কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৫(খ)

0
12

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৫)[দ্বিতীয় অংশ]

তাসনুভা তার কথা শুনেই এক গাল হাসল।হাসিমুখে বলল,’থ্যাংক ইউ আপু।আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।’

নবনীতা চারদিক দেখে ভ্রুদ্বয় উঁচু করে জানতে চায়,’সাথে কেউ আসেনি?একা কেন তুমি?’

‘এসেছে।কিন্তু আমাকে ফেলে উপরে চলে গেছে।’

‘আহারে! আপু উপরে নিয়ে যাব তোমায়?তুমি বললে নিয়ে যেতে পারি।’

নবনীতার অবশ্য তাকে নিয়ে যেতে হয়নি।তার আগেই আদি তিনতালায় এসে এদিক সেদিক তাসনুভাকে খুঁজে শেষটায় তাকে দেখতে পেয়ে তাদের দিকে এগিয়ে আসে।তাসনুভার সামনে এসেই কপট রাগ দেখিয়ে বলে,’এ্যাই মেয়ে,তোমাকে না এক জায়গায় রেখে এসেছিলাম?তুমি আবার এদিকে চলে এসেছ?তোমাকে নিয়ে যে কি করি আমি!’

‘সে আসে নি।একটা বাচ্চার পায়ের ধাক্কা লেগে ওর হুইলচেয়ার টা নিজ থেকেই চলছিল।আমি আরেকটু দেরি করলে মেয়েটা দেয়ালের সাথে গিয়ে ধা’ক্কা খেত।’

আদি কথা শুনতেই দ্রুত পাশ ফিরে।তাসনুভার চেয়ারের দু’টো হাতল মেয়েটির হাতের মুঠোয় ব’ন্দি।তার সাথে চোখাচোখি হতেই আদি অবাক হয়ে বলল,’বলো কি?এই দু’মিনিটে এতো কিছু ঘটে গেছে?’

তার কথার ধরনেই নবনীতা হেসে ফেললো।মাথা নেড়ে বলল,’জ্বী,এতোকিছু হয়ে গেছে।’

আদি মুচকি হেসে আহ্লাদী স্বরে বলল,’ইউ আর সো কিউট! নাম কি তোমার?’

অন্য কেউ এই কথা বললে সাথে সাথে নবনীতা মুখের উপর ধাম করে একটা উত্তর দিত।কিন্তু সামনে দাঁড়ানো ছেলেটার উদ্দেশ্য খারাপ না।বরং তার কথার মাঝে একটা বাচ্চামো ছিল।নবনীতা খুব ভালো করে মানুষ চেনে।এই ছেলেটা সম্ভবত স্বভাবতই একটু এমন।তবে তার কথায় কোনো অশোভন ইঙ্গিত ছিল না।উল্টো মুখ জুড়ে ছিল স্বচ্ছ হাসি।নবনীতা স্মিত হেসে উত্তর দেয়,’আমার নাম নবনীতা নূর।’

‘নাইস নেইম।জাস্ট লাইক ইউ।তোমার মতোই মিষ্টি তোমার নাম।’ আদি চঞ্চল হয়ে উত্তর দেয়।
তাসনুভা তার হাঁটুতে এতটা কি’ল বসিয়ে বিড়বিড় করে বলল,’তুমি এখানেও শুরু হয়ে গেছ?লজ্জা নেই তোমার?’
***

চিত্রা জন্মগত ভাবেই ছটফটে আর চঞ্চল প্রকৃতির।তাকে বারণ করা স্বত্তেও সে নবনীতা সামনে থেকে সরে যেতেই ছুটোছুটি শুরু করে দিলো।এদিক সেদিক যেতে যেতে চার তালায় যাওয়ার সিঁড়ির সামনে আসতেই সে কারো সাথে ধাক্কা খেল।শক্তপোক্ত শরীরটার সাথে তার কোমল শরীরের সং’ঘর্ষ হতেই সে কয়েক কদম পিছিয়ে গিয়ে ধপ করে ফ্লোরে গিয়ে পড়ল।

সামনে থাকা সুঠাম দেহের লোকটি তৎক্ষনাৎ হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসল।মাথা নিচু করে তার একটা হাত চেপে ধরে উদ্বিগ্ন হয়ে বলল,’আয়হায়! তুমি পড়ে গেলে কেমন করে?’

চিত্রা মাথা তুলল।তার সামনে বসে থাকা লোকটাকে সে প্রথম দেখাতেই চিনে নিল।বাচ্চাদের স্মৃতি শক্তি প্রখর।সে তাকে চিনতেই হাসিমুখে বলল,’আরাম ভাই!’

এহেন অদ্ভুত সম্বোধনে ভড়কে গেল যুবকটি।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল,’কি?কি ভাই?’

চিত্রা কিছুটা দমে গেল।সে কিছু ভুল কিছু বলেছে?সে তো খুব দ্রুত মানুষের মুখ চিনে ফেলে।এবার কি সেটা কাজে লাগেনি?সে কাচুমাচু মুখে আবারো বলে,’আরাম ভাই!’

যুবকটি থমকায়।কয়েক মুহূর্ত ভাবে।তারপরই কিছু একটা অনুধাবন করেই শব্দ করে হেসে ফেলে।হাসতে হাসতেই বলে,’ভালো বলেছো তো।আরাম ভাই।’
তার হাসির জবাবে চিত্রাও হাসল।যুবকটি জানতে চায়,’তুমি আমায় কেমন করে চিনো?’

‘আমি তুমাকে দেখেছি।পরী আপাইয়ের সাথে বেড়াতে গিয়ে।তুমি মাইকে কথা বলো তাই না?’

আবারও একগাল হাসে সে।মাথা নেড়ে জানায়,’ঠিক বলেছ একদম।আমিই মাইকে কথা বলি।’
কথাটা বলেই সে এদিক সেদিক দেখে বলল,’তুমি কার সাথে এখানে এসেছ?’

‘পরী আপাইয়ের সাথে।’

‘কোথায় তোমার পরী আপাই?’

চিত্রা এদিক সেদিক দেখে মলিন মুখে জবাব দেয়,’খুঁজে পাচ্ছি না।হারিয়ে গেছে।’

একপেশে হেসে উঠে দাঁড়ায় আরহাম।চিত্রার দিকে একহাত বাড়িয়ে বলে,’চলো তো,আমরা মিলে তোমার পরী আপাইকে খুঁজি।’

চিত্রা একনজর তাকে দেখে,আবার দেখে তার হাতের ব্যান্ডেজ।তার ভাবনার মাঝেই তার আরাম ভাই তাকে এক হাতে কোলে তুলে নিল।চোখ দিয়ে নিজের ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতটা দেখিয়ে বলল,’আমার কিন্তু একহাত অচল।অতো শক্ত করে ধরতে পারব না।তুমি একটু শক্ত করে ধরে রাখো তো আমায়।’

চিত্রা শক্ত করে তার গলা জড়িয়ে ধরল।আরহাম সামনে হাঁটতে হাঁটতে প্রশ্ন করল,’নাম কি তোমার?’

চিত্রা বেশ স্পষ্ট করে বলল,’হুমায়রা নূর চিত্রা।’

‘ওয়াও নাইস নেইম।এখন আমাকে বলো তো তোমার পরী আপাই দেখতে কেমন?এই পরীর ডানা কয়টা?’

চিত্রা ফিক করে হেসে দিলো।মুখে হাত চেপে মাথা নেড়ে বলল,’ডানা নেই।’

‘সর্বনাশ! ডানা ছাড়া এ আবার কেমন পরী?’ হাসল আরহাম নিজেও।চোখ সরু করে বলল,’দেখতে কি পরীদের মতো?’

চিত্রা সম্মতিসূচক জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল,’নাহ,সিন্ড্রেলার মতো।’

আরহাম চোখ উল্টায়।অল্প হেসে বলে,’চলো আমরা সিন্ড্রেলা কে খুঁজি তাহলে।’

একটু দূর যেতেই চিত্রা দ্রুত হাত নেড়ে বলল,’ঐ যে,ঐ যে! ঐ দেখো পরী আপাই।’

আরহাম থামল।চিত্রার হাত অনুসরণ করেই সামনে দেখল।সামনের দৃশ্য দেখতেই আপনাআপনি তার সমস্ত মুখে বিস্ময় ছেয়ে গেল।আদি আর তাসনুভা একটি মেয়ের সাথে কথা বলছে।মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তাসনুভার পেছনে।তার মুখে একটা মিষ্টি হাসি লেপ্টে আছে।অবাক হয় আরহাম।এই মেয়ে হাসতেও জানে?কোথায়,তার সাথে তো কোনোদিন এমন হাসি মুখে কথা বলে নাই।অথচ আদি আর তাস’এর সাথে কতো মিষ্টি করে কথা বলছে!

‘নামাও আমাকে।’

চিত্রার আওয়াজ কানে যেতেই হুশ ফেরে তার।বিনা বাক্যে দ্রুত তাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় সে।চিত্রা ছুটে যায় সামনের দিকে।দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে নবনীতাকে।

নবনীতা মাথা নিচু করে তাকে দেখতেই কপট রাগ দেখিয়ে বলে,’তোকে না এক জায়গায় দাঁড়াতে বলেছিলাম?তুই আবার চলে এসেছিস?’
চিত্রা উত্তর না দিয়ে কেবল দাঁত বের করে হাসল।

আদি বলল,’সে কে?’

‘আমার ছোট বোন।চিত্রা।ভালো নাম হুমায়রা নূর।’

‘উমমম নাইস নেইম।সেও কিন্তু খুব কিউট।’

নবনীতা হাসি চেপে বলল,’জ্বী জনাব।আমরা তিনবোনই ভীষণ কিউট।’

‘আরেকজন আছে নাকি?’

নবনীতা মাথা নেড়ে জানাল আছে।আদি লাজুক হেসে বলল,’আমি না দেখেই বলে দিতে পারি সেও খুব কিউট।’

তার বলার ধরনেই নবনীতা ফিক করে হেসে দিলো।আদি ছেলেটার মধ্যে এখনো কৈশোরের একটা ছাপ আছে।একদম নির্ভেজাল মিশুক প্রকৃতির ছেলে।নবনীতা চিত্রার এক হাত ধরে বলল,’ঠিক আছে,তোমরা থাকো।আমি আসি।’

বলেই সে তাসনুভার থুতনিতে হাত রাখে।আদুরে স্বরে বলে,’আমি আসি তাসনুভা।ঠিক আছে?ভালো থেকো তুমি।’

তাসনুভা মুখ ভর্তি হাসি নিয়ে বলল,’তুমিও ভালো থাকবে আপু।’

নবনীতা তার দিক থেকে চোখ সরিয়ে আদির দিকে তাকায়।কিছুটা থমথমে মুখ করে বলে,’মিস্টার আদি! আপনিও ভালো থাকবেন।’

আদি মুচকি হাসে।বলে,’তুমি ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকব।বুঝেছ?’

নবনীতা কিছু বলার আগেই তাসনুভা সামনে দেখে বলল,’ভাইয়া তুমি?’

তার কথা শুনতেই সামনে তাকায় নবনীতা।তাদের থেকে কয়েক হাত দূরত্বে দাঁড়ানো মানুষটিকে দেখতেই কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে যায় সে।লোকটা না গু*লি খেয়েছিল?এতো তাড়াতাড়ি হাঁটাচলা করছে কেমন করে?ইনি তাসনুভার ভাই?

আরহাম ধীর পায়ে এগিয়ে আসে।তার আর নবনীর মাঝে দূরত্ব কেবল দেড় হাতের।সে যারপরনাই শান্ত।মুখ ফুটে কিছুই বলার প্রয়োজন বোধ করে না।নবনীতা ভদ্রতার খাতিরে জানতে চায়,’কেমন আছেন আপনি?’

আরহাম গম্ভীর হয়ে জবাব দিলো,’আছি।আগের চেয়ে ভালো আছি।’

‘তোমরা দু’জন দু’জনকে চেনো?’ প্রায় একইসাথে বলে উঠল তাসনুভা আর আদি।

নবনীতা কিছুটা চাপা স্বরে বলল,’হু।’

আরহাম চোখ তুলে একবার তাকে দেখে।এতোক্ষণ কি সুন্দর মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিল হেসে হেসে! যেই আরহামকে দেখেছে,মুখটা এমন করে রেখেছে যেন আরহাম একটা জ’ন্তু।সে সামনে এলেই তার হাসি বন্ধ হয়ে যায়।আরহাম দারাজ গলায় বলে,’তুমি কেমন আছ?’

‘ভালো।’ ক্ষীণ গলায় উত্তর দেয় সে।

কথা শেষে নবনীতা আর এক মুহূর্তও দেরি করে না।চিত্রার হাত টা শক্ত করে ধরে বড় বড় পা ফেলে সামনে এগিয়ে যায়।মিনিট খানেকের মধ্যেই সে তিনতালার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।নিচে নামতেই তার মনে হলো সে আরেকটু নমনীয় হলেও পারতো।সাথে সাথেই আবার মনে হলো ‘আর কতো নমনীয় হবো?জিজ্ঞেস তো করেছি কেমন আছে?আর কি বলার আছে আমার?’

সে চলে যেতেই আরহাম একহাত ট্রাউজারের পকেটে রেখে হাস্কি স্বরে বলল,’দাঁড়া।আমি একটু আসছি।কাজ আছে একটা।’

আদি মাথা নাড়ে।জানতে চায় ওয়াজিদ কোথায়?আরহাম বলল,’নিচে আছে।রিসেপশনে।কিছু কাগজপত্রের ঝায় ঝামেলা আছে।ঐ গুলো শেষ হতে দে।তারপর আমরা বেরিয়ে যাবো।’

কথা শেষ করেই সে নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে পদযুগল সামনের দিকে এগিয়ে নেয়।সে দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতেই আদি সামান্য ঝুঁকে তাসনুভার কানের কাছে গিয়ে হিশহিশিয়ে বলল,’নবনীতা মেয়েটা খুব কিউট না?’

‘অনেক বেশি।’

‘আমার কিন্তু তাকে পছন্দ হয়েছে।কিন্তু নিজের জন্য না।’ চটপটে স্বরে উত্তর দেয় আদি।

চকিতে ঘাড় ঘুরিয়ে পাশ ফিরে তাসনুভা।আনন্দিত কন্ঠে বলে,’আমি যা ভাবছিলাম,তুমিও তাই ভাবছ?’

তার কথার জবাবে তারই মতো করে উৎসাহী হয়ে মাথা নাড়ে আদি।জানায়,’দু’জন কে একসাথে দেখার পরেই এই অদ্ভুত ভাবনা জেগেছে মনে।’

তনসনুভা কিছুক্ষণ কল্পনা করে খুশিতে গদো গদো হয়ে বলল,’হেব্বি মানাবে না দু’জনকে একসাথে?’

‘একদম।খাপে খাপ,আমেনার বাপ।’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে