কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-২৫(শেষ পর্ব)

0
10

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(২৫)

দুইদিন কড়া রোদ।তারপরই ধরণীর বুকে নেমে এসেছে এক পশলা ঝুম বৃষ্টি।সেই ঝুম বৃষ্টিতে গোটা শহর ভেসে গেছে।বৃষ্টির পানিতে কতো গ্লানি কতো ধুলোময়লা ধুয়ে গেছে।অথচ দুইটি প্রাণের মধ্যকার তীব্র অভিমান তখনও চলমান।

আজ বৃহস্পতিবার।বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আজ শ্রাবণের ত্রিশ তারিখ।কাল বর্ষার শেষ দিন।ওহহ হ্যাঁ,কাল নবনীতা নূরের শুভ বিবাহ।সন্ধ্যা নামতেই মেঘলা আকাশের মেঘপুঞ্জের আড়াল হতে উঁকি দিলো শত শত মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা,ভালো নাম নক্ষত্র।সেই নক্ষত্রগুলো জ্বলছিল।সেই দীপ্তিমান নক্ষত্র গুলোকে দেখে শুভ্রানী মলিন মুখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।কাল আপাইয়ের বিয়ে।আপাই আর তাদের থাকছে না।বিয়ের পর কাগজে কলমে সে শাহরিয়ার আরহামের স্ত্রী হয়ে যাবে।তখন তার একটা নতুন জীবন শুরু হবে।নিশ্চয়ই সে জীবনে শুভ্রা আর চিত্রার এখনের মতো এতো অধিকার থাকবে না?এখনের মতো আপাই আর চব্বিশ ঘন্টা তাদের নিয়ে ভাববে না।

শুভ্রা আলগোছে চোখ মুছে।আপাই কাল থেকে শুরু করে সকাল বিকাল সারাক্ষণ চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে।অথচ শুভ্রাকে দেখতেই এড়িয়ে যায়।চিত্রাকে সে মন ভরে আদর করে,কিন্তু শুভ্রা সামনে আসতেই সে না দেখার ভান করে পাশ কাটিয়ে যায়।অবহেলার মতো তীব্র যন্ত্রণা শুভ্রানী তার জীবনে আর দুটি পায় নি।এই নতুন শব্দের সাথে সে গত দুইদিনে পরিচিত হয়েছে।আপাই তাকে অবহেলা করছে।শুভিকে অবহেলা করছে তার আপাই?

‘শুভ্রা!’
ছাদের দরজা থেকে ডাক দিলো রিমি।দ্রুত এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়ালো।শুভ্রা দুই হাত ছাদের রেলিংয়ে রেখে ঘাড় কাত করে তাকে দেখল।রিমি তাকে দেখতেই আঁতকে উঠে বলল,’সে কি! তুমি কাঁদছিলে?’

শুভ্রা দ্রুত মাথা নাড়ে।রিমি মন খারাপ করে বলল,’এদিকে তুমি কাঁদছো,ঐদিকে তোমার বোন।কাল তার বিয়ে।তোমরা যদি এখন এমন করো তাহলে কেমন করে হবে শুভি?’

শুভ্রা চোখ মুছে।আর্দ্র গলায় বলে,’আমি আপাইয়ের কাছে মাফ চেয়েছি আপু।সেদিন রাতেই চেয়েছি।আপাই আমার কোনো কথারই জবাব দেয় না।এখন মনে হয় সেদিন তিনটার জায়গায় আরো কয়েকটা চড় মারতো,তাও ভালো ছিল।অন্তত মারার পর ঠিক মতো কথা তো বলতো।আপাইয়ের অবহেলা আমি নিতে পারছি না।তুমিই বলো এই শব্দটা কি আমার পরী আপাইয়ের সাথে যায়?’

রিমি সহানুভূতি দেখিয়ে তার কাঁধে একটা হাত রাখল।পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য অল্প হেসে বলল,’মাফ চাইলে তো সব মিটে যায় না শুভি।তুমি তাকে সত্যিই আঘাত করেছ।ছু’রির আঘাতে শরীরে ক্ষ’ত হয়,আর কথার আঘাতে মনে।তুমি কথা দিয়ে আঘাত করেছ।তাও তোমার বোনকে।যে বোন জীবনের সকল আনন্দ বিসর্জন দিয়ে তোমাকে আর চিত্রকে মানুষ করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল।কেবল একটি বাক্যে বলে দিলে,বাঁচতে দাও আমাদের।নবনী কি তোমাদের বাঁচতে দিচ্ছিলো না শান্তিতে?তোমরা একটু শান্তিতে বাঁচার জন্য মেয়েটা নিজের শান্তি শেষ করেছে।আমি অবাক হয়েছি শুভ্রা।যেই নবনীতার বোনদের প্রতি ভালোবাসা দেখে আমি তাকে ভালোবেসেছি,সেই নবনীতার বোন হয়ে তুমি এই কাজ কেমন করে করলে?সে তোমার পরী আপাই ছিল।যেই আপাইয়ের নিজের বলতে কেবল তুমি আর চিত্রই ছিলে।’

রিমি থামল।টের পেল শুভ্রার শরীর কাঁপছে।একটু সময় গড়াতেই সকল নিরবতাকে ছাপিয়ে শুভ্রা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল।দু’হাত মুখে চেপে অস্ফুটস্বরে বলল,’সেভাবে বলতে চাইনি আপু।কসম করে বলছি।বলতে চেয়েছিলাম একভাবে,বলে ফেলেছি আরেকভাবে।আমি আপাইকে কষ্ট দিতে চাইনি।সত্যি বলছি।আমি মুখ ফসকে যা তা বলেছি।’

শুভ্রা থামল।কান্নার দরুন তার হেঁচকি উঠে গেছে।সে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বলল,’কলেজে ব্যাচমেট রা ভীষণ নোংরা কথা বলে আপাইকে নিয়ে।তারা বলে আরহাম ভাই অনেক বড়লোক।তাই আপার সাথে সময় কাটাতো।কিন্তু সে তো আর আপাইকে বিয়ে করবে না।কিন্তু তারা তো জানে না আমার বোনই আরহাম ভাইয়ের সাথে বিয়ে টা বাতিল করে দিয়েছে।তুমি বলো তো আপু,আরহাম ভাই কি এতো জঘন্য?আপাই কি একটি বারের জন্যও তার সাথে বিয়ের ব্যাপারটা ভেবে দেখতে পারত না?’

রিমি ঠান্ডা স্বরে বলল,’শুভ্রা! নবনীতার একটা নিজস্ব জীবন আছে।তার সেই অধিকার আছে যে কাকে বিয়ে করবে,আর কাকে করবে না সেটা নির্ধারণ করার।নবনীর তো আগেও অনেক বিয়ে এসেছিল।তখন তো তুমি এমন করোনি।উল্টো তখন চেয়েছ বিয়েটা যেন ভেঙে যায়।তোমার বোন তোমারই থাকুক।এখন একজনকে পছন্দ হওয়াতে তুমি তোমার বোনকে জোর করতে পারো না।তারও একটা পছন্দ আছে।বিয়ের মতো নাজুক বিষয়ে তারও মতামত থাকতে পারে।তুমি কি একটু বেশিই বলে ফেলেছ না সেদিন শুভ্রা?’

শুভ্রা মিনমিনে স্বরে জবাব দেয়,’সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে করতেই তো শেষ হয়ে যাচ্ছি আপু।আপাই তিনদিন যাবত আমার সাথে কথা বলে না।এর চেয়ে বড় শাস্তি জীবনে আর কি হতে পারে?আপাইয়ের কাল বিয়ে হবে।তারপর হয়তো আমি আর চিত্র কখনোই মন খারাপের দিনগুলোতে আপাইয়ের বুকে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে পারব না।সেই আপাইকে কেবলই আমাদের আপাই হিসেবে পাওয়ার আজকে শেষ দিন।অথচ আমি তাকে জড়িয়ে ধরতে পারছি না।’

কথা শেষ করেই শুভ্রা পুনরায় ফুঁপিয়ে উঠে।সে মন থেকে সেরকম কিছু বলতে চায়নি।একদিকে কলেজের মানুষের কথা,অন্যদিকে বিয়ে তে আপাইয়ের প্রত্যাখ্যান,সব মিলিয়ে সে যা তা বলেছে।কিন্তু এখন এসব ভেবে কি লাভ?যা বলার তা তো বলেই ফেলেছে।আর তো সেটা ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না।

রিমি মৃদু স্বরে বলল,’থাক শুভি।এসব ছাড়ো।যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে।আমি তোমার বোনকে চিনি।তোমাদের ছাড়া সে থাকতে পারে না।বিয়ের আগে সে অবশ্যই তোমার সাথে কথা বলবে।নবনীতা এমনই।তার দু’টো কলিজার টুকরোর সাথে সে এতো লম্বা সময় অভিমান করে থাকতেই পারবে না।’

রিমি কথা শেষ করে ধীর পায়ে নিচে চলে গেল।এই ক’দিন যাবত ভীষণ ব্যস্ততায় দিন যাচ্ছে তার।নবনীতা বিয়ের জন্য রাজি হয়েছে।মন থেকে যদিও বিয়েতে মত দেয়নি।কিন্তু বিয়েটা তো হচ্ছে।রিমি হচ্ছে দুই পক্ষের কমন ম্যান।সে কনে পক্ষের সাথেও আছে,আবার বর পক্ষের সাথেও আছে।আদি কিংবা আরহাম যেকোনো প্রয়োজনে তাকেই ফোন দেয়।একটু আগেও আদি তাকে ফোন দিয়েছে।নবনীতার জন্য নাকি আরিশ আর তাসনুভা মিলে একটা শাড়ি কিনেছে।সেটা নাকি তারা পাঠিয়ে দিবে রাতেই।রিমি নিচে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দেয়।শারমিন নামের একজন ভদ্রমহিলা কে আরহাম বিকেলের দিকে পাঠিয়েছে নবনীতার ফ্ল্যাটে।শারমিনের রান্নার হাত ভালো।নবনীতার ক্ষুদ্র পরিসরের বিবাহ অনুষ্ঠানের সব রান্না শারমিনই করবেন।রিমি কেবল তাকে টুকটাক সাহায্য করে।রিমি রান্না ঘরে উঁকি দিতেই দেখল শারমিনের পাশাপাশি সেখানে নবনীতাও আছে।সে দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এলো।পাশে দাড়িয়ে জানতে চাইল,’কিরে তুই এদিকে?’

নবনীতা দুধ জ্বাল দিতে দিতে গাঢ় স্বরে বলল,’চিত্র কাস্টার্ড খেতে চেয়েছে।তাই বানাচ্ছি।’

রিমি বিরক্ত হয়ে বলল,’তো এটা আমাকে বলা যেত না?তুই আবার রান্নাঘরে আসতে গেলি কেন?কাল না তোর বিয়ে?’

নবনীতা স্টোভের আঁচ কমিয়ে পাশ ফিরে রিমিকে দেখল।কিছুটা ক্লান্ত আর বিরক্ত স্বরে বলল,’বিয়ে হলে কি রান্নাঘরে আসা যায় না?আর আমি তো এই বাড়ি ছেড়ে যাচ্ছিও না।এখানেই আছি আমি।রান্নাঘরে আসলে সমস্যা টা কি?’

‘নাহ সমস্যা কিছু নেই।এমনিই বললাম আরকি।’

রিমি তার থেকে চোখ সরিয়ে শারমিন খালাকে দেখে।তার হাতে একটা স্টিলের বাটি।রিমি তার দিকে দুই কদম এগিয়ে এসে বলল,’এটা কি?হলুদ?’

শারমিন কেবল উপরনিচ মাথা নাড়ে।আড়চোখে একবার নবনীতা নামের মেয়েটিকে দেখে।এর সাথে নাকি কাল বড় সাহেবের বিয়ে হবে।শারমিনের তো একে দেখলেই বুক ধুকধুক করে।বড় সাহেবের যা রাগ! তার উপর তার সাথে যুক্ত হয়েছে এই মেয়ে।দু’জন মিলে দু’জনকে মে’রে ফেললেও তো কেউ টের পাবে না।

মেয়েটি সুদর্শনা,তাতে তোনো সন্দেহ নেই।তার গায়ের বাসন্তী রঙের জামাটি তে তাকে খুব মানাচ্ছে।বড় সাহেবের সাথে এই মেয়ের জুটি বাইরে থেকে বেশ চমৎকার হবে।মেয়েটির মুখে মায়া আছে,একটা অস্পষ্ট অসহায়ত্ব আছে।কিন্তু কন্ঠের তেজ এক বিন্দুও কমে নি।শারমিন তাকে বলেছিল একটা কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ি গায়ে জড়াতে।এতেই সে যা কটমট করে জবাব দিলো,তাতেই শারমিন পুরোপুরি দমে গেছে।

রিমি তার হাত থেকে হলুদের বাটি নিজের হাতে নিল।তারপর নবনীতার কাছে এসে সেখান থেকে অল্প একটু হলুদ আঙুলে নিয়ে নবনীতার দুই গালে ছোঁয়াল।চরম বিরক্তিতে নবনীতার কপাল কুঁচকে গেল,অথচ মুখে সে কিছুই বলল না।তার সমস্ত মনোযোগ তার কাজে।তার চুলগুলো এলোমেলো করে বেঁধে রাখা।এক ফালি চুল মুখের উপর পড়ে আছে।চোখ জোড়া অতিশয় শান্ত।গালে হলুদ ছোঁয়ানোর পর তাকে নববধূর মতো লাগছে।

এমন সময়ই কলিংবেল বেজে উঠল।রিমি দরজার দিকে ছুটতে ছুটতে বলল,’শুভি এসেছে নিশ্চয়ই।বেচারির মন খারাপ।তাকেও হলুদ ছুঁয়িয়ে দেই।’

সে এক দৌঁড়ে গিয়ে দরজা খুলেই সাথে সাথে তার হাত বাড়িয়ে সামনে থাকা মানুষকে হলুদ ছোঁয়ায়।অথচ সামনে দাঁড়ানো মানুষটি শুভ্রা ছিল না।রিমি তাকে দেখেই হকচকিয়ে ওঠে।তাজ্জব হয়ে বলে,’ভাইয়া আপনি?’

সে ভেবেছিল শুভ্রা।তাই শুভ্রার গালে লাগানোর মতো আন্দাজে হলুদ মেখেছিল।অথচ সেই হলুদ লেগেছে ওয়াজিদের ঘাড়ে আর গলায়।রিমির চেয়েও বেশি চমকাল ওয়াজিদ।সে চোখ বড় বড় করে বলল,’এসব কি?’

রিমি সে উত্তর দেয় না।হঠাৎই তার মনে হলো তার গায়ে কোনো ওড়না নেই।কেবল আছে ঢিলেঢালা একটা কুর্তি।সে সঙ্গে সঙ্গে ওয়াজিদের মুখের উপর ধাম করে দরজাটা বন্ধ করে দিলো।ওয়াজিদ নিজেই তার এমন আচরণে হকচকিয়ে গেল।এই মেয়ের কি সত্যি সত্যি কোনো মানসিক সমস্যা আছে নাকি?এমন মুখের উপর দরজা বন্ধ করে কেউ?

রিমি এক দৌঁড়ে নিজের ওড়না হাতে নিয়ে আবারও দরজার দিকে ছুটল।দরজা খুলেই বোকা হেসে বলল,’সরি সরি।আমি ভেবেছিলাম আপনি শুভি।নেভার মাইন্ড।’

ওয়াজিদ চুপচাপ ভেতরে আসল।আসতে আসতেই বিড়বিড় করে গালি দিলো,’নেভার মাইন্ডের বাচ্চা!’

রিমি তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এসে বলল,’আদি ভাইয়া আর আরিশের না আসার কথা ছিল?আপনি কেন এসেছেন?’

ওয়াজিদ শীতল চোখে একবার তাকে দেখে।সেই চাহনিতে ভড়কে গিয়ে রিমি বলল,’না মানে।জানতে চাইলাম আরকি তারা কোথায়।’

ওয়াজিদ কিছু বলতে যাচ্ছিল,তার আগেই আদি ব্যস্ত পায়ে এপার্টমেন্টে ঢুকতে ঢুকতে বলল,’গুড ইভিনিং রিমি।’

রিমি সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরল।আদিকে দেখেই প্রশস্ত হেসে বলল,’ভাইয়া আপনি এসেছেন!’

আদি আরাম করে সোফায় বসে গা ঝাড়া দিয়ে বলল,’তো আসবো না?আমাকে ছাড়া ফেসটিভ জমে নাকি?’

রিমি জোরে জোরে মাথা নাড়ে,’না একদমই না।’

আদি সরু চোখে একবার ওয়াজিদকে দেখতেই প্রশ্ন করল,’কি রে?তুই এমন হলুদ মেখে বসে আছিস কেন?বিয়ে টা কি তোর হচ্ছে?’

ওয়াজিদ থমথমে মুখে একবার রিমির দিকে তাকায়।তারপরই কোনো কথা না বলে টি-টেবিলের উপরে রাখা টিস্যুর বক্স থেকে টিস্যু হাতে নিয়ে বেসিনের দিকে এগিয়ে যায়।আরিশ লিফট থেকে বেরিয়ে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে এপার্টমেন্টের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।গাড়ি পার্কিং করে আসতে আসতে তার আর আদির দেরি হয়ে গিয়েছে।যাওয়ার পথেই তার শুভ্রার সাথে দেখা হয়।শুভ্রা ছোট ছোট পা ফেলে ছাদ থেকে নেমে এসেছে মাত্র।

আরিশ তাকে দেখেই সৌজন্যসূচক হাসল।পরক্ষণেই শুভ্রার ফোলা ফোলা চোখ দু’টো দেখে অবাক হয়ে বলল,’কি হয়েছে শুভ্রা?তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?’

শুভ্রা চোখ তুলে একনজর তাকে দেখল।তারপরই আবার চোখ নামিয়ে নিল।আরিশ কিছু একটা বুঝে ফেলার ভান করে হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,’বুঝেছি।তোমার আপাইয়ের বিয়ে হয়ে যাবে সেজন্য মন খারাপ।তাই না?মন খারাপের কিছু নেই।তোমার আপাই তো তোমার কাছেই থাকবে।মন খারাপের কি আছে?’

শুভ্রা অন্যদিনের মতো আজ আর হাসিমুখে কিছু বলল না।যেমন করে মাথা নামিয়ে রেখেছিল তেমন করে মাথা নামিয়েই সে প্রস্থান নিল।আরিশ কিছুটা চমকালো,কিন্তু গায়ে মাখল না।হয়তো কোনো কারণে মন খারাপ।হতেই পারে।তার কি?

সে বসার ঘরে গিয়েই আদির পাশাপাশি বসল।তার হাতে একটা শপিং ব্যাগ।আজ বসুন্ধরা থেকে সে আর তাসনুভা মিলে নবনীতার জন্য শাড়ি আর জুয়েলারি পছন্দ করে কিনেছে।আফরোজা ফুফুর বিয়ে নিয়ে কোনো আগ্রহ কিংবা কৌতূহল নেই।আরিশ আর তাসনুভাই সবকিছু নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে।

আরিশ তার হাতের ব্যাগটা রিমির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’আপু এটা রাখো তোমার কাছে।আমি আর তাস এটা আপুর জন্য পছন্দ করেছি।’

রিমি হাসিমুখে ব্যাগটা হাতে নেয়।মন খারাপ করে বলে,’তাসনুভা কে আনলে না কেন?সে থাকলে ভালো লাগতো।’

আদি চুল ঠিক করতে করতে খানিকটা আফসোস করে বলল,’আর বলো না।এইটুক কেনাকাটা করেই সে টায়ার্ড।রাতে আবার ঔষধ খেতে হয়।তাই আর আনি নি।সমস্যা কি?কাল তো আসবেই।’

রিমি জবাবে কেবল মাথা নাড়ল।তখনি নবনীতা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো।সে মাথায় ঘোমটা দিয়েছে।তাকে সত্যি সত্যি নববধূর মতো দেখাচ্ছে।ওয়াজিদ তাকে দেখেই দ্রুত চোখ নামিয়ে নিল।তার দৃষ্টি মার্বেলের টাইলস বসানো ফ্লোরের দিকে।নবনীতা তাদের সামনে এসেই থমথমে মুখে বলল,’খেয়ে যাবেন আপনারা।রান্না হয়ে গেছে।’

কথা শেষ করেই সে একটা ট্রে তে কয়েকটা কাস্টার্ডের বাটি তুলে তাদের সামনে নিয়ে রাখল।নিচু স্বরে বলল,’আগে এটা খেয়ে নিবেন।’

বলেই সে শম্বুক গতিতে হেঁটে নিজের ঘরে চলে গেল।আরিশ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল,’এখনো মন খারাপ আপুর?’

আদি নিজেও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,’তাই তো মনে হচ্ছে।যাক গে,এসব কোনো ব্যাপার না।ঠিক হয়ে যাবে সব।একটু সময় দে।’

সে রাতে তারা রাতের খাবার নবনীতার ফ্ল্যাটেই করল।চিত্রা পুরোটা সময় তাদের সাথে ছিল।আর শুভ্রা ছিল নিজের ঘরে,বইয়ের পাতায় মুখ গুজে।তার বইয়ের পৃষ্ঠা গুলো ভিজে যাচ্ছিল তার চোখের পানিতে।সে পানি মুছে আবার পড়ার চেষ্টা করল।কিন্তু গত তিনদিনে সে সত্যি বলতে কিছুই পড়েনি।মনটা ভীষণ আকুপাকু করছিল তার।সে শেষমেশ উঠে দাঁড়ায়।এক দৌঁড় দেয় নবনীতার ঘরের দিকে।

নবনীতা তখন ঘরেই ছিল।সে একটু আগে নামাজ শেষ করেছে।তারপর এই বাদল দিনেই ঠান্ডা পানিতে গোসল করেছে।চুলে প্যাচানো তোয়ালেটা দিয়ে চুল মোছার সময় কোথা থেকে ছুটে এসে শুভ্রা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।নবনীতা তার আকস্মিক ছুটে আসাতে দুই কদম পিছিয়ে গেল।তাল সামলে নিতেই কঠিন গলায় বলল,’আমাকে ছাড়ো শুভ্রানী।কাজ আছে আমার।’

শুভ্রা মাথা তুলে।হতবাক হয়ে বলে,’আপাই! আমি তোমার শুভি।শুভ্রানী কেনো বলছ?’

নবনীতা নিজেকে তার থেকে সরিয়ে নিল।চুলের পানি ঝাড়তে ঝাড়তে গাঢ় স্বরে বলল,’তুমি কি আমি জানি।যাও খাবার রান্না হয়েছে।খেয়ে নাও।’

সে এগিয়ে যায় কিছুটা সামনে।হঠাৎই ঘুরে দাঁড়িয়ে শুভ্রাকে দেখে হাসি মুখে বলে,’বিয়ে করছি আমি কাল।তোর ন’ষ্টা বোন কাল বিয়ে করছে।এবার থেকে তোরা শান্তিতে বাঁচবি।’
.
.
.
.
আরহাম তার জীবনে জীবনসঙ্গী রূপে চেয়েছিল একেবারে স্বামীভক্ত,ঘরকোণে,সংসারী আর স্বল্প শিক্ষিত মেয়ে।যতটুকু শিক্ষা না জানলেই নয়,অতটুকু জানাই যথেষ্ট।এর বেশি জানার তো কোনো প্রয়োজন নেই।আরহাম স্ত্রী হিসেবে যে মেয়েটিকে চেয়েছিল,সেই মেয়ের মাঝে অবশ্যই নিজেকে আরহামের বাড়ির চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে রাখার মতো মানসিকতা থাকা দরকার ছিল।

অথচ আরহামের সাথে এমন কিছুই হয়নি।যে মেয়েটির সাথে তার বিয়ে হচ্ছে,সেই মেয়েটি উচ্চশিক্ষিত।পদার্থবিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে।মেয়েটা মোটেই নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে বন্দি করে রাখার মতো চিন্তাভাবনা পোষণ করে না।স্বামীভক্ত হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।উল্টো স্বামীর নাম শুনতেই সে মুখ কুঁচকে নেয়।

মেয়েটি চাকরি করে।আশ্চর্যের ব্যাপার আরহামই তাকে চাকরি দিয়েছে।সে প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ।মেয়েটি সাহসী,প্রতিবাদী,স্পষ্টভাষী।মোদ্দা কথা,মেয়েদের ব্যাপারে যা কিছু আরহামের অপছন্দ তার সবটাই এই মেয়ের মাঝে আছে।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,এতোগুলো অপছন্দের বিষয় তার মাঝে বিদ্যমান থাকা স্বত্তেও আরহামের তাকে পছন্দ।

সবকিছু ছাপিয়ে তার যেই স্বত্তাটি শাহরিয়ার আরহামকে মুগ্ধ করেছে,তা হলো তার ‘পরী আপাই’ নামক রূপভেদ।একটি তেইশোর্ধ তরুণী।যে তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর বয়সের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে।অথচ সেই সুন্দর সময়টা সে নষ্ট করছে তার বোনদের মানুষ করার কাজে।অদ্ভুত বিষয়! তার চোখে দেখা মা নামক স্বত্তাটি যেখানে নিজের স্বামী সন্তান ফেলে অন্যত্র চলে গিয়েছে,সেখানে পরী আপাই নামের একটি চমৎকার মানবী কেবল তেইশ বছর বয়সে নিজেকে মাতৃসম বোন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে।দুইটা বোনকে নিয়ে সে যেই বাস্তবিক সংগ্রামে নেমেছে,সেই সংগ্রামে আরহাম তার সহযোদ্ধা হতে যায়।পরী যখন ক্লান্ত হয়ে যাবে,তখন সে তার মাথায় হাত রেখে বলতে চায়,’ভয় নেই পরী।আমি আছি।এই দেখো,আমি আছি।’

পরদিন সকালেই আরহাম আলমারি ঘেটে একটা কালো পাঞ্জাবি বের করল।আজ শুক্রবার।জুমার নামাজ শেষ করে তারা নবনীতাদের বাড়ি যাবে।খুবই সাধারণভাবে তাদের বিয়ে হবে।নবনীতা চেয়েছিল রিসেপশনের আগ পর্যন্ত কিছুদিন যেন সে নিজের বাড়িতেই থাকে।এ কথা সে আদিকে বলেছে।আরহাম অবশ্য তাতে কোনো দ্বিমত পোষণ করেনি।দ্বিমত পোষণ করার মতো কিছু সে পায়নি।সে চেয়েছে পরীকে সমাজের লোকজনের কটু কথা থেকে মুক্তি দিতে।সে চেয়েছে পরীকে মাথা উঁচু করে বাঁচার সুযোগ করে দিতে।এক সাথে ঘর বাঁধা তো তার উদ্দেশ্য ছিল না।ঘর বাঁধা পর্যন্ত তো সে কখনো ভাবে নি।

আফরোজা বেগম সকাল থেকেই মুখ ফুলিয়ে রেখেছেন।তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এই বিয়েতে তিনি যাবেন না।মাথাব্যাথার বাহানা দিয়ে বাড়িতে পড়ে থাকবেন।এই বিয়ে উপলক্ষে তার কোনো আগ্রহ কিংবা উচ্ছ্বাস নেই।তিনি এখনো বিশ্বাস করতে পারছেন না আরহাম এমন একটি মেয়েকে বিয়ে করছে যার শিক্ষাগত যোগ্যতা স্বাভাবিকের চাইতেও অনেক বেশি।এতোগুলো দিনে তো আরহাম কখনোই এমন কোনো মেয়েকে বিয়ে করার কথা বলেনি।

আফরোজা বেগম তার স্বামীর মৃ’ত্যুর পর তাদের গ্রামের বাড়িতেই থাকতেন।দেবর ভাসুরদের নানা অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে তিনি তার মামাতো ভাইয়ের কাছে চিঠি লিখেছিলেন।আজিজ হোসেন তখন শয্যাশায়ী।তার শরীরে বাসা বেঁধেছিল ম’রণব্যাধি ক্যা’ন্সার।তাসলিমা তখন সংসার ছেড়ে আজিজ সাহেবেরই সহকর্মী নোমান কে বিয়ে করেছিলেন।

আফরোজার চিঠির জবাব এসেছিল অনেক পরে।ডাকযোগে কোনো ফিরতি পত্র আসেনি।বরং তাদের মফস্বলে একটি ছেলে এসেছিল তার খোঁজে।তার নাম শাহরিয়ার আরহাম।সে এসেই আফরোজা বেগম কে অনুরোধ করেছিল।বলেছিল,’ফুফু আমার একটা ছোট বোন আছে বাড়িতে।তাকে দেখার মতো কেউ নেই।সে সিঁড়ি থেকে পড়ে প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে।আপনি কি তার একটু যত্ন করবেন?’

ব্যাস,তখন থেকেই শেখ আজিজের প্রাসাদ তুল্য বাড়িতে আফরোজা আর তার মেয়ে সারাহ’র ঠাই হলো।তখন থেকেই আফরোজা মনে মনে পরিকল্পনা করেছিলেন সারাহ’র বয়স হতেই তিনি তার সাথে আরহামের বিয়ে দিবেন।আরহামের এমনিতেও বিয়ে নিয়ে কোনো মাথা ব্যাথা নেই।আফরোজার কথা সে নিশ্চয়ই ফেলে দিতো না।অথচ আফরোজা কে আশ্চর্য করে নিয়ে তার সাথে একটু আলোচনা না করেই আরহাম নিজের বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে।আফরোজা কে বুঝিয়ে দিয়েছে সে তার জীবনের ব্যাপারে ভ্রক্ষেপ করার কেউ না।যাক গে,সে যখন কেউ না তখন তার আর বিয়েতে গিয়ে কাজ নেই।সে বাড়িতেই থাকবে।বাকিরা যাক বিয়ে খেতে।আফরোজা ঐ মেয়ের মুখও দেখতে চায় না।

***

আজ তাসনুভা জীবনে প্রথমবার শাড়ি পরেছে।তার শাড়ি পরার এই অদ্ভুত আবদার পূরণ করেছে আদি।পার্লার থেকে দু’টো মেয়ে ঘরে এনে সে তাদের বলেছে তাকে শাড়ি পরিয়ে দিতে।তারাই ধরে ধরে তাকে শাড়ি পরিয়েছে।একটু কষ্ট হয়েছে,তবে তাসনুভাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছে শাড়ি পরার পর থেকে।সে একেবারে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পরেছে।পার্লারের মেয়ে দু’টো তার চুল সেট করে চলে গেল।আদি তাদের বিল পে করেই তাসনুভার দরজায় টোকা দিয়ে বলল,’আসবো বাচ্চা?’

তাসনুভা দ্রুত জবাব দেয়,’আসো না।দেখো কতো সুন্দর করে শাড়ি পরিয়েছে!’

আদি তার ঘরে গেল।তাকে উপরনীচ দেখেই অবাক হয়ে বলল,’তোমাকে এখন আর বাচ্চা বাচ্চা মনে হচ্ছে না।মেয়ে মেয়ে মনে হচ্ছে।’

তাসনুভা ঠোঁট টিপে হাসল।বলল,’আমি বাচ্চা নই।উনিশ বছর হয়ে যাবে ক’দিন বাদে।’

আদি হাত নেড়ে দায়সারাভাবে বলল,’সে যাই হোক।আমার কাছে তুমি বাচ্চাই।’

নামাজ শেষ করে ঐ বাড়িতে রওয়ানা দিতে দিতে দু’টোর উপরে বেজে গেল।তাসনুভা গাড়িতে উঠেই পেছন ফিরে একবার পেছনের সিটে বসা সারাহ কে দেখল।এক বস্তা মেকআপ মুখে ঢেলে দিয়েছে সে।কালো রঙের একটা শাড়ি আর হাতাকাটা ব্লাউজ।তাসনুভা তাকে দেখেই নাক ছিটকায়।আরিশের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলে,’এই ছাগলটা এসব কি পরেছে?বড় ভাইয়া কি এসব দেখে না?দেখে একটা চড় মারতে পারে না?’

আরিশ তাকে আলতো করে চিমটি কেটে বলল,’আহা থাম তো।এসব কথা পরে বলিস।এখন বিয়ের চিন্তা কর।’

তাসনুভা থামল।কিছু একটা চিন্তা করেই খুশিতে গদো গদো হয়ে বলল,’আমি চিন্তা করছি আমাদের কেনা শাড়িটা গায়ে জড়ানোর পর আপুকে কত্তো সুন্দর লাগবে! ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে আমার।’

আদি তাকে বাঁধা দিলো।সংশোধন করে বলল,’আপু না।বলো ভাবি।সে আজ থেকে আমাদের ভাবি।মিসেস আরহাম।’

****

‘ইশশ নবনী! তোকে কত্তো সুন্দর লাগছে! একদম সত্যি সত্যি পরী।মাশাআল্লাহ! কারো নজর না লাগুক।’

নবনীতা বসে আছে কোনো একটা জড় পদার্থের মতো।না নড়ছে,না মুখ ফুটে কোনো প্রতিবাদ করছে।সে আনমনে একবার আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে।গাঢ় লাল জামদানী,গলায় আর কানে কুন্দনের গয়না।কপালে টিকলি,এর পাশে আবার ঝাপটা।রিমি আধ ঘন্টার উপরে তাকে সাজিয়েছে।এখন তাকে দেখাচ্ছে পুরোপুরি নতুন বউ।

শুভ্রা ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়েছিল।মুগ্ধ চোখে সে একবার তার আপাইকে দেখে।কি সুন্দর! কি স্নিগ্ধ! আপাইকে এতো চমৎকার দেখাচ্ছে কেন?রিমি মনে করে তার খোপায় গাজরা লাগাতেও ভুলল না।সব মিলিয়ে নবনীতাকে দেখাচ্ছিল বাড়াবাড়ি রকমের সুন্দর।বিবাহের পাত্রী হিসেবে খুব বেশি মোহনীয়।

রিমি তাকে সাজিয়ে নিজে শাড়ি পরল।সাদা আর নীলের মিশেলে কারুকাজ করা একটা শাড়ি।শাড়ি পরেই সে বিভাকে সামান্য একটু কিছু খাইয়ে দিলো।তারপর চিত্রা কে রেডি করল।তারপর শুভ্রার কাছে এসে বলল,’যাও না শুভি।বসে আছো কেন?তুমিও রেডি হয়ে যাও।’

শুভ্রা মলিন হেসে বলল,’যাবো আপু।’

চিত্রা রেডি হতেই পুরো বাড়ি ছুটাছুটি করছিল।সে ঘরে আসতেই নবনীতা খপ করে তার হাতটা ধরে তাকে টেনে নিজের কাছে আনল।কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’এভাবে কেউ ছুটোছুটি করে?ব্যাথা পাবে না তুমি?’

এরই মাঝে শারমিন হন্তদন্ত হয়ে ঘরে এলো রিমির খোঁজে।ব্যস্ত হয়ে বলল,’রিমি ম্যাডাম কোথায়?বরের গাড়ি তো চলে এসেছে।’

রিমি মাশকারা লাগাতে লাগাতে তাড়াহুড়ো করে বলল,’সর্বনাশ! এতো আগে এসে পড়েছে?’

‘আগে কোথায়?তিনটা বাজে।’

রিমি সব সাজগোজের জিনিস ফেলে দরজার দিকে ছুটল।শারমিন কে তাড়া দিতে দিতে বলল,’শরবতের গ্লাস গুলো রেডি না খালা?তাড়াতাড়ি আমার হাতে দাও।’

আরহাম রিমিকে দেখেই একগাল হাসল।রিমি তাকে সালাম দিলো।সবাই কে বসার ঘরে বসিয়ে শরবত খেতে দিলো।আদি শরবত খেয়েই বলল,’কাজি সাহেব আমাদের সাথেই আছে রিমি।আপাতত খাওয়ার ঝামেলা টা থাকুক।অনেক বেলা হয়েছে।আগে বিয়ে টা হয়ে যাক।তাতেই সবার ভালো।’

রিমি মাথা নাড়ল।নবনীতার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল,’জ্বী জ্বী কোনো সমস্যা নেই।আমি নবনীতাকে নিয়ে আসি।’

সাদেক সাহেবকে ওয়াজিদ আর আদি মিলে ধরে ধরে বসার ঘরে এনেছে।তাকে বসানো হয়েছে আরহামের মুখোমুখি থাকা সোফাতে।যেখানে একটু পরে নবনীতাকে বসানো হবে।আরহাম তাকে দেখতেই উঠে গিয়ে সালাম করল।তারপর আবার নিজের জায়গায় গিয়ে বসল।

রিমি ঘরে যেতেই নবনীতা তাকে দেখে কাঠকাঠ স্বরে বলল,’কি হয়েছে?এখনই বিয়ে হবে নাকি?’

রিমি ছোট করে জবাব দেয়,’হু’

সে তাকে ধরার আগেই নবনীতা নিজ থেকে উঠে দাঁড়ায়।খুবই সাবলীল গতিতে দরজার দিকে এগিয়ে যায়।শুভ্রা দরজার এক কোণায় গুটিগুটি মেরে দাঁড়িয়েছিল।নবনীতা ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়ালো।ম্লান হেসে বলল,’আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি শুভ্রানী।তোমাকে আর আমার কারনে হেনস্তা হতে হবে না,আমার কারণে আর তোমার কোচিং মিস দিতে হবে না।দোয়া করি আমার মতো জঘন্য মানুষ যেন তোমার জীবনে আর না আসে।দুঃখীত! আমি তোমার কাছে মাফ চাইছি।আর কোনোদিন তোমার কষ্টের কারণ হবো না।তুমি ভালো থাকো।’

নবনীতা কথা শেষ করেই সোজা হেঁটে গেল বসার ঘরের দিকে।শুভ্রা দু’হাতে মুখ চেপে ছুটলো নিজের ঘরের দিকে।রিমি স্তব্ধ হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।তারপরই একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালো।

নবনীতা খুব স্বাভাবিক ভাবে সাদেক সাহেবের পাশে গিয়ে বসল।তার ইদানিং নিজেকে অনুভূতিশূণ্য মনে হয়।আরহাম চোরা চোখে একনজর তাকে দেখে।একবার দেখার পরই সে সব ভুলে ড্যাব ড্যাব করে তাকে দেখতেই থাকে।এই মেয়েটিকে দেখে তার মাথায় একটি শব্দই আসছে।সেটা হলো-“ভয়ংকর সুন্দর”।

কাজি গোলাম সিদ্দিক রেজিস্টার খাতা খুলে বিয়ে পড়ানো শুরু করেন।নবনীতা টের পায় এই মুহূর্তে এসে সে সাংঘাতিক রকমের দুর্বল হয়ে পড়েছে।আশ্চর্যের বিষয় তার দুই চোখ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।সে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছে না।আজ তার দু’জন মানুষের কথা খুব মনে পড়ছে।তার বাবা আর তার মা।বাবা নামের বটবৃক্ষটি আর তার পাশে নেই।সেই মায়াভরা মুখের অধিকারী লোকটা তার সাথে নেই।তার পরীর আজ বিয়ে হচ্ছে,অথচ সে দেখতে পাচ্ছে না।নবনীতা বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারছে না।মা নামের পৃথিবীর অমূল্য রত্নটি তার কাছে নেই।নবনীতা একা,খুব বেশি একা।

কবুল বলতে গিয়ে সে টের পেল তার কথা জড়িয়ে যাচ্ছে।সে কিচ্ছু বলতে পারছে না।তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।সে শেষমেশ কাঁপা কন্ঠে রিমিকে বলল,’চিত্রকে একটু এদিকে পাঠা রিমি।প্লিজ।’

রিমি দ্রুত চিত্রার খোঁজে এদিক সেদিক তাকায়।সে একটু সামনে যেতেই নবনীতা তাকে পিছু ডাকে।জড়ানো কন্ঠে বলে,’আমার শুভিকেও পাঠিয়ে দিস প্লিজ।’

পরী আপাই পরাজিত হয়েছে।যেই স্বচ্ছ আর নির্মল ভালোবাসায় সে এতোটা বছর শুভি আর চিত্রকে আগলে রেখেছিল,সেই পরী আপাই জীবনের এমন একটি মুহূর্তে অভিমান ধরে রাখতে পারে নি।শুভ্রা তার সামনে আসতেই সে খপ করে তার হাত টা ধরে নিল।কান্না গিলে অসহায় গলায় বলল,’আপাইকে মাফ করে দিস শুভ্রা।আপাই তোদের খুব বেশি ভালো রাখতে পারি নি।ভাবিস না অভিমান থেকে বলছি।অভিমান না,আমি সত্যিই ভালো রাখতে পারি নি তোদের।’

শুভ্রা সোফাতে বসেই তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কতোক্ষণ হাউমাউ করে কাঁদলো।নবনীতা অবশ্য শব্দ করে কাঁদে নি।কেবল দীর্ঘশ্বাসের সাথে এক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়েছে।সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দুই হাতে শক্ত করে তার দুই বোনকে আগলে ধরে।

কাজি গোলাম সিদ্দিক আবারো বললেন,’গুলশান নিবাসী মরহুম শেখ আজিজ হোসেনের জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ শাহরিয়ার আরহাম তোমায় নগদ চার লক্ষ টাকা দেনমোহর প্রদানে বিবাহ করিতে ইচ্ছুক।তুমি কি এই প্রস্তাবে রাজি?রাজি থাকলে বলো কবুল।’

নবনীতা দীর্ঘসময় চুপ থাকে।কাজি সাহেব কিছুটা ভড়কে গিয়ে তাকে দেখে।লাল শাড়ি পরিহিত অনিন্দ্য সুন্দরী মেয়েটি দীর্ঘসময় কাঠের পুতুল হয়ে বসে থাকার পর একটু নড়েচড়ে উঠে।অনুভূতি গুলো সব দলা পাকিয়ে গলার কাছে আটকে গেছে।সে কথা বলবে কেমন করে?

শেষটায় শুভ্রা আর চিত্রাকে ছেড়ে সে নিজের শাড়ির কুচির দিকটা খাঁমচে ধরে।সব অনুভূতি গিলে নিয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,’কবুল কবুল কবুল।’

তারপরই দায়সারাভাবে কাবিননামায় সাক্ষর করে।একবার চোখ তুলে সামনে বসে থাকা যুবকটিকে দেখে।তার সাথে এই মাত্র নবনীতার বিয়ে হয়েছে।সে এখন থেকে তার স্বামী।যেই স্বামী কে দেখামাত্রই কিছু কৎসিত স্মৃতি নবনীতার মস্তিষ্কে ভেসে উঠে।

আর তারপর?একটি সাক্ষর আর কবুল বলার মাধ্যমে দু’টি প্রাণ বাঁধা পড়ল পরিণয় নামক বন্ধনে।যারা কেউ জানে না সামনের দিনগুলো কেমন করে যাবে।যারা কেউ এখনো ঠিক মতো নিজেদের চিনেই উঠতে পারেনি।শুধু পরিস্থিতির পরিক্রমায় আজ তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।প্রকৃতি কিংবা নিয়তি,যাই বলা হোক না কেন।সেটাই তাদের এই অব্দি নিয়ে এসেছে।জুতো জোড়া হারায়নি,তবে চিত্রার কথা কে সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে সিনড্রেলার রাজকুমার সত্যিই তাকে খুঁজে নিয়েছে।যে তাকে টুপ করে ধরে নিয়ে টুশ করে বিয়ে করে ফেলেছে।

****সমাপ্ত****[প্রথম অধ্যায়]

{প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত হয়েছে।পরশু থেকে শুরু হবে দ্বিতীয় অধ্যায়।যেটা পুরোটাই হবে আরহাম আর নবনীতার বিবাহিত জীবনকে কেন্দ্র করে।উনত্রিশ মিনিটের মধ্যে প্রায় ১৮০ জন ভোট দিয়েছিলেন আমি যেন ধীরে সুস্থে সবগুলো চরিত্র নিয়ে গল্পটা লিখি।আমিও সেটাই করব।আরহাম আর নবনীতার বিবাহিত জীবনের সবকিছু আমি গুছিয়ে সময় নিয়ে লিখবো।সাথে পার্শ্ব চরিত্র গুলোকেও তুলে ধরব।যারা এতো এতো ভালোবাসা দিয়ে এ পর্যন্ত পড়েছেন তাদের কে অনেক অনেক ধন্যবাদ।দ্বিতীয় অধ্যায়ে আবারো আপনাদের ভালোবাসা পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।আরেকটি বিষয়,দ্বিতীয় অধ্যায়ে রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়ের চেয়ে তাদের সংসার জীবনের বর্ণনাই বেশি থাকবে।আগেই জানিয়ে দিলাম।}

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে