কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৭

0
107

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৭)

‘জানিস,আমার সাথে যেই বেটার বিয়ে ঠিক হয়েছিল,তার নাকি আগেই একবার বিয়ে হয়েছে।সে ঘরে নাকি আবার একটা মেয়েও আছে।’ অত্যন্ত বিচ্ছিরি মুখ করে কথাটা বলল রিমি।

নবনীতা গালের নিচে হাত রেখে বলল,’সাং’ঘাতিক ব্যাপার তো! তোদের কে কিছুই জানায়নি?’

‘উহু।কিছুই না।শা’লা যে বিয়াত্তা সেটাও জানায়নি।কতো বড় হত’চ্ছাড়া একবার চিন্তা কর।’

তার কথার ধরনেই নবনীতা ফিক করে হেসে ফেললো।জিজ্ঞাসু হয়ে বলল,’তো এরপর কি হলো?বিয়েটা তাহলে বাতিল?’

রিমি চোখ বড় বড় করে বলল,’বাতিল মানে?এটা একটা প্রশ্ন হলো?অবশ্যই বাতিল।কাল রাতে ফোন করে তাকে ইচ্ছে মতো কয়েকটা গালি দিয়ে ব্ল’ক করে দিয়েছি।এখন ভাবছি প্রতারণার মা’মলা করব তার নামে।কতো বড় ঠ’গ একবার ভেবেছিস?’

নবনীতা ঠোঁট উল্টায়।মাথা ঝাকিয়ে জানায় রিমি ঠিকই বলছে।বেটার নামে মা’মলা ঠুকে দেওয়া দরকার।তারপরই আবার সে নিজ থেকে বলে উঠে,’তুই চাইলে তার নামে মানহানির মা’মলাও করতে পারিস রিমি।’

‘সেটা কি করে?’ ভীষণ কৌতূহলী শোনায় রিমির কন্ঠ।

নবনীতা গম্ভীর মুখ করে বলল,’এই যে তার সাথে তার বিয়ে প্রায় হয়েই যাচ্ছিল।কাছের মানুষ জন জেনে গিয়েছিল তোর বিয়ে হবে।শেষটায় হলো না।এতে করে সবার কাছে তোর প্রেসটিজ ডাউন হলো না?তোর মানসম্মানে আঘাত করা হলো না?’

‘একদম একদম।ঠিক বলেছিস এভাবে তো ভেবে দেখেনি।’
রিমি থামলো।সেকেন্ডের মাথায়ই আবার উত্তে’জিত হয়ে বলল,’তাহলে তো আমি তার নামে অর্থ আত্ম’সাৎ এর মা’মলাও করতে পারি। সে যেদিন বাড়ি এলো,সঙ্গে পুরো গোষ্ঠী নিয়ে এলো।এই পঙ্গপালের দলকে খাওয়াতে গিয়ে আব্বুর পঁয়তাল্লিশ হাজার টাকার বাজার করতে হয়েছে।শা’লা রা’ক্ষসের দল!’ শেষ কথাটা বলতে গিয়েই দাঁত কিড়মিড় করে উঠে রিমির।

নবনীতা তাকে দেখল।তার কথা শেষ হতেই সে নিজের মুখটা আরো বেশি গম্ভীর করে ঠান্ডা গলায় বলল,’আমরা কিন্তু তার নামে খু’নের মা’মলাও দায়ের করতে পারি।’

হকচকিয়ে ওঠে রিমি।বি’স্ফারিত চোখে নবনীতাকে দেখে কন্ঠ খাদে নামিয়ে জানতে চায়,’সেটা কিভাবে?’

নবনীতা আগের চেয়েও শীতল কন্ঠে বলল,’সে তোর লেহেঙ্গা পরে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে করার শখের খু’ন করেছে।আমাদের পেট ভরে কাচ্চি খাওয়ার পরিকল্পনার খু’ন করেছে।রিমন ভাইয়া বলেছিল তোর বিয়েতে ফ্রিতে ফুচকা খাওয়ার ব্যবস্থা করবে।সেই স্বপ্নের খু’ন করেছে তোর হতে হতে না হওয়া বর।শুধু কি মানুষ মা’রলেই খু’নী হয়?ইচ্ছে গুলো যারা মা’রে তারা কি খুনী না?’

নবনীতা থামে।থমথমে মুখে পাশ ফিরে।রিমি বোকার মতো হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।দু’জনের দৃষ্টি মিলতেই দু’জন খিলখিল করে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।রিমি পেটে হাত চেপে হাসি থামাতে থামাতে বলল,’সহমত সহমত।ভুল কিছু বলিস নি কিন্তু নবনীতা।’

নবনীতা হাসি থামিয়ে তার কাঁধে হাত চেপে বলল,’হয়েছে।অনেক উদ্ভট কথাবার্তা হয়েছে।এখন আসল কথায় আসি।আমার মনে হচ্ছে তোর কপালে আল্লাহ খুব বেশি ভালো কাউকে রেখেছেন।সেজন্যই তোর এই বিয়ে টা ভেঙে গেছে।’

রিমি সন্দিহান চোখে তার দিকে দেখে বলল,’সত্যি?আমার তো মনে হয় না।’

‘আমার মনে হয়।মিলিয়ে নিবি ভবিষ্যতে।আর তারপর আমায় এসে ধন্যবাদ দিবি।’

দুই বান্ধবী কথা শেষে রমনার পুরোনো কাঠের বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।রমনার প্রশস্ত খোলা রাস্তায় কথা বলতে বলতে সামনে এগিয়ে যায়।নবনীতা লুবনাকে পড়ানো শেষ করে এদিকে এসেছে।রিমির নাকি ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে তার সাথে।নবনীতা জানত তার গুরুত্বপূর্ণ কথা ঠিক কেমন গুরুত্বপূর্ণ।তবুও সে এসেছে।কারণ রিমির সাথে কথা বলতে তার ভালো লাগে।সমবয়সী মানুষদের সান্নিধ্যে মানুষের সময় এমনিতেই ভালো যায়।বন্ধু শব্দটা ব্যক্তিভেদে একেকরকম অর্থ বহন করে।কিন্তু এই আত্মিক সম্পর্ক কে উপেক্ষা করে কি মানুষ বাঁচতে পারে?সম্ভবত না।এই সমমনা মানুষ গুলোকে আমাদের ভীষণ প্রয়োজন।খুব বেশি না,বন্ধুর মতো বন্ধু একজন থাকাটাই কি পরম সৌভাগ্যের বিষয় না?
.
.
.
.
পরের তিনটে দিন আরহামের কেটেছে চূড়ান্ত রকমের ব্যস্ততায়।এতো এতো ব্যস্ততায় নিজের হাতের কথাও সে বেমালুম ভুলে যাচ্ছে।ব্যস্ততার পাশাপাশি যতোই দিন যাচ্ছে ততোই উৎকন্ঠা কাজ করছে তার ভেতর।কি হবে সামনে?রাকিব নিশ্চয়ই চুপচাপ বসে থাকবে না।কিছু একটা ফন্দি তো ঠিকই আঁটছে মনে মনে।আবার সাথে ঐ ফাহাদও আছে।কে জানে আবার কোন নতুন ছক কষছে সে!

আরহাম আর বেশি ভাবে না।ভাবলেই মাথার দুই পাশ চিনচিন করে।সে পার্টি অফিসের সব ঝায় ঝামেলা মিটিয়ে বাড়ি এসে ঘামে ভেজা পাঞ্জাবি পরেই হাত পা ছড়িয়ে খাটে শুয়ে পড়ে।আদি আর আরিশ আজকে উত্তরা গিয়েছে।আদির দূর সম্পর্কের কোনো এক আত্মীয় থাকে সেখানে।তার সাথে দেখা করতে গিয়েছে সে।

আরহাম পকেট থেকে ফোন বের করে তার নম্বরে ডায়াল করে।কল রিসিভ হতেই বলে,’কিরে?দেখা করেছিস?এখন কোথায়?’

রাস্তায় গাড়ির হর্ণের শব্দে কিছুই ঠিক মতো শোনা যাচ্ছিল না।আদি গলার স্বর চওড়া করে বলল,’হ ভাই।মাত্র বেরিয়েছি।বুঝিসই তো দেশে আত্মীয় স্বজন বলতে তেমন কেউ নাই।কোথাও গেলেই জগত সংসারের সব আলাপ আমার সাথে শুরু করে দেয়।’

আদি হয়তো আরো কিছু বলতো,কিন্তু তার আগেই আরহাম বিরক্ত হয়ে বলল,’অতো কাহিনী শুনে আমার লাভ নাই ভাই।তুই দেখা করেছিস নাকি সেটা জানতেই ফোন দিয়েছিস।’

‘হ্যাঁ,দেখা করেছি।আর জানিস আজ ঐ বাড়িতে গিয়ে কি দেখেছি?’

আরহাম কল কেটে মোবাইল ফোনটা নিজের থেকে কিছুটা দূরে রাখল।নাক মুখ কুঁচকে বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করল,’বাচাল একটা!’

বিকেলের একটু আগে তার ঘরের সামনে তাসনুভা এলো।অত্যন্ত নরম গলায় ডাকলো,’বড় ভাইয়া!’

আরহাম চোখ বুজে ঝিমুচ্ছিল।তার আওয়াজের ধরন দেখেই সে ভারি গলায় বলল,’কি হয়েছে তাস?কি লাগবে?’

তাসনুভা ভ্যাবাচ্যাকা খায়।ভাইয়া কি বুঝে গেছে নাকি?সে কন্ঠ স্বর আরো নমনীয় করে শুধায়,’ভাইয়া তোমার কি আজ সন্ধ্যায় কোনো কাজ আছে?’

আরহাম চোখ বন্ধ রেখেই ভরাট কন্ঠে বলল,’আমার সারাদিনই কাজ থাকে।তোর কি দরকার সেটা বলল।’

তাসনুভা একটা ঢোক গিলে শুকনো মুখে বলল,’ভাইয়া, আদি ভাইয়া দেশে আসার পর আমরা কোথাও বের হইনি।চলো না আজ আমরা কোথাও গিয়ে খেয়ে আসি সবাই মিলে।’

‘তোরা যা।আমি যেতে পারব না।ক’দিন পর নির্বাচন।আমার মনে এতো রং নাই।ভালো হয় যদিও তোরাও না যাস।সিকিউরিটিরও তো একটা বিষয় আছে।’ বরফ শীতল কন্ঠে উত্তর দেয় আরহাম।

‘ভাইয়া প্লিজ।’ অনুনয়ের সুরে বলল তাসনুভা।

‘সব সময় জেদ করবি না তাস।ভালো লাগে না।’

‘প্লিজ ভাইয়া।’

‘তাসনুভা!’

‘ভাইয়া!’

‘পারব না আমি যেতে।আমার ইচ্ছে নেই।বাড়িতে কাজ আছে আমার।তোরা যা।আরিশ তো সব চেনে।আমাকে কেন নিতে হবে?’ কন্ঠে কিছুটা বিরক্তি মিশিয়ে উত্তর দেয় সে।

তাসনুভা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল,’ভাইয়া এমন করো কেন?এমন কি চেয়েছি তোমার কাছে?চলো না প্লিজ।প্লিজ ভাইয়া।আর কিছু চাব না তোমার কাছে।’

আরহাম চোখ খুলে সামনে দেখে।চূড়ান্ত রকমের বিরক্ত হয়ে বলে,’আচ্ছা বাপ,যাব নে তোদের সাথে।এবার যা এদিক থেকে।’

খুশিতে তাসনুভার দুই চোখে ঢেউ খেলে যায়।সে যাওয়ার আগে তর্জনী আঙুল তুলে চোখ পাকিয়ে বলল,’খবরদার! ঐ সারাহ কে নিবে না ভুলেও।সে গেলে কিন্তু আমি যাব না বলে দিলাম।’ কথা শেষ করেই সে হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে অন্যদিকে চলে গেল।

আরহাম মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করে বলল,’তাস যে মাঝেমধ্যে কি করে না! দুনিয়ার সবাইকে তার ভালো লাগে।শুধু ফুফু আর সারাহ বাদে।’

______________________________________________

চিত্রার আজ ঘুম ভেঙেছে পরী আপাইয়ের শত শত চুমু খেয়ে।সকাল হতেই নবনীতা তার মুখের সামনে থেকে এলোমেলো চুল গুলো সরিয়ে তার সমস্ত মুখে অগনিত চুমু খেল।জড়ানো কন্ঠে বলল,’শুভু জন্মদিন সোনা।আল্লাহ তোমায় নেক হায়াত দান করুক।’

চিত্রা পিটপিট চোখ মেলে তাকায়।পরী আপাই তার দিকে ঝুকে আছে।আপাইয়ের মিষ্টি মুখটা দেখতেই সে আলগোছে হাসে।মাথা তুলে আপাইয়ের গালে ছোট করে একটা চুমু দেয়।নবনীতা তার বুকে আস্তে করে মাথা রেখে হাসি হাসি মুখ করে বলল,’আমার ছোট্ট চিত্র পাখিটা আস্তে আস্তে বড় হয়ে যাচ্ছে।কষ্টও হয়,আবার ভালোও লাগে।’

‘কষ্ট কেন হয়?’ ঘুম জড়ানো গলায় জানতে চায় চিত্রা।নবনীতা এক গাল হেসে বলল,’তুই বুঝবি না।বাচ্চারা বড়ো হয়ে গেলে বড়দের কষ্টই হয়।’

কথা শেষ করেই সে দ্রুত উঠে বসে।চিত্রার এক হাত ধরে টানতে টানতে তাকে তাড়া দিয়ে বলে,’দেখি তাড়াতাড়ি হাত মুখ ধুয়ে একটু পড়তে বসো তো চিত্র।পড়া শেষে আমরা খেলা করব।’

চিত্রা চোখে আঙুল ডলতে ডলতে জানতে চায়,’তুমি বাইরে যাবে না আজকে?’

‘নাহ,আজ ছুটি নিয়েছি আমি।আজ শুধু আমি আমার মিষ্টি মিষ্টি দুইটা পাখির সাথে ঘুরবো।’

নবনীতার সারাটা দিন কাটলো অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ অন্যরকম।আজ সে সারাদিন বাসায় ছিল।কেবল চিত্রার সাথে বসে বসে গল্প করেছে।মাঝখানটায় আবার চিত্রার ড্রয়িং বুকে একটা গাছও এঁকেছে।

বিকেলে শুভ্রানী কোচিং থেকে বাড়ি ফিরেই ব্যস্ত হয়ে বলল,’আপাই মনে আছে তো,আজ আমরা বাইরে যাব।’

নবনীতা চোখ বাঁকা করে বলল,’হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে।তোর আসার অপেক্ষাই করছিলাম।যা তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।’

শুভ্রানী হাত মুখ ধুয়েই ঝটপট রেডি হলো।নবনীতা সেই ফাঁকে চিত্রাকে একটা নীল রঙের ফ্রক পরিয়ে দিলো।তারপর নিজেও একটা কুর্তি গায়ে জড়ালো।একেবারে গাঢ় লাল রঙের কুর্তি।রিমি তার জন্মদিনে এটা গিফট করেছিল।দেখেই বোঝা যায় খুব দামি হবে।শুভ্রা তাকে দেখতেই মুখ হা করে বলল,’তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে আপাই।একদম লাল পরী।’
জবাবে নবনীতা কেবল ম্লান হাসে।গাঢ় লাল ওড়না টা শালের মতো করে গায়ে জড়িয়ে কালো রঙের পার্স ব্যাগটা হাতে নিয়েই এক হাতে চিত্রার হাত ধরে তাড়া দিলো,’চল চল।পরে আবার দেরি হয়ে যাবে।’

বাড়ি থেকে বেরিয়েই তিন বোন সিএনজি ঠিক করে মিরপুর-০১ এ গেল।শুভ্রানী তার বৃত্তির টাকার একটি অংশ জমিয়ে রেখেছিল আজকের জন্য।ঢাকা শহরে অনেক সুন্দর সুন্দর রুফটপ রেস্টুরেন্ট আছে।শুভ্রার ভীষণ ইচ্ছে হয় এমন খোলা আকাশের নিচে আর সুউচ্চ ভবনের ছাদে অবস্থিত সুসজ্জিত রেস্টুরেন্ট গুলোতে গিয়ে গিয়ে খেতে।বৃত্তির টাকা দিয়ে সে এমনই একটা রুফটপে খেতে চেয়েছিল।নবনীতা তার বরাদ্দকৃত ১৫০০ টাকার সাথে নিজের ১০০০ টাকা মিলিয়ে মোট ২৫০০ টাকা আলাদা রেখেছিল।সাথে আবার আরো হাজার তিনেক নিজের সাথে রেখেছে।যদি হুট করে কিছু কিনতে মন চায়?

সোনি স্কয়ারের সামনে এসেই সে রিমিকে কল দেয়।সোনি স্কয়ারের উপরে নাকি খুব সুন্দর একটা রুফটপ রেস্টুরেন্ট আছে।রিমিই তাকে এটার খোঁজ দিয়েছে।সেজন্যই সে মালিবাগ থেকে চারশো টাকা গচ্চা দিয়ে এতো দূর এসেছে।রিমি কল ধরেই হড়বড় করে বলল,ভাই দাঁড়া দাঁড়া।রাগ করিস না প্লিজ।একটু লেইট হয়ে গেছি আমি।’

নবনীতা কপাল কুঁচকে বলল,’কোথায় তুই?’

রিমি কাচুমাচু মুখে জবাব দেয়,’টিনশেড কলোনি।’

‘কি?এতো দূর?এখনো চৌদ্দ তে তুই?’ আশ্চর্য হলো নবনীতা।

রিমি ফোন কানে ধরেই বলল,’তুই এক কাজ কর না।লিফট দিয়ে একদম টপ ফ্লোরে চলে যা।উপরে অনেক বাতাস।হাঁটাহাঁটি কর।ভালো লাগবে।’

বলেই সে ফোন কেটে দিলো।নবনীতা বিরক্ত হয়ে এদিক সেদিক তাকায়।শেষে মাথা তুলে একবার উপরে দেখে তারপর শুভ্রা আর চিত্রাকে উদ্দেশ্য করে বলে,’চল তো দেখি।উপরে গিয়ে দেখি কি অবস্থা।’

রিমি ঠিকই বলেছিল।জায়গাটা আসলেই অনেক সুন্দর।নবনীতা তার দুই বোনকে নিয়ে উপরে উঠেই বড় বড় চোখে চারদিক দেখল।ছোটবেলায় বাবা মায়ের সাথে ঘুরতে গেলে যেই পাঁচ তারকা হোটেল গুলোতে তারা উঠত,এই রেস্টুরেন্টের ইন্টেরিয়র ঠিক ঐ হোটলগুলোর মতো।চিত্রা গোল গোল চোখে সেসব দেখে।তারা এখন দশম তালায় আছে।যারা খোলা মেলা জায়গা পছন্দ করে না,তাদের জন্য ভেতরে বসার ব্যবস্থা আছে।নবনীতা ছাদে যাওয়ার আগেই চিত্রা আর শুভ্রার কয়েকটা ছবি তুলে।তারপর কাঁচের থাই গ্লাস ঠেলে ভেতরে এক পা দিতেই কোথা থেকে একজন গার্ড ছুটে এসে বলল,’দুঃখিত ম্যাম।আজকে আমাদের রুফটপে সাধারণ মানুষের প্রবেশ নিষেধ।রুফটপ আগে থেকেই বুকড।’

‘বুকড মানে?এতো বড় জায়গা আগে থেকেই বুকড?এই যে সামনের পুরোটাই তো খালি।বুকড কোথায়?’

‘সিকিউরিটি পারপাসে বুক করা হয়েছে ম্যাডাম।আরহাম স্যারের ফ্যামিলি আজ এখানে এসেছেন।রাত পর্যন্ত এদিকে বাকি মানুষের আসা নিষেধ।’

নবনীতা চোখ গরম করে বলল,’এসব কেমন কথা?সে আসলে আমরা আসতে পারব না কেন?সে টাকা দিয়ে খেলে আমরাও তো টাকা দিয়েই খাবো।তার ফ্যামিলি আসলে আমাদের কি?’

গার্ডের পোশাক পরে থাকা লোকটা বিরক্ত হয়।মুখ খিঁচে বলে,’এতো কিছু জানি না তো আপা।আমাকে যা করতে বলা হয়েছে আমি তাই করছি।’

নবনীতা ঝাঁঝালো চোখে একবার তাকে দেখে।এরই মাঝে চিত্রা সামনে কাউকে দেখতে পেয়েই নবনীতার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে সামনের দিকে ছুটতে শুরু করল।নবনীতা হকচকিয়ে ওঠে বলল,’আরে চিত্র কি করছ?কোথায় যাচ্ছ?’

গার্ডের দায়িত্বে থাকা লোকটাও ভীষণ আশ্চর্য হলো।তিনি সেদিকে হাত তুলে হড়বড় করে বললেন,’এ্যাই বাবু কোথায় যাও।দাঁড়াও দাঁড়াও।’

‘আরাম ভাই! আরাম ভাই!’
স্বল্প পরিচিত বাচ্চার গলায় নিজের অদ্ভুত নাম শুনেই পেছন ঘুরে আরহাম।দেখে নীল ফ্রক পরা সেই ছোট্ট মেয়েটা এলোমেলো পায়ে তার দিকে ছুটে আসছে।তার দৌঁড়ানো দেখে আপনাআপনি মুখে হাসি ফোটে আরহামের।সে কাছে আসতেই একহাতে তাকে টেনে তুলে নিজের কোলে।আগের বারের মতোই সতর্ক করে বলে,’আমার কিন্তু এক হাত অচল।শক্ত করে ধরে রাখো,নয়তো পড়ে যাবে।’

চিত্রা শক্ত করে তার গলা জড়িয়ে ধরে।দু’জনের চোখাচোখি হতেই চিত্রা মিষ্টি করে হাসল।আরহাম কপাল কুঁচকে বলল,’এখানে কি করে এসেছ বাবু?’

‘আপাই নিয়ে এসেছে।’

‘আপাই?’ কিছুটা অবাক হয় আরহাম।তারপরই তাকে কোলে নিয়ে হেঁটে যায় সামনের দিকে।নবনীতা তাদের দু’জনকে দেখেই চোখ সরু করে বলল,’তুমি একে চেনো চিত্র?’

‘চিনবে না কেন?শাহরিয়ার আরহামকে এই শহরের সবাই চেনে।’ চিত্রার হয়ে উত্তরটা আরহামই দিলো।নবনীতা থমথমে মুখে অন্যদিকে চোখ সরায়।আরহাম তার পাশে দাঁড়ানো গার্ড কে বলল,’এদের আসতে দাও।সমস্যা নেই।আর কাউকে আসতে দিও না।’

‘জ্বী স্যার।’

নবনীতা এক টানে চিত্রাকে আরহামের কাছ থেকে নিজের কাছে নিল।চাপা স্বরে বলল,’চলো আমরা সামনে যাই।’

সে দুই কদম সামনে যেতেই আরহাম তাচ্ছিল্য করে বলল,’হাউ আনগ্রেটফুল! একটা ধন্যবাদ পর্যন্ত দেয়নি।’

নবনীতা শুনল।কিন্তু প্রতিউত্তর করল না।সে কথা বাড়াতে চায় না।এদের হাতে ক্ষমতা আছে।এরা চাইলে সবই করতে পারে।কখনো রাস্তা বন্ধ করে সমাবেশ করবে,কখনো আবার পাবলিক রেস্টুরেন্টে পাবলিকেরই প্রবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করবে।নবনীতা আর কি বলবে?দেশটাই এমন।জোর যার মুলুক তার।

***

রিমি রিকশা থেকে নেমেই তাড়াহুড়ায় সামনে এগিয়ে গেল।ভাড়ার টাকা দেওয়ার পর যেই ভাঙতি টাকা তাকে ফেরত দেওয়া হয়েছে,সেটা ব্যাগে ঢুকাতে ঢুকাকেই সে ছুটল সোনি স্কয়ারের ভেতরের দিকে।

আচমকা কারো সাথে প্রচন্ড বেগে ধাক্কা খেতেই সে হুড়মুড় করে ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।সে একা পড়েনি,যার সাথে ধাক্কা খেয়েছে,সে সহ ধাম করে মাটিতে পড়েছে।রিমি ফ্লোরে বসেই আঁতকে উঠে পাশ ফিরে।

ওয়াজিদ ফোনে কথা বলছিল।আরহাম একটু আগে ফোন করে তাকে এখানে আসতে বলেছে।গ্র্যান্ড ফ্লোরে পা দিয়ে সে কেবল এক কদম সামনে গিয়েছিল।হুট করে পেছন থেকে কেউ ছুটে এসে তার শরীরের উপর আছড়ে পড়ল।এমন হঠাৎ সং’ঘর্ষের জন্য সে প্রস্তুত ছিলো না।তাল হারিয়ে মেঝেতে পড়তেই সে তাজ্জব বনে গেল।এটা কি হলো?

রিমির মতো সেও পাশ ফিরে অবাক হয়ে তাকে দেখল।রিমি তাকে দেখতেই মুখটা দুখী দুখী করে বলল,’সরি ভাইয়া খেয়াল করিনি।’

ওয়াজিদ নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়।ঠান্ডা গলায় বলে,’ইটস ওকে।’

তারপরই রিমির দিকে একহাত বাড়িয়ে দেয়।রিমি দ্রুত সেই হাতটা চেপে ধরে উঠার চেষ্টা করে।তখনই বাধে আরেক বিপত্তি।ফকফকে ফ্লোরে তার জুতোটা পিছলে গিয়ে সে পুনরায় ধাম করে ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।তার টানে ওয়াজিদ নিজেও হাঁটু মুড়ে মেঝেতে বসল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’তুমি কি হাঁটতে পারো না?’

রিমি দ্রুত উপরনিচ মাথা নাড়ে।কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,’জ্বী ভাইয়া পারি।কিন্তু আজকে তাড়াহুড়োয় মিস্টেক হয়ে যাচ্ছে।নেভার মাইন্ড।’
সে দ্রুত উঠে দাঁড়ালো।উঠে দাঁড়াতেই টের পেল তার ওড়নার একটা অংশ ওয়াজিদের শার্টের বোতামের সাথে আটকে আছে।

ওয়াজিদ গোল গোল চোখ করে সামনে দেখে।হাত বাড়িয়ে ওড়না টা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে।কিন্তু তার আগেই রিমি তাকে বাধা দিয়ে বলল,’না না আপনার কিছু করতে হবে না।আমি সব ঠিক করছি।’

বলেই সে তার ওড়নার এক মাথা চেপে ধরল।তারপর গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে একটা হ্যাচকা টান দিলো সেটা।শুধু ওড়না না,তার শক্তিশালী টান খেয়ে শার্টের বোতামটা টা সহ ছিঁ’ড়ে শার্ট থেকে খুলে এলো।ছিটকে গিয়ে পড়ল দূরে কোথাও।

এক চিৎকার দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরল রিমি।তার দুই চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম।বোতামটা শার্টের পেটের দিকে ছিল।সেটা ছিঁ’ড়ে আসাতে শার্টের ফাঁক দিয়ে ওয়াজিদের পেট দেখা যাচ্ছিল সামান্য।

ওয়াজিদ অবিশ্বাস্য চোখে সামনে তাকায়।একটা মানুষ এতো নিষ্কর্মা কেমন করে হতে পারে?এতো গুলো ভুল কেউ একসাথে কেমন করে করতে পারে?
সে একপ্রকার চমকে উঠে বলল,’তোমার কি মাথায় সমস্যা?এতো জোরে কেউ টান দেয়?জানো না শার্টের বোতাম গুলো কতো নড়বড়ে?’

রিমি দ্রুত মাথা নাড়ে।কাচুমাচু মুখে বলে,’জ্বী ভাইয়া সবই জানি।’

‘সব জানলে এতো জোরে চেনেছো কেন?’ বিক্ষিপ্ত মেজাজে প্রশ্ন করে ওয়াজিদ।

রিমি অসহায় মুখ করে একবার তার দিকে তাকায়।বাচ্চাদের মতো করে ঠোঁট উল্টে বলে,’সরি ভাইয়া।সিস্টেক হয়ে গেছে।নেভার মাইন্ড।’

ওয়াজিদ আর এক মুহূর্তও সেখানে দাঁড়ালো না।একটু পর দেখা যাবে তার গায়ের শার্টটাও আর নাই।এই মেয়ে কোনো না কোনো ভাবে সেটাও গা থেকে টেনে খুলে নিয়েছে।সে দ্রুত সামনে হাঁটা ধরল।রিমি নিজেও তার পিছু পিছু হাঁটা ধরল।হাঁটতে হাঁটতেই তার পা গিয়ে পড়ল ওয়াজিদের পলিশ করে রাখা সু জুতার পেছনটায়।সঙ্গে সঙ্গেই তার পা বেরিয়ে এলো জুতা থেকে।

রিমির মনে হচ্ছে তার মাথায় গোটা আকাশটাই ভেঙে পড়েছে।কি হচ্ছে এগুলো?সবকিছু এমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে কেন?

ওয়াজিদ বিস্ফারিত চোখে কয়েক পল তাকে দেখে যায়।পরক্ষণেই এক আঙুল তুলে মৃদু ধ’মকে উঠে বলে,’তুমি আমার পিছু পিছু আসবে না বলে দিলাম।’

বলেই সে জুতাটা পুনরায় পায়ে দিয়ে এক প্রকার ছুটে গিয়ে লিফটে ওঠল।রিমি দৌঁড়ে সেখানে গিয়ে বলল,’ভাইয়া আমিও তো উপরে যাবে।প্লিজ ভাইয়া আর ভুল হবে না।আমাকেও সাথে নিন।’

ওয়াজিদ আশপাশ দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।বিনা বাক্য ব্যয়ে লিফট থেকে বেরিয়ে এসে বলে,’ঠিক আছে তুমি যাও।আমি পরে যাব।’

রিমি হাসি হাসি মুখ করে লিফটে উঠল।ওয়াজিদ কেবল মাথা নামিয়ে নিজের শার্টের বোতাম বিহীন অংশটুকু দেখে।দেখতেই দুই হাতে টেনে টেনে সে জায়গাটা ঠিক করে।

নাহ,এতোটাও বাজে দেখাচ্ছে না।খুব বেশি বোঝা যায় না।ক্লান্ত হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।অন্যমনস্ক হয়ে বলে,’নির্ঘাত পাবনা থেকে ছাড়া পেয়ে এসেছে।শী কা’ন্ট বি নরমাল।নাহ,সে স্বাভাবিক মানুষ হতেই পারে না।’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে