#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(২২)
ওয়াজিদ আরো একটু পেছাতেই নির্দিষ্ট বেগ নিয়ে ছুটে আসা একটি তরুণী তার পিঠের কাছে এসে আছড়ে পড়ল।সঙ্গে সঙ্গে পেছন ফিরে সে।রিমি মাথা ডলতে ডলতে ব্যথাতুর কন্ঠে চেঁ’চিয়ে উঠে,’কে রে এটা?সিস্টেমে গন্ডগোল আছে নাকি?মানুষ সামনের দিকে হাঁটে।এমন হিন্দি সিরিয়ালের নায়িকা দের মতো পিছে হাঁটে কে ভাই?’
কথা শেষ করেই সে বিরক্তমুখে সামনে থাকা লোকটা কে দেখল।তাকে দেখতেই তার চক্ষু চড়াক গাছ।সে আঁতকে উঠে বলল,’ভাইয়া আপনি?’
ওয়াজিদ একনজর তাকে দেখে কোনো জবাব না দিয়ে তাকে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।রিমি নখ কা’মড়াতে কা’মড়াতে কিছুটা ভাবুক হয়ে বলল,’বাপরে! রাগ হয়েছে নাকি?’
সেও তার পিছু পিছু ছুটল।তার পাশাপাশি এসে বলল,’সরি ভাইয়া।আবারো মিস্টেক হয়ে গেছে।নেভার মাইন্ড।’
ওয়াজিদ সে কথা কানে তুলে না।সে নির্বিকার হয়ে সামনে এগিয়ে যায়।রিমি আর কোনো উপায়ান্তর না দেখে আলতো করে তার একহাত মুঠোয় নিয়ে অনুনয়ের স্বরে বলল,’ভাইয়া সরি তো।এতো রাগ হয়ে আছেন কেন?একটু কথা বলুন প্লিজ।’
ওয়াজিদ থামল।র’ক্তিম চোখে কিছুক্ষণ তার হাতটা দেখল।তারপর দেখল রিমিকে।রিমি তার চোখ দেখেই চুপশে গেল।এতো ভয়ংকর লাগছে কেন তাকে?
ওয়াজিদ এক ঝাড়ায় তার হাত ছাড়িয়ে নেয়।সম্ভবত এই প্রথমবার সে অতিমাত্রায় কর্কশ ভাষায় তাকে ধ’মকে উঠে,’এক চড় দেব পেছন পেছন আসলে।ফা’লতু মেয়ে একটা!’
সে থামে।কিছুক্ষণ টেনে টেনে শ্বাস ছাড়ে।রিমি পাথরের মতো দাঁড়িয়ে তাকে দেখে।ওয়াজিদ পুনরায় চেঁ’চিয়ে উঠে বলল,’তোমাদের কি মনে হয় আমাকে?আমি জোকার?আই হ্যাভ নো স্ট্রং ফিলিংস?অ্যাম আই আ জোক টু ইউ গাইস?আমি কি কোনো খেলনা?আমার জীবনে কোনো আবেগ থাকতে পারে না?কেন?সবসময় কেন ত্যাগটুকু আমাকেই করতে হবে?কারণ আমি ইন্ট্রোভার্ট।ওহহহ হ্যাঁ,আমাদের তো কোনো অনুভূতিই নেই।প্রকাশ করতে না পারলে সেটা আবার কিসের অনুভূতি।তাই না?’
রিমি মুখ হা করে তার কথা শুনল।আমতা আমতা করে বলল,’ভাইয়া আপনি কি আমাকে বলছেন?’
ওয়াজিদ সে কথার জবাব দিলো না।একনাগারে আবোল তাবোল বলেই গেল কতোক্ষণ।সে চাপা স্বভাবের মানুষ।তার পক্ষে আরহামের মতো এক্সপ্রেসিভ হওয়া সম্ভব না।কিন্তু তার অনুভূতি মিথ্যা না।সে সত্যিই মেয়েটির জন্য টান অনুভব করে।আজকে কালকে না,সেই প্রথম দিন থেকেই।আরহামের পার্টি অফিসে তাকে দেখার পর থেকে তার চোখ জোড়া শুধু তাকেই খুঁজত।মেয়েটি অনন্যা,এটা সে প্রথম দিনেই বুঝেছে।তার চলন,তার বচন,তার মূল্যবোধ সবকিছুই ওয়াজিদকে মুগ্ধ করে।এই মেয়েটিকে ওয়াজিদ পছন্দ করে।পছন্দ করার কোনো স্কেল নেই।যদি থাকতো তাহলে সে প্রমাণ করতে পারতো আরহামের চেয়ে বেশি সেই তাকে ভালোবেসেছে।
সে শেষ একবার রিমির দিকে দেখে তাকে তর্জনী তুলে শা’সায়,’খবরদার।এরপরের বার থেকে দূরে দূরে থাকবে আমার।’
কথা শেষ করেই সে হনহনিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।রিমি কতোক্ষণ হতভম্ব হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।অদ্ভুত বিষয়?লোকটি কি তাকে এসব বলল?কিন্তু তাকে কেন এসব বলবে সে?সে তার কি লাগে?সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখতে দেখতে ক্ষেপাটে স্বরে বলল,’এর আসলেই সিস্টেমে সমস্যা।ঝ’ড়ে মাথার অ্যান্টেনা নড়ে গেছে নিশ্চিত।’
সে আর সেসব নিয়ে ভাবে না।দ্রুত কদমে এগিয়ে যায় নবনীতার মেসেজ করা ওয়ার্ডের দিকে।যাওয়ার পথেই আরহাম আর তার পেছনে গুটি কয়েক লোককে দেখতে পায় সে।আরহাম তাকে দেখামাত্রই সে সালাম দেয়,’আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া।’
আরহাম সালামের জবাব দিলো।জানাতে চাইল,’বান্ধবীর সাথে দেখা করতে এসেছ?’
‘জ্বী ভাইয়া।’
আরহাম আঙুল তুলে ডান দিকে দেখিয়ে বলল,’ঐ দিকটায় যাও।সেখানেই আছে সে।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’
রিমি এগিয়ে যায়।আরহাম তাকে পিছু ডাকে,’একটু দাঁড়াও তো রিমি।’
রিমি থামল।আরহাম এগিয়ে এসে জানতে চাইল,’তুমি কি আমাকে তোমার নাম্বার টা দিতে পারবে রিমি?’
রিমি অবাক হয়ে বলল,’জ্বী ভাইয়া।কেন না?’
সে ঝটপট আরহামকে তার ফোন নম্বর দিলো।আরহাম নম্বর নিয়েই হাসিমুখে বলল,’আচ্ছা আমি আসি।’
রিমি দ্রুত মাথা নেড়ে সামনের দিকে পা বাড়ায়।শাহাদাতের কেবিনের বাইরেই নবনীতা চুপচাপ বসেছিল।তার কোলে ছোট্ট বিভা,যে এই মুহূর্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।রিমি তার কাছে এসেই চোখ গোল গোল করে বলল,’এটা কে নবনী?’
নবনীতা ঠান্ডা গলায় জবাব দেয়,’বিভা।ওর নাম বিভা।শাহাদাতের ছোট বোন।’
রিমি কয়েক পলক তাকে দেখল।কিছুটা আফসোস করে বলল,’ইশশশ রে! কতো মিষ্টি এই বাবুটা।মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ!’
নবনীতা আলতো করে তার মাথায় হাত রেখে বলল,’আমি ঠিক করেছি শাহাদাতের সুস্থ হওয়া পর্যন্ত বিভাকে আমি আমার কাছেই রাখব।’
সে থামল।একটু শ্বাস ফেলে ভাঙা গলায় বলল,’সম্ভব হলে শাহাদাত কেও আমি নিজের কাছে রাখতাম।রেখে পড়াশোনা করাতাম।কিন্তু আমার তো নিজেরই চলার টাকা নেই।নিজের বাড়ির বাজার করতেই জান যায়।আরো দু’জনকে পালবো কেমন করে?তবে আমি ভেবে নিয়েছি আল্লাহ না করুক যদি শাহাদাতের কিছু হয় তাহলে আমি বিভার সব দায়িত্ব নিব।’
রিমি হাসিমুখে তার পাশে বসল।তার কাঁধে হাত রেখে বলল,’গুড ডিসিশন।আমি তোর পাশে আছি।তুই একা না,আমিও বিভার দায়িত্ব নিতে চাই।আপাতত কিছুদিন বিভা আমার কাছেই থাকুক।তোর একটা পাকাপোক্ত চাকরি হলে তুই বিভাকে নিজের কাছে নিয়ে রাখিস কেমন?’
নবনীতা চোখ সরু করে বলল,’তুই বাচ্চা রাখতে জানিস?’
‘উহু জানি না।কিন্তু শিখে নিব।’
আরো ঘন্টাখানেক নবনীতা সেখানে ছিল।শেষ পর্যন্ত বিভাকে রিমির কাছে দিয়ে সে বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেয়।বিভাকে রিমির কাছে দেওয়াটাই তার কাছে সঠিক সিদ্ধান্ত বলে মনে হয়েছে।তার চেয়ে বেশি রিমিই বিভার যত্ন করতে পারবে।সে সারাদিন বাইরে বাইরে থাকে।বিভাকে যে একটু যত্ন করবে,আদর দিয়ে আগলে রাখবে,সে সময় কোথায়?
***
পুলিশের হাজতে ফাহাদকে আরো দুইদিনের মতো থাকত হয়েছিল।দলীয় নেতাদের কেউই তার জন্য থানায় যাননি।কেবল খালেক সাহেব আর নোমান সাহেবই বার কয়েক এ জায়গা সে জায়গা ছুটোছুটি করে তাকে জেল থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছে।জেল থেকে বেরিয়েই সে বড় বড় পায়ে হেঁটে সোজা গাড়িতে গিয়ে বসল।
খালেক সাহেব কিছুটা বিরক্ত হয়ে বললেন,’তোমাকে আমি কিছুতেই বোঝাতে পারি না ফাহাদ যে,তুমি আর কোনো কিছু করেই আরহামকে হারাতে পারবে না।সে অনেক বেশি এগিয়ে আছে জনপ্রিয়তায়।এছাড়া সে সরকার দল থেকে মনোনয়ন প্রাপ্ত।তুমি খুব ভালো করেই জানো তাকে হারানো সম্ভব না।তবুও কেন তুমি রাকিবের সাথে মিলে এসব করেছ?আরহামের তো কিছুই হয়নি,মাঝখানটায় তুমি দল থেকে বহি’ষ্কৃত হলে।লাভ টা কার হলো বলো তো আমায়?’
ফাহাদ থম মেরে কতোক্ষণ গাড়িতে বসে থাকল।ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে নোমান সাহেব বসেছিলেন।তিনি ঘাড় ঘুরিয়ে ফাহাদকে দেখে বললেন,’সবকিছুতে এতো হঠকারিতা করলে হয় ফাহাদ?’
ফাহাদ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,’তো কি করা দরকার ছিল আমার ছোট চাচ্চু?আরহামের বিজয়ে তালি বাজাবো আমি?আমার কি চুপ করে বসে বসে সব দেখা উচিত ছিলো?’
নোমান সাহেব মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ করে বললেন,’আহা সেটা করবে কেন?কিন্তু তুমি আর আরহাম তো একই দলের হয়ে রাজনীতি করছ।তোমার আরেকটু সাবধান থাকা উচিত ছিল।আরহামের বিরোধিতা করতে গিয়ে তুমি নিজের দলের সাথেই বিরোধিতা করে ফেলেছ।আর তাছাড়া কেন বারবার ভুলে যাও সে আজিজ হোসেনের ছেলে।তার জনপ্রিয়তা এমনিতেই বেশি হবে।’
ফাহাদ তেঁতেঁ উঠে বলল,’কেন?তার বাবা রাজনীতিতে নাম করেছে বলে তারও নাম হয়ে গেছে?সে কি করেছে?ঐ এক বাপের নাম ভাঙিয়ে খাচ্ছে।শেখ আজিজের ছেলে,শেখ আজিজের ছেলে।কান পচে গেছে এই কথা শুনতে শুনতে।’
‘পচে গেলেও কিছু করার নাই।আজিজ হোসেন পনেরো বছর যাবত এমপি ছিলেন।বিরোধী দল ক্ষমতায় থাকা অবস্থায়ও তিনি এমপি ছিলেন।হি হ্যাজ দ্যাট স্টারডম।ইউ ক্যান নট ডিনাই দ্যাট।’
‘স্টারডম মাই ফুট।’ গজরাতে গজরাতে উত্তর দেয় ফাহাদ।
তারপরই তার মুখটা দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে।তার ভেতরে ক্রো’ধের আ’গুন জ্বল’ছে।ঐ নবনীতার জন্য তার এই দশা হয়েছে।আরহামকে দোষ দিয়ে লাভ কি?দোষ তো ঐ মেয়ের।সে যদি এমন ছুটে না আসতো,তবে ফাহাদ ঠিকই পালিয়ে আসতে পারত।কোনো ভাবেই ধরা খেত না।ফাহাদ কাঁপতে কাঁপতে দাঁতে দাঁত পি’ষে গা’লি দেয়,’মা***গি একটা!’
তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে।তার হাতে আর কোনো ক্ষমতা নেই।কিন্তু নবনীতাকে জব্দ করার মতোন ক্ষমতা তার অবশ্যই আছে।ঐ ফকিন্নি দুই টাকার মেয়েকে সে চাইলেই জব্দ করতে পারবে।আর সে জব্দ করবেই।
***
পরের দুই দিন নবনীতার গিয়েছে কোনোরকম।না খুব ভালো,না খুব মন্দ।আরহাম তার কথা রেখেছে।অবস্থা বুঝে শাহাদাত কে স্কয়ারে ট্রান্সফার করা হয়েছে।তার সেখানে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।তার চিকিৎসার যাবতীয় খরচ সব শাহরিয়ার আরহামের নামে লিখা হবে।
নবনীতা দিনে একবার সেখানে গিয়ে তার খোঁজ নেয়।ডাক্তার বলেছেন শাহাদাত বাঁচবে।হয়তো পুরোপুরি সুস্থ হতে একটু সময় লাগবে,কিন্তু সে বাঁচবে।নবনীতাও আশায় বুক বাঁধে।অপেক্ষা করে এগারো বছরের ছোট্ট ছেলেটির সুস্থ হওয়ার।সে সুস্থ হবে,নবনীতার কথাকে সত্য প্রমাণ করে সে জীবনে অনেক বড় হবে।
রিমি বিভাকে ভীষণ যত্নে রাখছে।সেদিনই নাকি সে চার হাজার টাকার বেবি ফুড কিনেছে।নবনীতার মনে হয় বিভা তার কাছেই আপাতত বেশি ভালো থাকবে।নবনীতা আগে একটা চাকরি পাক,তারপর বিভাকে তার কাছে নিয়ে আসবে।
কোনো এক বিকেলে বাড়ি ফিরতেই সে দেখতে পেল চিত্রা আর শুভ্রা অসহায় মুখে বাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে আছে।সে দ্রুত এগিয়ে এসে জানতে চায়,’কি হয়েছে?এমন মন খারাপ করে আছিস কেন তোরা?’
শুভ্রা তার শুভ্র মুখখানা অমাবস্যার রজনীর মতো কালো করে বলল,’বাড়ির মালিক ফোরকান চাচা বলেছেন কালকের মধ্যে আমাদের বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে।’
‘কি?বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে মানে?’ এক প্রকার চেঁ’চিয়ে উঠে নবনীতা।
‘হু আপাই।এটাই বলে গেছে।মামি কে জিজ্ঞেস করো না হয়।’
নবনীতা হন্তদন্ত হয়ে বাড়ির ভেতর যায়।মিসেস রোকেয়া তখন তার ব্যাগ গোছানো তে ব্যস্ত।নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’এসব কি মামি?এসব কেন গোছাচ্ছ?’
মিসেস রোকেয়া তিরিক্ষি মেজাজে বললেন,’নয়তো কি করব?তুমি কি আর আমাদের ভালো ভাবে বাঁচতে দিবে?কি দরকার ছিল তোমার ঐ ফাহাদকে চ’ড় থা’প্পড় মারার?তুমি তার সাথে পারবে কিছুতে?তার টাকা পয়সা ক্ষমতা কোনোটা তোমার চেয়ে কম আছে?তুমি যাও,আরো বেশি লাগো নেতাদের সাথে।তোমার ঐ আচরণের কারণে আজ ফাহাদের দলের লোকরা এসে ফোরকান সাহেবকে ধম’কে গেছে।বলেছে কালকেই বাড়ি ছাড়তে।’
নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’এগুলা কেমন কথা?দেশে কি আইন কানুন কিছু নেই?সে কেন আমাদের উ’চ্ছেদ করবে?কি করেছি আমরা?মগের মুলুক নাকি?তার মন চাইলেই সে আমাদের বাড়ি ছাড়া করবে?আমি কেইস করব তার নামে।’
মিসেস রোকেয়া তার কথা শুনেই দুই হাত জোর করে কপালে ঠেকিয়ে বললেন,’আল্লাহর দোহাই লাগে।তোমার এই প্রতিবাদ তুমি অন্য কোনো সময় করবে।এখন আপাতত আমি আর আমার মেয়ে এই ঝামেলা থেকে উদ্ধার হয়ে নেই।এরপর তুমি কেস ঠুকো,যা মন চায় তা করো।আমি কিছু বলব না।’
নবনীতা তার জামাকাপড়ের স্তুপ দেখে সন্দিহান চোখে বলল,’তোমরা কোথায় যাচ্ছ?’
মিসেস রোকেয়া কাপড়গুলো স্যুটকেসে রাখতে রাখতে বললেন,’আমি আর প্রথা আমার বাপের বাড়ি যাচ্ছি।আপাতত সেদিকেই থাকব।’
‘আর আমরা?’ চটপট প্রশ্ন করল নবনীতা।
মিসেস রোকেয়া গজরাতে গজরাতে বললেন,’জাহা’ন্নামে যাও তোমরা।আমার কি?এসব করার আগে আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে?যত বড়ো মুখ না অতো বড়ো কথা! গিয়েছে ফাহাদের সাথে ঝামেলা বাঁধাতে।এখন বুঝো ঠেলা!’
নবনীতা ব্যস্ত হয়ে জানতে চায়,’আর মামা?মামার কি হবে?’
‘তোমার মামার কি হবে আমি জানি না।তুমি তো খুব গলাবাজি করো তোমার মামা,তোমার মামা করে।এখন দেখ তোমার মামার তুমি কি করবে।’
কথা শেষ করেই তিনি অন্য কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।নবনীতা তার পিছু পিছু গিয়ে অস্থির হয়ে বলল,’না মামি।এটা হয় না।ফাহাদের একটা শিক্ষা হওয়া দরকার।আমি তো কোনো ভুল করিনি।তাই না মামি?’
মিসেস রোকেয়া বেগম ব্যঙ্গ করে বললেন,’না না তুমি কি করে ভুল করবে?তুমি তো ফেরেস্তা।ভুল সব আমাদের।এবার আমাদের মুক্তি দাও।যেখানে খুশি যাও।আমাদের টা আমরা বুঝে নিব।’
নবনীতা যখন কয়েক দফা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো তখন সে ফোরকান সাহেবের শরণাপন্ন হয়।ফোরকান সাহেব তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তার কিছুই করার নেই।এসব রাজনৈতিক ঝামেলায় তিনি জড়াতে পারবেন না।এই বাড়ি ভাড়া দিয়েই তার পেট চলে।নবনীতাকে বাড়ি ছাড়া না করলে ফাহাদ তার বাড়িঘর ভেঙে দিবে।তাই তিনি কিছুতেই নবনীতাকে এদিকে রাখতে পারবেন না।
নবনীতা বাড়ি ফিরল এক বুক হতাশা নিয়ে।পুরো রাত সে জেগে রইল।সকালে কি হবে সে জানে না।মিসেস রোকেয়া আর প্রথা ঘরের অর্ধেক মালামাল নিয়ে তার বাবার বাড়ি চলে গেছেন।কেবল বাড়িতে ফেলে গেছেন তার প’ঙ্গু স্বামীকে।তাকে নিয়ে কি লাভ?বাড়তি আব’র্জনা যত কম থাকবে ততই ভালো।
সারারাত নবনীতার কেটেছে প্রচন্ড উৎ’কন্ঠার।সে জানে এ বাড়ি ছাড়া বাদে তার আর কোনো পথ নেই।কিন্তু সে কোথায় যাবে?কার কাছে আশ্রয় নিবে?কি করবে সে?
রাত বারোটা বাজে রিমি তাকে ফোন দিয়েছিল।সে সব খুলে বলতেই রিমি বলেছে সে যেন তার বাসায় গিয়ে উঠে।কিন্তু নবনীতা তার বাড়ি গিয়ে তার বোঝা বাড়াতে চায় না।সে চায় একটা চাকরি।যেটা তাকে মাথা উঁচু করে বাঁচতে সাহায্য করবে।
রিমির কলটা কাটার পরেও সে চুপচাপ দীর্ঘসময় দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসেছিল।ফজরের দিকেই রিমি তাকে আবারো কল দেয়।ধরতেই হড়বড় করে জানায়,’নবনী একটা চাকরির খোঁজ পেয়েছি।ধানমন্ডি তে অফিস।খুব ভালো জব।তুই কি কালকে ইন্টারভিউ দিবি একটা?’
নবনীতা সাথে সাথেই সে প্রস্তাব লুফে নেয়।খুশিতে গদো গদো হয়ে বলে,’অনেক অনেক ধন্যবাদ রিমি।তুই যে কি করে এতো অল্প সময়ে চাকরির খোঁজ আনতে পারিস কে জানে।অনেক ধন্যবাদ।’
জবাবে রিমি কেবল আমতা আমতা করে বলে,’ঐ আরকি।নেটওয়ার্ক ভালো আমার।’
সে ফোন রাখে।তারপর দ্রুত ডায়াল করে অন্য একটি নম্বরে।কল রিসিভ হতেই বলে,’ভাইয়া সে রাজি হয়েছে।’
অন্যপাশ থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,’কিছু টের পায়নি তো?’
‘না ভাইয়া।এখনো টের পায়নি।’
‘গুড।সামনেও পাবে না আশা করি।’
রিমি কল কাটে।নবনীতার চেয়েও সে বেশি খুশি আজ।নবনীতার দুঃখ গুলো সে নিজের চোখে দেখেছে।এবার একটু সুখ মেয়েটা ডিসার্ভ করে।তাই না?সে কল্পনা করে নবনীতার সামনের দিনগুলো স্বপ্নের মতো সুন্দর হবে।সে জানে কালকের চাকরি টা নিশ্চিত হওয়ার পর নবনীতা সারাদিন খুশিতে পুরো শহর চষে বেড়াবে।সে তার সই কে চেনে।সে এমনই।বাইরে থেকে কঠিন,অথচ ভেতর থেকে বাচ্চামো স্বভাবে ভরপুর।
***
ধানমন্ডির যেই অফিসের ঠিকানা রিমি নবনীতাকে মেইল করে পাঠিয়েছিল,সেটার সামনে গিয়েই নবনীতার মাথা ঘুরে গেল।এত্তো সুন্দর অফিস?বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো রিসোর্ট।এতো সুন্দর অফিসে তার মতো সদ্য গ্রেজুয়েটের চাকরি হবে?সে এক প্রকার হতাশা নিয়েই ইন্টারভিউ এর উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।সে জানে এতো বড় অফিসে তার চাকরি কিছুতেই হবে না।
তার ইন্টারভিউ নিয়েছিল দুই জন ভদ্রলোক।সেখানে তাকে খুব জটিল কিছু জিজ্ঞেস করা হয়নি।কেবল জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সার্কিট সংক্রান্ত ছোটখাটো বিষয় আর ওয়েব ডেভেলপমেন্ট নিয়ে একদম বসিক কিছু প্রশ্ন।নবনীতা প্রত্যেকটা প্রশ্নের ঠিকঠাক জবাব দিয়েছে।তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে সেদিনই তার চাকরি কনফার্ম করা হয়।
সে আনন্দে উচ্ছ্বাসে কোনো প্রতিক্রিয়া পর্যন্ত ব্যক্ত করতে পারছিলো না।তার চাকরি টা শেষ পর্যন্ত হয়ে গেছে?সে একটা পারমানেন্ট রোজগারের উৎস পেয়ে গেছে?হঠাৎই কিছু একটা মনে পড়তে সে কিছুটা ভাবুক হয়ে গেল।বেতনের ব্যাপারে তো কিছু জানা হয়নি।বেতন কতো হবে?দশ হাজারের কম হলে তো তার জন্য ঝামেলা হয়ে যাবে।পরক্ষণেই আবার তার মনে হয়,’ধুর! এতো বড় অফিসের চাকরি নিশ্চয়ই এতো কম বেতনের হবে না।’
সে শেষপর্যন্ত অধৈর্য হয়ে প্রশ্নটা করেই ফেলল,’কিছু মনে না করলে আমাকে একটু বলবেন স্যালারি টা কতো?’
দুইজনের মাঝে একজন মাথা তুলে খুব স্বাভাবিক গলায় বলল,’সত্তর হাজার।’
নবনীতা তার কথা শুনতেই এক লাফে উঠে দাঁড়ায়।তার এমন হঠাৎ উঠে দাঁড়ানো তে সামনে বসে থাকা দু’টো লোক কিছুটা চমকে উঠল।জানতে চাইল,’এনি প্রবলেম?আপনার কাছে কম মনে হলে আমরা গভর্নিং বডির সাথে কথা বলে আরো কিছুটা বাড়াতে পারি স্যালারি।’
নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত নাড়তে নাড়তে বলল,’না না।এমন কিছু না।আমি খুব খুশি।আমার কোনো সমস্যা নাই।প্লিজ গভর্নিং বডিকে এমন কিছু বলবেন না।’
দুই জনের মধ্যে একজন জানতে চাইল,’রেসিডেন্স কোথায় আপনার?’
নবনীতা পড়েছে নতুন বিপাকে।সে কেমন করে বলবে তার আপাতত কোনো রেসিডেন্সই নেই?তার উদভ্রান্ত দৃষ্টি দেখেই চেয়ারে বসে থাকা একজন বললেন,’মিস আপনাকে কিন্তু ধানমন্ডি এরিয়াতেই থাকতে হবে।রেসিডেন্সের অসুবিধা হলে জানাতে পারেন।আমাদের কোম্পানির অনেক গুলো এপার্টমেন্ট আছে এদিকে।সেগুলো তে আমাদের এমপ্লয়িদের আমরা কিছুটা ডিসকাউন্টে থাকার ব্যবস্থা করে থাকি।’
একটা প্রবাদ আছে না?মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি।নবনীতার মনে হচ্ছে আজ তার সাথে সেই প্রবাদ অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে।সে চেয়েছিল হাজার দশেকের একটা চাকরি।অথচ পেল সত্তর হাজার টাকার চাকরি।সত্তর হাজার! উচ্চারণ করতেও কষ্ট হয় নবনীতার।সবকিছু কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।আবার নাকি তারাই স্বল্পমূল্য রেসিডেন্স প্রোভাইড করবে।নবনীতার সাথে এসব হচ্ছে টা কি?সে তো এতোকিছুও আশা করেনি।
সেদিন বিকেলেই তাকে তার এপার্টমেন্ট দেখানো হলো।এত্তো সুন্দর বাসা দেখেই নবনীতার মনে হচ্ছিল সে খুশিতে কেঁদে ফেলবে।কাল রাত সে একটা আশ্রয়ের জন্য ছটফট করছিল।আর আজ এই এতো সুন্দর এপার্টমেন্ট টা তার! সে জানে এর ভাড়া ডিসকাউন্টেও বেশ চওড়া হবে।তবে তাতে কি?বেতন টাও তো কম না।এই টাকায় সে আরামে সবকিছু করতে পারবে।নবনীতা সারাদিন মনে মনে বিড়বিড় করল,’সত্তর হাজার! সত্তর হাজার! সত্তর হাজার!’
বিকেলে তার এপার্টমেন্টের চাবি তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো।বলা হলো প্রথম মাসের বেতন পেয়েই সে যেন ভাড়া মিটিয়ে দেয়।বাড়ির ভাড়া চল্লিশ হাজার টাকা।কিন্তু নবনীতার জন্য ভাড়া মাত্র বিশ হাজার টাকা।সে তাদের কর্মচারী বলে কথা!
নবনীতার কথা অত্যাধিক খুশিতে জড়িয়ে যাচ্ছিল।সে তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,’আপনারা কি প্লিজ আপনাদের গভর্নিং বডির কাউকে আমার সাথে কথা বলিয়ে দিবেন?আমি তাকে একটি বারের জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই।’
ফর্মাল ড্রেসে থাকা লোকটা কিছুটা বিব্রত কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বলল,’একচ্যুয়ালি ম্যাম,স্যারের সাথে তো এমন হুটহাট কথা বলানো যায় না।বুঝেনই তো বিষয়টা।’
নবনীতা কপাল চাপড়ায়।জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলে,’সেই তো! সে তো কতো বড়ো কোম্পানির মালিক।তার কি এতো সময় আছে?আমারই মাথা ঠিক নেই।আচ্ছা আপনি একটু তার সাথে দেখা হলে জানিয়ে দিবেন প্লিজ।’
নবনীতা সেদিন ইচ্ছে মতো টাকা খরচা করল।তার হাতে যত টাকা ছিল,পুরোটাই ঢেলে দিল আজেবাজে কেনাকাটায়।বিকেলের একটু পরেই সে উবার বুক করে সাদেক সাহেব,শুভ্রা আর চিত্রাকে তার নতুন বাড়িতে নিয়ে আসে।সবকিছু একটু গুছিয়ে সে রিমিকে চতুর্থ বারের মতো কল দিয়ে বলল,’কোথায় তুই?এখনো এলি না যে?’
রিমি আলগোছে হেসে বলল,’আসছি আসছি।পথেই আছি।তুই এতো হম্বিতম্বি করছিস কেন?আসছি আমি।একটু অপেক্ষা কর।’
বিভাকে নিয়ে রিমি নবনীতার নতুন এপার্টমেন্টে পা রাখতেই কোথা থেকে নবনীতা ছুটে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।শুধু জড়িয়ে ধরেই ক্ষ্যান্ত হয়নি।চট করে তার দুই হাতে দু’টো চুমুও খেল।কৃতজ্ঞতা ভরা কন্ঠে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,’থ্যাঙ্ক ইউ রিমি।তুই যে কোথা থেকে এতো ভালো চাকরির খোঁজ পেয়েছিস জানি না।ঐ দিকের মানুষ গুলো এত্তো ভালো! জানিস কি বলেছে ওরা আমায়?’
‘না তো।কি বলেছে?’
‘বলেছে এই মাসের বেতন টা আমায় আগে আগে দিবে।কারণ আমি স্টুডেন্ট।’
রিমি অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,’চমৎকার তো! আল্লাহ তোর সহায় হয়েছে বুঝেছিস।এজন্য তোর কপাল খুলে গেছে।’
নবনীতা জবাবে কেবল প্রশস্ত হাসল।রিমি চারদিক দেখে বলল,’সেকি! জিনিসপত্র তো খুবই কম।কেবল খাট আর তোষক আছে।’
নবনীতা নিরুদ্বেগ হয়ে বলল,’হ্যাঁ।ঐ বাড়িতে যা ছিলো,সবই ভ্যান দিয়ে এনেছি।আলমারি মামার ঘরে রেখেছি।তবে ড্রেসিং টেবিলটা আনি নি।নতুন কিনব একটা।আর হাড়ি পাতিল সব মামি নিয়ে গেছে।ব্যাপার না।আমি টাকা পেলেই কিনে ফেলব।আপাতত সব অর্ডার করে খাবো।’
রিমি ঠোঁট উল্টে বড় বড় চোখ করে বলল,’বাপরে! তুই তো পুরাই বড়লোক হয়ে গেলি রে নবনীতা! দেখিস বড়োলোক হয়ে আবার আমায় ভুলে যাসনে।’
নবনীতা জবাবে কেবল মুচকি হাসে।রিমির কাঁধে আলতো চাপড় মেরে বলে,’ধুর! এমন কিছু না।’
সেদিন সন্ধ্যার পর পর খুব বৃষ্টি হলো।নবনীতা শুভ্রা আর সাদেক সাহেবের কাছে বিভা আর চিত্রাকে রেখে রিমিকে নিয়ে বহুতল ভবনটি থেকে বেরিয়ে এলো।চারদিকে ঝুম ঝুম বৃষ্টির শব্দে পরিবেশ টা ভীষণ উৎসবমুখর হয়ে উঠছে।নবনীতা দু’হাত ছড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজল।রিমি খেয়াল করল বৃষ্টির পানির সাথে তার চোখের পানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।মেয়েটা সম্ভবত এই পাঁচ বছরের অধিক সময় ধরে কাটানো যা’যাবর জীবনে এই প্রথম একটু শান্তি একটু আনন্দের দেখা পেয়েছে।যে মানুষটা তাকে এই আনন্দ টুকু এনে দিয়েছে,সে মানুষটার কথা জানলে কি সে খুশি হবে?রিমি আনমনে হাসে।খুশি হতেই হবে।এই ভালোবাসার কাছে নবনীতাকে পরাস্ত হতেই হবে।
নবনীতা বিল্ডিংয়ের সামনের খোলা জায়গায় দু’চোখ বন্ধ করে দু’হাত মেলে ভিজছিল।অদূরেই গাঢ় নীল তথা কালচে নীল রঙের ল্যান্ড ক্রুজারটা দীর্ঘসময় ধরে থেমে তাকেই দেখছিল।এর মালিক নিজের সমস্ত ব্যস্ততা কে একপাশে সরিয়ে সন্ধ্যা নামতেই এদিকে ছুটে এসেছে।কেবল এই হাস্যোজ্জ্বল মুখটিকে সামনাসামনি একনজর দেখার জন্য।গাড়ির জানালায় নবনীতার প্রতিচ্ছবি দেখা যাচ্ছিল।সে হাত বাড়িয়ে সেটা ছুঁয়ে দেয়।ইশশ! কি সুন্দর দেখাচ্ছে এই মেয়েটাকে! যাক,পরীর একটা সুন্দর ঘর হয়েছে এতোদিনে।
সে তার প্রতিচ্ছবি ছুঁয়ে দিয়েই বলল,’তুমি কি তোমার এই ছোট্ট সংসারে আমায় ঠায় দিবে পরী?কথা দিচ্ছি,নিজেকে শুধরে দেখাবো।’
চলবে-