#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৩২)
‘শুভি! আপাইয়ের কুচিটা একটু ধরে দে তো।’
নবনীতা দুই হাতে অর্ধেক পরা শাড়িটা ধরেই গলা ছেড়ে ডাকল।একবার,দুইবার,তিনবার।শুভ্রার কোনো বিকার নেই।নবনীতা শেষে বিরক্ত হয়ে আবার ডাকল,’হচ্ছে টা কি শুভি?আসবি তুই?’
আরহাম অর্ধেক খাওয়া আপেলটা কা’মড়াতে কা’মড়াতে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালো।স্বাভাবিক গলায় বলল,’শুভ্রা নেই।কলেজের জন্য বেরিয়ে গিয়েছে।’
‘আয়হায়! এখন কি হবে?’
ভীষণ উদ্বিগ্ন শোনায় নবনীতার কন্ঠ।আরহাম আগাগোড়া একনজর তাকে দেখে কপাল কুঁচকে বলে,’সমস্যা কি?তুমি তো নিজে নিজেই শাড়ি পরতে জানো।শুভ্রাকে ডাকছো কেন?’
‘এটা সিল্কের শাড়ি।আগে কখনো সিল্ক পরিনি।ভীষণ ঝামেলা করছে শাড়িটা!’
আরহাম আরো একবার শাড়িটা দেখে।এটা সে দুইদিন আগে কিনেছে।তাসনুভা আর সে আড়ংয়ে গিয়েছিল।তখনই শাড়িটা তার চোখে পড়েছে।প্রথম দেখাতেই ভালো লেগেছে।দেখতেই মনে হয়েছে তার একটা বউ আছে,সেই বউ রোজ রোজ সুন্দর সুন্দর শাড়ি পরে স্কুলে যায়।সেই সুন্দরী বউকে এমন একটি শাড়ি গিফট করলে মন্দ হয় না।
সে তক্ষুনি এটা কিনে নিয়েছে।শাড়ির ম্যাটারিয়েল সম্পর্কে তার ধারণা নেই।কিন্তু এই মুহূর্তে নবনীতার উদ্ভ্রান্ত মুখশ্রী দেখে তার মনে হচ্ছে শাড়ির কাপড় টা খুব একটা সুবিধার না।সে হাতের আপেল টা ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে এগিয়ে এসে নবনীতার গলায় ঝুলিয়ে রাখা আঁচলের অংশটা হাতে নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলল,’ধুর! এতো পিছলা কেন?’
নবনীতা চোখ পাকায়।গট গট করে বলে,’কেনার আগে দেখেন নি পিছলা না খসখসা?এখন বলে লাভ আছে?’
‘লাভ নেই।তবে কেনার সময় দূর থেকে দেখে অনেক সুন্দর লাগছিল।শাইনিং দেখাচ্ছিল খুব।তাছাড়া তোমাকেও তো গায়ে ধরার পর ভালোই দেখাচ্ছে।’
নবনীতা ঘাম মুছতে মুছতে জবাব দেয়,’কিন্তু পরতে তো জান বের হচ্ছে।’
আরহাম এগিয়ে এসে নির্দ্বিধায় নবনীতার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’দাও দেখি।আমি চেষ্টা করি।’
‘আপনি আগে কখনো কুচি ধরেছেন কারো?’ সন্দিহান হয়ে জানতে চায় নবনীতা।
আরহাম নাক ছিটকায়।ছিটকে রেখেই বলে,’ইউউউ!! আমি কেন মেয়ে মানুষের কুচি ধরব?আমি কি ছ্যাবলা নাকি?’
‘তো এখন এসেছেন কেন?এসে আর ছ্যাবলা হতে হবে না।’ বিক্ষিপ্ত মেজাজে উত্তর দেয় নবনীতা।
‘উফফ তুমি তো বউ।তোমার বিষয়টাই আলাদা।’
কথা শেষেই আরহাম মোবাইল বের করল।ইউটিউব ঘেটে জামাই বউ মিলে কয়েকটা ভিডিও বের করে দেখল।আরহাম বহু কষ্টে কুচি ধরে সুন্দর করে সেট করে কুচিগুলো নবনীতার দিকে এগিয়ে দিলো।নবনীতা শক্ত করে ধরায় আগেই সে সেটা ছেড়ে দেয়।ফলসরূপ সমস্ত কুচি পুনরায় ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।এই দৃশ্য দেখে দু’জনই সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল।আরহাম একপ্রকার চিৎকার করে বলল,’পরী!! এটা কি করেছ?’
নবনীতাও তারই মতো চেঁচিয়ে উঠে বলল,’আপনি এটা কি করেছেন?ঠিক মতো ধরার আগে ছেড়ে দিয়েছেন কেন?’
আরহাম আশাহত হয়ে মাথা নামায়।পুনরায় হাঁটু গেড়ে বসে।কুচিগুলো ঠিক মতো ধরে নিজেই নবনীতার পেটের কাছে গুজে দেয়।নবনীতা পেটের কাছে তার হাত লাগতেই কেঁপে উঠল।আরহাম মাথা তুলে তার দিকে তাকায়।গম্ভীর গলায় বলে,’এমন লাফ দিয়ে উঠার কিছু নেই।বর হই আমি তোমার।’
নবনীতা সরু চোখে তাকে দেখে।বর দেখে কি এখন কাছে এলে খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে থাকবে?বর হোক আর যেই হোক,অনুভূতির বিষয়টা তো পাল্টে যাচ্ছে না।এই লোককে কি করে নবনীতা বোঝাবে যে বর কাছে এলেও মানুষ অল্প সল্প কাঁপে!
নবনীতা পুরো শাড়ি সেট করেই আয়নায় নিজের প্রতিবিম্ব দেখে।আরহাম ঠোঁট গোল করে বড়ো বড়ো চোখ করে বলে উঠে,’ওয়াও! লুকিং গরজিয়াস!’
তারপরই একটা হাত নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সামান্য ঝুঁকে বলল,’মে আই হোল্ড ইউর হ্যান্ড ডার্লিং?’
নবনীতা একগাল হাসল।হাত বাড়িয়ে একহাতে আরহামের বাহু আর অন্যহাতে তার কনুইয়ের কাছটায় জড়িয়ে ধরে শব্দ করে হেসে উঠে ন্যাকা সুরে বলল,’ইয়েস ডার্লিং।ইউ ডেফিনেটলি ক্যান।’
বলেই সে আরো এক দফা হাসল।ইদানিং সে নতুন প্রেমিকাদের মতো কারণে অকারণে উঠতে বসতে কেবল হাসে।আবার পরক্ষণেই সামান্য রূঢ় আচরণে তার দুই চোখ ছলছল করে উঠে।সে দাবাং নবনীতার খোলস ছেড়ে ইদানিং হুট করেই অভিমানী নবনীতা হয়ে যাচ্ছে।
বসার ঘরে আসতেই আরহাম চিত্রকে দেখল।সে এক মনে কার্টুন দেখছে টিভিতে।গত সপ্তাহে আরহাম টিভি কিনে লোক আনিয়ে বসার ঘরে সেট করে দিয়েছে।সারাদিন একটা বাচ্চা ঘরে থাকে।সে কতো আর রং পেন্সিল দিয়ে খেলবে?একটু তো বিনোদনের প্রয়োজন আছে।
আরহাম সেই চিরচেনা আদুরে স্বরে ডাকল,’চিত্র! ভাইয়ার কাছে এসো।’
চিত্র এক ডাকেই তার কাছে ছুটে গেল।আরহাম তাকে কোলে নিয়েই বলল,’চুলের এই অবস্থা কেন?’
বলেই আবার ফোড়ন কেটে বলল,’তোমার মহামানবী আপাই ইদানিং নিজে রং ঢং করতে করতে বাচ্চাটার আর খেয়াল রাখার সময় পায় না মনে হচ্ছে।’
নবনীতা মুখ হা করে তাকে দেখল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’সকালেই বেঁধে দিয়েছি।সে কি পরিমান দুষ্টুমি করে! নিজেই সব এলোমেলো করেছে।’
আরহাম তার একহাত দিয়ে চিত্রার দুইগাল চেপে ধর টুশ টুশ করে দু’টো চুমু খায়।আদর দিয়ে বলে,’সোনা বাচ্চা একটা!’
নবনীতা ভেংচি কেটে বলল,’ইশশশ রে! আপনার আহ্লাদ পেয়ে পেয়েই এমন বাদড় হচ্ছে দিন দিন।সারাদিন এতোবার আদর করার কি আছে হ্যাঁ?যত্তসব ন্যাকামোর দোকান।’
বলেই সে চোখ পাকিয়ে চিত্রার দিকে তাকায়।কড়া গলায় বলে উঠে,’টেবিলের উপর খাতা রাখা আছে।আসার পর যেন দেখি ওয়ার্ড সবগুলো লিখা শেষ হয়েছে।ঠিক আছে?’
চিত্রা মুখ কুঁচকায়।বিরক্ত স্বরে জবাব দে,’আচ্ছা ঠিক আছে।’
নবনীতা আর আরহাম সাদেক সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে দরজা লক করে বেরিয়ে গেল।লকের চাবি শুভ্রা আর নবনীতা দু’জনের কাছেই আছে।
লিফট থেকে নেমে দুই কদম সামনে যেতেই আরহাম পেছন থেকে তার হাত টেনে ধরল।নবনীতা তার অকস্মাৎ টেনে ধরায় বেশ খানিকটা হকচকায়।অবাক হয়ে পেছনে দেখে।আরহাম তাকে কাছে এনেই তার দুই হাত মুড়িয়ে পিঠের সাথে চেপে ধরে।নবনীতার দুই হাতের কবজি বাঁধা পড়ে আরহামের বলিষ্ঠ হাতের শক্ত বন্ধনে।
আরহাম আরেক হাতে নবনীতার গাল চেপে ধরে।তার চেপে ধরাতেই নবনীতার মুখ হা হয়ে গেল।সে গোল গোল চোখে অবাক হয়ে সামনে দেখে।তাকে চূড়ান্ত রকমের হতবাক করে দিয়ে আরহাম তার দুই গালে দুইবার দুইবার করে মোট চারবার চুমু খেল।শেষে তার টমেটোর মতো লাল হয়ে থাকা গালে আলতো করে কাম’ড়ও দিলো দুইটা।
নবনীতা হতভম্ব হয়ে বোকা বোকা মুখ করে সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকল কতোক্ষণ।প্রতিক্রিয়া দেওয়ার মতো মনস্তাত্ত্বিক অবস্থাও তার নেই।আরহাম সত্যিই তাকে চুমু খেয়েছে?তাও আবার পার্কিং লটে দাঁড়িয়ে।সে নিশ্বাস বন্ধ করে ফ্যালফ্যাল চোখে আরহামের চোখে চোখ রাখে।চমকে তার পলক ফেলাও বন্ধ হয়ে গেছে।
আরহাম তার বিস্মিত,হতবাক আর থমকে যাওয়া রূপ দেখেই বাঁকা হাসে।মাথা নামিয়ে নবনীতার কানের কাছে এসে গাঢ় স্বরে বলে,’গোপন সূত্রে খবর পেয়েছি চিত্রাকে চুমু খেলে নাকি তার পরী আপাইয়ের সাংঘাতিক রকমের হিংসে হয়? তাই এখন থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছি চিত্রাকে দু’টো চুমু খেলে তার আপাইকে চারটা খাবো।যতো কিছুই হোক,বউ বেশি ইম্পরট্যান্ট।তাই না?’
কথা শেষ করেই সে নবনীতাকে ছেড়ে দিয়ে দুই ঠোঁটের মাঝে সেই বাঁকা হাসি ধরে রেখেই সামনে এগিয়ে যায়।পেছনে পড়ে রয় আশ্চর্যে স্তম্ভিত হয়ে যাওয়া একটি মেয়ে যে কিনা ক্ষণিক আগেই স্বামীর মিষ্টি ভালোবাসায় সিক্ত হয়েছে।নবনীতা আনমনে নিজের এক হাত গালে ছোঁয়ায়।লোকটা তাকে চুমু খেয়েছে?তাও আবার এই জায়গায় দাঁড়িয়ে?নবনীতা এখন তার সামনে যাবে কেমন করে?সে তো লজ্জায় লাল নীল বেগুনি গোলাপি সব হয়ে যাচ্ছে।
আরহাম গাড়ির দরজা খুলে পেছনে ফিরে দারাজ কন্ঠে ডাকে,’পরী! পরে অবাক হবে।এখন গাড়িতে উঠে বসো।আজও আমরা দেরি করে ফেলেছি ভীষণ।’
.
.
.
.
লিলিপাই কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের সামনে আরহামের নিজস্ব ব্যবহারের বাড়াবাড়ি রকমের দামি গাড়িটা এসে থামতেই চারদিক থেকে সবাই সেই গাড়িটা ঘিরে দাঁড়াল।প্রথমেই গার্ডরা এসে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনলো।স্কুল অথোরিটিও অভ্যর্থনার ব্যাপারে বেশ সচেতন ছিলো।
প্রায় আট দশ জন দেহরক্ষীর কড়া নিরাপত্তায় আরহাম আর নবনীতা গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো।নবনীতা রোদের আঁচ টের পেতেই চোখে সানগ্লাস লাগায়।তারপর উদাস মুখ করে এদিক সেদিক তাকায়।কি একঘেয়ে জীবন! আশেপাশে এতো মানুষ,কিন্তু তবুও ছুটে গিয়ে তাদের সাথে মেশা যায় না।সর্বক্ষণ নিজেদের একটা গন্ডিতে আটকে রাখতে হয়।দেহরক্ষীদের নিরাপত্তা ব্যতীত বড় কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া যায় না।এর চেয়ে তো নবনীতার আগের জীবনই ভালো ছিল।যখন যেখানে মন চায় যেতে পারত।
আরহাম গাড়ি থেকে নেমেই হাসি মুখে সবাইকে অভিবাদন জানায়।একহাতে নবনীতার কাঁধ জড়িয়ে ধরে।স্কুলের প্রিন্সিপাল ডেইসি মিস ছুটে এসেই ফুলের তোড়া টা তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।অত্যন্ত উৎফুল্ল হয়ে বলল,’স্যার আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আসার জন্য।’
বিনিময়ে আরহামও হাসল।মেকি হাসি।সে জীবনেও এই কচি বাচ্চাকাচ্চাদের অনুষ্ঠানে আসতে চায় নি।বউয়ের ফাপড়ে পড়ে আসতে হয়েছে।তবুও সে নিখাঁদ আন্তরিকতা দেখিয়ে বলল,’না না।আমারও ভীষণ ভালো লাগছে এখানে এসে।’
সে আরেকটু সামনে এগুতেই তার হাতে থাকা ফুলের তোড়া টা নবনীতার হাতে তুলে দিলো।চাপা স্বরে বিড়বিড় করে বলল,’নেও।এসব বালসাল তোমার কাছেই রাখো।’
নবনীতা ফুলের তোড়া টা হাতে নিয়ে মাথা নুয়িয়ে ঘ্রাণ নেয়।আবেশে চোখ বুজে বলে,’ইশশ কি সুন্দর ঘ্রাণ! মোটেও বালছাল না।’
স্কুলের মাঠে পুরো অনুষ্ঠানের সেট আপ করা হয়েছে।অতিথিদের বসার জন্য এক পাশে ছাউনির মতো করা হয়েছে।প্রথম সারিতে বড়ো বড়ো কিছু সোফার মতো আরামদায়ক আসবাব,আর পেছনে সব চেয়ার রাখা।আরহাম আর নবনীতা গিয়ে বসল একেবারে সামনে।এইটুকু আসতে আসতে আরহাম আরো অনেক গুলো ফুলের তোড়া পেয়েছে।যার সবগুলোই নবনীতা তার দুই হাত দিয়ে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে।
নির্ধারিত আসনে বসার পরেই ক্যামেরা ম্যানরা ক্যামেরা হাতে ছুটে এসেই তাদের ছবি তোলা শুরু করল।আরহাম আরাম করে একহাত সোফার পেছনে রাখে।ভরাট কন্ঠে বলে,’হাসি হাসি মুখ করে ছবি তোলো পরী।এটাও আমাদের শর্তের অন্তর্ভুক্ত।’
কথা শুনেই নবনীতা এলোমেলো হাসল।সে আজকে কথা দিয়েছে সে সব কথা শুনবে।সুখী দম্পতিদের ন্যায় আচরন করবে।সে আরহামের একেবারে কাছাকাছি এসে হাস্যোজ্জ্বল মুখে ক্যামেরার দিকে তাকায়।দু’জনের হাসি হাসি মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে সবটাই নিছক লোকদেখানো।দাম্পত্যের দ টাও এখনো তাদের মাঝে আসে নি।তবে তারা একটু আকটু চেষ্টা করছে।হয়তো কখনো আসবে,হয়তো বা না।
কিছু সময় যেতেই নবনীতা উসখুস করা শুরু করল।তার অস্থির আচরণ রোদচশমার আড়াল থেকেই আরহামের দৃষ্টিগোচর হলো।সে তীক্ষ্ণ চোখে প্রশ্ন ছুড়ে,’কি হয়েছে তোমার?এমন অস্থিরতা করছ কেন?’
নবনীতা মলিন মুখে জবাব দেয়,’আমি সব ম্যামদের সাথে একসাথে থাকতে চাই।আমি টিচার্স রুমে যেতে চাই।’
আরহাম থমথমে মুখে তাকে দেখে।একটু পরেই ঠান্ডা গলায় বলে উঠে,’শর্ত ভাঙছো তুমি।কথা ছিল তুমি সবসময় আমার সাথেই থাকবে,ভীড়ভাট্টা এড়িয়ে চলবে।’
নবনীতা মন খারাপ করে উত্তর দেয়,’কিন্তু এটা তো আমার স্কুল।আমারও তো যেতে ইচ্ছে হয়।বাচ্চা গুলো ট্রায়াল রুমে আছে।আমার তাদের দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
আরহাম প্রতিউত্তর না করে সামনে দেখে।উত্তর দেওয়ার কোনো মানে নেই।সে এদিকে আসার আগে থেকেই নবনীতার সাথে তার কথা হয়েছিল নবনীতা এখানে এসে তার সাথে সাথে থাকবে।তার কথা মেনে চলবে।আসার পরেই ম্যাডাম নিজের কথা থেকে সরে যাচ্ছে।এখন আর চুপচাপ বসে থাকা তার পোষাচ্ছে না।
আরহাম আসার সাথে সাথেই আনুষ্ঠানিক ভাবে অনুষ্ঠান শুরু হয়।জাতীয় পতাকা উত্তোলন,জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন,কুরআন তেলাওয়াত,গীতা পাঠ-সবকিছু শেষ হতেই অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হলো।প্রথমেই ছোট ছোট সবুজ ঘাসে আবৃত মাঠে নৃত্য পরিবেশন করল নার্সারির এক ঝাঁক মিষ্টি বাচ্চারা।
আরহাম নাক মুখ ছিটকে চুপচাপ তাদের নাচ দেখে।বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করে,’যতোসব আন্ডাবাচ্চাদের ভেতর এসে আটকা পড়লাম।এগুলা যায় আমার প্রফেশনের সাথে?’
তার মহাবিরক্ত মুখটা দেখেই নবনীতা দুই চোখ সরু করে বলল,’ইশশ রে! এখন খুব প্রফেশন আসছে।নির্বাচনের আগে তো সারাক্ষণ যার তার বাচ্চাকে পেলেই কোলে নিয়ে আদিখ্যেতা করতেন।এখন এরা আন্ডাবাচ্চা হয়ে গেছে তাই না?’
আরহাম কুশনে ঠেস দিয়ে হাই তুলতে তুলতে বলে,’নির্বাচনের আগে তো কতো কিছুই করেছি।তবে অনেস্ট স্পিকিং,এসব বালবাচ্চা আমার একদমই ভালো লাগে না।চিত্রার ব্যাপারটা ভিন্ন।চিত্রা প্যা পু করে না।’
‘আমার স্টুডেন্ট রা প্যা পু করছে?কতো মিষ্টি করে নাচছে! সবগুলোই একেকটা রসগোল্লা,কি সুন্দর লাগছে রে!’
নবনীতা মুগ্ধ আর আনন্দিত চোখে ছোট ছোট বাচ্চাদের নাচ দেখে।ক্ষণিক পর পরই তালি বাজায়।গলা ছেড়ে তাদের উৎসাহ দিয়ে বলে,’খুব খুব খুব সুন্দর হচ্ছে বাচ্চারা।’
আরহাম সেই হাসিমাখা মুখটা প্রাণ ভরে দেখে।বিরক্তিকর প্রোগ্রামে একটা ইন্টারেস্টিং আর সুন্দর ব্যাপার হচ্ছে নবনীতার ভেতরকার উচ্ছ্বসিত আর কিশোরী স্বত্তাটির বহিঃপ্রকাশ।আরহাম সেই চমৎকার দৃশ্য মন ভরে দেখে।পরিবারের দায়িত্বে মুর্ছা যাওয়া মেয়েটির কি সত্যিই কোনো শখ আহ্লাদ ছিলো না?নাকি পরিস্থিতির চাপে সে কোনোদিন নিজের শখ প্রকাশই করতে পারেনি?এই যে কাঠখোট্টা নবনীতার আড়াল থেকে ইদানিং একটা কিশোরী নবনীতা উঁকি দিচ্ছে।এই নবনীতার তো অনেক অনেক শখ আছে।সে শখ করে,জেদ ধরে,আহ্লাদ করে।আরহাম তাকে কেমন করে বোঝায় তার এই দুরন্ত নবনীতাকে কতোখানি ভালোলাগে!
দুই তিনটা নাচ হওয়ার পরেই আরহাম খেয়াল করল নবনীতার মুখটা আচমকাই মলিন হয়ে গেছে।সে তার মলিন দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাতেই দেখল নবনীতার কিছু কলিগ বড়ো একটা জাম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে।তাদের একজন ইশারায় নবনীতাকে ডাকল।হাত নেড়ে বলল,’এসো না।’
নবনীতা অসহায় মুখ করে ডানে বায়ে মাথা নাড়ায়।মুখ না খুলেই আচরণে বোঝায় সে যেতে পারবে না।তারপরেও কি একটা ভেবে আবারো পাশ ফিরে কাচুমাচু হয়ে বলে,’আমি একটু যাই আরহাম?এটা তো আমার স্কুল।আমারও তো যেতে ইচ্ছে হয়।’
আরহাম গম্ভীর মুখে সামনে দেখতে দেখতে উত্তর দেয়,’ভীড় দেখছ?কতো রকম মানুষ চারদিকে।সিকিউরিটি লেভেল একদমই লো।কোনো সেফটি নাই।’
‘আমি তো দূরে যাচ্ছি না।এই সামনেই।মৌরি আর রাত্রির কাছে।’
‘প্রয়োজন নেই।চুপচাপ বসে থাকো।’
নবনীতা থম মেরে চুপচাপ বসে থাকে।মুখ দিয়ে আর কোনো শব্দ বের করে না।ক্ষণিক বাদে আরহাম তার হাতের উপর নিজের হাত রাখল।নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে হাত সরিয়ে নেয়।মৃদু ধমক দিয়ে বলে,’ধরবেন না।ভালো লাগছে না।’
আরো দশ মিনিট যেতেই আরহাম গাঢ় স্বরে ডাকে,’পরী!’
নবনীতা গট গট করে উত্তর দেয়,’কি?’
‘যেতে চাইছো কলিগদের কাছে?’
সাথে সাথে পাশ ফিরে নবনীতা।জ্বলজ্বল চোখে আরহামকে দেখেই ভীষণ চঞ্চল হয়ে বলে,’হ্যাঁ,চাই।’
‘আচ্ছা যাও।তবে জিপিএস অন রেখো।আর চোখের সামনে থেকো।’
মুহূর্তেই চোখ মুখ আনন্দে ভরে উঠে নবনীতার।তার ঠোঁটে প্রশস্ত হাসির দেখা মেলে,যেই হাসিতে আকাশ সমান কৃতজ্ঞতা মিশে আছে।নবনীতা খুশিতে আত্মহারা হয়ে আরহামের একহাত চেপে ধরে।সুমিষ্ট কন্ঠে বলে উঠে,’আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।সত্যিই ধন্যবাদ।’
সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায়।ছুটে যেতে চায় তার কলিগদের কাছে,তার স্টুডেন্টদের কাছে।এই ভীড়ভাট্টার মাঝে সেও মিশে যাবে।তার এমন জীবনই ভালো লাগে।একটু সামনে যেতেই আরহাম তাকে পিছু ডাকে।নিরেট স্বরে শান্ত মুখ করে বলে,’বেশি দূরে যেও না পরী।এসব ফাংশন আমার কাছে সুবিধার লাগে না।’
সে পেছন ফিরল।দ্রুত মাথা নেড়ে আশ্বাস দিলো,’অবশ্যই অবশ্যই।এখানেই আছি।’
সে চলে যেতেই আরহাম ঘাড় ঘুরিয়ে তার দেহরক্ষীদের দেখল।আসাদ নামের একজন কে উদ্দেশ্য করে খানিকটা আদেশের সুরে বলল,’যাও তো আসাদ।তোমার ম্যাডামের আশেপাশে থাকো।সামনে যেও না।এমন ভাবে পাহারা দিবো যেন সে টের না পায়।’
আসাদ মাথা নেড়ে তৎক্ষনাৎ চলে গেল সামনের দিকে।আরহাম পায়ের উপর পা তুলে চোখের উপরের সানগ্লাসটা খুলে একবার জহুরি চোখে আশপাশ দেখে।ভেতরটা খচখচ করছে।এতো অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে কেন?চারদিকে এতো ভীড়।অথচ আরহামের মনে হচ্ছে আশপাশে কেমন অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য ভাব।এমন দোলাচলে কেন ভুগছে সে?এমন অস্বস্তি হচ্ছে কেন তার?
হালকা নীল রঙের সিল্কের শাড়িটার আঁচল সামলে নবনীতা ছুটে যায় তার কলিগদের কাছে।মৌরি তাকে দেখেই টিপ্পনী কেটে বলল,’বাবারে! বর তো একেবারে চোখে হারায় নবনী।সুন্দরী মেয়েদেরই কপাল।বর সারাদিন বউ বউ করে।’
নবনীতা লাজুক হাসল।বাধা দিয়ে বলল,’ধ্যাত।এমন কিছু না।’
নবনীতা তার কলিগদের সাথে বেশ কিছু ছবি তুলল।তার ক্লাসের বাচ্চারাও তাকে দেখে ছুটে এসেছে।সে নিচু হয়ে তাদের সবাইকে একে একে জড়িয়ে ধরল।দূর থেকে এক জোড়া চোখ শান্ত চাহনিতে বারংবার তাকে দেখে।তার ঠোঁট,তার হাসি,তার প্রাণবন্ত ভাব সবকিছুই তাকে মুগ্ধ করে।এই মেয়েটির প্রতি সে বাড়াবাড়ি রকমের টান অনুভব করে।দিন কে দিন সেই টান সমস্ত মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।
হঠাৎই একটা ছেলে বাচ্চা ছুটে এলো আরহামের দিকে।তার হাতে একটা টকটকে লাল সতেজ গোলাপ।সে সেটা আরহামের দিকে বাড়িয়ে দেয়।ফোকলা দাঁত বের করে হেসে হেসে বলে,’দিস ইজ ফর ইউ।’
আরহাম চোখের উপর থেকে সানগ্লাস সরিয়ে তাকে দেখে।একহাত দিয়ে বাচ্চাটি কে কাছে এনে তার হাতের ফুলটি নেড়ে চেড়ে দেখে।ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিহান হয়ে বলে,’ফর মি?বাট হোয়াই?’
‘বিকজ ইউ আর লুকিং গ্রেট।আমিও বড় হয়ে তোমার মতো হতে চাই।’
আরহাম তার কথা শুনেই হাসল।এই বাচ্চাটি কে তার পছন্দ হয়েছে।শুধু এই বাচ্চা না,যারাই তার প্রশংসা করে,তাদের সবাই কেই আরহামের ভালো লাগে।কি অদ্ভুত! প্রশংসা জিনিসটা এতো মজার কেন?মন চায় কানের কাছে সারাদিন কেউ গান গেয়ে গেয়ে প্রশংসা করুক।আর আরহাম আরাম করে সেসব শুনবে।
সে তার চুলগুলো সেট করতে করতে বলল,’আমার ফুল লাগবে না চ্যাম্প।তুমি বরং এটা আমার হোম মিনিস্টার কে দিয়ে আসো।’
ছেলেটা জিজ্ঞাসু চোখে খানিকটা কৌতূহলী হয়ে তার দিকে তাকায়।আরহাম তাকে কাছে এনে তার কাঁধ জড়িয়ে একহাত সামনে তুলে তর্জনী আঙুল নবনীতার দিকে তাক করে বলল,’ঐ যে তোমার নবনী মিস কে দেখছ না?এই ফুলটা তাকে দিয়ে আসো।দিয়ে বলবে তিড়িংবিড়িং কম করতে।ঠিক আছে?’
ছেলেটা তার কথা এক মনে শুনল।সে বলা শেষ করতেই সে ছুটে গেল নবনীতার দিকে।নবনীতার একেবারে কাছাকাছি এসেই সে হাঁপাতে হাঁপাতে বাচ্চা বাচ্চা গলায় বলল,’মিস।দিস ইজ ফর ইউ।’
বলতে বলতেই সে হাতের ফুলটা নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দেয়।নবনীতা মাথা নামিয়ে তাকে দেখে।তার হাতের ফুলটা দেখতেই সে হাঁটু গেড়ে বসে।ফুলের ডালটায় এক আঙুল ছুঁয়িয়ে তার দিকে দেখে হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রশ্ন করে,’আমার জন্য এই সুন্দর ফুল?’
‘হু’
সতেজ আর পরিপূর্ণ ভাবে প্রস্ফুটিত রক্তিম গোলাপটি নবনীতা সাদরে গ্রহণ করল।টেনে টেনে দু’বার ঘ্রাণ নিল।খুশি হয়ে বলল,’ধন্যবাদ সোনা।মিস ভীষণ খুশি হয়েছি।’
ছেলেটা কয়েক পল তাকে দেখেই আধো আধো বুলিতে বলল,’তিলিংবিলিং কম করবে তুমি।কেমন?’
নবনীতার কিছুক্ষণ লাগল তার কথা বুঝতে।বোঝার পরেই সে খিলখিল করে হেসে উঠল।বলল,’তাই নাকি?এ কথা কে বলেছে?মহামান্য এমপি মহাশয়?’
বাচ্চাটা আঙুল তুলে আরহামকে দেখায় যে কিনা পায়ের উপর পা তুলে অনেক্ষন যাবত তাদের দিকেই দেখছিল।নবনীতা ফুলটা মুখের কাছাকাছি এনে মুচকি হেসে আরহামকে দেখে।দেখেই লাজুক হাসে।আরহাম প্রগাঢ় চাহনি তে সেই হাসি উপভোগ করে।বিনিময়ে সেও মুচকি হাসে।আড়চোখে একবার আসাদের অবস্থান দেখে।আসাদ তাকে ইশারায় আশ্বস্ত করে।অথচ আরহাম আশ্বস্ত হতে পারে না।একজন তাকে পাল্টা জবাব দিবে বলে তার ধারণা।ধারণা না,অবশ্যই দিবে।অথচ এতো দিনেও তার দলের কর্মীদের গায়ে একটা আঁচড়ও পড়েনি।এটা কেমন করে সম্ভব?এতো নির্লিপ্ততা তো প্রকাশ্য আক্রমণের চেয়েও বেশি আতঙ্কের।আরহাম এক মাসের উপরে সেই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।ভালো জিনিসেও ইদানিং তার সন্দেহ হয়।
.
.
.
.
মৌরি ছবি তোলা শেষে সাবলীল গলায় বলল,’চলো আমরা ট্রায়াল রুমে যাই।বাচ্চারা কেমন সেজেছে একটু দেখে আসি।’
নবনীতা বিব্রত হয়ে এদিক ওদিক দেখে।বিষন্ন হয়ে বলে,’না না।আমি যাব না মৌরি।তোমরা যাও।’
রাত্রি তার একহাত চেপে জোর গলায় বলল,’কেন যাবে না হ্যাঁ?বাচ্চারা তাদের নবনী মিস কে কতো পছন্দ করে! তুমি তাদের দেখবে না?অতো বরের চিন্তা করতে হবে না।একদিন একটু বরের চোখের আড়াল হলে কিছু হবে না।চলো তো।’
বলেই সে নবনীতার একহাত ধরে টানতে টানতে তাকে ট্রায়াল রুমের দিকে নিয়ে গেল।নবনীতা যেতে যেতে অপ্রস্তুত হয়ে একবার আরহামের দিকে তাকায়।আরহাম এখনো তাকে দেখেনি।সে কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত।
ট্রায়াল রুমে এসেই নবনীতা চোখ মেলে ছোট ছোট বাচ্চাদের দেখে।একেকজন কি সুন্দর সুন্দর জামা পরেছে! সুপারম্যান,স্পাইডারম্যান,ম্যাজিশিয়ান আরো কতো কিছু।নবনীতা এদের সবার সাথে দুষ্টুমি করল।বসে বসে সবাইকে আদর দিলো।বিনিময়ে তার ব্যাগ আবারো চকলেটে ভরে গেল।বাচ্চারা যে তাকে কি বুঝে এতো চকলেট দেয় কে জানে!
যেমন খুশি তেমন সাজো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে।প্রতিযোগিতারা একে একে করে ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়ে মঞ্চে গিয়ে তাদের অভিনয় প্রদর্শন করছে।এমনই সময় ট্রায়াল রুমে একটি বাচ্চা মৃদু শব্দে কেঁদে উঠে।
নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে।জানতে চায় কি হয়েছে সোনা?বাচ্চাটা মন খারাপ করে বলল,’আমার ম্যাজিশিয়ান হ্যাট বাড়িতেই রেখে এসেছি মিস।’
নবনীতা উদাস মুখ করে বলে,’আয়হায়।এখন কি হবে তাহলে?’
মৌরি অন্য আরেকটা বাচ্চার গালে কিছু একটা আঁকছিল।সে আঁকার ফাঁকেই বলল,’আরে ইনডোরে যে বাচ্চাদের প্লে জোন আছে,তার পাশেই তো একটা রুম আছে।কতো রকমের কস্টিউম আছে সেখানে।ম্যাজিশিয়ান হ্যাট তো সেখানেই পাওয়া যাবে।’
নবনীতা একগাল হেসে আঁচল সামলাতে সামলাতে বাচ্চা টা কে দেখে বলল,’এক্ষুনি নিয়ে আসছি।’
সে ট্রায়াল রুম থেকে বেরিয়ে দ্রুত পা বাড়ায় ইনডোরের দিকে।পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাকে হ্যাট আনতে হবে।
আসাদ অতি গোপনে তার পিছু পিছু আসে।সে যেন টের না পায় অতোখানি দূরত্ব নিয়েই দাঁড়ায়।নবনীতা চঞ্চল পায়ে হেঁটে ইনডোরে প্রবেশ করল।আসাদ দাঁড়ালো গেট থেকে সামান্য ভিতরে।এই জায়গা টা একদম ফাঁকা।মানুষ সব মাঠে।এদিকে কেউ নেই।মিউজিক প্লেয়ারে উচ্চশব্দে গান বাজছে।এদিকের কোনো শব্দ সেখানে পৌঁছানোর উপায় নেই।
এক জোড়া চোখ বহু সময় ধরে এই মোক্ষম সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।অপেক্ষায় ছিল এমন একটি নিরব নিস্তব্ধ আর যুতসই সময়ের।একদিন দুইদিনের অপেক্ষা না,প্রায় মাসখানেকের অপেক্ষা।এতোদিনে সে সুযোগ পেয়েছে।
সে এগিয়ে যায় নিঃশব্দে। শক্তিতে সে আসাদের সাথে পারবে না।পারতে চায়ও না।সে তাকে বধ করবে বুদ্ধিতে।আসাদের পেছনে যেতেই সে তার গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ল।আসাদ পেছন ফিরে পরিস্থিতি টের পাওয়ার আগেই সে পর পর তিনবার আসাদের চোখ বরাবর ছু’রি চালাল।বুকে কিংবা শরীরের অন্য কোথাও চালালে এতো সহজে তাকে হারানো যেত না।চোখ সবচেয়ে নাজুক জায়গা।মাথায় আ’ঘাত করার জন্য গায়ের জোর লাগে,অ’স্ত্রও ভীষণ ধাঁরালো হতে হয়।সবচেয়ে সহজ হয় চোখে আ’ঘাত করা।এক আ’ঘাতেই কুপোকাত।সে আঘাত করেই দুই হাতে শক্ত করে তার মুখ চেপে ধরে।আসাদ বিস্ফারিত চোখে তাকে দেখে।শক্তপোক্ত বলিষ্ঠ শরীরটা সদ্য জ’বা’ই’কৃ’ত মুরগির মতো ছটফট করে কতোক্ষণ।মুখ ফুটে কিছু একটা বলতে চায়।
ফাহাদ চোখ মুখ খিঁচে তার মুখটা চেপে রাখে।হঠাৎই তার দৃষ্টি যায় সামনে।দেখতে পায় তার চেয়ে কয়েক হাত দূরে একটি নারী অবয়ব দাঁড়িয়ে আছে।যার চোখে মুখে চূড়ান্ত মাত্রার বিস্ময়।যে বুঝতে পারছে না এসব কি হচ্ছে।ফাহাদ র’ক্তিম চোখে তাকে দেখল।
নবনীতা দুই হাতে টুপি টা হাতে চেপেই আতঙ্কিত হয়ে দুই পা পেছায়।তার হাত কাঁপছে থরথর করে।একটু আগে যে দৃশ্য সে দেখেছে,এটা দেখার পর কোনো মানুষের পক্ষে সুস্থ থাকা সম্ভব না।একজোড়া আতঙ্কিত চোখের সাথে এক জোড়া হিংস্র চোখের দৃষ্টি বিনিময় হয়।মুখ ঢাকা অবস্থাতেও নবনীতা সেই চোখের মালিককে অনায়াসে চিনে নেয়।এই তো প্রথম না।আগেও তো সে এমন অবস্থায় তাকে দেখছে।
বরফের মতো জমে যাওয়া শরীরটা আচমকা নড়েচড়ে উঠে।টের পায় আসাদের পর ফাহাদের পরবর্তী শিকার সে নিজেই।মস্তিষ্ক সচল হতেই সে এক চিৎকার দিয়ে ছুটে পালায়।এই দম বন্ধকর মুহূর্তে তার সব কিছু গুলিয়ে যাচ্ছে।সে ছুটতে ছুটতে ব্যাকুল হয়ে চেঁচায়,’আল্লাহ বাঁচাও।’
ফাহাদ তক্ষুনি আসাদ কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।উল্কাবেগে ছুটে যায় করিডোরের দিকে।তার হাতের ছু’রি টা তখনো র’ক্তরঞ্জি’ত।সেই ছু’রি থেকে চুয়ে চুয়ে রক্ত ঝরছে।এখনো তার আসল শিকার বাকি।
আসাদ তখন যন্ত্রণায় কাতরে কাতরে ছটফটাচ্ছিল।ঘন ঘন নিশ্বাসে তার শ্বাসরোধ হয়ে আসছিল।কিন্তু দায়িত্ব পালনে সে সর্বদা তৎপর।জীবনের শেষ সময়েও আসাদ নিজের দায়িত্ব পালন করল।সে তার কোমরে গুজে রাখা ওয়াকিটকি তে আন্দাজে হাত দিলো।হাতড়ে হাতড়েই সাইরেন বাজিয়ে বাকি সদস্যদের এলার্ট করল।তার কিছুক্ষণ পরেই তার কাপঁতে থাকা শরীরটা চিরতরের মতো শান্ত হয়ে গেল।আসাদ তার ইহজীবনের সমাপ্তি ঘটালো দায়িত্বপালন রত অবস্থায়।
আরহাম আচমকাই লক্ষ্য করল আশে পাশে কোথাও নবনীতার অস্তিত্ব নেই।চারদিক দেখেই সে তড়াক তরে উঠে দাঁড়ায়।ব্যস্ত হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।পেছন ফিরে গার্ডদের দেখে হম্বিতম্বি করে বলল,’আসাদ কে বলো তো তোমাদের ম্যাডাম যেখানেই আছে,তাকে আমার কাছে নিয়ে আসতে।’
তার কথা ঠিক মতো শেষ হওয়ার আগেই একজন তীব্র উৎকন্ঠায় চেঁচিয়ে উঠে বলল,’স্যার! আসাদ তার ওয়াকিটকি থেকে রেড সিগন্যাল পাঠাচ্ছে।’
আরহাম রুদ্ধশ্বাস কন্ঠে চেঁচিয়ে ওঠল,’রেড সিগনাল মানে?সে কোথায়?পরী কোথায়?এক্ষুনি তার লোকেশন ট্রেস করো।’
বলে সে আর অপেক্ষা করে না।অনুষ্ঠানের মাঝপথেই সবকিছু ছেড়ে এক দৌঁড়ে ছুটে যায় মাঠের অন্যদিকে।যেই আতঙ্কে ভেতরটা শুরু থেকে অস্থির হয়েছিল,সেই আতঙ্কই সত্যি হয়েছে।আরহাম নিশ্বাস বন্ধ করে ছুটে যায় ক্লাসরুমের বিল্ডিং গুলোর দিকে।দরদর করে ঘামতে থাকা শরীরটা অস্থির হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।ঠিক তখনই ইনডোর থেকে একটি তরুণীর গগনবিদারী আর্তচিৎকার তার কর্ণগোচর হয়।এক আওয়াজেই আরহাম থমকায়।শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে যায় হিমশীতল ধারা।তার নিস্তব্ধতার মাঝেই তরুণীটি পুনরায় চেঁচায়।বরাবরের মতোই প্রতিটা চিৎকারে সে খুঁজে যায় নিজের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটিকে।মানুষটি তার জন্মদাতা,মানুষটি সেই মেয়েটির বাবা।
চলবে-