কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩৩

0
10

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩৩)

নবনীতা উন্মা’দের মতো ছুটতে ছুটতে যেদিকে দুই চোখ যায় সেদিকেই পালিয়ে যাচ্ছিল।তবে সে বেশি দূর পালাতে পারল না।একটু দূরে যেতেই ফাহাদ খপ করে তার একহাত টেনে ধরল।প্রচন্ড ক্রোধে ফেটে পড়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,’পালাচ্ছিস কোথায়?তোর বরের কাজকর্মের প্রতিদান নিয়ে যা।’

নবনীতা এক ঝাড়ায় তার হাত ছাড়িয়ে পুনরায় সামনের দিকে ছুটে।ছুটতে ছুটতে তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।সে এতো দ্রুত দৌঁড়াতে পারে না।তার শ্বাসকষ্টের সমস্যা জন্মগত।হাঁপাতে থাকা শরীরটা ছুটতে ছুটতে টেনে টেনে নিশ্বাস নেয় কতোক্ষণ।শ্বাস টানতে টানতে অস্ফুটস্বরে শব্দ করে,’আল্লাহ! রক্ষা করো।’

ফাহাদ তাকে পুনরায় পেছন থেকে টেনে ধরে।নবনীতা শক্ত করে তার হাত চেপে ধরে।তার দৃষ্টি ফাহাদের হাতে থাকা র’ক্তাক্ত ছু’রির দিকে।যেই ছু’রি নবনীতার সমস্ত বাধা অতিক্রম করে একটু একটু করে এগিয়ে আসছিল তার পেটের দিকে।সে চিৎকার ছুড়ে সর্বশক্তি দিয়ে।ফাহাদকে প্রতিহত করার অভিপ্রায়ে সে পেছন ফিরে তার নাক বরাবর ঘু’ষি মা’রে।

দুই মিনিটের হাতাহাতি তে নবনীতার বাহু আর পিঠের অসংখ্য জায়গা কেটে ঝর ঝর করে র’ক্ত ঝরা শুরু করল।ফাহাদের নিজেরও হাত কাটলো।এই জীর্ণ দেহের মেয়েটিকে ধরাশায়ী করতে ফাহাদের এতো কষ্ট হবে,সেটা সে কল্পনাও করেনি।সে রাগে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’মা***গী একটা! ম’রার আগেও ভোগান্তি দিচ্ছে।হাত ছাড় ফকিন্নি।’

নবনীতা টেনে টেনে শ্বাস নেয়।এই মুহুর্তে স্রষ্টা ব্যতীত কে তাকে রক্ষা করবে?চারদিকে মিউজিক প্লেয়ার দিয়ে বাজানো গানের শব্দের মাঝে নবনীতার চিৎকার কেমন করে পৌঁছাবে তাদের কাছে?নবনীতা তবুও চিৎকার দেয়।মৃ’ত্যুভয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বলে,’বাঁচাও।প্লিজ কেউ বাঁচাও।’

ফাহাদ অবশেষে একটা আঘাত জোরাল ভাবে করতে সক্ষম হলো।হাতের ছু’রি টা প্রায় ইঞ্চি দুইয়ের মতো নবনীতার কাঁধের ভেতর প্রবেশ করল।নবনীতা অম্বর কাঁপিয়ে চিৎকার ছুড়ল,’বাবা!!’
সাথে সাথেই গল গল করে ফিনকি দিয়ে র’ক্ত ছুটলো তার।নবনীতা বেঁচে থাকার অভিপ্রায়ে শেষ চেষ্টা চালাল।ফাহাদের হাত না চেপে সে এক ধাক্কায় তার হাতের ছু’রি টা দূরে ছুড়ে মারল।এই প্রচেষ্টায় সে সফল হয়েছে।তার ধাক্কায় ছু’রিটা ফাহাদের হাত ছেড়ে আলমারির নিচে গিয়ে পড়ল।যার অবস্থান ফাহাদের নাগালের অনেক বাইরে।

বড্ড বেশি দেরি হয়ে গেছে।ফাহাদ যেটুকু সময়ে সব হবে ভেবেছিল,সেটুকু সময়ে সব হয়নি।আসাদের মতো মানুষকে মা’রতে তার দুই মিনিটও লাগে নি।আর এই চুনোপুঁটির মতো মেয়ে রীতিমতো তার ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছে।সে আর মাটিতে ঝুঁকে ছু’রি খোঁজার চেষ্টা করল না।আর দশ সেকেন্ড এদিক সেদিক হলেই সে ধরা পড়ে যাবে।সে একটা অশ্রাব্য গা’লি মুখ থেকে বের করে এক ধাক্কায় নবনীতাকে মেঝেতে ছুড়ে মারল।তারপরই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে পালাল সেখান থেকে।নিচে আরহামের গার্ডদের দেখা যাচ্ছে।তারা এই ভবনে ঢুকার আগেই তাকে পালাতে হবে।

নবনীতা মেঝেতে বসেই দুই দিকে দেখল।সেদিনের মতো তার হাতের কাছে কিছু নেই যেটা সে সোজা ফাহাদের ঘাড় বরাবর মারতে পারে।উল্টো সে নিজের শরীরের যন্ত্রণায় অস্থির।র’ক্তে র’ক্তে তার সমস্ত শরীর ভেসে যাচ্ছে।সে আস্তে করে তার শরীরটা মেঝেতে এলিয়ে দিলো।এতোক্ষণ ধস্তাধস্তি তে সে শরীরের ব্যাথা অনুভব করেনি।কিন্তু এখন একটু সময় যেতেই কাঁধের মারাত্মক যন্ত্রণায় সে ফুঁপিয়ে উঠল।নিজের রক্তে তার নিজেরই বমি পাচ্ছে।চটচটে আঠালো তরলটি তার সারা শরীরে গড়িয়ে পড়ছিল।কি বিভৎস দেখাচ্ছে তাকে।

বাবার কথা আবারো মনে পড়ছে তার।অনেক গুলো বছর আগে বাবাকে সে এমন জঘন্য অবস্থায় দেখেছিল।বাবা তো সেদিন বাঁচে নি।নবনীতা কি বাঁচবে?সে অসহ্য যন্ত্রণায় ফুঁপিয়ে উঠে।ভাঙা কন্ঠে বাবাকে একবার ডাকে।নিভু নিভু চোখে সামনে তাকাতেই দেখে আরহাম অস্থির হয়ে এলোমেলো পায়ে তার দিকে ছুটে আসছে।

তার কাছে আসতেই আরহাম স্তব্ধ হয়ে কতোক্ষণ আগাগোড়া তাকে দেখল।দেখা শেষ হতেই সেকেন্ডের ব্যবধানে মাটিতে বসে তার র’ক্তমাখা শরীরটা নিজের সাথে চেপে ধরল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’পরী!’

নবনীতা বুজে আসা চোখে তাকে দেখে।তার চোখ দু’টো ভীষণ অনুভূতিশূন্য আর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।তার সমস্ত শরীর সময়ের পরিক্রমায় ঠান্ডা হয়ে আসছে।সে কাঁপা কাঁপা হাতে আরহামের বাহু ধরে।থেমে থেমে নিশ্বাস নিয়ে বহু কষ্টে বলে,’আরহাম! আমার কিছু হলে শুভি আর চিত্রকে দেখবেন প্লিজ?তারা আমার কাছে আমানতের মতো।প্লিজ একটু দেখবেন?’

তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল,অস্পষ্ট শোনাচ্ছিল।তবুও নবনীতা তার কথা শেষ করল।আরহাম হতভম্ব আর অবাক হয়ে সেভাবেই মাটিতে বসে রইল।সে শূন্য চোখে মাথা নিচু করে নবনীতার শান্ত মুখশ্রী দেখে।সেদিন সে গু*লি খাওয়ার পর নবনীতা যেমন করে তাকে ধমকে উঠেছিল,তেমনি করে ধ’মকে উঠে বলে,’এ্যাই পরী।চোখ বন্ধ করছো কেন?বলেছি না চোখ বন্ধ না করতে?’
.
.
.
.
‘সিস্টিক ফাইব্রোসিস।অটোসোমাল রিসেসিভ ডিজঅর্ডার।জেনেটিক্যাল সূত্রে সন্তান জন্মগতভাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়।এই ডিজঅর্ডার টি এখন পর্যন্ত অনিরাময় যোগ্য।অর্থাৎ সিস্টিক ফাইব্রোসিসের কোনো স্থায়ী চিকিৎসা নেই।এটি রক্তশূণ্যতা জনিত একটি প্রকট ব্যথি।উত্তর ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে এই রোগ প্রথম দেখা যায়।তারপর ধীরে ধীরে সেই ব্যথি ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র বিশ্বে।আপনার ওয়াইফ মিসেস নবনীতা জন্মসূত্রেই এই ডিজঅর্ডারে ভুগছেন।’

হেমাটোলোজিস্ট মতিন আহমেদ খসরু তার হাতে থাকা রিপোর্ট গুলো ধরে রেখে এক টানে কথা গুলো শেষ করলেন।তার সামনে বসে থাকা যুবকটি তার কথার পিঠে কেবল নিষ্প্রাণ চোখে তার দিকে একবার তাকায়।দৃষ্টি মিলতেই সে আবার চোখ নামিয়ে নেয়।মতিন আহমেদ শান্ত চোখে তার পাঞ্জাবির বুকের দিকটা দেখে।যেটা তা’জা র’ক্ত শুকিয়ে রক্তিম হয়ে আছে।শুধু পাঞ্জাবি না,তার সমস্ত শরীরেই এখানে সেখানে র’ক্তের ছিটা।যুবকটা আইসিইউ বেডে স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকা মেয়েটির স্বামী।

মতিন সাহেব একটু থেমে আবারো বললেন,’নবনীতা জন্মের পর থেকেই এই জেনেটিক্যাল ডিজঅর্ডারের পেশেন্ট।একটা দীর্ঘসময় পর্যন্ত সে সুচিকিৎসায় ছিল।যার কারনে তার তেমন সমস্যা হয়নি।কিন্তু বিগত ছয় বছর যাবত সে সুচিকিৎসা দূরে থাক,ন্যুনতম যেই চিকিৎসা নেওয়ার প্রয়োজন ছিলো,সেটাও নেয়নি।অ্যানিমিয়া বিষয়টা হেলাফেলার না।বারবার বলেছি তাকে।সে কানে নেয়নি।সময় মতো র’ক্ত নেয় নি।নাজুক শরীরটাকে যাচ্ছে তাই কষ্ট দিয়েছে।আর আজকে যেটা হলো,যেই পরিমান র’ক্ত তার শরীর থেকে বেরিয়েছে,এরপর পুরোপুরি সুস্থ হতে নবনীতার বেশ সময় লাগবে।তার শরীরে এমনিতেই র’ক্তের প্রচুর অভাব।’

আরহাম একটু নড়েচড়ে উঠল।জীর্ণ গলায় বলল,’নবনীতার এই অসুখের কোনো চিকিৎসা নেই?’

মতিন আহমেদ দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।নমনীয় গলায় বলেন,’স্পেসিফিকালি এক শব্দে বললে বলব-না,নেই।কিন্তু সুচিকিৎসায় থাকলে এই অবস্থা থেকে কিছুটা ভালো অবস্থায় যেতে পারবে।কিছুটা না অবশ্য,বেশ ভালোই থাকতে পারবে।নবনীতার সমস্যাটা জন্মগত এবং মৃত্যু পর্যন্ত এই সমস্যা তাকে বয়ে বেড়াতে হবে।নাথিং টু ডু আরহাম।জেনেটিক্যাল ডিসঅর্ডার এমনই হয়।প্রতি মাসে মাসে র’ক্ত নিয়ে,ঔষধ খেয়ে তাকে বাকি জীবন পার করতে হবে।আরো ভালো হয় যদি ফিজিওথেরাপির ব্যবস্থা করতে পারো।তবে এখন না,বছর খানেক যেতে দাও।শরীরটা একটু মজবুত হোক।নবনীতা একটু ধাতস্থ হোক,তারপর।’

আরহাম তার চুল টেনে ধরে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ে।তার শরীর এখনো কাঁপছে।সে একটা শুকনো ঢোক গিলে জানতে চায়,’পরীর জ্ঞান ফিরবে কখন?’

‘আপাতত সামনের দুই দিন একটু অবজারভ করতে দাও।এখনি জ্ঞান ফেরা নিয়ে ভাবছো কেন?কি পরিমান ব্লিডিং হয়েছে তুমি নিজের চোখে দেখেছো।তার জীবন যে আছে এটাই কি বেশি নয়?’

আরহাম নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়।নিঃশব্দেই পা বাড়ায় সামনের দিকে।তার ভয়,তার আশংকা সবটা সত্য হয়েছে।তার সমস্ত কিছুর শোধ তোলা হয়েছে দু’টো নিষ্পাপ মানুষের র’ক্তের বিনিময়ে।যাদের একজন ইতোমধ্যেই তার পৃথিবীর অধ্যায় শেষ করে ফেলেছে।

যতবারই সে চোখ বুজে,নবনীতার শ্বাস টানতে থাকা শরীরটা তার মনসপটে ভেসে ওঠে।তখনই সে আর স্বাভাবিক থাকতে পারে না।তার বাবার মৃত্যুও সুখকর কিছু ছিল না।তবে এরকম চোখের সামনে আপন মানুষদের র’ক্তাক্ত শরীর সে আগে দেখেনি।কি যন্ত্রণাময় সে দৃশ্য! অথচ তার রাজনৈতিক জীবন চলাকালীন এমন কত কত নিষ্পাপ মানুষের ব*লি হয়েছে।সে সবটা জেনেছে,তবুও দলের বিপরীতে গিয়ে কিছু বলে নি।কারণ তারা তার কেউ ছিল না।তাদের মৃ’ত্যুতে তার হৃদয়ে র’ক্ত’ক্ষ’র’ণ হয়নি।কারণ সে তাদের আপনজন ছিল না।প্রতিহিংসার নোংরা রাজনীতি যখন তারই ঘরে এসে থাবা দিলো,তখন আরহাম টের পেল এতোদিনে নির্বিচারে খু’ন হওয়া শতো শতো নিষ্পাপ প্রাণদেরও একটা ঘর ছিল।সেই ঘরে তাদের প্রিয়তম কিংবা প্রিয়তমারা ছিলো।তারা সেই ঘরে আর কখনোই ফিরতে পারে নি।

আরহাম মতিন আহমেদের চেম্বার থেকে বেরিয়ে ক্লান্ত আর ভঙ্গুর পায়ে করিডোরে এসে দাঁড়ায়।রিমি তাকে দেখতেই তার কাছে ছুটে যায়।অধৈর্য হয়ে বলে,’উনি কি বলেছেন ভাইয়া?নবনীতা ঠিক আছে তো?’

আরহাম আস্তে করে মাথা নেড়ে বলল,’আছে।ঠিকই আছে।জ্ঞান ফিরতে একটু সময় লাগবে হয়তো।’

সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শুভ্রার পাশাপাশি চেয়ারে গিয়ে বসে।শুভ্রার সমস্ত মুখ তখনো রক্তিম।কাঁদতে কাঁদতে তার নাজেহাল অবস্থা।এতো কান্না সে বাবা মা মা’রা যাওয়ার পরেও কাঁদেনি।আজ কাঁদছে।সে যখন পাঁচ মিনিটের জন্য গ্লাসের দরজা দিয়ে আপাইকে দেখার সুযোগ পেল,তখনই সে পা উঁচু করে ভয়ে ভয়ে হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখল।যেই জীর্ণ অবস্থায় সে তাকে দেখেছে,তারপর থেকে সে ঝরঝর করে কেঁদেই যাচ্ছে।আপাইয়ের পুরো শরীর জুড়ে শুধু ব্যান্ডেজ আর ব্যান্ডেজ।সেই সাথে আশেপাশে কতো রকমের যন্ত্রপাতি।আবার তার শ্বাসপ্রশ্বাসও চলছিলো কৃত্রিম উপায়ে।কি ভয়াবহ সে দৃশ্য!

জীবনের দুঃখের রাত গুলো শুভ্রা আর চিত্রা আপাইয়ের বুকে গুটিশুটি মে’রে কাটিয়েছে।আজ প্রথমবার শুভ্রা চরম অসহায় মুহূর্তে ছুটে যাওয়ার মতো কোনো জায়গা পাচ্ছে না।রিমি আপু তার খুব খেয়াল রাখছে।কিন্তু রিমি আপু তো আর পরী আপাই না।পরী আপাইয়ের কোনো বিকল্প নেই।সেই শূন্যতা পূরণ করবে,এমন মানুষ পৃথিবীতে আর দু’টো আসে নি।

আরহাম চিত্রার হাত টেনে তাকে নিজের কাছে আনে।মেয়েটা সেই তখন থেকে ভয়ে আর আতঙ্কে মিইয়ে গেছে।তার চাঞ্চল্যে,তার ছুটোছুটি সবকিছু এক জায়গায় এসে থমকে গেছে।আরহাম তার মাথায় হাত বুলিয়ে মোলায়েম গলায় বলল,’কি হয়েছে চিত্র?এতো ভয় পাচ্ছ কি নিয়ে?ভাইয়াকে বলো।’

চিত্রা নাক টেনে টেনে আরহামের দিকে তাকায়।তার চুপশে যাওয়া মলিন মুখটা একটু সময় যেতেই ভয়াতুর গলায় প্রশ্ন করে,’আপাই কি ম’রে যাবে আরাম ভাই?এরপর কি আমি আর কখনোই আপাইয়ের কাছে ঘুমোতে পারব না?’

তার প্রশ্ন শুনেই আরহামের বুক ধ্বক করে উঠে।একটা বাচ্চা মেয়ে কতোখানি অসহায় হলে এমন একটা প্রশ্ন করতে পারে?কতোখানি আতঙ্কে থাকলে একটা বাচ্চা নিজের দুরন্তপনা থেকে সরে আসে?

আরহাম তাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে।গাঢ় কন্ঠে আশ্বাস দিয়ে বলে,’না চিত্র।তোমার আপাইয়ের কিচ্ছু হবে না।তোমাদের এতো একা করে সে যাবে কোথায়?’

সে কথা শেষ করেই শুভ্রাকে দেখল।শুভ্রা তখনও নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন করে যাচ্ছিল।আরহাম গলা খাকারি দিয়ে ডাকল,’শুভ্রা! এ্যাই শুভ্রা।’

শুভ্রা কোনোরকমে কান্না গিলে জবাব দেয়,’জ্বী ভাইয়া।’

‘তোমার আপাইয়ের কিছু হবে না শুভ্রা।একটা দিন যেতে দাও।তারপরই তার জ্ঞান ফিরবে শুভ্রা।তুমি আইসিইউ দেখে ভয় পাচ্ছো কেন?আইসিইউ তে আছে মানেই তার অবস্থা খারাপ,এমন কিছু কিন্তু না।’

আরহাম থামে।একটু সময়ের জন্য নিরব থেকে কিছু একটা ভাবে।তারপরই সমস্ত নিরবতা ছাপিয়ে গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে,’তোমার কাছে কিছু কথা জানার ছিল শুভ্রা।প্লিজ একটু বলবে?’

‘কি ভাইয়া?’ নাক টানতে টানতে জানতে চায় শুভ্রা।

‘তোমাদের হোম টাউন কি ঢাকার বাইরে?’

‘জ্বী।আমাদের জন্ম চট্টগ্রামে।’

আরহাম কিছু একটা বুঝে ফেলার মতো করে মাথা নাড়ল।তারপরই পুনরায় জানতে চাইল,’নবনীতার পাস্ট রেকর্ড অনুযায়ী সে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত খুব ভালো চিকিৎসার মাঝে ছিল।এমনকি কয়েকবার চেক আপের জন্য সিঙ্গাপুরেও গিয়েছিল।এরপর গত ছয় বছর ধরে সে আর নিয়মিত চেক আপের মাঝে ছিল না।এটার কারণ কি?’

শুভ্রা তার এলোমেলো চুলগুলো কানের কাছে গুজে নেয়।একটু পর পর তার হেঁচকি তুলে কান্না আসছে।ওয়াজিদের তাকে দেখেই মায়া হলো।সে মলিন মুখে বলল,’এমন করে কাঁদে না শুভ্রা।তোমার আপাই ঠিক আছে।আরহাম বললো তো।’

শুভ্রা দুই হাতে চোখ মুছে।আরিশ তার থেকে সামান্য খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে চোখ তুলে একবার তার মুখটা দেখল।সে একটু আগেই তার ভার্সিটি শেষে সোজা এদিকে এসেছে।তার আজকে পরীক্ষা ছিল।তার গলায় এখনো তার আইডি কার্ড টি ঝুলানো।

_____

‘আমার বাবার নাম নূর আহমেদ।চট্টগ্রামে আমার বাবার খুব ভালো পরিচিতি আছে।ব্যবসা করে আর বাবাকে চিনে না,এমন মানুষ খুব কমই আছে।বাবা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির শেয়ার হোল্ডার ছিলেন,চট্টগ্রামের বেশ কিছু ফ্যক্টরি তার নিজের নামে ছিল।যদিও তার কিছু আমার বাবা আমার দাদার কাছ থেকে পৈতৃক সূত্রে পেয়েছিল।আমার ছোট চাচার তুলনায় বাবা ব্যবসায় খুব বেশি নাম করেছিল।দাদার ফ্যক্টরি বাদেও বাবা নিজের টাকায় আরো অনেক কারখানার মালিক হয়েছিল।আমাদের তিন বোনেরই জন্ম হয়েছে চট্টগ্রামের একটি আলিশান বাংলো বাড়িতে।ছোটবেলা টা আমার আভিজাত্যেই কেটেছে।তবে এই অর্থ বিত্ত আর জৌলুস সবচেয়ে বেশি দেখেছিল আপাই।কলেজ জীবন শেষ করা পর্যন্ত আপাই খুব আড়ম্বরপূর্ণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল।আপাইয়ের আলমারি ভর্তি শুধু দেশি বিদেশি ব্র্যান্ডের জামা ছিল।আপার ঘরটা আমার একটু একটু মনে পড়ে।এত্তো বিশাল একটা ঘর! আমাদের পুরো ফ্ল্যাটের সমান ছিল তার একটা রুম।আপাই চিকিৎসার উদ্দেশ্য বাদেও অনেক অনেক দেশে ঘুরেছে।বাবা ভীষণ ভালোবাসতো তাকে।বাবা তাকে ছোট বেলা থেকেই একভাবে বড় করেছে।আপাই জন্মগতভাবে অসুস্থ ছিল।বাবা তাকে সবসময়ই চেক আপের মাঝে রাখতো।তবে অসুস্থতার জন্য বাবা আপাইকে বসিয়ে রাখে নি।আপাই ড্রাইভিং থেকে শুরু করে সুইমিং সবকিছুই পারতো।নিজে নিজে শিখেছে।বাবা সাহায্য করেছে।আপাইয়ের এতো সাহস ঐ ছোটবেলা থেকেই একটু একটু করে বাবা তার মধ্যে তৈরি করেছিলেন।আমাদের জীবন অতিমাত্রায় সুখে যাচ্ছিল ভাইয়া।কিন্তু সেই সুখ এক রাতেই ম্লান হয়ে গেল।বাবার পিএ সহ আরো কিছু বিজনেস পার্টনার মিলে ষড়’যন্ত্র করে বাবাকে বাড়ি থেকে বের করে আমাদের বাগানে নিয়ে কু’পিয়ে হ’ত্যা করল।প্রথমে বাবা,তারপর মা।আমার তো সেই স্মৃতি অল্প অল্প মনে পড়ে।শুধু মনে আছে মা কে মা’রার সময় বাবা আপাইকে জোর গলায় কিছু বলেছে।আর তারপরই আপাই আমাদের দুই বোন কে নিয়ে ছুটতে ছুটতে সেই রাতেই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে।পরদিন সকালে বাগানেই বাবা আর মায়ের লা’শ পাওয়া গিয়েছিল।আপাই সিদ্ধান্ত নিল কেস করবে।কিন্তু থানায় কেউ এই হ’ত্যা মামলার কেস পর্যন্ত নেয় নি।তারপর আমাদের বাড়ি থেকে শুরু করে সমস্ত সম্পত্তি রাতারাতি ভাগযোগ হয়ে গেল,অথচ আমাদের জানানোও হলো না।কারণ আমরা কেউই তখন প্রাপ্তবয়স্ক হইনি।বাবার পিএ আর বিজনেস পার্টনার রা তো অন্যায় ভাবে আমাদের অধিকাংশ সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়েছিল।এরপরেও যা কিছু বাকি ছিল,আমার একমাত্র চাচা সবকিছু দখলে নিলেন।আপাই বিরোধ করল।বলল বাবার কষ্টের সম্পদের এক আনাও সে কাউকে দিবে না।সেই লড়াইয়ে আপাই জিততে পারেনি।দেশীয় আইনে নাকি মেয়েরা কখনোই তার বাবার সব সম্পদ পায় না।তবুও যা একটু পাওয়ার কথা,সেটাও কেড়ে নেওয়া হলো আমাদের থেকে।আমরা শুরুতে একটু আশ্রয়ের আশায় চাচার বাড়িতে জায়গা নিলাম।চাচার বাড়িতে আমরা খুব বেশিদিন থাকতে পারিনি।তার কারণ আপাইয়ের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য।আমার চাচাতো ভাই তাকে বিয়ে করার জন্য উঠে পড়ে লাগল।চাচাও এ নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করলেন।বললেন বাড়িতে থাকতে হলে বিয়ে করতে হবে।কিন্তু আপাই কিছুতেই রাজি হলো না।চাচাতো ভাইয়ের সাথে সে বিয়ে বসবে না,কিছুতেই বসবে না।মিরাজ ভাইয়া,মানে আমার চাচাতো ভাইও আপাই কে ভীষণ উত্ত্যক্ত করা শুরু করেছিল।সে যখন বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে গিয়ে আপার গায়ে হাত দেওয়ার দুঃসাহস দেখালো,তখন আপাই কষিয়ে তাকে দু’টো থাপ্পড় দেয়।এরপরই আপাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমরা আর চাচার বাড়ি থাকবো না।রাতারাতি আমরা চাচার বাড়ি ছেড়ে দিলাম।ছেড়ে দিলাম নিজেদের শহরও।সেই রাতেই দুই বোনকে নিয়ে আপাই চলে আসলো ঢাকা।আমাদের স্থান হলো মামার বাড়িতে।আপাই তখন এডমিশন পরীক্ষার্থী।শুরুর কয়েকদিন আপাই কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছিল না।নতুন বাসা,নতুন মানুষ,নতুন শহর-সবমিলিয়ে আপাই দিনরাত শুধু দরজা বন্ধ করে হাউমাউ করে কাঁদতো।একদিকে বাবা মা হারানোর যন্ত্রণা,অন্যদিকে আমার আর চিত্রার দায়িত্বভার,সব মিলিয়ে আপাই পাগল হয়ে যাচ্ছিল।তার উপর মামার বাড়িতে মধ্যবিত্ত জীবনযাপনে নিজেকে মানিয়ে নিতে রীতিমতো কয়েকদিন নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করল আপাই।কিন্তু পড়াশোনা ছাড়ে নি একটুর জন্যও।চিত্রাকে বুকের উপর রেখে ঘুম পাড়াতে পাড়াতেই আপাই নিজের পড়াশোনা চালিয়ে গেল।কিছু ক্যাশ টাকা ছিলো আমাদের কাছে।আপাই সেসব টাকা দিয়ে একটা কোচিং-এ ভর্তি হলো।আপাই কেবল একমাস সময় পেয়েছিল।কারণ চাচার বাসায় থাকা অবস্থায় আপাই বইটা পর্যন্ত হাতে নিতে পারেনি।তারপর এই এক মাসের প্রস্তুতিতেই আপাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে।যদিও তার স্বপ্ন ছিলো ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি তে পড়ার,কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।এই অল্প সময়ে এরকম জঘন্য অবস্থায় আসলে কারো পক্ষেই সেই স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব নাকি জানি না।আপাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন।আমার স্কুল পরিবর্তন করা হলো।মামার তখন চাকরি ছিলো।খাবারের টাকা মূলত মামাই দিতো।বাজার সদাই সহ সংসারের সমস্ত খরচ মামাই বহন করতো।তারপর বছর দু’য়েক যেতেই মামা পর পর দুই বার স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে গেলেন।আমরা সাগর থেকে গিয়ে পড়লাম মহাসাগরে।তারপর শুরু হয় আমার আপাইয়ের নতুন সংগ্রাম।পড়াশোনার পাশাপাশি আপাই টিউশন সহ অন্যান্য পার্ট টাইম জবের খোঁজে লেগে পড়ল।হন্য হয়ে একটা চাকরি খোঁজা শুরু করল।পাকাপোক্ত কোনো চাকরিই আপাই পাচ্ছিল না।পরে আপাই যখন যেই চাকরি পেত,সেই চাকরির জন্যই ইন্টারভিউ দিতো।পড়াশোনার পাশাপাশি আমাদের সবার দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছিল আপাই।মামি আমাদের থাকার খোঁটা দিতেন,খাওয়ার খোঁটা দিতেন।সেই খোঁটা থেকে আমাদের বাঁচানোর জন্য আপাই নিজেই ভাড়ার টাকা আর বাজারের টাকার জোগান দিত।চিত্রার মা বাবা দুইটাই ছিলো আপাই।আপাই যে আমাদের কি পরিমান ভালোবাসে আর সেই ভালোবাসার জন্য সে কি পরিমান ত্যাগ স্বীকার করেছে,সেটা আমি কোনোদিন মুখে বলে শেষ করতে পারব না।চিত্রা আর আমি অসুস্থ হলে আপাই রাত জেগে আমাদের সেবা করত।সবসময় বলত আমরা দু’জন নাকি তার কাছে বাবা মায়ের আমানত।আপনি জানেন না ভাইয়া,আপাই আমাদের সুখের জন্য ঠিক কি কি বিসর্জন দিয়েছে।যেই আপাই আলমারি ভর্তি জামা নিয়ে নতুন নতুন জামার খোঁজ করত,সেই আপাই ঘুরে ফিরে দুই তিন সেটা জামা পরেই মাস পার করে দিত।মামি আমাদের খাবার নিয়েও যন্ত্রণা দিত।আপাই কি করতো জানেন?’

দীর্ঘ সময় ধরে অনর্গল কথা বলার পর শুভ্রা কিছুক্ষণ থেমে একটু দম নিল।হাসপাতালের করিডোরে তখন পিনপতন নিরবতা।করিডোরে উপস্থিত প্রতিটা মানুষ মোহাবিষ্ট হয়ে,আশ্চর্যান্বিত চোখে শুভ্রাকে দেখে যাচ্ছিল।একমনে শুনে যাচ্ছিল তার সমস্ত কথা।একটু পর পর ভাবছিল সে কি সত্যি বলছে?সত্যিই কি এটা কারো জীবনের গল্প?জীবন কখনো এতো নাটকীয় হয়?মেয়েরা কখনো এতো ভালো হয়?এতো ত্যাগ স্বীকার কি কোনো বোন তার অন্যান্য বোনদের জন্য করে?

শুভ্রা আচমকা হু হু করে কেঁদে উঠল।দুই হাত মুখে চেপে কান্না থামানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,’আপাই কোনোদিন তার ভাগের মাংসের টুকরো টা খেত না।আপাই সেটা রেখে দিয়ে কেবল ঝোল আর আলু খেত।আর মাংসের টুকরো টা পরের দিন আমাকে আর চিত্র কে ভাগ করে দিত।তাকে জিজ্ঞেস করলে বলত সে নাকি জীবনে অনেক ভালো ভালো খেয়েছে।বাকি জীবন আর খেতে না পারলেও চলবে।আপনি হয়ত বিশ্বাস করবেন না,কিন্তু বছরের পর বছর আমার আপাই এই কাজই করে গেছেন।আমার আপাই পরী।সে সত্যিই আমার আর চিত্র’র পরী আপাই।’

কিছু সময়ের বিরতির পর শুভ্রা শান্ত কন্ঠে পুনরায় বলতে থাকে,
‘আপাই অসম্ভব রূপবতী।সেটা আমার আলাদা করে বলার কিছু নেই।সবাই জানে।আপাইয়ের জন্য প্রচুর বিয়ের সম্বন্ধ এসেছিল।এর মাঝে একজন ছিল সেনাবাহিনীর মেজর।আমাদের বাড়িওয়ালা আঙ্কেলের ভাগ্নে।ছুটিতে বেড়াতে এসেই আপাইকে দেখে পাগল হলো।সে তাকেই বিয়ে করবে।লোকটা নিরেট ভদ্রলোক ছিল।আপাইয়েরও তাকে পছন্দ হয়েছিল বোধহয়।কারণ অন্যান্য সম্বন্ধ যেমন আপাই শোনা মাত্রই প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছিল,এই সম্পর্কটা আপাই এক নিমিষেই প্রত্যাখ্যান করে নি।সে সময় নিল।মেজর লোকটার কাছে জানতে চাইল বিয়ের পরেও আমার আর চিত্রার সমস্ত দায়িত্ব আপাই বহন করবে।আর আপাই চাকরি করবে।সম্ভবত উনি এতে রাজি ছিলেন না।আর আপাই তখন বরাবরের মতোই বিয়েটা ভেঙে দিলো।আপাই সব ছেড়ে ছুড়ে শুধু আমার আর চিত্র’র খাওয়া পরা নিয়ে পড়ে থাকত।তার ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসার নমুনা আমি মুখে কেমন করে বলব?নিজের জীবনটাই যে আমাদের খুশির জন্য মলিন বানিয়েছে,তাকে আমি কেমন করে কয়েক বাক্যে পরিচয় করাবো?সে আমার আপাই।সে চিত্র’র আপাই।সে এই শূন্য খা খা,হায়নাতে ভরা পৃথিবীতে আমাদের এক মাত্র আশ্রয়।সে আমার আর চিত্র’র জীবনে সত্যিকারের পরী হয়ে আসা পরী আপাই।’

শুভ্রা থামল।পুরোপুরি ভাবে তার কথা শেষ করল।শেষ করেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ মুছল।সে ক্লান্ত হয়ে গেছে কথা বলতে বলতে।অথচ বলা শেষ করার পর তার মনে হলো সে তো কিছুই বলতে পারেনি।তার উচিত ছিল আরো কিছু বলা।এতো অল্প কথায় পরী আপাইকে পরিচয় করানো সম্ভব?

করিডোরে দাঁড়ানো প্রতিটি জীব মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তার কথা শুনে।রোজ রোজ তাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ানো মেয়ে মানুষটির অতীত এতো লোমহর্ষক?এতো যন্ত্রণার?এতো সংগ্রামের?এতো আত্মত্যাগ কেউ কারো জন্য করে?মেয়েটি নিজের নামের অর্থকে স্বার্থক করেছে।সে সত্যিই পরী।দুষ্টু মানুষের ভীড়ে মিশে থাকা একটা মিষ্টি পরী।

আরহাম একটু নড়ে উঠে তার একহাত শুভ্রার মাথায় রাখে।তার স্নেহের পরশ পেতেই শুভ্রা পুনরায় ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দেয়।আরহাম ভরাট গলায় বলে,’কান্না করে না শুভ্রা।তোমার আপাই তো একটা আস্ত ফাইটার।তার কিচ্ছু হবে না।নবনীতা নূর হেরে গেলেও পরী আপাই কিছুতেই হারবে না।’

আরিশ আলগোছে চোখ মুছে।মৃদু হেসে জড়ানো কন্ঠে বলে,’সিরিয়াসলি?চোখ ভিজে গেছে আমার!’

আদি মাথা নিচু করে ছোট করে জবাব দেয়,’আমারও।’

তাসনুভা তো শুভ্রা কথা শুরু করার পর পরই দুই চোখে পানির ফোয়ারা খুলে বসেছে।আরিশ তার চোখ মুখের অবস্থা দেখেই তার মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল,’যা তাস! কাঁদতে কাঁদতে একটা নদী বানিয়ে ফেল।ন্যাকু একটা!’

রাত একটু বাড়তেই আরিশ আর তাসনুভা বাড়ি ফিরে গেল।তাসনুভার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়েছে।রিমি বিভাকে নিয়ে দূরের আরেকটা চেয়ারে গিয়ে বসল।ওয়াজিদ আর আদি করিডোরের এক পাশে দাঁড়িয়ে মৃদু স্বরে কথাবার্তা বলছিল।চিত্রা একটু আগেই আরহামের কোলে ঘুমিয়ে গেছে।আরহাম আনাড়ি হাতে তাকে ধরে রেখেছে।আগে কখনো এমন করে কোনো বাচ্চা তার কোলে ঘুমায়নি।তার ভয় হচ্ছে।যদি পড়ে যায়?

শুভ্রা মাথা নামিয়ে চুপচাপ জড় পদার্থের মতো বসেছিল।কাঁদতে কাঁদতে এখন আর চোখ দিয়ে পানিও আসছে না তার।আরহাম একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখল।আচমকা কিছু মনে পড়তেই সে কিছুটা ব্যস্ত,কিছুটা অস্থির আর খুব বেশি কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল,’আচ্ছা শুভ্রা,তোমার আপাইয়ের ঐ মেজরের নাম কি ছিল?সে কি দেখতে খুব বেশি সুন্দর ছিল?আচ্ছা সেসব ছাড়ো।বলো তো,আমি বেশি সুন্দর নাকি তোমার আপাইয়ের সে মেজর?’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে