কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৬

0
5

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৬)

‘নবনীতা’

পিছুডাকে থমকে যায় রমণীর পদযুগল।পেছন ফিরে আওয়াজের উৎস খুঁজতে ব্যস্ত হয় সে।দেখে তার থেকে অনেকটা দূরে একজন যুবক দাঁড়িয়ে আছে।তার মাথায় হেলমেট।মুখ দেখা না গেলেও তাকে চিনতে একটুও অসুবিধে হয়নি রমণীর।মুখ দেখা না গেলেও পরণের টি-শার্ট আর ট্রাউজার বলে দিচ্ছে সামনে দাঁড়ানো লোকটি কে।

নবনীতা তখন হাসপাতালের সামনের খোলা পার্কিং এরিয়া অতিক্রম করছিল।হঠাৎ ডাকে তার যাত্রায় ভাটা পড়ল।আরহাম এগিয়ে এলো তার দিকে।দু’জন দাঁড়ালো ঠিক মুখোমুখি।নবনীতার কোনো বিকার নাই।শুরুতে যদিও কপালে ভাঁজ পড়েছিল,তবে সেটা সময়ের সাথে মিলিয়ে গিয়েছে।তাকে খুবই নিরুদ্বেগ দেখাচ্ছে।

আরহামের দিক থেকে বিষয়টা সম্পূর্ণ ভিন্ন।তার মন খচখচ করছে,প্রচন্ড রকম অপ্রস্তুত বোধ করছে সে।শেষটায় নিজের সব জড়তা একপাশে সরিয়ে সে বলল,’নবনীতা তোমায় ধন্যবাদ।’

‘কেন?’ কিছুটা অবাক হয়ে শুধায় সে।

আরহাম অন্যদিকে ফিরে নির্বিকার হয়ে বলল,’সেদিন এতো গো’লাগু’লির মাঝেও নিজের লাইফ রিক্স নিয়ে আমাকে হেল্প করার জন্য।’

উত্তরে সে আশা করেছিল সামনের মেয়েটির অমায়িক হাসি,মিষ্টি কন্ঠ।যেটা একটু আগেই আদি আর তাসনুভার সামনে প্রকাশ পেয়েছিল।সে ভেবেছিল নবনীতা হাসবে,একেবারে স্বচ্ছ হাসি।কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।নবনীতা গম্ভীর মুখে নিচু স্বরে বলল,’ধন্যবাদের কিছু নেই।আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আমি এটাই করতাম।এমন কিছু বিশেষ করিনি আমি।’

নবনীতা কথা বলেই মাথা নামিয়ে নেয়।আবারও কি বেশি কাটখোট্টা উত্তর দিয়ে দিয়েছে সে?কিন্তু সে তো ভুল কিছু বলে নি।আরহামের জায়গায় অন্য কেউ ভুক্তভোগী হলেও তো সে ছুটে যেত।

আরহাম উত্তর পেতেই কিছুক্ষণ সটান দাঁড়িয়ে রইল।না কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো,না কিছু বলল।সে জানে না কেন,কিন্তু কথাটা তার ভীষণ বুকে বি’ধেঁছে।অন্য কেউ থাকলেও এটাই করত মানে?সে কি পৃথিবীর সবাইকে বাঁচানোর ঠেকা নিয়েছে?সবাই আর আরহাম কি এক?এই ‘সবাই’ শব্দটা ব্যবহার করে সে স্রেফ আরহামকে একটা নিচু কাতারে নামিয়ে এনেছে।এর বেশি কিছুই না।

নিজের ভেতরের ক্রো’ধ কিংবা চাপা রা’গ,দু’টোই আরহাম হজম করে নিল।ট্রাউজারের পকেট হাতড়ে যতগুলো টাকার নোট হাতে পেল,সবগুলোই বের করে আনল।তারপর সাবলীল কায়দায় হাতটা বাড়িয়ে দিলো নবনীতার দিকে।

নবনীতা নত চোখেই তার হাত দেখে।হাতে থাকা নোটগুলো চোখে পড়তেই সঙ্গে সঙ্গে চোখ তুলে।আশ্চর্য হয়ে বলে,’এসব কি?’

‘চোখে দেখো না?এসব টাকা।নোট।মানি।’

‘আমি জানি।আমাকে কেন দিচ্ছেন?’

আরহাম গোমড়া মুখে জবাব দেয়,’তুমি আমাকে সাহায্য করেছ।আমি ঋণী তোমার কাছে।ঋণ শোধ করছি।আমি কারো কাছে ঋণী থাকতে চাই না।’

নবনীতা শীতল চোখে একবার তাকে দেখে।সেই শীতল চোখ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে র’ক্তিম হয়।লোকটা তাকে টাকা দিয়ে মূল্যায়ন করছে?প্রখর আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নারীর কাছে এই নোট এগিয়ে দেওয়ার বিষয়টি অপমান জনক ঠেকায়।কিছু টাকাতেই কি সবকিছুর শোধ বোধ হয়?অতিশয় শীতল কন্ঠে সে প্রশ্ন করে,’আপনার সত্যিই মনে হয় সেদিন আমি যা করেছি,সেটা আপনি কোনো অর্থের বিনিময়ে শোধ করতে পারবেন?’

‘পারব না?’

‘না পারবেন না।মূল্যবোধের মূল্যায়ন টাকা দিয়ে হয় না।আমাকে অন্তত এসব টাকা কড়ি দিবেন না দয়া করে।’ কটমট চোখ করে উত্তর দেয় নবনীতা।

সেই চাহনি আরহামের একদমই অপছন্দ।মেয়েরা কেন এভাবে তাকাবে?এগুলো সবই পড়াশোনার ফল।মেয়েরা একটু শিক্ষিত হলেই ধরা কে সরা জ্ঞান করে।অহংকার আর দ’ম্ভে এদের মাটিতে পা পড়ে না।সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলে,’তোমাকে না,তোমার জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে থাকলেও আমি এটাই করতাম।’

‘আমি অন্য কোনো মেয়ে নই।আমি নবনীতা।আমার স্বতন্ত্র পরিচয় আছে।নবনীতা অন্য মেয়ে না।টাকার ফুটানি অন্য কোথাও দেখান গিয়ে।’

কাঠকাঠ গলায় জবাব দিয়েই নবনীতা চিত্রার হাত ধরে ব্যস্ত কদম চালিয়ে মিনিটের মাঝেই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল।আরহামের থেকে কোনো জবাব সে চায় না।তার কথাটুকু সে বলে দিয়েছে।এখন আর দাঁড়িয়ে থাকার প্রশ্নই আসে না।

আরহাম তার প্রস্থান দেখতে দেখতেই দুই হাত মুঠ করে দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’সেটাই তো।তুমি অন্য মেয়ে হবে কেমন করে?তুমি নবনীতা।ঘাড়’ত্যাড়া নবনীতা।তুমি তো এক পিসই।মার’কাটারি মেয়ে মানুষ!’
.
.
.
.
বাড়ির দুয়ারে পা রাখতেই বসার ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে কিছুটা বিরক্ত হলো নবনীতা।আপনাআপনি ললাট কুঞ্চিত হয় তার।পায়ের জুতা জোড়া যথাস্থানে রেখে ভেতরে পা বাড়ায় সে।বসার ঘরের মাঝামাঝি সোফায় দুই পা এক করে মাথা নামিয়ে বসে থাকা ছেলেটিকে দেখা মাত্র সে বিরক্তি দ্বিগুন হয়।সমস্যা কি এর?আবার কেন এসেছে?
তার সাথে চোখাচোখি হতেই সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।পুরুষালি কন্ঠে আওড়ায়,’নবনীতা! তুমি এসেছ?আমি তোমারই অপেক্ষা করছিলাম।’

ইফাজের দিকে একনজর দেখেই নবনীতা ক্ষীণ স্বরে বলে উঠে,’কেন?আমার অপেক্ষা কেনো করছিলে?’

‘কারণটা তুমি জানো।’

‘আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না ইফাজ।তুমি কি বাংলা বোঝ না?’ চোখে মুখে চরম বিরক্তি এনে উত্তর দেয় নবনীতা।

ইফাজ কিছুটা এগিয়ে আসে।ব্যাকুল কন্ঠে শুধায়,’কিন্তু কেন নবনীতা?আমি কি এতোটাই অযোগ্য?’

নবনীতা তার কথা শুনল।সে থামতেই বড় করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেঝেতে দৃষ্টি নামিয়ে বলল,’তুমি অযোগ্য নও।যোগ্যতার কথা আসছে কেন?বললামই তো চিত্র আর শুভির একটা ব্যবস্থা না করে আমি বিয়ে করতে পারব না।’

‘হ্যাঁ,তাতে সমস্যা কোথায়?তুমি তো বিয়ের পরেও তাদের ব্যবস্থা করতে পারো তাই না?আমি তো তোমার চাকরি করা নিয়ে কোনো বাধা দিবো না।’

নবনীতা চোখ তুলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।সামনের ঘর থেকে হলদে-সোনালি আলোর আভা এই ঘরেও আসছে।সে সেদিকে দেখে অন্যমনস্ক হয়ে বলল,’আগে তো একটা পাকাপোক্ত চাকরি পেতে হবে?আমি এখনো তেমন চাকরি পাইনি ইফাজ।আর তাছাড়া বিয়ের পর আমি মন খুলে তাদের জন্য কিছু করতেও পারব না।এসব সংসারের জঞ্জালে আমাকে জড়িয়ো না,প্লিজ।’

ইফাজ আশাহত হয়ে সামনে তাকায়।এই মেয়েটার কি কোনোদিনই মন গলবে না?এমন কেন সে?সে ভগ্ন কন্ঠে আস্তে আস্তে বলল,’নবনীতা! শুভ্রানী আর চিত্রার জন্য তো তোমার জীবন কিংবা বিয়ে থেমে থাকবে না।তাই না?’

‘আমার বিয়ে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না ইফাজ।তুমি নিজের বিয়ে নিয়ে ভাবো।’ কাঠকাঠ স্বরে উত্তর আসে অন্যদিক থেকে।

ইফাজ আশাহত ভঙ্গিতে দু’টো তপ্ত শ্বাস ছাড়ে।নবনীতা আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে তার ঘরের দিকে পা বাড়ায়।রোজ রোজ বাড়িতে আসলেই একটা না একটা কাহিনী ঘটতেই থাকে।মামি কে বলা স্বত্তেও কি কারণে তিনি বার বার ইফাজকে এখনো সোজাসুজি কিছু বলছেন না নবনীতার জানা নেই।বারবার বারণ করা স্বত্তেও বিয়ের প্রসঙ্গ কেন উঠছে?

সে নিজের ঘরে গিয়েই চিত্রার হাতে তার মোবাইল ফোন দেখে আরো এক দফা বিরক্ত হয়।মুখ দিয়ে চ’কারান্ত শব্দ করে বলে,’এসব হচ্ছে টা কি চিত্র?সারাদিন কেবল ফোন নিয়ে পড়ে থাকো?দেখি এদিকে আসো।হাসপাতাল থেকে এসেছ না?চটপট গোসল করে ফেলতে হবে।আসো আসো।আপাইয়ের কাছে আসো।’

চিত্রাকে গোসল করিয়ে নবনীতা নিজেও লম্বা সময় ধরে গোসল করল।হাসপাতালে গেলেই স্ট্র্যাচারের ক্যাচ ক্যাচ শব্দে তার মাথা ধরে যায়।জং ধরা লোহার ঝরনা থেকে বৃষ্টির ফোটার মতো পানি নেমে এসে মেঝেতে ঝম ঝম শব্দ করে।নবনীতা ঝরনা ছেড়ে দাঁড়িয়ে থাকে দীর্ঘসময়।আজ তার বাবাকে মনে পড়ছে ভীষণ।বাবা নামের বটবৃক্ষ যখন ছায়া দেওয়ার জন্য আর মাথার উপর থাকে না,তখন গোটা পৃথিবীটাই মরুভূমির মতো শূন্য লাগে।নবনীতা বাবাকে দেখে না আজ কতো গুলো দিন।বাবা থাকলে নবনীতার এমন ছাপোষা পশু পাখির মতো জীবনে মানিয়ে নিতে হতো না।বাবা থাকলে এই কাঠফাটা রোদের ভেতর তাকে চাকরির খোঁজে ছুটোছুটি করতে হতো না।বাবা থাকলে আজ তাদের একটা সুন্দর জীবন হতো।চিত্র তখন আর রাস্তাঘাটের যেকোনো মানুষের মাঝে বাবাকে খুঁজত না।তার তখন সত্যিই একটা বাবা থাকতো।

নবনীতা আচমকা ফুঁপিয়ে উঠলো শব্দ করে।আওয়াজ যাতে বাইরে না যায় তাই সে মুখটা শক্ত করে চেপে ধরল।মুখ চেপেই হাউমাউ করে বলল,’বাবা,আমি তোমার সাহসী মেয়ে হওয়ার লড়াইয়ে হাঁপিয়ে উঠেছি বাবা।তুমি জানো না বাবা,তুমি ছাড়া পৃথিবীটা কতো কষ্টের! তুমি জানো না ছেলে মানুষদের চোখ কতো নোংরা,মন কতো সংকীর্ণ! আমি না হয় সাহসী হলাম,সংগ্রামী হলাম।কিন্তু ঐ নোংরা চোখ গুলো থেকে কীভাবে বাঁচবো বাবা?আমি নিজের অস্তিত্ব কেমন করে ভুলে যাবো বাবা।চিত্র আর শুভির মাথা রাখার একটা জায়গা আছে।দুঃখ ঝাড়ার জন্য একজন মানুষ আছে।তাদের একটা পরী আপাই আছে।আমার কেউ নেই বাবা।কেমন করে আমি শুভি কে বলি ‘আপাই কিছুদিন বিশ্রাম নিব,তোরা নিজেদের কাজ নিজেরা করে নে।’ কেমন করে আমি চিত্র কে বোঝাই আমাদের বাবা মা কোনোটাই নেই চিত্র?যাকে তাকে সে নামে ডাকবে না।কেমন করে বোঝাই আপাই সত্যি সত্যি ফুরিয়ে যাচ্ছি অল্প অল্প করে?একটু স্বস্তি চাই,আর কিছু না।’

স্বস্তির কথা উঠতেই সঙ্গে সঙ্গে মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে।একটা মমতাময়ী মুখ।নবনীতা যথাসাধ্য চেষ্টা করে সেই মুখটা ভুলে থাকতে।মনে পড়লেই কান্না আসে।নবনীতা হলফ করে বলতে পারে মা থাকলে আজ এই করুণ অবস্থাতেও নবনীতা ভীষণ খুশি থাকতো।সারাদিনের ভোগান্তি শেষে সে এক ছুটে মায়ের নরম কোলটায় মাথা রেখে সব দুঃখ ঝেড়ে দিত।যতো অভিযোগ আছে সব মায়ের কাছে খুলে বলত।মা তখন তার মাথায় হাত বুলিয়ে তার মন ভালো করে দিত।তখন কি জীবন এতো দুর্বি’ষহ ঠেকাতো তার কাছে?

গোসল শেষে চুপচাপ বেরিয়ে আসে সে।চোখ দু’টো তার তখনও পানিতে টইটম্বুর।চিত্রা আবারো তার ফোন হাতে নিয়ে কার্টুনের ভিডিও দেখা শুরু করেছে।সে এবার আর তাকে কিছু বলল না।পিঠটা দেয়ালে ঠেকিয়ে সে মেঝেতে গিয়ে বসল।বেশি কিছু না,জীবনে একটা মাথায় হাত ছোঁয়ানো মানুষ থাকলেই হতো।নবনীতা হাউমাউ করে কেঁদে তার কাছে সব দুঃখ উজার করে দিত।ইফাজ কি সেই একজন পুরুষ হতে পারবে?সে কি পারবে একটা চূড়ান্ত বিরক্তিকর দিনে নবনীতা বাড়ি ফিরতেই এককাপ চায়ের সাথে তাকে তার বিরক্তিটুকু উগড়ে দেওয়ার সুযোগ করে দিতে?নাহ পারবে না।ইফাজকে সে বহুদিন ধরে চেনে।সে কখনোই পারবে না নবনীতার শুকনো খাঁ খাঁ জীবনে স্বস্তির বর্ষণ এনে দিতে।

_____________________________________________

‘নবনীতা নাম?’ আরিশ তড়িঘড়ি করে জানতে চায়।

আদি জবাব দেয়,’হু।নবনীতা নূর।ভীষণ সুইট।’

‘সে কথা ছাড়ো।দেখতে কেমন?ফর্সা মতোন,হ্যাংলা পাতলা,চুলে সবসময় বেণী করে রাখে,চুল গুলো কোমর সমান।আর গলাটা খুব মিষ্টি,নিউজ চ্যানেলের উপস্থাপিকা দের মতো?’

তাসনুভা আশ্চর্য হয়ে বলল,’অদ্ভুত! তুমি কেমন করে জানো?তুমি তাকে চেনো?’

আরিশ মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে জানায় সে সামনাসামনি দেখেনি তবে সে তাকে চেনে।শুধু সে না,আরহাম সহ তার দলের সবাই তাকে চেনে।

আদি উৎসুক হয়ে জানতে চাইল,’বলো কি?আরহামের সাথে শুভ দৃষ্টি আগেই শেষ নাকি?’

‘দেখা হয়েছে।তবে সেটা শুভ বলে তো মনে হয়নি।’ গোমড়া মুখে জবাব দেয় আরিশ।
তারপরই সে সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে তাসনুভা কে উদ্দেশ্য করে বলে,”আরে তোর মনে নেই নবনীতার কথা?ভাইয়ার সমাবেশে গিয়ে যে ভাইয়াকে ধুয়ে দিয়েছিল?’

তাসনুভা আঁতকে উঠে বলল,’কি?এটা সেই নবনীতা?আমি তো তাকে খুবই কড়া ভেবেছিলাম।কিন্তু সে তো খুবই মিষ্টি।হেসে হেসে কথা বলছিল আমাদের সাথে।’

আরিশ তুড়ি বাজিয়ে জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’মিষ্টিই তো।কেবল আমার গোয়ার ভাইয়ের সাথে তেতো।সে যেই মানুষ! তার সাথে কেই বা ভালো থাকবে?’

তাসনুভা বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে।চিন্তিত হয়ে বলে,’কেস টা তাহলে খুব জটিল।’

আদি মন খারাপ করে বলল,’ধুর আমরা আরো কতোদূর ভেবে নিয়েছিলাম।পরিকল্পনা সব মাঠেই মা’রা গেল।’

আরহাম বাড়িতে এসেই লম্বা একটা ঘুম দিয়েছিল।ঘুম শেষে দোতালার করিডোরে দাঁড়িয়ে লিভিং রুমের জটলা দেখেই কপাল কুঁচকে বলল,’কিরে?তোরা এমন গোল হয়ে কি ফন্দি আঁটছিস?’

আদি মাথা তুলেই ভাব নিয়ে বলল,’আমরা একটা মিশনে নেমেছি।সফল না হওয়া পর্যন্ত ডিসক্লোজ করা যাবে না।’

আরহাম আর ঘাটায় না।সে তাদের মতো বেকার না।তার মাথায় অনেক রকম চিন্তা ঘুরপাক খায় সারাক্ষণ।তার অনেক কাজ জমা আছে।সে দুই দিন প্রচারণায় যেতে পারেনি।সামনের দিনগুলো তার খুব ব্যস্ত যাবে।

সে তাদের আলোচনায় ভ্রক্ষেপ না করে আবার নিজের ঘরে চলে গেল।কয়েকটা জরুরি কল করতে হবে।কালকে সে কোন কোন এলাকায় যাবে সেটার একটা পরিকল্পনা আগে থেকেই করে নিতে হবে।

সব কাজ শেষ করতে করতে রাত দশটা বাজল।নিচ থেকে আফরোজা বেগমের ডাক শোনা যাচ্ছে।তিনি হয়তো খেতে ডাকছেন তাকে।সে গলা উঁচু করে বলে,’কাউকে দিয়ে আমার ঘরে পাঠিয়ে দিন ফুফু।আমি নিচে নামতে পারব না।’

রাজনীতি বাদেও শেখ আজিজ হোসেনের নিজস্ব কিছু ব্যবসা ছিল।রাজনীতিতে তার পদচারণা হয়েছে অনেক পরে।তিনি এর আগে বহুদিন ব্যবসা করেছেন।তার কয়েকটা ফার্ম হাউজ আছে।রাঙামাটি আর কক্সবাজারে তার রিসোর্ট আছে।এছাড়া একটা রেস্টুরেন্ট আর বেশ কিছু গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি তিনি নিজের জীবদ্দশায় প্রতিষ্ঠা করে গেছেন।তার মৃ*ত্যুর পর সবটাই আরহাম সামলায়।যদিও জালালুর রহমান তাকে ব্যবসায়িক কাজে সাহায্য করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছিলেন,কিন্তু আরহাম নিজ থেকেই সবটা সামলে নিয়েছে।বয়স কম দেখে জালাল সাহেব সন্দিহান ছিল তাকে নিয়ে।তবে আরহাম বয়সের অপরিপক্কতার অযুহাতে ব্যবসা সামলাতে কোনোরকম গড়িমসি করেনি।জালাল সাহেব এমনিতেই রাজনৈতিক ব্যাপারে তাকে অনেক সাহায্য করেছেন।আবার এই ব্যবসার বিষয়টা উনার উপর চাপিয়ে দিয়ে উনার চাপ বাড়াতে চায়নি আরহাম।

আরহাম আলমারির ড্রয়ার থেকে কিছু ব্যবসায়িক কাগজপত্র বের করে কাউচের সামনের টি-টেবিলের উপর সেসব ছড়িয়ে রাখল।বাইরে থেকে নাতিশীতোষ্ণ ঠান্ডা বাতাস পর্দা ভেদ করে ঘরে আসছে।আরহাম রিমোট দিয়ে এসি বন্ধ করে সেই হাওয়া গায়ে মাখে।এখন তো বর্ষার মৌসুম।বৃষ্টি হবে নাকি?

আরহাম কাউচ থেকে উঠে অলস ভঙ্গিতে হেঁটে ব্লুটুথ স্পিকার দিয়ে লো ভলিউম গান ছাড়ে।দেশি বিদেশি নানা ব্যান্ডের গান তার প্লে লিস্টে আছে।মিউজিক অন হতেই সে চুপচাপ হেঁটে কাগজ গুলো হাতে নিয়ে বসল।বল পয়েন্ট কলম টা খুলে বিভিন্ন হিসেবে কা’টাছেঁ’ড়া করতে করতে নিজের কাজে মন দিলো।

সময় গড়ায়।দূর আকাশ থেকে ভারিক্কি শব্দে মেঘের গ’র্জন ভেসে আসে।পুরো ঘর জুড়ে এক অদ্ভুত চাঞ্চল্য বিরাজ করে।স্পিকারে লো ভলিউমে একের পর একের গান বাজতে থাকে।বাজতে বাজতেই এক সময় ‘ব্লু জিন্স’ ব্যান্ডের এক গুচ্ছ কদম গানটি সামনে আসে।

আরহাম নিজের কাজে বেশ মনোযোগী ছিল।আচমকা গানের কিছু লাইন কানে যেতেই সে থমকাল।হাতের বল পয়েন্ট কলমটি যেই গতিতে চলছিল,সেই গতিতে ভাটা পড়ল।মন্থর হলো তার আঙুলের চলন।হাতের কলম টা আস্তে করে টেবিলের উপর রেখে সে উঠে দাঁড়াল।স্পিকারটা হাতে নিয়ে মোবাইলের প্লে লিস্ট থেকে পুনরায় সে অংশটুকু বাজালো।ভরাট পুরুষালী কন্ঠে আবারো উচ্চারিত হলো সেই কয়েক লাইন,

“দেখি তোমাকে আছো দাঁড়িয়ে,
আনমনে নীল শাড়িতে।
হাজার ভীড়ে,সব ছাড়িয়ে,
শুধু তুমি আমার চোখে।”

আরহাম সেই অংশটুকুই আবারো রিভার্সে গিয়ে শুনল।একবার দুইবার বার বার।তার চোখের সামনে সেই পুরোনো দৃশ্য গুলো আরো একবার ভেসে উঠে।

অবচেতন মন আবারো কল্পনা করে সেই দৃশ্যটুকু।একটি গু’লিবি’দ্ধ অসাড় দেহ,হুট করেই মৃদু আর্ত’নাদে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে।সেই শব্দেই চমকে উঠে পেছন ফিরেছে একটি মেয়ে।মেয়েটির চোখে বিস্ময়,সাথে আবার কিছুটা উৎকন্ঠা।কি অদ্ভুত! তার পরনেও নীল শাড়ি।চারদিকে লোকজনের ছুটোছুটি।কিন্তু নিস্তেজ হয়ে আসা দেহ টা কেবল নিভু নিভু চোখের পাতায় দেখে যাচ্ছিল সেই মেয়েটিকে।মেয়েটি তারপর কি করল?

আরহাম আলগোছে হাসে।মেয়েটি তারপর ছুটে এলো।ছুটে এসেই হাঁটু গেড়ে বসল আরহামের কাছে।শক্ত করে চেপে ধরল র*ক্তে ভিজে যাওয়া সেই ক্ষ’তস্থান।আবার মাঝখানটায় একবার ধ’মকও দিলো বোধহয়,’মানা করেছি না চোখ বন্ধ করতে?চোখ বন্ধ করছেন কেন?’
আচ্ছা মেয়েটা কি কোনো স্কুলের টিচার?সারাক্ষণ এমন শা’সনের সুরে কথা বলে কেন?আরহাম কি তার অবাধ্য ছাত্র?যাকে দেখতেই সে চোখ গরম করে?
আরহাম জানে না,সত্যিই জানে না।

আচমকা কাছে কোথায় শব্দ করে বজ্রপাত হয়।তব্দা খেয়ে হুশ ফেরে আরহামের।চারদিক দেখে কি হচ্ছে সেটা বোঝার চেষ্টা করে সে।চোরা চোখে দরজার দিকে তাকায়।কেউ দেখেনি তো?পরক্ষণেই আবার মনে হয়,দেখলেই বা কি?এই গান সে শুনতেই পারে।আগেও শুনেছে।এতে এতো চিন্তার কি আছে?

আবেগ অনুভূতি বড়ই ভয়াবহ জিনিস।আরহাম এদের কখনো তার ধাঁর ঘেঁষতে দেয়নি।ব্যাপারটা এমন না যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছে,আসল কথা তার কোনোদিনও সেরকম কোনো অনুভূতি তৈরিই হয়নি।তার কাছে নারী শব্দের অর্থ তাসলিমা ইউসুফ,তার মা।মেয়ে বলতে সে তাকেই চিনে এসেছে।এরপর আর তার কোনোদিন মেয়ে চিনতে ইচ্ছে হয়নি।সারাহ কিংবা আফরোজা ফুফু কাউকে নিয়েই সে মাথা ঘামায় না।তাসনুভা বাদে এই পৃথিবীর কোনো মেয়ে কি মিনিটের জন্য হলেও তার বক্ষপিঞ্জরে স্থান করে নিতে পেরেছিল?পারে নি তো।

আরহাম দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।নিজের গালে নিজেই দু’টো চড় মা’রে।কি হচ্ছে এসব?বিড়বিড় করে সে নিজেই নিজেকে ধ’মকায়,’তোর কি গু’লি খেয়ে মাথার তার ছিঁ’ড়ে গেছে আরহাম?এসব কেন ভাবছিস?সে তোর জন্য কিছু করেনি।বলেই তো দিয়েছে তোর জায়গায় যে কেউ থাকলে সে এটাই করতো।সে খুব মহান।সে জগতের সকলের সেবা করার ব্রত নিয়েছে।তুই কেউ না,কেউ না।’

আরহামের আর সে রাতে কাজ করা হয়নি।এক লাফে খাটে শুয়ে শুভ্র রঙের কম্ফর্টার টা গায়ে চাপিয়ে এসির পাওয়ার ১৭ডিগ্রি তে নামিয়ে দীর্ঘসময় সে সেভাবেই পড়ে রইল।শেষে কতোক্ষণ নিজেই নিজের চুল টানল।শেষমেশ নিজের ভেতরের প্রচন্ড অস্থিরতার কাছে পরা’স্ত হয়ে সে হাত পা ছড়িয়ে কতোক্ষন শান্ত হয়ে শুয়ে থাকল।মেয়েটির জন্য সে কেউ না।তাকে বাঁচানো টা নেহাৎই তার বিবেকের তাড়না ছিল।কিন্তু আরহাম কি করে তাকে সব মেয়েদের কাতারে রাখবে?এই মস্ত বড় পৃথিবীর সাতশো কোটি মানুষের মাঝে সেই ছিল প্রথম মেয়ে যে কি-না ক’রুন সময়ে শাহরিয়ার আরহাম কে আগলে ধরেছিল।চারিদিকের বিশাল হট্টগোলের তোয়াক্কা না করে নবনীতা নূর ছুটে এসেছিল তার দিকে।নি’স্তেজ হয়ে আসা শরীরটা নিজের বিবশ দেহের ভার ছাড়ার জন্য একটা কাঁধ খুঁজে পেয়েছিল সেদিন।সেই কাঁধের মালিক ছিল নবনীতা।সেদিন মেয়েটার চোখে উৎকন্ঠা দেখেছে আরহাম।কই সে বাদে তো আর কোনো মেয়ে কখনো তার জন্য উৎকন্ঠা দেখায়নি।তাসনুভা দেখায়।কিন্তু তাসনুভা তো তার রক্ত।নবনীতা কে?তার চোখে কেন উৎকন্ঠা থাকবে?মেয়েদের কে চিরকাল যেই সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে আসছিল আরহাম,নবনীতা কেন সেই সংজ্ঞার বাইরে গিয়ে আরহাম কে ভুল প্রমান করে দিলো?কেন দিকবিদিক ভুলে ছুটে এসে দেখিয়ে দিয়েছে মেয়েরাও অন্যের বিপদে নিঃস্বার্থ ভাবে ঝাঁ’পিয়ে পড়তে পারে?আরহাম জানে নবনীতা তাকে ‘সব’ শব্দটা দিয়ে গণমানুষের কাতারে নিয়ে আসতে পারলেও সে কোনোদিন তাকে সেভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারবে না।কিছুতেই পারবে না।

মাথার উপর আরো একটা বালিশ চেপে ধরল আরহাম।এমন চলতে থাকলে সে খুব দ্রুতই পাবনা চলে যাবে।সে বড় করে শ্বাস টানে।আর না,আর না।অনেক হয়েছে।চুলোয় যাক নবনীতা।তার কি?তার সামনে নির্বাচন।সেই নির্বাচনে জয়ী হতেই হবে তাকে।

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে