#কোনো_এক_শ্রাবণে [দ্বিতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(২৬)[দ্বিতীয় অংশ]
[রিচেক নেই।বুঝে নিয়েন কষ্ট করে]
একেবারে পরিপাটি পরিচ্ছন্ন একটি ঘর।দেয়ালে একটা সুন্দর ওয়াল পেইন্ট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।নবনীতার হাবিজাবি খরচার মাঝে এটাও অন্তর্ভুক্ত।সে বেতন হাতে পেয়েই এটা কিনেছে।
বাইরে খুব সুন্দর চাঁদের আলো।সেই আলোর সামান্য খানিকটা নবনীতার ঘরেও আসছিলো।কিন্তু বাল্ব জ্বালানোর কারণে সেই আলো আর বোঝা যাচ্ছিল না।নবনীতা চুপচাপ খাটের এক কোণায় বসেছিল।তার হাতে মুঠ করে রাখা ফুলদানি।আরহাম বাড়াবাড়ি করলেই সে তার মাথা ফা’টাবে।যদিও কারো মাথা ফাটানোর অভিজ্ঞতা তার নেই।যাক গে ব্যাপার না।অভিজ্ঞতা না হলে নতুন করে হবে।এটা আবার এমন কি?
দরজার লক ঘোরানোর শব্দতেই নবনীতা নড়েচড়ে বসল।ক্যাচ ক্যাচ শব্দে দরজা খুলেই আরহাম ভেতরে উঁকি দিয়ে একবার ভেতরের অবস্থা দেখল।নাহ,পরিস্থিতি ঠান্ডাই মনে হচ্ছে।সে আস্তে করে দরজা বন্ধ করল।ছিটকিনি তে হাত দিতেই নবনীতা চেঁচিয়ে ওঠল,’ঐটা লাগানোর কোনো দরকার নাই।বাইরে কোনো বাঘ সিংহ নেই যে আমাদের খেয়ে নিবে।’
আরহাম একবার তাকে দেখল।তারপরই শব্দ করে ছিটকিনি তুলে দরজা বন্ধ করল।পাশাপাশি লক ও করল।তারপর গট গট করে হেঁটে আসতে আসতে বলল,’আমার এভাবে দরজা খুলে উদাম হয়ে ঘুমানোর অভ্যাস নেই।আমি দরজা বন্ধ করে উদাম হয়ে ঘুমাই।’
আরহাম খুবই সাচ্ছন্দ্য হেঁটে এসে আরাম করে খাটে বসল।মাথার বালিশটা পিঠের পেছনে রেখে হেলান দিলো।ঘাড় ঘুরিয়ে একবার নবনীতাকে দেখল।নবনীতা দ্রুত চোখ নামিয়ে শক্ত করে ফুলদানি টা চেপে ধরল।অবস্থা ভালো না।পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলেই নবনীতা তার মাথা ফা’টিয়ে দু’ভাগ করবে।
আরহাম তাকে দেখেই কুটিল হেসে বলল,’হ্যালো সেনোরিটা।কেমন আছ?’
নবনীতা তীর্যক চোখে একবার তাকে দেখেই মাথা নামিয়ে নেয়।মনে মনে জবাব দেয়,’তোর সাথে বিয়ে হবার পর কেউ ভালো থাকতে পারে?’
অথচ মুখ ফুটে সে তেমন কিছুই বলল না।
আরহাম একটু কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে নেয়।তার কাটখোট্টা স্বরে মধু মাখিয়ে মেকি হেসে বলে,’তোমার মনে হয় না এখন আমাদের একটু সহজ হওয়া উচিত?’
নবনীতা এক শব্দে উত্তর দেয়,’না।’
আরহাম মুখ খিঁচিয়ে তাকে দেখে।একটু সময় নিয়ে উত্তর দিলেও তো পারত।এমন মুখের উপর কে উত্তর দেয়?সে তবুও ভদ্রতা দেখিয়ে বলল,’যাকগে,সেটা তোমার বিষয় তুমি কি করবে।আমারটা আমি বললাম।আমি এতো পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে পারি না।এসব ঝগড়াঝাটি মেয়েদের স্বভাব।তুমিও এখন থেকে আমার সাথে ভালো করে কথা বলবে।আমি তোমার হাসবেন্ড।বুঝেছ?’
নবনীতা ফুলদানি থেকে হাত ছেড়ে দুই হাত হাঁটুর উপর রাখল।মাথা নুয়িয়ে চাপা স্বরে বিড়বিড় করল,’নে’শাখোর একটা!’
আরহাম তার কথা শুনতেই তেঁতেঁ উঠে বলল,’এ্যাই বেয়াদব! তুমি কি বললে?’
নবনীতা অন্যদিকে চোখ সরিয়ে চুপচাপ সেদিকে দেখে।আরহামের দুই হাত নিশপিশ করছে।মন চাচ্ছে ঠাটিয়ে দু’টো চড় দিতে।কিন্তু এটা সম্ভব না।নবনীতার সাথে এসবে যেতে চায় না সে।নবনীতার কোনো ভরসা নেই।সে সিদ্ধান্ত নিল সে আর তাকে ঘাটাবে না।অনেক সৌজন্যে দেখিয়েছে।বিনিময়ে নে’শাখো’র তকমা পেয়েছে।এখন সে হাত পা ছড়িয়ে আরামের ঘুম দিবে।নবনীতার সাথে পরেও কথা বলা যাবে।বিয়ে হয়েছে তাদের।কথা বলার জন্য গোটা জীবনই পরে আছে।আপাতত ঘুমিয়ে যাওয়াই ভালো।
সে এক টানে গায়ের পাঞ্জাবি টা খুলে নিল।নবনীতা লাফ দিয়ে খাট থেকে নেমে হতবাক হয়ে বলল,’এসব কি?’
আরহাম নিজেও অবাক হলো।চোখ বড় বড় করে বলল,’কি আবার কি?গরম লাগছে আমার।’
‘এজন্য সব খুলে ফেলবেন?’
‘সব খুলিনি।পাঞ্জাবি খুলেছি।তুমি যেমন শাড়ি পাল্টেছ অনেকটা তেমন।’
নবনীতা চোখ পাকিয়ে বলল,’এতো শখ থাকলে বাড়ি যেতে পারলেন না?আরেকজনের বাড়িতে পড়ে আছেন কেন?’
আরহাম মহা বিরক্ত হয়ে জবাব দেয়,’সেটা তোমার মামাকে বলো না।আমাকে কেন বলছ?আমি কি তোমার সাথে থাকার জন্য হেদিয়ে মরছি?’
নবনীতা চুপচাপ আবার খাটে এসে বসল।তার পেঁচার মতো করে রাখা মুখটা একবার দেখেই আরহাম পিঠের পেছনে রাখা বালিশটা খাটে ফেলে তার উপর মাথা রাখল।খানিকটা আদেশের সুরে বলল,’ফ্যানের রেগুলেটর ঘুরিয়ে স্পিড বাড়াও তো।গরম লাগছে ভীষণ।’
নবনীতা কটমট করে বলল,’পারব না।নিজে উঠে বাড়ান।’
আরহাম চোখ বন্ধ করেই গাঢ় স্বরে বলল,’স্বামীর সাথে বোয়াদবি করতে নেই।যাও স্পিড বাড়াও।’
নবনীতা খাটের এক কোণায় রাখা ফুলদানি টা তুলে আরহামের মাথা বরাবর সেটা উঁচিয়ে ধরল।মন চাইছে এখনই এটা তার মুখ বরাবর ছেড়ে দিতে।কিন্তু সে এই কাজ করবে না।আর যাই হোক,সে পাগল না।ফুলদানি টা স্বস্থানে রেখে সে উঠে গিয়ে পাখার স্পিড বাড়ায়।আরহাম কতোক্ষণ এপাশ ওপাশ করে বিরক্ত হয়ে বলল,’এ্যাই পরী! একটা কোলবালিশ দাও তো।’
নবনীতা চোয়াল শক্ত করে জবাব দেয়,’পারব না।এতো আদর যত্ন করতে পারব না।কিছু বলছি না দেখে একটার পর একটা বলেই যাচ্ছেন।’
আরহাম চোখ খুলল।মুচকি হেসে বলল,’তাহলে কিছু বলো।এমন চুপ মেরে আছো কেন?’
নবনীতা কথা না বাড়িয়ে আলমারি থেকে কোলবালিশ বের করে আরহামকে দিলো।আরহাম সেটা পেতেই গাঢ় স্বরে বলল,’ধন্যবাদ।এমনই স্বামীর সেবা করতে থাকো।’
নবনীতা কথা বাড়ালো না।ঘরের বাতি নিভিয়ে চুপচাপ রুমের সাথে থাকা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো।আরহামা মাথা তুলে একবার সেদিকে দেখল।তার কি এখন ভালো জামাইয়ের মতো সেদিকে যাওয়া উচিত?গিয়ে সঙ্গ দেওয়া উচিত?নাকি আরামে একটা ঘুম দেওয়া উচিত?
আরহাম বেছে নিল শেষেরটা।সে হাত পা ছড়িয়ে মরার মতো ঘুম দিবে।বউদের বেশি প্যাম্পার করা উচিত না।বেশি লাই দিলে মাথায় উঠে যাবে।তখন এদের মাথা থেকে নামাতে কষ্ট হবে।বউদের বেশি ভালোবাসলে পরিণাম খুব একটা ভালো হয় না।আরহাম এর ভুক্তভোগী।সে নিজ চোখ দেখেছে।সে বারান্দায় গেল না।উল্টো নবনীতার মাথার বালিশটাও নিজের কাছে এনে সেটা তার মাথার উপর চেপে ধরল।এভাবে না ঘুমালে সে ঘুমুতে পারে না।
নবনীতা বারান্দার গ্রিলে হাত রেখে দাঁড়ায়।এখান থেকে চারদিকে দৃশ্য বেশ ভালো লাগে।আকাশটাও ভালো দেখা যায়।সে বাতি নেভানোর পরই টের পেল আজকের চাঁদটা বেশ বড়।হয়ত কাল কিংবা পরশুই পূর্ণিমা।নবনীতা বারান্দার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে ক্লান্ত শ্বাস ছাড়ে।
বিয়ে নিয়ে সে বিগত ছয় বছরে একটি বারও ভাবে নি।যত সম্বন্ধ এসেছিল,সে দুই মিনিটের জন্যও কিছু না ভেবে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছে।সে কখনোই সংসার কিংবা স্বামী এই বিষয় গুলো মস্তিষ্কে ঠাই দেয় নি।এখন ঘটনা প্রবাহে সে একজনের স্ত্রী।বিয়ে হয়েছে।ক’দিন বাদে সংসারও হবে তার।হবে অবশ্যই।সে কতোদিন আর পালিয়ে বেড়াবে?কিন্তু দুঃখের বিষয় যার সাথে তার বিয়ে হয়েছে তাকে তার পছন্দ না।
অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ এক জিনিস।নতুন করে দু’জন দু’জনকে চিনবে।এই ব্যাপারটা মানানসই।কিন্তু তার তো সেই অবস্থাও নেই।নতুন করে নিজের বর কে জানার কিছু নেই।তার বর যে কি জিনিস সেটা সে বিয়ের আগেই জেনে নিয়েছে।তার পরবর্তী দিনগুলো কেমন কাটবে ভাবলেই তার কেমন অসহ্য লাগে সবকিছু।
সে আবারো আকাশ দেখে।কৈশোরে বিয়ে নিয়ে টুকটাক কিছু ইচ্ছে ছিল তার।মনে হতো কোনো এক পূর্ণিমা রাত্তিরে বিবাহের পর নিজের বর কে নিয়ে সে চন্দ্র বিলাশ করবে।জীবনের ভালো মন্দ অসংখ্য গল্প তাকে শোনাবে।অথচ তার বিয়েতে সেরকম কিছুই হয় নি।
সে আধঘন্টা পর নিজ থেকেই ভেতরে এলো।চাঁদের আবছা আলো তে মোটামুটি সবকিছুই দেখা যাচ্ছিল।নবনীতা একবার অন্যমনস্ক হয়ে খাটের দিকে তাকাতেই তার দুই চোখ স্থির হলো।আরহামের ঘুমের ধরন দেখেই তার হাসি পেল।সে দ্রুত একহাতে তার মুখ চেপে ধরল।মুখে সেই হাসি ধরেই সামনে এগিয়ে গেল।
সাইডবক্সের উপর তার ফোন রাখা ছিল।সে সেটা হাতে নিয়েই চটপট তার কয়েকটা ছবি তুলে নিল।হাসি চেপে রাখার পরেও তার হাসি বেরিয়ে যাচ্ছিল।নিজের বাচ্চামো দেখে তার নিজেরই মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে।কিন্তু কি আর করার?মন কে যতোই শক্ত খোলসে ঢেকে রাখুক না কেন,সে তো সবসময়ই সুযোগ বুঝে সেই আগের নবনীতা কে খুঁজে আনার চেষ্টা করে।যেই নবনীতা ছয় বছর আগেই বিলীন হয়ে গেছে।যেই নবনীতা ছয় বছর আগেই নিজের ভালো থাকা ছেড়ে দিয়েছে।
নবনীতা তার টেবিলের উপর থেকে পুরোনো ফটো অ্যালবাম টা হাতে নেয়।পাতা উল্টে উল্টে নিজেদের পুরোনো ছবি দেখে।এগুলো দেখলেই সে ভীষণ আবেগী হয়ে যায়।বিশেষ করে বাবার ছবি দেখলে।সে তার মা কে ভালোবাসে না বিষয়টা একদমই এমন না।কিন্তু বাবাকে সে প্রচন্ড রকমের ভালোবাসে।বাবা তাকে ছোট বেলা থেকেই সাহসী রূপে বড় করেছে।বাবা তাকে জীবনের বহু পাঠ দিয়েছে।সে বাবাকে সাংঘাতিক ভালোবাসে।আজকের এই বিশেষ দিনে যতবারই চোখ বন্ধ করছে,ততবারই তার বাবার প্রতিচ্ছবি চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে।নবনীতা আলগোছে চোখ মুছে।বাবা সবসময় বলত নবনীতার জীবনে খুব ভালো কেউ আসবে।নবনীতার সংসার জীবন ভীষণ সুখের হবে।বাবার এই কথা মনে পড়তেই সে আরেকবার খাটের দিকে চোখ নেয়।আরহাম এখন বালিশ ছেড়ে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমুচ্ছে।নবনীতা হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে।বাবার এই সুন্দর দোয়া আল্লাহ কবুল করেনি।বাবা তার জীবনে যেই সুপুরুষের আগমন চেয়েছিল,সেই সুপুরুষ আর যেই হোক,আরহাম না।
নবনীতা চুপচাপ পাতা উল্টায়।তার ইচ্ছে ছিল বিয়ে হলে বরকে সারারাত বসে বসে তার পুরোনো অ্যালবাম দেখাবে।তার বর সেই ছবি দেখে আশ্চর্য হয়ে বলবে,’আরে! এটা তুমি?’
নবনীতা তখন একগাল হেসে মাথা নেড়ে বলবে,’হ্যাঁ।এটা আমিই।চেনা যাচ্ছে না তাই না?’
***
আকাশে চাঁদ উঠেছে।সেই সাথে আছে অগণিত তারা।শরৎ শুরু হতেই প্রকৃতির রূপ হুট করেই পাল্টে গেছে।আকাশ কিছুটা স্বচ্ছ দেখাচ্ছে।সেই আকাশ পানে দেখেই ওয়াজিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।হাতের সিগারেট টা শেষ হওয়ার পথে।সে তাদের বাড়ির ছাদে বসেছে।রেলিংয়ের দুই পাশে দুই পা ঝুলিয়ে।হঠাৎই ছাদের দরজায় কারো পায়ের আওয়াজ পেতেই সে ঘাড় ঘুরায়।তার থেকে বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কে দেখামাত্রই চমকে উঠে বলে,’কি রে?তুই?এতো রাতে?’
আদি নিঃশব্দে হেঁটে তার পাশে গিয়ে বসল।ঠিক তারই মতো করে দুই দিকে দুই পা ঝুলিয়ে।ওয়াজিদ তাকে সাবধান করে বলল,’ধরে বসবি কিন্তু।পড়ে যাবি না হয়।’
আদি গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’তোরা যে কি ভাবিস আমাকে বুঝি না।বিদেশে থাকি মানে এই না যে দেশের সবকিছু ভুলে গেছি।এতো আদিখ্যেতা করতে হবে না আমাকে নিয়ে।’
আদি কথা শেষ করেই ওয়াজিদের হাত দেখে।দেখেই বুক চাপড়ে বলে,’জানতাম।জানতাম তোকে এমন দেবদাস রূপেই দেখব।আমার আন্দাজ কখনো ভুল হয় না।’
ওয়াজিদ বিরক্ত হয়ে বলল,’কি যা তা বলছিস! দেবদাস কেন হতে যাবো?’
আদি মুখের হাসি মিলিয়ে নিল।গম্ভীর স্বরে ডাকল,’ওয়াজিদ!’
ওয়াজিদ ম্লান হাসল।ছোট করে বলল,’বল।’
‘আই ক্যান রিড আইস ওয়াজিদ।আমি চোখের ভাষা বুঝতে পারি মানুষের।স্পেশালি তোর আর আরহামের।’
‘হুম।আমি জানি।’
‘তুই তবুও আমার সামনে ভণিতা করছিস।’
‘কোথায় ভণিতা করেছি?তুই আমার কাছে কিছু জানতে চাস নি।চেয়েছিস কি?’
আদি শীতল কন্ঠে বলল,’জানতে চাই নি।কারণ যা বুঝার সেটা আগেই বুঝে গিয়েছি।’
ওয়াজিদ বিনিময়ে কেবল মলিন মুখে হাসল।আদি আরো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’তুই নবনীতাকে এখনো পছন্দ করিস?’
ওয়াজিদ দায়সারাভাবে জবাব দেয়,’নাহ।একসময় করতাম।এখন করা ছেড়ে দিয়েছি।’
আদি একটা শুকনো ঢোক গিলে।নিরেট স্বরে বলে,’আরহামও মেয়েটাকে পছন্দ করে।জানিস?’
‘জানি।জানি বলেই ছেড়ে দিয়েছি।নয়তো একবার হলেও বলতাম।’
ওয়াজিদ থামল।দীর্ঘসময় দুই পক্ষের মাঝে পিনপতন নিরবতা।তারপরই সব নিরবতাকে ছাপিয়ে ওয়াজিদ বলতে শুরু করল,’আই ট্রুলি বিলিভ আরহাম মেয়েটাকে পছন্দ করে।এবং আমি যতখানি ভেবেছিলাম,আরহাম তাকে তার চেয়েও বেশি পছন্দ করত।সেজন্যই নিজের পছন্দ ছেড়ে দিয়েছি।’
কথা শেষ করেই সে আদির বিষন্ন মুখটা একবার দেখে নিল।ওয়াজিদ আলগোছে হেসে বলল,’মন খারাপের কিছু নেই আদি।আমি মন থেকে বিশ্বাস করি নবনীতাই সেই মেয়ে যেই মেয়ে আরহামকে তার বদ্ধমূল ভ্রান্ত ধারণা থেকে বের করে আনতে পারবে।’
সে থামল।একটু শ্বাস নিল।জিরিয়ে নিয়ে বলল,’নবনীতাকে নিয়ে আমি আরহামের মধ্যে একটা সিগনিফিকেন্ট চেঞ্জ দেখতে পাই।আরহাম মেয়েটিকে পছন্দ করে।সিটি কলেজের সেই ঘটনার পর থেকে আমি তার মাঝে একটা অনুশোচনা,একটা অস্বস্তি,একটা মন খারাপের ভাব দেখতে পেতাম।সেই মন খারাপের পুরোটাই ছিল নবনীতাকে নিয়ে।তার সবসময় এটাই মনে হতো তার জন্য একটি মেয়ের নামে উল্টা পাল্টা কথা ছড়ানো হচ্ছে।এই বিষয়টি আমাকে অবাক করেছে আদি।আরহাম বিচলিত ছিলো একটি মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা তুলার বিষয়ে।যেই আরহাম কে আমি চিনতাম সেই আরহাম দিনরাত মেয়েদের গালমন্দ করত।সেই আরহামের মাঝে যখন আমি এই পরিবর্তন দেখলাম,তখন আমার মনে হলো আমার পিছিয়ে যাওয়াটাই উত্তম।তুই জানিস সে কি পরিমান পাগলামি অলরেডি করে ফেলেছে?
নবনীতার এক রিলেটিভ কে ধরে এনে থ্রেটও দিয়েছে সে যেন নবনীতার আশেপাশে না ঘুরে।ভাবা যায়?’
আদি গাঢ় স্বরে বলল,’একদম।আমারও এক ই কথা।আমি ভেবেছিলাম তোর ব্যাপারটা তাকে বলব।কিন্তু তার দিক থেকে যেই স্ট্রং ফিলিংস টা আমি উপলব্ধি করেছি,সেটার সামনে দাঁড়িয়ে আর কিছু বলতে ইচ্ছে হয়নি।আমার মনে হয়েছে সে খুব ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে।’
ওয়াজিদ মাথা নেড়ে এক লাফে ছাদে নেমে এলো।রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আদিকে দেখে ফিচেল হেসে বলল,’আমি ভেবেছিলাম সে কেবল ইনফেচুয়েশনে ভুগছে।তবে আমি নিজের কথা ফিরিয়ে নিয়েছি।সে মেয়েটিকে খুব বেশি পছন্দ করে।কিন্তু তার মেল ইগোর কারণে স্বীকার করছে না।তুই তো জানিসই কি পরিমান গোয়ার আর জেদি সে! ঐ জেদ ধরেই বসে আছে।আমি জানি নবনীতার সাথে সামনের দিনগুলো তে থাকতে থাকতে সে নিজের সমস্ত জেদ আর তেজ ছেড়ে দিয়ে নিজের সত্যিকারের স্বত্তাটিকে ফিরে পাবে।আর সেই আরহাম অবশ্যই নবনীতার শূন্য খা খা জীবনে শ্রাবণের বর্ষণ নামিয়ে আনবে।সবদিক ভেবে নিজের পিছিয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ মনে হলো আদি।নবনীতা কেবল আমার ভালো লাগা।কিন্তু তুই আর আরহাম আমার জীবনের অংশ।এমন একটি ব্যাপার নিয়ে আমি আরহামের সাথে আমার এতো বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারব না।আরহাম আর তোর সাথে কথা না হলে আমার সারাদিন কেমন মন খারাপ থাকে।নবনীতা জীবনে না থাকলেও চলবে,তবে এই জীবনে আরহামের থাকা টা জরুরি।’
আদি তার কথা শুনল মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায়।একটি ছেলে নির্দ্বিধায় নিজের অনুভূতিটুকু বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে।কারণ সে বন্ধুত্ব নষ্ট করতে চায় না।যেই বন্ধুত্ব শুরু হয়েছিল স্কুল জীবন থেকে।তারপর একে একে বাইশটি বছর কেটে গেছে।ক্লাস টু এর বেঞ্চে লিখে রাখা তিনটি নাম এখনও একসাথে আছে।তাদের মাঝে রক্তের সম্পর্ক নেই।তবে একটি চমৎকার সম্পর্ক আছে,আত্মার সম্পর্ক,বন্ধুত্বের সম্পর্ক।
আদি রেলিং থেকে নেমে শক্ত করে ওয়াজিদ কে জড়িয়ে ধরল।জড়ানো কন্ঠে বিড়বিড় করল,’তুই জীবনে খুব সুখী হবি ওয়াজিদ।আমার মনে হয় তোর জন্য আল্লাহ চমৎকার কিছু ভেবে রেখেছেন।মিলিয়ে নিস আমার কথা।’
ওয়াজিদ জবাবে কেবল এক গাল হাসল।ভবিষ্যৎ নিয়ে সে আর ইদানিং ভাবে না।সামনে কি হবে সেটা নিয়ে তার আগ্রহও কাজ করে না।মা তার জন্য মেয়ে দেখছে।মা যাকে বলবে ওয়াজিদ তাকেই বিয়ে করবে।এ বিষয়ে সে আর নতুন করে কিছু ভাবতে ইচ্ছুক না।
***
ঠিক রাত তিনটার দিকে এপাশ ওপাশ করতে গিয়ে আরহামের ঘুম ভাঙল।ঘুম ভাঙার পর আশপাশ দেখে সে বুঝতে পারল এটা তার ঘর না।একটু ধাতস্থ হতেই তার মনে পড়ল আজ তার বিয়ে হয়েছে আর এই ঘরটা নবনীতার।
মনে পড়তেই সে এক লাফে উঠে বসল।পুরো ঘর ফাঁকা।মেয়েটা গেল কোথায়?সে একবার বারান্দায় উঁকি দিলো।বারান্দা একদম ফাঁকা।আরহাম খুব বেশি মাথা ঘাটালো না।নিশ্চয়ই রিমিদের ঘরে গিয়েছে।সে আবারো ধপ করে শুয়ে পড়ল।পাশ ফিরতেই কিছু একটা দেখে সে হকচকিয়ে ওঠে।খাটের এক পাশে নবনীতার হাত দেখা যাচ্ছে।সে নিজের হাতের উপর মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে।
আরহাম দ্রুত খাট থেকে নামল।এগিয়ে এসে দেখল মেয়েটা বসে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছে।সে বসেছে ফ্লোরে,আর মাথা রেখেছে খাটে।আরহাম এগিয়ে এসে তার ঠিক মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসল।খেয়াল করল তার কোলের উপর একটা ফটো অ্যালবাম।আরহাম অতি সন্তর্পণে সেটি হাতে নিল।
ধীরে সুস্থে অ্যালবাম টা খুলতেই সে বুঝলো এটা নবনীতার ফ্যামিলি অ্যালবাম।আরহাম উঠে গিয়ে বারান্দার সামনের পর্দা গুলো দুই ধারে চাপিয়ে দিলো।তারপর আবারো হেঁটে এসে নবনীতার পাশাপাশি গিয়ে বসল।চাঁদের রূপালি আলোতে চারদিক ভালোই দেখাচ্ছে।কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন নেই।
আরহাম একে একে সবগুলো ছবি দেখল।দেখতে দেখতেই সে কিছুটা আশ্চর্য হলো।নবনীতার বাবার মুখটা খুব চেনা চেনা লাগছে।কোথাও দেখেছি কি?ঠিক মতো মনে পড়ছে না।কিন্তু সবচেয়ে অবাক করা বিষয় অ্যালবামের অধিকাংশ ছবিই নামি দামি রিসোর্টে তোলা,তার মধ্যে কিছু আবার দেশের বাইরে।আরহাম কেবল বিস্মিত নয়নে সেসব দেখে।ছবিতে যেই হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটিকে দেখা যাচ্ছে এই মেয়েটিই নবনীতা?এতো সুন্দর! কতো দামি দামি পোশাক! বাবাকে জড়িয়ে ধরে সে কি হাসি!বেশভূষা চালচলন সবকিছুতেই আভিজাত্যের ছোঁয়া স্পষ্ট।এতোটা আভিজাত্যের মাঝে থাকার পর এই মেয়েটি এই কষ্টের জীবনে কেমন করে মানিয়ে নিল?তার মা বাবা কোথায়?মা বাবা না থাকুক,কোনো আত্মীয় স্বজনই কি নেই?
আরহাম অ্যালবাম দেখতে দেখতেই অবাক হয়ে বলল,’এগুলো পরীর ছবি?বিশ্বাসই হচ্ছে না।সত্যিই পরীর মতো দেখাচ্ছে।’
সে অ্যালবাম বন্ধ করে পুনরায় সেটা নবনীতার কোলের উপর রাখল।চোখ মেলে একবার গভীর দৃষ্টিতে নবনীতাকে দেখতেই সে খেয়াল করল নবনীতা আজ চুল বাঁধে নি।এলোমেলো চুল সব মুখের উপর এসে ভীড় করছে।আরহাম কাঁপা কাঁপা হাতে তার মুখের সামনে থেকে চুলগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো।
একটি চাঁদের আলোয় আলোকিত রাত।সেই আলোতেই ছিমছাম ঘরটাতে আরহাম গালের নীচে হাত রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীকে খুটিয়ে খুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল।তার মুখ,তার কপাল,তার চোখ,তার ঠোঁট,তার নাক,তার গাল কোনোকিছুই বাদ গেল না।আরহাম সিদ্ধান্ত নিল বাকি রাতটুকু সে এভাবেই বসে থেকে কাটাবে।আরামে ঘুমানোর চেয়ে ফ্লোরে বসে বসে এই অপার্থিব সৌন্দর্য অবলোকন করা আরো বেশি ভালো।সে মুখে সূক্ষ্ম এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে নির্নিমেষ মেয়েটিকে দেখে গেল।তার নাম পরী।সে সত্যিই পরী।যে পরীকে আরহাম তার ঘরে আনতে চেয়েছিল।পরীটা অবশেষে তার ঘরে এসেছে।কি চমৎকার ব্যাপার!
নবনীতার চন্দ্র বিলাশের স্বপ্ন পূরণ হলো,সেটাও তার অগোচরে।সে জানলও না তার বর পুরো রাত জেগে জেগে শুধু তাকেই দেখেছে।তার তাকে অ্যালবাম দেখানোর ইচ্ছে ছিল।সেই সুপ্ত বাসনাও পূরণ হলো।কিন্তু মেয়েটা টেরও পায়নি।আরহাম আরো একবার হাত বাড়িয়ে তার চুলগুলো ঠিক করে দিলো।তার ইচ্ছে হচ্ছে নবনীতার একটি হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিতে।কিন্তু সেটা সম্ভব না।মেয়েটা জেগে যেতে পারে।সে আর মাঝরাতে কোনো ঝামেলা চায় না।সে হাসি মুখে আরো একবার তার দিকে তাকায়।অস্ফুটস্বরে বলে,’পরী! তোমাকে আমার এলোমেলো,ছন্নছাড়া আর উদ্ভ্রান্ত জীবনে স্বাগতম।’
চলবে-