#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(১৫)[প্রথম অংশ]
পুরোটা রাস্তা নবনীতা পাড়ি দিয়েছে রাশেদুল হক কে গা’লি দিতে দিতে।তার র’ক্ত টগবগ করে ফুট’ছিল।মানুষ এতো নোংরা হয় কেমন করে?প্রকাশ্যে এই কথা গুলো বলতে তার লজ্জা হয়নি একটুও?
বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে সে যখন ঘরে এলো তখন সাদেকের সাহেবের ঘরের চি’ৎকার চেঁচামেচি তে তার মেজাজ আরো বেশি বিগড়ে গেল।প্রথার উচ্চবাচ্য ঘরের দুয়ার থেকে তার কানে আসছে।সে বড় বড় পা ফেলে সোজা সেদিকে গেল।ঘরে ঢুকেই কাঠকাঠ স্বরে বলল,’কি সমস্যা প্রথা?এমন ষাঁড়ের মতো চেঁ’চাচ্ছ কেন?’
প্রথা পেছন ফিরল।নবনীতার উপস্থিতি টের পেতেই তি’রিক্ষি মেজাজে বলল,’তুমি আবার এসেছ?তোমাকে বলেছি না আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবে না?’
নবনীতা দুই কদম এগিয়ে এসে দু’হাত বুকে বেঁধে দাঁড়ায়।নির্বিকার ভঙ্গিতে জবাব দেয়,’তোমাকেও তো বলেছিলাম আমার মামার সাথে এমন ব্যবহার করবে না,এমন বাজে গলায় কথা বলবে না।তুমি শুনেছ আমার কথা?’
‘আমার বাবা।’
‘আমার মামা।’
‘আমার বেশি আপন।অধিকার আছে আমার।’
‘অধিকার আমারও আছে।’ শক্ত মুখে জবাব দেয় নবনীতা।
মিসেস রোকেয়া তার একের পর এক উত্তরে বিরক্ত হয়ে বললেন,’তুমি সবকিছুতে এতো বাড়াবাড়ি কেন করো বলো তো?আগে তো জানবে প্রথা কেন এসেছে?না শুনতেই এতো কথা কেন বলছ?’
‘কেন?কেন এসেছে প্রথা?কি কারণে তার বাবার সাথে এতো জোর গলায় কথা বলছে সে?আমাকে বলো।শুনি আমি।’ চোখ সরু করে জানতে চায় নবনীতা।
মিসেস রোকেয়া জোরাল গলায় বললেন,’প্রথা আর তার কয়েকজন বন্ধু মিলে একটা ব্যবসা করতে চাচ্ছে।সেজন্য তার কিছু টাকা প্রয়োজন।তোমার মামার কাছে সেই টাকাই চাইতে এসেছে।খারাপ কিছু তো করেনি।নিজের ভবিষ্যতের কথাই ভাবছে।’
নবনীতা কপাল কুচকায়।সেরকম মুখ করেই বলে,’প্রথা ব্যবসা করবে?গ্র্যাজুয়েশন টা তো আগে শেষ করুক।এখনই ব্যবসার কি প্রয়োজন?’
‘আমি কখন কি করব সেটাও এখন তোমাকে বলে করতে হবে?’ গলা উঁচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে প্রথা।
মিসেস রোকেয়ার থেকে নজর সরিয়ে নবনীতা প্রথার দিকে নজর দেয়।একবার আপাদমস্তক তাকে দেখে কড়া গলায় বলে,’একদম এমন উঁচু গলায় কথা বলবে না আমার সাথে।বয়সে তোমার যথেষ্ট বড় আমি।আমি শুভি নই,চিত্র নই।আমি নবনীতা।তোমার উচ্চবাচ্যে আমি ভয় পাই না।কিসের ব্যবসা করবে তুমি?একটু খুলে বলো তো আমাকে?’
প্রথা চোখ নামায়।রাগ নিয়ন্ত্রণের জন্য কিছুক্ষণ টেনে টেনে শ্বাস নেয়।ফুঁসতে ফুঁসতে জবাব দেয়,’যেই ব্যবসাই করি না কেন,ভালো মন্দ বুঝেই করব।’
নবনীতা প্রশ্নাত্মক চাহনিতে তাকে দেখে বলল,’কতো টাকা প্রয়োজন?’
প্রথা গমগমে স্বরে উত্তর দেয়,’দশ লক্ষ টাকা!’
‘কি?দশ লক্ষ টাকা?’ একপ্রকার চেঁচিয়ে ওঠল নবনীতা।পরক্ষণেই নিজের বিস্ময় নিয়ন্ত্রণ করে বলল,’তোমার মাথা ঠিক আছে প্রথা?ব্যবসার শুরুতেই দশ লক্ষ টাকা পুঁজি খাটাবে?দশ লক্ষ টাকা কি চাট্টে খানি কথা?এতো টাকা কোথা থেকে আসবে?’
প্রথা নির্বিকার হয়ে জবাব দেয়,’কেন?এতো চিন্তার কি আছে?বাবার পেনশনের টাকা আছে না ব্যাংকে?ঐটা থেকে দশ লাখ টাকা দিলেই তো হলো।’
নবনীতা চূড়ান্ত রকমের আশ্চর্য হয়ে বলল,’তোমার কি মাথা ঠিক আছে প্রথা?ঐ টাকা টা মামার টাকা।মামার চিকিৎসার জন্য রাখা হয়েছে।তুমি কি করে ঐ টাকায় হাত দিতে চাইছো?মামার ব্যাংকে রাখা টাকায় তোমার কোনো অধিকার নেই।’
‘কেন?কেন অধিকার নেই?আমি তার সন্তান।আমার অধিকার আছে।’ গজরাতে গজরাতে উত্তর করে প্রথা।
‘না অধিকার নেই।তোমার প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির পেছনে প্রতি মাসে বিশাল টাকা খরচা হয়।এর মাঝে তুমি অন্য কোনো টাকা চাইতে পারো না।আগে ভালো মতো গ্র্যাজুয়েট হও,তারপর এসব ব্যবসা নিয়ে ভেবো।’ কিছুটা শাসন,কিছুটা তিরষ্কারের সুরে জবাব আসে।
তার সোজাসাপ্টা কথাবার্তায় প্রথা খৈ হারিয়ে পুনরায় একই কথা বলল,’তুমি আমার বাড়িতে থেকে আমার উপরই খবরদারি করো।তোমার লজ্জা করে না?’
নবনীতা মাথা নাড়ল।তর্জনী নেড়ে বলল,’না,একদমই না।আমার লজ্জা করে না।ঠিক যেমন আমার টাকায় ভাড়া দেওয়া বাড়িতে থেকে,আমার টাকায় বাজার করা খাবার খেয়ে আমারই সাথে কাটখোট্টা ভাষায় কথা বলতে তোমার লজ্জা করে না,তেমন আমারো লজ্জা করে না।’
প্রথার থোতা মুখ ভোঁ’তা করে দেওয়ার জন্য এর চেয়ে যুতসই উত্তর সম্ভবত আর কিছুই হতো না।মুখের উপর এমন উত্তর পেতেই সে চুপশে গেল।কেবল চাপা ক্রোধে অজানা কোনো জ’ন্তুর মতো ফোস ফোস শব্দ করে শ্বাস ছাড়ছিল।
নবনীতা নড়বড়ে হয়ে যাওয়া খোপা টা খুলে শক্ত করে বেঁধে নেয়।সাদেক সাহেবের কাছে হেঁটে গিয়ে তার কাঁধে হাত রাখে।সাদেক সাহেবের চোখ মুহূর্তেই আদ্র হয়।সংসারের এই পর্যায়ে এসে বাবা নামক স্বত্ত্বাটি উপলব্ধি করতে পারে,সংসারে তার মূল্য নির্ধারণ করা হয় অর্থ উপার্জনের পরিমানের উপর ভিত্তি করে।যখন সে প্রতি মাসে বিশাল অঙ্কের টাকা কামাই করে আনতো,তখন নিশ্চয়ই বাবার সাথে প্রথা এমন আচরণ করত না।এখন বাবা অচল।তাকে ভালোবাসা কিংবা সম্মান কোনোটাই দেখানো প্রয়োজন নেই।প্রয়োজন কেবল বুড়িয়ে যাওয়া লোকটির অবশিষ্ট শেষ সম্বল টুকু।সেটার জন্যই বাড়ির একটি ঘর এখনো তার ভাগ্যে জুটেছে।
নবনীতা তার একহাত নিজের দুই হাতের মুঠোয় নিল।দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে জানাল,’সবকিছুতে মন খারাপ করবে না মামা।মন খারাপ জিনিসটা মূল্যবান।যার তার উপর করা যায় না।সবার উঁচু আওয়াজে মনে কষ্ট নিবে না।যারা কোনোদিনও তোমার ঋণ শোধ করতে পারবে না তাদের সাথে কিসের মন খারাপ?আগে তারা তোমার পূর্বের সকল ঋণ শোধ করুক।তারপর না হয় তাদের গলাবাজি দেখা যাবে।’
স্পষ্ট আর জড়তাহীন কিছু বাক্য,অথচ সাদেক সাহেবের মনে হলো মেয়েটি তার মাঝে একটা নব প্রাণের সঞ্চার করে গেছে।সত্যিই তো,প্রথার আচরণে সে কেন কষ্ট পাবে?প্রথা কি কোনোদিন পারবে অতীতের সব ঋণ শোধ করতে?তার কথায় সাদেক সাহেব কেন মন খারাপ করবে?
তিনি মুগ্ধ চোখে তার সামনে দাঁড়ানো যুবতী কন্যাটি কে দেখেন।অপলক শুধু দেখতেই থাকেন।আর কতো বিশেষণ এসে যুক্ত হবে এই মেয়েটির নামের পাশে?সাদেক সাহেবের জানা নেই।তবে তিনি এইটুকু জানেন এই মেয়েটি অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন।তার ভেতর এমন এক বিশেষ ক্ষমতা আছে যেই ক্ষমতায় সে তার আশেপাশের মানুষজন কে আচ্ছন্ন করে রাখে।তার ভেতর শক্তি আছে,সাহস আছে।যেই শক্তি আর সাহস দাবা’নলের আ’গুনের মতো তার আশেপাশের সবার ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে।সাদেক সাহেব এই মেয়েটিকে স্নেহ করেন,স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশিই ভালোবাসেন।
নবনীতা তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা কাঁথা টা তার বুক পর্যন্ত টেনে দিলো।ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে থমথমে স্বরে বলল,’আমি যেন আর কোনো আওয়াজ না পাই আর এই ঘর থেকে।’
বলেই সে লম্বা লম্বা কদম ফেলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।মিসেস রোকেয়া তার প্রস্থান দেখতেই চাপা স্বরে বললেন,’অহংকারের ঠেলায় বাঁচে না।দম্ভে মাটিত পা টাও পড়ে না এই মেয়ের।দু’টো পয়সা রোজগার করে,আবার সুযোগ বুঝে খোঁচাও দিয়ে দেয়।’
***
নবনীতা তার ঘরে গিয়েই প্রথমে হাত মুখ ধুয়ে খাটের এক পাশে গিয়ে আধ শোয়া হয়ে হেলান দিলো।চিত্রাকে এক হাত তুলে ডেকে বলল,’চিত্র সোনা! আপাইয়ের কাছে আয় তো।’
চিত্র ছোট ছোট পায়ে তার সামনে এলো।নবনীতা একটানে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে তার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে আদুরে গলায় বলল,’চুল গুলো এমন অবস্থা করেছ কেন চিত্র?সকালে না আপাই বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলাম?’
‘খুলে গেছে খেলতে খেলতে’ অত্যন্ত স্বাভাবিক কায়দায় জবাব দেয় চিত্রা।
নবনীতা আলগোছ হেসে বলল,’আচ্ছা যাও ,চিরুনী আর ব্যান্ড টা নিয়ে আসো,আপাই আবার বেঁধে দিচ্ছি।’
চিত্রার চুল বাঁধার সময়ই আচমকা ধাম করে বিকট শব্দে ঘরের দরজা খুলল।চিত্রা আর নবনীতা দু’জনই সে শব্দে ধড়ফড়িয়ে ওঠল।আওয়াজের উৎস খুঁজতে সামনে দেখেই নবনীতা তিতিবিরক্ত হয়ে ধ’মকে উঠে,’এসব কি শুভি?এতো জোরে কেউ দরজা খোলে?অদ্ভুত কাজ কারবার করিস মাঝে মাঝে!’
শুভ্রা তার ধ’মক গায়ে মাখল না।উল্টো কাঁধে ঝুলানো কলেজ ব্যাগটা কাঁধ থেকে খুলে সোজা শূণ্যে উড়িয়ে দিলো।নবনীতা ব্যাগটা দেখেই ব্যস্ত হয়ে বলল,’আরে কি করছিস তুই?ধর ব্যাগটা।’
শুভ্রার অবশ্য ব্যাগ ধরতে হয়নি।ব্যাগটা শূন্যে উড়তে উড়তে তার পড়ার টেবিলেই গিয়ে পড়েছে।শুভ্রানী সে দৃশ্য দেখেই গর্ব করে বলল,’আমার নিশানা কখনো মিস যায় না।’
কথা শেষ করেই সে এক ছুটে নবনীতার কাছে গিয়ে তাকে আধশোয়া অবস্থাতেই শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।নবনীতা তার আচরণে বোকা বনে গেল।শুভ্রা তাকে আরো কিছুটা অবাক করার জন্যই দ্রুত তার দুই গালে পর পর দু’টো চুমু খেল।তারপর চিত্রাকে তার কাছ থেকে একটু দূরে সরিয়ে নিজে তার পাশাপাশি বসে বলল,’যা চিত্র! অনেক আদর খেয়েছিস তুই।এবার একটু আমাকেও আদর দেও আপাই।বড় হয়েছি বলে তুমি আমায় পাত্তা দাও না একটুও।’
নবনীতা বোকার মতো কিছুক্ষণ তাকে দেখে।নিজের বিস্ময়ভাব কাটতেই সে খিলখিলিয়ে হেসে ফেললো।শুভ্রার মাথায় হাত ছুঁয়িয়ে বলল,’আয় তোরও মাথায় হাত বুলিয়ে দেই।’
শুভ্রানী তার মাথা থেকে হাত নামিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,’উফফ আজ আর তার দরকার নেই।’
সে আরেকটু এগিয়ে গেল।মুখটা একদম নবনীতার কানের কাছে নিয়ে খুশি খুশি গলায় বলল,’একটা খুবই ভালো খবর আছে আপাই।’
নবনীতা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় কি?
শুভ্রা এক দৌঁড়ে তার টেবিলের সামনে গিয়ে ব্যাগ খুলে একটা খাম আর একটা ফাইল বের করল।তারপর আগের মতোই আবার দৌঁড়ে দৌঁড়ে নবনীতার কাছে এসে সেগুলো তার হাতে তুলে দিলো।
নবনীতা সবার প্রথমে ফাইল খুলে তার ভেতর থাকা লেমিনেটিং করা কাগজ টাই বের করল।কাগজের লিখা টুকু পড়েই তার দু’চোখ জ্বল জ্বল করে ওঠে।শুভ্রানী মাস খানেক আগে একটা বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিল।নবনীতাই সে পরীক্ষার জন্য ফর্ম তুলেছিল।সেটার রেজাল্ট বেরিয়েছে।শুভ্রানী বৃত্তি টা পেয়ে গেছে।
নবনীতা কিছু বলার আগেই শুভ্রা উৎফুল্ল স্বরে বলল,’আজ কলেজের প্রিন্সিপালের হাতে রেজাল্ট এসেছে।ছুটির পর আমাকে ডেকে নিয়ে সার্টিফিকেট আর টাকা দিয়েছে।বলেছে পরবর্তীতে কলেজ ফেস্টেও আমাকে কলেজের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হবে।’
কথা শেষ করেই সে মুচকি হাসে।নবনীতা অভিভূত হয়।মন্ত্রমুগ্ধের মতো তার কথা শুনে।দুই চোখে আনন্দ আর উচ্ছ্বাস ছলকে উঠে।সহসা শুভ্রা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল সে।প্রচন্ড আবেগী হয়ে বলল,’খুব খুশি হয়েছি আমি শুভি।আমার ভেতরটা গর্বে আর আনন্দে ফুলে ফেঁ’পে যাচ্ছে সোনা।মনে হচ্ছে বৃত্তিটা আমি নিজেই পেয়েছি।’
শুভ্রা লাজুক হাসল।খামের থেকে টাকাটা বের করে নবনীতার হাতে তুলে দিলো।এককালীন সাত হাজার টাকা।নবনীতা টাকাগুলো হাতে নিয়ে জড়ানো গলায় বলল,’দেখি তোর মাটির ব্যাংক টা আন তো।এই টাকাটা আমি তোর ব্যাংকে জমাবো।’
বাড়িতে মোট তিনটে মাটির ব্যাংক আছে।নবনীতা সেগুলো কিনেছিল বছর চারেক আগে।নবনীতা শুভ্রানী আর চিত্রার যার যার ব্যাংক।সাদেক সাহেব যখন শারীরিক ভাবে সুস্থ ছিলেন তখন তিনি প্রায়শই তিন বোনকে কারণে অকারণে টুকটাক সালামি দিতেন।নবনীতা সেগুলো যার যার ব্যাংকে জমা করেছে।চিত্রার ব্যাংকে অবশ্য সে নিজেও মাঝে মাঝে টাকা দেয়।তার বিশ্বাস একদিন এই ব্যাংক গুলোতে অনেক অনেক টাকা জমবে।সেই টাকা দিয়ে তারা তিনবোন অনেক দূরে কোথাও ঘুরতে যাবে।কতো চমৎকার না বিষয় টা?
শুভ্রা বিরোধ করে বলল,’না না।এই টাকা আমি ব্যাংকে ফেলব না।আমি আগেই ভেবে নিয়েছি এই টাকায় আমি কি কি করব।’
নবনীতা কপালে ভাঁজ ফেলে সন্দিহান চোখে বলল,’কেন?কি করবি তুই এই টাকায়?’
.
.
.
.
‘এ্যাই বাচ্চা! একা একা কোথায় যাচ্ছ?’
তাসনুভা বাড়ির বাইরের ইয়ার্ডে ঘুরাঘুরি করছিল।আদির ডাক কানে যেতেই সে হুইলচেয়ার থামিয়ে ঘাড় ঘুরালো।আদি বাড়ির বাইরের খোলা জায়গা থেকে হেঁটে ভেতরে আসছিল।তাসনুভা তাকে দেখতেই বলল,’কি হলো?তুমি না ভাইয়াকে সাথে নিয়ে আসার কথা?’
আদি হাঁটতে হাঁটতে তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালো।ক্লান্ত স্বরে বলল,’তোমার ভাইয়াকে বিকেলে রিলিজ দিবে।তখন আনব।’
‘তাহলে তুমি এখন এসেছ কেন?একটু আগেই তো গেলে।’ চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করে তাসনুভা।
‘কেন?তোমার কি অসুবিধে হচ্ছে আমি বাড়িতে ঘন ঘন আসাতে?’ কোমরে হাত রেখে জানতে চায় আদি।
তাসনুভা মুখ চেপে হাসে।গালে হাত রেখে বলে,’হ্যাঁ হচ্ছে।তুমি কি এখন মন খারাপ করে অন্য কোথাও চলে যাবে?’
‘নাহ বাচ্চা।আমার এতো রাগ টাগ হয় না।আমি কোথাও যাচ্ছি না।’
কথা শেষ হতেই আদি শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে ভারি গলায় বলল,’তোমার বিগ ব্রাদার পাঠিয়েছে আমায়।তোমার নাকি এই সপ্তাহে হসপিটালে গিয়ে চেক আপ করানোর কথা?তোমার ভাই বলেছে আমি যেন বাড়ি গিয়ে তোমায় নিয়ে আসি।আরিশের তো সেমিস্টার ফাইনাল চলছে।মতিন চাচা অসুস্থ,কাজে আসেনি আজ।তোমার ভাইয়ের আবার ট্রাস্ট ইস্যু আছে।যাকে তাকে ভরসা করতে পারে না।তাই আমাকে বলেছে তার বোনকে নিয়ে হসপিটাল যেতে।বুঝেছ পিচ্চি?’
তাসনুভা কপালে হাত চাপল।অবাক হয়ে বলল,’তুমি এতো কথা কেমন করে বলো?তোমরা তিন বন্ধু একেবারে তিন রকম।’
‘এদের মাঝে সবচেয়ে কিউট আর সবচেয়ে সুইট আমি।তাই না?’ শার্টের কলার উঁচিয়ে গদো গদো হয়ে প্রশ্ন করে আদি।
তাসনুভা শব্দ করে হেসে ফেলল।এক হাত মুখে চেপে বলল,’হ্যাঁ,একদম তাই।’
আদি তার মাথায় এক হাত রেখে তাড়া দিয়ে বলল,’চলো চলো।আমাদের বেরিয়ে পড়তে হবে।বড্ড লেইট হয়ে যাচ্ছি আমরা।’
_____________________________________________
‘মিস নবনীতা।আপনার সমস্যা টা আপনি বেশ ভালো করেই জানেন।আপনি যথেষ্ট সচেতন মানুষ।তা স্বত্ত্বেও রোগ নিয়ে আপনার এই অবহেলা সত্যিই ডিসাপয়েন্টং।আপনার রেগুলার চেক-আপ করানোর কথা।অন্তত প্রতিমাসে একবার।কিন্তু আপনি এসেছেন পাক্কা তিন মাস পরে।আপনাকে যে মেডিসিন গুলো দিয়েছিলাম আপনি সেগুলো নিয়ম করে নেন না।সবকিছু বাদ দেন।আপনার প্রতি মাসে রক্ত নেওয়া প্রয়োজন।আপনি কি নিচ্ছেন?’
বার্ডেম হসপিটালের হেমাটোলোজি ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ডাক্তার মতিন আহমেদ খসরু কথা গুলো বললেন খুবই থমথমে মুখে।নবনীতা সে কথা শুনেই মাথা নামিয়ে নিল।ঠিক যেমন প্রিন্সিপালের বকুনি শুনে কেউ মস্তক নত করে,ঠিক সেভাবে।
তার পাশের চেয়ারেই চিত্রা ভদ্র বাচ্চার মতো চুপটি করে বসে আছে।মতিন সাহেবের গম্ভীর মুখটা দেখেই তার সমস্ত চঞ্চলতা উধাও হয়ে গেছে।সে বসে আছে একটা পুতুলের মতো।না কোনো নড়াচড়া করছে,না কোনো শব্দ করছে।নবনীতা আর চিত্রা আজ হসপিটালে এসেছে।শুভ্রা এখন কোচিং-এ।বৃত্তির টাকার একটা অংশ সে নবনীতার চেকআপের জন্য দিয়েছে।একটা অংশ নিজের ব্যাংকে রেখেছে।চিত্রার সামনে জন্মদিন।তার জন্মদিনের কেক কিনার জন্যও শুভ্রা টাকা রেখেছে।এছাড়া আরো অনেক টুকটাক ইচ্ছে আছে তার।সে সবগুলোই পূরণ করতে চায়।নবনীতা তাকে বাঁধা দেয়নি।এটা তার অর্জন।সে যেভাবে চাইবে সেভাবেই খরচ করবে।নবনী তাকে বারণ করার কে?
‘মিস নবনীতা! শুনছেন তো?’
চমকে উঠে সে।দ্রুত মাথা তুলে জানায়,’জ্বী স্যার।শুনছি।’
‘আপনি দয়া করে আর এতো অবহেলা করবেন না নিজের।আপনি খুব স্ট্রং একজন মেয়ে।সেই স্ট্রেগথ্ হারাবেন না প্লিজ।ইউ শ্যুড ইমিডিয়েটলি টেইক ব্লা’ড।বুঝছেন তো মিস?’
‘জ্বী বুঝেছি।এ মাসেই র’ক্ত নিব।আপনাকে ধন্যবাদ স্যার।’
ডাক্তার মতিনের সাথে আরো কিছুক্ষণ আলাপচারিতার পর নবনীতা চিত্রাকে সাথে নিয়ে তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো।হসপিটালের নিচে ফার্মেসি আছে।সেখান থেকে কিছু ঔষধ কিনতে হবে তাদের।সে কেবল মাত্র চেম্বার থেকে বেরিয়ে তিনতালার মাঝামাঝি এসে দাঁড়িয়েছিল।ঠিক তখনই আনমনে এদিক সেদিক দেখতেই কিছু একটা দেখে তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।সে পাশ ফিরে চিত্রকে দেখে তাড়াহুড়ো করে বলল,’একদম এদিকে দাঁড়িয়ে থাকবে চিত্র।আপাই এক্ষুনি চলে আসব।’
কথা শেষ করে সে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না।ব্যস্ত পায়ে ছুটে গেল সামনের দিকে।
তাসনুভার চেক আপ শেষে আদি গিয়েছিল আরহামের কেবিনে।আরহামের কেবিন চার তালায়।যাওয়ার আগে আদি তাসনুভা কে করিডোরের একটা পাশে রেখে গিয়েছে।বলেছে দুই মিনিটে যাবে আর তিন মিনিটে আসবে।কিন্তু দশ মিনিট শেষ হতেও তার কোনো দেখা নাই।তাসনুভা বিরক্ত হয়ে এদিক সেদিক দেখল।তার থেকে একটু দূরেই চাইল্ড স্পেশালিষ্ট আকরামুল হোসেনের চেম্বার।চেম্বারের বাইরে বাচ্চা নিয়ে তাদের মা বাবারা বসে আছেন।কিছু কিছু বাচ্চা এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে।তাদের চিৎকারে তাসনুভার কান ব্যথা হয়ে যাচ্ছে।হঠাৎই একটি বাচ্চা ছুটতে ছুটতে তাসনুভার হুইল চেয়ারের চাকায় ধা’ক্কা খেল।সঙ্গে সঙ্গে স্টিলের হুইল চেয়ারটি হুড়হুড় করে চলতে শুরু করল।আঁতকে উঠে তাসনুভা।দ্রুত চাকায় হাত রেখে সেটা থামানোর চেষ্টা করে।কিন্তু চাকা পর্যন্ত ঠিকঠাক তার হাত পৌঁছায় না।বিষয়টা এমন না যে তাসনুভা হুইল চেয়ারটা থামাতে অক্ষম।কিন্তু হঠাৎ এমন পরিস্থিতি তে পড়ে সে কি করবে সেটাই ঠাহর করতে পারছিল না।ঘাবড়ে গিয়ে সে কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে সামনে দেখে যাচ্ছিল।কোনো নার্স কি আশেপাশে নেই?কেউ কি নেই যে তাকে দেখে বাঁচাতে আসবে?
হঠাৎই তাসনুভার হুইলচেয়ারের গতি কমল।পেছন থেকে কেউ শক্ত করে সেটা টেনে ধরল।সাথে সাথেই চাকা দুটো থামল।তাসনুভা বুকে হাত চেপে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল।তারপর দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দেখল।
তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে একটি মেয়ে।পরনে হালকা আকাশী রঙের জামা।চুলে বেণী বাঁধা।তাসনুভার সাথে চোখাচোখি হতেই সে মিষ্টি করে হাসল।জানতে চাইল,’কি হলো?ভয় পেয়েছ নাকি?ভয়ের কিছু নেই সোনা।এই দেখো আমি তোমাকে ধরে ফেলেছি।’
চলবে-
(সময় পেলে আজ রাতে অতিরিক্ত অংশ দিয়ে দিব)