কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৮

0
167

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৮)

রেস্টুরেন্টের ছাদ মূলত দোতালা বিশিষ্ট।মানে অনেকটা ছাদের উপর আরেকটা ছাদ এরকম ব্যাপার।দেখতে একেবারে রিসোর্টের মতো দেখায়।নবনীতা,শুভ্রানী আর চিত্র নিচেই ছিল।চারদিকে ছোট ছোট গাছের টব।দেখতে ভালোই লাগে।উপরে আবার খোলা আকাশ।

তাসনুভা একেবারে সবচেয়ে উপরের ছাদটার রেলিং ঘেঁষে বসেছিল।তার এক হাত গালে।তারা একটু আগেই এসেছে এদিকে।এদিকে আসার পর তার মানুষের সাথে কথা বলার সাথে প্রকৃতির সান্নিধ্যে উপভোগ করতে বেশি ভালো লাগছে।হঠাৎ তার চোখ গেল নিচের ছাদে।সেদিকে কাউকে দেখতেই তার দু’চোখ আনন্দে ঝলকে উঠে।সে চঞ্চল হয়ে ডাকে,’নবনীতা আপু!’

নবনীতা সঙ্গে সঙ্গে মাথা তুলে উপরে তাকায়।তাসনুভা কে দেখতেই হাসি মুখে বলে,’কেমন আছ তাসনুভা?’

‘অনেক ভালো।উপরে আসো না আপু।’

নবনীতা ঘাড় ঘুরিয়ে একবার শুভ্রা আর চিত্রা কে দেখে তারপর স্মিত হেসে বলে,’ঠিক আছে আসছি।’

চিত্রা এদিক সেদিক ছুটোছুটি করছিল।নবনীতা আর তাকে ধরল না।বাচ্চা মানুষ,খোলা জায়গা পেয়েছে।একটু ছুটোছুটি করুক।সে আর শুভ্রা ছোট ছোট পা ফেলে ওপরে উঠে আসে।নবনীতাকে দেখতেই আদি হাত নেড়ে বলল,’নবনীতা! তুমি?কি অদ্ভুত।একেবারে দেজাভু।দুনিয়াটা সত্যিই গোল দেখছি।’

আরিশ আদির কথা শুনেই পেছন ফিরে দাঁড়ালো।নবনীতার চেয়েও যেই জিনিসটা তাকে বেশি আশ্চর্য করেছে সেটা হলো তার পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা।সে তাকে দেখতেই চমকে উঠে বলল,’শুভ্রানী তুমি?’

শুভ্রানী তার চেয়েও কয়েকগুন বেশি অবাক হয়ে তাকে দেখে।সে শাহরিয়ার আরহামের ছোট ভাই?অথচ প্রথম সাক্ষাৎে তার একদমই তাকে এমন মনে হয়নি।আরিশ এগিয়ে আসে।নবনীতা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়,’শুভি কে তুমি চেন?’

‘চিনবো না কেন?সেদিন সে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে আমার গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল।’
কথাটা বলেই সে দুই আঙুল তুলে আকাশের দিকে তাক করে বলল,’আরেকটু দেরি হলেই ডিরেক্ট উপরে।আমি সময় মতো ব্রেক মে’রেছিলাম বলে বেঁচে গেছে।’

শুভ্রা দ্রুত মাথা নামিয়ে নিল।কি দরকার ছিল এতো বিশদভাবে সবকিছুর বর্ণনা করার?নবনীতা কটমট চোখে একবার তাকে দেখল,কিন্তু এর বেশি আর কিছু করল না।এই মুহুর্তে এটা নিয়ে কথা বলার পরিবেশ নেই।

তাসনুভা তাকে দেখতেই আবারো একগাল হাসল।সেই হাসির জবাবে নবনীতাও তাকে স্বচ্ছ একখানা হাসি উপহার দিলো।মেয়েটা কতো মিষ্টি।তার হুইলচেয়ার টা দেখলেই নবনীতার খারাপ লাগে।এই গোলগাল মুখের আদুরে দেখতে মেয়েটা হাঁটতে পারে না।পা থাকতেও না হাঁটতে পারাটা কতো কষ্টের,তাই না?

চিত্রা একটা গাছের পাতায় হাত দিয়ে সেটা নেড়ে চেড়ে দেখছিল।তখনি কেউ একজন তার হাত টা মুঠ করে ধরল।কিছুটা ধ’মক,কিছুটা উদ্বেগ জড়ানো গলায় বলল,’এটা ধরে না চিত্র।গাছের পাতায় মাঝে মাঝে পোকা থাকে।কা’মড় দিলে কিন্তু যন্ত্র’না হবে।’

চিত্রা হাত সরিয়ে নেয়।আরহাম একবার চোখ তুলে উপরের দৃশ্য দেখতেই চিত্রাকে এক হাত ধরে টেনে অন্য পাশে নিয়ে আসে।একটা চেয়ার টেনে তাকে মুখোমুখি বসায়।বাচ্চাকাচ্চার প্রতি তার খুব বেশি টানও কাজ করে না,আবার সে তাদের খুব বেশি অপছন্দও করে না।দূরে থাকলে জোর করে কাছে ডাকে না,আবার কাছে এলে অবহেলাও করে না,অনেকটা এমন।কিন্তু এই বাচ্চাটির ব্যাপার ভিন্ন।তাকে দেখলেই আরহামের তাসনুভার বাচ্চাকাল টা মনে পড়ে যায়।ছোটবেলায় তাসনুভার গাল আর ঠোঁট অবিকল চিত্রার মতো ছিল।এই একটি দিকে এই বাচ্চাটি বাকি বাচ্চাদের চেয়ে একটু আলাদা,একটু ভিন্ন।আরেকটি কারণও আছে।তার আপাই অপছন্দ করা স্বত্তেও সে আরহামকে অপছন্দ করেনি।ত্রিশোর্ধ যুবকটির কাছে এই ব্যাপারটা অত্যন্ত উপভোগ্য।

সে কিছুটা নিচু স্বরে বলল,’চিত্র তোমার আপাই কি সারাদিনই এমন বকাঝকা করতে থাকে?’

চিত্রা মাথা নেড়ে বলল,’না আপাই তো খুব ভালো।আমাকে চকলেট কিনে দেয়,চুল বেঁধে দেয়,গোসল করিয়ে দেয়,পাপ্পি দিয়ে ঘুম থেকে তুলে,রং কিনে দেয়,খেলা করে,ঘুম পাড়িয়ে দেয়।’

আরহাম কপাল কুঁচকায়।অবাক হয়ে বলে,’তাহলে তোমার মা বাবা কি করে?সব তো তোমার আপাই করে দেয়।’

চিত্রা পা দোলাতে দোলাতে খুব স্বাভাবিক করে বলে,’আমাদের তো মা বাবাই নেই।’

আরহাম ভড়কে গিয়ে বলে,’নেই মানে?কোথায় মা বাবা?’

‘আকাশে।’ ছয় বছরের ছোট্ট শিশুটি খুবই নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়।যেন কথাটা কতোই না স্বাভাবিক! অথচ আরহামের বুকে কথাটা গিয়ে বিঁ’ধে তীরের ফলার মতো।মা বাবা আকাশে?মানে তারা বেঁ’চে নেয়?এই ছোট্ট মেয়েটা,যে কি-না মৃ’ত্যুর সংজ্ঞাও ঠিকঠাক বুঝে না,তার বাবা মা নেই?

আরহাম কোনো কথা না বলে কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে কতোক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল।একটু পরেই খুব শান্ত স্বরে বলল,’তোমার সবকিছু তোমার আপাই ই করে?’

চিত্রা উপরনিচ মাথা নাড়ে।ঠোঁট গোল করে বলে,’আপাই সারাদিন কাজ করে,আর রাতে বাড়িতে এসে আমাকে অনেক আদর দেয়।শুভি আমাকে দুপুরে খাইয়ে দেয়,আর পরী আপাই রাতে।’

আরহাম মন দিয়ে তার কথা শুনে।সে টের পাচ্ছে এই কথাগুলো শুনতে সে ভীষণ আগ্রহী।সে টের পাচ্ছে তার সাথে সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম একটি নারীস্বত্ত্বার পরিচয় হতে যাচ্ছে।সে চোখ তুলে আরো একবার উপরে দেখে।নবনীতার মা বাবা নেই।এই দু’টো মেয়ের অভিভাবক তাহলে সে?সে নিজেই তো এখনো বাচ্চা।সে আবার কেমন করে এতো বড় বড় দায়িত্ব কাঁধে নিচ্ছে?

সে আরো একটু ঝুকে এসে একদম হিশহিশিয়ে বলল,’আচ্ছা চিত্র,তোমার আপাইয়ের পছন্দের জিনিস কি কি?’

চিত্রা একটু ভেবে চিন্তে বলল,’ফুচকা।আপাই খুব ফুচকা খায়।’

আরহাম মুচকি হাসে।কিছু একটা কল্পনা করে বলে,’সেটা তো জানিই।আর কি কি পছন্দ তোমার আপাইয়েরই?’

প্রশ্নটা করে সে নিজেই হকচকিয়ে যায়।অদ্ভুত! চিত্রাকে সে এসব প্রশ্ন কেন করছে?নবনীতার কি পছন্দ না পছন্দ সেটা দিয়ে তার কি কাজ?সে এমন আজগুবি কাজ কারবার কেন করছে?

চিত্রা আবারো ভাবল কিছুক্ষণ।গালে হাত রেখে চিন্তিত মুখে বলল,’আপাই আর কিছু পছন্দ করে না।আপাই তো সবসময় শুভি আর আমার পছন্দের জিনিস গুলোই কিনে দেয়।আপাইয়ের কোনো পছন্দ নেই।আপাই বলেছে আমাদের পছন্দই আপাইয়ের পছন্দ।’

ছোট্ট মেয়েটি কথাটা বলেই আরো এক দফা মুচকি হাসে।আরহাম নিষ্পলক চোখে তাকে দেখল।’আপাইয়ের কোনো পছন্দ নেই’ এই কথাটার মর্ম যেদিন চিত্র বুঝবে সেদিন সে অনুধাবন করতে পারবে কেন আপাইয়ের কোনো পছন্দ নেই।এই মিষ্টিমুখের বাচ্চা মেয়েটা কি জানে যে তার আপাই কেন বলেছে তাদের পছন্দই আপাইয়ের পছন্দ?হয়তো জানে না,জানার মতো বয়স এখনো হয়নি।

আরহাম চোখ তুলে উপরে দেখে।স্থির হয়ে শুধু দেখতেই থাকে।মেয়েটার জামার রং টা কি সুন্দর! একেবারে সদ্য বিবাহিতা মেয়েরা গায়ে লাল রং জড়ালে যেমন লাগে,তাকেও এমনই লাগছে।কি চমৎকার! কি অপূর্ব! এই মেয়েটির নবনীতা রূপটা আরহামের ঠিক পছন্দ হয়নি।কিন্তু পরী আপাই?পরী আপাই নামের এই অদ্বিতীয়া মেয়েটিকে অপছন্দ করার সাধ্যি কি আরহামের আছে?এই বয়সের একটি মেয়ের কোনো শখ সেই,কোনো আহ্লাদ নেই?বোনদের পছন্দই তার পছন্দ।এটা কি কখনো হতে পারে?পৃথিবীতে এমন মেয়েদের অস্তিত্ব থাকতে পারে?সে তো মেয়ে বলতে তার মা কেই চিনে এসেছে।সেই মানুষটা তো চিত্রার পরী আপাইয়ের মতো ছিল না।সে তো নিজের সন্তানদেরই কখনো এতো গভীর মমতায় লালন করে নি।আর এই টুকু মেয়েটা আরো দুইটা মেয়ের মা-বাবা উভয়ের দায়িত্ব পালন করছে।আবার বলছে বোনদের পছন্দই তার পছন্দ?মা হওয়ার পরেও একজন নারী যেই আত্মত্যাগ টুকু করতে পারে না,সদ্য গ্র্যাজুয়েট একজন বোন কি করে হাসিমুখে সেই কাজ করে দেখাচ্ছে?

তার সাথে একবার চোখাচোখি হতেই আরহাম চোখ নামিয়ে নিল।নবনীতা উপরের ফ্লোরের রেলিং ঘেঁষে নিচে দেখে বলল,’চিত্র! ওদিকে কি করছ?উপরে আসো।’

আরহাম চিত্র’র একটা হাত মুঠ করে ধরে বলল,’শোনো চিত্র! তোমার আপাই কিন্তু তোমাকে জিজ্ঞেস করবে যে আমি তোমাকে কি কি জিজ্ঞেস করেছি।তুমি কিন্তু ভুলেও সেগুলো বলবে না।বলবে কার্টুন নিয়ে কথা বলছিলাম।ঠিক আছে?এটা আমাদের সিক্রেট,ওকে?’

চিত্রা দাঁত বের করে হাসল।বলল,’ঠিক আছে আরাম ভাই।’

তারপরই চেয়ার থেকে নেমে সিঁড়ির দিকে ছুটল।সে ওপরে আসতেই নবনীতা খপ করে তার হাত টা ধরে চোখ বড় বড় করে বলল,’ঐ লোকের সাথে এতো কি গুজুরগুাজুর ফুসুরফাসুর করছিলি রে?কি বলেছে সে তোকে?’

চিত্রা খুবই আত্মবিশ্বাসের সাথে জবাব দিলো,’কার্টুন নিয়ে কথা বলছিলাম আপাই।’

সাথে আবার নিজ থেকেও কিছু কথা যোগ করল যেন ব্যাপারটা নবনীতার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।সে দুই হাত নেড়ে নেড়ে বলল,’ভাইয়ার প্রিয় কার্টুন মটু পাতলু।’

নবনীতা সন্দিহান চোখে একবার তাকে দেখে।তারপর এক আঙুল দিয়ে আলতো করে ঠোঁট চেপে ধরে বলল,’আচ্ছা তুমি খেলা কর যাও।কিন্তু কোনোকিছুতে হাত দিয়ো না কেমন?’

চিত্রা মাথা নেড়ে এক দৌঁড়ে সেখান থেকে চলে গেল।নবনীতা চুপচাপ হেঁটে তাসনুভাদের টেবিলের কাছে এলো।শুভ্রা তখন আদির সাথে কথা বলছিল।এই আদি লোকটা ভীষণ মিশুক।একটু দেখা হতেই এমন করে কথা বলছে যেন সে তার খুব চেনা কেউ।নবনীতা সেদিকে গিয়েই আশপাশ দেখে তাসনুভা কে বলল,’আমরা তাহলে ঐ টেবিলে গিয়ে বসি?’

তাসনুভা বিচলিত হয়ে বলল,’কেন?এখানেই বসো না।পুরো টেবিলই তো খালি পড়ে আছে।তোমরা তো তিনজনই।’

নবনীতা সাথে সাথেই সে প্রস্তাব নাকচ করে দিলো।হাত নেড়ে বলল,’না না।তোমরা বসো,আমরা অন্য কোথাও গিয়ে বসবো।’
একটু থেমে সে আবার বলল,’আসলে আমার একটা ফ্রেন্ডও আসবে।কিন্তু সে যে কোথায় কে জানে!’

তার কথা শুনতেই আদি বলল,’আমারও তো একটা ফ্রেন্ড আসবে।সেও যে কোথায় কে জানে!’
.
.
.
.
‘বললাম তো ম্যাডাম।ভেতরে যাওয়া যাবে না।নিষেধ আছে।’
গার্ডের দায়িত্বে থাকা লোকটা চূড়ান্ত বিরক্ত হয়ে কথাটা বলল।

রিমি বায়না ধরে বলল,’প্লিজ আঙ্কেল।যেতে দিন না।আমার ফ্রেন্ড কে আমি বলেছি এদিকে আসতে।আউটডোরে যেতে না দিলে সে রেগে দুই দিন আমার সাথে কথাই বলবে না।’

‘কিছু করার নাই ম্যাডাম।অন্য কোনো রেস্টুরেন্টে যান।এদিকে আজকে কাউকে যেতে দেওয়া যাবে না।’

রিমি উদাস মুখে বলল,’কাউকেই যেতে দেন নি ভেতরে?’

‘নাহ,সবাইরে ফেরত পাঠায় দিসি।’

রিমি মলিন মুখ করে বলল,ওহ!’

তারপরই সে ব্যাগে হাত দিয়ে তার ফোনটা খুঁজতে খুঁজতে ঘুরে দাঁড়ায়।ধপ ধপ পা ফেলে ইনডোরের দিকে পা বাড়ায়।ওয়াজিদ মাত্র লিফট থেকে নেমে সামনে হাঁটা শুরু করেছিল।তক্ষুনি কারো মাথা ধাম করে তার বুকে এসে বারি খায়।ওয়াজিদ লাফিয়ে উঠে দুই কদম সরে যায়।রিমি মাথা ডলতে ডলতে উপরে তাকায়।দু’জনার চোখাচোখি হতেই রিমি আঁতকে উঠে।তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে এখনই কেঁদে ফেলবে।সে ভাঙা গলায় মিনমিন করে বলল,’সরি ভাইয়া।মিস্টেক হয়ে গেছে।নেভার মাইন্ড।’

ওয়াজিদ স্বভাবতই ধৈর্যশীল,শান্ত প্রকৃতির মানুষ।সহজে তার রাগ হয় না,সে রাগ দেখাতেও পছন্দ করে না।এমনিতেই নিচে সে মেয়েটির সাথে কিছুটা রুক্ষ হয়ে কথা বলেছিল।সে মুখে সৌজন্যসূচক হাসি ফুটিয়ে বলল,’ইটস ওকে।পরের বার থেকে দেখে চলবে।’

‘ওয়াজিদ! এসেছিস?’

প্রশ্ন শুনতেই ওয়াজিদ সামনে তাকায়।ঘুরে দাঁড়ায় রিমি নিজেও।কাঁচের দরজার অন্যদিকে আরহাম দাঁড়িয়ে আছে।যদিও সে এগিয়ে আসায় গার্ড নিজেই দরজাটা টেনে ধরেছিল।ওয়াজিদ এগিয়ে যায় তার দিকে।আরহাম তীক্ষ্ণ চোখে তার সঙ্গে থাকা মেয়েটিকে দেখে বলে,’এটা কে?’

‘চিনি না।’ ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দেয় ওয়াজিদ।

আরহাম খাঁড়া চোখে আবারো মেয়েটিকে দেখে।মেয়েটির মুখটা পূর্ব পরিচিত।আগে দেখেছে মনে হচ্ছে।আরহামের দৃষ্টি দেখতেই রিমি বিনয়ী স্বরে বলল,’আসসালামু আলাইকুম আরহাম ভাইয়া।’

আরহাম সালামের জবাব দিলো।জানতে চাইল,’তুমি কি ডি.ইউ তে পড়ো?’
রিমি দ্রুত মাথা নাড়ে।জানায় সে সেখানেই পড়ে,ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট।
একটু পরে নিজ থেকেই বলে,’আমি নবনীতার ফ্রেন্ড।’

এবার তাকে ঠিক মতো চিনতে পেরেছে আরহাম।ফুচকার স্টলে সে তাকেই দেখেছিল নবনীতার সাথে।সে ঠান্ডা গলায় বলল,’এদিকে আসো।তোমার বান্ধবী টেরেসেই আছে।’

রিমি কিছু বলার আগেই ওয়াজিদ চমকে উঠে বলল’কি?নবনীতা আছে এখানে?’

আরহাম ঠোঁট গোল করে মৃদু স্বরে উত্তর দেয়,’হু’

***

নবনীতা চুপচাপ দূরের একটা টেবিলে বসেছিল।তার কেন যেন চিত্র’র উপর রাগ হচ্ছে।মেয়েটা বারবার আরহামের কোলে উঠে তার গলা জড়িয়ে ধরছিল।বেড়াতে গেলে চিত্রা কখনো তার হাত ছাড়ে না।সেই চিত্রই আজ তাকে ছাড়া দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে।বার বার আরহামদের টেবিলের কাছে গিয়ে দুষ্টুমি করছে।।চিত্র দুষ্টু টা বারবার ঐ টেবিলে চলে যাচ্ছিল।

শুভ্রা,চিত্রা আর রিমি সবার সাথেই কথা বলছিল।আদি আর আরিশ চারদিক হেঁটে হেঁটে কথা বলছে,তাসনুভাও থুতনির নিচে এক হাত রেখে আশাপাশ দেখছে।ওয়াজিদ বসে আছে টেবিলের এক কোণার একটি চেয়ারে।তার আড়চোখের চাহনি দূরের টেবিলের থম মেরে বসে থাকে মেয়েটির পানে নিবদ্ধ।আদি বিষয়টা প্রথমবার এড়িয়ে গেলেও তারপর সে মনোযোগ দিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করে।তারপর আবার আরিশের সাথে কথায় মন দেয়।

আরহাম রিমিকে উদ্দেশ্য করে বলল,’তোমার ফ্রেন্ড একা বসে আছে।গিয়ে কথা বলো যাও।’

রিমি অসহায় মুখ করে বলে,’কাজ হবে না ভাইয়া।সে এখন গেলেও মুখ ফুলিয়ে রাখবে।কতোবার গিয়েছি।কোনো কিছুই ঠিক মতো বলে না।’

‘কথা বলতে গেলে কি বলে?’

‘বলে আমার সাথে তোদের কিসের কথা?আমি তো বড়লোক নই।তোরা তোদের বড়লোক আরহাম ভাইয়ের সাথে কথা বল।তোদের আর আমার প্রয়োজন নেই।’ ম্লান মুখে উত্তর দেয় রিমি।

আরহাম উত্তর শুনেই আলগোছে হাসে।কথা না বাড়িয়ে বলে,’আচ্ছা থাক।যেতে হবে না আর।সে নিজেই আসবে।’

কথা শেষ করে সে আদি আর আরিশের দিকে তাকায়।পকেটে একহাত গুজে সম্মুখে পা বাড়ায়।শুনতে পায় পেছন থেকে রিমি শুভ্রাকে উদ্দেশ্য করে বলছে,’শুভি তোমরা কেক কিনো নাই?’

শুভ্রা ধিমি স্বরে উত্তর দেয়,’নাহ,কিনি নাই।আপাই বলল এখান থেকে বেরিয়ে কিনবে।’

‘কিসের কেক?’ ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করে আরহাম।
শুভ্রা সাবলীল ভঙ্গিতে জবাব দিলো,’আজ চিত্র’র বার্থডে।তাই আমরা কেক কিনব ভাবছি।’

আরহাম মাথা নাড়ে।আর কোনো কথা না বলে সেখান থেকে সরে আসে।যোগ দেয় আদি আর আরিশের আড্ডায়।মাঝে আবার কয়েকটা ফোনকলও রিসিভ করে।সবশেষে হাই তুলতে তুলতে বলে,’এদিকে না এসে কয়টা কাজ করে নিলে আরো ভালো হতো।কালকে সারাদিন আর দম ফেলার সময় টুকুও পাবো না।’

টেবিলে খাবার আসতেই আরহাম গলা উঁচু করে ডাকল,’এই সবাই খেতে আসো।’

তাসনুভা টেবিলের কাছেই ছিল।সে চোখ সরু করে বলল,’নবনীতা আপু তো মনে হচ্ছে আসবে না।’

আরহাম নিরুদ্বেগ হয়ে বলল,’না আসুক।আমাদের কি?এক বেলা না খেলে সে ম’রে যাবে না।সে বরং বসে বসে বাতাস খাক।প্রকৃতির বাতাস খেলে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।’

‘ধ্যাত! এসব কেমন কথা?তুমি একটু গিয়ে বলো না তাকে আসতে।’

‘কি?আমি গিয়ে তাকে বলব?কেন রে?আমার কিসের ঠেকা পড়েছে?সে কোন জায়গার প্রেসিডেন্ট শুনি?’ খটখটে গলায় প্রশ্ন করে আরহাম।

তাসনুভা মুখ ভার করে অন্যদিকে চোখ সরিয়ে নেয়।ভাইয়া এমন কথায় কথায় তেঁতেঁ উঠে কেন?অদ্ভুত ব্যাপার!
রিমি এগিয়ে এসে কিছুটা সংকোচ নিয়ে বলল,’ভাইয়া আমরা না হয় অন্য টেবিলেই খাই।আপনারা এখানে থাকুন।’

আরহাম একবার রিমিকে দেখে তারপরই তীর্যক চাহনিতে নবনীতাকে দেখে।দেখেই ওয়েটারকে ডেকে নবনীতার বসে থাকা টেবিলের দিকে একটা আঙুল তুলে বলল,’ওদের খাবার টা ঐ টেবিলে সার্ভ করে দিও।’

সাদা ফর্মাল শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা ফিটফাট মাঝবয়সী লোকটা তার কথা শুনতেই সেদিকে এগিয়ে গেল।সাথে বাকি ওয়েটারদেরও কিছু একটা নির্দেশ দিলো।মুহূর্তেই নবনীতার সামনে থাকা টেবিলটা খাবারে খাবারে ভরে গেল।

নবনীতা বিস্মিত নয়নে খাবারের প্লেট হাতে দাঁড়ানো লোকটিকে প্রশ্ন করল,’এতো খাবার কে খাবে?’

লোকটি নম্র গলায় জবাব দেয়,’আরহাম স্যারই বলেছেন ম্যাম।তাদের টেবিলে যা কিছু দেওয়া হয়েছে তাই যেন আপনাদের টেবিলে দেই।’

‘আপনার আরহাম স্যারকে বলুন তার মতো টাকার ফুটানি আমরা করি না।আর এতো খাবার আমরা খেতেও পারব না।আরহাম স্যারের ডিশ আরহাম স্যার কেই দিন।আমরা এতো কিছু চাই না।’ কর্কশ রসকষহীন কন্ঠে প্রতিউত্তর করে নবনীতা।

সামনে দাঁড়ানো লোকটা থতমত খেয়ে কিছু সময় তার দিকে দেখল।রিমি দুই দিক দেখে কন্ঠ নামিয়ে বলল,’আঙ্কেল,আমরা এতো কিছু খাব না।আপনি কষ্ট করে বাকি খাবার গুলো নিয়ে যান।না হয় অপচয় হবে।’

নবনীতা তার কথা শেষ না হতেই কঠিন মুখ করে বলল,’আমরা খেতেও পারব না আর এতো টাকা বিলও দিতে পারব না।নিয়ে যান এসব।’

শুভ্রানী অসহায় দু’টো চোখে তার পরী আপাইকে দেখে।আপাই যখন থেকে দেখেছে চিত্র আরহাম ভাইয়ের কোলে,তখন থেকে তার মুখের হাসি পুরো জগৎ ছাড়িয়ে অন্য কোনো গ্রহে গিয়ে ঠাই নিয়েছে।আপাই চিত্রকে নিয়ে ভীষণ পজেসিভ।সে বাদে চিত্র কারো গলা জড়িয়ে ধরলেই তার মেজাজ বিগড়ে যায়।আজও তাই হয়েছে।

আরহাম আড়চোখে একবার তাদের দেখল।ম্যাডাম নবনীতা তখনও মুখ ফুলিয়ে বসে।চিত্রা আরিশ আর আদির সাথে টেনিস বল ছু’ড়ে ছু’ড়ে খেলছিল।আরহাম তাকে ডেকে বলল,’অনেক খেলেছ।এখন খেতে যাও চিত্র।’

চিত্র দৌঁড়ে দৌঁড়ে নবনীতার কাছে গিয়ে তার পাশের চেয়ারে বসল।ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া মাথাটা নবনীতার হাতের উপর রেখে আদুরে গলায় বলল,’পরী,খুব খিদে পেয়েছে।’

নবনীতা মুখটা অন্যদিকে সরিয়ে নিয়ে ভাবলেশহীন ভাবে বলল,’খিদে পেলে খাও।আমাকে বলছ কেন?এই যে সামনে প্লেট আছে।নিয়ে খাও।’

রিমি তার আচরণ দেখেই কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলল,’এসব কি নবনী?তুই কি মাঝে মাঝে বাচ্চা হয়ে যাস?ছোট একটা বাচ্চা।এমন করছিস কেন?’

‘আমি কি করেছি?অদ্ভুত তো! সে তো আমাকে ছাড়াই এতোটা সময় ছিল।এখন সমস্যা কি?’

নবনীতা মুখটা ঘুরিয়ে চিত্রাকে দেখে কটাক্ষ করে বলল,’এক কাজ কর।তুই তোর ঐ পরানের ভাইয়ের কাছে চলে যা।সে তোকে একেবারে মেখে মেখে খাইয়ে দিবে।সামনে নির্বাচন তো,এজন্য জনদরদী ভাইয়ের হাসি থামে না।একবার জিততে দে,তারপর দেখবি আসল চেহারা।’

‘আহা আপাই! তুমি চিত্র কে এতো কঠিন কঠিন কথা বলছ কেন?সে কি এসব বোঝে?আজ ওর বার্থডে।প্লিজ আপাই।এসব করো না।’ অত্যন্ত করুণ চোখে নবনীতার দিকে দেখে কথাটা বলল শুভ্রা।

নবনীতা দমে গেল সাথে সাথে।একটা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে সবার প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল,’আচ্ছা হয়েছে।চলো খাওয়া শুরু করো।দেরি হয়ে যাচ্ছে আমাদের।’

চিত্রা মলিন মুখে একবার তার আপাইকে দেখে।শুভ্রা চামচে ফ্রাইড রাইস নিয়ে তার মুখের সামনে এনে বলল,’নেও চিত্র খেয়ে নাও।শুভি খাইয়ে দিচ্ছি তোমায়।’
চিত্রা চুপচাপ খাবার টা মুখে নেয়।
নবনীতা আড়চোখে তাদের কর্মকাণ্ড দেখে,আর রিমি দেখে তাকে।চিত্রাকে যে সে কি পরিমান ভালোবাসে সেটা রিমি তার চোখ দেখেই বুঝতে পারে।
খাওয়ার ফাঁকেই একবার চিত্রার সাথে তার আপাইয়ের চোখাচোখি হয়।দু’জনই কয়েক পল স্থির হয়ে দু’জনকে দেখে।নবনীতা টের পাচ্ছে তার চোখ আর্দ্র হয়ে যাচ্ছে।অকস্মাৎ চিত্রা ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিলো।
সেই কান্না দেখেই নবনীতার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠে,চোখ দু’টো ঝাপসা হয়।সে সঙ্গে সঙ্গে তাকে জড়িয়ে ধরে এক হাত দিয়ে।কপালে চুমু খেয়ে অনুতপ্ত হয়ে বলে,’সরি সোনা।আপাই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছি।সরি,অনেক গুলো সরি।তোমার না আজকে জন্মদিন।কাঁদে না পাখি।জন্মদিনে কাঁদতে নেই।’

চিত্রা কান্না থামালো সত্যি সত্যি।তারপরই শুভ্রার হাত থেকে চামচ টা একটান দিয়ে নিজের হাতে নিয়ে সেটা নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,’আপাই খাওয়াবে,তুমি না।তুমি শুধু আপাই বাড়িতে না থাকলে খাওয়াবে।’

নবনীতা হাসল।শুভ্রা নিজেও প্রথমে চোখ পাকিয়ে পরে আবার হেসে দিলো।

‘তোমরা কি নিয়ে এতো কথা বলছ?’

পাশ থেকে কেউ ডাকতেই নবনীতা সেদিকে ফিরে।দেখে তাদের চেয়ে কিছুটা দূরে তাসনুভা যার হুইল চেয়ারের হাতল দু’টো একজন ওয়েটারের হাতে বন্দি।নবনীতা তাকে দেখেই বলল,’তাসনুভা তুমি?কিছু লাগবে আপু?’

তাসনুভা কিছুটা অনুযোগ,কিছুটা অনুরোধ করে বলল,’ঐদিকে সবাই নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে।আমার এসব ভালো লাগে না।আমি কি তোমাদের সাথে খেতে পারি?’

নবনীতা আশ্চর্য হয়।পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,’কেন নয়?অবশ্যই খেতে পারো।আসো আসো।আমার পাশে এসো।’

তাসনুভা তার পাশটায় এলো।নবনীতা হাতের চামচটা ফেলে হাত দিয়ে অল্প পরিমান ফ্রাইড রাইস নিয়ে চিত্রকে খাওয়ায়।রিমি তাকে দেখতেই নিজের চামচ টা ফেলে দিয়ে বলল,’আমিও হাত দিয়েই খেতে চাচ্ছিলাম।কিন্তু লজ্জায় খেতে পারছিলাম না।এখন আর কোনো লজ্জা নেই।’

তাসনুভা অবাক হয়ে তাদের দেখে।নবনীতা তার বিস্ময় জড়ানো চোখ জোড়া দেখেই হাসি মুখে বলল,’এতো অবাক হয়ো না তাসনুভা।আমরা গ্রামের চাচাতো বোনরা একটু এমনই।অতো স্টাইল করে খেতে পারি না।আমার এক কোটি টাকা থাকলেও আমি সারাজীবন হাত দিয়েই ফ্রাইড রাইস খাবো।’

তাসনুভা দিরুক্তি করে বলল,’ধুর,আমি মোটেও তোমাদের গ্রামের চাচাতো বোন ভাবছি না।আমার উল্টো চিত্রার খাওয়া দেখে লোভ লাগছে ভীষণ।’

নবনীতা তার কথা শুনতেই খুব হাস্যোজ্জ্বল মুখে তার দিকে একটা লোকমা বাড়িয়ে দিলো।মিষ্টি হেসে বলল,’দেখো তো।খেয়ে দেখো তো কেমন লাগে।’

তাসনুভা একবার তার হাত আরেকবার তার মুখটা দেখল।সে ভাবে নি নবনীতা এতো সুন্দর করে তাকে খাইতে দিতে চাইবে।তাকে এভাবে কেউ কখনো খাইয়ে দেয়নি।ছোটবেলাটা সে বাড়ির পরিচারিকা দের সান্নিধ্যেই কাটিয়েছে।আরহাম আর আরিশ ভাইয়া তার খুব যত্ন নিত।কিন্তু তাকে কেউ কখনো এতো মমতায় খাইয়ে দিতে আসেনি।

সে আর্দ্রচোখে লোকমা মুখে তুলে।দূর থেকে এক জোড়া চোখ গভীর মনোযোগে সেই দৃশ্য দেখে।টের পায় দৃশ্যটা তার হৃদয়ে জোয়ারের বিশালাকার ঢেউরের মতো আঁছড়ে পড়ছে।টের পায় এতো স্নেহ তার ছোট্ট বোনটাকে তার নিজের ফুফুও কখনো দেয়নি।টের পায় পরীদের মধ্যে থাকা কোনো একটা পরী সত্যিই নিজের জগৎ ছেড়ে এই মর্ত্যলোকে এসে ঠায় নিয়েছে।তার ডানা নেই,কিন্ত সে সত্যিই পরী।

আরহাম একটা শুকনো ঢোক গিলে।তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।অনুমান করতে পারছে তার সাথে যা হচ্ছে সেটা স্বাভাবিক না।সে কি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে?
অসম্ভব অসম্ভব।সে কখনো দুর্বল হতে পারে না।কিন্তু এই যে অবাধ্য মন বার বার একটা নিষিদ্ধ মানবীর দিকে ঝুকে যাচ্ছে,সেটার কি করবে আরহাম?একে তো আর বেঁধে রাখা যাচ্ছে না কিছুতেই।

চলবে-

(পুরোটা লিখা হয়নি।প্রচুর বড় হয়ে যাচ্ছিল।সব ঠিক থাকলে রাতে অতিরিক্ত অংশ পাবেন ইনশাআল্লাহ)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে