কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩১

0
16

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩১)
[রিচেক দিতে পারিনি]

নবনীতা একমনে স্টুডেন্টদের এসাইনমেন্ট চেক করছিল।খাতা দেখার সময় সে চোখে চশমা ব্যবহার করে।সে একটা এসাইনমেন্ট দেখা শেষ করে অন্য একটা এসাইনমেন্টে হাত দেয়।

আজ তার বিবাহিত জীবনের আটত্রিশ দিন পূর্ণ হয়েছে।আটত্রিশ দিনে আটত্রিশ রকমের ঘটনা ঘটেছে।ভালো বিষয় হচ্ছে এই দিনগুলোতে তাদের সম্পর্কটা সহজ হয়েছে।বিয়ের সময় যেই বাজে সমীকরণের মাঝে তারা আটকে ছিল,সেই সমীকরণে কিছু পরিবর্তন এসেছে।নবনীতার ইদানিং মনে হয় আরহাম মানুষটা অতোটাও মন্দ না।কিছু গোড়ামি আছে,কিছু একরোখা আচরণ সে প্রায়শই করে।তবে সব মিলিয়ে এতোটাও খারাপ না।

ফার্স্ট ইম্প্রেশন কে মাঝে মাঝেই বেস্ট ইম্প্রেশন বলে ধরা হয়।অর্থাৎ তুমি প্রথম দেখায় যাকে পছন্দ করবে,তাকে তোমার আজীবন ভালো লাগবে।আর প্রথম দেখায় তোমার যাকে ভালো লাগবে না,গোটা জীবনেও তুমি তার প্রতি ভালো লাগা আনতে পারবে না।নবনীতা আজকাল রাত দিন হন্য হয়ে এই প্রবাদের মালিক কে খুঁজে।সামনে পেলে ঠাটিয়ে দু’টো দিত।একেবারে ভিত্তিহীন একটা প্রবাদ,যার কোনো সত্যতা নেই।আরহামকে তার প্রথম দেখায় স্রেফ একটা ক্ষমতা লিপ্সু আর দাম্ভিক মানুষ মনে হয়েছিল।তারপর সময়ের পরিক্রমায় সে একটা নতুন আরহামকে চিনেছে।যেই আরহামকে এক শব্দে দাম্ভিক কিংবা ক্ষমতা লিপ্সু বলেই নবনীতা পাশ কাটিয়ে দিতে পারে না।আরহামের আড়ালে আরেকটা আরহাম আছে।বিয়ের পর সেই আরহামের সাথে নবনীতার পরিচয় হচ্ছে।পরিচয় হওয়ার পর থেকেই মনের মাঝে একটা কথাই বাজে-‘নাহ,লোকটা এতোও খারাপ না’

তার কিছু গোড়ামি আছে।নবনীতার ব্যক্তি স্বাধীনতায় মাঝে মাঝেই সে হস্তক্ষেপ করে ফেলে।সেদিনও সে বাড়াবাড়ি করেছে।কিন্তু সবচেয়ে চমৎকার দিক সে নিজ থেকে এসে নিজের মেল ইগো কে পাশে সরিয়ে সরি বলতে শিখেছে।বাড়াবাড়ি করার পর সেটার জন্য ক্ষমা চাওয়াটা শাহরিয়ার আরহামের চরিত্রের নতুন একটি দিক।সারাক্ষণ নবনীতাকে ট্র্যাক করা,প্রতি মুহূর্তে ফোন দিয়ে আপডেট রাখা,স্কুল বাদে বাড়ির বাইরে বের হতে না দেওয়া,প্রতিটা বিষয়ে তার উপর পুরুষালী শাসন কায়েম করা-এই সবকিছুর ঊর্ধ্বে সে সম্পূর্ণ অন্যরকম একটি আরহাম কে খুঁজে পায়।যে আরহাম প্রাণপণ এই সংসার টা টিকিয়ে রাখতে চায়।আরহামের চোখে সে এই সম্পর্কের জন্য টান দেখতে পায়।সেই চোখে নবনীতা একটা অদ্ভুত ব্যাকুলতা খুঁজে পায়।ঐ দিনশেষে তার একটা কথাই মনে হয়-ছেলেটা এতোটাও পাষন্ড না।বরং অনায়াসে ঘর করার মতো।

নবনীতা আনমনে এসাইনমেন্টের উপর আঁকিবুঁকি করে।সামনের মাসে তাদের রিসেপশন।তারপরই নবনীতা পাকাপাকি ভাবে আরহামদের বাড়ি চলে যাবে।প্রথম প্রথম আরহাম প্রায় রোজই তার বাড়ি আসতো।ইদানিং ব্যস্ততা বেড়েছে।সপ্তাহে বড়ো জোর দুইদিন আসে।এলেও পুরো সময় ফোন নিয়ে পড়ে থাকে।অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি তার ফোনে প্রতি মিনিটে মিনিটে নতুন নতুন মানুষদের কল আসতেই থাকে।এবং এরা সবাই বড় মাপের মানুষ,বড়ো বড়ো রাজনীতিবিদ।নবনীতা উচ্চবিত্ত জীবন দেখেছে।কিন্তু রাজনৈতিক জীবন দেখেনি।বৈবাহিক সূত্রে তার সেই জীবন দেখার সুযোগও হচ্ছে।নেতাদের ডজন খানেক বিশ্বস্ত চ্যালা থাকে,যারা কথায় কথায় কোনোকিছু না বুঝেই সহমত ভাই সহমত ভাই করে চেঁচায়।ভাই যদি বলে সূর্য দক্ষিণ ওঠে,এতেও এরা গড্ডালিকা প্রবাহের ন্যায় সেটাই বিশ্বাস করে নেয়।নেতাদের একজন পিএ থাকে।যেকোনো সাধারণ মানুষ চাইলেই নেতা পর্যন্ত যেতে পারে না।আগে পিএ’র সাথে আলোচনা করে এপয়নমেন্ট নিতে হয়।তারপর গিয়ে ভাগ্য ভালো হলে নেতারা একটু দেখা দেয়।

নবনীতা এসাইনমেন্ট দেখার ফাঁকেই মিষ্টি করে হাসে।বাচ্চাগুলো যে মাঝে মাঝে কি করে! সেদিন চিত্রার সাথে ঝগড়া করতে গিয়ে সে আরহাম কে জড়িয়ে ধরেছে।তাও একেবারে দুই হাতে শক্ত করে।বিষয়টা সে টের পেয়েছে যখন আরহামও তাকে বিনিময়ে তারই মতো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে।টের পেতেই তার সমস্ত শরীর হিম হয়ে আসল।সে পাথরের মূর্তির মতো কতোক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।না সরতে পারছিল,না কিছু বলতে পারছিল।

আবার সেদিন বিভার সাথে দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে গিয়ে নবনীতা হোঁচট খেয়ে সোজা আরহামের গায়ে গিয়ে পড়েছে।বিভা তো এক দৌঁড়ে অন্য ঘরে চলে গেছে।কিন্তু নবনীতা তো বাঁধা পড়ে গেছে আরেক জায়গায়।আরহাম মোবাইলের স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে তাকে দেখল।এক হাত নবনীতার পিঠে রেখে জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,’কি চাই?’

নবনীতা উঠতে গিয়েও উঠতে পারল না।কেবল মিনমিনে স্বরে উত্তর দিলো,’কিছু না।হোঁচট খেয়েছি।’

আরহাম আর কিছু বলার আগেই ঘরের বাইরে শুভ্রার গলার আওয়াজ পেতেই নবনীতা ছিঁটকে দূরে সরে এলো।আরহাম বিক্ষিপ্ত মেজাজে মনে মনে কতোক্ষণ গালমন্দ করল।কাকে গালি দিয়েছে সে নিজেও জানে না।

সারাদিন বাড়িতে শতরকমের ঘটনা ঘটে।আর স্কুলে আসলেই নবনীতার একটার পর একটা ঘটনা মনে পড়ে।সেগুলো ভেবেই সে দিনভর মুচকি হাসে।সহকর্মীরা গোল গোল চোখ করে তাকে দেখে।নতুন নতুন বিয়ে হয়েছে তার,স্বামী এমপি।টাকা পয়সার অভাব নাই।সে সুখে থাকবে না তো কে থাকবে?সে মুচকি হাসবে না তো কে হাসবে?

স্কুলের হেড টিচারের নাম ডেইজি।তিনি ক্লাসটাইম শেষ হতেই নবনীতার কাছে আসলেন।ঠিক নবনীতার পাশাপাশি চেয়ারে গিয়ে বসলেন।নবনীতা কিছুটা চমকায়।বিচলিত হয়ে জানতে চায়,’কিছু বলবেন ম্যাম?’

মিসেস ডেইজি কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে ভীষণ বিনয়ী ভঙ্গিতে বললেন,’আসলে নবনী,তোমাকে একটা কথা বলার ছিল।’

নবনীতা হাতের কলম টা ডেস্কের উপর ফেলে সরাসরি মিসেস ডেইজির চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,’জ্বী ম্যাম বলুন না?’

‘আসলে সামনের সপ্তাহে তো আমাদের স্কুলে কালচারাল প্রোগ্রাম।বাচ্চাগুলো খুব এক্সাইটেড।আমরা চাচ্ছি প্রোগ্রামটা বেশ জাকজমক করে সেলিব্রেট করতে।এজন্য আমরা আরহাম স্যার,মানে আপনার হাসবেন্ড কে গেস্ট হিসেবে ইনভাইট করতে চাই।স্যার তো এতো নরমাল কোনো ফাংশন এটেন্ড করেন না জানি।কিন্তু আপনি যদি একটু বলেন তাহলে নিশ্চয়ই উনি সেটা ফেলতে পারবেন না।আপনি কি আরহাম স্যারকে একবার বলবেন?খুব বেশি সময় নষ্ট করব না তার।এই ধরুন ঘন্টা খানেক মতো।প্লিজ নবনী,মানা করবেন না।’

নবনীতা অপ্রস্তুত হয়ে তার দিকে তাকায়।গালের নিচে হাত রেখে বিচলিত হয়ে বলে,’আমি বলব উনাকে?’

‘জ্বী।স্যার আপনার কথা ফেলতে পারবেন না।’

নবনীতা নিজ মনে উত্তর দেয়,’স্যার কবে আমার কথা শুনেছে?সে তো নিজের মর্জির মালিক।আমি বললেই কি?’

সে ভদ্রতার খাতিরে স্মিত হেসে উসখুস করতে করতে জবাব দেয়,’জ্বী আচ্ছা।আমি বলে দেখব।’

‘কথা দিচ্ছেন তো?আমি তাহলে আজ রাতেই উনার কাছে ইনভাইটেশন নিয়ে যাবো।’

‘না না।আজ না।আমি আগে উনার সাথে কথা বলি।তারপর আপনাকে জানাব।তখন যাবেন প্লিজ।’ ভীষণ তাড়াহুড়ো করে উত্তর দেয় নবনী।

মিসেস ডেইজি আর দিরুক্তি করলেন না।সে যখন আশ্বাস দিয়েছে তখন নিশ্চয়ই কোনো একটা ব্যবস্থা হবে।মিসেস ডেইজির সাথে আরো কিছুক্ষণ কথা শেষে নবনীতা তার ভ্যানিটি ব্যাগটা হাতে নিয়ে সবকিছু গোছগাছ করে টিচার্স রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

গেইটের কাছে আসতেই তার ব্যাগে থাকা মোবাইল ফোনটি যান্ত্রিক শব্দে বেজে উঠল।নবনীতা তাড়াহুড়ো করে সেটা হাতে নেয়।আরহাম ফোন দিয়েছে।হাত ঘড়িতে সময় দেখতেই সে বুঝল আজ সে মিনিট দশেক দেরি করেছে।ফোন রিসিভ করে কিছু বলার আগেই অন্য পাশ থেকে কড়া গলায় প্রশ্ন এলো,’কোথায় তুমি?এখনো গাড়িতে উঠো নি কেন?’

নবনীতা আরো এক দফা বিরক্ত হয়।আরহাম যতোই চেষ্টা করুক,তার বচনভঙ্গিতে ভয়াবহ রকমের সমস্যা আছে।ভালো কথাও সে মেজাজ দেখিয়ে বলে।নবনীতা শান্ত হয়ে জবাব দেয়,’মাত্র বেরিয়েছি।স্কুল গেইটের সামনে।’

‘ওহহ আচ্ছা।’ গমগমে স্বরে প্রতিউত্তর করে সে।

নবনীতা গাড়িতে উঠে পুনরায় তাকে ফোন দিলো।আরহাম ফোনটা কানে চেপেই যথাসাধ্য নরম গলায় বলল,’বলো পরী।’

নবনীতা বিচলিত আর দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।একটু একটু লজ্জাও হচ্ছে তার।শেষে লজ্জা শরম সব একদিকে সরিয়ে সে জানতে চায়,’আপনি আজ বাড়ি আসবেন না?’

অন্যপাশে পিনপতন নিরবতা।সেই নিরবতায় নবনীতার অস্বস্তি আরো বহুগুন বেড়ে যায়।প্রায় মিনিট খানেক পরে মুঠোফোনের অপরপ্রান্ত থেকে হিম শীতল কন্ঠে জবাব আসে,’আসছি।একটু পরেই আসছি।’

নবনীতা সাথে সাথে ফোন কেটে দেয়।কোলের উপর থাকা দুই হাত আচ্ছা মতো কচলায়।আরহাম তাকে কি ভাবছে কে জানে! সে নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দেয়,এতো ভাবার কি আছে?আরহামও তো হুটহাট তার বাড়ি চলে আসতো।সে তো কখনো লজ্জা পেত না।নবনীতা কেন পাবে?

***

আরহাম এসেছে দুপুর দুইটার দিকে।আজ দরজা খুলেছে শুভ্রা।আরহাম তাকে দেখেই চমকে উঠে বলল,’কি ব্যাপার?তুমি আজ বাসায়।কোচিং-এ যাও নি?’

শুভ্রা মাথা নেড়ে জবাব দেয়,’না ভাইয়া।আজ বন্ধ।’

‘ওহহ আচ্ছা।’
আরহাম এদিক সেদিক তাকায়।ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চায়,’তোমার আপাই কোথায়?’

শুভ্রা রান্নাঘরের দিকে আঙুল তুলে বলল,’আপাই রান্নাঘরে।আপনার জন্য রান্না করছে।’

আরহাম চোখ বড় বড় করে বলল,’বলো কি?রান্না করছে আমার জন্য?আমার তো লক্ষ্মণ ভালো ঠেকছে না।’

শুভ্রা জবাবে কেবল মুচকি হাসল।আরহাম একহাত পাঞ্জাবির পকেটে রেখে উৎসুক হয়ে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়।ভেতরে উঁকি দিতেই দেখে চারদিকে শুধু ধোঁয়া।এর মাঝে নবনীতার পিঠ আর হাত সামান্য দেখা যাচ্ছে।আরহাম মুখের সামনে হাত নাড়তে নাড়তে বলল,’হেই সেনোরিটা! মে আই কাম ইন?’

নবনীতা ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকায়।দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,’ইয়েস।ইউ ক্যান।’

আরহাম দ্রুত ভেতরে এলো।হাত নাড়তে নাড়তে বলল,’রাধছো টা কি?ধোঁয়া তে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না।’

নবনীতা একহাতে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,’বাটার চিকেন।কিন্তু ধোঁয়া হয়েছে অন্য কারণে।আমি শুরুতে একটা ভুল করে ফেলেছিলাম।’

আরহাম আতঙ্কিত হয়ে বলল,’এ খাবার খাবে কে?’

নবনীতা অবাক হয়ে বলল,’খাবে কে মানে?আপনি খাবেন।আর কে?’

আরহাম এক হাত বুকে চাপে।আঁতকে উঠে বলে,’কি সর্বনাশ! মরে টরে যাব নাকি?চেহারা দেখে তো সুবিধার মনে হচ্ছে না।’

নবনীতা কটমট চোখে একবার সেদিকে তাকায়।আরহাম সেই চাহনির তোয়াক্কা না করে বলল,’এতো চোখ রাঙিয়ে লাভ নাই।আগে তুমি খাবে।দশ মিনিট পরেও যদি না মরো,তাহলে আমিও খাবো।বুঝেছ?’

____

নবনীতার বানানো বাটার চিকেন খুব একটা বাজে হয়নি।আরহাম মুখে দিয়েই প্রসন্ন হেসে বলল,’নট ব্যাড পরী।ভালোই হয়েছে।’

নবনীতা মুখ বাঁকা করে বলল,’মানলাম রান্না কম পারি।তাই বলে এতোও খারাপ না আমার রান্নার হাত।আর কয়েকবার ট্রাই করলেই হয়ে যাবে।’

আরহাম সম্মতিসূচক মাথা নাড়ল।চিত্রা খাওয়া শেষেই ঘুম দিয়েছে।শুভ্রা বসেছে পড়ার টেবিলে।তার টেস্ট পরীক্ষা শুরু হবে কিছুদিন পর।পড়তে যদিও তার ভালো লাগে না খুব একটা।তবুও সে পড়ছে।সে জীবনে কিছু একটা হতে চায়।সে তার আপাইকে গর্বিত অনুভব করাতে চায়।

নবনীতা সবকিছু গুছিয়ে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে তার ঘরে এলো।আরহাম তখন বারান্দায়।বরাবরেই মতোই তার কানে ফোন।সে ফোনালাপে ব্যস্ত।নবনীতা ঢিলেঢালা খোপা টা খুলে আবার শক্ত করে সেটা বাঁধলো।আরহাম কথা শেষে ফোন কেটে বারান্দা থেকে বেরিয়ে এলো।

আসতেই তার চোখ যায় নবনীতার দিকে।তার পরনের শাড়িটা সেই সকালে গায়ে জড়িয়েছে সে।স্কুল থেকে ফিরে সে আর সেটা খুলেনি।সোজা রান্নাঘরে গিয়েছে দুপুরের খাবার রান্না করার জন্য।তার শাড়ি বেশ খানিকটা নড়বড়ে হয়ে পিঠ ছেড়ে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে।

আরহাম চুপচাপ এগিয়ে যায় তার দিকে।নবনীতা পেছন ফিরতেই তার সাথে থাক্কা খায়।অবাক হয়ে বলে,’কি হয়েছে?কিছু বলবেন?’

আরহাম কোনো ভণিতা কিংবা সংকোচ ছাড়াই হাত বাড়িয়ে তার কোমর চেপে তাকে নিজের একেবারে কাছাকাছি এনে দাঁড় করায়।নবনীতা ঘটনার আকস্মিকতায় ধড়ফড়িয়ে উঠে।বিস্ফারিত চোখে সামনে দেখে।আরহাম শাড়ি গলিয়ে তার কোমরে একহাত রাখল।নবনীতা ঈষৎ কেঁপে উঠে দ্রুত মাথা নামিয়ে নেয়।মন চাইছে এক ধাক্কা দিয়ে ছুটে পালাতে।কিন্তু সেটা সম্ভব না।বিয়ে হয়েছে তার।পালানোর আর কোনো উপায় নেই।

সে মনে মনে নিজেকে বোধায়,’সিন ক্রিয়েট করিস না নবনী।জামাই লাগে তোর।ধরতেই পারে,কাছে আসতেই পারে।’
সে টেনে টেনে আরো কয়েকবার শ্বাস নিয়ে মাথা নামিয়ে নেয়।হৃদস্পন্দন এতো বেশি বেড়ে গেছে যে তার মনে হচ্ছে এক্ষুনি সেটা ফেটে নবনীতা হার্ট অ্যাটাক করে ম’রে যাবে।

আরহাম অন্য হাতে তার মুখের সামনে চলে আসা ছোট ছোট চুল গুলো সরায়,আলতো করে তার ঘাড়ের পেছনে হাত রাখে।দু’জনের দূরত্ব তখন গুনে গুনে এক কিংবা দুই ইঞ্চি।নবনীতা দুই হাতে শক্ত করে তার শাড়ি খাঁ’মচে ধরে।মনে মনে নিজেকে খুব করে শা’সায়,’উল্টো পাল্টা এক্সপ্রেশন দিবি না নবনীতা।নাক ছিটকাবি না।নরমাল থাক,একদম নরমাল।বর না তোর?’

সে যথাসম্ভব চেষ্টা করে শান্ত থাকার।অথচ পালস রেট নিয়ন্ত্রণের বাইরে।আরহাম তার কপালে কপাল ঠেকিয়ে ঘোরলাগা গলায় ডাকে,’পরী!’

নবনীতা মাথা নামিয়ে চোখ মুখ খিঁচে জবাব দেয়,’জ্বী?’

আরহাম একটা শ্বাস ছেড়ে গাঢ় স্বরে বলল,’উই আর ম্যারিড ফর মোর দ্যান ওয়ান মান্থস।ডোন্ট ইউ থিংক আমাদের আরেকটু ক্লোজ হওয়া উচিত?নিজেদের প্রয়োজনে,সম্পর্কের প্রয়োজনে,সবকিছুর প্রয়োজনে?’

নবনীতা দু’টো শুকনো ঢোক গিলে।টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে বুকের ভেতরের তোলপাড় নিয়ন্ত্রণ করে।একেবারে ধিমি স্বরে জবাব দেয়,’জ্বী’

‘সেটা কখন?কবে?’

নবনীতা নিচের ঠোঁট কা’মড়ে ধরে।মনের মাঝে চলমান সকল দোলাচল একদিকে সরিয়ে সে সুমিষ্ট কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে জবাব দেয়,’আপনি যেদিন চাইবেন সেদিনই।’

আরহাম হাসল।প্রসন্ন,নির্মল আর স্বচ্ছ হাসি।সে টের পাচ্ছে তার দুই হাতে বন্দি নারী কায়া টি একটু সময় পর পরই থেমে থেমে কাঁপছে।তার সমস্ত তেজ,জেদ আর চোখ রাঙানি হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

আরহাম একপেশে হেসে তাকে ছেড়ে দিলো।এক লাফে খাটে উঠে বলল,’এই বাড়িতে এসব রোমান্স টোমান্স সম্ভব না।ঘর ভর্তি বাচ্চাকাচ্চা সারাদিন প্যা পু করে।লজ্জায় আমার মাথা কাজ করে না।তোমার বাড়ি এটা পুরাই বেবি কেয়ার হোম হয়ে যাবে ক’দিন বাদে।’

নবনীতা তার কথা শুনতেই মুচকি হাসল।তার কথার জবাব না দিয়ে ঠিক তার মুখোমুখি এসে বসল।আরহাম চোখ সরু করে বলল,’ব্যাপার কি বলো তো?লক্ষ্মণ তো ভালো না।তুমি তো এতো ভদ্র মানুষ না।’

নবনীতা সে কথা পাত্তা না দিয়ে অত্যাধিক কোমল স্বরে বলল,’আমার একটা কথা শুনবেন আরহাম?শুনেই রিজেক্ট করা যাবে না,মানতে হবে।’

****

কয়েক সেকেন্ড অপলক নবনীতাকে দেখার পর আরহাম শব্দ করে হেসে উঠল।হাসতে হাসতেই বলল,’সিরিয়াসলি পরী?’

নবনীতা থতমত খেয়ে বলল,’এভাবে হাসার কি আছে?আমি কি কোনো কৌতূক করেছি?’

আরহাম হাসি থামায়।গম্ভীর গলায় বলে,’তো হাসব না?আমি কি পাড়া মহল্লার পাতি নেতা?যে যেখানে খুশি নিয়ে যাবে,যেকোনো অনুষ্ঠানে নিয়ে বসিয়ে রাখবে?একটা ওয়েট আছে আমার।সব অনুষ্ঠানে আমি যেতে পারব না পরী।’

নবনীতা হাল ছাড়ল না।গো ধরে বলল,’প্লিজ আরহাম।এই প্রথম আর শেষবার।আর কখনো বলব না প্লিজ চলুন।সর্বোচ্চ দেড় দুই ঘন্টাই লাগবে।বেশি না।’

‘নো।নেভার।এতো জায়গায় গেলে আমার ওয়েট কমে যাবে।প্রেসটিজ ডাউন হবে।আমার একটা ব্যক্তিত্ব আছে।এই ব্যক্তিত্বের একটা ভার আছে।’

নবনীতা চটপট জবাব দেয়,’সেখানে গেলে ব্যক্তিত্ব হালকা হবে না।প্লিজ চলুন না।তারা কতো আশা করে আমার কাছে রিকুয়েষ্ট করেছে।’

‘না,পারব না।সব জায়গায় যেতে পারব না।এতো সস্তা নাকি আমি?’

নবনীতা আরেকটু এগিয়ে এসে তার দুই হাত লুফে নেয়।অনুনয় করে বলে’প্লিজ।আসুন না।বাচ্চারা খুব খুশি হবে।’

আরহাম খ্যাক করে উঠে বলল,’বাচ্চারা কেন খুশি হবে?আমি তাদের বাপ লাগি?’

নবনীতক হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।আরহাম তার মলিন মুখটা দেখেই বাঁকা হেসে বলল,’আচ্ছা যাও।যাবো আমি।কিন্তু কয়েকটা শর্ত আছে আমার।’

নবনীতার দুই চোখ খুশিতে চকমক করে উঠে।সে চঞ্চল হয়ে জানতে চায়,’কি শর্ত?’

আরহাম খাটে শুয়ে এক পায়ের উপর এক পা রেখে বলল,’শর্ত হলো তুমি আমাকে সুন্দর করে রিকুয়েষ্ট করবে।বলবে আরহাম স্যার প্লিজ আপনি চলুন।আপনি না গেলে আমার একদমই ভালো লাগবে না।আপনি প্লিজ আপনার পদধূলি ফেলে আমাদের ধন্য করুন।বলো বলো,এখনি বলো।’

নবনীতা কড়া চোখে একবার তাকে দেখে।তারপরই অত্যাধিক কোমল গলায় ন্যাকা সুরে বলে উঠে,’নেতাদের নেতা,সব নেতার বড় নেতা,মহামান্য আরহাম! আপনি প্লিজ আমাদের ছোট খাটো স্কুলের কালচারাল প্রোগ্রামে চলুন।একটু পায়ের ধুলো দিন।আমরা ধন্য থাকবো।চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।প্লিজ স্যার মানা করবেন না।’

আরহাম চোখ বড় বড় করে তার কথা শুনল।সে থামতেই জোরে জোরে হাততালি দিয়ে বলল,’চমৎকার! চমৎকার! আমি যতটুকু চেয়েছি,তার চেয়েও বেশি বলেছো।খুশি হয়েছি আমি।বলে দাও তোমার ডেইজি ম্যামকে আমি তার স্কুলের ফাংশনে আসছি।’

নবনীতা তার কথা শুনেই প্রশস্ত হাসে।যাক,সে তাকে রাজি করাতে পেরেছে।এই নিয়ে অনেক দ্বিধায় ছিল সে।আরহাম যে যেতে রাজি হয়েছে এটাই অনেক।তার আজ সারাদিনের খাটুনি স্বার্থক।

****

উত্তরবঙ্গে বন্যার তান্ডব বেড়েই চলেছে।প্রায় ছয়টি জেলার অসংখ্য গ্রাম বন্যায় তলিয়ে গেছে।অবস্থা দিনকে দিন বেগতিক হয়েই যাচ্ছে।বন্যার্তদের সহায়তায় সারাদেশে বিভিন্ন এনজিও,বিভিন্ন সংঘটন থেকে সম্মিলিত ভাবে সাহায্য তোলা হচ্ছে।

রাজনীতিতে চ্যারিটি বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ।আবেগপ্রবণ জাতির মন জয় করার জন্য লোক দেখানো দান খয়রাতের কোনো বিকল্প নেই।ব্যাপক অর্থ দান করলেই যেকোনো রাজনৈতিক নেতা জনগণের চোখের মধ্যমণি হয়ে উঠে।আরহাম এই সুযোগ হাতছাড়া করার পাত্র না।তার অর্থায়নে বন্যা কবলিত মানুষদের সহায়তার জন্য বিরাট পরিসরে ত্রাণ কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়েছে।

সে দুইদিন ধরেই এসব নিয়ে ব্যস্ত।ওয়াজিদ আগে থেকেই সোশ্যাল এক্টিভিটিজের সাথে যুক্ত।সে আর আদি সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা সশরীরে বন্যা কবলিত এলাকায় যাবে।

সন্ধ্যার পরেই ত্রাণসামগ্রী ভর্তি বড়ো বড়ো কার্টন গুলো বিশালাকার ট্রাকে তোলার ব্যবস্থা করা হলো।আরহাম সন্ধ্যার একটু পরে সেখানে গেল।গিয়েই একটা কার্টন হাতে তুলে তোফায়েল কে ডেকে বলল,’এদিকে আয় তো তোফায়েল।আমার পকেট থেকে ফোনটা বের কর।’

তোফায়েল তার কথা মতো ফোন বের করল।আরহাম একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,’আমার একটা সুন্দর ছবি তোল।দেখে যেন মনে হয় কাজ করতে করতে আমি হাঁপিয়ে গেছি।’

তোফায়েল ঠোঁট টিপে চাপা স্বরে হাসে।আরহামের নির্দেশ মতো চটপট তার কয়েকটা ছবি তুলে।রাত দশটার পরে সবার মিলিত প্রচেষ্টায় কাজ কিছুটা কমে এলো।আরহাম তার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে এসেই হাত পা ছেড়ে ইজিচেয়ারে বসল।

একটু পরে আদিও ভঙ্গুর পায়ে হেঁটে এসে তার মুখোমুখি সোফাতে বসল।হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’ওয়াজিদের এনার্জি আছে ভাই।আমি তো কয়েক কার্টন তুলেই শেষ।’

আরহাম জিজ্ঞাসু হয়ে জানতে চায়,’স্যার কি এখনো ঐদিকেই আছেন?’

‘হু।একনাগাড়ে কাজ করেই যাচ্ছে।সত্যিকারের সমাজসেবক যাকে বলে।’

পিঁক পিঁক শব্দ হচ্ছে।আরহাম হাতড়ে হাতড়ে দ্রুত পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে।নবনীতা ফোন দিয়েছে।সে ফোন রিসিভ করেই বলল,’বলো পরী।’

অন্যপাশ থেকে ব্যস্ত গলায় প্রশ্ন আসে,’বাসায় আসবেন না আজ?’

আরহাম হাসি হাসি মুখে জবাব দেয়,’এই তো আসছি।আরেকটু সময় লাগবে।’

‘ওহহ আচ্ছা।কাল কিন্তু কালচারাল প্রোগ্রাম।মনে আছে?’

‘জ্বী ম্যাডাম।মনে আছে।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।’

নবনীতা সাথে সাথেই ফোন কেটে দিলো।আরহাম ফোন রেখেই আদির দিকে তাকায়।ভাব নিয়ে বলে,’বউয়ের ফোন,বাড়ি যেতে বলছে।আর এদিকে থাকা সম্ভব না।’

আদি চোখ তুলে তাকে দেখে।মুখ খিঁচিয়ে বলে,’শা’লা চুটিয়ে সংসার করছিস তাই না?’

আরহাম মাথা নাড়ে।কলার ঠিক করতে করতে বলে,’একদম তাই।’

সে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।আরো আধ ঘন্টার মতো নিচে দাঁড়িয়ে থেকে অবশেষে তার গাড়িতে করে ধানমন্ডির উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়।কাল সে লিলিপাই কিন্ডারগার্টেন স্কুলের কালচারাল প্রোগ্রামে যাবে।ল্যাদা ল্যাদা বাচ্চাদের নিয়ে আহ্লাদ করতে হবে।কি পরিমান বিরক্তিকর বিষয়!

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে