কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৯

0
13

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৮)
অতিরিক্ত

খাবার শেষে নবনীতা যখন বিলের কথা বলল তখন ওয়েটার তাকে জানাল তার বিল দিতে হবে না,আরহামই আজ পুরো বিল দিবে।

কথা শুনেই নবনীতার ব্রহ্মতালু ছ্যানছ্যান করে উঠে।এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে সে খ্যাক করে ওঠে,’কিহ?কে দিবে?’

তার সামনে থাকা লোকটা ভড়কে গেল।মিনমিন করে বলল,’আরহাম স্যার দিবেন।’

‘কেন?তোমার আরহাম স্যার কেন দিবেন?আমরা কি ফকির?ভিখারি আমরা?’

ওয়েটারের দায়িত্বে থাকা ভদ্রলোক পড়লেন বিপাকে।এই মেয়ে এমন ক্ষে’পে যাচ্ছে কেন?তার সাথে রাগ দেখিয়ে কি লাভ?সে তো আরহাম না।তিনি কিছুটা বিচলিত হয়ে বললেন,’ম্যাম আপনি আরহাম স্যারের সাথে কথা বলুন।আমার এদিকে কিছুই করার নেই।আমি আপনার থেকে টাকা নিতে পারব না।বারণ আছে আমার।’

‘আপনাদের শুধু বারণই থাকে।একবার বলেন ভেতরে ঢুকা যাবে না,বারণ আছে।আবার বলেন বিল দেওয়া যাবে না বারণ আছে।শুধু বারণ আর বারণ।যাকগে,আপনার আরহাম স্যার কোথায়?তার সাথে আমি কথা বলছি।’

লোকটা তার তর্জনী তুলে পশ্চিম দিকে দেখিয়ে বলল,’স্যার নিচের টেরেসে।সেখানেই তাকে পাবেন।’

নবনীতা আর কথা বাড়ায় না।বড় বড় পা ফেলে সামনে এগিয়ে যায়।মেজাজ তার এমনিতেও খুব একটা ভালো ছিল না।এখন মনে হচ্ছে মাথায় কেউ আ’গুন ধরিয়ে দিয়েছে।লোকটা সবকিছুতে এতো টাকার বাহাদুরি দেখায় কেন?নবনীতা কি কোনো ফকির?

আরহাম বিল মিটিয়ে কেবল উপরের ছাদে উঠার সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল।তক্ষুনি তার সাথে নবনীতার একটা মুখোমুখি সং’ঘর্ষ হলো।নবনীতা তাল সামলাতে না পেরে একটু পেছন দিকে হেলে পড়ে।আরহাম সঙ্গে সঙ্গে ডান হাত দিয়ে শক্ত করে তার একহাত চেপে ধরে তাকে পুনরায় সোজা করে দাঁড় করায়।নবনীতা ঠিক মতো দাঁড়াতেই তার চোখ যায় নিজের হাতের দিকে।এক ঝাড়ায় হাত ছাড়িয়ে নেয় সে।

আরহাম গা ছাড়া ভাব নিয়ে তাকে এড়িয়ে যেতে নিলেই নবনীতা গম্ভীরমুখে বলে উঠে,’আপনি আমাদের বিল কেন দিয়েছেন?আমরা চেয়েছি?’

আরহাম থামল।পাশ ফিরে নবনীতার দিকে দেখে তারই মতো গম্ভীর স্বরে বলল,’এদিকে আমাদের সাথে শুধু তোমরাই ছিলে।যেহেতু সব খাবার এক সাথেই অর্ডার হয়েছে,তাই বিলও এক সাথেই এসেছে।এখানে এমন সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই।জাস্ট কাম ডাউন।’

‘নো।আই ক্যান নট।কাম ডাউন হতে পারব না আমি।আপনি আমাকে অপমান করছেন।’ ভীষণ জোরাল শোনায় তরুণীর কন্ঠ।

আরহাম তব্দা খেয়ে বলল,’এক্সকিউজ মি?হোয়াট?’

নবনীতা দুই বার শ্বাস নেয়।দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলে,’আপনি কেন আমাদের বিল দিবেন?আমরা কি বিল দিতে অক্ষম? অথবা আমরা কি আপনার ইনভাইটেড গেস্ট?নো,উই আর নট।তাহলে আপনি কেন বিল দিবেন?আমাদের বিল দেওয়ার সামর্থ্য নেই?আপনি নিজে বিল দিয়ে আমায় অপমান করছেন।আমি বিল দিতে অক্ষম নই জনাব।’

আরহাম হতভম্ব হয়ে তার কথা শুনে।চোখ বড় বড় করে বলে,’মাই গড! তুমি কি সবকিছু দুই ধাপ বেশি বোঝো নাকি?তুমি যতদূর ভেবে নিয়েছ অতো দূর তো আমার মাথায়ও আসেনি।অক্ষমতা,অপমান,সামর্থ্য-ও মাই গড।আই কা’ন্ট টেইক দিস।’

নবনীতা গোমড়া মুখ করে বলল,’অতো কথা বুঝি না।আমার কি বিল হয়েছে বলুন।আমার টা আমি দিব।’

কথা শেষ হতেই সে তার ব্যাগ থেকে ২৫০০ টাকা বের করে আরহামের দিকে এগিয়ে দিলো।আরহাম এক খাবলায় টাকা টা হাতে নিয়ে সেটা পকেটে রাখল।নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’পকেটে কেন রাখছেন?’

আরহাম তার চেয়েও দ্বিগুণ আশ্চর্য হয়ে বলল,’তো কোথায় রাখব?মাথায়?’

নবনীতা দুই হাত বুকে বেঁধে চাপা কন্ঠে বলল,’এতো টাকা আমরা খাই নি।যেটুকু খেয়েছি ঐটুকু রেখে বাকিটা ফেরত দিন।’

তার কথা শুনতেই আরহাম স্তম্ভিত হয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়।তার মুখের চূড়ান্ত রকম বিস্ময় দেখেই নবনীতা বিরক্ত হয়ে বলল,’এভাবে দেখার কিছু নেই।এতো টাকা আমরা খাইনি।হিসেব আছে আমার কাছে।’

আরহাম কয়েক মুহুর্ত নিষ্পলক তাকে দেখে।চুপচাপ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে।ভ্যাবাচ্যাকা মুখ করে বলে,’তুমি তাহলে হিসেব করে বলো কতো হয়েছে।’

নবনীতা হিসেব করল।তার সেই হিসেবে পানির বোতলের দামটাও অন্তর্ভুক্ত করল।আরহাম গোল গোল চোখে তার কাজকর্ম দেখে।নবনীতা মোবাইলের ক্যালকুলেটরে হিসেব করে জানায়,’একুশ শো আশি টাকা খেয়েছি আমরা।’
তার পরেই একটু চিন্তা করে বলল,’তিনশো বিশ টাকা ফেরত দেবেন আপনি আমাকে।আচ্ছা থাক।বিশ টাকা দিতে হবে না।তিনশো ই দিন।’

আরহাম চোয়াল শক্ত করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’কেন?বিশ টাকা কেন দিব না?আমি কি হোটেলের বেয়ারা?হ্যাঁ?’

নবনীতা থমথমে মুখে একবার সেদিকে তাকায়।তারপরই আবার চোখ নামিয়ে নেয়।আরহাম মানিব্যাগ বের করে একশো টাকার নোট গুনছিল।হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই সে চোখ তুলে বলল,’ওহ ভালো কথা।চিত্র আমার থেকে দুই চামচ ফালুদা খেয়েছিল।আমি কি সেই দামটাও রাখব পরী আপাই?’

নবনীতা একপেশে হাসল।খোঁচা দিয়ে বলল,’জ্বী।রুচিতে যদি কুলায় তাহলে রাখতে পারেন।আমার আপত্তি নেই।আর শুনুন।আমাকে পরী আপাই বিশেষণ দিয়ে কটাক্ষ করবেন না।এই নামটা আমার কাছে অনেক প্রিয়।এই পরিচয় টা আমার জন্য গর্বের।যারা আমাকে এই নামে ডাকে তারা আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান নেয়ামত।’

আরহাম গুনে গুনে তিনশো বিশ টাকা তার হাতে তুলে দিলো।মুখ বাঁকা করে বলল,’সবকিছুতে এতো প্যাচ খুঁজবে না।আমি তোমায় কটাক্ষ করিনি।’

‘স্যার,কেক এসে গেছে।’

আরহাম আরো কিছু বলার আগেই পেছন থেকে ওয়েটার ছেলেটা তার পেছনে এসে দাঁড়ায়।
আরহাম ঘুরে দাঁড়িয়ে ইনডোরের দিকে দৃষ্টি নেয়।কেক হাউজের টি শার্ট জড়ানো একটা অল্পবয়সী ছেলে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে মস্ত বড় কেকের বক্স হাতে।
আরহাম হাত নেড়ে ইশারা করে তাকে আসার জন্য।

নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’কেক কেন?’

আরহাম মুখ দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করে বলল,’আজ আমার খুব প্রিয় একজনের জন্মদিন।তাই কেক এনেছি।তোমার কোনো সমস্যা?’

বলেই সে সোজা হেঁটে উপরে চলে গেল।নবনীতা কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে থেকে নিজেও গটগট করে উপরে উঠে এলো।
***

তিনতালা বিশিষ্ট একটা বিশাল কেক।চারদিকে শুধু চকলেট আর চকলেট।কেকের নাম চকো মাউন্টেন কেক।পুরো কেকের ডেকোরেশন করা হয়েছে নামি দামি ব্র্যান্ডের চকোলেট দিয়ে।কেক টা আনা হয়েছে হূমায়রা নূর ওরফে চিত্রার জন্মদিন উপলক্ষে।কেক আনিয়েছে তার পছন্দের আরাম ভাই।এতো সুন্দর কেক টা দেখতেই চিত্রার মন খুশিতে নেচে উঠে।এতো সুন্দর কেক সে শুধু বড় বড় দোকান গুলোতে বাইরে থেকে দেখেছে।কখনো তো সামনে থেকে দেখেনি।ইশশশ! এটা খেতে কতোই না মজা হবে!

আরহাম হাত বাড়িয়ে তাকে ডাকল।আদর মাখা গলায় বলো,’দেখি চিত্র,এদিকে আসো তো।কেকের সাথে তোমার একটা ছবি তুলে দেই ভাইয়া।’

পুরো বিকেল আর সন্ধ্যা দৌঁড়ে দৌঁড়ে আরহামের কাছে ছুটে যাওয়া চিত্রা এইবার এতো বড় কেক সামনে থাকার পরেও তার ডাকে সাড়া দিলো না।তার পাশে একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।চিত্রা বুঝতে পারছে এই মানুষটা আরাম ভাইয়ের সাথে তার মেলামেশা পছন্দ করে না।

সে সেদিকে গেল না।উল্টো হাত তুলে নবনীতার ডান হাতটা চেপে ধরল।দুই দিকে মাথা নেড়ে করুণ মুখে আরহাম কে জানাল সে যেতে পারবে না।তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি তার কাছে এই দামি কেকের চেয়েও বেশি মূল্যবান।

চকিতে পাশ ফিরে নবনীতা।চিত্রা আরহামের কাছে না গিয়ে তার হাত ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে,এমনটা সে ভাবেনি।চায় ও নি।চিত্রা তাকে ভয় পাচ্ছে।তার রাগ হওয়ার আ’তঙ্কে সে চকোলেট দেখেও সেদিকে ছুটে যাচ্ছে না।

তীব্র অনু’শোচনা জেঁকে ধরে নবনীতাকে।সে কি আজ বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলেছে?সে হাঁটু মুড়ে বসে চিত্রার গালে একটা চুমু খেয়ে বলল,’যাও না সোনা।কেউ ভালোবেসে উপহার দিলে সেটা নিতে হয়।যাও গিয়ে ছবি তুলো,কেক কাটো।আপাই কিছু বলব না।তুমি মজা করে কেক খাও।’

তার অনুমতি দিতে দেরি হলো,কিন্তু চিত্রার এক ছুটে আরহামের কোলে চড়তে দেরি হলো না।আরহাম তাকে টুপ করে একটা চুমু খেল।নবনীতা যেই গালে খেয়েছে,তার অপর গালে।নবনীতা ওঠে দাঁড়িয়ে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়ায়।তাসনুভা মোমবাতি জ্বালিয়ে সেটা কেকের উপর রাখে।আরহাম চিত্রার হাতে ছু’রি ধরিয়ে কেকটা কাটল।সবাই হাততালি দিয়ে সমস্বরে বলে ওঠল,’হ্যাপি বার্থডে চিত্রা।’

চিত্রা কেবল জবাবে মিষ্টি করে হাসে।একদিনে এতো আনন্দ তার সহ্য হচ্ছে না।খুশিতে তার চোখ চিকচিক করছে।এতো সুন্দর কেকটা তার জন্য আনা হয়েছে।এটা তার বার্থডে কেক।এতো সুন্দর তার বার্থডে কেক?

সে সবাই কে একটু একটু করে কেক খাওয়ায়।নবনীতাকেও।নবনীতা কেকটা মুখে দিয়েই মুখটা কে খুশি খুশি করে বলল,’উমমমম খুব মজা তো।নাও,এখন তুমি খেয়ে নেও বাকিটা।’

বিশাল কেকটা তারা খেয়ে শেষ করতে পারে নি।আরহাম সবার খাওয়া শেষে বাকিটা স্টাফ দের খেয়ে নিতে বলল।তার আবার ফোন বাজছে।জালালুর রহমান ফোন দিয়েছেন।হয়তো সমাবেশ নিয়ে কোনো জরুরি কথা আছে।সে ফোনটা কানে চেপে ধরে হন্তদন্ত হয়ে নিচের ছাদে নেমে এলো।

নবনীতা সেই পুরোটা সময় ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।লোকটা চিত্রার জন্য কেক এনেছেন।এটা অবশ্য মন্দ কিছু না।বিষয়টা সুন্দর।চিত্রার চেহারার খুশি আর আনন্দ দেখে সে ঐ লোককে কিছুই বলতে পারবে না।কিন্তু তার ভেতর পু’ড়ছে।এই জন্য অন্য কেউ দায়ী না।এটাই বাস্তবতা।সে আবারো অনুধাবন করল জগতে ভালোবাসাই সবকিছু না।এর সাথে অর্থেরও প্রয়োজন আছে।চিত্র আর শুভিকে সে যতোই ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখুক না কেন,সে তাদের কে কখনোই এই আনন্দটুকু দিতে পারবে না।চোখের সামনে থাকা চওড়া মূল্যের কেক টি জানান দিচ্ছে নবনীতার অক্ষমতার।চিৎকার করে বলছে,’দেখ পরী।তুই স্বয়ংসম্পূর্ণ না।তুই বাচ্চা দু’টোর সব অভাব পূরণের যোগ্য না।’

নবনীতা তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।কেউ দেখে নেওয়ার আগেই অতি সন্তর্পণে চোখের কোণায় এসে জমে থাকা পানিটুকু মুছে নেয়।তার চোখের পানি দেখে লোকে তাকে স্বান্তনা দিক,এটা সে চায় না।সে চায় না কেউ তাকে করুণা করুক।করুণা জিনিসটা তার বড্ড অপ্রিয়।

তাসনুভা আদি আরিশ মিলে চিত্রার সাথে অনেক ছবি তুলল।সবাই মিলে গ্রুপ ছবিও তুলেছে দুইটার মতো।আদি তাকে ডেকে বলল,’হেই নবনীতা! এসো না।তুমিও আসো।’

নবনীতা ম্লান মুখে দু’দিকে মাথা নাড়ে।ক্লান্ত স্বরে বলে,’না না।আমি ছবি তুলব না।তোমরা তোলো প্লিজ।’

তাসনুভা হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে এগিয়ে আসে তার দিকে।অনুরোধের সুরে বলে,’আপু আমার সাথে একটা সেলফি তোলো।প্লিজ?’

নবনীতা স্মিত হাসে।তার হাত থেকে মোবাইল ফোনটা নিজের হাতে নিয়ে সামান্য ঝুকে দু’জনের বেশ কিছু ছবি তোলে।তারপর আবার সেটা তাসনুভার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে তাসনুভার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।কপালের কাছটায় ছোট করে চুমু খেয়ে বলে,’এতো রিকোয়েস্টের কিছু নেই সোনা।তুমি ছবি তুলতে চাইছ আর আমি তুলব না,এটা হতে পারে?খুব ভালো থাকো তাসনুভা।আপু তোমার জন্য অনেক অনেক দোয়া করে দিলাম।’

তাসনুভা লাজুক হাসল।মাথা নামিয়ে বলল,’তোমার জন্যও অনেক দোয়া আপু।’

তার সাথে কথার ফাঁকে আনমনে একবার নিজের হাতের দিকে দেখতেই চোখ বড় বড় হয়ে গেল নবনীতার।অবাক হয়ে সে ফ্লোরের এদিক সেদিক দেখতে শুরু করল।তাসনুভা ভড়কে গিয়ে বলল,’কি খুঁজো আপু?’

‘ঘড়ি,আমার ঘড়ি।’ উদ্বিগ্ন হয়ে জবাব দেয় সে।

তারপরই সে হন্য হয়ে চারদিকে সেটা খুঁজতে শুরু করে।নিচের ফ্লোর উপরের ফ্লোর দু’টোতেই সে তন্ন তন্ন করে ঘড়িটা খুঁজল।আরহাম তার এই হম্বিতম্বি দেখে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বিড়বিড় করে বলল,’একটা ঘড়িই তো।এমন ভাব যেন স্বর্ণের টুকরো হারিয়েছে।’

নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে তাকে দেখল।কটমট করে বলল,’আমি সারাদিন বাইরে থাকি।টিউশন করাই।আমার সময় মেপে চলতে হয়।আপনার জন্য তু’চ্ছ হলেও আমার কাছে এর মূল্য আছে।’

বলেই সে তার পার্সটা হাতে তুলে নেয়।পেছন ফিরে চিত্রা,শুভ্রা আর রিমি কে দেখে বলে,’চল।যেতে হবে আমাদের।’

‘আর ঘড়িটা?সেটার কি হবে?’ জিজ্ঞাসু হয়ে প্রশ্ন করে রিমি।

নবনীতা সামনে ফেরে।কাঠকাঠ গলায় উত্তর দেয়,’আরেকটা কিনে ফেলব।’

কথা শেষ করেই সে শেষ বারের তাসনুভার কাছে গেল।তাসনুভার মাথায় হাত ছুঁয়িয়ে বলল,’গেলাম তাসনুভা। নিজের খেয়াল রেখো।কখনো মালিবাগ এলে আমাকে জানাবে।আমার বাসায় তোমার দাওয়াত রইল।’

বলেই সে মাথা তুলে বাকিদের দেখে।সৌজন্যসূচক হেসে বলে,’আপনাদেরও দাওয়াত।’

‘আর আরহামের?আরহামের দাওয়াত নেই?’ চঞ্চল হয়ে প্রশ্ন করল আদি।কিন্তু তারপরই আরহামের দাঁত কিড়মিড় করতে থাকা মুখটা দেখে সে দমে গেল।অস্পষ্ট স্বরে বলল,’ঐ আরকি।জাস্ট জানতে চাইছিলাম।’

নবনীতা ঠোঁটের কোণায় অল্প হাসি ফুটিয়ে সেখান থেকে চলে এলো।ওয়াজিদ রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার প্রস্থান দেখে।সে যখন হাঁটে তখন তার হাঁটার মাঝে একটা আত্মপ্রত্যয় কাজ করে।এই বিষয়টা তাকে আরো বেশি মোহনীয় করে দেয়।

তারা চলে যেতেই আরহামও আর দেরি করল না।তারা যাওয়ার মিনিট দশেকের মাথায় সে নিজেও বাকিদের নিয়ে গাড়িতে উঠে বসল।ওয়াজিদ কে তার বাসায় ড্রপ করে তারা আজিজ ভিলার পথ ধরে।

বাড়ি পৌঁছাতেই আরহাম সোজা তার ঘরে গেল।ঘরে গিয়েই সে এলোমেলো হয়ে কতোক্ষণ খাটের উপর শুয়ে থাকে।মস্তিষ্কে কেবল আজকের ঘটনা গুলোই ছায়াছবির মতো চলতে থাকে,কানে বাজতে থাকে চব্বিশ ছুঁই ছুঁই রমণীর সুন্দর কিন্তু দৃঢ় কন্ঠস্বর।

অনেকক্ষণ পর আরহাম শোয়া থেকে উঠে বসে।পকেট হাতড়ে বের করে একটি ধাতব বস্তু।সেটা বের করে সামনে আনতেই তার মুখে হাসি ফুটে।

অ্যান্টিক কালারের একটা ম্যাটালিক ঘড়ি।লেডিস ওয়াচ।দেখতে বেশ সুন্দর।সেই ওয়াচের মালকিন আজ হন্য হয়ে তাকে খুঁজেছে।মালকিন জানে না সেই ঘড়ি অনেক আগেই কারো হাতে পৌঁছে গেছে।

আরহাম ঘড়িটা হাতে নিয়েই পুনরায় শুয়ে পড়ল।তার ঠোঁটের কোণায় ক্ষণিকের জন্য হাসি ফুটল।সম্ভবত নিচে নেমে আরহামের সাথে ধাক্কা খেয়েই ঘড়িটা তার হাত থেকে খুলে পড়েছে।সে যখন জালাল সাহেবের সাথে কথা বলতে নিচে নেমেছে,তখনই সে সেটা পেয়ে চটপট লুফে নিয়েছে।

আরহাম ঘড়িটা দেখে।একহাত মাথার নিচে রেখে নিরেট স্বরে বলে,’পরী আপাই সারাদিন শুধু ঠাসঠাস উত্তর দেয়।তাই পরী আপাইয়ের বোবা ভার্সন বাড়ি এনেছি।একটা পরী আমার ঘরেও থাকা উচিত।তাই না?’

আরহাম একপাশ হয়ে শোয়।সে জানে সে বাড়াবাড়ি করছে।সে অসম্ভব জিনিস নিয়ে ঘাটাঘাটি করছে।হয়তো সত্যিই এটা ইনফ্যাচুয়েশন।কিন্তু যেটাই হোক,যেই কৃষ্ণ গহ্বরে সে তলিয়ে গেছে,সেটা থেকে তাকে টেনে বের করার সাধ্যি কারো আছে নাকি সে জানে না।এই ইনফ্যাচুয়েশন বড্ড ভয়ংকর।একে সে যতো এড়িয়ে যেতে চাইছে,ততোই এর সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছে।আরহাম ভেবে নিয়েছে এসব ব্যাপারে সে আর নিজেকে কিংবা নিজের উপর প্রেশার ক্রিয়েট করবে না।সামনে যা হবে দেখা যাবে।এতো ভাবার কি আছে?

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে