#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(২৪)[প্রথম অংশ]
নতুন কিনে আনা ড্রেসিং টেবিলটি শুভ্রানীর ভীষণ পছন্দ হয়েছে।এতে তার চেহারা খুব ভালো দেখায়।পুরোনো ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালে তাকে জঘন্য দেখাতো।সে তার হাতে থাকা কলাপাতার রঙের জামাটা কাঁধের কাছে চেপে ধরে নিজেকে একবার আয়নায় দেখে নেয়।
নবনীতা আধশোয়া হয়ে ম্যাগাজিন পড়ছিল।শুভ্রাকে দেখেই সে চোখ তুলে বলল,’শুভি! তুই কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিস না।এতো সাজার কিছু নেই।’
শুভ্রা মুখ ফুলিয়ে বলল,’বিয়ের অনুষ্ঠান না হোক।সংবর্ধনা অনুষ্ঠান তো।এটাও আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’
সে আবার নিজের কাজে মন দেয়।আবার কিছু একটা মনে পড়তেই পেছন ফিরে বলল,’তুমি রেডি হচ্ছো না কেন?’
নবনীতা আড়মোড়া ভেঙে অলস ভঙ্গিতে জবাব দেয়,’হবো।এখন ভীষণ আলসেমি লাগছে।তুই আগে রেডি হ।রেডি হয়ে আমাকে ডেকে দিস।’
শুভ্রা চোখ বাঁকিয়ে একনজর তাকে দেখে।যেকোনো অনুষ্ঠানে যেতে নিলেই তার যত আলসেমি শুরু হয়।আজ তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠান।কলেজ থেকে তাকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।কতো মানুষ আসবে।শুভ্রার তো ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।আর আপাইয়ের মাঝে কোনো উৎসাহ নেই এ’নিয়ে।যখন থেকে সে শুনেছে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি শাহরিয়ার আরহাম,তখন থেকে সে এমন একটা চেহারা বানিয়ে রেখেছে যেন এই অনুষ্ঠানটা কোনো অনুষ্ঠানের পর্যায়েই পড়ে না।তার না আছে কোনো আগ্রহ,না আছে কোনো চঞ্চলতা।
অনুষ্ঠান ছিল বিকেল তিনটায়।নবনীতা আর শুভ্রার পৌঁছুতে পৌঁছুতে বেজে গেল তিনটা বিশ।তারা যে সময় সেখানে গিয়ে পৌঁছুলো,তখনই আরহামের গাড়িও সেখানটায় এসে থামল।কলেজের সামনে থাকা গার্ডরা এগিয়ে এসে চারদিক ঘিরে ধরল।একজন পাশ ফিরে নবনীতাকে দেখতেই কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,’আরে আপনি দূরে যান।দেখছেন না স্যারের গাড়ি আসছে?’
নবনীতা চোখ বড় বড় করে বলল,’দূরে যাব মানে?আমরাও তো অনুষ্ঠানে এসেছি।আপনারা কি আমন্ত্রিত অতিথিদের সাথে এমন ব্যবহার করেন?এগুলো কেমন কথা?’
লোকটা তার কথায় ভ্রুক্ষেপ তো করলোই না,উল্টো দ্বিগুণ বিরক্ত হয়ে বলল,’অন্য কোথাও গিয়ে প্রতিবাদ করেন আপা।আমন্ত্রিত অতিথি আর প্রধান অতিথির মাঝে অনেক পার্থক্য আছে।যান সরেন আপনি।’
নবনীতা চোয়াল শক্ত করে সরে দাঁড়ায়।গার্ডরা ছুটে গিয়ে গাড়ির দরজা খুলে দেয়।গাড়ির ভেতর থেকে ফিটফাট বেশভূষায় বেরিয়ে আসে একজন যুবক।তার নাম শেখ শাহরিয়ার আরহাম।কলেজের প্রিন্সিপাল তাকে দেখতেই এগিয়ে এসে করমর্দন করলেন।কুশল বিনিময় করলেন।আরহামও হাসিমুখে তার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলল।
কলেজের ভেতর যেতেই ছাত্রছাত্রীরা দুই দিক থেকে ফুল ছিটিয়ে তাকে স্বাগতম জানাল।আরহাম হাসিমুখে তাদের আপ্যায়ন গ্রহণ করল।এটাই তো তার প্রাপ্তি।তার পরিচিতি,সম্মান,মানুষের ভালোবাসা সবকিছুই তো তার কাছে দারুণ উপভোগ্য মনে হয়।
অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিক চোখ নিতেই সে দেখল দূরে একটা বিশালাকার জাম গাছের নিচে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।বরাবরের মতোই তার দুই হাত বুকে বাঁধা।দৃষ্টি শান্ত,মুখটা থমথমে।আরহাম একপেশে হাসল।সে সব সময়ই এমন গ্যাংস্টার হয়ে থাকে কেন?সে কি সত্যিই নিজেকে দাবাং ভাবে নাকি?
আরহাম আর সেসব ঘাটায় না।রোদচশমা টা চোখের উপর চাপিয়ে সে সোজা সামনে হেঁটে যায়।কিন্তু শেষ মুহূর্তে না চাইতেও সে আরো একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে।মেয়েটার চুলগুলো আজও বেণি বাঁধা।তাকে হয় খোপা,নয়তো বেণিতে দেখা যায়।সে কি একটু চুল ছাড়তে পারে না?সেদিন যখন সে ছুটে এসে তাকে আগলে ধরেছিল,তখন তো তার চুল খোলা ছিল।তাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছিল।আরহাম তাকে সেই রূপে আরো একবার দেখতে চায়।পরী আপাই কি তাকে সে সুযোগ করে দিবে?
আরহাম মুচকি হাসে।কখনোই না।
অনুষ্ঠান শুরু হতেই একে একে সবাই বক্তব্য রাখল।নবনীতা অডিটোরিয়ামের মাঝামাঝি কোনো একটা জায়গায় বসেছিল।মানুষের এতো ঘ্যান ঘ্যান তার ভালো লাগে না।আরহামকে যখন তার বক্তব্য রাখার জন্য মাইক্রোফোনের সামনে ডাকা হলো তখন নবনীতা তার কন্ঠ নকল করে ন্যাকা সুরে বলল,’আমি শেখ শাহরিয়ার আরহাম।আমার বাবা প্রয়াত সংসদ সদস্য শেখ আজিজ হোসেন।আমি খুব চালাকির সাথে জনগণের টাকা মে’রে দিব।আর জনগণ টেরও পাবে না।তারা অবাক হয়ে বলবে এই সুন্দর ছেলেটা কতো সুন্দর করে চুরি করে! হেহেহে,দেখছ আমি কতো চালাক।’
শুভ্রা মুখ শক্ত করে তার দিকে তাকায়।প্রতিবাদ করে বলে,’একদমই না।আরহাম ভাই সেরকম মানুষ না।সব নেতাই অমন হয় না।’
নবনীতা তার কথা গ্রাহ্য করল না।উল্টো গা ছাড়া ভাব নিয়ে বলল,’হয়েছে হয়েছে।তোর আরহাম ভাই কতো ভালো জানা আছে।মাত্র তো রাজনীতিতে আসল।বছর যেতেই দেখবি আমেরিকায় রাজপ্রাসাদ বানিয়ে ফেলেছে।এদের আমার চেনা আছে।’
সে নাক ছিটকে সামনে দেখে।নিজের কাজে সে মোটেই লজ্জিত না।শুভ্রা আর চিত্রার ঐ লোকের জন্য একটু বেশিই টান।এতো টান থাকা ভালো না।মাঝে মাঝে তার নিন্দে করলে সেই টানে কিছুটা ভাটা পড়বে।সে সামনে তাকায়।কটমট চোখে আরহাম কে দেখে।আরহাম মাইক্রোফোন হাতে নিয়েই বলল,’আমি শেখ শাহরিয়ার আরহাম।আমার বাবা প্রয়াত সংসদ সদস্য শেখ আজিজ হোসেন।’
নবনীতা মুখে ওড়না চেপে কতোক্ষণ হাসল।সে জানতো এই লোক মাইক পেলেই শুরুর দুই মিনিট বাপের কেচ্ছা শুনাবে।বাপ ভক্ত পুত্র একদম।হঠাৎই কিছু মনে পড়তে নবনীতা একটু ভাবুক হলো।এর কি মা নেই?সারাদিন বাবা বাবা করে,মায়ের কথা তো বলে না।মা কি বেঁচে আছে নাকি সেও প্রয়াত?নবনীতা আনমনে বিড়বিড় করে,’ম’রে গেলে তো মুখ ফুটে বলার কথা।’
নিজের কথায় সে নিজেই লজ্জিত হয়।দ্রুত তওবা কাটে।তার সমস্যা আরহামের সাথে।খামোখা এখানে মা বাবাকে টেনে আনার কোনো মানে নেই।
সে চটপট সংবর্ধনায় মন দেয়।আরহাম কথার ফাঁকেই তাকে একনজর দেখে।দেখতেই দ্রুত চোখ সরিয়ে নেয়।একে দেখলেই সে ভুলভাল কিছু বলে ফেলবে।আপাতত সেদিকে না দেখাই ভালো।
সবার বক্তব্য শেষ হতেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মূল পর্ব শুরু হলো।শিক্ষা,ক্রিড়া,আবৃত্তি,সঙ্গীত,নৃত্য সব ক্যাটাগরিতেই পুরষ্কারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।নবনীতা মাথা নিচু করে নিজের হাতটা দেখছিল।সে আজকে ধূসর রঙের জামা পরেছে।বুকের উপর ফেলে রাখা ওড়নাটার রং কুচকুচে কালো।আজ তার অফিস নেই।তাকে ছুটি দেওয়া হয়েছে।সে মাঝে মাঝে অবাক হয়।যেদিনই তার কাজ থেকে সেদিনই কেন তাকে বিনাবাক্যে ছুটি দেওয়া হয়?এই অফিসের অথোরিটি এতো ভালো কেন?নবনীতা রোজ দোয়া করে,অফিসের সিইও যেন একশো বছর বাঁচে।
মাইক্রোফোনে শিক্ষা ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করার সময় যখন ডাকা হলো,’পুষ্পিতা নূর,তুমি যেখানেই আছো,মঞ্চে আসো’ তখনই নবনীতা নড়েচড়ে উঠে।দ্রুত হাতে থাকা মুঠোফোনটি উপরে তুলে ক্যামেরা অন করে।আনন্দে তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।শুভ্রা ছুটে যায় মঞ্চের দিকে।নবনীতা শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে থাকে।তার চোখ আর্দ্র হয়।শুভিটা কতো বড় হয়ে গেছে! সে দ্রুত ক্যামেরা তাক করে তার দিকে।
আরহাম শুভ্রাকে দেখতেই উঠে দাঁড়ালো।একগাল হেসে বলল,’কনগ্রেচুলেশানস শুভ্রা।জীবনে আরো অনেক দূর এগিয়ে যাও।’
জবাবে শুভ্রাও হাসল।স্বচ্ছ হাসি।স্টেজের সামনেই ক্যামেরা ম্যান দাঁড়ানো ছিল।শুভ্রা আরহামের হাত থেকে পুরষ্কার নিতে নিতে সেদিকে ফিরে হাসল।আরহামও সামনে দেখল।তবে তার দৃষ্টি অন্যদিকে।সে দেখছে অডিটোরিয়ামের মাঝামাঝি সারিতে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীটির দিকে।যে কি-না শুভ্রা আর আরহামের এমন হাসিখুশি মুখটা দেখেই তেলে বেগুনে জ্বলে যাচ্ছে।এমন ভাবে কটমট করে তাকাচ্ছে যেন আরহাম তার থেকে তার বোনদের কেড়ে নিচ্ছে।
নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে কয়েকটা ছবি তুলল দু’জনের।শুভ্রা আর চিত্রা এই লোককে মারাত্মক পছন্দ করে।অথচ নবনীতা ভেবে পায় না এর মধ্যে পছন্দ করার মতো কি আছে?এ তো একটা আস্ত ভন্ড।সে যেটা দেখায় সেটা সে মোটেও না।নেতাদের সে ভালো করে চেনে।এদের মতো হিপোক্রেট আর দু’টো নেই।
***
‘জ্বী ভাই।একদম অথেনটিক নিউজ।ঐ নবনীতা আরহামের কোম্পানির অফিসেই চাকরি নিয়েছে।পাশাপাশি এখন সে যে বাড়িতে থাকে,সেটার মালিকও আরহাম।’
মিলন কথা শেষ করেই উৎসুক চোখে সামনে তাকায়।ফাহাদ তখন তার বাড়ির ড্রয়িং রুমের ইজিচেয়ারে বসে দোল খাচ্ছিল।মিলন থামতেই সে সরু চোখে বলল,’ঐ নবনীতা জানে এসব?’
‘না ভাই।তাকে বলা হয়েছে এ বাড়ি ভাড়ায় চলে।অফিসের এমপ্লয়ি হিসেবে তার জন্য কিছুটা কম রাখা হয়েছে ভাড়া।’
ফাহাদ কুটিল হাসল।পায়ের উপর পা তুলে ভরাট গলায় বলল,’বাপরে! জল তাহলে এতোদূর।’
সে থামে।পুনরায় নিজ থেকে বলে,’আরহামকে আমি চিনি।অতো দরদী তো সে না।অন্তত নিজের কোম্পানিতে কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রে সে কখনোই এতো উদাসীন থাকে না।রাজনীতিতে সে ঘোড়ার আন্ডা,কিন্তু তার ব্যবসায়ীক বুদ্ধি চমৎকার।সে খুব চ্যুজি মানুষ।এতো সহজে সে কখনোই কাউকে নিয়োগ দেয় না।তার মনে যে অন্যকিছু আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।’
মিলন চাপা স্বরে বলল,’ভাই আমার মনে হয় সে মেয়েটিকে পছন্দ করে।তার পারসোনাল গাড়িটা প্রতিদিন ধানমন্ডি এরিয়াতে যায়।গিয়ে নবনীতা যেই বিল্ডিং এ থাকে,সেই বিল্ডিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে।’
‘বাহ চমৎকার।এবার তো তাহলে একটা কেলো বাঁধাতেই হয় দেখছি।’
সে আয়েসি ভঙ্গিতে ইজিচেয়ারে দোল খেতে খেতে বলল,’আরহাম আজ কোথায়?’
মিলন চট করে জবাব দেয়,’সে তো আজ সিটি কলেজের অনুষ্ঠানে গিয়েছে।’
কথা শেষ করে সে আরেকটু এগিয়ে আসে।ফাহাদের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে,’নবনীতাও আজ সেখানে আছে ভাই।’
.
.
.
.
কো’কেইন,মেথাম’ফেটুমিন,এ্যাভা’নাফিল-বহুল ব্যবহৃত তিনটি ড্রা’গ।প্রথমটি নেশা’দ্রব্য হিসেবে অহরহ ব্যবহৃত হয়।বাকি দুইটি নেশা দ্রব্য হিসেবে সুপ্রসিদ্ধ না হলেও নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে এদের কার্যকারিতা যথেষ্ট ভালো।এ্যাভা’নাফিল ব্যবহৃত হয় উত্তেজনা বর্ধক হিসেবে।দীর্ঘদীন ডিপ্রেশন কিংবা মনোরোগে ভুগতে থাকা ব্যক্তিদের প্রফুল্ল রাখার জন্য এবং আনন্দদায়ক অনুভূতি তৈরি করার জন্য মেথাম’ফেটুমিন ব্যবহার করা হয়।এরা প্রত্যেকেই সুনির্দিষ্ট কাজে ব্যবহৃত হলেও সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের শরীরে এরা কাজ করে অন্যভাবে।এদের প্রভাবে স্নায়ু কিছু সময়ের জন্য অবশ হয়ে যেতে পারে,ব্যক্তি নিজের ইচ্ছার বাইরে গিয়ে অযোচিত কাজ করতে পারে,কখনো আবার নিজের ফিজিক্যাল নিডস গুলো প্রকট আকারে প্রকাশ করে ফেলতে পারে।
বিকেলের দিকে যখন আরহাম সহ বাকি অতিথিদের জন্য শরবত বানানো হলো তখন নাফিজ প্রিন্সিপালের রুমে ছুটে গিয়ে বলল ট্রে টা সে নিয়ে যেতে চায়।সে নিজেও কলেজের স্টুডেন্ট।তার কথা শুনে বিনা কোনো প্রশ্নের তার হাতে শরবতের গ্লাস সাজানো ট্রে টা তুলে দেওয়া হলো।সে ট্রে টা নিয়ে নিরাপদ দুরত্বে এসেই একটা গ্লাসে তার পকেটে থাকা কাগজের টুকরোয় রাখা পাউডার জাতীয় মিশ্রণটি ঢেলে দিলো।তাকে এটা দিয়েছে মিলন।বলেছে শরবতে এটা মিশিয়ে আরহামকে খাওয়াতে পারলেই পাঁচ হাজার টাকা দেবে।সাথে আরো একটা কাজ করতে হবে।সেটা করলে সে পাবে আরো পাঁচ হাজার।নাফিজ দ্রুত পাউডারের মিশ্রণ টি শরবতে মেশায়।যেখানে তিনটা শক্তিশালী ড্রাগ আছে,সাথে আছে হাই ফ্লেভাবের অরেঞ্জ পাউডার,যেন বাকি ঔষধের উটকো গন্ধ কারো নাকে না লাগে।
সে গিয়েই সবার প্রথমে সেটা আরহামের দিকে বাড়িয়ে দিলো।আরহাম সেটা হাতে নিয়েই ঢক ঢক করে একটানে খেয়ে শেষ করল।তার সত্যিই ভীষণ তেষ্টা পেয়েছিল।খাওয়া পর্যন্ত সবকিছু ঠিকই ছিল।বিপত্তি বাঁধে একটু পরে।আরহাম টের পায় তার হাত কাঁপছে।গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।অডিটোরিয়ামের এসির বাতাসেও তার পুরো শরীর ঘেমে যাচ্ছে।
পরিস্থিতি টের পেয়েই সে তড়াক করে উঠে দাঁড়ায়।তার পাশাপাশি চেয়ারে থাকা ভদ্রলোক ব্যস্ত হয়ে জানতে চায়,’কি হয়েছে? আপনি ঠিক আছেন?’
আরহাম পকেট থেকে টিস্যু বের করে মুখ মুছে।সে ঠিক নেই।তার ভেতর অদ্ভুত কিছু একটা ঘটে যাচ্ছে।তার দাঁত কিড়মিড় করছে।নিষিদ্ধ অনুভূতি তাকে জেঁকে ধরেছে।সে আঁতকে উঠে।কি হচ্ছে এসব তার সাথে?এমনটা কেন হচ্ছে?হি ইজ নট ড্রাঙ্ক।ইভেন হি নেভার ডাজ।তাহলে?সে দ্রুত ঢোক গিলে গলা ভিজায়।নিজের দুই হাত শক্ত করে মুঠ করে বলে,’প্লিজ আমাকে কি কোনো খালি রুমে থাকতে দিবেন কিছুক্ষণের জন্য?আই অ্যাম নট ফিলিং ওকে।’
একজন কর্মচারী তক্ষুনি তাকে কলেজের টিচার্স রুমে নিয়ে গেল।আরহাম সেখানে গিয়ে একটা সোফাতে বসেই বলল,’প্লিজ এসিটা ছেড়ে দিন আর আমার জন্য কড়া করে এক কাপ কফি বানিয়ে আনুন।প্লিজ।’
মধ্য বয়স্ক লোকটি চুপচাপ চলে গেল।আরহাম শক্ত করে নিজের মুখ চেপে ধরল।কতোক্ষণ নিজের চুল নিজে টানল।তার অসহ্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।সে নির্ঘাত কোনো একটা ভুল করে ফেলবে এখানে থাকলে।দুই মিনিট অতিবাহিত হতেই সে বুঝল কফির অপেক্ষায় বসে থাকাও তার জন্য সম্ভব না।সমস্ত শরীর,এমনকি অনুভূতিটুকুও তার নিয়ন্ত্রণে নেই।কাঁপা হাতে সে ড্রাইভারকে কল দিলো।তার পক্ষে এখানে থাকা সম্ভব না।সে টেনে টেনে আরেকটু শ্বাস নেয়।সোফার কুশন খাঁ’মচে ধরে ঠোঁ’ট কামড়ে পড়ে থাকে চুপচাপ।এদিকে কেউ নেই।সবাই অডিটোরিয়ামে।
হঠাৎই তার ঘরের দরজা খুলে একটি মেয়ে হনহনিয়ে ভেতরে আসে।কাঠকাঠ স্বরে জানতে চায়,’সমস্যা কি আপনার?আমায় ডেকেছেন কেন হ্যাঁ?’
আরহাম মাথা তুলে।ধড়ফড়িয়ে উঠে বলে,’তুমি?’
___
নবনীতা চুপচাপ তার চেয়ারে বসেছিল।শুভ্রা তখন অন্য সারিতে তার বান্ধবীদের সাথে কথা বলছিল।তখনি একটি ছেলে এসে খুব বিনয়ী স্বরে বলল,’আপু আপনি কি নবনীতা?’
নবনীতা আড়চোখে তার দিকে তাকায়।গাঢ় স্বরে বলে,’জ্বী আমিই নবনীতা।কেন কি হয়েছে?’
ছেলেটা কোমল গলায় বলল,’আসলে আরহাম ভাই আপনাকে ডেকেছেন।বলেছেন একটু টিচার্স রুমে যেতে।’
তার কথা শুনেই নবনীতা তেঁতেঁ উঠল।কাটখোট্টা স্বরে বলল,’কেন?কেন যাব আমি?আমি কি উনার চাকর লাগি?’
ছেলেটা চমকালো কিছুটা।কিন্তু হাল ছাড়ল না।এগিয়ে এসে বলল,’আমি তো কিছু জানি না আপু।আপনি একটু গিয়ে দেখলে ভালো হতো।’
নবনীতা তিরিক্ষি মেজাজে উঠে দাঁড়ায়।বিরক্ত হয়ে জানতে চায়,’কোথায় টিচার্স রুম?’
ছেলেটি আঙুল তুলে অডিটোরিয়ামের সামনের বিল্ডিং টা দেখায়।নবনীতা পার্স হাতে নিয়ে চোখ মুখ কুঁচকে দ্রুত সেদিকে পা বাড়ায়।সে চোখের আড়ালে যেতেই নাফিজ দ্রুত ফোন বের করে একটা নম্বরে কল করে।রিসিভ হতেই তাড়াহুড়ো করে জানায়,’কাজ হয়ে গেছে ভাই।এখন শুধু দরজা বন্ধ করে লোক ডাকার পালা।’
____
নবনীতা তার কথা শেষ করে এক কদম এগিয়ে আসতেই সশব্দে টিচার্স রুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেল।হঠাৎ আওয়াজে নবনীতা কেঁপে উঠল।পেছন ফিরে বলল,’কি আশ্চর্য! দরজা বন্ধ করল কে?’
‘নবনীতা!’ ঘোর লাগা কন্ঠে ডাক দেয় আরহাম।
নবনীতা সোজা হয়ে তার দিকে দেখে।নাক মুখ খিঁচে বলে,’সমস্যা কি?কি হয়েছে?’
আরহাম টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ায়।নবনীতা তার উদ্ভ্রান্ত কদম দেখতেই সন্দিহান চোখে বলে,’আর ইউ ড্রাঙ্ক?’
আরহাম সেই কথা গায়ে মাখে না।সে একটানে নবনীতাকে তার মুখোমুখি এনে দাঁড় করায়।নেশাক্ত কন্ঠে বলে,’নো আই অ্যাম নট ড্রাঙ্ক।বাট আই অ্যাম ইন লাভ।’
নবনীতা এক ধাক্কায় তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দেয়।র’ক্তিম চোখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’একটা চ’ড় দেব ধরে! নে*শাখো*র একটা! মদ খেয়ে মাতলামি করছে।’
আজ আর তার চোখ রাঙানিতে কোনো কাজ হয়নি।আরহাম পুনরায় হ্যাঁচকা টানে তাকে নিজের কাছে আনল।নবনীতাকে চূড়ান্ত রকমের বিস্মিত করে সে নবনীতার কপালে অধর ছোঁয়াল।নবনীতা তার এই আচরণে এতোটাই স্তব্ধ হলো যে সে নড়ে গিয়ে নিজেদের দূরত্ব টুকু বাড়ানোর মতো স্বাভাবিক কাজটুকুও তার দ্বারা হলো না।সে পাথরের মূর্তির ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।
আরহাম ঝুঁকে এসে তার মাথাটা নবনীতার কাঁধে রাখল।তার দুই হাত চেপে ধরে জড়ানো গলায় বলল,’ইউ আর লুকিং সো স্টানিং।তোমাকে ভীষণ ভালো দেখাচ্ছে পরী।আমার তোমাকে ভীষণ চুমু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে।’
নবনীতা হকচকিয়ে ওঠে।এই লোক এসব কি বলছে?উনার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?সে এবার নিজেকে তার কাছ থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করল।আরহাম তার দুই হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরল।ঘোরলাগা গলায় বলল,’প্লিজ ডোন্ট গো পরী।”
ঠিক তখনি খটখট শব্দে টিচার্স রুমের দরজা খুলে যায়।নবনীতা হতভম্ব হয়ে দেখে কলেজ অথোরিটির কিছু মানুষ,সাথে কয়েকজন শিক্ষক দরজার সামনে এসে ভীড় করেছে।তারা তাদের দেখছে।তাদের দৃষ্টিতে বিস্ময়।নবনীতার দৃষ্টিতে যতখানি বিস্ময়,ঠিক ততখানি বিস্ময়।
নবনীতা গায়ের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তাকে ধাক্কা দিলো।আরহাম তাল হারিয়ে পুনরায় সোফায় গিয়ে ধপ করে বসে পড়ল।তার দৃষ্টি ঘোলাটে।সে কি করেছে এতোক্ষণ সে নিজেও জানে না।
নবনীতা নিজের পরনের জামাটা শক্ত করে খাঁমচে ধরে।ভীতু চোখে তার সামনে দাঁড়ানো মানুষ গুলোর নোংরা দৃষ্টি দেখে।গলার কাছে দলা পাকানো কান্নাটুকু গিলে নেয়।তারপরই কোনোদিক না দেখে এক ছুটে বেরিয়ে যায় টিচার্স রুম থেকে।তার চোখ ছাপিয়ে জল এসে যাচ্ছে।লোকজন তাকে বাজে চোখে দেখছে।অথচ নবনীতা নিজেও জানে না একটু আগে এসব কি হয়েছে,কেন হয়েছে।’
চলবে-