয়েটিকে বুকে চেপে অন্য হাতে তার অন্য বোনটিকে জড়িয়ে ধরে।তারা তার প্রাণেরই অংশ।সে এদের কিচ্ছু হতে দেবে না।সে একাই এদের মা বাবা হবে।তাকে হতেই হবে।সমস্ত প্রতিকূলতা,সমস্ত অন্যায় থেকে সে এদের রক্ষা করবে।নয়তো সে কেমন করে প্রমাণ করবে সে সত্যিই তার বাবার সাহসী কন্যা?
সে আনমনে তাদের নিজের কাছে ডাকে।তার মনে হচ্ছে বাচ্চা দু’টো তার কাছ থেকে খুব দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে।একটা অন্ধকার রাস্তায় তারা একটু একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছে।সে হকচকিয়ে উঠে তাদের ডাকে।ব্যাকুল হয়ে বলে,’কোথায় যাচ্ছ তোমরা?এই দেখো আপাই এদিকে।তোমরা আপাই কে ছেড়ে কোথায় যাচ্ছ?এসো,এসো।এক্ষুণি আমার কাছে এসো।নয়তো হারিয়ে যাবে।’
কানের কাছে কোথাও যান্ত্রিক শব্দে কিছু একটা টিক টিক করে যাচ্ছে।হসপিটালের স্ট্রেচারের বিরক্তিকর শব্দ ভেসে ভেসে কর্ণকুহরে এসে বারি খায়।ফিনাইলের কটু গন্ধ অক্সিজেন মাক্স ভেদ করে নসিকা রন্ধ্রে গিয়ে পৌঁছায়।প্রতিটা ইন্দ্রিয় একে একে সচল হয়।নিস্তেজ হয়ে পড়ে থাকা হাতটা সামান্য কেঁপে উঠে হসপিটাল বেড আঁকড়ে ধরে।অস্পষ্ট আর জড়ানো কন্ঠে ডাকে,’আমার শুভি! আমার চিত্র!’
ডিউটিরত নার্স তার অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতেই সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালেন।তার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক।তিনি এক দৌঁড়ে ছুটে যান ডাক্তারের চেম্বারে।গিয়েই উচ্ছ্বসিত হয়ে ব্যস্ত গলায় বললেন,’পেশেন্ট রেসপন্স করছে স্যার।তার সেন্স ফিরছে ধীরে ধীরে।’
মতিন আহমেদ সে কথা শুনতেই নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।ব্যস্ত ভঙ্গিতে সামনে পা ফেলতে ফেলতে বলেন,’গ্রেট।আমি এটারই অপেক্ষায় ছিলাম।’
মতিন আহমেদ দ্রুত কেবিনে গেলেন।একটু একটু করে জ্ঞান ফিরতে থাকা তরুণীটি পুনরায় ডাকে,’আমার শুভি! আমার চিত্র!’
মতিন আহমেদ অল্প হেসে মাথা নাড়েন।নিজ থেকেই বললেন,’দেখো অবস্থা।এখনো বোনদের কথাই বলে যাচ্ছে।’
চারদিকের নানারকম শব্দের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে নবনীতার অবশ শরীরটা একটু একটু করে সচল হলো।মস্তিষ্ক আর ইন্দ্রিয়সমূহ সবকিছুর সাথে একটুখানি খাপ খাইয়ে নিতে সক্ষম হতেই নবনীতা ধীরে ধীরে চোখ খুলল।কয়েকবার ব্যর্থ হওয়ার পর শেষটায় সে ঠিক মতো চোখ খুলতে সক্ষম হলো।চোখ খুলতেই সে প্রথমে যাকে দেখল তার নাম ডাক্তার মতিন।ঢাকায় আসার পর তিনিই তার চেক আপ করতেন।নবনীতা চোখ মেলতেই তিনি হাসি মুখ করে বললেন,’কংগ্রেটস নবনীতা।লাইফ গেইভ ইউ অ্যানাদার চান্স।’
নবনীতা জবাবে কেবল দুই ঠোঁট সামান্য প্রসারিত করল।শরীরের জায়গায় জায়গায় চিন চিন ব্যথা হচ্ছে।সে কতো ঘন্টা এভাবে পড়ে ছিল কে জানে! কিন্তু এখন তার ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।
মতিন আহমেদ তার কেবিন থেকে বেরিয়েই আরহামের কাছে এগিয়ে গেলেন।বেশ সাবলীল গলায় বললেন,’তোমার ওয়াইফের জ্ঞান ফিরেছে আরহাম।চাইলে একটু দেখা করে আসতে পারো।’
আরহাম চকিতে তার দিকে ফিরে।একপ্রকার নিশ্বাস বন্ধ করে জানতে চায়,’সত্যি?যেতে পারব আমি?’
প্রশ্ন শেষ হতেই সে নতুন করে আবার প্রশ্ন করে,’গিয়ে কি চুপচাপ বসে থাকব?নাকি সেও আমার সাথে কথা বলতে পারবে?’
জনাব মতিন আহমেদ শব্দ করে হেসে ফেললেন।সেই হাসি ধরে রেখেই বললেন,’না না।চুপ করে বসে থাকতে হবে না।তুমিও কথা বলতে পারবে।’
আরহাম জ্বল জ্বল চোখে কেবিনের দিকে পা বাড়ায়।কেবিনের দরজায় হাত দিতেই তার কিছু একটা মনে পড়ে।সে চোখ ঘুরিয়ে শুভ্রা তার চিত্রা কে দেখে।তারপরই তাদের কাছে এগিয়ে এসে বলে,’তোমরা আগে যাবে নাকি আমি?তোমার আপাই তো আবার শুভি আর চিত্র বলতে অজ্ঞান।’
শুভ্রা ব্যস্ত ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল,’না না ভাইয়া আগে আপনিই যান।আমরা পরে যাব।’
আরহাম আর কথা না বাড়িয়ে দ্রুত পায়ে কেবিনের দিকে এগিয়ে গেল।সৌজন্যের খাতিরে তার বলা উচিত ছিল শুভ্রাকে।সে সৌজন্য দেখিয়ে বলেছে।বলার সময়ই মনে মনে দোয়া করছিল শুভি যেন তাকেই যেতে বলে।নয়তো ভীষণ ঝামেলা হয়ে যেত।পরী জ্ঞান ফেরার পর সবার আগে যাকে দেখবে সেই মানুষটা আরহাম হবে না,এটা হতেই পারে না।সে একেবারে নিঃশব্দে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল।
নবনীতা তাকে দেখতেই অল্প হাসার চেষ্টা করল।আরহাম চুপচাপ হেঁটে ঠিক নবনীতার কাছাকাছি রাখা টুলটায় গিয়ে বসল।দু’জনের চোখাচোখি হতেই সে হাত তুলে বোকা হেসে বলল,’হাই সেনোরিটা।কেমন আছ?’
নবনীতা রুগ্ন হাতটা নিজের মুখের কাছে এনে তার অক্সিজেন মাক্সটা সরাল।থেমে থেমে জড়ানো কন্ঠে বলল,’ভালোই আছি মনে হচ্ছে।’
আরহাম গোল গোল চোখে কয়েক পলক তাকে দেখে।নতুন করে কি বলা যায় তার মাথায় আসছে না।যেটা বলার জন্য ভেতরটা ছটফট করছে সেটা এখন বলা যাবে না।কি বিচ্ছিরি পরিস্থিতির মাঝে পড়েছে সে।অবশেষে চেরাগ বাতি দিয়ে অনুসন্ধান করার পর সে একটা কথা খুঁজে পেল।সে প্রসন্ন হেসে বলল,’আমি দুই দিন ধরে সারাক্ষণ এদিকেই ছিলাম।কেন জানো?’
নবনীতা একপেশে হাসে।একবার মাথা নেড়ে জানায় সে জানে না।আরহাম ভাব নিয়ে বলল,’কারণ আমি চেয়েছি জ্ঞান ফেরার পর সবার প্রথম যেন তুমি আমাকেই দেখ।আর দেখ,আমার চাওয়া পূরণ হয়েছে।’
নবনীতা থমথমে মুখে জবাব দেয়,’জ্বী না জনাব।পূরণ হয়নি।আমি সবার আগে ডাক্তার আর নার্স কে দেখেছি।তারপর আপনাকে।’
আরহাম বাঁকা চোখে তাকে দেখল।বিরক্ত হয়ে বলল,’ধ্যাত! ঐ দেখার কথা বলিনি।আপনজনদের কথা বলেছি।’
নবনীতা শান্ত চোখে তার দিকে তাকায়।ঠিকই তো।ডাক্তার আর নার্স তো তার আপনজন না।তার আপনজন তো তার সামনে বসে থাকা এই ছেলেটা।যেই ছেলেটা রাজনীতিবিদ হিসেবে যেমন তেমন,কিন্তু ফ্যামিলি ম্যান হিসেবে এক শব্দে অসাধারণ।নবনীতা চোখ মেলে তাকে দেখে।লোকটার চোখ বলছে সে সত্যিই দুই রাত ঘুমায়নি।কেন ঘুমায় নি?নবনীতার জন্য?নবনীতা তার কে হয়?
আরহাম দীর্ঘসময় চুপচাপ থাকার পর নবনীতার ক্যানুলা লাগানো রুগ্ন হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।জড়ানো কন্ঠে বলে,’আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় আচরণ করেছি পরী।আই অ্যাম সরি ফর দ্যাট।বাট এই দেখ,আমি তোমায় ছুঁয়ে প্রমিজ করছি,আমি তোমাকে আর কষ্ট দিব না।সত্যি সত্যি বলছি।তুমি এখন থেকে খুব ভালো থাকবে।এসব চাকরি বাকরির চিন্তা ছাড়ো।তুমি মন দিয়ে সংসার সাজাবে।বুঝেছ?’
নবনীতা ক্লান্ত ঘুম ঘুম চোখে আবারো তাকে দেখে।টেনে টেনে কয়েকটা শ্বাস নেয়।আরহাম কে তার অনেক কিছুই বলার ছিল।কিছু বিষয়ে সে আরহামের উপর নাখোশ।অথচ এই পরিস্থিতিতে সেসব কথা তার মুখ দিয়ে বের হচ্ছে না। অপর পক্ষের মানুষটা যখন এতোখানি সহানুভূতি দেখায়,তখন নবনীতা আর কঠিন থাকতে পারে না।
আরহাম একটা হাত তুলে নবনীতার মাথায় রাখে।রাখতেই নবনীতার ক্লান্ত মুখটা দেখে গাঢ় স্বরে বলে,’তুমি এতো প্যারা নিচ্ছ কেন?আমি তো আছি।আমি থাকতে তুমি এতো কষ্ট কেন করবে?’
খড়খড়ে মরুর বুকে একটুখানি বৃষ্টি নেমে এলে যেমন অনুভূতি হয়,আরহামের একটু খানি স্নেহের বাণীতে নবনীতার ঠিক তেমনই অনুভূত হলো।এই ছয়টা বছর সে বিরামহীন ছুটে গেছে।মস্ত বড় পৃথিবীতে সে একাই লড়াই করেছে,অগনিত বার হোঁচট খেয়েছে।বার বার অনুভব করেছে তার জীবনে একটা শক্ত খুঁটির খুব অভাব।শুভ্রা আর চিত্রার মাথা গোজার ঠাই আছে।অথচ নবনীতার কেউ নেই।কেউ নেই যে কিনা নবনীতার কাছে আসবে আর বলবে,’এতো কষ্ট কেন করছ পরী?এই তো আমি আছি।আমি থাকতে তোমার কোনো ভয় নেই।’
নবনীতা আর্দ্র চোখে আবারো সামনে তাকায়।তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে,বক্ষপিঞ্জরে চলছে কালবৈশাখীর তুমুল তান্ডব।সে আনমনে এক ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দেয়।আলগোছে হাসে।যেই হাসিতে মিশে আছে খুব বেশি কৃতজ্ঞতা।তাকে এই প্রথমবারের মতো কেউ এমন করে আশ্বাস দিয়েছে।নবনীতা তো তার কাছ থেকে কখনোই এমনটা আশা করে নি।তার বাধ্য হয়ে,শুভ্রার সাথে রাগ দেখিয়ে,নিজের অভিমানের বশবর্তী হয়ে করা বিয়ে যার সাথে হয়েছিল,তার আর বর্তমানের আরহামের মাঝে কতোখানি পার্থক্য আছে! এই আরহাম কে নবনীতার মন্দ লাগে না।একটুও মন্দ লাগে না।
দু’জন চুপচাপ স্থির দৃষ্টিতে একে অন্যকে দেখে।নবনীতা কেবল মিষ্টি হেসে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।এই হাতটা তার স্বামীর।যেই স্বামীর অন্যায় অপরাধ নবনীতা গুনেও শেষ করতে পারবে না।কিন্তু সব দোষের ঊর্ধ্বে তার যেই গুনটি নবনীতাকে মুগ্ধ করে তা হলো নবনীতার প্রতি তার অপ্রতিরোধ্য টান।নবনীতা এই ছয় বছরে এতো রকম মানুষের সাথে পরিচিত হয়েছে,যে মানুষ চিনতে তার খুব একটা সময় লাগে না।সেই অভিজ্ঞতা থেকেই সে চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারে শাহরিয়ার আরহাম তাকে পছন্দ করে।যেই পছন্দে কোনো খাঁদ নেই।
আরহাম অনেকক্ষণ উসখুস করার পর শেষটায় ধৈর্যহারা হয়ে বলল,’পরী তোমাকে আরো একটা কথা বলার ছিল।জানি হসপিটাল উপযুক্ত জায়গা না।তবুও নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না।’
নবনীতা কপাল কুঁচকায়।একটু নড়েচড়ে উঠে জানতে চায়,’সেটা কি?’
আরহাম হড়বড় করে প্রশ্ন করে,’তোমার নাকি একটা মেজরের সাথে বিয়ে ঠিক হয়েছিল।আর তুমিও নাকি প্রথমবারেই সেই বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করোনি।এটা কি সত্যি?’
বিস্ময়ে নবনীতার মুখ হা হয়ে গেল।এমন একটা প্রশ্নের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিল না।সে আশ্চর্য হয়ে বলল,’মেজর?কিসের মেজর?কার মেজর?’
‘আর কার?তোমার মেজর।তোমাদের বাড়িওয়ালার ভাগ্নে।তোমায় বিয়ে করতে চেয়েছিল,ঐ মেজর।’
আরহাম কথা শেষেই চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকায়।নবনীতার বিস্ময়ভাব তখনো কাটেনি।কতোক্ষণ গোল গোল চোখে আরহাম কে দেখেই সে ফিক করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতেই চাপা স্বরে বলল,’ওহহ আচ্ছা মনে পড়েছে।’
‘মনে পড়েছে মানে?আবার কি মনে পড়েছে?ঐ বেগানা পুরুষকে মনে পড়ার কি আছে হ্যাঁ?’ খিটখিটে হয়ে প্রশ্ন করে আরহাম।
এই প্রশ্ন তেও নবনীতার হাসি পেল।সে মুচকি হেসে জবাব দিলো,’আচ্ছা তাহলে আর মনে করব না।ঠিক আছে?’
আরহাম জবাব না দিয়ে কেবল মাথা নাড়ল।তারপরই আবার ব্যস্ত হয়ে বলল,’একটা প্রশ্ন করি?’
‘জ্বী স্যার।করুন।’
‘সত্যি করে বলবে কিন্তু।’
‘জ্বী।অবশ্যই।বলুন আপনি।’
আরহাম একটু এগিয়ে এলো।কৌতূহলী হয়ে বলল,’আচ্ছা সত্যি করে বলো তো ঐ মেজর বেশি সুন্দর ছিল নাকি আমি?লাইক আমাকে বিয়ে করার পর তোমার কি একবারও মনে হয়েছে যে “ধ্যাত!এর চেয়ে তো ঐ মেজর কে বিয়ে করলেই বেশি ভালো হতো”?বলো তো সত্যি করে?’
নবনীতা নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে হাসি আড়াল করল।কয়েক সেকেন্ড ভেবে ভীষণ চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল,’সেটা বলার জন্য তো আমার আবার তার কথা মনে করতে হবে।আপনি তো এই মাত্র বললেন তার কথা মনে করা যাবে না।তাহলে কিভাবে উত্তর দিব?’
আরহামকে দেখাল তার চেয়েও বেশি চিন্তিত।অনেকক্ষণ ভাবনা চিন্তার পর সে মুখ বাঁকা করে জবাব দিলো,’আচ্ছা এক মিনিটের জন্য মনে করো।তারপর আবার ভুলে যেও।’
নবনীতা এবার সত্যি সত্যি শব্দ করে হেসে ফেলল।কোথাকার কোন মেজর।কতো বছর আগের কাহিনী।তার কথা তো নবনীতা কবেই ভুলে গেছে।এখন কেমন করে সে আবার এসব মনে করবে?
সে দুষ্টু হেসে আরহামকে দেখে বলল,’যতোটুকু মনে পড়ে,ঐ মেজরটাই বেশি সুন্দর ছিল।হাইটেও আপনার চেয়ে বেশি ছিল বোধ হয়।’
আরহাম আশাহত হলো,সেই সাথে কিছুটা ব্যথিত।সে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করল,’জামাই বউয়ের একটা পারফেক্ট হাইট ডিফারেন্স থাকতে হয়।আমাদের টাই বেস্ট।তোমার ঐ মেজর জিরাফ।’
‘হু।হতেই পারে।আমি আমার টা বললাম আরকি।’
‘তুমি তোমার টা বললা মানে?তুমি নিজের বর কে ফেলে আরেকজনের গুণ গাইছো?এটা কতো বড়ো অপরাধ তুমি জানো?তোমার উচিত ছিল আমার প্রশংসা করা।আর তুমি ঐ মেজরের প্রশংসা করছ?এটা কেমন বেয়াদবি হ্যাঁ?’
নবনীতা জবাবে কেবল ঠোঁট টিপে হাসে।ঐ মেজরের চেহারা তার মনেও নাই ঠিক মতো।তবুও আরহাম কে ক্ষেপাতে তার ভালো লাগছে।
আরহাম বিরক্ত হয়ে অন্যদিকে ফিরে বলল,’এটা একদমই ঠিক না।আমি বাদেও তোমার জীবনে আর কেউ ছিল,ব্যাপারটা আমি মেনে নিতে পারছি না।তোমার সফ্ট কর্ণারের জায়গাটাও বা কেন আরেকজন পাবে শুনি?নট ফেয়ার।’
নবনীতা দুই চোখ সরু করে বলল,’সফ্ট কর্ণারের জায়গা আরেক জন পাবে মানে?আমার সফ্ট কর্ণার এখন কার জন্য আছে?’
‘অবশ্যই আমার জন্য।আই নো।তুমি আমাকে নিয়ে ভীষণ অবসেসড আমি জানি।’ দায়সারাভাবে জবাব দেয় আরহাম।
নবনীতা ফিচেল হাসে।দিরুক্তি করে জবাব দেয়,’জ্বী না জনাব।আমার আপনার প্রতিও কোনো সফ্ট কর্ণার নেই।’
বলেই সে আরো কিছুক্ষণ মাথা নামিয়ে নিঃশব্দে হাসে।
আরহাম কটমট চোখে তাকে দেখেই তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠে,’তোমার মতো বেইমান আমি দু’টো দেখিনি।এতো কিছু করার পরেও তুমি এই কথা বলছ।এজন্যই আমার মেয়ে মানুষ পছন্দ না।যাও কাল থেকে আমি আর এখানে আসবোই না।তুমি থাকো তোমার মতো।’
বলেই সে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।নবনীতা দ্রুত তার একহাত চেপে ধরে।মিষ্টি হেসে অনুরোধ করে,’প্লিজ আরহাম।এক্ষুণি যাবেন না।আরো কিছুক্ষণ থাকুন।থেকে আমার মন ভালো করে দিয়ে তারপর যান।’
তার বচনভঙ্গি এতো সুন্দর ছিল যে আরহাম এক কথাতেই সব মান অভিমান ভুলে গেল।সাথে সাথেই সে পুনরায় টুলে গিয়ে বসল।নবনীতা তার হাতটা পুনরায় নিজের মাথায় রেখে বলল,’আপনি সামনের পাঁচ মিনিট আমার মাথায় হাত রেখে একটানা বলবেন-তোমার কোনো ভয় নেই পরী,আমি আছি।
কি?বলতে পারবেন না?’
আরহাম অবাক হয়ে বলল,’কি অদ্ভুত ব্যাপার! এক কথা এতোবার বলব কেন?আমি কি পাগল?নাকি তোমার মাথায় সমস্যা?কোনটা?’
নবনীতা জেদ ধরে বলল,প্লিজ,বলুন না।আমার শুনতে ভালো লাগে ভীষণ।’
আরহাম হতাশ হয়ে মাথা নেড়ে নবনীতার মাথায় হাত বুলায়।নবনীতা আবেশে চোখ বুজে।আরহাম গলা খাকারি দিয়ে কন্ঠ পরিষ্কার করে বলতে শুরু করে,’তোমার কোনো ভয় নেই পরী।আমি আছি।তোমার কোনো ভয় নেই পরী।আমি আছি।তোমার কোনো ভয় নেই পরী।আমি আছি……….’
একবার,দুইবার,তিনবার,নবরীতার কথা মতো আরহাম পাঁচ মিনিটে অগণিত বার টেপ রেকর্ডারের মতো এক নাগাড়ে একই কথা বলে গেল।কে জানে,এই কথায় নবনীতা কি এমন মজা পেয়েছে।আচমকাই তার চোখ যায় নবনীতার বুজে রাখা চোখ দু’টোর দিকে।সে অবাক হয়ে আবিষ্কার করে নবনীতা নিঃশব্দে কাঁদছে।তার চোখ ছাপিয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরছে।আরহাম থমকায়।থতমত খেয়ে প্রশ্ন করে,’এ্যাই পরী! তুমি কাঁদছো কেন?আমি আবার কি করলাম?’
নবনীতা চোখ খুলে।একহাতে গালের কাছটা মুছতে মুছতে জড়ানো কন্ঠে বলে,’খুশিতে কাঁদছি।আপনি বলতে থাকুন।প্লিজ থামবেন না।’
আরহাম বোকা বোকা হয়ে আবারো যন্ত্রের ন্যায় এক কথা বারংবার বলতে থাকে।সে জানে না এই কথায় কি এমন মাধুর্য আছে,যেটা তার বউ এতো এতো শুনতে চাইছে।
সে জানল না তার সামান্য কিছু বাক্য মা বাবা হারানো মেয়েটির তপ্ত মরুর বুকে এক পশলা বৃষ্টি নামিয়ে দিয়েছে।কাঠফাটা গ্রীষ্মে বৃষ্টির আগমন যতো আনন্দের,তার এই কথাগুলোও নবনীতার কাছে ঠিক ততোটাই আনন্দের।নবনীতা টের পায় এই কথা গুলো শুনতে তার ভীষণ ভালো লাগছে,সে এসবের মাঝে তৃপ্তি খুঁজে পায়।মন চায় এক দৌঁড়ে কোনো একটা উন্মুক্ত প্রান্তরে ছুটে যেতে আর চিৎকার করে বলতে,’এই দেখো,আমি একা নই।আমার সাথে আরেকজন আছে।আমার ভয় নেই,কোনো ভয় নেই।’
চলবে-