কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-১১

0
18

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(১১)

‘এটা আবার কি এনেছো তুমি?’ কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল তাসনুভা।

আরহাম তার হাতের সাদা কাঁচের টবে থাকা গাছটার দিকে দেখে গম্ভীর মুখে বলল,’এটা স্পাইডার প্লান্ট।এটা রুমে থাকা ভালো।এটা থাকলে বাতাস পরিষ্কার থাকে।’

তাসনুভা আড়চোখে বড় ভাইকে দেখল।মনে মনে বলল,’শুরু হয়েছে আবার নতুন পাগলামি।’ অথচ মুখে বলল,’এটা কি আজ থেকে আমার রুমে থাকবে?’

আরহাম বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ে।দ্বিরুক্তি করে বলে,’হু,শুধু তোর রুমে না।তোর,আমার,আরিশের সবার রুমে থাকবে।অনেক গুলো আনিয়েছি আমি।’

তাসনুভা নাক ছিটকাল।
‘দেখতে একদমই সুন্দর না ভাইয়া।ঘাসের মতো লাগে।’

আরহাম চোয়াল শক্ত করে বলল,’সুন্দর দিয়ে কি যায় আসে?সুন্দর চিবিয়ে ঘাস খাবো আমি?আমার প্রয়োজন আউটকাম।জিনিসটা থেকে আমি কি ফল পাচ্ছি এটাই আমার প্রয়োজন।’

‘কিন্তু তবুও।এমন ঘাসের মতো গাছ ঘরে আনিয়ে খামোখা সৌন্দর্য নষ্ট করছ।আমাদের বাড়ির বাতাস এমনিতেই পরিষ্কার।এসব গাছ এনে পরিষ্কার করার দরকার নাই।’

তাসনুভার উত্তর আরহামের পছন্দ হয়নি।সে মুখটাকে পেঁচার মতো করে বলল,’বেশি বুঝিস তুই?এগুলোর কতো ডিমান্ড জানিস তুই?আমি ভাবছি সামনের মাসে লেভেনডার প্লান্ট আনাবো।’

‘সেকি! ঐটা তো শীতপ্রধান দেশে হয়।এই গরমে কেমন করে বাঁচবে?’ভাবুক হয়ে প্রশ্ন করল তাসনুভা।

আরহাম কাঁধ উঁচিয়ে বলল,’সো হোয়াট?আমাদের বাসায়ও তো এসি থাকে।এটার বেঁচে থাকার মতো টেম্পারেচার আমাদের বাসাতেই আছে।এটার খুব ডিমান্ড।বাতাসের টক্সিন দূর করে এটা।’

তাসনুভা কপাল চাপড়ায়।আফসোস করে বলে,’তুমি কি সবকিছুতে শুধু লাভ লোকসান খুঁজো?সবকিছু কি লাভ লোকসান দিয়ে বিচার হয়ে ভাই?মাঝে মাঝে তো ভালোবাসা আর চোখের সৌন্দর্যও ম্যাটার করে তাই না?’

আরহাম তার কথা শুনতেই নাক ছিটকাল।ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে বলল,’ওসব সৌন্দর্য টৌন্দর্য আমি গুনি না।ভালোবাসা আবার কি?একটা জিনিস থেকে হয় আমি ভালো কিছু পাবো,নয়তো খারাপ কিছু।আমি সেই জিনিস গুলোই চ্যুজ করবো যেগুলো আমাকে ভালো কিছু দিতে পারবে।মানুষের ক্ষেত্রেও তাই।যাদের কাছ থেকে আমার কিছু পাওয়ার আছে আমি তাদের সাথেই মিলেমিশে চলি।নয়তো অপ্রয়োজনে মানুষের কাছাকাছি অন্তত আরহাম যায় না।’

‘সর্বনাশ! বিয়ের ক্ষেত্রেও এই টেক্টিস ফলো করবে নাকি?’ দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করল আরিশ।

আরহাম ত্যারছা চোখে আরিশকে দেখে।আরিশ ঘরে ঢুকেই এক লাফে বিছানার মাঝামাঝি গিয়ে বসেছে।আরহাম চুল ঠিক করতে করতে বলল,’অবশ্যই।বিয়ের ক্ষেত্রেও নিজের লাভ দেখেই বিয়ে করব।আমার কথা মতো উঠবস করবে এমন মেয়েই আমার চাই।’

তাসনুভা কৌতূহলী হয়ে জানতে চায়,’ তুমি কি সত্যি সত্যিই ফাইভ পাশ মেয়ে বিয়ে করবে নাকি?’

আরহাম মাথা ঝাকায়।গর্ব করে বলে,’ফাইভ পাশ মেয়ে যদি আমার কথা মতো চলতে পারে,তবে তাই করব।আমি আগেই বলেছি,অতো পড়াশোনা জানা মেয়ে আমি বিয়ে করব না।’

আরিশ আশ্চর্য হয়ে শুধায়,’তার মানে তুমি সত্যি সত্যি এমন কাউকে বিয়ে করবে যে কেবল দিন রাত তোমার হুকুম মেনে চলবে?’

‘একদম তাই।আমি যা বলব তাই শুনবে।আমার কথার উপর কোনো কথা বলবে না।আমার আদেশ ছাড়া কোনো কাজ করবে না।আর মোস্ট ইম্পরট্যান্ট,একবার বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর এই বাড়ির গন্ডি পেরিয়ে কোথাও যাবে না।এই বাড়িতেই থাকবে,তাসের যত্ন করবে,রান্না করবে,সংসার সামলাবে,স্বামীর সেবা করবে,বাচ্চা পেলে পেলে বড় করবে-দ্যাটস ইট।’

তাসনুভা অবাক হয়ে বলল,’কিন্তু এটা কেমন কথা?একটা মেয়ে সারাদিন ঘরে থাকবে?তার ও তো কিছু প্রয়োজন থাকতে পারে।’

‘কেন?সমস্যা কি?তুই থাকিস না সারাদিন বাড়িতে?’

তাসনুভা মুখ দিয়ে বিরক্তি সূচক শব্দ করে বলল,’সেটা তো আর শখ করে থাকিনা।হাঁটতে পারি না বলে সারাদিন ঘরে থাকি।ঐ মেয়ে কেন খামোখা সারাদিন ঘরে থাকবে?তারও তো কিছু স্বপ্ন থাকতে পারে,চাকরি বাকরি থাকতে পারে।’

‘কি?চাকরি থাকবে মানে?’ খ্যাক করে চেঁচিয়ে উঠল আরহাম।দু’হাত নেড়ে কড়া গলায় বলল,’অসম্ভব।এসব চাকরিজীবী স্বপ্নওয়ালী মেয়েকে আমি বিয়েই করব না।পা’গল নাকি আমি?বাড়িতে কি আরেকটা তাসলিমা আনবো নাকি অমন মেয়ে বিয়ে করে?’

আরিশ কোনো প্রতিউত্তর করল না।এই নাম শুনলে সে কেমন যেনো গম্ভীর আর শান্ত হয়ে যায়।আরহাম ভাইয়ের অত্যন্ত অপছন্দের এই নাম।অথচ এই নামের মানুষটার সাথে তাদের তিনজনের সম্পর্ক কতো গভীর!

তাসনুভা মন খারাপ করে বলল,’এমন করে বলছ কেন ভাইয়া?সব মেয়েই কি খারাপ হয়?’

আরহাম কাটখোট্টা স্বরে জবাব দেয়,’এতো প্রশ্ন করিস না তো তাস।ঐ তাসলিমাকে দেখেও কি তোদের শিক্ষা হয় না?এসব মেয়েদের জীবনেও বাড়ির বাইরে কাজ করার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত না।আমার বাবা মহামানব।স্ত্রীকে বাড়ির বাইরে কাজ করার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।সেই স্ত্রী ই দুই গালে জুতো মে’রে আরেক লোকের সাথে ঘর পেতেছে।তাও আবার স্বামী আর তিন বাচ্চাকে ফেলে।চরিত্র’হীনা মহিলা একটা!’

তাসনুভা চোখ মুখ শক্ত করে বলল,’এভাবে বলো না ভাই,প্লিজ!’

‘কেন?কেন বলব না?ঐ তাসলিমা কে নিয়ে বললে তোদের এতো লাগে কেন?ঐ দুশ্চ’রিত্রা আমাদের কি হয়?’

‘তুমি জানো না সে আমাদের কি হয়?’ থমথমে মুখে জানতে চাইল আরিশ।

আরহাম চিবিয়ে চিবিয়ে উত্তর দেয়,’জানি,কিন্তু মানি না।আর তাকে আমার পক্ষে কোনোরকম সম্মান করাও সম্ভব না।তোরা পারলে তার পূজো কর।আমি এসবে নাই।তাসলিমা আমার চোখে দেখা সবচেয়ে জ’ঘন্য মানুষ।আমার বাবার বিশ্বাস ভালোবাসাকে সে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছে।সুযোগ পেলে সব মেয়েই এমন করে।আমার বউকে আমি সেই সুযোগ দেবই না।’

তাসনুভা মলিন মুখে বলে,’আমিও তো মেয়ে ভাই।’

‘চুপ কর তো।তুই মেয়ে ছেলে এসব পরে।সবার আগে তুই আমার বোন।তুই আরহামের বোন।তুই আলাদা।’

‘আমি আলাদা।আর বাকি সব মেয়ে এক?’

আরহাম অন্যদিকে ফিরে ছোট করে জবাব দেয়,’হু,এক।’

তাসনুভা ম্লান হাসল।হাসি মুখেই বলল,’আমার কি মনে হয় জানো ভাইয়া?’

আরহাম চোখ পাকায়।জানতে চায় কি?

‘আমার মনে হয় তুমি খুব ভালো বর হবে।এই যে তুমি মুখে বলছ তুমি তোমার বউকে কিছুই করতে দিবে না,আসলে তার কিছুই হবে না।তুমি তোমার বউকে খুব খুব খুব ভালোবাসবে।বাবার চেয়েও বেশি।’

‘আর সে কি করবে?তাসলিমার মতো আমার ভালোবাসা কে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আরেক লোকের সাথে বিয়ে বসবে?’ তাচ্ছিল্যের সুরে জানতে চায় আরহাম।

তাসনুভা ভীষণ বিরক্ত তার বড় ভাইয়ের উপর।সবকিছুতে ঘুরে ফিরে সে এক নামই নিয়ে আসে।তাসনুভা কপট রাগ দেখিয়ে বলল,’বার বার এক কথা বলবে না ভাই।একজন এমন করেছে মানেই সবাই এমন করবে তা না।’

তাসনুভা একটু দম নিল।সামান্য কিছু সময় পরেই আবার উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,’আমার মনে হয় তোমার বউ খুব মিষ্টি হবে।মনে নাই নানু কি বলত?বলত যে বদমেজাজী ব্যাটাদের বউ হয় মিষ্টি।আমারও মনে হয় সে খুব মিষ্টি হবে।তোমাকে,আমাকে,ছোট ভাইয়াকে-আমাদের সবাইকে খুব ভালোবাসবে।’

আরহাম চোখ বাঁকিয়ে বলল,’ইশশ রে! বউ তো নয় যেন ভালোবাসার টাংকি! শোন তাস,এসব মেয়ে মানুষরা ভালোবাসা বোঝে না।তারা শুধু নিজের টা বোঝে,নিজেকে নিয়ে ভাবে।ছেলেরা পরিবারের প্রতি যত্নশীল হয়,দায়িত্ববান হয়।’

আরিশ চট করে প্রশ্ন করে,’মেয়েরা যত্নশীল হয় না?’

আরহমান হাসে।অবজ্ঞা করে বলে,’অসম্ভব।মেয়েদের কখনো সংসারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিতে দেখেছিস?মেয়েরা উপার্জন করলেও নিজের জন্য করে।ঘুরে ফিরে সবাই ঐ তাসলিমার মতোই।’

‘ভাইয়া! প্লিজ তুমি চুপ করো!’ সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠে দুই ভাই বোন।

আরহাম সেসব গায়ে মাখে না।তাসলিমা কে নিয়ে কটু কথা বললে আরিশ আর তাসনুভার খুব গায়ে লাগে।তাতে আরহামের কি?লাগুক গায়ে।সে কোনো মিথ্যা কথা বলে না।ঐ তাসলিমা তার জন্য কি করেছে?তাকে পেটে ধরেছে।এজন্য কি এখন আরহামের উচিত তার গুনগান করা?যতোসব ফালতু লজিক!

সে ঘর থেকে বরিয়ে যেতে যেতে গাঢ় স্বরে বলল,’খুব গায়ে লাগে তাই না?লাগবেই তো।তোরা তো আর তার পায়ে পড়িস নি।তোরা তো আর চোখের সামনে মা কে অন্য বাড়ির বউ হতে দেখিসনি।তোরা তো স্কুলের ক্লাসরুমে হেনস্তার শিকার হোস নি।তোদের কাছে তো আমার টাই বাড়াবাড়ি মনে হবে।যাক গে,আমি চললাম।তোরা দু’জন ইচ্ছে হলে কতোক্ষণ গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদ।তাসলিমার কাছে কবুতরের পায়ে বেঁধে উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দে।’

শেষ কথাটা বলতে গিয়েই আরহাম আওয়াজ করে হেসে ফেলল।পরক্ষণেই আবার তাসনুভা আর আরিশের থমথমে মুখটা দেখতেই মুখে হাত চাপল।আরিশ বিরক্ত হয়ে বলল,’অদ্ভুত! তুমি আবার হাসছ ভাইয়া?’

আরহাম সে কথার উত্তর দেয় না।কেবল ন্যাকা সুরে গান ধরে,
‘মেঘের খামে আজ তাসলিমার নামে,
উড়ো চিঠি পাঠিয়ে দিলাম।
পড়ে নিয়ো তুমি,মিলিয়ে নিয়ো খুব যতনে তা লিখেছিলাম।
~বাণীতে মা ভক্ত আরিশ তাসনুভা’

কথা শেষ করেই আরহাম আরো কতোক্ষণ খ্যাকখ্যাক করে হাসল।তাসনুভা তার হাতের কাছের বালিশটা সবেগে ছুড়ে মারল তার দিকে।ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,’তুমি যাবো ভাইয়া?সবসময় এসব ভালো লাগে না।’

আরহাম বালিশটা ক্যাচ ধরে বুকের সাথে চেপে ধরে বলল,’আচ্ছা যা।চলে গেলাম আমি।তোরা যা খুশি কর।আরিশের ফোনে তাসলিমার ছবি আছে।দরকার পড়লে সেটা দেখেও কাঁদতে পারিস।আই হ্যাভ নো প্রবলেম।’
.
.
.
.
নবনীতার আজকের দিনটা অন্যান্য দিনের তুলনায় ভালো।ভালো হওয়ার একটা বিশাল কারণ আছে।কুরিয়ার অফিসের যে চাকরিটা সে করত,সেখানে আজ তার বেতন হয়েছে।

সে জানতো তার বেতন ছ’হাজার।কিন্তু পরবর্তীতে অফিসের ম্যানেজার জানাল বেতন ছ’হাজার থেকে বাড়িয়ে সাত হাজার করা হয়েছে।অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বেতনের টাকায় একটা হাজার টাকার নোট বেশি যোগ হওয়াতে নবনীতার মন খুশিতে বাক-বাকুম।সে অফিস থেকে বেরিয়ে সোজা রিকশা নিল।আজ একটু খরচা করাই যায়।এ হাজার টাকা তার হিসেবের বাইরে।

বাড়িতে ফিরতেই সে শুভ্রানীকে তাড়া দিলো,’শুভি তাড়াতাড়ি পড়া শেষ কর।আজ আমরা ঘুরতে বের হবো।’

শুভ্রা অবাক হয়ে জানতে চায়,’কোথায় বের হবো?কি উপলক্ষে বের হবো?’

নবনীতা তাড়াহুড়ো করতে করতে জবাব দেয়,’ছয় হাজারের জায়গায় সাত হাজার পেয়েছি বেতন।এই খুশিতে বের হবো।এখন পড়া শেষ করে তাড়াতাড়ি রেডি হ।’

শুভ্রানী কেবল গোল গোল চোখে তার বোনের চঞ্চলতা দেখে।নবনীতা আলমারি থেকে চিত্রার জন্য একটা জামা বের করল।লাল টুকটুকে একটা জামা।তারপর সেটা চিত্রাকে পরিয়ে তার চুলগুলো সুন্দর করে বেঁধে দিলো।চুল বাঁধার পর চিত্রাকে দেখাচ্ছিল মিষ্টি একটা বাচ্চা।নবনীতা গালে হাত চেপে প্রফুল্ল মুখে বলল,’আল্লাহ রে!! আমার চিত্র সোনাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে।একদম পামকিন পামকিন!’

বয়স যাই হোক না কেন,মেয়ে মানুষ প্রশংসায় গলে যায়।চিত্রাও গলে গেল।কিছুটা লাজুক হেসে সে ঘরের আয়নায় একবার নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নেয়।নবনীতা তাকে পেছন করে জাপ্টে ধরে প্রশ্ন করে,’কি?কেমন দেখাচ্ছে চিত্র কে?’

চিত্রা হাত নেড়ে নেড়ে জবাব দেয়,’সু বিউতিফুল।সু ইলিগ্যান।’

নবনীতা চোখ বড় বড় করে বলল,’সর্বনাশ! এ কথা কে শেখালো?নির্ঘাত শুভি,তাই না?’

চিত্রা ইশারায় জানাল নবনীতার ধারণাই ঠিক।নবনীতা পেছন ফিরে শুভ্রার বোকা বোকা মুখটা দেখতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে।কয়েক পল বাদেই আবার চিত্রাকে জড়িয়ে ধরে তার দুই গালে ঠেসে ঠেসে দু’টো চুমু খেয়ে আহ্লাদী গলায় বলে,’কি পাকা পাকা কথা বলে এই দুষ্টুটা!’
কিছু সময় বাদে নবনীতা নিজ থেকেই বলে উঠল,’জাস্ট লুকিং লাইক আ ওয়াও চিত্র।’

শুভ্রানী এগিয়ে এলো।অবাক হয়ে বলল,’আপাই তুমিও এই কথা জানো?’

‘হু।লুবনার কাছ থেকে জেনেছি।ঐটা তো আরেকটা মোবাইলের পোকা।সারাদিন কিসব রিলস টিলস দেখতে থাকে।পড়াশোনা বাদে সে সবকিছুতেই ভীষণ পারদর্শী।’

শুভ্রার পড়া শেষ করে সব কিছু গুছিয়ে বাড়ি থেকে বের হতে হতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।আধ ঘন্টা বাদেই হয়তো আযান দিবে।নবনীতা মাথার ঘোমটা টা আরো একটু সামনে টেনে হতাশ গলায় বলল,’ধ্যাত।সেই তো আবার দেরি ই করে ফেললাম।মাঝখান টায় মাগরিবও গেলো।’

সেদিন তিন বোন মিলে সোজা নিউমার্কেট গেল।নবনীতা ফুচকা খেল,তাও আবার দু’প্লেট।একেকটা ফুচকা মুখে দেওয়ার পর তার চোখে মুখে যে তৃপ্তির ভাব ফুটে উঠে,সেটা দেখেই শুভ্রা ঠোঁট টিপে হাসে।আপাই ফুচকার ভক্ত।এসবে কোনো ভাগযোগ করে না আপাই।যার যার প্লেট তার তার।নবনীতা যখন দু’চোখ বন্ধ করে ফুচকার স্বাদ নিতে ব্যস্ত,তখন শুভ্রা অতি সন্তর্পণে তার প্লেটের একটা ফুচকা নবনীতার প্লেটে তুলে দিলো।এই একটা খাবারই আছে যেটা পরী আপাই খুব আয়েস করে খায়।যেই আপাই নিজের সব বিসর্জন দিয়ে শুভ্রা আর চিত্রাকে ভালোবাসতে পারে,সেই আপাইকে ভালোবেসে তার অগোচরে তার প্লেটে একটা ফুচকা দেওয়াই যায়।

শুভ্রা মুগ্ধ চোখে দেখে।নবনীতা ফুচকা চিবুতে চিবুতে অস্পষ্ট গলায় বলে,’ফাটাফাটি হয়েছে একদম।মন ভালো হয়ে গেছে আমার।’

ফুচকা খাওয়া শেষ করে তারা কতোক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল।চিত্রাকে চিপস আর চকোলেট কিনে দিয়েছে নবনীতা।তারপর তার যায় স্টেশনারি দোকানে।চিত্রার কালার পেপার লাগবে,শুভির লাগবে প্র্যাক্টিক্যাল খাতা।নবনীতা আর শুভ্রা ব্যবহারিক খাতা গুলো পাতা উল্টে দেখছিল।নবনীতা জিজ্ঞেস করে,’তিনটা এক সাথে কতো দিব ভাইয়া?’

চিত্রা এসব ঝামেলায় নেই।সে নিজের জিনিসপত্র সব পেয়ে গেছে।সে সেগুলো হাতে নিয়ে ফুটপাতে হাঁটাহাঁটি করছিল।তার দুই হাত ভর্তি এটা সেটা।হাঁটতে হাঁটতে আচমকা সে হোঁচট খেল।হাঁটু ভোঙে মাটিতে বসতেই ব্যথায় ফুপিয়ে উঠল।ঠোঁট ভেঙে ডাকল,’আপাই!’

নবনীতার কানে তার আওয়াজ যেতেই নবনীতা আঁতকে উঠল।হাতে রাখা খাতাটা দ্রুত ডেস্কের উপর ফেলে সে ছুটল ফুটপাতের দিকে।তার পিছু পিছু শুভ্রাও দোকান থেকে হম্বিতম্বি করে বের হলো।

নবনীতা ফুটপাতে পা রাখতেই দেখতে পেল চিত্রার এক হাত একটা শক্ত হাতের মুঠোয় বন্দি।সেই হাতের মালিক তার অন্য হাতে চিত্রার হাঁটুর কাছের ধুলো ময়লা গুলো সব ঝেড়ে দিচ্ছে।ঝাড়তে ঝাড়তেই আদুরে স্বরে বলছে,’কিচ্ছু হয়নি বাবু।এই দেখো তুমি একদম ঠিক আছো।’

একছুটে নবনীতা সেখানে গেল।প্রচন্ড অস্থির হয়ে প্রশ্ন করল,’কি হয়েছে?কি হয়েছে আমার চিত্র’র?’

ওয়াজিদ মাথা তুলল।নবনীতা প্রথমেই তাকে চিনতে পারেনি।যখন চিনল,তখন এক থাবায় চিত্রকে তার কাছ থেকে নিজের কাছে নিয়ে এলো।চিত্র’র গালে হাত রেখে ব্যস্ত হয়ে বলল,’কিভাবে পড়লি চিত্র?বেশি ব্যথা পেয়েছিস?’

চিত্রা কেবল ডানে বায়ে মাথা নাড়ে।ওয়াজিদ অমায়িক হেসে উত্তর করে,’না না।সে তেমন ব্যথা পায় নি।হোঁচট খেয়েছিল।আমি ধরে নিয়েছি।বাসায় গিয়ে ভ্যাসলিন লাগিয়ে দিবেন।তাহলেই একদম ঠিকঠাক হয়ে যাবে।’

নবনীতা তার কথার পিঠে কেবল সৌজন্যসূচক হাসল।ওয়াজিদের কন্ঠ অত্যন্ত মোলায়েম।মুখ জুড়ে সবসময় অমায়িক হাসি লেপ্টে থাকে।আরহামের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হওয়া স্বত্বেও আরহামের চেয়ে ওয়াজিদের আচার আচরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন।নবনীতার এই লোকটি কে খারাপ লাগে না।

ওয়াজিদ কথা শেষ করে আড়চোখে একবার তার মুখোমুখি দাঁড়ানো রমণীকে দেখে নেয়।তার চোখেমুখে সে কি ভীষণ উৎকন্ঠা! ওয়াজিদ ঠিক করে বুঝিয়ে বলার পরেও সে দুশ্চিন্তা মুক্ত হতে পারছে না।ওয়াজিদ স্মিত হেসে বলল,’মিস নবনীতা! রিলাক্স।ওর কিচ্ছু হয়নি।পড়ে গিয়েছে কেবল।বাচ্চারা এমন একটু আধটু পড়েই।’

এবার সম্ভবত কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছে নবনীতা।সে চোখ তুলে একগাল হেসে বলল,’ধন্যবাদ ভাইয়া।আসলে একে নিয়ে আমি খুব চিন্তায় থাকি।বাচ্চা মানুষ তো,তাই ভয় হয়।আপনাকে ধন্যবাদ।আল্লাহ আপনার ভালো করুক।আমরা তাহলে আসি।’

কথা শেষ হতেই নবনীতা চিত্রার হাতের জিনিসগুলো নিজের হাতে নিল।ব্যাগ থেকে কিছু টাকা বের করে শুভ্রার হাতে দিয়ে বলল,’যা তো খাতা গুলো নিয়ে আয়।’
শুভ্রা খাতা আনার পরেই তিনজন একটা রিকশা ডেকে মিনিটের মাঝেই সেখান থেকে উধাও হয়ে গেল।

কেবল পেছনে পড়ে রইল একটি যুবক,যার চোখে মুখে তখনো রাজ্যের মুগ্ধতা।সাদামাটা পোশাক,প্রসাধনী বিহীন একটা ক্লান্ত মুখ,গভীর দু’টো চোখে মলিনতার ছাপ,একপাশে বেণি করে অযত্নে ফেলে রাখা চুল,অথচ এতো অযত্নেও তার সৌন্দর্যের এইটুকুও ম্লান হয়নি।কি আছে এই রমণীর মাঝে?সেই প্রথম দিন থেকে ওয়াজিদের চোখ জোড়া মুগ্ধ হয়ে কেবল সেই প্রশ্নের জবাবই খুঁজে যাচ্ছে।মেয়েটি অত্যন্ত সাধারণ,তবে ওয়াজিদের কেন তাকে এতো বেশি অসাধারণ বলে মনে হয়?কেন মনে হয় এই মেয়েটি যেখানেই যায়,কেবল মুগ্ধতা ছড়ায়?

নবনীতাদের রিকশা অনেক দূর এগিয়ে গেছে।ওয়াজিদ দাঁড়িয়ে আছে বুকে হাত বেঁধে।মেয়েটাকে তার ভালো লাগে,ভীষণ ভীষণ ভালো লাগে।

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে