কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-২৭

0
13

#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(২৭)

ভোরের একটু আগে নবনীতা সামান্য নড়েচড়ে উঠল।তার চঞ্চল চোখের পাতা দেখেই আরহাম নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়।চুপচাপ গিয়ে নিজের জায়গায় শুয়ে পড়ে।চোখের উপর এক হাত রেখে আড়চোখে সেদিকে তাকায়।

নবনীতার ঘুম ভাঙতেই প্রথমে সে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজের অবস্থান অনুমান করল।তারপরই মাথা তুলে একনজর আরহাম কে দেখল।দেখেই হতাশার শ্বাস ছাড়ল।এখনও ঘুমুচ্ছে।একবারও কি ঘুম ভাঙে না এই লোকের?

হাতের অ্যালবাম টা আঁকড়ে ধরে সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই টের পেল তার পিঠের দিকটা অবশ হয়ে গেছে।নবনীতা উঠতে গিয়েও আর উঠতে পারল না।একহাতে ভর দিয়ে ধপ করে খাটে বসে পড়ল।পিঠ আর কোমরের ব্যথায় আনমনে মৃদু আর্তনাদ করল।

আরহাম চোখের সামনে থেকে হাত সরায়।ঘুম জড়ানো গলায় জানতে চায়,’কি হয়েছে?’

নবনীতা তার দিকে ফিরল।তাকে দেখতেই মুখ শক্ত করে বলল,’কি আর হবে?সকাল হচ্ছে।আর কিছু হয়নি।আপনি পড়ে পড়ে ঘুমান।যেই ঘুমের নমুনা! মানুষ ম’রলেও টের পাবেন না।’

আরহাম তার কথা শুনতেই ঠোঁট টিপে হাসে।অদ্ভুত! সে নিজেই চায় আরহাম যেন তার কাছ না ঘেঁষে।আবার নিজেই বলছে মরে গেলেও টের পাবে না।মেয়েরা আসলে চায় টা কি?

সে নবনীতার দিকে ফিরে জানতে চাইল,’এনি প্রবলেম?’

নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’নো।নো প্রবলেম।আপনি ঘুমান।’

কথা শেষ করেই সে উঠে দাঁড়ায়।অ্যালবাম টা স্বস্থানে রেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।সাদেক সাহেবের ঘর থেকে টুকটাক শব্দ আসছে।নবনীতা তার ঘরে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলল,’মামা পানি কিন্তু খুব ঠান্ডা।আমি চুলায় পানি বসাচ্ছি।সেটা দিয়ে ওযু করবে।’
বলে আর সে উত্তরের অপেক্ষা করে না।রান্নাঘরে ছুটে গিয়ে স্টোভ জ্বালিয়ে পাতিলে করে পানি বসায়।তারপর আবার ব্যস্ত পায়ে হেঁটে যায় শুভ্রার ঘরে।ঘরে উঁকি দিতেই সে দেখল ঘর একদম ফাঁকা।কপালে ভাঁজ পড়ে তার।কোথায় গেল এরা সবাই?

বসার ঘরে ফ্যান চলছে।নবনীতা দ্রুত সেখানে গেল।গিয়েই দেখল এরা সবাই কার্পেটের উপর তোশক আর চাদর বিছিয়ে ঘুমুচ্ছে।নবনীতা হাসি মুখ করে তাদের দেখল।একপাশে রিমি,তার পাশে শুভ্রা,শুভ্রার পাশে চিত্রা।চিত্রা আর বিভা পাশাপাশি।তাদের সাথে আরো একজন ছিল।তাকে দেখতেই নবনীতা কিছুটা চমকাল।আনমনে বিড়বিড় করল,’তাসনুভাও এসেছে?’

তাসনুভা ঘুমিয়েছে একেবারে একপাশে।মেয়েটার মুখটা দেখতে ভীষণ আদুরে লাগছে।নবনীতা সবাইকে ডিঙিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়।ঠিক তার শিয়রে গিয়ে বসে।হাত বাড়িয়ে তার চুলে বিলি কাটে।মেয়েটার সাথে তার অনেকদিন কথা হয় না।সে মেয়েটাকে ইদানিং এড়িয়ে যায়।অথচ এড়িয়ে যাওয়ার কোনো কারণ নেই।নবনীতার সমস্যা তার ভাইয়ের সাথে।তাসনুভা কি দোষ করেছে?তাসনুভা তো তাকে পছন্দ করে।একেবারে স্বচ্ছ তার অনুভূতি।নবনীতা আলতো করে তার কপালে চুমু খেল।সেও তো চিত্র আর শুভ্রার মতোই ভীষণ একা।কতো মিষ্টি একটা মেয়ে!

মিনিট দশেক বসে থাকার পর নবনীতা আবার রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে যায়।পানি ফুটছে সম্ভবত।মামার ঘর পর্যন্ত গরম পানি পৌঁছে দিতে হবে।সে সবকিছু গুছিয়ে ওযু করল। বিয়ের পরদিন সকালে নামাজ পড়ে প্রার্থনা করলে দাম্পত্য জীবন সুখের হয়।এ কথা সে বহু মানুষের মুখে শুনেছে।তবে নবনীতা দাম্পত্য জীবন সুখী হওয়ার প্রার্থনা করে না।সুখী না হোক,কেবল সহনীয় হলেই হলো।কোনোরকমে এক ছাদের নিচে থাকতে পারলেই হবে।সুখ দিয়ে কি হবে?সেটা এমনিতেও তার জীবন থেকে নাই হয়ে গিয়েছে।

সে নামাজ শেষে কতোক্ষণ ইউটিউব ঘাটল।কি নাস্তা বানানো যায় মাথায় আসছে না।তাসনুভার পছন্দ কেমন সেটাও সে জানে না।তাসনুভা যেহেতু আজ প্রথম তার বাসায় থাকছে,তার উচিত তার পছন্দসই কিছু করা।শেষ পর্যন্ত সে সিদ্ধান্ত নিল সে আলু পরোটা বানাবে।অনেক আগে একবার বানিয়েছিল,খুব একটা ভালো হয়নি।আজকে আবার চেষ্টা করবে।ভালো হলে তো হলোই,নয়তো মানিয়ে নিবে।

সে কেবলই ময়দার প্যাকেটে হাত দিয়েছে,তক্ষুনি কলিং বেল বেজে উঠল।নবনীতা এক দৌঁড়ে সেখানে যায়।ডোর ভিউয়ারে চোখ রেখে দরজার সামনে দাঁড়ানো মানুষটি কে দেখে।দেখতেই অবাক হয়ে বলে,’আদি ভাইয়া এসেছে! এতো সকালে!’

সে দ্রুত পেছন ফিরে রিমির কাছে যায়।হাঁটু মুড়ে বসে তাকে ঠেলতে ঠেলতে বলে,’এ্যাই রিমি ওঠ।আদি ভাইয়া এসেছে।ঘরের যা অবস্থা করেছিস! কোথায় বসাবো উনাকে?’

রিমি ধড়ফড়িয়ে ঘুম থেকে উঠে।উঠেই এপাশ ওপাশ দেখে অস্থির হয়ে বলে,’কি হয়েছে?কে ম’রেছে?’

নবনীতা কপাল চাপড়ায়,’কেউ ম’রে নি।আদি ভাইয়া এসেছেন।ওঠ এখন।’

রিমি দ্রুত উঠে বসে।তার আর নবনীতার কথায় শুভ্রাও চোখ ডলতে ডলতে সামনে তাকায়।নবনীতা গাঢ় স্বরে বলে,’যা শুভি।নিজের ঘরে যা।’

শুভ্রা এক ডাকেই চুপচাপ ওঠে নিজের ঘরে চলে গেল।রিমি গেল ডাইনিং রুমে।সোফাতে বসতে না পারলেও চেয়ারে অন্তত বসতে পারবে আদি।

নবনীতা দরজা খুলতেই আদি তাকে দেখে প্রশস্ত হাসল।উৎফুল্ল কন্ঠে বলল,’গুড মর্নিং নবনীতা!’

বিনিময়ে নবনীতাও এক গাল হাসল।দরজা ছেড়ে দাঁড়িয়ে সাবলীল ভঙ্গিতে বলল,’আসুন ভাইয়া।ভেতরে আসুন।’

আদি ঘরে এসেই বসার ঘরের চিত্র দেখে অবাক হয়ে বলল,’তাসনুভা ফ্লোরে ঘুমিয়েছে কাল?’

নবনীতা এগিয়ে এসে মৃদু স্বরে বলল,’জ্বী ভাইয়া।কেন?ওর অভ্যাস নেই এসবে?’

‘নাহ।আরহামদের তো কখনো নিচে ঘুমাতে দেখিনি।যাকগে ব্যাপার না।সবাই মিলে ফ্লোরিং করে ঘুমানোর মজাই আলাদা।’

নবনীতা কিছুটা লজ্জিত হয়ে বলল,’আসলে আমি জানতাম না তাসনুভা বাড়িতে আছে।তাহলে আমি অবশ্যই তাকে এভাবে রাখতাম না।’

আদি কিছুটা বিরক্ত হলো।কন্ঠে সেই বিরক্তি ধরে রেখেই বলল,’তুমি আবার এতো হেজিটেট করছ কেন?আমি অবাক হয়েছি,রাগ হইনি।’

কথা শেষ করেই সে ডায়নিং রুমে পা বাড়ায়।নবনীতা চুপচাপ তার পেছনে এসে দাঁড়ায়।রিমি তার হাত দেখেই অবাক হয়ে বলল,’সেকি! হাতে এসব কিসের প্যাকেট?’

আদি তার হাতের প্যাকেট গুলো টেবিলে রেখে নিরেট স্বরে বলল,’তোমাদের জন্য নাস্তা এনেছি।শারমিন খালা তো রাতেই চলে গিয়েছে।তাই ভাবলাম আমিই নাস্তা কিনে নেই।তোমরা নিজেরাও তো স্টুডেন্ট।অতো রান্নাবান্না নিশ্চয়ই জানো না।’

রিমি স্মিত হাসল।যাক,একটা ভালো কাজ হয়েছে।সকাল সকাল রান্না করা একটা বিশাল ঝামেলা।সে আর নবনী কেউই রান্না জানে না।দু’জন মিলে অখাদ্য বানানোর চেয়ে কিনে আনা খাবার খাওয়া ভালো।

নবনীতা এগিয়ে এসে মুখভার করে বলল,’কি দরকার ছিল?আমরা তো কিছু একটা বানিয়েই নিতাম ভাইয়া।শুধু শুধু আবার এতো কিছু আনলেন কেন?’

রিমি চোখ পাকিয়ে তাকে দেখে।নবনীতা ইশারায় জানতে চায়-কি হয়েছে? রিমি মনে মনে উত্তর দেয়,’কচু বানাতিস তুই।যতোসব অখাদ্য খাওয়ানোর ধান্দা।’

আদি পাখা ছেড়ে চেয়ার টেনে বসল।চারদিক দেখে বলল,’আমার বন্ধু কোথায়?এখনো ঘুমে?’

নবনীতা ছোট করে জবাব দেয়,’জ্বী।’

আদি ঘড়িতে সময় দেখেই খানিকটা বিচলিত হয়ে বলল,’মাত্র সাতটা আটচল্লিশ বাজে।বেশি সকাল সকাল এসে পড়েছি তাই না?’

রিমি দিরুক্তি করে বলল,’না না ভাইয়া।ঠিকই আছে।আমরাই লেইট।’
সে কথা শেষ করেই নবনীতাকে দেখে খানিকটা ধ’মকে উঠে বলল,’দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি দেখছিস?যা ভাইয়া কে ডেকে আন।বল আদি ভাইয়া এসেছে।’

নবনীতা চমকে উঠে বলল,’ডাকবো মানে?আমি কি করে ডাকবো?’

‘অদ্ভুত! যেমন করে ডাকে এমন করে ডাকবি।’

নবনীতা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার আদিকে দেখে।আদি সামনে না থাকলে রিমি কে কিছু কথা বলা যেত।এখন আর সেটা সম্ভব না।সে মাথা নামিয়ে গটগট করে হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেল।

ঘরে এসেই সে ত্যাড়ছা চোখে একবার আরহাম কে দেখে।এগিয়ে এসে গলা উঁচিয়ে বলে,’আদি ভাইয়া এসেছে বাসায়।’

আরহামের কোনো ভাবোদয় হলো না।সে উল্টো আওয়াজে বিরক্ত হয়ে অন্য পাশে ফিরে গেল।নবনীতা আরো একবার উঁচু স্বরে বলল,’আদি ভাইয়া এসেছে।সাথে খাবারও এনেছেন।উঠতে বলেছে আপনাকে।’

আরহাম বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’সমস্যা কি?এভাবে চেঁচাচ্ছ কেন?’

নবনীতা কোমরে হাত রেখে তার চেয়েও দ্বিগুন বিরক্ত হয়ে উত্তর দেয়,’আদি ভাইয়া এসেছেন।একসাথে নাস্তা করবে আপনার সাথে।উঠুন।’

আরহাম তার কথা পাত্তা না দিয়ে চোখের উপর একহাত রেখে বলল,’এই সাত সকালে কেউ কারো বাসায় আসে?আদির খাবার আদিই খাক।’

নবনীতা চোখ মুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকে দেখে।তারপরই বিরক্ত হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।এর সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করে লাভ নাই।আজকে তার কাজ আছে।সে আজকে থেকে আবার অফিস জয়েন করবে।নয়টা বাজলেই সে অফিসের জন্য বেরিয়ে যাবে।

সে আলমারি ঘেটে নীল রঙের একটা জামা বের করে দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে ছুটে।গোসল শেষে বের হতে হতে প্রায় সাড়ে আটটা বেজে গেছে।বের হয়েই সে তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল।তাড়াহুড়ো করে ভেজা চুলে চিরুনী চালালো।

তার খট খট আওয়াজে আরহামের ঘুম উড়ে গেল।সে আড়মোড়া ভেঙে বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরতেই দেখল নবনীতা ভেজা চুল নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছে।চুলের পানিতে তার পুরো পিঠ ভিজে যাচ্ছে।আরহাম এক লাফে উঠে বসল।অবাক হয়ে বলল,’ভেজা চুল নিয়ে এমন টানা হ্যাঁচড়া করছ কেন?ভেজা চুল আঁচড়াতে হয় না।জানো না এটা?’

নবনীতা পেছন ফিরে।কটমট করে বলে,’বেশি কথা বলবেন না।আপনার কাছে জানতে চেয়েছি?আমার চুল আমি বুঝে নিবো।’

আরহাম ত্যাড়ামি করে বলল,’একদমই না।তোমার চুল তুমি বুঝে নিবে না।তুমি এমন টেনে টুনে সব চুল ছিঁড়ে ন্যাড়া হয়ে গেলে আমি তোমাকে বউ বলে পরিচয় দেব না।’

‘দিয়েন না।খুব উপকার হবে আমার।’

বলেই সে আবার ভেজা চুপচুপে চুলে চিরুনী দিয়ে টানাটানি শুরু করে।আরহাম দ্রুত উঠে তার কাছে যায়।নবনীতার কোলের উপর রাখা তোয়ালে টা নিজের হাতে নিয়ে সহজ গলায় বলে,’চুল তো মুছো নি ভালো করে।দেখি এদিকে ফিরো।’

নবনীতা বড় বড় চোখে তাকে দেখে।কড়া গলায় বলে,’কি যা তা বলছেন?এতো আদিখ্যেতা দেখাতে হবে না।নিজের কাজে যান।’

আরহাম সেসব পাত্তা দিলো না।সে তোয়ালে হাতে নিয়ে নবনীতার কাছাকাছি এসে সেটা নবনীতার মাথায় চাপিয়ে তার চুলগুলো ঝেড়ে দিলো।নবনীতা চুল মোছার ফাঁকেই চেঁচিয়ে ওঠল,’আরে আস্তে।সব রাগ কি আমার চুলের উপর ঝাড়ছেন নাকি?থামুন।থামুন।আমার কিন্তু মাথা ব্যথা করবে এখন।’

আরহাম থামল।নবনীতার চুলে হাত দিয়ে বলল,’দেখো।চুল অলরেডি অর্ধেক শুকিয়ে গেছে।ঠিক মতো মুছতেও তো জানো না।আবার বড় বড় কথা বলো।’

নবনীতা দুই হাতে মাথা চেপে ধরে।চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে একটু সামলে উঠতেই চেঁচিয়ে উঠে,’পুরো দুনিয়া ঘুরছে আমার।এতো উপকার ভবিষ্যতে আর না করলেও হবে।’

আরহাম হাসল।এলোমেলো চুলগুলো সব তার মুখের উপর পড়ে আছে।তাকে অদ্ভুত দেখাচ্ছে।সে দেয়ালে হেলান দিয়ে কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়,’এই সাত সকালে এমন মাঞ্জা মেরে যাচ্ছ টা কোথায়?’

নবনীতা চোখ পাকিয়ে কঠিন মুখ করে বলল,’মোটেই মাঞ্জা মেরে যাচ্ছি না।কেবল চুলই শুকাচ্ছিলাম বসে বসে।’

সে একটু থেমে খুশি খুশি মুখ করে বলল,’আমি আজ অফিসে জয়েন করছি অনেক দিন পর।’

আরহাম ঠোঁট উল্টে বলল,’বাব্বাহ! চাকরি করছ নাকি?’

নবনীতা আত্মবিশ্বাস নিয়ে জবাব দেয়,’অবশ্যই।তাও চমৎকার একটা অফিসে।’

‘কেন কেন?চমৎকার কেন?’ উৎসুক হয়ে জানতে চায় সে।

‘অফিসের লোকজন খুব ভালো।বিশেষ করে গভর্নিং বডির মেম্বার আর সিইও।আমি বলে বোঝাতে পারব না।আমাকে তারা অনেক ভালোভাবে ট্রিট করে।’

আরহাম ঠোঁট টিপে আসে।মনে মনে বিড়বিড় করে,’সিইও সামনে এলেই তো সব প্রশংসা গায়েব হয়ে যাবে ম্যাডাম।’

তবে মুখ ফুটে তেমন কিছু বলেনি।শুধু বলেছে ভালো,বেশ ভালো।
নবনীতা অবশ্য থামে নি।সে আরো দশ মিনিট অফিসের গুন গেয়েছে।আরহাম দুই কান খুলে সবটা শুনেছে।এতো শান্তি তো রোমান্টিক গান শুনলেও লাগে না।মনে হচ্ছে কানের ভেতর কেউ মধু ঢেলে দিচ্ছে।সে শেষটায় চাপা স্বরে বলল,’অফিসের সিইওর জন্য একটু দোয়া করে দিও তো।সে যেন বউ নিয়ে সুখে থাকতে পারে।’

নবনীতা আয়না থেকে চোখ সরিয়ে আরহাম কে দেখে বলল,’অবশ্যই সুখে থাকবেন।উনি নিরেট ভদ্রলোক।সুখে না থাকার প্রশ্নই আসে না।’

নবনীতা আধভেজা চুলটা কোনোরকম ক্লাচারের সাহায্যে আটকে অল্প কিছু খেয়ে নেয়।তাসনুভা খাবার ঘরেই ছিল।সে একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছে।নবনীতা তাকে দেখেই মিষ্টি করে হাসল।তার থুতনিতে হাত রেখে বলল,’আমার এখন বের হতে হবে তাসনুভা।পরে কোনোদিন তোমার সাথে মন ভরে কথা বলল কেমন?’

সে দ্রুত গতিতে বাসা থেকে বের হয়।নাস্তা খাওয়া শেষে আরহাম সাদেক সাহেবের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আদি আর তাসনুভা কে সাথে করে বেড়িয়ে গেল।তার আবার সন্ধ্যার দিকে একটা অনুষ্ঠানে যেতে হবে।

নবনীতার অফিস বরাবরের মতো আজও ভালো কেটেছে।তবে আজ কেন যেন সবাই গোল গোল চোখে তাকে দেখছিল।নবনীতা কিছুটা হকচকায়।সম্ভবত তার বিয়ের বিষয়টি তারা জেনে গেছে।কিন্তু নিজ থেকে কিছু বলতে পারছে না।নবনীতা আর এসব নিয়ে এতো মাথা ঘামায় না।যার যা ভাবার ভাবুক।তার কি?তাকে তো আর কিছু বলছে না।

দুপুরের একটু পরেই সে অফিস থেকে বেরিয়ে লুবনার বাড়ির দিকে রওয়ানা দেয়।লুবনার আবার পরীক্ষার রুটিন দিয়ে দিয়েছে।ফাঁকিবাজ টা কিছুই পারে না।তাই নবনীতা ইদানিং তাকে নিয়মিতই পড়াচ্ছে।

লুবনার বাসার কলিং বেল চাপতেই খটখট শব্দে দরজা খুলে গেল।দরজা খুললেন মিসেস ইয়াসমিন।নবনীতাকে দেখামাত্রই তিনি নাক ছিটকালেন।তার অদ্ভুত চাহনি দেখে নবনীতা নিজেই ভড়কে গেল।অপ্রস্তুত হয়ে এদিক সেদিক দেখল।তার এমন ঘৃণাভরা দৃষ্টির কারণ কি নবনীতা?নাকি তার আশে পাশে থাকা অন্যকিছু?

মিসেস ইয়াসমিন কয়েক পল তাকে দেখেন।তারপরই খানিকটা ভৎসনা করে বলেন,’তোমার আর লুবনাকে পড়াতে হবে না।তোমার মতো মেয়ের কাছে আমি মেয়ে পড়াবো না।’

নবনীতা হতভম্ব হয়ে তার কথা শুনলো।তোমার মতো মেয়ে মানে?কেমন মেয়ে সে?সে একটা শুকনো ঢোক গিলে গলা ভিজায়।মিসেস রোকেয়া তার সেই মলিন মুখ দেখে দমলেন না।উল্টো আগের চেয়েও কঠিন গলায় বললেন,’তোমাকে খুব ভালো মেয়ে ভেবেছিলাম।তুমিও সেই বাকিদের মতোই।শরীর বেঁচে সংসার চালাও আবার বড় বড় কথা বলো।’

তার কথা শুনেই নবনীতার কান ঝা ঝা করে উঠে।সে বোকা বোকা হয়ে কেবল বলে,’আন্টি কি যা তা বলছেন।’

মিসেস ইয়াসমিন কর্কশ গলায় জবাব দেন,’যা তা বলছি না।সব জেনেই বলছি।মা বাপ নেই,এধরনের মেয়েদের আমার খুব ভালো করে চেনা আছে।এরা যার তার সাথে শুয়ে যায়।ভেবেছিলাম তুমি আলাদা,অন্যরকম।এখন দেখছি তুমিও ঐ তাদের মতোই।নেতার সাথে ফষ্টিনষ্টি করে এখন তার ফ্ল্যাটে থাকা শুরু করেছ।’

নবনীতা দুই কদম পিছিয়ে গেল।ঘটনার আকস্মিকতায় তার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছিল না।একটু ধাতস্থ হতেই সে জোর গলায় বলল,’এসব কি বলছেন আপনি?আপনি আমার নামে নোংরা অপবাদ দিচ্ছেন।আমি নিজের টাকায় ফ্ল্যাটে থাকি।ভাড়া দিয়ে থাকি।’

‘হ্যাঁ।খুব জানা আছে।এমপির অফিসে কাজ করো,তার বাড়িতে থাকো,স্কুল কলেজে গিয়ে নষ্টামি করো,আবার বলো ভাড়া দিয়ে থাকো।খুব চেনা হয়েছে আমার তোমাকে।এই হলো তোমার সংগ্রামের নমুনা।আকাম কুকাম কি করেছ কে জানে,শেষে আবার বাধ্য হয়ে বিয়েও নাকি করেছে।যাকগে,এসব আমার বলে আর কাজ নেই।তুমি আমার মেয়েকে আর পড়াতে আসবে না।তোমার মতো টিচার আমার লাগবে না।’

নবনীতা ফ্যালফ্যাল চোখে তার পুরোটা কথা শুনল।উপযুক্ত জবাব দেওয়ার জন্য অপর পক্ষের কথা বোধগম্য হতে হয়।অথচ মিসেস ইয়াসমিন এতোক্ষণ কি বললেন,তার সিংহভাগই তার বোধগম্য হলো না।শুধু সে এইটুকু বুঝল মিসেস ইয়াসমিন এক নিমেষেই তার এতো বছরের সংগ্রাম,এতো বছরের পরিশ্রমের উপর আঙুল তুলেছেন।নবনীতার কষ্ট,তার ত্যাগ তিতিক্ষা সবকিছুকে একটা নোংরা বিশেষণ দিয়ে বিশেষায়িত করে দিয়েছেন।

সে পুনরায় চেঁচিয়ে উঠে বলে,’কি সব উল্টা পাল্টা বাজে কথা বলছেন আপনি আমার নামে।আপনাকে সম্মান করি তাই বলে আপনি যা খুশি বলবেন?আমি আমার যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছি।’

তার চেঁচানো তে মিসেস ইয়াসমিনের কোনো ভাবোদয় হয়নি।তিনি কটমট করে বললেন,’তোমার যোগ্যতা যে কি সেটা ফেসবুকে ঢুকলেই বোঝা যায়।যাও গিয়ে তোমার নামি দামি কাস্টমারদের খুশি করো।আমার মেয়েকে তোমার পড়াতে হবে না আর।’

বলেই তিনি ধাম করে তার মুখের উপর দরজা বন্ধ করলেন।নবনীতা স্তম্ভিত হয়ে আরো দুই পা পেছায়।তার চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে,অপমানে শরীর ঝলসে যাচ্ছে।ইয়াসমিন আন্টি তাকে এসব কথা বলছে?তার চরিত্র নিয়ে এতো বাজে বাজে কথা বলছে?সে নষ্টা?সে শরীর বেঁচে খায়?শেষ?এইটুকুই?এইটুকুতেই নবনীতার পরিচয় দেওয়া শেষ?

নবনীতা আরো কয়েক কদম পেছায়।শেষে দুই হাত মুখে চেপে মেইন রোডের দিকে ছুটে।মূল সড়কে আসতেই যে গাড়ি সামনে পেল সেটাতেই চড়ে বসল।বসেই নিজের দুই হাত মুখের উপর চেপে হাউমাউ করে কতোক্ষণ কাঁদলো।বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত নিজেকে সামলে রাখা তার পক্ষে সম্ভব না।তবুও সে নিজেকে কয়েক দফা শান্ত রাখার চেষ্টা করে।রাস্তাঘাটে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা তার উদ্দেশ্য না।সে কোনোরকম বাড়ি যেতে পারলেই বাঁচে।সে দ্রুত চোখ মুছে দুইবার বড়ো করে শ্বাস টানে।পরোক্ষনেই আবার তার চোখ ভিজে উঠে।বারবার কেবল মনে হয় এতো সহজে কথা গুলো বলে দিলো?একবারও যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করল না?

***

আরহাম অনুষ্ঠান শুরুর একটু পরে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো।প্রায় ঘন্টা দুয়েক পরে তার মুঠোফোনটি আনুমানিক রাত আটটার দিকে পিঁক পিঁক শব্দ করে বেজে উঠল।সে ফোন হাতে নিয়ে দেখল রিমির কল।কপালে ভাজ পড়ে তার।দ্রুত কল রিসিভ করেই সে জানতে চায়,’কি হয়েছে রিমি?এনি প্রবলেম?’

রিমি অন্যপাশ থেকে কি বলল জানা নেই,তবে তার কথা শুনতেই আরহাম উঠে দাঁড়ায়।ব্যস্ততার অযুহাত দেখিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে পড়ে সেখান থেকে।গাড়িতে উঠেই তাড়াহুড়ো করে বলে,’মোতাহের তাড়াতাড়ি তোমার ম্যাডামের এপার্টমেন্টে যাও তো।
.
.
.
.
সুখ এমন এক দুর্লভ বস্তু যা সবার জীবনে বেশি সময়ের জন্য স্থায়ী হয় না।নবনীতারও হয়েছে তাই।যেই আকাশ ছোঁয়া সুখ তার ধূসর জীবনটাকে রংধনুর সাত রঙের ন্যায় রাঙিয়ে দিয়েছিল,সেই সুখ হঠাৎই কর্পূরের ন্যায় উবে গেল।নবনীতা জানতে পারল,যেই অফিস নিয়ে সে রোজ রোজ এতো গর্ব করতো সেই অফিসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আর কেউ না,শেখ শাহরিয়ার আরহাম।অফিস জয়েনিং এর অর্ধমাস পূর্ণ হওয়ার পর সে যখন বিষয়টি জানলো,তখন তার আনন্দ উচ্ছ্বাস সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।

সে আজ বাড়ি ফিরে হন্য হয়ে তার অফিসের ওয়েবসাইট ঘেটে এই তথ্য বের করেছে।এই বিষয় টা ঠিক মতো হজম করার আগেই আরো একটা বিষয় সে জানতে পারল,যেটা হুট করেই হজম করা তার পক্ষে সম্ভব ছিল না।

সে জানতে পারল যেই বাড়িতে সে এতোদিন যাবত থাকছে,যেই ফ্ল্যাটের মেঝের উপর সে দাঁড়িয়ে আছে,কাগজে কলমে সেই ফ্ল্যাটের মালিক শাহরিয়ার আরহাম নিজেই।এটা আরহামের নিজের এপার্টমেন্ট।যেটাতে নবনীতা এতোদিন নির্দ্বিধায় থাকছিল।যেই আরহাম কে জড়িয়ে তার নামে নোংরা কথা উঠছিল,সেই আরহামের এপার্টমেন্টেই সে গুনে গুনে সতেরো দিন কাটিয়েছে।

নবনীতা বাড়ি ফিরে আরো একবার গোসল করল।সে কি করবে?এই চাকরিটা ছেড়ে দিবে?বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে?
তারপর?তারপর কি হবে?কোথায় যাবে সে?তার তো কোনো জায়গা নেই যাওয়ার।এই কিছুদিনে সে যেই পরিমান কেঁদেছে,সারা জীবনেও অতোখানি কেঁদেছে নাকি সন্দেহ।এখন কাঁদতেও তার ক্লান্ত লাগে ভীষণ।আরহামের উদ্দেশ্য সে জানে না।ঠিক কি কারণে সে তাকে নিজের অফিসে কাজ দিয়েছে,নিজের বাড়িতে ঠাই দিয়েছে সে জানে না।জানতে চায়ও না।মানসিক ভাবে সে এসব নিয়ে ভাবার মতো অবস্থায় নেই।সে শুধু তাকে নিয়ে মানুষের চিন্তাভাবনা কেমন সেটা অনুমান করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেছে।তার সমস্ত মনোযোগ শুধু সেসব নিয়েই।

চরিত্রের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে যখন আঘাত লাগে,তখন দৃঢ় আর মজবুত ব্যক্তিত্বের মেয়েটিও পড়ন্ত বিকেলের অস্তমিত সূর্যের ন্যায় নুয়িয়ে পড়ে।সকল তেজ,জেদ কেমন যেন এক লহমায় দমে যায়।নবনীতার সাথেও তাই হলো।সেই রাতে তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো।জ্বরের প্রকোপ এতোই বেশি হলো যে সে চোখ বন্ধ রেখেই অস্ফুটস্বরে বিড়বিড় করে গেল।রিমি তার কপালে হাত রেখেই আঁতকে উঠে।দ্রুত জলপট্টির ব্যবস্থা করে।কোনো কিছু না ভেবেই আরহামের নম্বরে ডায়াল করে।

আরহাম তার এপার্টমেন্টে পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত নয়টা বেজে গেল।সে গিয়েই এলোমেলো পায়ে নবনীতার ঘরে যায়।রিমি বসেছিল তার পায়ের কাছটায়।আর শুভ্রা আর চিত্র বসেছে ঠিক তার পাশে।চিত্রর চোখে মুখে ভয়,উৎকন্ঠা।আপাই এমন জ্বরের ঘোরে প্রলাপ করছে,সেটা সে জীবনে এই প্রথম দেখেছে।শুভ্রা তাকে দেখেই সরে এলো।আরহাম গিয়ে বসল তার ঠিক পাশটায়।তাসনুভার জ্বর হলে সে যেভাবে তার কপালে হাত রাখে,তেমন করেই সে নবনীতার কপালে হাত রাখল।তাপমাত্রা অনুমান করেই চিন্তিত হয়ে বলল,’থার্মোমিটারে জ্বর মেপেছিলে রিমি?’

‘জ্বী ভাইয়া।একটু আগে ১০৪ ছিলো,এখন ১০৩ আর ১০৪ এর মাঝামাঝি নেমে এসেছে।’

আরহাম কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থাকল।এমন পরিস্থিতি তে সে আগে পড়েনি।তার কি করা উচিত?নবনীতাকে আগলে নেওয়া উচিত?কিন্তু সে এসবে অভ্যস্ত না।তার কেমন অদ্ভুত লাগে সবকিছু।সে শেষটায় তার একহাত নিজের হাতের মুঠোয় নেয়।কোমল কন্ঠে ডাকে,পরী,এ্যাই পরী!’

নবনীতা ক্ষণিকের জন্য টেনে টেনে চোখ খুলে।তার বুজে আসা চোখ দেখেই আরহাম অপ্রস্তুত হয়ে বলে,’বেশি খারাপ লাগছে পরী?’

নিজের প্রশ্নে তার নিজেরই বিরক্তি ধরে যায়।১০৩ ডিগ্রি জ্বর গায়ে নিয়ে শুয়ে থাকা মানুষ কে সে প্রশ্ন করছে খারাপ লাগছে কিনা।এর চেয়ে খাপছাড়া প্রশ্ন আর কি হতে পারে?

নবনীতা তার কথা শুনল নাকি বোঝা গেল না।একটু পরেই সে তার ডান হাত টা শক্ত করে চেপে ধরে তার হাতের পিঠে মাথা রেখে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো।আরহাম তার এহেন কাজে থতমত খেল।এসব কি হচ্ছে?নবনীতা কাঁদছে?আশ্চর্য ঘটনা।সে কখনো তাকে কাঁদতে দেখেনি।

নবনীতা হেঁচকি তুলে ডাকল,’বাবা,ও বাবা।একটু কথা বলো বাবা।’

আরহাম নিঃশ্বাস বন্ধ করে তার কথা শুনে।এতো বেশি অপ্রস্তুত সে আগে কখনো হয়নি।মেয়েটা তার বাবাকে ডাকছে।কিন্তু সেই মানুষটা বেঁচে নেই।সে আরহামকে সেই মানুষটার জায়গায় কল্পনা করছে।এমন একটা অপ্রীতিকর মুহূর্তে আরহামের কি করা উচিত?

নবনীতা ঘোরের মাঝে থেকেই ফুপিয়ে উঠে বলল,’আমি হেরে গিয়েছি বাবা।তারা সবাই আমাকে চরিত্রহীনা বলছে।বলছে আমি নাকি…’
সে কথা শেষ করতে পারে না,তার আগেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে।তারপরই আবার শরীরে একটু জোর এনে বলে,’তারা বলছে আমি নাকি শরীর বেঁচে আমার দুই বোনকে মানুষ করেছি।’
বলতে বলতেই সে হাউমাউ করে উঠে।

আরহাম চূড়ান্ত রকমের অপ্রস্তুত হয়ে ঘরে থাকা বাকিদের দিকে তাকায়।তারপরই চোখ সরিয়ে নেয়।কিছুটা লজ্জিত হয়ে মাথা নামিয়ে নেয়।

রিমি দ্রুত চিত্রা আর শুভ্রাকে সরিয়ে নিল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’এসো তো।আমরা অন্য ঘরে যাই।’

যাওয়ার আগে সে চাপা স্বরে আরহামকে বলল,’ভাইয়া কিছু প্রয়োজন হলে বলবেন।’

আরহাম সে কথার জবাব দেয় না।তার সমস্ত মনোযোগ খাটে শুয়ে থাকা মেয়েটির দিকে।যার শরীর তীব্র জ্বরে অল্প সল্প কাঁপছে।আরহাম তার হাতের উপর নিজের অন্য হাত টা রাখে।

কেয়ারিং হাসবেন্ড তথা যত্নবান স্বামীর সংজ্ঞা আরহাম জানে না।জীবনের কোনো এক মুহূর্তেও তার সেটা হতে ইচ্ছে করেনি।মনে হয়নি যে সে খুব বউয়ের যত্ন করবে।স্ত্রী কে নিয়ে তার চিন্তাভাবনা ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম।মেয়েদের যত্ন করা,তাদের আগলে নেওয়া এই বিষয় গুলো কোনোদিনই তার মস্তিষ্কে কিংবা চিন্তা চেতনায় স্থান করে নেয়নি।

অথচ সেই রাতে আরহাম হুট করেই নিজেকে চূড়ান্ত রকমের যত্নবান স্বামী রূপে আবিষ্কার করল।সে টের পেল তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর গায়ে যেই নোংরা কথা গুলো কাদার মতো ছোড়া হচ্ছে,এই কাদা তার শরীরেও আবর্জনা রূপে জমা হচ্ছে।তার রাগ হয়,জেদ হয়।মন চায় যারা যারা এসব করছে তাদের কষিয়ে দু’ঘা দিতে।

নবনীতার মাথায় চেপে রাখা কাপড় টা ক্রমশ গরম হয়ে যাচ্ছিল।আরহাম কয়েকবার সেটা পানিতে ভিজিয়ে তার সমস্ত মুখ,হাত,গলা এমনকি পায়ের পাতাও মুছে দিলো।এমনকি তাকে আগলে ধরে ঔষধও খাওয়ালো।

নবনীতা রাতভর শুধু ঘুরেফিরে এক কথাই বলল।থেমে থেমে অগণিত বার ডাকল,’বাবা,বাবা।তুমি প্লিজ আমার কাছে চলে আসো বাবা।আমি আর পারছি না।’

তার চোখের পানিতে বালিশ ভিজলো,ভিজলো আরহামের হাতও।আরহাম কাঁপা কাঁপা হাতে তার মাথায় হাত বুলায়।চাদরটা ঠিক মতো টেনে তার গায়ে তুলে দেয়।বিগত দিনের মতো আজও নিদ্রাহীন রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়।মাঝরাতেই নবনীতা আচমকা ফুপিয়ে উঠে,’বাবা! আমাকে তোমার কাছে নিয়ে যাও।প্লিজ বাবা।প্লিজ।’

আরহাম থমথমে মুখে তাকে দেখে।অজানা কারণে তার রাগ হচ্ছে।অভিমান হচ্ছে খানিকটা।কিন্তু সে বিনিময়ে একবারের জন্যও রাগ ঝাড়লো না।কেবল মুখটা নবনীতার কাছাকাছি এনে মৃদু ধ’মকের সুরে বলল,’এসব কেমন কথা পরী?বাবা নেই তো কি হয়েছে?আমি তো আছি।তাই না বলো?’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে