কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১৪

0
140

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১৪)

ব্যস্ত সড়কের একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে আটতলা বহুতল ভবনটির অবস্থান।পুরো ভবনজুড়েই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের শো রুম।নয়তো অফিস ভাড়া নেওয়া।ভবনের চতুর্থ তালায় একটা কোচিং সেন্টারও আছে।নবনীতার গন্তব্য সেখানেই।

রিমির পাঠানো ঠিকানার সাথে একবার আশেপাশের ঠিকানা মিলিয়ে সে নিশ্চিত হয় এটাই সে কোচিং সেন্টার।সে এখানে এসেছে একটা পাকাপোক্ত চাকরির খোঁজে।বিশাল বড় কোচিং সেন্টারে স্টুডেন্ট পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল।রিমির থেকে নবনীতা এই জায়গার সন্ধান পেয়েছে।রিমি বলছিলো বেতন নাকি মাসিক ত্রিশ হাজার টাকা।শুনেই নবনীতা বিষম খেয়েছে।এতো গুলো টাকা!

লিফটের বাটন চেপে চারতালায় পৌঁছে সে বড় বড় দু’টো শ্বাস ছাড়ে।ভাইবা দেওয়ার আগে যেমন নার্ভাস লাগে,তারও ঠিক তেমনই নার্ভাস লাগছে।বুক একটু পর পর ভার হয়ে আসছে।দুশ্চিন্তায় শরীর ঘেমে ঘেমে একাকার।

নবনীতা কোচিংয়ের অফিস রুমে গিয়েই নিজের পরিচয় দিলো।সুমিষ্ট কন্ঠে জানতে চাইল,’কোন রুমে গিয়ে যোগাযোগ করতে হবে?একটু জানিয়ে দিবেন কষ্ট করে?’

ডেস্কে বসা লোকটি কাজের ফাঁকে চোখ তুলে একবার তাকে দেখে।তার চাহনিতেই ভড়কে গেল নবনীতা।এমন অদ্ভুত করে তাকাচ্ছে কেন?নবনীতা কি কোনো চোর?

লোকটি খাতা কা’টছিলো।কাজ করতে করতেই সে বিরক্ত মুখে বলল,’সামনে যান।নিজেই পেয়ে যাবেন।’

নবনীতার কান দু’টো ঝাঁ ঝাঁ করে উঠে।কি পরিমান রূঢ় হলে কেউ এমন কর্কশ ভাষায় কথা বলতে পারে?নবনীতার জানা নেই।সে নিজের দুই হাত কচলাতে কচলাতে সামনের দিকে পা বাড়ায়।যেতে যেতে বিড়বিড় করে,’তুই বললে কি মহাভারত অশুদ্ধ হতো?যতসব গোয়ারের দল!’

কোচিং সেন্টারের মাঝামাঝি একটা রুম আছে।চারপাশে থাই গ্লাস।নবনীতা কক্ষের সামনে গিয়ে একটু দূরে থাকা একজন মেয়ে কে ডেকে জানতে চায়,’ভেতরে যাওয়া যাবে কি?আমি আসলে বিজ্ঞাপন দেখে এসেছিলাম।শুনেছি নতুন শিক্ষক নাকি নিয়োগ দেওয়া হবে?’

যে মেয়েটিকে প্রশ্ন করা হয়েছে তার বয়স নিতান্ত অল্প।সে রিনরিনে স্বরে জবাব দেয়,’জ্বী আপু।আপনি ভিতরে যান।রাশেদ স্যার ভেতরে আছেন।আপনি গিয়ে কথা বলুন।’

নবনীতা শেষ বারের মতো বড় করে একটা শ্বাস টেনে কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।বেশ পরিপাটি একটা রুম।রুমের মাঝখানটায় ডেস্ক।পেছনের ওয়ালে খোদাই করে কোচিং সেন্টারের নাম লিখা।ডেস্কের সামনে ইজিচেয়ারে বসা একজন ভদ্রলোক।তিনি তখনও নবনীতাকে দেখেন নি।তার কানে মুঠোফোন,তিনি কারো সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত।

নবনীতা চুপচাপ দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রইল।অপেক্ষা করল তার ফোন কাটার।লোকটি ফোন রেখেই সামনে দেখে।শীতাতপ নিয়ন্ত্রীত কক্ষে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়েই নড়েচড়ে বসে।
নবনী বিনয়ী কন্ঠে সালাম দেয়।
রাশেদ নামের লোকটি সালামের জবাব দিয়ে ইশারায় তাকে বসতে বলে।কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চায়,’কেন এসেছেন?কোনো প্রয়োজন?’

***

‘মিস নবনীতা নূর।গ্র্যাজুয়েটেড ফ্রম ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা।ফিজিক্স ডিপার্টমেন্ট।সিজি থ্রি পয়েন্ট সিক্স এইট।উমমম বেশ ইম্প্রেসিভ পারফরম্যান্স।’
হাতে থাকা কাগজ গুলো উল্টাতে উল্টাতে বিড়বিড় করে জনাব রাশেদ।

নবনীতা হাত দু’টো কোলের উপর ফেলে উৎসুক চোখে জনাব রাশেদের কার্যকলাপ দেখে।মনটা ভীষণ ছটফট করছে।তিনি কি তার সিভি পছন্দ করেছেন?এই মোটা অঙ্কের বেতনের চাকরি টা কি সে পাবে?যদি পেয়ে যায় তাহলে কি হবে সেটা ভেবেই তার আনন্দ হচ্ছে।

জনাব রাশেদুল হক তার সিভি দেখা শেষ করে ফাইলটা ডেস্কের উপর রাখলেন।চোখ দিলেন নবনীতার মুখে।সেই দৃষ্টি সময়ে সময়ে একটু একটু করে নামতে নামতে নবনীতার বুকে এসে থামল।

মুহূর্তেই মুখোভঙ্গি পাল্টে গেল তেইশোর্ধ রমণীর।ওড়না তো ছিলোই,রাশেদুল হকের লোলুপ দৃষ্টি অনুসরণ করতেই কাঁধের ব্যাগটাও দ্রুত বুকের উপর এনে চেপে ধরল সে।রাশেদ অবশ্য সেসবে ভ্রুক্ষেপ করে না।গলা খাকারি দিয়ে জানতে চায়,’ম্যারিড নাকি আন-ম্যারিড?’

চোয়াল শক্ত হয়ে রমণীর।কোচিংয়ে শিক্ষকতা করার সাথে এই প্রশ্নের সম্পর্ক কোথায়?তবুও সে কাঠকাঠ স্বরে জবাব দেয়,’আন-ম্যারিড।’

রাশেদ সাহেব দাঁত বের করে হাসলেন।উত্তর তার পছন্দ হয়েছে।তার হাসি দেখেই নবনীতার মনে হলো তার বলা উচিত ছিল সে ম্যারিড।চার বাচ্চার মা।অদ্ভুত ধরনের প্রশ্ন করছে এই লোক!

‘তো মিস,বাড়ি কোথায় আপনার?’

‘মালিবাগ’ বিরক্ত কন্ঠে উত্তর দিলো সে।

রাশেদ সাহেব ডেস্কের উপর দুই হাত রাখলেন।সামান্য ঝুঁকে বললেন,’পড়ানো ছাড়া আর কি পারেন?’

আবারও চোয়াল শক্ত হয় নবনীতার।মুষ্টিবদ্ধ হয় হাত,জ্বল জ্বল করে উঠে দুই চোখ।প্রশ্ন করার ধরন দেখেই রাগ উঠছে তার।সে বসে থেকেই একটু পিছিয়ে গিয়ে কটমট করে বলে,’এখানে যেহেতু শিক্ষকতা করার জন্য এসেছি,তাই পড়ানো বাদে অন্য কিছু পারার যৌক্তিকতা দেখছি না।’

রাশেদ সাহেবের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।ভীষণ ত্যাদড় এই মেয়ে।যাকগে ত্যাদড় মেয়েদের রশিদ সাহেবের মন্দ লাগে না।কয়েকটা নোট সামনে ফেললেই এদের সব তেজ হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।

তিনি দমলেন না।উল্টো কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,’ভা*র্জিন নাকি না?’

থতমত খায় নবনীতা।বিস্ফারিত চোখে সামনে দেখে।কি প্রশ্ন করল লোকটা এই মাত্র?নবনীতা কি ঠিক শুনেছে?প্রশ্ন শুনতেই চোখ জোড়া আপনাআপনি র*ক্তিম হলো তার।কেমন প্রশ্ন এটা?সমস্ত শরীর ঘিন ঘিন করে উঠে।চেঁচিয়ে জানতে চায় সে,’এটা কি ধরনের প্রশ্ন?কি ধরনের অসভ্যতা এগুলো?’

রশিদ সাহেব দাঁত বের করে হাসে।পূর্ণ দৃষ্টি মেলে নবনীতাকে এক নজর দেখে আমোদে গলায় বলে,’এতো রাগ হচ্ছো কেন?শুধু ছাত্রদের পড়ালেই হবে?মাঝে মাঝে আমাকেও খুশি করতে হবে না?’

রাশেদুল হক থামলেন।সামনে বসে থাকা মেয়েটার থমথমে রূপ তার বোধগম্য হচ্ছে না।সে এমন থম মেরে বসে আছে কেন?অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ায় তরুণীটি।চোখ মুখ খিঁচিয়ে সশব্দে একটা চ’ড় বসায় রাশেদ সাহেবের গালে।স্তম্ভিত হয় রাশেদ সাহেব নিজেও।অবিশ্বাস্য চোখে গালে হাত রেখে সামনে দেখে।মেয়েটি তার গালে হাত তুলল?তারই কোচিং সেন্টারে এসে তাকেই চ’ড় মারল?

তিনি গালে হাত চেপেই চেঁচিয়ে উঠেন,’তোমার সাহস কতো! তুমি আমার গায়ে হাত তুলো! দুই টাকার মেয়ে হয়ে,,,,’

‘খবরদার! একদম জিভ টেনে ছিঁ’ড়ে ফেলব যদি আমার নামে আর নোংরা কিছু বলেছেন তো।দুই টাকার মানে?আপনি আমার মূল্য ঠিক করার কে?চরিত্র*হীন কোথাকার! কোচিং সেন্টার খুলে এসব কাজ করেন?শিক্ষার মতো সুন্দর বিষয়টির সাথে নিজের সব নোংরামি জড়িয়ে রেখেছেন।অ’সভ্য একটা!’ দ্বিগুন শব্দে চেঁচিয়ে ওঠল সামনে থাকা মেয়েটি।মেয়েটির চোখে আ’গুন ছিল।কন্ঠে সীমাহীন তেজ ছিল।কথায় ছিল তলো’য়ারের ন্যায় ধাঁর।রাশেদ সাহেব সেই ধাঁরের কাছে দমে গেলেন।তোতলাতে তোতলাতে বললেন,’তোমার নামে আমি কেস করব বে’য়াদব মেয়ে।’

নবনীতা চোখ মুখ শক্ত করে ক্ষে’পাটে সুরে বলল,’আপনি কেন কেস করবেন?আমাকে বলেন,আমিই করে দিব কেস।লু’চ্চা ই’তর একটা।বুড়ো বয়সেও বদ’মাইশি শেষ হয় না।লাগবে না আপনার নোংরা কোচিং-এ চাকরি।আর পরের বার থেকে কথা বলার আগে এই চ’ড় টা মাথায় রাখবেন।যতোসব ফা’লতু আর ন’ষ্ট চিন্তাভাবনার মানুষ! নিজের নাই শিক্ষা,আবার এসেছে অন্যকে শিক্ষা দিতে।’

নবনীতা বেরিয়ে গেল হনহনিয়ে।যতটা বিনয় নিয়ে সে ভেতরে এসেছিল,ততটাই বিরক্তি আর রা’গ নিয়ে সে বের হলো।বের হতেই দরজার কাছে সেই মেয়েটির সাথে তার দেখা হলো।মেয়েটি জানতে চায়,’কি হয়েছে আপু?স্যার কি বলেছেন?’

নবনীতা চোখ গরম করে তাকে দেখল।তার চাহনিতেই মেয়েটা ভড়কে গেল।এতো রে’গে আছে কেন মেয়েটা?নবনীতা কোনো উত্তর না দিয়েই গটগট করে হেঁটে ভবন থেকে বেরিয়ে এলো।তার মুঠোফোন বাজছে।নিশ্চয়ই রিমির কল।কিন্তু সে আজ ফোন রিসিভ করবে না।কিসব ফালতু আর নষ্ট কোচিং সেন্টারের খোঁজ এনেছে গা’ধা টা! নবনীতার শরীর তখনও গিজগিজ করছিল রাগে।একটা চ’ড় কম হয়েছে।ঐ শয়’তান টাকে জুতো পে’টা করা উচিত ছিল।
.
.
.
.
আরহামের পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজন করা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হা’মলা করার মূল উদ্দেশ্য ছিল জনগণ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভ’য় ভী’তি সঞ্চার করা।এতে করে তার দলের সমর্থন কমে যেত।মানুষ ভয়েই তার আয়োজন করা আর কোনো অনুষ্ঠানে আসত না।ফল সরূপ তার দল হালকা হয়ে যেত।রাকিবের পরিকল্পনা মূলত এমনই ছিল।

অথচ হলো হিতে বিপরীত।আপামর জনতার একটা বিশাল অংশ আরহামের প্রতি গভীর সহানুভূতি দেখাল।অল্প বয়সী একটা ছেলে নতুন নতুন নির্বাচন করছে।সে তো কেবল একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল।অথচ এই অপ’রাধে তার উপর হামলা হলো,ছেলেটা গু’লি খেল।স্বাভাবিক ভাবেই জনগণের উপর এর একটা প্রভাব পড়ল।দেখা গেল একটা বিরাট সংখ্যার মানুষ আরহামের প্রতি দরদে গদো গদো হলো।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাকিবের কাজকর্মের জোরাল প্রতিবাদ করল।সংবাদ মাধ্যমে গুলোতে অগনিত আর্টিকেল ছাপা হলো।মোদ্দা কথা প্রতিটা বিষয়ই রাকিবের বিরুদ্ধে গিয়ে দাঁড়াল।সে চেয়েছিল লোকজন যেন ভয়ে আর আরহামের কোনো সম্মেলনে না যায়।কিন্তু ঘটনা এই পর্যায়ে এসেছে যে লোকজন এখন আরহাম বলতে অ’জ্ঞান।

অতীত জিনিসটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ।আরহামের অতীত ভালো।যোগ্য বাবার সন্তান সে।নিজের কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেও কোনো কেলে’ঙ্কারি তে জড়ায়নি সে।তার উপর তার বয়স অল্প।দেখতে নিরেট ভদ্রলোক।স্বাভাবিক ভাবেই মানুষের একটা বিশেষ টান কাজ করে তার প্রতি।সেদিনের ঘটনার পর তর তর করে তার জনপ্রিয়তা বাড়ল।যে কখনোই তাকে চিনত না বা তার কথা জানত না সেও দেখা গেল তার সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনার নিন্দা জানাল।আরহাম এমন একটা বাজি জিতে গেল যেই বাজি সে কোনোদিন লাগেই নি।

পরেরদিন বিকেলে সে হাঁটাচলা করতে পারছিল।ব্যথাটা কেবল একটা হাতেই সীমাবদ্ধ ছিল।বাকি শরীরে দুর্বলতা ছিল,কিন্তু যন্ত্র’ণা কমে গিয়েছিল অনেকটাই।জালালুর রহমান সাহেব প্রতিদিনই সময় করে তার কেবিনে আসতেন।সেদিন বিকেলে কেবিনে এসেই তিনি প্রশস্ত হাসলেন।আরহামের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন,’কেমন আছ আব্বাজান?’

আরহাম হাসল।জড়ানো গলায় বলল,’একদম ফিট এন্ড ফাইন আছি আঙ্কেল।তবে অথোরিটি রিলিজ দিচ্ছে না।বলছে আরো একদিন অবজারভেশনে রাখতে।’

জালালুর রহমান কেবিনের একপাশের কাউচে গিয়ে বসলেন।নিরুদ্বেগ হয়ে বললেন,’রাখুক না।সমস্যা কি?চিন্তা করো না।অলরেডি অর্ধেক নির্বাচন তুমি জিতে গেছ।’

আরহাম আশ্চর্য হলো।জিতে গেছ মানে?তার কোঁচকানো চোখ জোড়া দেখতেই জালাল সাহেব হাস্যোজ্জ্বল মুখে বললেন,’রাকিবের এই কাজের প্রচন্ড সমালোচনা হচ্ছে।লোকজন তার নিন্দা করছে।তোমাকে সবাই ভীষণ পছন্দ করছে আরহাম।বিগত একদিনেই বিশাল ফ্যান বেজ হয়েছে তোমার।তোমাকে বেশি কিছু করতে হবে না।কেবল নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত এই মানুষদের নিজে পক্ষে রাখবে।এমন কিছু করবে না যেন কেউ তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়।গট ইট?’

আরহাম মাথা নাড়ে।তাকে ভাবুক দেখাচ্ছে ভীষণ।একটু সময় বাদে সে নিজ থেকেই বলল,’বুঝেছি।রাকিব আমাকে ভিক্টিম বানিয়েছে।আমি এখন নির্বাচনের আগ পর্যন্ত ভিকটিমই থাকব।’

‘এক্স্যাক্টলি! এদেশের মানুষ আবেগে ধরাশায়ী হয়।তুমি নির্বাচন জিতবে সেই আবেগ কে পুঁজি করে।’

জালালুর রহমান থামলেন।কাউচ থেকে উঠে আরহামের মুখোমুখি এসে বললেন,’শোন আরহাম,কাল কিন্তু তোমাকে রিলিজ দেওয়ার পর হসপিটালের সামনে অনেক সাংবাদিক আসবে।অনেক রকম প্রশ্ন করা হবে।তুমি সবগুলো প্রশ্নের বিনয়ের সাথে উত্তর দিবে।কিছুতেই রাকিব কে নিয়ে কিংবা ফাহাদকে নিয়ে কটু কথা বলবে না।কেবল বলবে যে বা যারা এসব করেছে তাদের প্রতি তোমার কোনো রাগ নেই,কিন্তু ভবিষ্যতে যেন তোমাকে জব্দ করার উদ্দেশ্যে এতো গুলো মানুষকে ঝুঁকিতে না ফেলে।মানুষ গুলোর তো কোন দোষ নেই।বুঝেছ?এই ভাবে গুছিয়ে কথা বলবে।একজন ভালো রাজনীতিবিদ কখনো অন্য কারো নাম নিয়ে কাঁদা ছো’ড়া’ছু’ড়ি করে না বুঝেছ?তুমি ওয়ান ম্যান আর্মি হবে।রাজনীতিতে একটা স্বতন্ত্র নাম হবে তোমার,যেমনটা তোমার বাবা জনাব আজিজ হোসেনের ছিল।তুমি কোনো সং’ঘাতে জড়াবে না কেমন?’

আরহাম বাধ্য ছেলের মতো মাথা নাড়ল।কৃতজ্ঞতা সরূপ জালাল সাহেবের হাত মুঠ করে ধরল।নিরেট স্বরে বলল,’ধন্যবাদ আঙ্কেল।আপনার গাইডেন্স ছাড়া আমার পক্ষে এতটুকু আশা সম্ভব হতো না।’

বিনিময়ে জালাল সাহেবও স্মিত হেসে বললেন,’এতে এতো ধন্যবাদের কিছু নেই।আজিজ স্যারের হাতে আমার রাজনীতির হাতেখড়ি।তার ছেলেকে এই পথে সাহায্য করাও আমার সৌভাগ্য।’
.
.
.
.
‘হেই বাচ্চা! কেমন আছো?’

তাসনুভা ঘুম থেকে উঠেই হাত মুখ ধুয়ে করিডোরে এসেছিল।হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন তার হুইল চেয়ার টেনে ধরল।তাসনুভা অবাক হয়ে পেছন ফিরে।আদি ভ্রু কপালে তুলে আবার জিজ্ঞেস করল,’হেই বাচ্চা কেমন আছো?’

তাসনুভা চোখ পাকায়।আশ্চর্য হয়ে বলে,’তুমি কাল দেশে এসেছ।আর এতোক্ষণে জিজ্ঞেস করছ কেমন আছি?’

আদি ফিচেল হাসে।মাথা চুলকে বলে,’কাল তো সে সুযোগ ছিলই না।দৌঁড়াদৌড়ি তে সেসব মনে ছিল না।এখন মনে পড়েছে পিচ্চি টা কে তো জিজ্ঞেসই করা হয়নি সে কেমন আছে।বলো পিচ্চি কেমন আছো?’

তাসনুভা মিষ্টি হেসে বলল,’ফাইন।আই অ্যাম ভেরি ভেরি ফাইন।হোয়াট অ্যাবাউট ইউ?’

আদিও তার মতো করেই জবাব দিলো,’আই অ্যাম ভেরি ভেরি ফাইন টু।’

কথা শেষ করেই সে তাসনুভার দিকে দেখে বলল,’নিচে নামবে নাকি?’

‘হু।আরিশ ভাইয়া কে ডেকে দাও তো।অথবা আফরোজা ফুফু কে।’

‘কাউকেই ডাকতে হবে না।আমি নামিয়ে দিচ্ছি।’ ভরাট গলায় জবাব দেয় আদি।

তাসনুভা কে নিয়ে নিচে নামার একটু বাদেই আরিশও নিচে নেমে এলো।আদির সাথে মুখোমুখি হতেই উৎফুল্ল হয়ে বলল,’গুড মর্নিং আদি ভাইয়া।’

‘গুড মর্নিং আরিশ।’

তিনজন খাবার টেবিলের সামনে আসতেই আফরোজা বেগম রান্নাঘর থেকে হটপট হাতে ছুটে এলেন।চেয়ার টানতে টানতে আহ্লাদী স্বরে বললেন,’বসো না,বসো না।দাঁড়িয়ে আছো কেন?’

বলেই তিনি হটপট টা টেবিলে রেখে পুনরায় ছুটে গেলেন রান্না ঘরে।আদি কৌতূহলী হয়ে বলল,’ইনি কি তোদের সাথেই থাকে?’

তাসনুভা বিষন্ন মুখে জবাব দেয়,’হু।সাথে এনার মেয়েও থাকে।’

আদি মাথা নাড়ে।ফিসফিস করে বলে,’দেখে তো ভ’ন্ড মনে হচ্ছে।’

তাসনুভা চকিতে তার দিকে ফিরে।চোখ বড় বড় করে বলে,’কীভাবে বুঝলে তুমি?’

আদি টি-শার্টের কলার ঠিক করতে করতে ভাব নিয়ে বলল,’আমি সব বুঝি।আইনস্টাইন লেভেলের আই-কিউ আমার।’

তাসনুভা মুখ কালো করে বলল,’একটু আই-কিউ তোমার বন্ধু কেও দিও।সে যে কেন এদের বাড়িতে রেখেছে কে জানে! ভাইয়া যে কেন এদের ছলচা’তুরি ধরতে পারে না সেটাও বুঝি না।’

‘কারণ তোমার ভাই ত্যাড়ামি করতে ভালোবাসে।এছাড়া আর কোনো কারণ নেই।নিজেকে সব’জান্তা সর্ব’জ্ঞানী ভাবে তোমার ভাই।’

আরিশ মাথা নাড়ে।নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে,’তা অবশ্য ঠিক।সে যা ভাবে তাই করে।আমাদের কথা তো পাত্তাই দেয় না।’

তার কথা শেষ না হতেই ডাইনিং রুমে সারাহ এসে উপস্থিত হলো।তাকে দেখতেই তাসনুভা মুখ ভে’ঙচায়।বিড়বিড় করে বলে,’এসেছে আরেক ঢংগী!’

সারাহ টেবিলের কাছে আসতেই সবার আগে আদি কে দেখে।বাড়িতে নতুন কেউ এসেছে সেটা সে জানত না।আদি চোখ তুলে একবার তাকে দেখে পুনরায় খাবার খাওয়ায় মন দিলো।

সারাহ চেয়ার টেনে বসেই গলা ছেড়ে ডাকল,’মা নাস্তা দাও।বের হতে হবে আমার।’

‘তুই আবার কোথায় যাবি?’ সরু চোখে প্রশ্ন ছুড়ে আরিশ।

সারাহ মেকি হেসে জবাব দেয়,’ঐ তো।একটু কাজ আছে ভাইয়া।’

আফরোজা বেগম পরোটার প্লেট হাতে ডায়নিং রুমে এলেন।প্লেট টা সামনে রেখেই অন্যদিকে চলে গেলেন।আদি পরোটা ছিঁ’ড়ে মুখে দিতেই আরিশ পাশ থেকে বলল,’আজকের পরোটা টা খেতে বেশ ভালো হয়েছে তাই না?’

আদি দিরুক্তি করে।মাথা নেড়ে বলে,’উহু।এখানে পরোটার কোনো বিশেষত্ব নেই।সুন্দর মানুষের সামনে বসে যা কিছুই খাবে,সেটাই অমৃত মনে হবে।এটাই বাস্তব।সামনে সুন্দরী থাকলে যে কোনো রান্নার স্বাদই বহুগুন বেড়ে যায়।’

আদি থামল।চোখ তুলে দেখল সারাহ’র মুখটা খুশিতে গদো গদো হয়ে গেছে।সেই খুশির ঝিলিক তার সমস্ত মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।তাসনুভা গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল।আদি ভাইয়া ঐ চুর’নির সাথে এতো রসের আলাপ করছে কেন?

সারাহ দ্রুত আরেকটা পরোটা আদির প্লেটে তুলে দিয়ে ন্যাকা সুরে বলল,’নিন না ভাইয়া আরেকটা খান।খেয়ে বলেন কেমন হয়েছে।’

আদি পরোটা টা না খেয়েই দ্বিগুন ন্যাকা স্বরে উত্তর দেয়,’উহু।বলার কিছু নেই।সুন্দর মানুষের হাত থেকে নেওয়া জিনিস সুস্বাদু হবে সেটা জানা কথা।না খেয়েই এই কথা বলে দিতে পারি আমি।’

সারাহ আবারও খুশিতে গদো গদো হয়।আদি আরেকটু পরোটা ছি’ড়ে মুখে নিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল,’যার হাত থেকে নেওয়া পরোটাই এতো মজা,তার হাতে বানানো বিরিয়ানি না জানি কতোটা ভালো হবে! হেই বিউটিফুল! তুমি বিরিয়ানি রান্না করতে পারো?’

সারাহ বিরিয়ানি রাঁধতে জানে না।তবে এতো এতো প্রশংসায় সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে জানায় সে রাঁধতে জানে।আদি মুচকি হাসল।বলল,’আজ একটু রেঁধে খাওয়াবে কি?’

এক কথাতেই রাজি হলো সারাহ।তাসনুভা গোল গোল চোখ করে তাকে দেখে।তার মুখটা সামনে এলেই তাসনুভার মেজাজ গরম হয়।আদি ভাইয়ের কি তার সাথেও আদিক্ষেতা করা লাগে?

সারাহ খাওয়া শেষেই কিচেনে ছুটল।সে আজ বিরিয়ানি রান্না করবে।সে যেতেই আদি শব্দ করে হেসে উঠল।আরিশ অবাক হয়ে বলল,’তোমার ফ্লার্ট করার স্বভাব আর গেল না তাই না?’

আদি তার কাঁধ চাপড়ে চঞ্চল হয়ে বলে,’না ভাই।এখনো সেই স্কিল ধরে রেখেছি।আরহাম রাজনীতি করে,ওয়াজিদ সোশ্যাল এক্টিভিটিজ এর সাথে যুক্ত।আর আমি এখনো সেই রোমিও গিরিই করে যাচ্ছি।

আরিশ খেতে খেতে বলল,’তোমার স্কিল সেই আগের মতোই আছে।এমন ভাবে বলো যে মেয়েরা এক কথাতেই কাবু।’

তাসনুভা খাওয়া থামিয়ে মুখ কালো করে বলল,’সেজন্য এই চুর’নি সারাহ-র সাথেও এসব করতে হবে?’

আদি ঘাড় ঘুরায়।তাসনুভার মলিন মুখটা দেখেই কিছুটা বিচলিত হয়ে বলল,’এ্যাই বাচ্চা,তুমি রাগ করেছ?ভাইয়া কিন্তু জাস্ট মজা করেছি।’

‘ঐ সারাহ-র সাথে মজা করার কি আছে?ভালো লাগে না আমার তাকে।’

আদি গালের নিচে হাত রেখে সামান্য ঝুঁকে তার মুখটা দেখল।দু’জনে চোখাচোখি হতেই সে দুই হাত কানে চেপে ব্যস্ত হয়ে বলল,’আচ্ছা আচ্ছা সরি।আর কখনো এমন মজা করব না।রাগ করে না বাচ্চা।তুমি না ভালো বাচ্চা?হু?’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে