কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-২০

0
105

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(২০)

‘আরহাম! আমার কথা তোর কানে যাচ্ছে?এই পা’গলামির মানে কি?’ চূড়ান্ত রকমের অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করল ওয়াজিদ।

আরহাম ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে অল্প অল্প দুলছিল।ওয়াজিদের অস্থির কন্ঠ শুনতেই সে শান্ত গলায় বলল,’কি পাগ’লামি করেছি আমি?’

‘তুই ঐ ছেলেকে ধরে এনেছিস কেন?কে এই ছেলে?তুই আবার নির্বাচনের আগে এসব হঠকারিতা শুরু করেছিস?’

আরহাম জবাব দেয় না।তার এই নির্লিপ্ত,বে’পরোয়া ভাব ওয়াজিদের দুশ্চিন্তা বাড়ায়।সে তার মুখোমুখি চেয়ার টেনে বসে।অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলে,’আবারো তুই ভুলভাল করছিস ভাই।এই ছেলে কে?দোষ কি তার?’

আরহাম অল্প হাসে।কপালে দুই আঙুল ছুঁয়িয়ে বলে,’আছে,দোষ আছে তার।’

‘সেটাই জানতে চাইছি।দোষটা কি?’

‘সে একজন কে ছুঁয়েছে।এটাই তার দোষ।’ থমথমে মুখে জবাব দেয় আরহাম।

ওয়াজিদ তব্দা খেয়ে বলল,’অদ্ভুত!এটাই তার অপ’রাধ?’
পরক্ষণেই আবার চোখ সরু করে বলল,’কাকে ছুঁয়েছে সে?’

আরহাম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে বলে,’তাতে তোর কি?যাকে ছুঁয়েছে,সেটা আমার বিষয়।আমি মিটমাট করব।’
কথা শেষ করেই সে টেবিলের একপাশে রাখা মার্লবোরো এর পাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে সেটা দুই ঠোঁটের সাহায্য চে’পে ধরল।লাইটার দিয়ে খুব সাবধানে সেটা ধরিয়ে একটা টান দিলো।ওয়াজিদ আশ্চর্য হয়ে বলল,’তুই এখনো এতো শান্ত আছিস?’

সে ভরাট গলায় উত্তর দেয়,’অশান্ত হওয়ার মতো কিছু হয়নি ওয়াজিদ।আমি তাকে কিড*ন্যাপ করিনি।জাস্ট একটু জেরা করে তারপর ছেড়ে দিব।ডোন্ট বি সো প্যানিকড।’

ওয়াজিদ গোল গোল চোখ করে বলল,’তুই এতো স্বাভাবিক কথা বলছিস একজনকে তুলে এনে?মাই গড! তোর মাঝে মাঝে কি হয় কে জানে!’

আরহাম দুই আঙুলের সাহায্যে সিগা’রেট টা চেপে ধরে একহাত পকেটে গুজে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে হেঁটে পাশের ঘরটায় চলে গেল।এই মুহূর্তে তারা তাদের সেই পুরোনো আস্তানায় এসেছে।লোকালয় থেকে একটু নিবিড়ে,জনমানব বিহীন আন্ডার কন্সট্রাকশন বিল্ডিংয়ের দোতালায়।

ইফাজ জড়োসড়ো হয়ে চেয়ারের উপর বসে ছিল।সে কিছুটা ঘা’বড়ে আছে,আবার কিছুটা বিভ্রান্তির মধ্যে আছে।আরহামের ছেলেরা তাকে এখানে নিয়ে এলো কেন?সে কি করেছে?

তাকে একটা ঘরে এনে বসিয়ে রাখা হয়েছে।এখনো তার সাথে কেউ কথা বলেনি।খুব সম্ভবত আরহামই তার সাথে কথা বলবে।ইফাজ অন্যমনস্ক হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।তার মতো সাধারণ মানুষের সাথে শাহরিয়ার আরহামের কি কথা থাকতে পারে?

তার অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়।ঘরের বন্ধ দরজা আচমকা খুটখুট শব্দ করে খুলে যায়।ইফাজ মাথা তুলে সামনে দেখে।দেখল ত্রিশোর্ধ সুদর্শন যুবকটি ধীর পায়ে হেঁটে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।তার মুখে একটা সিগা’রেট,যেটা থেকে এতটু পর পর সে ধোঁয়া ছাড়ছে।তার চোখ মুখ অতিশয় শান্ত।

ইফাজ তাকে দেখতেই বিনয়ী স্বরে বলল,’আসসালামু আলাইকুম ভাই।’

আরহাম জবাবে মাথা নাড়ল।ঝলমলে হেসে উত্তর দিলো,’ওয়ালাইকুমুস সালাম ইফাজ।’

সে চেয়ার টেনে তার ঠিক মুখোমুখি বসল।ইফাজকে জহুরি চোখে একনজর দেখতেই প্রশ্ন করল,’কেমন লাগে ইফাজ বার বার রিজেকশন সহ্য করতে?হু?’

হকচকিয়ে ওঠে ইফাজ।আশ্চর্য হয়ে সামনে দেখে বলে,’জ্বী ভাইয়া?’

আরহাম আবারো বরফ ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,’বার বার একটি মেয়ে প্রত্যা’খ্যান করা স্বত্তেও বে’হায়ার মতো তার পেছন পেছন ঘুরতে কেমন লাগে?’

ইফাজ প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কতোক্ষণ সামনে দেখে।প্রশ্নটা ঠিকঠাক বুঝতেই সে মাথা নামিয়ে নেয়।স্বচ্ছ গলায় উত্তর দেয়,’মেয়েটা যদি নবনীতা হয় তাহলে ভালোই লাগে।’

আরহাম পুনরায় সি’গারেটে একটা টান দেয়।থমথমে গলায় বলে,’নবনীতার আশেপাশে যেন কোনোদিনও তোকে না দেখি।বুঝেছিস?সে তোকে পছন্দ করে না।’

তার কন্ঠে কিছু তো ছিল।ইফাজ স্তব্ধ হয়ে কয়েক পল তাকে দেখে।যেই প্রশ্নটা তা মনে খচখচ করছিল,সেটা সে আর মুখ ফুটে বলে না।সবটা হজম করে নিয়ে সে শুধু চাপা কন্ঠে বলে,’সম্ভব না ভাই।আমি তাকে ভালোবাসি।সে যতোই টালবাহানা করুক,দিনশেষে তার একটা ঠাই প্রয়োজন।আমি সেই ঠাই হতে চাই।’

এই সোজাসাপটা জবাবে সামনে থাকা যুবকের দুই চোখ জ্বল জ্বল করে উঠে।সে টের পায় তার শিরা উপশিরায় ছুটে যাওয়া র*ক্ত কোনো কারণ ছাড়াই ফু’টছে।নিজের এই পরিবর্তনে তার চেয়ে বি’রক্ত আর কেউ নেই।কেন তার সাথে এমন হচ্ছে?ইফাজ যদি তাকে ভালোও বাসে ,তবে তার কি?ইনফেচুয়েশন বলে সে যেটাকে আখ্যা দিয়েছে,সেটা কেন ইনফেচুয়েশন থেকেও বেশি কিছু হয়ে যাচ্ছে?

সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’তোর ঠাই হতে হবে না।তোর কাছে কেউ ঠায় চায়নি।সাবধান করে দিচ্ছি তোকে।আর যেন তার আশেপাশে তোকে না দেখি।’

আরহাম থামল।একবার বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে ইফাজের একটা হাত চেপে ধরল।ইফাজ ফ্যালফ্যাল চোখে শুধু সবটা দেখে গেল।আরহাম তার হাত চেপে ধরেই চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’এরপর যদি এই হাত দিয়ে রাস্তাঘাটে বা অন্য কোথাও তাকে ছুঁয়েছিস,তাহলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না।’

আরহাম তার হাত ছাড়ল।চেয়ারে হেলান দিয়ে নিরেট স্বরে বলল,’আমার সামনে নির্বাচন।আজাইরা সময় নাই হাতে।এজন্য আর কোনো বাড়াবাড়ি তে গেলাম না।তোকেও ভালো বাড়ির ছেলেই মনে হচ্ছে।পরের বার থেকে রাস্তাঘাটে এসব বে’য়াদবি করবি না ঠিক আছে?নয়তো কিন্তু হাতগুলো আর হাতের জায়গায় থাকবে না।’

ইফাজ নির্লিপ্ত হয়ে জবাব দেয়,’ভাই নবনী ব্যতীত কোনো মেয়ের সাথেই আমি এমন আচরণ করিনি।আপনি চাইলে খোঁজ নিতে পারেন।’

‘নবনীর সাথেও কেন করবি?নবনী তোর বউ লাগে?’ ধ’মকে উঠল আরহাম।

ইফাজ থমকায়।কয়েক মুহূর্ত শুধু নিশ্চুপ হয়ে সামনে দেখে।শেষটায় ভারি গলায় বলে,’বউ লাগে না,তবে আমার বিশ্বাস সে একদিন আমার বউ হবে।’

আরহাম তার জবাব পেতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।তার মেজাজ চূড়ান্ত রকমের বি’ক্ষিপ্ত।হঠকারিতা আর ভুলভাল করাটা যার স্বভাব,তার কাছে বুদ্ধিমানের মতো কাজ আশা করা বোকামি।মাথা গরম করে নিজের খেয়ালখুশি মতো আচরণ করতে অভ্যস্ত আরহাম আজও সেই একই কাজ করল।সে ওঠে গিয়ে একহাত ইফাজের গলায় রেখে তার মা’থাটা পেছনের দেয়ালের সাথে চে’পে ধরল।

ধড়ফড়িয়ে ওঠল ইফাজ।সে এক মুহূর্তের জন্যও ভাবেনি এমন কিছু হবে।আরহাম ঝুকল।দাঁতে দাঁত পি’ষে বলল,’থা’প্পড় চিনস?বউ বউ করছিস কেন?বিয়ে হয়েছে তোদের?আরেকবার বউ বউ করলে এদিকেই পু*তে দেব শা’লা।’

ইফাজ বাকরুদ্ধ হয়ে কতোক্ষণ তাকে দেখল।তার মুখে বুলি ফুটতেই সে থেমে থেমে বলল,’আপনি রে’গে যাচ্ছেন কেন?’

আরহামের রাগ কমল না।উল্টো সে আগের চেয়েও ক্ষে’পাটে সুরে বলল,’রা’গবো না তো কি করব?তুই বি’য়ে করবি মানে?শোন ইফাজ না টিফাজ,আই ডোন্ট কেয়ার।তুই দুনিয়ার সব মেয়ের দিকে তাকা,সব মেয়েকে বউ বানানোর স্বপ্ন দেখ।কিন্তু পরীর দিকে তাকাবি না।কথা ক্লিয়ার?’

ইফাজ বিস্মিত হয়ে বলল,’পরীকে আপনি ব্যক্তিগতভাবে চেনেন?’

‘ঐ শা’লা।তুই আবার আমার দেখাদেখি পরী পরী শুরু করেছিস কেন?এক চ’ড় দেব তোকে বে’য়াদব।কোনো পরী টরী করবি না।বলবি নবনীতা ম্যাম।ঠিক আছে?বল তো কি বলবি?’ইফাজের গাল চেপে রা’গে গিরগির করে উঠল আরহাম।

ইফাজ নির্নিমেষ তাকে দেখে।এই পা’গলামো এই উ’ন্মাদনার সবটাই ইফাজ বোঝে।এই রো’গের সে পুরোনো রো’গী।তবে আরহামের সাথে তার অনেক চারিত্রিক পার্থক্য আছে।সে আরহামের মতো এমন পা’গলামো করে নি।করবেও না।সে নবনীতাকে চেনে।যেই নবনীতা তার মতোন ছেলেকেই গ্রাহ্য করে না,সেই নবনীতা এই আরহামকে সুযোগ দিবে?কক্ষনো না।নবনীতা এমন বে’পরোয়া,বদ’মেজাজি ছেলেদের কখনোই নিজের ধাঁর ঘেঁষতে দিবে না।

ইফাজ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।মৃদু স্বরে বলে,’নবনীতা ম্যাডাম।’

আরহাম হাসল।মুখে সেই পৈ’চাশিক হাসি ধরে রেখেই বলল,’গুড।ভেরি গুড।এখন যা।ভালো ছেলের মতোন বাড়ি যা।’

ইফাজ ছাড়া পেতেই উঠে দাঁড়ায়।সে দরজার সামনে যেতেই আরহাম পিছু ডেকে বলে,’এ্যাই শোন।’

ইফাজ পেছন ফিরে।আরহাম ঘাড় ঘুরিয়ে তাকে দেখে নম্র সুরে বলে,’শনিবার আমায় ভোট দিবি বুঝেছিস?’

ইফাজ একটু চুপ থেকে তারপর বলল,’জ্বী।আপনাকেই দিব।’

বলেই সে আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল।যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলল,’দিব।ভালো করে ভোট দিব তোকে।ডেস্পারেট ছেলে একটা!’

***

নবনীতা কেবলই তার পড়ার বই টা কোলে নিয়ে খাটে বসেছিল।ঠিক তখনিই বাইরের কোলাহলে তার কপালে ভাঁজ পড়ে।এই সময় কে এসেছে?কিছু সময় বাদেই মিসেস রোকেয়া হন্তদন্ত পায়ে তার ঘরে এলেন।এক প্রকার চেঁ’চাতে চেঁ’চাতে বললেন,’নবনীতা! তুই এসব কি করেছিস?’

নবনীতা ভড়কে গিয়ে বলল,’আমি?আমি আবার কি করেছি?’

‘তুই নাকি ইফাজের নামে আরহামের কাছে না’লিশ করিস?আরহামের ছেলেরা আজ তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছে।’

কথা শুনেই নবনীতা হকচকিয়ে ওঠে।আশ্চর্য হয়ে বলে,’এসব কি বলছ মামি?ইফাজকে তুলে নিয়ে গেছে মানে?’

মিসেস রোকেয়া কিছু বলতে পারলেন না।তার আগেই তার বড় ভাইয়ের বউ সাবিনা ধপ ধপ পা ফেলে নবনীতার ঘরে এলেন।এক প্রকার চেঁ’চিয়ে উঠে বললেন,’তুমি জানো না এটার মানে?তুমি কিচ্ছু জানো না তাই না?আমার ছেলেটাকে কি পেয়েছ তুমি?যা’দু টোনা করেও ক্ষ্যান্ত হওনি।এখন বিচার দিচ্ছ তার নামে?’

নবনীতা শক্ত মুখে জবাব দেয়,’প্রথম কথা আমি কোনো বিচার দেইনি।দ্বিতীয় কথা আমি কোনো যা’দু টোনাও করিনি।বারবার এক কথা বলবেন না আন্টি।’

মিসেস রোকেয়া একটু পিছিয়ে গেলেন।তার মুখে সুক্ষ হাসির রেখা।সাবিনা কে তিনি দুই চোক্ষে সহ্য করতে পারেন না।সাবিনার ছেলে লক্ষী মন্ত মেয়ে বিয়ে করে নিয়ে সুখে থাকবে।এটাও কি মিসেস রোকেয়া হতে দিবে?তিনি চায় ইফাজ যেন নবনীতা কে বিয়ে করে।নবনীতার মতোন চ্যাটাং চ্যাটাং মুখের উপর জবাব দেওয়া পুত্রবধূই যথেষ্ট ঐ সাবিনা চু’ন্নি কে শা’য়েস্তা করার জন্য।সাবিনা নিজেকে বাঘিনী ভাবে তাই না?রোকেয়া হলফ করে বলতে পারে,তার বাড়িতে যে বাঘিনী আছে,এর সামনে গেলে সাবিনা স্রেফ একটা মেনি বেড়াল বৈ আর কিছু না।

মিসেস রোকেয়া ঠোঁট টিপে হাসেন।বেচারি সাবিনা নিজেই নিজের পরবর্তী অবস্থার জন্য দায়ী হবে।

মিসেস সাবিনা ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,’তুমি দয়া করে এসব নাটক করবে না।ইফাজকে তুমি তোমার রূপের জালে ফাঁসিয়েছ।আমার ছেলে কখনো কোনো মেয়ের পেছনে এভাবে বে’হায়ার মতো ঘুরেনি।তুমি তার মাথায় কি বীজ ঢুকিয়েছ কে জানে।তোমার কি সব ছেলেদেরই ঝুলিয়ে রাখার স্বভাব?ঐ নেতার সাথে তোমার এতো যোগাযোগ কিসের?কি লাগে সে তোমার?’

নবনীতা হাতের বইটা বন্ধ করে শব্দ করে সেটা খাটে রাখল।চিত্রা ফ্লোরে বসে ড্রয়িং করছিল।নবনীতা বই রাখতেই সে মুখ টিপে মুচকি হাসে।পরী আপাই এখন ঐ সাবিনার বাচ্চাকে তেল ছাড়া ভুনা করবে।শুভ্রা নিজেও পড়ার টেবিলে বসে সেদিকে চোখ দেয়।মনে মনে বলে,’বেচারি সাবিনা।নিজেই নিজের বেইজ্জতি করতে এসেছে।’

নবনীতা উঠে গিয়ে ঠিক মিসেস সাবিনার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।তার প্রগাঢ় এবং তীক্ষ্ণ চাহনিতে সাবিনা কিছুটা দমে গেলেন।আমতা আমতা করে বললেন,’কি হয়েছে?এভাবে কি দেখ?’

নবনীতা বুকে হাত বাঁধে।অতিশয় শীতল কন্ঠে বলে,’ইফাজকে বহুবার প্রত্যাখ্যান করেছি।এর কারণটা নিশ্চয়ই জানেন।দোষটা ইফাজ না,দোষটা তার মা।ইফাজের সাথে যদিও বা আমি সংসার করতে পারি,কিন্তু তার মায়ের মতো মহিলার সাথে এক ছাদের নিচে থাকা আমি অসম্ভবই মনে করি।’

এক জবাবেই মিসেস সাবিনার থোতা মুখ ভোতা হয়ে গেল।তিনি কেবল গোল গোল চোখে তার সামনে দাঁড়ানো আ’গুনের স্ফু’লিঙ্গটি কে দেখেন।কি ধাঁরালো আর শানিত তার বচন! নবনীতা একটু জিরোয়।তারপর আবার বলতে শুরু করে,’আপনার মাথায় বুদ্ধি কম আন্টি।আপনি একবার বলছেন আমি ইফাজকে ফাঁসিয়েছি,আবার বলছেন আমি তার নামে না’লিশ করেছি।দু’টো কথার কোথাও কোনো যোগসাজশ নেই।যদি তাকে ফাঁসানোই আমার উদ্দেশ্য হয়,তাহলে তার নামে নালিশ করব কেন?মানুষ নিশ্চয়ই তার নামে অভি’যোগ দায়ের করে না যার উপর সে যা’দুটোনা করে?পরের বার আমার উপর অভিযোগের আঙুল তোলার আগে একটু গুছিয়ে যুক্তি তৈরি করে আনবেন।আর আপনার ছেলেকে আমি কোনোদিনই বিয়ে করব না।এটা তাকে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিবেন।আর শেষ কথা,ঐ নেতার সাথে আমার কিছু নেই।সে কেন এমন করেছে আমি জানি না।করে থাকলে সেটা ঠিক হয়নি।তাই বলে সবকিছুতে আমার নাম এনে জড়াবেন না।পারলে আপনি নিজের ছেলের উপর যা’দুটো’না করে তাকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করুন।এতে আমি ভীষণ খুশি হবো।’

নবনীতা কথা শেষ করল।মিসেস সাবিনা পাথরের ন্যায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন।অপমানে তার চোখ ছলছল করে উঠেছে।ভেতরে ক্রো’ধের আ’গুন,অথচ মুখে কোনো কথা নেই।এই ত্যাদড় মেয়ের সাথে তিনি কথায় পারবেন?

নবনীতা পুনরায় খাটে গিয়ে বসল।খাটে থাকা বইটা খুলে পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল,’যখন তখন মানুষের বাড়ি এসে আন্দাজের ওপর যা তা বলে চেঁ’চাবেন না আন্টি।এটা আপনার বাড়ি না,আমরা আপনার খাই না।এবার আপনি যেতে পারেন।ধন্যবাদ।’

নবনীতা বইয়ের পাতায় মন দেয়।খুবই শান্ত দেখাচ্ছে তাকে।যেন কিছুই হয়নি।মিসেস রোকেয়া ঠোঁট টি’পে হাসেন।আজ তিনি মাংসের সবচেয়ে বড় টুক’রো টা নবনীতাকে দিবেন বলে ঠিক করেছেন।সাবিনার যেই না’জেহাল দশা করেছে সে,এর বিনিময়ে এই টুকু পুরষ্কার তিনি তাকে দিতেই পারেন।

সাবিনা রা’গে ফুঁসতে ফুঁসতে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।মিসেস রোকেয়া সেদিকে দেখেই কুটিল হাসেন।বিড়বিড় করে বলেন,’বেশ হয়েছে।খুব খুশি হয়েছি আমি।শাক’চু’ন্নি কোথাকার!’
.
.
.
.
পরেরদিন আরহাম প্রায় বেলা দু’টো পর্যন্ত প্রচারণায় ব্যস্ত ছিল।শুরুতে এই ছুটোছুটি তার অ’সহ্য লাগতো,এখনও লাগে,তবে এখন এসব সা সওয়া হয়ে গেছে।সে মহানগর অফিসে ফিরে তার রুমের চেয়ারে বসেই হাঁসফাঁস করতে করতে বলল,’এসি অন কর তোফায়েল।ম’রে যাচ্ছি গরমে।’

তোফায়েল এসি অন করে।ওয়াজিদ ক্লান্ত পায়ে রুমে এসেই কাউচের উপর গা ছেড়ে দিলো।পাশে থাকা গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খেল।আরহাম মা’র্লবো’রো এর প্যাকেট থেকে সি’গারেট বের করতে করতে ওয়াজিদ কে দেখে জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,’খাবি?’

ওয়াজিদ হাত নাড়ল।কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলল,’না,তুই খা।আমি পরে খাবো।’

আরহাম কেবলই সিগারেটে লাইটার দিয়ে আ’গুন ধরিয়েছিল,তক্ষুনি কোথা থেকে তামজিদ ছুটে এসে বলল,’ভাই রাস্তায় লেডি ডন কে দেখলাম।মনে হলো আপনার অফিসেই আসছে।’

আরহাম কপাল কুঁচকায়।বলে,’লেডি ডন কে?’

তামজিদ কিছু বলার আগেই তোফায়েল জানালা দিয়ে বাইরে দেখে আঁতকে উঠে বলল,’কেলো হয়েছে বস।দাবাং নবনীতা তো একদম অফিসের সামনে এসে গেছে।একেবারে গ্যাংস্টারের মতো হেঁটে হেঁটে আসছে।’
তার কথা শুনেই ওয়াজিদ সব ক্লান্তি ফেলে ছুটে গেল থাই গ্লাস টেনে বন্ধ করে রাখা জানালার দিকে।নিচে দেখতেই আশ্চর্য হয়ে বলল,’সত্যিই তো।নবনীতাই তো এটা।’

আরহাম সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের সিগারেটা ফ্লোরে ফেলে পা দিয়ে পি’ষে ফেলল।তারপর সেটাকে একটা লা’থি দিয়ে দূরে সরিয়ে বলল,’দূরে যা বা’লসা’ল।’

তারপর সি’গারেটের প্যাকেট টা ড্রয়ারে রেখে ড্রয়ার থেকে একটা সেন্টার ফ্রেশ বের করল।সে টের পেল সে আচমকা দরদর করে ঘামছে।অদ্ভুত বিষয়! সে ঘাবড়ে যাচ্ছে কেন?’

মিনিট খানেক বাদে তার দরজায় টোকা পড়ল।আওয়াজের ধরন দেখেই আরহাম বুঝল এটা নবনীতা।সে বাদে এমন ধাম ধাম করে দরজা ধাক্কানোর সাহস আর কার আছে?

আরহাম গলা খাঁড়া করে বলল,’কাম ইন।দরজা খোলাই আছে।’

নবনীতা শব্দ করে দরজা খুলে।কোনোদিক না দেখে সোজা এগিয়ে যায় আরহামের টেবিলের দিকে।সেই প্রথমদিনের মতো টেবিলের ধাঁর ঘেঁষে দাঁড়ায়।গলা উঁচিয়ে জানতে চায়,’এসব কি?আবার কি নতুন নাটক শুরু করেছেন আপনি?’

‘আমি আবার কি করলাম?আমি তো জনসেবায় ব্যস্ত।নাটক করার সময় কোথায়?’ চমকে উঠে প্রশ্ন করে আরহাম।

নবনীতা চোয়াল শক্ত করে বলে,’আপনি কেন ইফাজ কে বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছেন?কারণ কি এটার?’

আরহাম ভাবলেশহীন ভাবে বলল,’ওমা সেকি! সে রাস্তাঘাটে তোমায় উত্ত্য’ক্ত করেছে।এটা তো একটা শা’স্তি যোগ্য অপ’রাধ।তাই না?’

‘সে আমায় উত্ত্য’ক্ত করলে আপনার কি?আমি আপনার কাছে সাহায্য চেয়েছি?’

‘চাও নি?তুমিই তো সেদিন বললে ছেলেরা যেন মেয়েদের রাস্তাঘাটে বিরক্ত না করে,আমি যেন সে ব্যবস্থা করি।এখন তুমিই আবার কথা ঘুরাচ্ছ?’ আরহাম বেশ অবাক হয়ে জানতে চায়।

নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’আমি আপনার দলের লোকদের সিটি কলেজের সামনে মেয়েদের উত্ত্য’ক্ত করতে মানা করতে বলেছিলাম।আপনি সেটা করেছেন?উল্টো আমাকে কে কি করল সেটা নিয়ে পড়ে আছেন!’

আরহাম গালের নিচে হাত রেখে অবাক হওয়ার ভান করে বলল,’তো তুমি মেয়ে না?তোমাকে রক্ষা করা আমার একটা নৈতিক দায়িত্ব না?’

‘আমি মেয়ে,কিন্তু আমি নিজেই নিজেকে প্রোটেক্ট করতে পারি।’ কটমট করে জবাব দেয় নবনীতা।

আরহাম হাসল।তিরষ্কার করে বলল,’বাপরে! রোমান রেইন্স নাকি তুমি?নাকি আন্ডারটেকার?হেহ?যাও তো।আমার সাথে পায়ে পায়ে ঝগড়া করো না তো সবকিছুতে।’

নবনীতা দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’আমি আপনার সাথে লাগতে চাই না।কিন্তু আপনি কাজই করেন এমন।’
সে থামে।মুহুর্তেই আবার চোখ সরু করে বলে,’আরেকটা কথা।আপনি নাকি ইফাজকে বলেছেন আমি বাদে সব মেয়েদের দিকে দেখতে।এটা কি সত্যি?’

আরহাম ভাবুক হয়ে বলল,’তাই নাকি?সে তোমাকে এমনটা বলেছে?’

‘সে বলেছে না কে বলেছে আপনার জেনে কাজ নেই।আপনি বলেছেন নাকি বলেন।’

আরহাম মাথা নাড়ে।মুখ দিয়ে শব্দ করে বলে,’নাহ।আমি এমন কিছু বলিনি।সে মিথ্যা বলেছে তোমাকে।’

কথা শেষ করেই সে নবনীতাকে দেখে।একটা ঢোক গিলে বলে,’এভাবে দেখার কিছু নেই।আমি ইফাজ টিফাজকে এমন কিছু বলি নাই।আমি কেবল জনস্বার্থে নারীদের সম্মান রক্ষার্থে তাকে সচেতন করেছি।তোমার উচিত খুশি হয়ে আমার প্রশংসা করা।সেই তুমি আবার আমাকেই দোষ দিচ্ছ।’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে