কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-২১(ক)

0
11

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(২১)[প্রথম অংশ]

নবনীতা গোমড়া মুখ করে কয়েক সেকেন্ডের জন্য তাকে দেখে।দেখা শেষ হতেই চোখ সরু করে বলে,’সত্যি করে বলুন তো,আপনি মনে মনে আবার কি ছক কষছেন?’

আরহাম তার কথা শুনতেই হো হো করে হেসে ফেলল।তার হাসি দেখে নবনীতার শরীর ছ্যান্যান করে উঠে।সে কি কোনো উপহাস করেছে?এমন করে হাসছে কেন ঐ লোক?আরহাম এক হাত পেটে চেপে হাসি থামাতে থামাতে বলল,’মাই গড! তুমি এখানেও ছক ফক নিয়ে পড়ে আছ?তোমার কাজই আমাকে সন্দেহ করা।যাও তো তুমি।সামনে থাকলেই উল্টা পাল্টা বকে যাও তুমি।’

নবনীতা কিছুক্ষণ চুপ থাকে।পরক্ষণেই থমথমে মুখে বলে,’ইফাজ আমার আত্মীয় হয়।আপনি পরবর্তী তে এসবে নাক গলাবেন না বলে দিলাম।আমার টা আমাকে দেখে নিতে দিন।’

‘ইফাজ তোমার কি এমন আত্মীয় হয় একটু শুনি?তোমার মামির ভাইয়ের ছেলে।অনেক দূরের আত্মীয়।’ কিছুটা তাচ্ছিল্য করে বলল আরহাম।

নবনীতা জোর গলায় জবাব দেয়,’আমি যেহেতু আমার মামা মামির সাথে থাকি,তাই এটাও আমাকে মানিয়ে চলতে হয়।কাছে দূরে বিষয় না।আপনি এখন থেকে দূরে থাকবেন এসব থেকে।’
সে থামে।হঠাৎই চোখ সরু করে বলে,’শুধু ইফাজ না।আপনি আমার চিত্র থেকেও দূরে থাকবেন।বুঝেছেন?’

আরহাম চোখ তুলে তাকে দেখল।দেখতেই শব্দ করে হেসে ফেলল।মুখে সে হাসি ধরে রেখেই বলল,’আর ইউ জেলাস?’

‘কোন দুঃখে জেলাস হবো আমি?’

‘এই যে চিত্র আমাকে এতো ভালোবাসে সেজন্য।তুমি তো আবার চিত্র’র ভালোবাসা কে তোমার ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করো।’

নবনীতা থতমত খেয়ে চুপ হয়ে গেল।আড়চোখে একবার আরহাম কে দেখে চাপা স্বরে বলল,’সে যাই হোক।আপনি নিজেকে নিয়ে ভাবুন।নির্বাচন নিয়ে ভাবুন।নিজের চ্যালাপেলা দের কন্ট্রোল করুন।আমার সিকিউরিটি আমি নিজেই এনশিউর করতে পারি।’

কথা শেষে সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না।যেরকম হনহনিয়ে এসেছিল,ঠিক সেরকম করেই বেরিয়ে গেল।সে যেতেই ওয়াজিদ অবাক হয়ে বলল,’ইফাজ তাহলে নবনীতার পরিচিত?’

আরহাম দায়সারা ভাবে জবাব দেয়,’হু।’

‘সে নবনীতার হাত ধরেছিল রাস্তায়?’

অন্য দিক থেকে আগের মতোই জবাব আসে,’হু’

ওয়াজিদ চোখ মেলে সামনে দেখে।বুকের বা পাশটায় চিনচিন ব্যথা করছে তার।কেন করছে?আরহামের দিকে সে নির্নিমেষ কয়েক পল তাকিয়ে থাকে।সে কিছু একটা অনুধাবন করতে পারছে।যা সে অনুধাবন করছে সেটা তার জন্য সুখকর না।তার সামনে বসে থাকা যুবকটিকে সে চেনে।খুব ভালো মতো জানে সে যখন কোনো কিছু নিয়ে উঠে পড়ে লাগে,তখন সে সেটা হাসিল করেই ছাড়ে।সে ছোট থেকেই লাগাম’হীন,বে’পরোয়া আর নিজের খেয়ালখুশির মালিক।

ওয়াজিদ কাউচ ছেড়ে উঠে ঠিক তার মুখোমুখি চেয়ারে বসল।নিচু আওয়াজে ডাকল,’আরহাম!’

আরহাম তাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকায়।জিজ্ঞাসু হয়ে বলে,’কিরে?কিছু বলবি?’

ওয়াজিদ একটা শ্বাস ছেড়ে নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,’হু,বলব।’

‘কি?’

‘তুই কি নবনীতাকে পছন্দ করিস আরহাম?’ কোনো ভনিতা না করে ওয়াজিদের সোজাসাপটা প্রশ্ন।

আরহাম তার কথা শুনতেই এক গাল হাসে।কপালে আঙুল ঠেকিয়ে গাঢ় স্বরে বলে,’নাথিং লাইক দ্যাট।জাস্ট ইনফেচুয়েশন।’

ওয়াজিদ অধৈর্য হয়ে বলল,’নো ম্যান।দ্যাট কান্ট বি ইনফেচুয়েশন।কেবল ইনফেচুয়েশন থেকে কেউ এতোটা বাড়াবাড়ি করে না।তুই কতোটা বাড়াবাড়ি শুরু করেছিস তুই জানিস?’

আরহাম মুচকি হাসে।ওয়াজিদের চোখে চোখ রেখে শুধায়,’তাহলে তুই বল এটা কি?শুনি আমি।’

ওয়াজিদ কয়েক সেকেন্ড শান্ত হয়ে বসে থাকে।একটু ধাতস্থ হতেই বরফ শীতল কন্ঠে জবাব দেয়,’এটা অনুভূতি।ইউ ফিল ফর হার।তোর চোখ বলছে তুই তাকে পছন্দ করিস।তুই কি কিছুই বুঝিস না?’

আরহাম আলগোছে হেসে বলল,’না আমি বুঝি না।তুই আর আদি আছিস না সবকিছু বুঝার জন্য?আমি অতো বুঝতে চাই না।অনুভূতি অর ইনফেচুয়েশন,হোয়াটএভার ইট ইজ,আমি নবনীতার আশেপাশে ঐ ইফাজ টিফাজকে সহ্য করতে পারি না।এখন তুই প্লিজ জ্ঞান ঝাড়িস না যে আমি প্রেমে পড়েছি হ্যান ত্যান।এমন কিছু না ভাই।প্রেম টেমের কোনো ফাংশন নেই আমার।এসব অনুভূতি ইনফেচুয়েশন সময়ের সাথে কেটে যাবে।’

সে থামে।হঠাৎ কিছু একটা ভেবে তিরিক্ষি স্বরে বলে,’শা’লা ঐ সময়টাই তো পাচ্ছি না।রোজ রোজ কোনো না কোনো ভাবে দেখা হয়ে যাচ্ছে।মাইন্ড ডাইভার্ট করার সময়টুকুও পাচ্ছি না বা’ল।’

ওয়াজিদ তার কথা শুনেই নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়।আরহাম চোখ পাকিয়ে বলল,’কিরে?কোথায় যাচ্ছিস তুই?’

ওয়াজিদ চুপচাপ সামনে পা বাড়ায়।নিরাসক্ত কন্ঠে বিড়বিড় করে,’শরীর খারাপ লাগছে আমার।বাড়ি গিয়ে একটু রেস্ট করব আমি।তুই থাক,আমি একটু আসি।’
.
.
.
.
সিটি কলেজের সামনে রোজই আড্ডাবাজ বেকার ছেলেপুলে গুলো ভীড় জমায়।আজও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।শুভ্রা কলেজ শেষে বাইরে আসতেই এদের দেখা পেল।

এদের মাঝে একজনের নাম বিনয়।নাম নাকি মানুষের ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব ফেলে।এই কথা শুভ্রা সেদিন থেকে অবিশ্বাস করা শুরু করেছে যেদিন থেকে সে বিনয় কে দেখেছে।এর মতো বদ’মাইশ আর উচ্ছৃ’ঙ্খল সে তার জীবনেও দু’টো দেখেনি।এর নাম নাকি বিনয়! বিনয়ের ব টাও নেই তার মাঝে।

শুভ্রানী খুব বেশি মেধাবী না।কিন্তু সে খুব পরিশ্রমী।নিজেদের অ’সহায়ত্ব তাকে পরিশ্রমী করে তুলেছে।বাবা মায়ের মৃ’ত্যুর পর সে যখন দেখত আপাই নামের মানুষটি সবে মাত্র কলেজ জীবন শেষ করে একহাতে বই আর অন্য হাতে চিত্রা কে আগলে নিচ্ছে,তখন থেকেই শুভ্রা প্রতিজ্ঞা করেছে সে খুব পড়াশোনা করবে,সে আপাইয়ের দুঃখ দূর করবে।শুভ্রার বই খাতা কিনতে আপাই কখনো কার্পন্য করে না।শুভ্রা বেঁচে থাকতে কোনোদিনও তার ঋণ শোধ করতে পারবে না।কিন্তু সে এর কিছুটা ফিরিয়ে দিতে চায়।আপাই আর কতো ধুকে ধুকে ম’রবে?এখন তো শুভ্রা বড় হচ্ছে।সে নিজেই এখন আপার ঢাল হবে।

শুভ্রা খুব মন দিয়ে পড়ে।ছিমছাম গড়নের যে অসম্ভব ভালো মেয়ে মানুষটি নিঃস্বার্থভাবে তাকে আর চিত্রকে আগলে রেখেছে,ঐ মেয়েটিকে শুভ্রা গর্ববোধ করাতে চায়।সে খুব বেশি পড়তে চায়।পড়াশোনার পাশাপাশি সে বিতর্ক ক্লাবেও নাম লিখিয়েছিল।সেই থেকেই কলেজে তার টুকটাক পরিচিতি।তখন থেকেই সে টিটু,মিরন আর বিনয়ের চোখে পড়েছে।টিটু আর মিরন যদিও আপাইয়ের পি’টুনি খেয়ে তার দিকে নজর দেওয়া বন্ধ করেছে,কিন্তু বিনয় সেই আগের মতোই আছে।সে তাকে দেখলেই অ’শালীন অঙ্গভঙ্গি করে,শিশ বাজায়,অসভ্য আচরণ করে।

আজকেও সে বেরিয়ে আসতেই বিনয় তাকে দেখে শিশ বাজালো।সে আটসাট হয়ে আরেকটু সামনে যেতেই বিনয় তার মুখোমুখি এসে তার পথ রোধ করে দাঁড়ায়।শুভ্রা দ্রুত তাকে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে সে দুই হাত প্রসারিত করে তার যাওয়ার পথ বন্ধ করে।জিভ দিয়ে দুই ঠোঁ’ট ভিজিয়ে কুৎ’সিত ইশারা করে বলে,’আহা ময়না যাচ্ছো কোথায়?একটু কথা তো বলো।’

শুভ্রা একটা শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা কন্ঠে বলল,’প্লিজ রাস্তা ছাড়ুন।’

বিনয় লোলুপ দৃষ্টিতে একবার উপর নিচ তাকে দেখে।সেই দৃষ্টি দেখলেই শুভ্রার বুক ফে’টে কান্না আসে।সে তড়িঘড়ি করে অন্যদিক দিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হয়।সে অন্য পথে যেতেই বিনয় দ্রুত পায়ে তার পিছু নেয়।

শুভ্রা শ্বাস বন্ধ করে ছুটে যায় এক প্রকার।বিনয় নিজেও তার পেছনে ছুটে আসে।তাকে থামানোর উদ্দেশ্যে যেই না সে তার হাত ধরার জন্য নিজের হাতটা এগিয়ে নিল ,ঠিক তখনই কোথা থেকে ছুটে এসে একটা শক্ত হাত বিনয়ের কুৎসিত হাতটাকে খপ করে ধরে ফেলল।

বিনয় থামল।শুভ্রা নিজেও থামল।পেছন ঘুরে বড় বড় চোখ করে তাকে বিনয়ের নোং’রা স্পর্শ থেকে বাঁচানো লোকটিকে দেখল।বিনয় নিজেও চোখ তুলে সামনে তাকায়।সামনে দাঁড়ানো ছেলেটিকে দেখা মাত্রই সে তব্দা খেয়ে বলল,’আরিশ ভাই।আপনি?’

আরিশ শান্ত চোখে একবার তাকে আর একবার শুভ্রাকে দেখে।গম্ভীর গলায় জানতে চায়,’এদিকে কি করছিস?শুভ্রার পিছু নিয়েছিস কেন?’

বিনয় ভড়কে গেল।মেয়েটি কি আরিশ ভাইয়ের পরিচিত?সে তো তাদের পরিচিত মেয়ে বলতে সারাহ আর তাসনুভা কেই চিনে।সে আমতা আমতা করে বলে,’না মানে,ইয়ে ভাই,আসলে ইয়ে হইছে,,,’

আরিশ তাকে কথার মাঝেই থামিয়ে দিলো।একহাত তুলে কিছুটা শা’সিয়ে বলল,’আর কখনো এমন শুভ্রার পিছু নিবি না।বুঝেছিস?’

বিনয় দ্রুত মাথা নাড়ে।আরিশ কাঠকাঠ স্বরে বলে,’এখন যা এদিক থেকে।’

বিনয় যাওয়ার আগে আরো একবার তাকে সালাম দিলো।যেতে যেতেই বলল,’আরহাম ভাইকে আমার সালাম দিবেন ভাই।’

সে চলে যেতেই আরিশ সোজাসুজি শুভ্রার দিকে দেখে বলল,’ঠিক আছ শুভ্রা?’

শুভ্রা উপরনিচ মাথা নাড়ে।কৃতজ্ঞ ভরা কন্ঠে বিড়বিড় করে,’ঠিক আছি আমি।’

‘কোথায় যাচ্ছ?বাসায়?’

‘জ্বী?’

‘আমি ড্রপ করে দেই?’ খুবই নম্র হয়ে প্রশ্ন করে আরিশ।

তার কথা শুনতেই শুভ্রা কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করল।তার এলোমেলো দৃষ্টি দেখতেই আরিশ অমায়িক হেসে বলল,’আনইজি ফিল করার কিছু নেই।আমরা তো এখন অল্প সল্প চিনি নিজেদের তাই না?’

শুভ্রা কেবল আস্তে করে মাথা নাড়ে।আরিশ পুনরায় জিজ্ঞেস করে,’ড্রপ করে দিব শুভ্রা?’

কলেজ ইউনিফর্মের পেটের দিকটা খাঁ’মচে ধরে শুভ্রা মিনমিন করে জবাব দেয়,’জ্বী,ঠিক আছে।’

গাড়িতে বসেই আরিশ সবার প্রথমে এসি অন করল।তারপর গাড়িতে থাকা পানির বোতল টা শুভ্রার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’নাও পানি খাও।একটু ঠান্ডা হও।’

শুভ্রা বাধ্য মেয়ের মতো বোতল হাতে নেয়।আরিশ সিট বেল্ট লাগাতে লাগাতে বলে,’ঐ ব’খাটে গুলো কি রোজই এমন করে?’

কয়েক ঢোক পানি খেয়ে শুভ্রা মলিন মুখে জবাব দেয়,’জ্বী দেখতে পেলেই এমন করে।’

আরিশ স্মিত হেসে বলল,’আর করবে না।নিশ্চিন্ত থাকতে পারো।’

শুভ্রা মিষ্টি করে হাসল।একটু পরে কিছু একটা মনে পড়তেই বলল,’আপনি যেন কোন ইউনিভার্সিটি তে পড়েন?’

‘ব্র্যাক।’স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে জবাব দেয় আরিশ।

‘আপনাদের ক্যাম্পাস বাড্ডাতে না?’

‘হু।কেন বলো তো?’

শুভ্রা বোকা বোকা হেসে বলল,’না মানে আপনি হঠাৎ এই রাস্তায় এলেন তো তাই।’

আরিশ গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে গাঢ় স্বরে বলল,’এদিকে এসেছি কাজে।ভাইয়া পাঠিয়েছিল।তোমাদের কলেজের অফিসে একটা কাজ ছিল।তাই।’

শুভ্রা ছোট করে জবাব দিলো,’ওহহ বুঝেছি।’

প্রতিউত্তরে আরিশ কেবল একগাল হাসল।কুচকুচে কালো টয়োটার গাড়িটা নির্দিষ্ট গন্তব্য নিয়ে চলতে শুরু করে।সেই সাথে চলতে শুরু হয় দু’জন মানব মানবীর পথ চলা।তারা কি জানে তাদের পরবর্তী গন্তব্য কোথায় গিয়ে থামবে?

_____________________________________________

শান্তিনগর বাজারের বিপরীত দিকের রাস্তায় কর্ণফুলী শপিং মলের সামনে প্রায় রোজই অস্থায়ী ভাবে কম বয়সী ছেলেরা তাদের জিনিসপত্র সাজিয়ে বেচাকেনার উদ্দেশ্যে বসে।

নবনীতা সেদিকে আসতেই হঠাৎ একটা ছেলেকে দেখে তার কদম শ্লথ হয়।সে এগিয়ে যায় তার দিকে।শ্যাম বর্ণের রোগা পাতলা ছেলেটিকে দেখতে খুবই অল্প বয়সের মনে হচ্ছে।তার পরনের সাদা গেঞ্জিটা ধুলো ময়লা জমে আর সাদা নেই,সেটা রীতিমতো ছাইরঙা হয়ে গেছে।তার মুখটা কতো মলিন! দায়িত্বের ভারে ঝুকে যাওয়া কাঁধটা নবনীতার কোমল হৃদয়ে আ’ঘাত করে।

সে এগিয়ে এসে বলে,’নাম কি তোমার বাচ্চা?’

ছেলেটি অবাক হয়ে তাকে দেখে।দেখেই গোল গোল চোখ করে বলে,’শাহাদাত।’

নবনীতা মিষ্টি করে হেসে বলে,’বাহ! খুব সুন্দর নাম তো।তোমার বয়স কতো শাহাদাত?’

শাহাদাত নামের ছেলেটি দায়সারাভাবে উত্তর দেয়,’এগারো।’

নবনীতার বুকটা ধ্বক করে উঠে।সে একহাত শাহাদাতের থুতনিতে রেখে মলিন মুখে জানতে চায়,’বাড়িতে আর কেউ নেই সোনা?তুমি এতো ছোট বয়সেই এসব করছ কেন?তোমার বাড়িতে কেউ নেই?’

শাহাদাত দুই দিকে মাথা নাড়ে।স্বাভাবিক গলায় বলে,’না আপা।আমার বাপ অনেক আগেই মই’রা গেছে।মা আমারে আর আমার বইনরে থুইয়া আরেক খানে গেছে গা।’

‘তোমার বোনও আছে?’ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে নবনীতা।

শাহাদাত উত্তর দেয়,’হ আছে।তিন বছর বয়স।’

নবনীতা আঁতকে উঠে বলল,’তাকে কোথায় রেখে এসেছ তুমি?’

শাহাদাত তার তর্জনী তুলে মার্কেটের প্রবেশ পথের একটু ডানদিকে একজন মাঝবয়েসী মহিলার কোলে থাকা একটা ফুটফুটে মেয়ে বাচ্চাকে দেখিয়ে বলে,’ঐ যে বাচ্চাটা,এটাই আমার বইন।নাম বিভা।’

‘আর এই মহিলাটা কে?’

‘ফরিদা খালা।আমগোর লগেই থাকে বস্তিতে।’

নবনীতা ম্লান মুখে জবাব দেয়,’ওহহ আচ্ছা।’
তারপরই সে শাহাদাতের হাতে থাকা বইগুলো দেখে।ছোট বাচ্চাদের পড়ার বই।গত মাসেই সে চিত্রার জন্য এমন কয়েকটা বই কিনেছিল।সে ঠিক করেছে সে আজও কয়েকটা বই কিনবে।

সে দুইটা বই হাতে নিয়ে বলল,’কত রাখবে এই দু’টো?’

শাহাদাত জানায়,’একশো টাকা।’

নবনীতা তার পার্স থেকে দু’শো টাকা বের করে।টাকাটা শাহাদাতের হাতে গুজে দিয়ে বলে,’এই নাও দু’শো টাকা।একশো টাকা বইয়ের,আর বাকি একশো তোমার আর বিভার জন্য আমার ভালোবাসা।আপুর হাত খালি ভাই।নয়তো একটু বেশিই দিতাম।তুমি এই টাকায় বিভাকে কিছু কিনে খাওয়াবে কেমন?সাথে নিজেও খাবে,বুঝলে?’

এই সামান্য ভালোবাসা আর স্নেহের বাণীতে শাহাদাত নামের অনাথ ছেলেটির দুই চোখ কৃতজ্ঞতায় ভরে উঠে।এতোক্ষণ নির্লিপ্ত আর নির্বিকার থাকা ছেলেটা আচমকাই ভীষণ আবেগী হয়ে নবনীতার হাতটা তার মাথায় রাখল।অনুভূতি জড়ানো গলায় বলল,’আপা আপনি একটু আমার জন্য দোয়া কইরা দেন।আপনে আসমানের হুর।আপনার দোয়া আল্লাহ কবুল করব।’

নবনীতা তার কথা শুনেই শব্দ করে হেসে ফেলল।হাসতে হাসতে বলল,’কেন?তোমার কেন আমাকে হুর মনে হচ্ছে?’

‘ফরিদা খালা কইছে হুর রা হুদাও মাইনষেরে ভালোবাসে।আপনেও আমারে হুদাই এতো ভালোবাসা দিতাছেন।’

নবনীতা আরো কিছুক্ষণ খিলখিলিয়ে হাসল।তারপর শাহাদাতের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বলল,’অনেক বড়ো হও শাহাদাত।তোমার সাফল্যে যেন মানুষ ভীষণ আশ্চর্য হয়।খুব নাম করো সোনা।’

তার কথা শেষ হওয়ার আগেই দূর থেকে কোথাও গো’লাগু’লির শব্দে আশপাশ চঞ্চল হয়ে উঠল।ঘটনার আকস্মিকতায় নবনীতা নিজেও কেঁপে উঠে।ঘটনা কি সেটা ঠাহর করতেই তার কয়েক মিনিট লেগে যায়।একটু সময় যেতেই সে বুঝল যে এটা গু’লি চালানোর শব্দ।আরো এক দফা সমস্ত শরীর অ’বশ হয়ে আসে তার।সে চোখ মেলে দেখে লোকজন সব ছুটে শপিং মলের ভেতর গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।

গো’লাগু’লির শব্দ ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে।ব্যস্ত রাস্তাটা হঠাৎই কেমন স্তব্ধ হয়ে গেছে।চারিদিকে লোকজনের চিৎ’কার শোনা যায় শুধু।নবনীতা একটু ধাতস্থ হয়েই শাহাদাতের একহাত ধরে বলল,’চলো শাহাদাত,আমরা ভেতরে গিয়ে একটু অপেক্ষা করি সবকিছু ঠিক হওয়ার।’

শাহাদাত তার হাতে থাকা বইগুলো বাদেও আরো অনেক বই ফুটপাতে বিছিয়ে রেখেছিল।সে সেগুলো দেখতে দেখতে তাড়াহুড়ো করে বলল,’আপনে যান।আমি এডি গুছায়া আসতাছি।’

কাছেই কোথাও এবার আবারো গু’লি চালানোর শব্দ হয়।নবনীতা একহাত নিজের মাথায় চে’পে ধরে।সে যদি আর এক মুহূর্তও এদিকে থাকে তাহলে নির্ঘাত সে মাথা ঘুরে পড়ে যাবে।এই শব্দ গুলোতে তার অস্বস্তি হয়।সে কোনোরকমে মার্কেটের দিকে ছুটে যায়।নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নেয়।

আশপাশ থেকে উড়ো খবর কানে আসে আজ নাকি রাকিবের সমাবেশ ছিল রাজারবাগের দিকে।সে সমাবেশ কে ঘিরেই নাকি এই গো’লাগু’লির সূত্রপাত।কেউ কেউ বলছে শাহরিয়ার আরহাম প্রতি’শোধ পরায়ন হয়ে এই কাজ করেছে।কেউ আবার বলছে এটা নতুন কোনো ষড়’যন্ত্র।

দূর থেকে পুলিশের গাড়ির সাইরেন বাজানোর শব্দ শোনা যাচ্ছে।সময়ের সাথেই শব্দ গুলো স্পষ্ট হতে থাকে।নবনীতা টের পায় দুর্বৃ’ত্তরা খুব কাছাকাছি কোথাও চলে এসেছে।

হঠাৎই তার চোখ যায় সড়কের অন্যপাশে।মুখে কাপড় বাঁধা একটা যুবক সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।তার হাতে উন্নত মডেলের একটা পি’স্তল।তার এক আঙুল ট্রিগারে রাখা।সে গু’লি করছে এলোপাতাড়ি।কোনো নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই।কেবল গু’লি করেই যাচ্ছে।রাস্তায় থাকা একটা কুকুরের গায়ে সে গুলি লাগতেই সেটা ছি’টকে মাটিতে গিয়ে পড়ল।তার র’ক্তে সড়কের বেশ খানিকটা অংশ র’ঞ্জিত হলো।নবনীতা পরনের ওড়না টা মুখে চাপে।তার বমি পাচ্ছে ভীষণ।

শাহাদাত তখনো তার বেচার জন্য কেনা বইগুলো গোছাতে ব্যস্ত।নবনীতা তাকে দেখেই চিৎ’কার করে বলল,’আর বই গোছাতে হবে না শাহাদাত।তুমি এদিকে আসো।এক্ষুনি আসো।’

শাহাদাত কেবলই তার কন্ঠ শুনে পেছন ফিরেছিল,তক্ষুনি এলোপাতাড়ি ছুড়’তে থাকা গু’লি গুলোর একটি তার পেটের কাছ দিয়ে ফুটো করে বেরিয়ে গেল।এগারো বছরের ছোট্ট ছেলেটা তার স্বপ্নেও এমনকিছু কল্পনা করেনি।সে ফ্যালফ্যাল চোখে নিজের পেটের দিকে দেখে।মুহূর্তেই তার ছোট্ট শরীরটা মাটিতে ঢলে পড়ে।নবনীতা গগন কাঁপিয়ে চিৎ’কার দেয়,’শাহাদাত!!!’

লোকজন কেউ কেউ ছুটে যায় শাহাদাতের দিকে।চেপে ধরে তার গু’লিবি’দ্ধ স্থান।আর নবনীতা?সে কি করল?

প্রচন্ড ঘৃ’ণা আর বুক ভর্তি সাহস নিয়ে তরুণীটি ক্ষি’প্র গতিতে ছুটে যায় সড়কের অন্যদিকে।ইতোমধ্যে পুলিশ পৌঁছে গেছে সেখানে।দুর্বৃ’ত্তরা যে যেখানে পালানো শুরু করেছে।ধাওয়া পাল্টা-ধাওয়া,টিয়ার’শেলের ধোঁয়া আর রাবার বু’লেটের শব্দে চারদিক কেমন গমগমে হয়ে ছিল।এরই মাঝে তরুণী টি সব ভয় ভীতি কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ছুটে যায় অবৈধ অ’স্ত্র হাতে দাঁড়ানো যুবকটির দিকে,যার ছোঁ’ড়া গু’লিতে শাহাদাতের ছোট্ট শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।সে গিয়েই এক থা’বায় তার মুখের সামনে থেকে কাপড় সরায়।

তার অকস্মাৎ আক্র’মনের জন্য যুবকটি প্রস্তুত ছিল না।মুখের উপর কেউ থা’বা দিতেই সে হকচকিয়ে ওঠে।নবনীতা একনজর তার মুখটা দেখেই গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে তার গালে একটা চ’ড় দেয়।চেঁ’চিয়ে উঠে বলে,’জানো’য়ার কোথাকার! তোর মতো জানো’য়ারের কাছে আরহাম কিচ্ছু না।’

ফাহাদ গালে হাত দিয়ে স্তব্ধ হয়ে কতোক্ষণ তাকে দেখল।মেয়েটা তাকে মে’রেছে?সে কি ধ’রা পড়ে গেছে?এটা কি করে সম্ভব?এই মেয়ের কি জানের ভয় নেই?পেছন থেকে পুলিশের একটি টিম ছুটে আসছিল তাদের দিকে।অবস্থা বেগতিক দেখে ফাহাদ এক ধা’ক্কায় নবনীতা কে মাটিতে ছু’ড়ে ফেলল।তারপরই তীব্র বেগে সামনের দিকে দৌঁড়ে পালায়।

মাটিতে পড়েও নবনীতা হাল ছাড়ল না।সে অস্থির হয়ে এদিক সেদিক খুঁজে একটা বড়ো সড়ো ইটের টুক’রো দেখতে পেল।সঙ্গে সঙ্গে সেটা হাতে তুলে সে ছু’ড়ে মারে ফাহাদের দিকে।

অব্যর্থ নিশানা।ইট টা গিয়ে পড়ে ফাহাদের ঘাড় বরাবর।সঙ্গে সঙ্গে তাল হারিয়ে সে মাটিতে গিয়ে পড়ে।আর উঠার সময়টুকুও পায়নি ফাহাদ।ব্যথা সহ্য করে উঠে বসতেই সে দেখল পুলিশের টিম টি তাকে ঘিরে ফেলেছে।এর মধ্যে একজন তার দিকে ব’ন্দুক তাক করে বলল,’নড়বে না একদম।ইউ আর আন্ডার এরেস্ট।’

নবনীতা নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায়।পুলিশদের পেছনে সব সাংবাদিকরা এসেছিল নিউজ কভার করতে।তাদের কেউ কেউ নবনীতাকে দেখেই ক্যামেরা আর মাইক্রোফোন হাতে ছুটে যায় তার দিকে।জানতে চায়,’এখানে কি হচ্ছিল খুলে বলুন ম্যাম।আপনি ঠিক আছেন তো?’

নবনীতা টেনে টেনে কয়েকবার শ্বাস নেয়।শেষে জড়ানো গলায় বলে,’আমি ভালো আছি।কিন্তু শাহাদাত ভালো নেই।’

চলবে-

[সুন্দর সুন্দর কমেন্ট করে মন ভালো করে দিন তো।মন ভালো থাকলে অতিরিক্ত অংশ দিলেও দিতে পারি রাতে🥱]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে