#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(১৩)
আরহাম তার শক্তপোক্ত শরীরের ভার নবনীতার উপর ছেড়ে দিয়েই দু’চোখ বুজে নিল।তার ইন্দ্রিয় সমূহ অবশ হয়ে যাচ্ছে।নবনীতা পাশ ফিরে একবার তাকে দেখল।কম্পমান হাতটা কোনোরকমে তার গালে ছোঁয়াল।কাঁপা কন্ঠে বলল,’আরহাম প্লিজ এভাবে চোখ বন্ধ করবেন না।আপনার নার্ভস গুলোকে সচল রাখুন।আরহাম! কথা শুনতে পাচ্ছেন তো আমার?’
আরহাম চোখ বুজেই অস্পষ্ট স্বরে কিছু একটা বলল।নবনীতা তার কিছুই শুনল না।চারদিকে গো’লাগু’লির বিকট শব্দ।টিয়ার’শেলের ধোঁয়ায় চারদিক ঘোলাটে।নবনীতা সেসব নিয়ে ভয় পাচ্ছে না।নিজেকে নিয়ে সে কবেই বা ভয় পায়?কিন্তু এই যে তার কাঁধে মাথা রাখা যুবকটা,যার হাতে সে কিছু সময় আগেই গুলি খেয়েছে,তার জন্য নবনীতার চিন্তা হয়।
তাকে নবনীতার ব্যক্তিগত ভাবে পছন্দ না।শুধু সে না,যেকোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকেই নবনীতার পছন্দ না।কিন্তু ছেলেটা নিশ্চয়ই এমন কোনো অপরাধ করেনি যার জন্য তার গু*লি খেতে হবে?
বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার।প্রতি*হিংসার এই নোংরা রাজনীতির শেষ কোথায়?
মিনিট দু’য়েক বাদে ফেরারি’র একটা লেটেস্ট মডেলের গাড়ি তাদের সামনে এসে থামল।গাড়ি থেকে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো ওয়াজিদ।ছুটে গেল তাদের দিকে।সে গিয়েছিল ফার্মগেট,ছোট্ট একটা কাজে।এরই মাঝে এতো কিছু ঘটে গেছে।ওয়াজিদ কাছে আসতেই আরহামের হাত দেখে আঁ’তকে উঠে।ব্যস্ত হয়ে বলে,’মাই গড! কিভাবে হয়েছে এসব?আরহাম! এ্যাই আরহাম!’
নবনীতা বিরস মুখে জবাব দেয়,’সেন্স নেই।আপনি দয়া করে উনাকে যত দ্রুত সম্ভব হসপিটালে নিন।’
মাথা নাড়ল ওয়াজিদ।শক্ত করে আরহামের একহাত চেপে ধরে বলল,’জ্বী।ওকে আমার গাড়িতে করে নিয়ে যাব।’
দূর থেকে তোফায়েলের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।সে কাছে এসেই হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,’দলের আরো কয়েকটা ছেলেও গুলি খেয়েছে।তাদের সবাইকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি।’
নবনীতা আরহামকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।ওয়াজিদ আর তোফায়েল মিলে ধরাধরি করে তাকে গাড়িতে তোলে।নবনীতা নিঃশব্দে দু’কদম পিছিয়ে যায়।তোফায়েল দ্রুত ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে গিয়ে বসল।ওয়াজিদ পেছন ফিরে নবনীতাকে দেখতেই শীতল কন্ঠে বলল,’চারপাশের অবস্থা ভালো না নবনীতা।আপনি কিছু মনে না করলে আমি আপনাকে একটা সেইফ জায়গা পর্যন্ত পৌঁছে দিতে পারি।আপনি কি কষ্ট করে গাড়িতে উঠে বসবেন?’
নবনীতা বিচলিত বোধ করল।ওয়াজিদ ভুল কিছু বলেনি।কিন্তু তার গাড়িতে চড়তেও নবনীতার সংকোচ কাজ করবে।কিন্তু কিছু তো করার নেই আর।সে কয়েক পল চুপ থেকে ধীর পায়ে হেঁটে গাড়ির সামনে এলো।কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ঠিক আরহামের মাথার কাছটায় গিয়ে বসল।ওয়াজিদ গাড়ি লক করে স্টিয়ারিংয়ে হাত রাখে।কালো রঙের গাড়িটি চলতে শুরু করে।
নবনীতা একটু হাঁফ ছেড়ে ডানদিক ফিরল।আরহাম কে দেখতেই পুনরায় এক হাত বাড়িয়ে আরহামের ক্ষ’তস্থানে সেটা চেপে ধরল।তার হাত কাঁপছে।কিন্তু সে আজ ভয় পাবে না বলে পণ করেছে।
ত্রিশোর্ধ যুবকের মাথা গাড়ির সিটে কেমন অবহেলায় পড়েছিল।নবনীতার দেখতেই মায়া হলো।নিশ্চয়ই লোকটা কষ্ট পাচ্ছে।গু’লি খাওয়ার পর শরীরে কম যন্ত্রণা হওয়ার কথা না।
নবনীতা দুই দিক দেখে বড় করে শ্বাস নেয়।মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নেয়।একটু এগিয়ে এসে আলতো হাতে আরহামের মাথা টা ফোমের সিট থেকে তুলে তার কোলে রাখে।নিজের কাজে নিজেই অপ্রস্তুত বোধ করে সে।নিজের এতো কাছাকাছি কোনো পুরুষের অস্তিত্ব বুকের ভেতর কেমন অ’সহ্যকর অনুভূতি সৃষ্টি করে।সে তো লোকটিকে পছন্দ করে না।কিন্তু তার স্বভাবসুলভ কোমল হৃদয় কারো করুণ দশা সইতে পারে না।সে একহাত আরহামের বাহুতে আর এক হাত তার মাথায় রাখে।চোখ বুজে একটানা দোয়া ইউনুস পাঠ করে।মনে মনে বলে,’আল্লাহ! তুমি তাকে শেফা দান করো।’
আধঘন্টা পর ওয়াজিদের গাড়ি বার্ডেম হসপিটালের সামনে এসে পৌঁছায়।সে আগে থেকেই অথোরিটি কে জানিয়ে রেখেছিল,তাই তারা স্ট্রেচার নিয়েই রেডি ছিল।আরহামকে হসপিটালাইজ করার পর সব ফর্মালিটি শেষ করে ওয়াজিদ ভঙ্গুর পায়ে করিডোরের সিটে এসে বসে।নবনীতা দাঁড়িয়ে ছিল এক কোণায়।ওয়াজিদ যদিও তাকে তার বাড়ি পর্যন্ত ড্রপ করে আসতে চেয়েছিল,সে জানিয়েছে তার কোনো প্রয়োজন নেই,সে নিজেই চলে যেতে পারবে।কিছু সময় যেতেই সে এগিয়ে এসে নিচু স্বরে ডাকল,’ভাইয়া!’
মাথা তুলল ওয়াজিদ।তার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি অনুসরণ করে নবনীতা জবাব দেয়,’ভাইয়া আমি এখন আসি?’
‘হুম।আসো।’
‘ধন্যবাদ ভাইয়া।’
আর কথা বাড়ায় না সে।মাথা নিচু করে শম্বুক গতিতে বেরিয়ে আসে জনমানবপূর্ণ হসপিটাল থেকে।
নিজের জায়গা থেকে উঠে দাঁড়ায় ওয়াজিদ।এগিয়ে যায় হাসপাতালের একেবারে সামনে কাঁচের থাই গ্লাসের দিকে।দৃষ্টি রাখে বাইরের দিকে।দুই মিনিট গড়াতেই হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসে একজন তরুণী।বের হতেই চলার গতি বাড়ায় সে।ওয়াজিদ ডান হাত তুলে কাঁচের গ্লাসে তার প্রতিবিম্ব ছুঁয়ে দেয়।ঠোঁটে ফুটে ওঠে অস্পষ্ট হাসি,পরক্ষণেই আবার সেই হাসি মিলিয়ে যায়।নীল শাড়ি জড়ানো নীলাঞ্জনা এতো চমৎকার কেন?তার ভেতর যেই স্বচ্ছ হৃদয় আছে,সেই হৃদয়ের প্রশংসা কেমন করে করবে ওয়াজিদ?
তেইশোর্ধ তরুণী সময়ের সাথে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়।ওয়াজিদ নিরবে হেঁটে তার আগের জায়গায় গিয়ে বসে।আরহাম হাতে গু*লি খেয়েছে।প্রা’ণনা’শের আশঙ্কা নেই।কিন্তু যদি সুস্থ হতে খুব বেশিদিন লেগে যায়?এই সময়ে তো প্রতিটা সেকেন্ড তার জন্য মূল্যবান।ওয়াজিদ মাথা নামিয়ে নেয়।দুশ্চিন্তারা যেন পিছুই ছাড়ছে না।
.
.
.
.
কাগজপত্রের ঝুট ঝামেলা সামলে বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখতেই সূর্যের প্রখর তাপে কপাল কুঁচকায় আদি।গলার কাছে ঝুলানো সানগ্লাসটা চোখে পড়েই বিরক্ত হয়ে বলে,’বাপরে বাপ! বাংলাদেশ কি দুবাই হয়ে গেল নাকি?এতো গরম কেন?’
সে দ্রুত পকেট থেকে ফোন বের করে আরহামের নম্বরে ডায়াল করে।যতবারই ফোন দিচ্ছে ততবারই রোবটির সুরে নারী কন্ঠটি বলে উঠছে,’দুঃখীত! আপনার ডায়ালকৃত নম্বরে ই মুহুর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না’।
আদি কান থেকে ফোন সরিয়ে বিক্ষিপ্ত মেজাজে বলে উঠল,’ধুর বা*ল! শা’লা ঢাক ঢোল বাজিয়ে দাওয়াত দিয়ে এখন নিজেই আর ফোন ধরে না।’
আরহামকে না পেয়ে আদি ওয়াজিদের নম্বরে ডায়াল করে।পঞ্চম বার রিং হতেই ওয়াজিদ কলটা রিসিভ করল।সে কিছু বলার আগেই আদি চটে যাওয়া মেজাজে বলল,’কিরে ভাই! দেশে আয়,দেশে আয় বলে মা’থা খে’য়েছিস।এখন দেশে আসতেই আর কোনো পাত্তা নেই?’
অন্য পাশ থেকে কি জবাব এলো জানা নেই কিন্তু জবাব শুনতেই আদি ভড়কে গিয়ে বলল,’কি?কি বলিস ওয়াজিদ?কখন হলো এসব?কিভাবে হলো?মাই গড! আর ইউ সিরিয়াস?’
.
.
.
.
রিমি দের বাড়ি গিয়ে চিত্রাকে নিয়ে আর এক মুহূর্তও দেরি করল না নবনীতা।রিমি যদিও তাকে বলছিল একটু বিশ্রাম করে যেতে কিন্তু নবনীতা সে কথা শুনেনি।তার মাথা ঘুরছে।বাড়ি গিয়ে ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমুতে হবে।
চিত্রাকে নিয়ে বাড়ি আসতেই নবনীতা টের পেল বাড়ির পরিবেশ আজ থমথমে।মামি কেমন থম মেরে বসে আছে।মুখটা গোমড়া।নবনীতা চুপচাপ তার ঘরে গেল।তাকে দেখতেই শুভ্রা এগিয়ে এলো।নবনীতা তার কাঁধে হাত রেখে ক্ষীণ স্বরে জানকে চায়,’খেয়েছিস শুভি?’
শুভ্রা কেবল অসহায় চোখে ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।মুখ কালো করে বলে,’আজ নাকি রান্না হয়নি।’
নবনীতা এক হাত মাথায় চেপে খাটের ধাঁর ঘেঁষে বসল।ক্লান্ত স্বরে জানতে চাইল,’কেন?কারণ টা কি?’
‘প্রথা আজ বাড়ি এসে খুব চিৎকার চেঁচামেচি করেছে।মামার পেনশনের টাকা টা যেন ব্যাংক থেকে তুলে তাকে দিয়ে দেয়।সে নাকি কিসব বিজনেস করবে।ক্যারিয়ার গোছাবে।’
‘সে ক্যারিয়ার গোছাবে?তার মধ্যে সেই তাড়না আছে?’ তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে জানতে চায় নবনীতা।
শুভ্রা নিচু স্বরে বলে,’ঐ আরকি! টাকা নিয়ে খুব চিল্লাফাল্লা করেছে।মামিও এটা সেটা বলেছে।’
‘মামি কার পক্ষে?প্রথা না মামা?’ চোখ সরু করে জানতে চায় নবনীতা।
‘প্রথার পক্ষে।বলছিল যে প্রথা বড় হয়েছে।এখন তো তার ভবিষ্যৎ তাকেই গোছাতে হবে।টাকা পয়সা তো সব তার জন্যই।হেন তেন কতো কিছু।’
জবাবে নবনীতা কেমন মাথা নিচু করে হাসল।তারপর তার ব্যাগ থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট টা বের করে শুভ্রার হাতে তুলে দিলো।অফিস রুমে যাওয়ার আগে সে রিমির কাছে তার ব্যাগটা রেখে গিয়েছিল।এতো কিছুর মাঝেও রিমি সেটা হাতছাড়া করেনি।
শুভ্রা প্যাকেট হাতে নিয়েই বলল,’তুমিও এতোক্ষণ না খেয়ে আছো আপাই?এটা নিশ্চয়ই তোমাকে দিয়েছিল খেতে।’
নবনীতা দু’হাত খাটে রেখে মাথাটা আস্তে করে পেছনের দিকে এলিয়ে দেয়।বিবশ কন্ঠে বলে,’হুম।খাইনি।তুই একটা প্লেটে নিয়ে নিজে খেয়ে আমাকেও একটু খাইয়ে দে তো শুভি।’
শুভ্রানী তার কথা মতোই প্লেট এনে নিজে খাওয়ার ফাঁকে তাকে খাইয়ে দিলো।চিত্রা বাড়ি ফিরেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।খাওয়া শেষে নবনীতাও শাড়ি পরা অবস্থা তেই বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজে।ভেতর টা কেমন অস্থির লাগছে।হাত টা এখনো কাঁপছে।কে জানে লোকটার জ্ঞান ফিরেছে নাকি?
নবনীতা চোখ বুজতেই শত রকম দুশ্চিন্তা এসে তার মস্তিষ্কে হানা দিলো।সে মনে করার চেষ্টা করে ঘটনাস্থলে সে সময় কোনো সাংবাদিক ছিল কি?সে খুব করে চাইছে তার আর আরহামের কোনো ফুটেজ যেন মিডিয়ার হাতে না যায়।সে এই লাইট ক্যামেরার জগৎ থেকে দূরে থাকতে চায়।সে চায় না আর কোনো নতুন সমস্যায় জড়াতে,চায় না অন্য কোনো নাম কিংবা অন্য কোনো বিশেষণ এসে তার পাশে যুক্ত হোক।সে চায় নির্ঝঞ্ঝাট সাদামাটা জীবন।সেই জীবনে সে কিছুতেই লেমলাইটে আসতে চায় না,হতে চায় না আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।কি অ’সহ্যকর একটা সময় পার করছে সে!
.
.
.
.
আরহামেন জ্ঞান ফিরেছে কিছু সময় আগে।হাসপাতালের করিডোরে তার দলের ছেলেদের ভীড়।তাদের গুঞ্জন আর কোলাহলে তৃতীয় তালার পরিবেশ ভারি হয়ে যাচ্ছিল।
জ্ঞান ফিরতেই আরহাম সবার প্রথমে ওয়াজিদ কে দেখল।তার নিষ্প্রাণ চোখ জোড়া দেখতেই ওয়াজিদ মলিন হেসে বলল,’শা’লা পাক্কা রাজনীতিবিদ হয়েছিস দেখছি।ছু*রি চা*কু না,সোজা একদম গু*লি খেয়ে ফেলেছিস।’
কথার পিঠে আরহাম নিজেও হাসল।শরীরটা দুর্বল লাগছে।হাতে গু*লি খে’লেও ব্যথা সমস্ত শরীরেই হচ্ছে।আরহাম যন্ত্রনায় কা*তর হয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই সে নড়েচড়ে উঠে।চঞ্চল চোখে কেবিনের এদিক ওদিক দেখে।চোখ জোড়া ব্যস্ত হয় একটি স্বল্প পরিচিত মুখ দেখার আশায়।ওয়াজিদ জানতে চায়,’কাকে খুঁজিস আরহাম?’
উত্তর দেয় না সে।উত্তর দিতে তার অস্বস্তি হচ্ছে।শেষমেশ এক প্রকার বাধ্য হয়ে সে মিনমিনে স্বরে বলে,’সে কোথায়?’
‘সে টা কে? ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইলো ওয়াজিদ।
আরহাম পড়েছে মহা বিপাকে।কি জবাব দিবে সে?তার জবাবে ওয়াজিদ তাকে ক্ষেপাবে না তো?সে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলে,’ঐ নবনীতা আরকি।সে কোথায়?’
‘ওহহ সে! সে তো তোকে এডমিট করার পর পরই চলে গেছে।আমাকে অবশ্য বলেই গেছে।আমি ভাবলাম হয়তো তাড়া আছে।তাই বলেছি চলে যেতে।ঠিক করেছি না বল?’
অপরপাশের ব্যক্তিটি নিশ্চুপ থাকে কিছু সময়।শেষটায় তপ্ত শ্বাস ছেড়ে জানায়,’হু,ঠিকই করেছিস’
‘এসব কি ভাই?আমাকে পুরো শহর ঘুরাবি বলে দেশে এনে নিজেই গু*লি খে’য়ে হসপিটালে পড়ে আছিস!’ কেবিনের দরজা দিয়ে ভেতরে উঁকি দিয়ে মজার ছলে প্রশ্ন করে আদি।
তাকে দেখতেই মুখোভঙ্গি পাল্টে যায় আরহামে।চোখ দু’টো আনন্দে চকমক করে উঠে।এক লাফে উঠে বসার চেষ্টা করে সে।ওয়াজিদ আলতো করে তার কাঁধ চেপে ধ’মক দেয়,’পা*গল নাকি?চুপচাপ শুয়ে থাক।’
আদি নিজ থেকেই ভেতরে এলো।সে কাছে আসতেই আরহাম উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,’আদি! তুই! ফাইনালি দেশে এসেছিস তুই।’
‘হু ভাই।হাতে এবার বিশাল সময় নিয়ে এসেছি।তোর নির্বাচন,বিয়ে,বাচ্চা সবকিছু হওয়ার আগ পর্যন্ত দেশেই আছি।’
আরহাম হাসল।চোখ ঘুরিয়ে ওয়াজিদ কে দেখে বলল,’আমার আগে তো ওয়াজিদের বিয়ে হবে।আমরা মাথা*গরম মানুষ।আমাদের বউ হবে কে?ওয়াজিদ তো মেয়েদের সেই সো কল্ড গ্রিন ফ্ল্যাগ।দেখবি ক’দিন বাদেই মেয়েরা সব হুম’ড়ি খেয়ে পড়বে।’
ওয়াজিদ আড়চোখে একবার তাকে দেখে।এটা যে প্রশংসার আড়ালে খোঁচা সে ভালো করেই জানে।আদি হাই তুলতে তুলতে বলল,’ঘুমে চোখ ভে’ঙে যাচ্ছে ভাই।’
আরহাম সরু চোখে শুধায়,’কেন?বাড়ি যাসনি এখনো?’
‘আর কোথায়?আরিশ আর তাসনুভা এসেছিল।তাদের গাড়ির সাথে লাগেজ দু’টো পাঠিয়ে দিয়েছি।আসার পর থেকে এই হসপিটালেই ঘুরপাক খাচ্ছি।’
‘আরিশ আর তাসনুভা এসেছে?’ অবাক হয়ে জানতে চায় আরহাম।
‘অবশ্যই এসেছে।এখনো আছে,ওয়েটিং রুমে।’
আরহাম দুই দিকে মাথা নাড়ে।হতাশ ভঙ্গিতে বলে,’কি যে করে না ছেলে মেয়ে দুইটা! দেখি একটু ডেকে দে তো।দেখা করে বাড়ি যাক।তাসনুভার তো রাতে আগে আগে ঘুমুতে হয়।’
তাসনুভা আর আরিশ কেবিনে আসতেই আরহাম মলিন হাসল।তার এই জীর্ন রূপ থেকেই তাসনুভা ঠোঁট ভে’ঙে কেঁদে দিলো।সে আগেও কয়েক দফা কেঁদেছে।আরহাম মুচকি হেসে তার মাথায় হাত ছোঁয়ায়।মিছেমিছি ধ’মক দিয়ে বলে,একদম মেয়েদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবি না তো তাস! অসহ্য লাগে।’
তাসনুভা কান্না থামালো।কিন্তু থেমে থেমে আবার ফুপিয়ে উঠছিল।আরহাম হাসপাতালের বেডের সাথে হেলান দিয়ে বলল,’বুঝলিরে তাস,আমি অনেক বড় মাপের রাজনীতিবিদ হয়ে গেছি।শত্র*তার বশে কেউ আমাকে গু*লি করতে পারে সেটা তো আমি ভাবতেই পারিনি।মন্দ না ব্যাপারটা।নিজেকে খুব উঁচু মানের মানুষ মনে হচ্ছে।’
তাসনুভা আর আরিশ আরো কিছুক্ষণ ছিল।পরে রাত হয়ে যাওয়ায় তারা দু’জন বাড়ি ফিরে গেল।তাদের সাথে আদিও বাড়ি গেল।বেচারা একটানা জার্নি করে একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময়টুকুও পায় নি।তারা যাওয়ার পর আরহামের দলের ছেলেরা একবার একবার করে একনজর তাকে দেখে গেল।আরহাম কেবল স্মিত হেসে বলল,’একদম ভালো আছি।কালকেই ডিসচার্জ হয়ে বাড়ি ফিরব।’
ওয়াজিদ আড়চোখে তাকে দেখে পুনরায় মাথা নামিয়ে নেয়।বিড়বিড় করে বলে,’এসেছে আমার ডাক্তার! নিজে নিজে ঘোষণা দিচ্ছে কবে তার ডিসচার্জ হবে।যত্তসব!’
আরহাম তাকে দেখে সন্দিহান চোখে বলল,’কি রে?তুই যাবি না?’
‘নাহ,রাতটা এখানেই আছি।’ গম্ভীর মুখে জবাব দেয় ওয়াজিদ।
এতো এতো শারীরিক যন্ত্রণার মাঝেও আরহাম শব্দ করে হাসল।একহাত বাড়িয়ে ওয়াজিদের পিঠ চাপড়ে বলল,’ওয়াজিদ! বন্ধু তুই আমার,বাপ না।’
ওয়াজিদ এক ঝাড়ায় তার কাঁধ ছাড়িয়ে নিল।বিরক্ত মুখে বলল,’বাজে বকিস না তো।ভালো লাগছে না।’
আরহাম চুপ থাকল কিছুক্ষণ।স্থির চোখে সামনে বসা ছেলেটা কে দেখল।তারপরই এক গাল হেসে বলল,’লাভ ইউ ম্যান।তোর মতো করে কেউ আমার কথা ভাবে না।’
ওয়াজিদ শুধু মাথা নামিয়ে মুচকি হাসে।কোমল এবং নিচু স্বরে বলে,’তোর মতো অবুঝপনাও কেউ করে না আরহাম।’
ওয়াজিদ বেডে পাশের টুল থেকে উঠে কেবিনের এক পাশের কাউচে গিয়ে শোয়।ঘাড় ঘুরিয়ে আরহাম কে দেখে বলে,’ঘুমিয়ে যা আরহাম।একটু ঘুমালে শরীরটা ভালো লাগবে।’
আরহাম ঘুমানোর চেষ্টা করল।অক্ষ’ত হাতটা গালের নিচে রেখে আস্তে করে চোখ বুজল।চোখ বুজতেই বন্ধ চোখের পাতায় ভেসে ওঠে একেবারে অন্যরকম এবং অপ্রত্যাশিত একটি দৃশ্য।
আরহামের শক্ত পোক্ত শরীরটা এক আ’ঘাতেই তাল হারিয়ে ক্যাম্পাসের মাটিতে লু’টিয়ে পড়েছে।ঘটনার আকস্মিকতার সে একেবারে বিস্মিত,বাকরুদ্ধ।কেবল টের পেল গু*লিটা তার বাহু ছে’দ করে গিয়েছে।চারদিকে লোকজনের ছুটোছুটির শব্দ।সবাই নিরাপদ জায়গার খোঁজে ছুটছে।জীবন বাঁচানো ফরজ।আরহাম তো এখানে ভুল কিছু দেখে না।এরই মাঝে বুজে আসা চোখে সে দেখল তার থেকে কয়েক হাত দূরে একটি নারী কায়ার উপস্থিতি।অকস্মাৎ শব্দে ঘুরে দাঁড়িয়েছে সে।তার চোখেও একই রকম বিস্ময়।যেন সে মানতে পারছে না এই জায়গায় আরহাম আছে।
আর তারপর?নীল শাড়ি গায়ে জড়ানো নীলিমা কি জীবন বাঁচানোর উদ্দেশ্যে পালিয়ে গিয়েছিল বাকিদের মতো?সে কি বাকি মেয়েদের মতো চিৎকার করে উঠেছিল?
নাহ,নীলিমা পালায়নি।কিছু সময় থমকে ছিল অবশ্য।তারপরই সম্বিৎ ফিরে পেতে একদৌঁড়ে ছুটে এসেছিল আরহামের কাছে।সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে চে’পে ধরেছিল আরহামের ক্ষ’তস্থান।একদম অপছন্দের মানুষটি কে বাঁচানোর জন্য তার সে কি ব্যকুলতা! চটচটে র*ক্ত দেখতেই সে কেমন মিইয়ে গেল।কিন্তু হাত ছাড়ল না।আগলে ধরল গু*লিবি*দ্ধ শরীরটাকে।কথায় কথায় চোখ মুখ শক্ত করে ফেলা মেয়েটা ঐরকম পরিস্থিতিতেও ধ’মকে উঠল।মনে হলো যেন আদেশ করছে ‘চোখ বন্ধ করতে মানা করেছি না?’
আরহাম দ্রুত চোখ খুলে।বেডসাইড টেবিলে পানির বোতল রাখা ছিল।সে এক হাতে কোনোরকম সেটা খুলে কয়েক ঢোক পানি খেল।তারপর আবার চোখ বুঝল।এবার তার বন্ধ চোখ স্মরণ করল অপ্সরীর ন্যায় দেখতে একটি মুখ।যদিও দীর্ঘদিনের অবহেলায় তার মুখে একটা ক্লান্তির ছাপ পড়েছে,চোখের নিচে একটু আধটু কালি জমেছে,সুন্দর মুখটা হয়তো দায়িত্বের জাঁ’তাকলে পি’ষে নিজের লাবন্য হারিয়েছে কিছুটা,কিন্তু যেই অপার্থিব সৌন্দর্যে স্রষ্টা তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন,সেই সৌন্দর্য কি একটুও মলিন হয়েছে?হয়নি তো।আরহাম তো খুব কাছ থেকে সেই সৌন্দর্য পর্যবেক্ষণ করেছে।
অকস্মাৎ চোখ খুলে আরহাম।নিজের অবচেতন মনের কার্যকলাপে নিজেই ভীষণ বিরক্ত হয়।এসব কেমন আচরণ?সে এতো কেন ভাবছে মেয়েটি সে নিয়ে?কে ঐ মেয়ে?সাহায্য করেছে এজন্য আরহাম তার কাছে কৃতজ্ঞ।এই তো।আর তো কিছু ভাবার নেই তাকে নিয়ে।
কিন্তু মনের উপর কবেই বা কোনো ব্যক্তিসত্তার নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ছিল?সে তো ভেবে যায় নিজের মতোন করে,সকল বাস্তব অবাস্তবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে।বার বার মনে হয় সে তো চলে গেলেও পারতো।কিন্তু সে যায়নি।কেন যায় নি?কেনো এতোখানি সহানুভূতি দেখাল?সে তো আরহামের কাছের কেউ না।
আরহাম রাতভর ছটফট করে।তার জেদ হচ্ছে,রাগ হচ্ছে।এতো এতো গন্ড*গোলেও যখন নিজের বিপদের চিন্তা না করে আরহামের প্রাণ বাঁচাতে ছুটে এসেছিল,তখন আরো কিছু সময় অপেক্ষা করে আরহামের জ্ঞান ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করল না কেন?এতো কিসের তাড়া তার?
নিজের গালে নিজেই চড় মা’রে সে।বিড়বিড় করে কতোক্ষণ নিজেকেই আচ্ছা মতোন বকু’নি দেয়।দাঁত কিড়মিড় করে বলে,’বা*লের সাবকনশাস মাইন্ড! ঘুমা আরহাম ঘুমা।তোর মতিভ্রম হচ্ছে।পটাপট ঘুমিয়ে যা।সকালে উঠতেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’
চলবে-