কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-৩০

0
12

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩০)

লিলিপাই কিন্ডারগার্টেন স্কুল।ধানমন্ডি থেকে সামান্য খানিকটা দূরে।নবনীতা স্কুলের নেমপ্লেট টা আরেকবার দেখেই ভেতরে পা বাড়ায়।

আরহাম তাকে বলেছিল সামনের দুই বছর তার মন মতো কোনো চাকরি করতে।যেটা তার ভালো লাগে।সে অনেক ভেবে বের করেছে সে এমন কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতা করতে চায়।যেহেতু বেতনের চিন্তা নেই,তাই বেতনের বিষয়টা সে তেমন একটা ভাবল না।কেবল ভাবল নিজের মনের শান্তির কথা।সে বাচ্চাদের খুব ভালোবাসে।তার চাকরিটাই যদি হয় বাচ্চাকাচ্চা কেন্দ্রিক তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই নেই।

সে যখন আরহাম কে জানিয়েছে সে বাচ্চাদের টিচার হতে চায় তখন আরহাম গোল গোল চোখে কতোক্ষণ তাকে দেখল।তারপরই উপহাস করে বলল,’খুবই গরীব স্বপ্ন তোমার।’

নবনীতার কাছে মোটেও এটা কোনো গরীব স্বপ্ন না।তার বাচ্চা কাচ্চা ভীষণ ভালো লাগে।এদের সাথে সময় কাটাতেই তার আনন্দ হয়।সে জায়গায় তার চাকরিটাই যদি হয় মানুষের সাথে সময় কাটানো,তাহলে তো কোনো কথাই নেই।

আরহাম তার ইচ্ছে শুনেই কতোক্ষণ হাসল।শেষটায় বিদ্রুপ করে বলল,’তাহলে এক কাজ করো।কিন্ডারগার্টেনের টিচার না হয়ে বেবি সিটার হয়ে যাও।সারাদিন ডজন খানেক বাচ্চা কানের কাছে প্যা পু করে চিৎকার করবে।তখন খুব ভালো লাগবে।’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকায়।গো ধরে বলে,’মোটেও না।আমার বাচ্চাদের প্যা পু ও ভালো লাগে।’

সে শাড়ির কুচি সামলে ভেতরে যায়।সে ক্লাস থ্রি-এর সেকশান সি এর ক্লাস টিচার।সে তাদের ম্যাথামেটিকস পড়ায়।ছোট ছোট বাচ্চা গুলো ফ্রক আর শকস পরে ছুটে ছুটে ক্লাসরুমে আসে।এই দৃশ্য তার খুবই ভালো লাগে।তারা সবাই তাকে নবনী মিস বলে ডাকে।

নবনীতা অনুভব করে স্কুলে তার একটা আলাদা নাম ডাক আছে।সেটা অবশ্য নিজের যোগ্যতার কারণে না,স্বামীর যোগ্যতার কারণে।এমপির স্ত্রী বলেই সম্ভবত কলিগরা তাকে একটু বেশিই পাত্তা দেয়।সবাই তার সাথে একটু মাখো মাখো সম্পর্ক বজায় রেখে চলে।সে বিনিময়ে কেবল সহজ আর সাবলীল আচরণ করে তাদের সাথে।

ক্লাসরুমে তার ব্যাপক জনপ্রিয়তা।তার বয়স অনেক অল্প।তার মতো এডুকেশনাল ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এসে সচরাচর কেউ কিন্ডারগার্ডেনে চাকরি নেয় না।তার বয়সের কারণেই সম্ভবত বাচ্চারা তাকে খুব পছন্দ করে।রোজই তারা তাকে এটা সেটা এনে দেয়।তাদের চকলেট পেতে পেতে তার ব্যাগ ভরে গেছে।সে মানা করলেও তারা তার হাতে চকলেটের প্যাকেট ধরিয়ে দেয়।

আজও সুহানা নামের একটি মেয়ে রোল কল করার পর গুটি গুটি পায়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।নবনীতা হাজিরা খাতা থেকে চোখ সরিয়ে তাকে দেখেই মিষ্টি হেসে বলল,’হোয়াটস হ্যাপেন সুহানা?এনিথিং রং?’

সুহানা তার ফোকলা দাঁত বের করে হাসল।ডান হাতে মুঠ করে চেপে রাখা চকলেট টা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে গালভর্তি হেসে বলে,’মিস।দিস ইজ ফর ইউ।’

নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’সত্যি?থ্যাংকস।বাট আই ডোন্ট নিড দিস।তুমি খেয়ে নাও।মিস তাতেই খুশি হবো।বুঝেছ?’

সুহানা নারাজ হলো।নবনী মিসের প্রস্তাব তার পছন্দ হয়নি।মিসের জন্য আনা জিনিস সে কেন খাবে?তাহলে কি সেটা আর গিফট হলো?সে গো ধরল।হাত পা নেড়ে বলল,’নো মিস।প্লিজ টেইক দিস।’

নবনীতা কপালে হাত রেখে অসহায় ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।এদের ভালোবাসাময় যন্ত্রণা থেকে তার মুক্তি নাই।সে সুহানার জেদের কাছে পরাজিত হয়ে হাসি হাসি মুখ করে চকলেট টা হাতে নিল।সুহানা চকলেট দিয়েই তার কাছে এলো।ফিসফিস করে বলল,’মিস আমাকে আজকে একটা স্টার বেশি দিবে,ওকে?’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে তার দিকে তাকায়।ঠোঁট গোল গোল করে বলে,’ওরে দুষ্টু! চকলেট ঘুষ দিয়ে বেশি বেশি স্টার নেওয়ার বুদ্ধি।এই ছিলো তোমার পেটে?’

বলেই সে হাত বাড়িয়ে সুহানার পেটে সুরসুরি দেয়।সুহানা হাসিতে গড়াগড়ি খায়।হেসে উঠে নবনীতা নিজেও।ইশশ! কি সুন্দর এই জীবন! কতো ভালো আছে নবনীতা! সে আর কিছু চায় না।বাকি জীবনটা এমন করে পার করে দিতে পারলেই হলো।

স্কুলের ক্লাসটাইম শেষ হতেই সে অফিসরুমে গিয়ে কিছুক্ষণ বসল।মৌরি নামের তার একজন কলিগ তাকে দেখেই বলল,’নবনী! তুমি আজ ফ্রি আছো?’

নবনীতা কপাল থেকে হাত সরিয়ে নিরেট স্বরে জবাব দেয়,’জ্বী আছি।কেন আপা?’

‘চলো না আজ কোথাও ঘুরে আসি আমি,তুমি,প্রভা আর রাত্রি মিলে।’

নবনীতা বলপয়েন্ট কলমটা গালে চেপেই ভাবুক হয়ে বলল,’আজ?আচ্ছা আমি ভেবে দেখছি।’

তার সামনে বাচ্চাদের ক্লাস টেস্টের খাতা গুলো রাখা।সে দশ বারোটার মতো খাতা কেটে বাকি খাতা গুলো গুছিয়ে তার জন্য বরাদ্দকৃত ড্রয়ারে গিয়ে রাখল।তারপরই আনুমানিক একটার দিকে সব কাজ শেষ করে স্কুল থেকে বেরিয়ে গেল।

স্কুলের সামনে আসতেই কালো রঙের প্রাডো গাড়িটি তার দৃষ্টিগোচর হয়।সে চুপচাপ হেঁটে সেটাতে চড়ে বসে।এই গাড়ির মালিক তার স্বামী।স্বামী রোজ রোজ এই গাড়ি পাঠায় তাকে আনা নেওয়া করার জন্য।নবনীতা শুরুতে কয়েকবার বিরোধ করেও কাজ হয়নি।শেষটায় বাধ্য হয়ে সে সবটা মেনে নিয়েছে।

নবনীতা ইদানিং আরহামের কিছু অদ্ভুত চারিত্রিক দিকের সাথে পরিচিত হচ্ছে।যার মধ্যে একটি তার ডমিন্যান্ট স্বত্তা।স্ত্রী কে নিয়ে তার কিছু অদ্ভুত হাইপোথিসিস আছে।যেমন-নবনীতা যেকোনো যানবাহনে চড়তে পারবে না,বাড়ি থেকে বের হলে তাকে আরহামের পাঠানো গাড়ি দিয়েই যাতায়াত করতে হবে।এর চেয়েও বিরক্তিকর বিষয় তাকে সবসময় নিজের জিপিএস অন রাখতে হবে।এমনকি প্রতিদিন স্কুল শেষে আরহামকে ফোন দিয়ে জানাতে হবে সে স্কুল থেকে বেরিয়েছে।নবনীতা এসবের সাথে লড়াই করতে করতে রীতিমতো ক্লান্ত হয়ে শেষমেশ পরাজয় মেনে নিয়েছে।

সে চিরকাল আত্মবিশ্বাস আর আত্মমর্যাদার সাথে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা মানুষ।পুরুষালি শাসন বলতে সে কেবল বাবার শাসনকেই বুঝত।তারপর আর তার জীবনে অন্য কোনো ছেলে অভিভাবক হয়ে এসে তাকে শাসন করেনি।এখন তার বিয়ে হয়েছে।স্বামী আছে।সে তাকে ভালো মন্দ বলবে।নবনীতার এতে আপত্তি নেই।নবনীতার আপত্তি তার স্বামীর কিছু বাড়াবাড়ি আচরণ নিয়ে।আরহাম তার ইমেইলের এক্সেস পর্যন্ত নিজের কাছে রাখে।স্ত্রী হিসেবে এই বিষয়টা তার কাছে কিছুটা অপমানজনক মনে হয়।তবে সে ইদানিং আর তেমন কিছু বলে না।বিয়ে যখন মেনে নিয়েছে,তখন একসাথে সংসারের বিষয়টিও মেনে নিয়েছে।সেক্ষেত্রে অপরপক্ষের মানুষের ত্রুটি গুলো নিয়ে খামোখা ঝামেলা বাধিয়ে লাভ নেই।ঝামেলা বাধালে যদি কোনো কাজ হতো তাহলে এক কথা।আরহাম যে কি পরিমান গোয়ার আর জেদি সেটা নবনীতা তার বিয়ের একমাস না হতেই টের পাচ্ছে।তাকে বলে কোনো লাভ নেই।সে যেটা বুঝার সবসময় সেটাই বুঝে বসে থাকে।তার ভাবনা চিন্তার উপর নিজের ভাবনা চিন্তা চাপিয়ে দেওয়া নবনীতার জন্য অসম্ভব।

সে বাড়ি গিয়েই গোসল সেরে নেয়।সকালে সে মুরগির মাংস রান্না করেছিল।এখন সেটা গরম করে চিত্রা কে খাইয়ে দিতে হবে।বেলা তিনটা নাগাদ কলিং বেল বেজে উঠে।নবনীতা মাত্রই চিত্রাকে খাইয়েছে।শুভ্রা আসার সময় হয়েছে।সে কালো রঙের শাড়ির আঁচল সামলে দ্রুত দরজার দিকে যায়।দরজা খুলেই সে খানিকটা চমকায়।

আরহামের সাথে তার চোখাচোখি হতেই আরহাম ক্লান্ত স্বরে বলে,’হাই সেনোরিটা! কেমন আছ?’

‘আপনি এই সময়ে?’

‘হু,সন্ধ্যার আগে আর কাজ নেই।ভাবলাম দুপুরে এখানেই খেয়ে যাই।’

নবনীতা দরজা বন্ধ করতে করতে ছোট করে জবাব দেয়,’ওহহ আচ্ছা।’

আরহাম তার বেডরুমে গিয়েই পাঞ্জাবির দু’টো বোতাম ঢিলে করে আরাম করে খাটে শোয়।গলা ছেড়ে ডাকে,’পরী একটু পানি দাও প্লিজ।’

নবনীতা অলস ভঙ্গিতে হেঁটে এসে পানির গ্লাসটা তার সামনে বাড়িয়ে দেয়।আরহাম পুরোটা পানি শেষ করে গ্লাসটা তার হাতে ফিরিয়ে দিলো।জানতে চাইল,’তুমি খেয়েছ কিছু?’

‘নাহ,শুভি আসলে একসাথে খেতাম।শুভি তো এলো না।আপনাকে দিয়ে দিব খাবার?’

‘নাহ,শুভ্রা এলেই খাবো নে।’

শুভ্রা আসলো আরো পনেরো মিনিট পর।সে আসার পরেই নবনীতা সবকিছু টেবিলে বেড়ে দেয়।আরহাম খেতে খেতেই জানায়,’তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে পরী।’

নবনীতা কিছুটা অবাক হয়ে বলল,’সেটা কি?’

‘শাহাদাতের রিলিজের ব্যাপারে কথা বলেছিলাম।বলল সামনের সপ্তাহে অথবা এর পরের সপ্তাহে তাকে ডিসচার্জ করা হবে।তারপর তুমি তাকে তোমার কাছেই রাখতে পারবে।’

নবনীতা খেতে খেতেই উৎফুল্ল স্বরে বলে উঠে,’বাহ! দারুন খবর তো।’

‘শাহাদাত আর বিভাকে কোথায় রাখতে চাও?এই বাসায়?নাকি চাইল্ড হোমে?’

নবনীতা দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,’অবশ্যই এই বাসায়।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে।তোমার এখানেই রেখো।কিন্তু এদের তো সময় দিতে হবে।তুমি নিজেই তো স্কুলে থাকো।কিভাবে কি করবে?’

নবনীতা ব্যস্ত হয়ে জবাব দেয়,’সে একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে।চিন্তার কিছু নেই।’

খাবার শেষ করেই সে চটপট সব গুছিয়ে নেয়।আরহাম জহুরি চোখে একনজর আগাগোড়া তাকে পরোখ করে।তার এই নতুন চাকরির সবচেয়ে চমৎকার দিক হচ্ছে তার রোজ রোজ নিয়ম করে শাড়ি পরা।অন্তত আরহামের কাছে এই দিকটাই ভালো লেগেছে।শাড়িতে তাকে চমৎকার লাগে।সুডৌল ছিমছাম শরীরে সে যখন শাড়ি জড়ায় তখন আরহামের মনে হয় সে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে বসে তাকে দেখে যাক।তাকে আজকাল চমৎকার লাগে।সত্যিকারের পরীনিতা মনে হয়।একেবারে নতুন বউয়ের মতো বেশভূষা।

খাবার শেষ করে আরহাম ম্যাগাজিন হাতে শোয়ার ঘরে প্রবেশ করল।নবনীতা তখন ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে চোখে কাজল দিচ্ছিল।আরহাম জানতে চায়,’তুমি ঘরে বসে বসে এমন সাজগোজ করছ কেন?স্ট্রেঞ্জ!’

নবনীতা চোখে কাজল পরতে পরতে উত্তর দেয়,’আমি আজ এক জায়গায় যাচ্ছি।’

মুহুর্তেই মুখের হাসি মিলিয়ে যায় আরহামের।অতিশয় শীতল গলায় সে জানতে চায়,’কোথায় যাচ্ছ?’

‘কোথায় যাচ্ছি সেটা ঠিক জানি না।তবে উত্তরার কোনো একটা ক্যাফে তে যাচ্ছি।’

‘সাথে আর কে কে?’

আরহাম প্রশ্ন করেই চোখ মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকায়।নবনীতা এখনো তার মুখোভঙ্গি লক্ষ করেনি।সে এক চোখে কাজল দেওয়া শেষ করে অন্য চোখের দিকে মনোযোগ দেয়।আয়নাতে নিজেকে দেখতে দেখতেই বলে,’আমি,প্রভা,মৌরি আর রাত্রি।আমরা চারজনই যাচ্ছি।’

‘কার অনুমতি নিয়ে যাচ্ছো?’

গম্ভীর আর থমথমে গলায় করা প্রশ্নটা কর্ণগোচর হতেই নবনীতা কিছুটা ভড়কায়।পেছন ফিরে আরহাম কে দেখে বোকা বোকা হয়ে বলে,’জ্বী?’

‘তুমি কার অনুমতি নিয়ে এতো দূর যাচ্ছ পরী?’

‘অনুমতি মানে?আমরা অফিস কলিগ রা যাচ্ছি।অনুমতির কি আছে?আপনার গাড়ি তেই তো থাকব আমি।’

‘অনুমতির অনেক কিছু আছে।উত্তরা যাচ্ছ সেজেগুজে আবার বলছ অনুমতির কি আছে।অনুমতি নিয়েছ তুমি আমার?’

নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা টুলটা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।হতবাক কন্ঠে বলে,’আরহাম! আমার কি এইটুকু স্বাধীনতা নেই যে আমি আমার মেয়ে কলিগদের সাথে একটু উত্তরায় যেতে পারব?’

‘না নেই।তোমাকে বলেছি আমাকে জিজ্ঞেস করে বাড়ির বাইরে যেতে।স্কুলে চাকরি করতে দিয়েছি এটাই অনেক।তুমি আবার ঘুরাঘুরি শুরু করেছ কবে থেকে?রিমির সাথে যেখানে মন চায় যাও,আমার অনুমতির প্রয়োজন নেই।কিন্তু এর বাইরে সব কাজেই তোমাকে অনুমতি নিতে হবে পরী।আই হ্যাভ নট গেভ ইউ দ্যাট মাচ ইনডিপেনডেন্স।’

নবনীতা অবিশ্বাস্য চোখে তাকে দেখে।খানিকটা উঁচু স্বরে বলে উঠে,’আপনি মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছেন।কিছু বলি না দেখে আপনি রীতিমতো অনধিকার চর্চা করছেন।’

আরহাম তার চেয়েও উঁচু গলায় চেঁচায়,’কোনো অনাধিকার চর্চা করছি না।অধিকার আছে আমার।আমার বউ কোথায় যাবে না যাবে সেই বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার অধিকার আমার আছে।তুমি শাড়ি পরে সেজেগুজে উত্তরা যাচ্ছ আর একবার আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করো নি?তোমার কি আমাকে তথাকথিত সুইট,বউকে অগাধ ফ্রিডম দেওয়া হাসবেন্ড মনে হয়?’

নবনীতা ব্যথিত চোখে তাকে দেখে।শেষটায় মলিন মুখে বলে,’আপনি একটু বাইরে যাওয়া নিয়ে এতো গুলো কথা বলছেন?আমি তো এতো গুলো দিনে এই প্রথম বাইরে যাচ্ছি।তারাই আমাকে বলেছে যাওয়ার জন্য।’

‘যেই বলুক।তুমি কেন যাবে?তুমি আমাকে বলেছো একবারও?অকারণে মেয়েদের বাইরে ঘুরাঘুরি আমার পছন্দ না।’

‘আরহাম!’ খুবই করুণ শোনায় নবনীতার কন্ঠ।
‘আমাকে আপনি সন্দেহ করছেন?’

আরহাম পুরো শরীর আস্তে করে এলিয়ে দেয় তোশকে।দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’সন্দেহ না পরী।সন্দেহের কিছু নেই।মেয়েদের প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া আমার পছন্দ না।তাসনুভাও তো কতোবার বাড়ির বাইরে যেতে চায়।আমি যেতে দেই?মেয়েদের ঢ্যাং ঢ্যাং করা আমার একদমই ভালো লাগে না।তুমি পরবর্তীতে আর কখনো আমার অনুমতি না নিয়ে কোথাও যাওয়ার প্ল্যান করবে না বুঝেছ?’

নবনীতা নিরুত্তর হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকে দেখে।শেষে দুই হাতে নিজের শাড়ি চেপে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।ছোট করে জবাব দেয়,’জ্বী বুঝেছি।’

তার কথা শেষ হওয়ার একটু পরেই তার মুঠোফোনটি শব্দ করে বাজতে শুরু করে।নবনীতা নির্বিকার চিত্তে সেটা রিসিভ করার আগেই আরহাম ছোঁ মেরে ফোনটা তার হাতে নেয়।নবনীতা কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে তাকে দেখে।আরহাম ফোন রিসিভ করেই গাঢ় স্বরে বলে,’আমি নবনী না।আমি তার হাসবেন্ড বলছি।’

অন্যপাশ থেকে হয়তো আরো কিছু বলল।নবনীতা সেগুলো শুনে নি।সে কেবল শুনেছে আরহাম হাস্কি স্বরে জবাব দিচ্ছে,’পরী আজ যেতে পারবে না।আমরা পলিটিক্যাল পারসনরা নিজেরাও হুটহাট কোথাও যেতে পারি না।আমাদের ফ্যামিলি মেম্বাররাও যেতে পারে না।’

কথা শেষ করেই সে শীতল চোখে নবনীতার দিকে তাকায়।নবনীতার চোখ দু’টো রাগে কষ্টে মনের দুঃখে একটু পর পর আর্দ্র হয়ে যাচ্ছিল।সহ্যেরও একটা সীমা থাকে।আর কতো ধৈর্য ধরতে হবে তাকে?সে চুপচাপ মাথা নামিয়ে নেয়।তার সত্যিই বুকে চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।এই ব্যথার নাম কি?কে জানে!

আরহাম তার এই কাঁদো কাঁদো মুখশ্রীর তোয়াক্কা করল না।সে কল কেটেই ফোনটা বিছানায় আস্তে করে ছুড়ে মারল।আরো কিছুক্ষণ বাতাস খেয়ে পাঞ্জাবি ঠিক করতে করতে উঠে দাঁড়ালো।বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে নবনীতার কাছটায় এসে বলল,’মন খারাপের কিছু নেই।আমার সাথে সংসার করতে হলে এসব মানিয়ে নিতে হবে।আমি যথেষ্ট ছাড় দিয়েছি তোমায়।এর চেয়ে বেশি সম্ভব না।’

কথা শেষ করেই সে হনহনিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।সে যাওয়ার পরেও নবনীতা কয়েক মিনিট সটান দাঁড়িয়ে রইল।একটু হুশ ফিরতেই ধপ করে খাটে গিয়ে বসল।কেবল কলিগরা একসাথে ঘুরতে যেতে চেয়েছে বলে এতো কথা?নবনীতা কি এতোই উড়নচণ্ডী যে বর তাকে শাসনে বেধেছে?কবেই বা সে এমন সমবয়সীদের নিয়ে কোথাও ঘুরতে গিয়েছে?রিমি ছাড়া তো সে তেমন কারো সাথেই মিশে না।

সে চুপচাপ খাটে গিয়ে শোয়।চাদর খাঁমচে ধরে নিচের ঠোঁট কা’মড়ে কান্না গিলে।সবকিছু কেমন অসহ্য লাগছে।মানুষটা এতো অদ্ভুত কেন?একটু ভালো লাগতেই পরমুহূর্তে এমন একটা কাজ করে যেটা এক নিমিষেই ভালো লাগা টুকু গায়েব করে দেয়।

আরহাম সব কাজ শেষে বাড়ি ফিরল রাত দশটায়।এসেই বড়ো বড়ো পা ফেলে নবনীতার ঘরে আসলো।আসতেই দেখল নবনীতা চিত্রাকে সাথে নিয়ে শুয়ে শুয়ে ফোন দেখছে।

নবনীতা আরহামের অস্তিত্ব টের পেতেই নড়েচড়ে উঠে।অন্যমনস্ক চোখে এদিক সেদিক দেখে।আরহাম চিত্রার গালে হাত রেখে আদুরে গলায় বলল,’চিত্র! যাও তো।তুমি বসার ঘরে গিয়ে আপাইয়ের ফোন দেখ যাও।’

চিত্রা ফোন নেওয়ার আগেই নবনীতা এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়।চোখ পাকিয়ে কড়া গলায় ধমকে উঠে,’একদম ফোনে হাত দিবে না।আমার ফোন কি কোনো সরকারি সম্পদ?’

আরহাম আড়চোখে তাকে দেখল।কথাটা চিত্রকে বললেও আসল উদ্দেশ্য যে আরহামকে শোনানো,তাতে কোনো সন্দেহ নেই।সে ভয় পাওয়ার ভান করে বলল,’বাপরে! ম্যাডাম দেখি হেব্বি ক্ষেপেছে!’

সে তার পকেট থেকে নিজের ফোনটা বের করে চিত্রার হাতে তুলে নিয়ে বলল,’যাও চিত্র।তুমি ভাইয়ার ফোনে গেমস খেল।নাও।’

চিত্রা ফোন হাতে পেয়েই মহাসুখে এক দৌঁড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।নবনীতা অন্যদিকে চোখ সরিয়ে গজরাতে গজরাতে বলল,’চিত্র কিন্তু নষ্ট হচ্ছে এসব করে করে।সারাক্ষণ ফোন হাতে থাকলে অল্পতেই পেকে যাবে।’

আরহাম স্মিত হেসে নবনীতার আরেকটু কাছাকাছি এসে বসল।গাঢ় স্বরে ডাকল,’পরী!’

নবনীতা এক দৃষ্টিতে সিলিং দেখতে দেখতে জবাব দেয়,’কি?’

‘রাগ হয়েছ?’

‘নাহ।’

আরহাম ডান হাত দিয়ে তার কবজি চেপে ধরল।নবনীতা হকচকিয়ে ওঠে বলল,’আবার কি?’

আরহাম দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’চলো আমরা ঘুরতে বের হই।’

নবনীতা হাত ছাড়িয়ে নিতে নিতে তিরিক্ষি মেজাজে বলে উঠে,’কিসব যা তা বলছেন?কোথায় যাব আমরা?’

‘কেন?তারা যেখানে গিয়েছে সেখানে যাব।কলিগদের সাথে যেতে পারো নি,বরের সাথে যাবে।সমস্যা কি?’

নবনীতা হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যপাশে ফিরে কাঠকাঠ গলায় জবাব দেয়,’প্রয়োজন নেই।আমি কোথাও যেতে চাই না।’

আরহাম কনুইয়ের উপর ভর দিয়ে আধশোয়া হয়।গম্ভীর কিন্তু অমায়িক কন্ঠে বলে উঠে,’আহা! রাগ হচ্ছো কেন?চলো না।শাড়ি তো পরাই আছে।চট করে একটা রাইড দিয়ে আসি চলো।’

‘দরকার নেই।’

‘দরকার আছে।’

নবনীতা উত্তর না দিয়ে দুই চোখ বন্ধ করে নেয়।তার চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।অদ্ভুত! সে কি কচি খুকি হয়ে যাচ্ছে আজকাল?এইটুকু সামান্য বিষয়ে তো চিত্রাও কাঁদে না,অথচ তার কান্না পাচ্ছে।

আরহাম ঝুকে এসে তার মুখটা দেখতেই চমকে উঠে বলল,’সর্বনাশ! তুমি কাঁদছো পরী?’

নবনীতা চোখ মুছে।দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,’না তো।কাঁদছি না।পাগল নাকি?’

আরহাম খাট থেকে উঠে এসে তার মুখোমুখি গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসে।আলতো হাতে তার হাত চেপে ধরে কন্ঠে কিছুটা মধু মিশিয়ে বলে,’রাগ হয়েছ পরী?আচ্ছা যাও সরি।বাট মাই ইনটেনশন ওয়াজ নট রং।আমার উদ্দেশ্য খারাপ ছিল না পরী।’

নবনীতা নাক টানতে টানতে বলল,’বচনভঙ্গি বলতেও একটা শব্দ আছে আরহাম।আপনি ভীষণ রুড।প্রচন্ড খ্যাটখ্যাটে স্বভাবের।’

আরহাম হাসল।হাসতে হাসতেই জানতে চাইল,’আর তুমি?তুমি কেমন স্বভাবের?’

‘জানি না।তবে আপনার চেয়ে ভালো।’

আরহাম তার হাত দু’টো আরো একটু শক্ত করে চেপে ধরে বলল,’চলো।এখন যাই।মন ভালো হবে।’

নবনীতা দ্রুত মাথা নাড়ে।ব্যস্ত হয়ে বলে,’না না প্লিজ।এখন আর ইচ্ছে হচ্ছে না।’

আরহাম আর জোর করল না।উল্টো জানতে চাইল,’খেয়েছ?’

‘নাহ’

‘চলো খাবো।’

‘আচ্ছা’

নবনীতা চুপচাপ উঠে গিয়ে টেবিলে খাবার বেড়ে দেয়।সবাইকে খাইয়ে দিয়ে সব কিছু গুছিয়ে নিজের ঘরে আসতে আসতে প্রায় বারোটার উপরে বাজল।সে ঘরে আসলো হাই তুলতে তুলতে।প্রচন্ড ঘুম পেয়েছে।আলসেমি তে সে গায়ের শাড়িটাও খুলে নি।সে খাটে বসেই খোপা খুলে দিয়ে সমস্ত চুল উন্মুক্ত করল।আরহাম গালের নিচে হাত রেখে ড্যাব ড্যাব করে কয়েক পল তাকে দেখে।

নবনীতা বালিশের উপর সমস্ত চুল ছড়িয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ল।প্রায় মিনিট পাঁচেক পর আরহাম নিজ থেকেই ডাকল,’পরী!’

অন্য পাশ থেকে আগের মতোই ঠান্ডা গলায় জবাব আসে,’জ্বী?’

‘বিং প্রোটেক্টিভ ডাজ নট মিন বিং টক্সিক।আমি আমার ফ্যামিলি কে একটা সেফ জোনে রাখতে চাই।এটা নিশ্চয়ই মন্দ কিছু না।তাই না?’

নবনীতা সাথে সাথে উত্তর দেয়,’কিন্তু আপনার বলার টোন টা খুবই হার্শ।’

‘আচ্ছা যাও।এখন থেকে এভাবে বলব না।কিন্তু তুমিও কথা দাও তুমি এখন থেকে আমার অনুমতি বাদে যখন তখন বাড়ি থেকে বের হবে না।’

নবনীতা হতাশ ভঙ্গিতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে জবাব দেয়,’ঠিক আছে।যেমনটা আপনি বলবেন।’

সে ঘুমিয়ে পড়ল কয়েক মিনিটের ব্যবধানে।অথচ আরহাম জেগে থাকল আরো দীর্ঘসময়।নবনীতার ঘুম গাঢ়।এটা আরহাম আগেই টের পেয়েছে।সে ঘুমিয়ে পড়তেই আরহাম এক হাতে তার ডান হাতটা নিজের হাতে নেয়।বালিশের উপর তার চুল ছড়িয়ে রাখা ছিল।আরহাম অন্যহাত দিয়ে তার চুলে আঙুল চালায়।গভীর ঘুমে অসাড় রমণীর সুশ্রী মায়াভরা মুখশ্রী দেখেই সে স্মিত হাসল।অত্যন্ত ক্ষীণ স্বরে বিড়বিড় করে বলল,’দুঃখীত পরী।এ জীবনেও তোমাকে সেরকম স্বাধীনতা দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।আমার কিছু এথিকস আছে।আই ক্যান নট ওভারলুক দ্যাম।’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে