#কোনো_এক_শ্রাবণে
কলমে #মেহরিমা_আফরিন
(১২)
“আপাই এই লাল শাড়িটা পরে দেখো না,ভীষণ মানাবে তোমায়।নতুন বউয়ের মতো দেখাবে একদম।”
শুভ্রানী আলমারির তাক থেকে গাঢ় লাল শাড়িটা বের করে নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিলো।নবনীতা চোখ কপালে তুলে বলল,’ধ্যাত।এটা কেমন কড়া রং।আমি কি বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি?’
শুভ্রানী বিরক্ত হয়ে আলমারি ঘেটে আরো একটা শাড়ি বের করল।গাঢ় নীল রঙের শাড়ি,ধূসর পাড়।সেটা নেড়ে চেড়ে সে বলল,’তাহলে এটা পরো।সুন্দর লাগবে তোমায়।’
নবনীতা চোখ রাঙিয়ে একটানে তার হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে ঈষৎ ধ’মকে উঠে বলল,’আমাকে নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।তুই যা,পড়তে বস গিয়ে।’
শুভ্রা কাচুমাচু মুখ করে বলল,’এমন করো কেন আপাই?এটা তো সত্যি অনেক সুন্দর।এ্যাই চিত্র! বল তো এই শাড়িটা খুব সুন্দর না?’
চিত্রা একনজর শাড়িটা দেখে ঠোঁট গোল করে বলল,’খুব’
নবনীতা জহুরি চোখে ধূসর পাড়ের গাঢ় নীল শাড়িটা দেখল।এটা কি কালচারাল ফেস্ট হিসেবে বেশি চকমকে দেখাচ্ছে?তার মস্তিষ্ক জবাব দেয়,’এটাতে অতো কাজ নেই নবনী,এটাই পরে নে।’
নবনীতা শাড়িটা হাতে নিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিলো।ক্লান্ত স্বরে বলল,’শাড়ি সামলাতে ভীষণ কষ্ট হয় রে শুভি! সেজন্য পরতে চাই না।’
‘অথচ শাড়িতে তোমায় খুব ভালো লাগে আপাই! তুমি অতো ভেবো না তো,আমি সুন্দর করে পিন আপ করে দিবো।তুমি চটপট পরে নাও এটা।’
নবনীতা নির্বিকার ভঙ্গিতে শাড়ির ভাজ খুলে আরো একবার সেটা দেখল।আজ তাপমাত্রা কতো?এই গরমে সে শাড়ি পরে টিকবে কেমন করে?সে জানালার ধাঁরে গিয়ে বাইরে উঁকি দেয়।ঠোঁট গোল করে শ্বাস ছেড়ে বলে,’বাপরে! কি ভ্যাপসা গরম পড়েছে দেখেছিস?’
শুভ্রানী ঠিক পাখার নিচ বরাবর বসে তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল,’ভ্যাপসা গরমের পর প্রচন্ড বৃষ্টি হয়।আজ বোধ হয় বৃষ্টি হবে।চট্টগ্রামে কালকে সারাদিন বৃষ্টি হয়েছে।’
নবনীতা জানালা থেকে মুখ সরিয়ে অলস ভঙ্গিতে বলল,’ইশশ! কোথায় চট্টগ্রামের আবহাওয়া,আর কোথায় এই ঢাকার আবহাওয়া! কয়দিন পর দেখবি ঢাকায় উট চলছে।’
শুভ্রা মুখ টিপে হাসে।আপাইের চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি।গরমে অস্থির দেখাচ্ছে তাকে।নবনীতা এগিয়ে এসে শাড়িটা শুভ্রার হাতে ধরিয়ে বলল,’পুরোটা তুই পরাবি।আমি পরতে পারব না।আলসেমি লাগছে।’
শুভ্রা এই প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করল।শাড়ি পরতে আর পরাতে,দু’টোই শুভ্রার ভীষণ ভালো লাগে।সে মিনিট দশেকের মাথায় খুব সুন্দর করে নবনীতাকে শাড়ি পরালো।সেফটিপিন দিয়ে সবকিছু ঠিকঠাকও করে দিলো।শাড়ির আঁচল টা ফেললো নবনীতার হাতের উপর।নবনীতা চোখ সরু করে বলল,’এভাবেই থাকবে?কাঁধে তুলবি না?’
‘না না।ওভাবে ভালো লাগে না।এটাই সুন্দর।’ তাড়াহুড়ো করে জবাব দেয় শুভ্রানী।
নবনীতা চোখ পাকিয়ে কিছু বলতে গিয়েও পরে আর বলল না।আয়নাতে তার প্রতিবিম্ব ফুটে উঠেছে।নাহ,তাকে একদমই মন্দ দেখাচ্ছে না।
শুভ্রানী তাকে শাড়ি পরানোর পর চিত্রাকেও খুব সুন্দর একটা জামা পরিয়ে দিলো।চিত্রার জামার রং ও নীল।নবনীতা পেছন ঘুরে তার জামাটা না দেখেই বলল,”আরামের জামা পরিয়েছিস তো?খুব গরম কিন্তু বাইরে।অতো ভারি কিছু পরাস না কিন্তু।”
শুভ্রা চিত্রার চুল বাঁধার ফাঁকে জবাব দেয়,”একদম নরম জামা! কোনো সমস্যা হবে না।”
নবনীতা আয়নার সামনে দাঁড়ায়।শাড়ির সাথে সামান্য সাজলে মন্দ হয় না।সমস্যা হচ্ছে তার কাছে অতো শত সাজের জিনিস নেই।দুইটা লিপস্টিক,ভ্যাসলিন,কাজল আর পাউডার-প্রসাধনী বলতে নবনীতার ছোট্ট ঘরে এগুলোই আছে।
নবনীতা কাজল হাতে নিয়েই আবার কি মনে করে সেটা রেখে দিলো।দ্রুত তার ফোনটা হাতে নিয়ে রিমিকে কল দিলো।রিসিভ হতেই দ্রুত প্রশ্ন ছুড়ল,”রিমি রে! তুই কি কাজল দিবি?”
অন্যপাশ থেকে রিমি আশ্চর্য হয়ে জবাব দেয়,’অদ্ভুত প্রশ্ন করছিস নবনী! কালচারাল ফেস্ট! শুধু কাজল কেন,ঘরে যা আছে সব মেখে আসবো।’
নবনীতা জবাবে কেবল হাসল।মাথা নেড়ে বলল,’আচ্ছা ঠিক আছে।’
‘তুই রেডি?’
‘হু।তুই?’
‘এই তো।এখনই বের হবো।’
‘আমিও।’
নবনীতা কথা শেষ করে ফোন কা’টে।শুভ্রা এগিয়ে এসে বলল,’আপাই তোমার চুলে একটা খোপা করে দেই সুন্দর করে?’
নবনীতা ভ্র কুঁচকে জানতে চায়,’খোপা আবার সুন্দর করে কীভাবে করে?খোপা তো খোপাই।’
শুভ্রা তার কাঁধে হাত চেপে তাকে খাটে বসাতে বসাতে জবাব দেয়,’আহা তুমি বসো তো।আমাকে বাকি কাজ করতে দাও।’
নবনীতা বসল।শুভ্রা গুনে গুনে সতেরো মিনিট সময় নিল।নবনীতা শেষমেষ অধৈর্য হয়ে বলল,’শুভি আমি কেবল একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছি,কারো বিয়ে তে না।’
শুভ্রা তার ধ’মক গায়ে মাখল না।চুল বেঁধে সে নিজেই তার চোখে কাজল পরালো,ঠোঁটে লিপস্টিক দিলো।নবনীতা আশ্চর্য হয়ে বলল,’তোরা সবসময় আমাকে নিয়ে এতো মাতামাতি করিস কেন?আমি কি শাবানা নাকি ববিতা?এতো বিউটিফাই করবি না তো আমাকে।আমি খুব অর্ডিনারী পার্সন।’
কথা শেষ করেই সে উঠে দাঁড়ালো।আয়নায় তাকে দেখা যাচ্ছে।অনেক দিন পর তার মুখটা সামান্য প্রসাধনীর ছোঁয়া পেয়েছে।শুভ্রা তার চুল খুব সুন্দর করে বেঁধেছে। খোপা করার পাশাপাশি সিঁথির দুই পাশে চুল গুলোকে খুব সুন্দর করে হেয়ার ক্লিপ দিয়ে সেট করেছে।নবনীতা একবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে পেছন ঘুরে শুভ্রাকে দেখতেই তার গালে হাত রেখে বলল,’চুল বাঁধা টা তো খুব সুন্দর হয়েছে।কোথায় শিখলি?’
শুভ্রা হাসি মুখে জানায় এন্যুয়াল ফাংশনে একজন এভাবে বেঁধেছিল।সেখান থেকেই শিখলাম।তোমাকে একদম পুতুলের মতো লাগছে আপাই।মনে হচ্ছে তুমি সত্যি সত্যি পরী আপাই!’
নবনীতা হাসল।পরক্ষণেই আবার শুভ্রাকে তাড়া দিয়ে বলল,’যা তুই তাড়াতাড়ি ড্রেস পর।তোকে কলেজে নামিয়ে আমি আর চিত্র ভার্সিটি যাবো।’
.
.
.
.
‘ভাই,ভাই! ঐ দেখেন লেডি ডন আসছে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের ভেতরে তখন আরহাম আর তার দলের ছেলেরা দাঁড়িয়েছিল।আরহাম অবশ্য এতোক্ষণ অফিসরুমের ভেতরে ছিল।কয়েক মিনিট আগেই সে বেরিয়ে এসেছে।বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষে অসংখ্য ছেলে মেয়ারা আসছে।এরই মাঝে তোফায়েলের কথায় চোখ জোড়া আপনাআপনি সরু হয় আরহামের।সহসা সে ঘুরে দাঁড়ায়,চোখ রাখে মূল ফটকের দিকে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক দিয়ে তখন ভেতরে প্রবেশ করছিল একটি তরুণী।তার এক হাত শাড়ির কুচি সামলাতে ব্যস্ত,অন্য হাতের মুঠোয় একটা ছোট্ট হাত বন্দি।আরহাম গভীর চোখে সেই দৃশ্য দেখে।মেয়েটি আরহামের পূর্ব পরিচিত।যদিও খুব একটা মধুর না সেই পরিচয়,তবুও পরিচিত তো।মেয়েটির নাম নবনীতা।
পাশ থেকে তামজিদ মজার ছলে বলল,’বাংলার মাদার তেরেসা এসেছেন।সাইড হয়ে দাঁড়া সব।’
ভীড়ের মাঝে অন্য কেউ বলল,’ধুর হয় নি।বল যে ফাটাকেষ্ট নবনীতা এসেছে,যে কি-না এক নিমিষেই পুরো সিস্টেম চেঞ্জ করে দিতে চায়।’
রনি দাঁত কেলিয়ে ব্যঙ্গ করে বলল,’আমার কাছে কিন্তু আপার দাবাংগিরি সেই লাগে।আমার জন্য সে দাবাং নবনীতা।’
অন্য দিক থেকে মত আসে,’উহু।সে হলো দাঁত কিড়মিড় নবনীতা।দেখিস না,সারাক্ষণ কেমন দাঁত কিড়মিড় করে কথা বলে।যেন আমাদের সাথে তার পুরোনো শত্রু*তা।’
আরহাম হাসল।কটাক্ষ করে বলল,’স্টুপিড।পুরাই একটা স্টুপিড মেয়ে।আত্মসম্মানে ভরপুর সো কল্ড সুশীল নাগরিক।হেহহহ!! সামনে এলেই রাগ ওঠে।’
এতো এতো মতামতের মাঝে সবচেয়ে ভিন্ন মতামত দিলো ওয়াজিদ।সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সামনে দেখে বলল,’নীলাঞ্জনা।নীল পরী নীলাঞ্জনা।’
আরহাম নাক ছিটকে বলল,’কি?নীল পরী নাচে না?কেনো নাচে না?’
বলেই ফিক করে হেসে দিলো।ওয়াজিদ থমথমে মুখে বলল,’ইয়ার্কি হচ্ছে?’
আরহাম কপাল কুঁচকে বলল,’তবে কি হচ্ছে?তুই ও তো ইয়ার্কিই করছিস।’
হকচকিয়ে ওঠে ওয়াজিদ।সে কি সবার সামনেই কথাটা বলেছে?কি সর্বনাশা কথা।সে দ্রুত মাথা নেড়ে বোকা বোকা হেসে বলল,’ঐ আরকি।একটু মজা করলাম।’
আরহাম সামনে ফিরল।নবনীতার থেকে তাদের দূরত্ব বেশ কয়েক মিটারের।নবনীতার সাথে থাকা ছোট্ট মেয়েটিকে আরহামের ভালো লেগেছে।মেয়েটির মুখ গোলগাল,মায়াভরা মুখ।দেখলেই আদর দিতে ইচ্ছে হয়।অথচ এর সাথেই যে মেয়েটি দাঁড়ানো তার ব্যাপার সম্পূর্ণ ভিন্ন।একে দেখলেই আরহামের মন চায় তার দুই গালে চটাশ চটাশ করে চ/ড় দিতে।কি ভোগান্তিই না ভুগতে হয়েছে আরহাম কে এই মেয়ের জন্য!
নবনীতা চিত্রার হাত ধরে অন্য পাশে চলে গেল।আজ সে শাড়ি পরেছে।সচরাচর সে শাড়ি পরে না।তোফায়েল সে দিকে দেখেই বলল,’তবে যাই বলেন মেয়েটা কিন্তু হেব্বি ভাই।একেবারে নায়িকা।কেবল মুখ খুললেই আসল রূপ বেরিয়ে আসে।’
আরহাম সে কথায় কর্ণপাত করে না।সে কেবল পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে এপাশ ওপাশ দেখে গম্ভীর মুখে বলে,’আমরা কিন্তু আজ একটা কাজে এসেছি এদিকে।আমাদের সেটাতেই মনোযোগ দেওয়া উচিত।’
.
.
.
.
রিমি অপরাধীর মতো মুখ করে চোখ তুলে সামনে তাকায়।তার সামনে অগ্নিমূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে নবনীতা।রিমি বসে আছে অডিটোরিয়ামের বেঞ্চে।তার পাশের সিটে বসে আরামে পা দোলাচ্ছে চিত্রা।নবনীতা এখনো বসে নি।অডিটোরিয়ামে প্রবেশ করা মাত্র তার মেজাজ বিগড়ে গেছে।
অডিটোরিয়ামের স্টেজে বড় ব্যানারে লিখে রাখা হয়েছে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও আলোচনা সভা’
আয়োজনে-সাধারণ শিক্ষার্থীবৃন্দ
পৃষ্ঠপোষকতায়-শেখ শাহরিয়ার আরহাম
নাম দেখেই নবনীতা আকাশ থেকে পড়ল।এই কালচার ফেস্ট মূলত আরহামের নির্বাচনী প্রচারণার অংশ মাত্র।রিমি নিশ্চয়ই সবটা জানতো।তা স্বত্বেও তাকে কিছুই খুলে বলে নি।নবনীতা কটমট করে বলল,’এটা ঠিক না রিমি।তুই জেনে বুঝে আমাকে ঐ আরহামের আয়োজন করা অনুষ্ঠানে নিয়ে এসেছিস।এমনটা তুই না করলেই পারতি।’
রিমি কাচুমাচু মুখে জবাব দেয়,’আরহাম ভাই একা তো আয়োজন করেনি।আমরা স্টুডেন্ট রা করতে চাইছিলাম।ভাইয়া কেবল সেটার পরিধি বাড়িয়েছেন আর পারমিশন এনে দিয়েছেন।ব্যাস এই টুকু।’
‘ব্যাস এইটুকু?বাইরে যে তোর ভাই বিশাল বহর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে,এদের কাজ কি?আলোচনার নামে তো নিজেরই গুনগান করবে।’
রিমি তার দুই হাত চেপে মোলায়েম স্বরে বলল,’আচ্ছা তুই প্লিজ বোস।এটা তো আমাদের জন্যই আয়োজন করা হয়েছে।আমরা ভার্সিটির স্টুডেন্ট।সমস্যা কি?কেউ আয়োজন করলে সেটাতে উপস্থিত হতে তো সমস্যা নেই তাই না?’
নবনীতা কিছু বলার আগেই রিমি আঙুল তুলে বলল,’দেখ তুই কিন্তু বলেছিস আরহাম ভাইয়ের সাথে তোর কোনো ব্যক্তিগত শত্রু*তা নেই।তাহলে সে অনুষ্ঠানে এলো কি এলো না,আয়োজন করল কি করল না তাতে আমাদের কি?আমরা আমাদের মতো এসেছি।মজা করবো,তারপর চলে যাবো।শেষ।আর কিছু তো জানার দরকার নেই আমাদের।’
নবনীতা তপ্ত শ্বাস ছেড়ে এদিক ওদিক মাথা নেড়ে।রিমির সাথে কথা বলে পারা যাবে না।সে একশো রকম যুক্তি দিয়ে তার কথাই ঠিক প্রমাণ করবে।সে আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ চিত্রার পাশটায় গিয়ে বসল।অডিটোরিয়াম আজ চমৎকার করে সাজানো হয়েছে।নিশ্চয়ই পুরোটাই আরহামের টাকা।অডিটোরিয়াম ভর্তি ছেলে মেয়ের মুখে শুধু আরহাম ভাইয়ের নাম।নবনীতা ভেঙচি কাটে।টাকা দিলেই সবাই ভালো হয়ে যায়।আজ আরহাম ভাই টাকা দিয়েছে,তাই সে ভালো।কাল অন্য কোনো ভাই টাকা দিলে দিনভর শুধু তার নামই জপতে থাকবে।এই হলো দেশের সামগ্রিক অবস্থা!
নবনীতার পেঁচার মতো করে রাখা মুখটা দেখেই রিমি ঠোঁট টিপে হাসল।মিষ্টি সুরে বলল,’চল না একটু হেঁটে আসি।’
নবনীতা তার এক কথাতেই রাজি হলো।চিত্রার হাত টা শক্ত করে ধরে নির্বিকার হয়ে বলল,’চল তাহলে।’
***
রিমি একটা ফুচকা মুখে দিয়েই দু’চোখ বন্ধ করে তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুল এক করে আমোদে গলায় বলল,’উফফ! দারুন হয়েছে! একদম মুচমুচে ফুচকা!’
নবনীতা অসহায় চোখে সেদিকে তাকায়।ইশশশ! রিমি বেয়া’দব টা কি সুন্দর ফুচকা খাচ্ছে! এভাবে চোখের সামনে কেউ ফুচকা খেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা যায়?নবনীতার ইচ্ছে করছে এক ছুটে স্টলের সামনে গিয়ে গপাগপ কয়েকটা ফুচকা মুখে ঠুস’তে।কিন্তু প্রবল আত্মসম্মানবোধ তাকে পেছন থেকে টেনে ধরেছে।এই স্টলের ব্যবস্থাও আরহাম নিজস্ব অর্থায়নে করেছে।নবনীতা তার টাকায় ফুচকা খাবে না।
কিন্তু মন তো মানে না।একদিক থেকে সতর্কবাণী আসে ‘নবনী তুই ভুলেও ঐ আরহামের টাকায় খাবি না’।প্রখর আত্মসম্মান যেখানে নবনীতার হাত পা বেঁধে রাখে,সেখানে মনের গহীন থেকে বার্তা আসে-‘কয়েকটা ফুচকা খেয়েই নে নবনী।এতো এতো মানুষের ভীড়ে কেই বা তোকে দেখবে?তাছাড়া তোর রাগ আরহামের সাথে।ফুচকার সাথে তোর কিসের রাগ?খেয়ে নে নবনীতা।কেউ দেখবে না।’
নবনীতা শাড়ির আঁচলে মুখ মুছে।কি সুন্দর ফুচকা আর টকের ঘ্রাণ আসছে।নবনীতার ইন্দ্রিয় সমূহ টেনে টেনে সেই ঘ্রাণ নিতে ব্যস্ত।অবাধ্য মন আকুপাকু করছে।কি হয় একটু খেলে?
নবনীতা বড় বড় দু’টো শ্বাস টানে।সব চিন্তা ভাবনা মান অভিমানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শাড়ির আঁচল সামলে এক ছুটে চিত্রাকে নিয়ে স্টলের সামনে যায়।ভীষণ চঞ্চল হয়ে বলে,’মামা আমাকে একদম ঝাল ঝাল এক প্লেট ফুচকা দিন তো।অনেক বেশি ঝাল দিবেন।’
রিমি আড়চোখে তাকে দেখে আবার নিজের খাওয়ায় মন দেয়।সে নবনীকে চেনে।সে জানত নবনীতা কিছুতেই এই লোভ সামলাতে পারবে না।নবনীতা ভয়ংকর রকমের ফুচকা প্রেমি।তার পৃথিবী একদিকে,আর ফুচকা অন্যদিকে।খাওয়ার ফাঁকে দু’জনের একবার চোখাচোখি হতেই দু’জন শব্দ করে হেসে উঠল।নবনীতা শাড়ির আঁচল মুখে চেপে লাজুক মুখ করে বলল,’ভাবলাম ফ্রিই যখন আছে,তখন একটু খেয়েই নেই।’
সে সময় আরহাম আর তার ছেলেরা খোলা করিডোরে জড়ো হয়ে কথাবার্তা বলছিল।আরহাম কে দেখতেই বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীরা সালাম দিলো।কেউবা সামনে এসে হ্যান্ডশেক করল,কোলাকুলি করল।আরহাম পুরোটা সময় মেকি হাসি বজায় রেখে সবার সাথে টুকটাক কথাবার্তা বলল।রোজ রোজ এতো মানুষের সাথে মিষ্টি কথা বলতে বলতে সে বিরক্ত।গত কয়েকদিন যাবত টানা হাসতে হাসতে তার গাল ব্যথা হয়ে গেছে।কিন্তু কিছুই করার নেই।জয়ী হওয়ার আগ পর্যন্ত এই মেকি হাসি নিয়েই তাকে থাকতে হবে।
হঠাৎই তার চোখ পড়ল করিডোর থেকে একটু দূরে ক্যাম্পাসের খোলা মাঠে।যেখানে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে ফুচকার স্টল বসানো হয়েছে।এগিয়ে গেল আরহাম।চোখের সানগ্লাসটা খুলে তীক্ষ্ণ নজরে দেখার চেষ্টা করল সামনের দৃশ্য।সামনে তাকাতেই তার চোখ জোড়া ক্ষণিকের জন্য স্থির হলো।সে করিডোর থেকে বেরিয়ে মাঠে এসে দাঁড়ায়।আশ্চর্য চোখে সামনে দেখে।
শুরু থেকেই ভীষণ তেজী আর গম্ভীর স্বভাবের যে মেয়েটিকে সে চিনে আসছে,সেই মেয়েটি কে সে আজ আবিষ্কার করল সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে।নীল শাড়ি গায়ে জড়ানো রমণীকে এই মুহূর্তে ভীষণ অন্যরকম দেখাচ্ছে।গভীর দু’টো চোখে সে কি চঞ্চলতা! ব্যস্ত কন্ঠে সে স্টলে দাঁড়ানো মাঝ বয়সী লোকটিকে বলছে,’মামা এই ফুচকায় একদমই ঝাল দেবেন না।বাচ্চা মানুষ।এতো ঝাল খেতে পারে না।’
বলা শেষ করেই সে তার প্লেট থেকে আরো একটা ফুচকা মুখে নিয়ে প্রসন্ন হাসল।সেই হাসি দেখে আরহামের নিজেরও হাসি পেল।জনদরদি,মারকাটারি আর প্রতিবাদী রমণীর এই কিশোরী রূপটা মন্দ না।তাকে কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের মতো দেখাচ্ছে।নবনীতার এই রূপের সাথে আরহাম পরিচিত না।
আরহাম এগিয়ে গেল।তার পেছন পেছন তোফায়েল আর তামজিদ হেঁটে আসে।তাদের দেখতেই আশেপাশের মানুষজন সরে দাঁড়ায়।আরহাম স্টলের সামনে গিয়েই কয়েকজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,’কেমন হয়েছে ফুচকা?’
মেয়েরা মিষ্টি করে হাসল।কেউ আবার আহ্লাদী গলায় বলল,’খুব ভালো হয়েছে ভাইয়া।’
নবনীতা তাকে দেখতেই বিষম খেল।মুখের ফুচকাটা ঠিক মতো খেতেও পারছে না।কেবল থমথমে আর বিষন্ন মুখে সে সামনে দেখে।এতো সুন্দর মন মেজাজ পুরোটাই বিক্ষিপ্ত হয়ে গেছে তার।আরহাম তাকে দেখেই একপেশে হাসল।এগিয়ে এসে তার মুখোমুখি হয়ে জানতে চাইল,’মিস নবনী! ফুচকা কেমন হয়েছে?’
নবনীতা অন্যদিকে ফিরে কাঠকাঠ স্বরে জবাব দেয়,’ভালো।’
আরহাম মুচকি হাসে।একবার নবনীতাকে আর একবার তার হাতে প্লেট টা দেখে।তারপরই কি ভেবে তার প্লেট থেকে একটা ফুচকা তুলে মুখের কাছে নিতে নিতে বলল,’দেখি তো নবনী আপা,ফুচকা কেমন হয়েছে।’
হকচকিয়ে ওঠে নবনীতা।অপ্রস্তুত হয়ে আশপাশ দেখে।সবাই চোখ গোল গোল করে তাদেরই দেখছে।সে চাপা স্বরে ধ’মকে উঠে,’এগুলো কেমন অ’সভ্যতা!’
আরহাম ফুচকা মুখে দেওয়ার দুই সেকেন্ডের মধ্যে চোখ বড় বড় করে নবনীতার দিকে দেখল।এটা ফুচকা নাকি মরিচের চচ্চড়ি?তার লাল হয়ে যাওয়া মুখটা দেখতেই নবনীতার হাসি পেল।একদম ঠিক হয়েছে।আর করবি এমন অ’সভ্য কাজ কারবার?
আরহাম ঝালে হু হা করতে করতে মুখ চেপে ধরল।তার চোখে পানি এসে গেছে।কিন্তু এতো মানুষের সামনে সে নিজের এই বেহাল দশা প্রকাশ করতে চায় না।সে শক্ত করে মুখ চেপে বহু কষ্টে ফুচকাটা গলাধঃকরণ করে।ভেতরটা ঝালে ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে।রিমি দ্রুত তার দিকে পানির বোতল এগিয়ে দিলো।আরহাম একটানে পুরোটা পানি খেয়ে শেষ করল।এখন একটু ভালো লাগছে।পানি শেষ হতেই সে নবনীতাকে দেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,’এতো ঝাল মানুষ খায়?এজন্যই তো কথা বার্তার এই অবস্থা।সাংঘা’তিক মেয়ে মানুষ!’
কথা শেষ হতেই আরহাম হনহনিয়ে চলে গেল।নবনী বাঁকা চোখে একবার সেদিকে দেখে পরক্ষণেই আবার গা ছাড়া ভাব নিয়ে নিজের খাওয়ায় মন দিলো।তার কি দোষ?ঐ লোক নিজেই এসেছিলেন জব্দ হতে।
রিমি এগিয়ে এসে উৎফুল্ল মুখে বলল,’ইশশ! তোর কি ভাগ্য! এতো এতো মেয়ের মাঝে আরহাম ভাই শুধু তোর সাথে কথা বলেছেন। আবার তোর প্লেট থেকে ফুচকাও খেয়েছেন। ইশশ! এমন ভাগ্য যদি আমার হতো! কি একটা ফাটাফাটি সিন! একেবারে দেখার মতো।আমার সাথে এমন কিছু ঘটে না কেনো?’
‘ভাগ্য না ছাই।’ ভেঙচি কেটে জবাব দেয় নবনীতা।
‘এসেছিল আমার সাথে পায়ে পা দিয়ে ঝগড়া করতে।এখন ঝালের চোটে কোনো কথা ছাড়াই কেটে পড়েছে।যত্তসব নেতা ফেতার দল!’
.
.
.
.
নবনীতা যা ভেবেছিল একদম তাই হয়েছে।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নামে দীর্ঘসময় কেবল নির্বাচনী প্রচারণা চলল।আরহাম সহ আরো অনেক নবীন নেতারা ভাষণ দিলো।আসন্ন নির্বাচন কে ঘিরে চলল দীর্ঘ আলোচনা।নবনীতা পাথরের মতো বসে বসে সবটা দেখল।মানুষ নিজের প্রশংসা নিজে কীভাবে করে এটা রাজনৈতিক নেতাদের না দেখলে বোঝা যায় না।এরা একটানা অনর্গল নিজের ঢোল নিজেই পেটায়।মানুষ এদের কি প্রশংসা করবে?নিজেরাই তো নিজেদের প্রশংসা করে কূল পায় না।সাথে আবার এদের কিছু চ্যালাপেলা আছে,যারা পুরো ঘটনা না শুনতেই সহমত ভাই সহমত ভাই করে চেঁচায়।এদের দেখলেই শরীর গিজগিজ করে নবনীতার।
দুপুর আড়াইটা নাগাদ অনুষ্ঠান শেষ হলো।সবার জন্য খাবারের আয়োজনও করা হয়েছে।নবনীতা মুখ শক্ত করে খাবারের প্যাকেট টা হাতে নিল।তোফায়েল তাকে দেখেই দাঁত কেলিয়ে হাসে।এই মেয়েটার কটমট চেহারা তোফায়েলের ভালো লাগে।রাগ চেপে রাখার কারণে তাকে অদ্ভুত দেখায়।নবনীতা প্যাকেট টা নিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়।তার খিদে নেই একটুও।বাড়িতে গিয়ে শুভির সাথে ভাগ করে খাওয়া যাবে।
রিমি জানতে চাইল,’একটু পরে সঙ্গীত সন্ধ্যার আয়োজন করা হবে।তুই কি থাকবি?’
‘পা’গল নাকি?মাথা খারাপ আমার?তুই থাকলে থাক।আমায় বাড়ি যেতে হবে।শুভির আসার সময় হয়েছে।’
রিমি তার পার্স ব্যাগটা হাতে নিয়ে ব্যস্ত গলায় বলল,’ধ্যাত! আমারও বাড়ি ফিরতে হবে।চল তাহলে।বেরিয়ে যাই আমরা।’
ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই নবনীতাদের ব্যাচমেট মোহনা তাদের সামনে এসে ঠান্ডা গলায় বলল,’নবনী একটু দাঁড়া তো।ইসমাইল স্যার রিসেন্ট প্রোজেক্ট নিয়ে কি যেন কথা বলবেন।তুই একটু অফিসে আয় তো।’
কথা শেষ করেই সে দ্রুত অফিস রুমের দিকে পা বাড়ায়।নবনীতা ক্লান্ত শ্বাস ছেড়ে চিত্রার হাত টা রিমির হাতে ধরিয়ে দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,’দেখি চিত্রা কে একটু ধর তো।আমি গিয়ে দেখে আসি আবার কি সমস্যা হয়েছে।’
রিমি চিত্রার হাত ধরেই মিষ্টি হেসে বলল,’চলো তো চিত্র।আমরা একটু হাঁটাহাঁটি করি।’
নবনীতা আঁচল সামলায়।ক্রদ্ধ পায়ে এগিয়ে যায় অফিস রুমের দিকে।ঘড়িতে দুইটা বেজে আটচল্লিশ মিনিট।শুভি নিশ্চয়ই বাড়ি এসে গেছে।কি খাবে মেয়েটা?মামি তো ঠিক মতো রান্নাও করে না ইদানিং।
অফিস রুমে যেতেই নবনীতা দেখল সে বাদেও প্রজেক্টের সাথে যুক্ত সবাইকেই এখানে ডাকা হয়েছে।তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না।টুকটাক আলোচনার জন্যই সবাইকে ডাকা হয়েছে।নবনীতা এক পাশে দাঁড়িয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে ইসমাইল স্যারের কথা শুনছিল।
আচমকা বিকট শব্দে পুরো অফিস রুম কেঁপে উঠল।ধড়ফড়িয়ে উঠল নবনীতা।একই শব্দের পুনরাবৃত্তি হলো পর পর কয়েকবার।আশেপাশের সবাই একজন অন্য জনের মুখ দেখাদেখি করছিল।ঘটনা কি সেটা কেউই ঠাহর করতে পারছে না।নবনীতা আতঙ্কিত নয়নে এদিক সেদিক তাকায়।এই শব্দ সে চেনে।এই শব্দে তার খুব ভয়।
কিছু সময় যেতেই বাইরে থেকে মানুষ জনের ছুটোছুটি আর চিৎকারের শব্দে তার শরীর হিম হয়ে এলো।শিরদাঁড়া দিয়ে বয়ে গেল শীতল ধারা।কেউ একজন ছুটতে ছুটতে অফিস রুমে এসে জোরে জোরে শ্বাস ফেলে বলল,’কেউ রুম থেকে বের হবে না।বাইরে ভীষণ গোলা’গু’লি হচ্ছে।বিরোধী দলের রাকিবের লোকজন বাইরে খুব ঝামেলা করছে।সবাই ভেতরেই থাকুন।’
কথা শেষ করেই সে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে অন্য রুমের দিকে ছুটল।খবর টা সবার নিকট পৌঁছে দেওয়া জরুরি।কক্ষে উপস্থিত সবার মুখ আতঙ্কে ছেয়ে গেল।নবনীতার শরীর ক্রমশ শীতল হয়ে যাচ্ছে।গো’লাগু’লি হচ্ছে মানে?কি বলছে এসব?বাইরে তো চিত্র আছে,রিমি আছে।
চিত্র’র কথা ভাবতেই আঁতকে উঠে সে।বড় বড় করে শ্বাস টানে।আর্ত’চিৎকার করে বলে,’আমার চিত্র! আমার চিত্র!’
সে প্রাণপণ ছুটে যায় দরজার দিকে।মোহনা তার হাত ধরে চমকে উঠে বলে,’কি করছিস নবনী?বাইরের পরিস্থিতি খারাপ।এখন বাইরে যাসনে।’
নবনীতা এক ঝটকায় তার হাত ছাড়িয়ে নেয়।উন্মা’দের মতো ছুটে যায় বাইরের দিকে।ফুঁপিয়ে উঠে বলে,’আমার চিত্র বাইরে।আমি এদিকে কেমন করে থাকব?’
অফিস রুম থেকে বেরিয়ে সামনে দেখতেই নবনীতা স্তব্ধ হয়ে গেল।চারদিকে কেমন বিবর্ণ বি’ধ্বস্ত অবস্থা।একটু আগেই যেই উৎসব উৎসব আমেজ ছিল চারদিকে,তার পুরোটাই মাটি হয়ে গেছে।কি বিবর্ণ দেখাচ্ছে সবকিছু! চারদিকে শুধু হা’হা’কার আর হা’হা’কার!
নবনীতা ছুটে এলো ঠিক সে জায়গায় যেখানে সে রিমি আর চিত্রকে রেখে এসেছিল।অথচ সে জায়গা এখন একদম ফাঁকা।ব্যাগে রাখা মুঠোফোন টা কর্কশ শব্দে বাজছে।নবনীতা দ্রুত সেটা বের করল।রিমির কল।রিসিভ করেই নবনীতা প্রচন্ড উৎকন্ঠা মেশানো গলায় বলল,’রিমি তুই কোথায়?আমার চিত্র কোথায়?’
ফোনের ওপাশে সাউন্ড গ্রে’নেড ছোঁড়ার শব্দে অন্য শব্দ ঠিকঠাক শোনা যাচ্ছিল না।রিমি গলায় আওয়াজ চওড়া করে জানাল চিত্রা তার সাথেই আছে।গো’লাগু’লি শুরু হতেই রিমি একটা সিএনজি ঠিক করে চিত্রাকে নিয়ে সেখান থেকে চলে এসেছে।কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় নবনীতা।হাঁফ ছেড়ে বলে,’একটু দেখে রাখিস রিমি।আমি এখানের ঝামেলা শেষ হতেই তোর বাসায় এসে চিত্রকে নিয়ে যাব।’
অত্যাধিক শব্দে সব কথা শোনা যায় না।নবনীতা ফোন রাখার আগেই বিকট শব্দে গু*লি চালানোর শব্দে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন কেঁ*পে উঠে।কেঁ*পে উঠে নবনীতা নিজেও।আওয়াজ হওয়ার সাথে সাথেই মৃদু আর্ত’নাদে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে একটি বলিষ্ঠ দেহ।আশ্চর্য হয়ে পেছন ফিরে নবনীতা।পেছন ফিরতেই চোখ কপালে উঠল তার।
তার থেকে সামান্য কিছুটা দূরে আরহাম।তার একহাত দিয়ে অঝোরে র*ক্ত ঝরছে।সে হাতে গু*লি খেয়েছে।বাহুর কাছটায় র*ক্ত মেখে বি’ভৎস দেখাচ্ছে তাকে! নবনীতা পেছন ফিরতেই দু’জনের চোখাচোখি হলো।হতবাক হয় নবনীতা।আরহাম একা কেন এদিকে?তার লোকজন কোথায়?সে কেন এই পরিস্থিতিতে বাইরে বেরিয়েছে?ভাবনার মাঝেই আরো একবার অস্ফুট আর্ত’নাদ করে সে।নবনীতার বুকে ধ্বক করে উঠে।মস্তিষ্কে হানা দেয় সেই পুরোনো স্মৃতি।একটা ক্লান্ত শরীর,মাটিতে লুটিয়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে,দু’টো ঘোলাটে চোখ,সেই চোখে শত শত চাপা কষ্ট।
দ্রুত চোখ বন্ধ করে নবনীতা।এই দৃশ্য সে আর মনে করতে চায় না।সে সহ্য করতে পারে না এই দৃশ্য।
সময় গড়ায়।কিছুটা ধাতস্থ হয় নবনীতা।শরীরে শক্তি আর সাহস সঞ্চার করে।চোখ মেলে সামনে তাকায়।নাহ,সে ভয় পাবে না।র*ক্ত দেখে সে পালাবে না।সে এই লোকটিকে বাঁচাবে।তার সামনে থাকা এই লোকটি যেমনই হোক,নবনীতা তাকে নোংরা রাজনীতির খপ্পরে পড়ে ম’রে যেতে দিবে না।কিচ্ছু হবে না তার,নবনীতা কিছু হতেই দিবে না।
শাড়ির আঁচলটা কোমরে গুজে সে জোরে জোরে শ্বাস নেয়।তারপরই এক দৌঁড়ে ছুটে যায় আরহামের দিকে।মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে আঁকড়ে ধরে তার গু’লিবি’দ্ধ সুঠাম দেহ।বিস্মিত হয় আরহাম।অবাক হয়ে পাশে দেখে।নবনীতা তার একহাত দিয়ে শক্ত করে আরহামের বাহু চেপে ধরে।র*ক্তে তার হাত ভিজে যাচ্ছে।দাঁত দিয়ে ঠোঁট কা’মড়ে ধরে সে।নিজেকে বোঝায় ‘র*ক্ত দেখে ভয় পাবি না নবনী।সাহস কর,দেখিয়ে দে তুই ভীতু না।’
সে শক্ত করে হাত চেপেই এক প্রকার ব্যকুল হয়ে বলল,’চোখ বন্ধ করবেন না আরহাম।প্লিজ চোখ খোলা রাখুন।চোখ বন্ধ করবেন না প্লিজ।’
আরহাম দেখে।দেখতেই থাকে।টের পায় এতো গুলো দিনে এই প্রথম মেয়েটা তার এতো কাছাকাছি এসেছে।মেয়েটা কি কোনো জ্বীন পরী?নয়তো এমন গো’লাগু’লির মাঝে সে কেমন করে আরহামের দিকে ছুটে এলো?সে তো পাশ কাটিয়ে চলেও যেতে পারত।অথচ সে ছুটে এলো যেন আরহাম তার খুব কাছের কেউ।
আরহাম এক হাতে মাটি আঁকড়ে ধরে।নিভু নিভু চোখে তাকে শক্ত করে ধরে রাখা মেয়েটি কে দেখে।খুটিয়ে খুটিয়ে তার মুখটা পর্যবেক্ষণ করে।একটা ক্লান্ত মুখ যেখানে দীর্ঘদিনের অবহেলা জমা হয়েছে।কাজল দেওয়া দু’টো গভীর চোখ যেখানে শতাব্দীর মলিনতা এসে ভীর করেছে।মেয়েটা কি জানে এই ছুটোছুটিতে তার সুন্দর করে বেঁধে রাখা খোপা খুলে তার ঘন কালো কেশ উন্মুক্ত হয়ে তার পিঠ ছাপিয়ে গেছে?হয়তো জানে না।আরহাম দেখে,কেবল দেখতেই থাকে।আচমকা মেয়েটিকে তাকে ধ’মকে উঠে।কড়া গলায় বলে,’চোখ বন্ধ করতে মানা করেছি না?চোখ বন্ধ করছেন কেন?’
আরহাম টেনে টেনে চোখ খোলার চেষ্টা করে।কিন্তু শরীর সে কথায় সায় দেয় না।সে তার অর্ধেক শরীরের ভার নবনীতার উপর ছেড়ে তার মাথাটা আলতো করে নবনীতার কাঁধে রাখে।ত্যাড়া গলায় বলে,’পারব না চোখ খোলা রাখতে।শরীর ব্য’থায় ছি’ড়ে যাচ্ছে।তুমি কি করে বুঝবে আমার অবস্থা?’
চলবে-