কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-২৩

0
111

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(২৩)

জীবনের প্রতিটি দিনেরই নিজস্ব তাৎপর্য থাকে।কোনো কোনো দিন আমাদের কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।কোনো কোনোদিন আবার খুবই সাধারণ।শাহরিয়ার আরহামের আজকের দিনটি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।কোনো সন্দেহ নেই,আজ তার রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন।আজ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

আগের রাতে সে ঘুমাতে পারেনি কিছুতেই।ভেতরটা কেবল ছটফট করছিল।এতো উৎকন্ঠা নিয়ে মানুষ বাঁচে কেমন করে?আরহামের জানা নেই।মাঝে মাঝে তার মনে হয় এসবে না জড়ালেই ভালো হতো।কতো সুন্দর ছিলো তার জীবনটা! আলমারি খুলে পাঞ্জাবি বের করার সময় পাশের তাকে থাকা টি-শার্ট আর ট্রাউজার গুলো অসহায় মুখ করে তার দিকে তাকায়।আরহামও অসহায় মুখে একবার তাদের দেখে।এসব পরে পরে আর বাইরে বাইরে টইটই করা হবে না।এখন সে পুরোদস্তুর জেন্টেলম্যান হয়ে গেছে।

সে পাঞ্জাবি হাতে নিয়ে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে যায়।রাজনীতিতে সে জড়িয়েছিল কৌতূহল,আগ্রহ আর জেদের বশে।তার মাথায় রাজনীতির ভূত চেপেছিল।একপ্রকার নেশার মতো হয়ে গিয়েছিল।মনে হচ্ছিল যে করেই হোক জিততেই হবে।হয়তো সে আজ জিতবে।হয়তো না,সে সত্যিই আজ জিতবে।সব কেন্দ্র তার দখলে,হারার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।একদিকে মন্ত্রী হওয়ার আনন্দ যেমন তাকে আচ্ছন্ন করে রাখে,অন্যদিকে নিজের উড়াধুরা ব্যাচলর লাইফের হঠাৎ পরিবর্তন তাকে হতাশ করে।

সে আর সেসব নিয়ে মাথা ঘামায় না।জীবনে তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না।সব নেশাকে ছাপিয়ে সে না হয় রাজনীতিকেই বেছে নিল।সে ঝটপট তৈরি হয়ে নেয়।আতরের শিশি থেকে গায়ে আতর মাখে।পাঞ্জাবির সাথে পারফিউম টা ঠিক যায় না।আতরই ঠিক আছে।যেদিন টি-শার্ট আর ট্রাউজার গায়ে জড়াবে সেদিন সে ভরে ভরে বডি স্প্রে লাগাবে।

সে তৈরি হয়ে দ্রুত নিচে নেমে আসে।আদি তাকে দেখতেই ভ্রু উঁচু করে বলে,’কিরে?নার্ভাস?’

আরহাম স্মিত হেসে জবাব দেয়,’কিছুটা।’

‘ব্যাপার না।তুই জিতবি।আমার মন বলে।’

সেদিন সকালের নাস্তায় অনেক কিছু রান্না হয়েছিল।কিন্তু আরহাম তার কিছুই খেতে পারেনি।সে যতই মুখে বলুক সে নার্ভাস না,ভেতরে ভেতরে সে ভীষণ নার্ভাস।তার কেমন অ’সহ্য লাগছে সবকিছু।মনে হচ্ছে হৃদপিণ্ড টা এখনই ফুড়ুৎ করে বেড়িয়ে তার হাতে চলে আসবে।

সে আর বাড়িতে বেশি সময় নষ্ট করল না।খাওয়া শেষে আদিকে নিয়ে বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।ওয়াজিদ ইতোমধ্যই কেন্দ্রে পৌঁছে গেছে।তাদেরও যতো দ্রুত সম্ভব কেন্দ্রে যেতে হবে।

***

‘নবনীতা!’

রিমির ডাকে বিরক্ত হয়ে চোখ খুলল নবনীতা।কাঁচা ঘুম ভাঙলে তার বিরক্ত লাগে,রাগ হয়।সে মুখ কুঁচকে বলে,’সমস্যা কি?ডাকছিস কেন সকাল সকাল?একটু ঘুমাতে দে।’

নবনীতার আজকে তার নতুন বাড়িতে পঞ্চম দিন।গত পরশু সে বেতনের টাকা হাতে পেয়েছে।টাকা পেয়েই সে হাবিজাবি বহুত কেনাকাটা করেছে।আপাতত এই দুইদিন সে সেগুলো গোছাতেই ব্যস্ত।তার এপার্টমেন্ট এগারো তালায়।এতো উঁচু থেকে বাইরের দৃশ্য খুবই মনোরম দেখায়।একে তো আবাসিক এলাকা।তার উপর আবার এতো উঁচুতে ফ্ল্যাট।নবনীতা প্রতিদিন বিকেলে এক কাপ চা হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়।সে দুই হাজার টাকা খরচা করে একটা টুলও কিনেছে।শুধু মাত্র বারান্দায় বসে চা খাওয়ার জন্য সে এই খরচা টুকু করেছে।

মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে হয় পুরো দুনিয়াটা কিনে ফেলতে।রাস্তায় যা দেখে তাই কিনতে মন চায় তার।বহু কষ্টে সে নিজেকে আজগুবি খরচাপাতি থেকে বাঁচায়।এই যে সত্তর হাজার টাকা হাতে পেতেই সে এলোপাতাড়ি কতো টাকা খরচা করেছে তার কোনো ইয়াত্তা নেই।সে একটা নতুন মেট্রেস কিনেছে।এটাতে একবার পিঠ রাখলে সে আর এই দুনিয়ায় থাকে না।গত কয়েকদিন যাবত সে সময় পেলেই শুধু ঘুমায়।

নতুন অফিসের লোকজন এতো ভালো যে নবনীতার মাঝে মাঝে মনে হয় সে অফিসের কর্মচারী না,বরং অফিসের বসের বউ।তারা তাকে এত্তো সম্মান করে।সে কোনো কিছুতে আটকে গেলেই একবার বললেই সাহায্য করে দেয়।নিজের চিন্তাভাবনায় তার নিজেরই হাসি পায়।তার অফিসের বসের নাম রোকন।তিনি বিবাহিত আর দুই বাচ্চার বাবা।সুতরাং তাকে বসের বউ ভেবে এতো যত্ন করার কোনোই সুযোগ নেই।

নবনীতা এই ছয় বছরে জীবনের সবচেয়ে চমৎকার দিনগুলো কাটিয়েছে বিগত পাঁচদিনে।সারাদিনে সে যতো ক্লান্তই হোক না কেন,দিন শেষে এতো সুন্দর একটা এপার্টমেন্ট তার সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেয়।তার দু’টো বোন এতোটা সময় একটা খুপরি ঘরে বন্দি থাকতে থাকতে অবশেষে এতো বড় একটা ফ্ল্যাট পেয়েছে।চিত্রার খুশি দেখলেই নবনীতার মন ভালো হয়ে যায়।তার সুদিন ফিরেছে।এমন একটা অফিসে তার চাকরি হয়েছে যেখানে তাকে যথাযথ সম্মান দেওয়া হয়।অফিসের গভার্নিং বডির সদস্যরা নিশ্চয়ই খুব ভালো মনের মানুষ।নবনীতা অপেক্ষায় আছে কবে একটা অফিসিয়াল ফেস্টিভ হবে আর সে অফিসের সিইও কে নিজ চোখে দেখবে।কতো দয়ালু এই মানুষটা! নিজের নামটা পর্যন্ত প্রকাশ করতে চায় না।নবনীতার ফাইলে কোথাও তার নাম নেই।জনদরদী মানুষরা বোধহয় এমনি হয়।যারা নাম নিয়ে কোনো বড়াই করে না।নবনীতা নিজের মনেই বিড়বিড় করে,’সবাই কি ঐ শাহরিয়ার আরহাম নাকি যে নিজের ঢোল নিজেই পেটায়?সারাক্ষণ একই গান গেয়ে যায় আমি শাহরিয়ার আরহাম।আমাকে কে না চেনে! যত্তসব।’

নবনীতা ভালো আছে।ভীষণ ভালো আছে।লুবনাকে পড়ানো বাদে সে তার সব টিউশন ছেড়ে দিয়েছে।তার আর টিউশনের প্রয়োজন নেই।তবে লুবনাকে সে পড়ায় ভালোবেসে,টাকার চিন্তা থেকে নয়।কুরিয়ার অফিসের চাকরিটাও এখন আর করতে হয় না।নবনীতা কেবল সকাল থেকে বিকাল অফিস করে।বাড়ি এসে টুকটাক রান্না করে।এশার নামাজ শেষে লম্বা একটা ঘুম দেয়।কি আনন্দ! কি আনন্দ! এতো সুখ নবনীতা রাখবে কোথায়?

রিমি তাকে আবারো ডাক দিলো,’আজ তো নির্বাচন।তুই ভোট দিতে যাবি না?’

নবনীতা তার বুজে আসা চোখটা টেনে টেনে খুলে।নিদ্রাচ্ছন্ন গলায় বিড়বিড় করে,’না যাব না।তোর আরহাম ভাইকে ভোট দেওয়ার প্রয়োজন নেই।সে এমনিতেই রাতের ভোটে বিজয়ী।গিয়ে দেখবি তোর আর আমার ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে।’

রিমি অধৈর্য হয়ে বলল,’ধ্যাত।আগ বাড়িয়ে এতো কথা বলিস না তো।এমন কিছুই হবে না।উঠ তুই।রেডি হ।’

নবনীতা তক্ষুনি উঠল না।আরো কিছুক্ষণ সেভাবেই নরম বিছানায় পড়ে রইল।দেয়াল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে সকাল নয়টা ত্রিশ।নবনীতা মুচকি হাসে।আজকাল সে বড্ড দেরি করে ঘুম থেকে উঠছে।ঘুম থেকে উঠেই সে প্রথমে গেল রান্নাঘরে।গিয়েই স্টোভ জ্বালায়।আনাড়ি হাতে চুলে খোপা বাঁধে।সে ইদানিং টুকটাক রান্নাও করছে।আগে মিসেস রোকেয়াই সব রান্না করতেন।এখন নবনীতা ইউটিউব ঘেঁটে নিজেই রান্না করে।এটা তার সংসার,এটা পরীর সংসার।এ সংসার পরী নিজের মতো করেই সামলাবে।

রিমি গতকাল এসেছিল বিভাকে নিয়ে।আর যায়নি।শাহাদাতের অবস্থা একটু ভালো।আইসিইউ থেকে কেবিনে শিফট করা হয়েছে।আশা করা যায় আরো মাসখানেকের মাঝে সে সুস্থ হয়ে যাবে।বিভা আপাতত রিমির কাছেই আছে।নবনীতা এখনো সব গুছিয়ে উঠতে পারেনি।তাছাড়া তার অফিস টাইমে বিভাকে রাখবে কে?নবনীতার এখন নিজেকে একেবারে পাক্কা গৃহিণী মনে হয়।যার কাজের কোনো শেষ নেই।স্বামী বাদে তার সংসারে সবই আছে।

শুভ্রা এই বছর নতুন ভোটার হয়েছে।তার এক কথা।সে আরহাম ভাইকে ভোট দিতে যাবেই যাবে।নবনীতা কয়েক দফা তাকে চোখ রাঙিয়েও কোনো লাভ হয়নি।শেষ পর্যন্ত টুকটাক রান্না শেষে নবনীতা বিভা আর চিত্রকে ঘুম পাড়িয়ে সাদেক সাহেবের কাছে রেখে বেলা বারোটার দিকে বাড়ি থেকে বের হলো।

সে কেন্দ্রে পৌঁছাতে পৌঁছাতে দুপুর একটা বেজে গেল।এই সময়টাতে তেমন ভীড় থাকে না।জনমানব বলতে গেলে খুবই কম।নবনীতা রিকশা ভাড়া মিটিয়েই ক্লান্তিতে দু’টো শ্বাস ছাড়ে।তারপর পাশ ফিরে শুভ্রাকে দেখে চোখ গরম করে বলে,’চলুন ম্যাডাম।আপনার মূল্যবান ভোট দিয়ে রাষ্ট্র কে ধন্য করুন।’

নবনীতা দ্রুত হেঁটে ভেতরের দিকে পা বাড়ায়।তারা যেই কেন্দ্রে ভোট দিতে এসেছে,সেটা একটা পুরোনো স্কুল।তার পরনে আজ কালো রঙের জামা।গায়ের ওপর শালের মতো জড়িয়ে রাখা ওড়নার রং ও কালো।

আরহাম তখন তোফায়েলের হুন্ডার উপর বসে এই কেন্দ্রে তার কর্মীদের সাথে কথা বলছিল।তার হাতের সিগারেট টা কেবল অর্ধেকই শেষ হয়েছিল।এমন সময় গেটের দিকে দেখতেই সাথে সাথে সে সেটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে পিষে ফেলল।গভীর দৃষ্টিতে সামনের দৃশ্য টুকু দেখল।দেখল কালো জামা গায়ে জড়িয়ে একটি মেয়ে মূল ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকছে।বরাবরের মতোই প্রসাধনী বিহীন মুখশ্রী।তবে অন্যান্য দিনের চেয়ে খুব বেশি প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে তাকে।তার চুলগুলো বেণি করে একপাশে ছেড়ে রাখা হয়েছে।চোখে মুখে তার বিরক্তির ছাপ।আরহাম মুচকি হাসে।সে ভালো মুখে থাকে কখন?

তার পিছন পিছন হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে আসে রিমি।এসেই এদিক সেদিক চোখ নিয়ে কাউকে খুঁজল।খুঁজে পেতেই একগাল হাসল।ইশারায় সালাম দিলো।আরহামও সে সালামের জবাব দিলো,ইশারায়।

আরহাম আজকে অনেক গুলো কেন্দ্রে গিয়েছে।আদি,আরিশ,ওয়াজিদ সবাই ই নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত।এতো এতো কেন্দ্রে ছুটতে ছুটতে রীতিমতো পা ব্যথা হচ্ছে তার।এতোকিছুর মাঝেও আরহাম এই কেন্দ্রে এসেছে।আসার আগে অবশ্য রিমির থেকে খোঁজ নিয়ে এসেছে।রিমিই এখন তার ভরসা।

সেসময় ভীড় কম ছিল।নবনীতা,রিমি আর শুভ্রা পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভোট দিয়ে ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে এলো।শুভ্রা বেরিয়ে এসেই রিমিকে জিজ্ঞেস করল,’কাকে ভোট দিয়েছ?’

রিমি উৎফুল্ল স্বরে বলল,’আর কাকে?অবশ্যই আরহাম ভাইকে।’

শুভ্রা এবার কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল,’আপাই তুমি কাকে ভোট দিয়েছ?’

‘কেন বলবো?এটা কি বলার জিনিস?বলার জিনিস হলে তো পর্দা দিয়ে ঢেকে ভোট দিত না মানুষ।’ খুবই কাটখোট্টা স্বরে উত্তর দেয় নবনীতা।এক উত্তরেই শুভ্রা দমে গেল।মিন মিন করে বলল,’না ঐ আরকি।’

শ্রেণিকক্ষের বাইরে করিডোরের মতো জায়গা ছিল।তারা বের হতেই দেখল আরহাম বুকে হাত বেঁধে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।তার সামনে বয়স্ক মতোন একজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন।দু’জন নির্বাচন সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে কথা বলছে।

নবনীতা তাদের একটু কাছাকাছি যেতেই রিমি ইচ্ছা করে তাকে একটা ধাক্কা দিলো।ধাক্কা খেয়েই নবনীতা তাল হারিয়ে দুই কদম সামনে এগিয়ে গেল।তার রোগা পাতলা শরীরটা মাটিতে পড়ার আগেই আরহাম একটু এগিয়ে এসে দু’হাত বাড়িয়ে শক্ত করে তার দুই কাঁধ চেপে ধরল।নবনীতা ঠিক মতো উঠে দাঁড়াতেই সবার প্রথমে আরহামকে দেখল।তারপরই দেখল তার কাঁধ।দেখতেই সে এক ঝাড়ায় নিজেকে সরিয়ে নেয়।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’এসব হচ্ছে টা কি?গায়ে হাত দিচ্ছেন কেন?’

আরহাম আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি?আমি গায়ে হাত দিয়েছি?তুমি আমার নামে যা তা বলছ।পড়ে যাচ্ছিলে তুমি।আমি তোমায় বাঁচিয়েছি।’

‘উদ্ধার করেছেন আমায়।আপনি না ধরলে তো নিচে পড়ে আমি মরেই যেতাম নির্ঘাত।নিচে তো গভীর উপত্যকা তাই না?জীবন বাঁচিয়েছেন আপনি আমার!’

আরহাম চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’তুমি একটা বে’য়াদব আর এরোগেন্ট মেয়ে।কৃতজ্ঞতা বোধ বলতে নেই তোমার।’

‘জ্বী আপনার অনেক আছে।’ কটমট করে জবাব দেয় সে।

জবাব দিয়েই ধুপ ধাপ পা ফেলে দ্রুত করিডোর থেকে বেরিয়ে মূল ফটকের দিকে এগিয়ে যায়।আরহাম তার প্রস্থান দেখতেই বিড়বিড় করে,’এর এলার্জি আছে আমার সাথে।অদ্ভুত মেয়ে!’
.
.
.
.
নির্বাচনের ফলাফল অনেক টা আগে থেকেই জানা ছিল।তবুও বলা তো যায় না।কখন কি হয়ে যায়! আরহাম বিকেল থেকে তার পার্টি অফিসে বসেছিল।ভোট গণনা শুরু হতেই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল।ওয়াজিদ আর আদি তখনও কেন্দ্রে।আরহাম অধৈর্য হয়ে ওয়াজিদ কে কল দেয়।ওয়াজিদ ফোন ধরেই তাকে আশ্বস্ত করল,’আরে এতো প্যানিকড হওয়ার কিছু নেই ভাই।তুই জিতে যাবি।সবকিছুই তোর ফেভারে আছে।’

আরহামকে অপেক্ষা করতে হলো আরো দুই ঘন্টা।সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকেই ওয়াজিদ তাকে ফোন দিলো।ফোন রিসিভ করতে গিয়েই আরহাম টের পেল সে কাঁপছে।কাঁপা হাতে কলটা রিসিভ করে কোনোরকম ফোনটা কানে চেপে ধরতেই শুনল ওয়াজিদ অন্যপাশ থেকে এক প্রকার চেঁ’চিয়ে উঠে বলছে,’আরহাম তুই জিতে গিয়েছিস।তুই জিতে গিয়েছিস আরহাম।’

তার কথা শুনেই আরহাম এক লাফে তার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো।সে কি সত্যি শুনছে?সে জিতে গেছে?ওয়াজিদ সত্যি বলছে?সে চিৎকার করে বলল,’ওয়াজিদ সত্যি?তুই কোনো কাগজ পেয়েছিস হাতে?’

‘অফিসিয়ালি পাইনি।কিন্তু আন-অফিসিয়ালি পেয়ে গেছি।’

আরহাম মোবাইলটা কানে চেপেই কতোক্ষণ আনন্দে চেঁচায়।পার্টি অফিসের বাইরে তার ছেলেরা ইতোমধ্যেই বিজয় উল্লাস শুরু করেছে।দশ মিনিট পরেই আদি কোথা থেকে ছুটে এসে শক্ত করে জাপটে ধরল তাকে।জড়ানো গলায় বলল,’প্রাউড অফ ইউ ম্যান।আমি জানতাম তুই পারবি।’

ওয়াজিদ এসেছে আরো অনেক পরে।সে আসার আগেই আরহামের পার্টি অফিস রাজনৈতিক নেতা আর সাংবাদিক দের পদচারণায় কোলাহলপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।তাকে দেখতেই আরহাম সব ফেলে তার দিকে ছুটে গেল।সে তীব্র বেগে ছুটে গিয়ে ওয়াজিদকে জড়িয়ে ধরল।ওয়াজিদ এমন হঠাৎ জাপটে ধরায় তাল হারিয়ে সোজা ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।আরহামের এমন অদ্ভুত কাজ কারবারে হেসে উঠে বলল,’কি রে তুই পাগল হয়েছিস?দেখ আমার জামাটাও নোংরা হয়ে গেছে।’

‘হোক নোংরা।আমারটাও তো হয়েছে।আজ একটু আধটু নোংরা হলে কিছু হবে না।’
আরহাম একটু থামে।পর পরই আবার বলতে শুরু করে,’ওয়াজিদ,থ্যাংক ইউ ভাই।তুই না থাকলে এসব কিছুতেই সম্ভব হতো না।লাভ ইউ ব্রো।’

আদি তাদের দেখেই তাদের দিকে ছুটে গেল।ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে নিজেও তাদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’তোরা আমাকে ছাড়াই এতো খিলখিল করছিস কেন?বিদেশে থাকি বলে পর হয়ে গেছি নাকি?দেখি আমাকেও জায়গা দে।ওয়াজিদ সর তো।সর সর।’

তিন বন্ধুর স্বচ্ছ,সুন্দর আর নির্মল মুহূর্ত।কতোটা ভ্রাতৃত্ব,টান আর ভালোবাসা মিশে আছে সেই সম্পর্কে! তাদের এই সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সম্প্রচার করা হলো প্রায় প্রতিটা চ্যানেলে।শেখ আজিজ হোসেনের ছেলে এমপি হয়েছে।তাও বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে।লোকজনের তার প্রতি বিশেষ টান আছে।কতো সুদর্শন এই ছেলেটা!

ফাহাদদের বাড়িতে অবশ্য সেদিন টেলিভিশন চলে নি।পুরোটা বাড়িই কেমন নিস্তব্ধ হয়েছিল সারাটা দিন।সবাই যার যার মতো খেয়ে নিল।বাড়ির সবাই শুয়ে পড়তেই মাঝবয়সী একজন মহিলা শোয়া থেকে উঠে বসলেন।পাশ ফিরে দেখলেন তার স্বামী গভীর ঘুমে নিমগ্ন।তিনি ধীর পায়ে হেঁটে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন তার ঘর থেকে।পা টিপে টিপে লিভিং রুমে গিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলেন।টি-টেবিলের উপর রাখা রিমোটের বাটন চেপে টেলিভিশন চালু করলেন।খুঁজতে থাকলেন দেশীয় সংবাদ মাধ্যমে গুলোর রাতের নিউজ।

তার ভেতর চাপা উৎকন্ঠা।সে উড়ো খবর শুনেছে আরহাম নাকি জিতে গেছে।সে একবার নিজ চোখে সেটা দেখতে চায়।অবশেষে তার প্রতিক্ষার অবসান হলো।এলাকাভিত্তিক প্রচারণা মাধ্যমে গুলোতে খুব তোড়জোড় করে আরহামের বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপ দেখানো হচ্ছে।তাসলিমা তাকে দেখতেই নিজের শাড়ির আঁচল মুখে চেপে ধরেন।এক দৌঁড়ে ছুটে যায়,যেমনটা সে বারবার করে আসছে।

চোখ মেলে দেখে ওয়াজিদ আর আদির হাস্যোজ্জ্বল মুখ।দেখতেই তার চোখ ভিজে যায়।সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসে।ছেলেগুলো কত্তো বড় হয়ে গেছে! এই তো সেদিনের কথা,যখন এরা স্কুল শেষে বাড়ি ফিরেই ফালুদা খাওয়ার বায়না ধরত।তাসলিমা আলগোছে হাসেন।কতো বড় হয়ে গেছে এরা! কতো ছোট ছোট ছিলো বাচ্চাগুলো।কাঁধে একটা স্কুল ব্যাগ।হাতে ব্যাডমিন্টনের র‍্যাকেট।সেই আদি আর ওয়াজিদ আজ এতো বড় হয়ে গেছে! তাদের কি এখন মনে আছে তাসলিমার কথা?তারা কি তাদের সোনা মায়ের কথা মনে রেখেছে?নাকি তাদের অভিমানী আর জেদী বন্ধুর মতো তারাও তাকে ঘৃণা করে?

তাসলিমা আচমকা একলা ঘরটায় ফুঁপিয়ে উঠেন।ছেলেটা এতো বড় হয়ে গেছে! নির্বাচনে জিতে গেছে।অথচ তিনি ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরতে পারছেন না।কপালে একটা চুমু খেতে পারছেন না।এর চেয়ে দুঃখজনক আর কি হতে পারে?

তাসলিমা কয়েক দফা কান্না থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলেন।বারবার হাত বাড়িয়ে স্ক্রিনে দেখানো ফুলের মালা গলায় ঝুলিয়ে রাখা ছেলেটিকে ছুঁয়ে দিলেন।হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বললেন,’আমায় মাফ করো বাবা।দয়া করে আর আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না।আমায় একটু ভালোবাসার সুযোগ দাও বাবা।তুমি কি জানো তোমার স্বার্থ’পর,বে’ঈমান মা টা যে একদমই ভালো নেই?তুমি কি একটি বারের জন্যও মা কে ক্ষমক করবে না?তুমি কি একটি বারের জন্যও মায়ের দিকে ফিরে তাকাবে না?আর কতো শাস্তি দিবে বাবা?এই আমাকে শাস্তি দিতে গিয়ে কি তুমি নিজে ভালো আছো বাবা?আমি তো আমার ছেলেকে চিনি,আমি জানি সে ভালো নেই।’

চলবে-

গল্পের যেকোনো আপডেট পাওয়ার জন্য এই গ্রুপে যুক্ত হোন-

https://www.facebook.com/share/g/2ugxN3yXD3sC19iL/?mibextid=K35XfP

[কালকে গল্প নাও দিতে পারি,পর্ব না পেলে বুঝে নিবেন]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে