কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-০৯

0
21

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৯)

শুভ্রানী কি অনেক বেশি সুন্দর?কই সে তো খুবই সাধারণ দেখতে।তাহলে তার পিছে এই বখাটে গুলো সবসময় পড়ে থাকে কেন?কলেজে কতো সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে।লাইন মারতে চাইলে তাদের সাথে গিয়ে মারুক।শুভ্রার সাথে এতো কি?

প্রথম প্রথম শুভ্রা এসব ভীষণ ভয় পেত।এখন আর তেমন ভয় পায় না।কেবল তারা আশে পাশে থাকলে নিজেকে গুটিয়ে নেয়।তবে মাঝে মাঝে তার সত্যিই ক্লান্ত লাগে ভীষণ।তার জন্য পরী আপাইয়ের ভোগান্তি আরো বেড়েছে।আপাই মাঝে মাঝেই সময় করে তাকে নিতে আসে কলেজ থেকে।এমনিতেই আপার এতো কাজ।তার উপর এর সাথে যুক্ত হয়েছে শুভ্রানীর উটকো ঝামেলা।

মেইন রোডে আজ ডজন খানেক ছেলে।এদের সামনে দিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে কিংবা সাহস কোনোটাই শুভ্রার নেই।সে সিদ্ধান্ত নিল সে অন্য রাস্তা দিয়ে সামান্য ঘুরে যাবে।

সে আজ মূল সড়কের বদলে অন্য একটা গলি দিয়ে বাড়ি ফিরবে বলে ঠিক করেছে।এই গলি দিয়ে সে আগে বাড়ি ফিরেছে কয়েকবার।তবে আজকে চারদিক বেশ নিরব।শুভ্রা গুনগুন করে গান ধরে দুই হাতে ব্যাগের ফিতা টানতে টানতে হাঁটা শুরু করল।

গলির শেষ মাথায় কয়েকটা কুকুর ঘুরাঘুরি করছিল।এদের দেখামাত্রই শুভ্রা থেমে গেল।সামনে দেখতেই তার মুখটা শুকিয়ে কিসমিসের মতো চুপসে গেল।সে কুকুর সাংঘাতিক রকমের ভয় পায়।হাত দিয়ে নাকের চারপাশের ঘামটুকু মুছে নিল সে।গান বন্ধ করে যত রকম দোয়া জানা ছিল তার,সেগুলোই সে এক নাগাড়ে পড়তে শুরু করল।আপাই বলেছে কুকুর দেখে ভয় পেলে কুকুর আরো বেশি ভয় দেখায়।কুকুর দেখলে ভয় পাওয়া যাবে না।বরং কুকুরকে পাত্তা না দিয়ে হেঁটে যেতে হবে।

শুভি সিদ্ধান্ত নিয়েছে আজ সে কুকুরকে পাত্তা দিবে না।কিন্তু এক পা সামনে এগোতেই তার মনে হলো তার কলিজা এক লাফে তার গলা পর্যন্ত উঠে এসেছে।আর এক পা সামনে ফেললেই সেটা ফুড়ুৎ করে তার হাতে এসে যাবে।

দু’টো কুকুর রাগী রাগী চোখ করে শুভ্রানীকে দেখছিল।ভাব এমন যেন শুভ্রা তাদের হাড্ডির লোভ দেখিয়ে ঘাস ধরিয়ে দিয়েছে।শুভ্রা চোখ মুখ খিঁচে দুরুদ পড়তে পড়তে দুই কদম সামনে গেল।ঠিক তক্ষুনি রাগী রাগী মুখের কুকুর দু’টো প্রচন্ড শব্দ করে ডেকে ওঠল।ব্যাস,এতেই শুভ্রা ভয়ে এক লাফে কয়েক হাত পিছিয়ে গেল।ভয়ে ভয়ে বলল,’আল্লাহ গো,আজ বাঁচিয়ে দাও প্লিজ।’

আপাই ঠিকই বলত।কুকুরের সামনে ভয় পেলেই কুকুর ভয় দেখায়।এই যে সামান্য ডাকেই শুভ্রানী ভয়ে আঁতকে উঠেছে,এতেই কুকুর দু’টো ঘেউ ঘেউ করতে করতে তার দিকে ছুটল।ব্যাস,শুভ্রা কে আর পায় কে?সে হাত পা ছুড়ে এক চিৎকার দিয়ে ভোঁ দৌড় দিল উল্টো পথে।

শুভ্রা ছুটতে তো ছুটছেই।তার পেছন পেছন ছুটছে দু’টো কুকুরও।শুভ্রা কোথায় যাচ্ছে,চারপাশে কি হচ্ছে সেসব কিছুই সে জানে না।সে কেবল উন্মাদের মতো ছুটছে আর মাঝে মাঝে হেঁচকি তুলে তুলে কাঁদছে।কুকুর দু’টো খুব কাছাকাছি এসে গিয়েছে।শুভ্রা দৌঁড়ের গতি বাড়াল।তার পা অবস হয়ে যাচ্ছে,গলা এতোক্ষণে শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেছে।তবুও শুভ্রা থামল না।দৌঁড়ের মাঝেই সে এক দফা কেঁদে নিল।চিৎকার করে বলল,’আপাই! বাঁচাও আমাকে!’

গলির মাথায় তখন কুচকুচে কালো একটি টয়োটার গাড়ি প্রচন্ড গতি নিয়ে গলির ভেতর প্রবেশ করল।ফাঁকা রাস্তা দেখেই গাড়ির চালক স্বাভাবিকের তুলনায় সামান্য বেশি গতিতে গাড়ি চালাচ্ছিল।কিন্তু যখনই সে দেখল একটি মেয়ে দিকবিদিকশুন্য হয়ে গলির ভেতর ছুটোছুটি করছে এবং তার গতি একেবারে গাড়ির অভিমুখে তখনই গাড়ির চালক সজোরে গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে ব্রেক চেপে ধরল।

শুভ্রা যখন দেখল তার আর কালো রঙের গাড়িটির মাঝে দূরত্ব কেবল কয়েক হাতের,তখনই সে দু’হাত কানে চেপে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিকট চিৎকার দিলো।গাড়িটি থামল।একেবারে শুভ্রার গা ঘেঁষে থামল।গাড়ির চালক তৎক্ষণাৎ সিট বেল্ট খুলে বেরিয়ে এলো।শুভ্রা যতখানি ভয় পেয়েছে,সে ভয় পেয়েছে তার চেয়েও বেশি।

আরিশ গাড়ি থেকে বেরিয়ে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল।শুভ্রা এখনো চোখ বন্ধ করে চিৎকার করে যাচ্ছে।আরিশ ভয়ে ভয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল।মিনমিনে গলায় বলল,’চিৎকার বন্ধ করো।এক্সিডেন্ট হয়নি তোমার।ঠিক আছো তুমি?’

মেয়েটি সাথে সাথেই চিৎকার থামাল না।যখন টের পেল সে একদম ঠিক আছে,কালো গাড়িটি তাকে পিষিয়ে দেয়নি,তখনই সে আস্তে আস্তে কান থেকে হাত সরিয়ে চোখ খুলল।দেখতে পেল তার চেয়ে কয়েক হাত দূরে সাদা টি শার্ট গায়ে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।চোখ বড় বড় হয়ে গেল শুভ্রার।এতো সুন্দর ড্রাইভার!

ছেলেটি এগিয়ে এলো।সন্দিহান গলায় বলল,’ঠিক আছো তো?’

শুভ্রা উপরনিচ মাথা নাড়ল কেবল।তার প্রচন্ড পানি খেতে ইচ্ছে করছে।ছেলেটার কাছে চাইবে কি?

তার অবশ্য পানি চাইতে হলো না।ছেলেটি নিজেই গাড়ির ভেতর থেকে পানির বোতল বের করে সেটা শুভ্রার দিকে এগিয়ে দিল।শুভ্রা বিনা বাক্য ব্যয়ে সেটি লুফে নিল।চুপচাপ কয়েক ঢোক পানি খেয়ে পুনরায় সেটি আরিশের নিকট ফিরিয়ে দিলো।

আরিশ কৌতূহলী হয়ে জানতে চাইল,’নাম কি তোমার?অমন করে ছুটছিলে কেন?’

লজ্জায় শুভ্রা দ্রুত মাথা নামিয়ে নিল।সে কেমন করে বলবে এই ছেলেকে যে সে কুকুরের দৌঁড়ানি খেয়ে এই অব্দি এসেছে?সে দ্বিতীয় প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না।কেবল অল্প কথায় জবাব দিলো,’আমার নাম পুষ্পিতা নূর।ডাক নাম শুভ্রানী।’

আরিশ মাথা নাড়ল।নিরেট স্বরে বলল,’নাইস নেইম।শুভানী।’

শুভ্রা পাল্টা প্রশ্ন করল,’আপনার নাম কি?’

আরিশ হাসি হাসি মুখ করে বলল,’আমার নাম শেখ সাদিকুর আরিশ।’

জবাবে শুভ্রা ঠিক তার মতো করেই ঠোঁট নেড়ে বলল,’নাইস নেইম।আরিশ।’

তার বলার ধরন দেখেই আরিশের হাসি পেল।শুভ্রা কপাল কোঁচকাল।সে কি ভুল কিছু বলেছে?লোকটা এমন হাসছে কেন?

‘তো মিস শুভ্রানী,আপনি কোথায় যাচ্ছিলেন এমন দৌঁড়ে দৌঁড়ে?বাসা কোথায়?’ বেশ সাবলীলভাবে প্রশ্ন করল আরিশ।

শুভ্রা রিনরিনে স্বরে জবাব দিলো,’জ্বী মালিবাগে।আমি সেখানেই থাকি।’

আরিশ মাথা ঝাকালো।গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে বলল,’তুমি কিছু মনে না করলে আমি তোমাকে ড্রপ করে দিতে পারি।আমি মতিঝিল যাচ্ছি।’

শুভ্রা সঙ্গে সঙ্গে দুই হাত নেড়ে হড়বড় করে জবাব দিল,’না না,তার কোনো দরকার নেই।আমি চলে যেতে পারব।’

আরিশ স্মিত হাসল।টি শার্টের গলার কাছ ঝুলিয়ে রাখা সানগ্লাসটা চোখের উপর চাপিয়ে সে হাত দিয়ে তার চুলগুলো ঠিক করে নিল।অমায়িক হেসে বলল,’ওকে।আমি তাহলে আসি।’

‘এটা কি আপনার গাড়ি?’ ভ্রু উঁচিয়ে জানতে চাইল শুভ্রা।

নিজের প্রশ্নে শুভ্রা নিজেই অপ্রস্তুত বোধ করল।তার মনে হচ্ছে এই প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি।অথচ তার কৌতূহলী মন।সেই তখন থেকেই এই প্রশ্ন তার মনে খচখচ করে যাচ্ছিল।

আরিশ ট্রাউজারের পকেটে হাত রেখে দুই দিকে মাথা নেড়ে বলল,’আমার না আসলে,এটা আমার ভাইয়ার গাড়ি।বাড়ির সবাই এটা ব্যবহার করে।আজ আমি নিয়ে বেরিয়েছি এই যা।’

শুভ্রা বুঝতে পেরে মাথা নাড়ল।এক শব্দে বলল,’ওহহ’

তারপর আর কথা না বাড়িয়ে দুই হাত ব্যাগের ফিতায় চেপে মাথা নিচু করে সে পুনরায় বাড়ির পথ ধরল।হাঁটতে হাঁটতেই তার মনে হলো বাবা বেঁচে থাকলে আজ শুভ্রাও এমন গাড়িতে চড়তে পারত।বাবা মায়ের কিছু স্মৃতি শুভ্রার মনে আছে।মনে আছে স্যুট-টাই পরা একটা লোক খুব দামি গাড়িতে চড়ে বাড়ি ফিরতেন।কখনো কখনো আপাই আর শুভ্রাকে নিয়ে মাঝরাতে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন।মা ভীষণ চেঁচামেচি করতেন এই নিয়ে।কিন্তু বাবা নামের মানুষটা সে কথা কানে তুলতেন না।কতো সুন্দর ছিল সেই জীবন! অর্থ বিত্ত আভিজাত্য কোনো কিছুরই তো কমতি ছিল না।মাঝে মাঝে শুভ্রানীর মনে খুব কৌতূহল জাগে।মনে হয় আপাই কেমন করে এই নিম্নবিত্ত জীবনে মানিয়ে নিচ্ছে?আপাই তার জীবনের দীর্ঘসময় কাটিয়েছে অর্থ বিত্ত আর জৌলুসের মধ্যে থেকে।তারপর হঠাৎ এই ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এই রকম জীবনে কেমন করে মানিয়ে নিয়েছে আপাই?

শুভ্রানীর ধারণা সারাদিন পরী পরী শুনতে শুনতে আপাই সত্যিই পরী হয়ে গেছে।পরী আপাই শুভ্রার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ।আপাই এতোটাই ভালো যে মাঝে মাঝে তাকে মানুষের সাথেও মেলানো যায় না।আপাই কোনোদিন নিজের খাওয়া,নিজের পরা নিয়ে ভাবে না।তার জীবনের সমস্ত ধ্যান জ্ঞান শুধু তার শুভি আর চিত্রকে নিয়ে।আপাই কেবল তাদের দিয়েই যাচ্ছে।শুভ্রার ভীষণ ইচ্ছে হয় একদিন সেও আপাইয়ের জন্য কিছু করবে।খুব বড়ো ডাক্তার হবে সে।তারপর আপার চিকিৎসা করবে।আর কোনো কাজ করতে দিবে না আপাকে।তখন আপাইয়ের ছুটি।

আকাশে গম গম শব্দ হয়।শুভ্রার চোখ ভিজে যায়।তার মস্তিষ্কে মা বাবার অস্তিত্ব অনেকটাই ঘোলাটে।পরী আপাই বাদে তার আর চিত্র’র জীবনে কেউ নেই।খুব বেশি বিপদে পড়লে কিংবা খুব বেশি কষ্ট পেলে যেই চেহারাটা শুভ্রার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেটা তার পরী আপাই।আপাই রোজ রোজ বলে তার পুরো পৃথিবীটাই নাকি শুভি আর চিত্র।শুভ্রা কোনোদিন জোর গলায় বলতে পারে না আমাদের পৃথিবীটাও শুধু তুমি আপাই।শুভ্রা আলগোছে চোখ মুছে।আপাই এতো ভালো কেন?এতো কেন ভালোবাসে তাদের?একটু কম ভালোবাসলে কি ক্ষতি?
.
.
.
.
কাল আরো একটা ক্লাস টেস্ট আছে।শুভ্রা বাড়ি ফিরে গোসল শেষ করে চিত্রাকে খাইয়ে দিলো।তারপর ঠান্ডা মাথায় পড়তে বসল।এখন সময় বিকেল চারটা।চিত্র ঘুমাচ্ছে খাটের ঠিক মাঝামাঝি হাত পা ছড়িয়ে।এই সময়টা বাড়ি নিরব থাকে।মামি এসময় বাড়ি থাকে না,পাড়া বেড়ায়।প্রথা তো কখনোই ঠিক মতো বাড়ি থাকে না।কেবল টাকার প্রয়োজন হলে বাড়ি আসে আর চিৎকার চেঁচামেচি করে।

চারটা বাজার একটু পরেই বাড়ির কলিংবেল বেজে ওঠল।কপালে ভাঁজ পড়ল শুভ্রার।অদ্ভুত তো! এই সময় কে এসেছে?কেমিস্ট্রি বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালো শুভ্রা।অসময়ে বাড়িতে কেউ এলে বুক টিমটিম করে।শুভ্রারও করছে।তার ভাবনার মাঝেই কলিংবেলে আবারো চাপ পড়ল।

শুভ্রা গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে গেল।দরজার কাছে গিয়ে আওয়াজ উঁচু করে জানতে চাইল,’কে?কে এসেছেন?’

অপরপাশ একদম নিরব।শুভ্রা কড়া গলায় বলল,’নাম না বললে দরজা খুলব না।’

দরজার অন্যপাশ থেকে এবার উত্তর এলো।তেইশোর্ধ তরুণী প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উত্তর দিলো,’আমি শ্যাওড়া পাড়ার পেতনী।এবার দরজা খোল বেয়াদব।’

চমকে গেল শুভ্রা।এটা তো আপাইয়ের গলা।এক দৌঁড়ে ছুটে গিয়ে সে দরজা খুলে দিলো।আশ্চর্য হয়ে বলল,’আপাই তুমি?এই সময়ে?’

নবনীতা ঘামে ভেজা শরীরটা নিয়ে কোনোরকম ঘরে ঢুকল।শুভ্রার কথার জবাব না দিয়ে উল্টো তাকে ধমকে ওঠল,’সমস্যা কি তোর?এতোক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?ঘুমিয়ে যাস নাকি?’

শুভ্রা দরজা বন্ধ করতে করতে উত্তর দিল,’আরে আপাই তুমি আসবে সেটা কি আমি জানতাম নাকি?তুমি তো কখনো এই সময়ে আসো না।’

‘কেন?এই সময়ে আসাতে কি তোর সমস্যা হচ্ছে?কষ্ট হচ্ছে?হলে বলে দে।চলে যাই আমি।’

শুভ্রা পড়েছে মহা বিপাকে।সে কখন চলে যেতে বলল?আপাই সবকিছুতে এমন রেগে যাচ্ছে কেন?সে ঝটপট একগ্লাস পানি তার দিকে বাড়িয়ে দিলো।তড়িঘড়ি করে বলল,’তুমি পানি খাও।মাথা ঠান্ডা করো তোমার।’

নবনীতা চেয়ার টেনে পানির গ্লাস হাতে নিয়ে বসল।একটু পানি খেয়েই প্রশ্নাত্মক চাহনি তে জানতে চাইল,’চিত্র কোথায়?খেয়েছে কি দুপুরে?’

‘হু।আমি এসে খাইয়ে দিয়েছি।’

‘কালকে পরীক্ষা আছে?’

‘আছে।কেমিস্ট্রি সেকেন্ড পেপার।পরিমানগত রসায়ন।’

‘যা গিয়ে পড়তে বস।’

শুভ্রা গটগট করে হেঁটে চলে গেল।আপার আজ মাথা গরম।কাছে থাকলেই কথা শুনতে হবে।এর চেয়ে দূরে দূরে থাকাই ভালো।

নবনীতা কিছুক্ষণ চেয়ারে হেলান দিয়ে জিরিয়ে নিল।আজ লুবনাকে পড়াতে হয়নি।লুবনা মামা বাড়ি বেড়াতে গিয়েছে।লুবনা ছাড়াও নবনীতা আরো দুই জায়গায় টিউশন করে।সৌভাগ্যক্রমে আজ কোনোটাই করাতে হয়নি।কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নবনীতা হাতের প্যাকেট টা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো।

আসার সময় সে আধা লিটার দুধ কিনে এনেছে।সে মাঝে মাঝেই এমন হুটহাট কেনাকাটা করে।আধা লিটার দুধ খুব বেশি কিছু না,তবে নবনীতার কমজোর পকেটের কাছে সেই খরচা টাও নগন্য না।

সে রান্নাঘরে গিয়েই দুধটা ভালো মতো জ্বাল করে নিল।তারপর একটা বড়ো কাপে প্রায় অর্ধেকের বেশি দুধ ঢেলে বাকিটা অন্য একটা চোখ কাপে ঢেলে নিল।

মিসেস রোকেয়া বাড়িতে এসেই সবার প্রথমে রান্নাঘরে গেলেন।দুই হাতে দু’টো গ্লাস নিয়ে নবনীতা রান্নাঘর থেকে বের না হতেই রোকেয়া তার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।কাপের দিকে চোখ রেখে বললেন,’এটা কি?কার জন্য এনেছ?’

নবনীতা একটা শ্বাস ছেড়ে জবাব দিল,’মামার জন্য এনেছি।মামার এখন এই ধরনের খাবার দরকার।’

‘আরেকটা?আরেকটা কার জন্য? চোখ পাকিয়ে জানতে চাইলেন মিসেস রোকেয়া।

নবনীতা নিরাসক্ত,খানিকটা বিরক্তি মেশানো গলায় বলল,’আরেকটা শুভির জন্য।’

‘কেন?শুভ্রা কি বিশেষ কেউ?’

‘বিশেষ কেউ না।কাল তার পরীক্ষা।তাই ভাবলাম বাকিটুকু তাকে দিয়ে দেই।’

‘বাহ খুব ভালো।নিজের দুই বোন ছাড়া তো আর কিছুই তোমার চোখে পড়ে না।’

নবনীতা ক্লান্ত চোখে একবার মিসেস রোকেয়াকে দেখল।গুরুজনদের সাথে বেয়াদবি করা তার পারিবারিক শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত না।কিন্তু মামিকে কেমন করে ঠান্ডা মাথায় সহ্য করতে হয়,সেটাও নবনীতার জানা নেই।নবনীতা তার সামনে নিজের ধৈর্য ধরে রাখতে পারে না।উত্তর দেওয়ার জন্য ঠোঁট নিশপিশ করে।

তবুও সে ধৈর্য না হারিয়ে একেবারে ঠান্ডা গলায় বলল,’মামি আমি কখনোই চিত্র কিংবা শুভির জন্য খুব বেশি আলাদা কিছু করি না।কিন্তু শুভির তো অনেক পড়ার চাপ।একটু ভালো খাবার না খেলে এতো পড়াশোনার চাপ নেবে কেমন করে?’

মিসেস রোকেয়া মুখটাকে পেঁচার মতো করে ন্যাকা সুর টেনে বললেন,’বোন তো তোমার আরেকজনও আছে।তার কথা তো কখনো ভাবো না।তার সাথে তোমার যতো হিংসে!’

নবনীতা হাসল।ঠিক কোনো একটা রসিকতার জবাবে যেমন করে হাসে,ঠিক তেমন করে হাসল।প্রথাকে সে কেনো হিংসে করবে?প্রথার মাঝে কি আছে যেটা দেখে নবনীতা তাকে হিংসে করবে?এই প্রশ্নটা মামিকে করা যায়।কিন্তু মামি এক উত্তরে আধ ঘন্টা চিল্লাফাল্লা করবে।তার বেরস ফাঁটা বাঁশের মতো গলা শুনলেই নবনীতার মাথা ব্যথা শুরু হয়।

সে মিসেস রোকেয়াকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেল।যেন সে তার কোনো কথা শুনতেই পায়নি।রোকেয়া দাঁত চেপে গিরগির করে উঠলেন,’অন্যের বাড়িতে থাকে,কিন্তু ভাব এমন যেন এটা তার বাড়ি।দু’পয়সার যোগান দিয়েই নিজেকে বাড়ির মালিক ভাবে।’

****

সন্ধ্যার পর নবনীতার ফোনে রিমির কল এলো।রিসিভ করার সাথে সাথেই অন্যপাশ থেকে চটপটে গলায় রিমি বলল,’নবনী তেইশ তারিখ কিন্তু অবশ্যই ভার্সিটিতে আসবি।সাথে চিত্র আর শুভিকেও নিয়ে আসবি।’

নবনীতা চোখ সরু করে বলল,’কিন্তু কেন?তাদের কে কেন সাথে নিবো?’

‘কাল কলেজে একটা কালচারাল ফেস্ট।সবাই সবার ভাই বোনদের নিয়ে আসবে।তুইও তাদের নিয়ে আসবি।বুঝলি?’

‘ধ্যাত।এসব ফেস্ট টেস্ট আমার ভালো লাগে না।তুই যা।আমি যেতে পারব না।’

‘তোর ভালো না লাগলে নাই।শুভি আর চিত্র’র তো ভালো লাগে।তুই তাদের নিয়ে আয়।তুই না হয় চব্বিশ না হতেই বুড়িয়ে গিয়েছিস।বাচ্চাগুলো তো এখনো ছোট।তাদের দিকটা তো অন্তত ভাব।’

নবনীতা আর না পেরে বলল,’থাক হয়েছে।এদেরকে আমি সময় করে ঠিকই বেড়াতে নিয়ে যাই।তাছাড়া শুভির ক্লাস টেস্ট আছে তেইশ তারিখ।কীভাবে যাব বল?’

‘চিত্র কে নিয়ে আয়।শুভি তো কলেজের জন্য প্রায়ই বাইরে যায়।চিত্র তো সারাদিন এই চার দেয়ালে বন্দি।চিত্রকে সাথে নিয়ে আয়।’

নবনীতা পরাজিত সৈনিকের ন্যায় মাথা নেড়ে বলল,’আচ্ছা বাবা হয়েছে।দেখছি আমি ব্যাপারটা।কিন্তু আগেই বলে দিচ্ছি আমি কিন্তু কোনো শিওরিটি দিতে পারব না।না আসলে মন খারাপ করিস না কিন্তু আবার।’

রিমি বোধ হয় প্রস্তাবে রাজি হয়েছে।এরপর আর সে কোনো জোরাজুরি করল না।নবনীতা ফোন রেখে চিত্রার কাছে গিয়ে চিত্রার চুলের ঝুটিতে আলতো করে টান দিয়ে বলল,’এই চিত্র! তুই কি আপাইয়ের সাথে বাইরে যেতে চাস?’

প্রশ্ন শুনতেই চিত্রার চোখ দু’টো খুশিতে ছলাৎ ছলাৎ করে উঠল।সে জোরে জোরে মাথা নেড়ে জানাল সে যেতে চায়।নবনীতা চোখ পাকিয়ে আঙুল তুলে কড়া গলায় বলল,’নিয়ে যেতে পারি।তবে আমার শর্ত আছে একটা।’

চিত্রা গাল ফুলিয়ে মুখটাকে দুখী দুখী করে বলল,’আবার কি শর্ত আপাই?’

‘শর্ত হচ্ছে তুমি আপাইয়ের হাত ছাড়বে না।এদিক সেদিক কোথাও যাবে না।চুপটি করে ভালো মেয়ের মতো বসে থাকবে।রাজি তো?’

চিত্রা দ্রুত উপরনিচ মাথা নাড়ল।বুড়ো আঙুল তুলে পাকামো করে বলল,’ওকে।রাজি পরী।আমি রাজি।’

নবনী তার গালে ছোট করে চিমটি কেটে বলল,’খুব পাকা হয়েছিস না?পরী পরী করে ডাকছিস যেন তোর ছোট আমি।’
.
.
.
.
‘ভাই একেবারে অথেনটিক নিউজ।ঐ ফাহাদ সেদিন রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নবনীতা মেয়েটার সাথে কি যেন কথা বলেছে।’

রনি থামল।চোখ তুলে দেখল আরহাম তীক্ষ্ণ চোখে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।সে থামতেই আরহাম চোখ সরু করে বলল,’কিন্তু কেন?কেস কি?কিছু জানিস?’

‘না ভাই।তবে এটাই প্রথম না।শুনেছি ঐ নবনীতা নাকি এর আগেও ফাহাদের অফিসে গিয়েছিল একবার।’

আরহাম উত্তর দেওয়ার আগেই পেছন থেকে কেউ একজন অশালীন ইঙ্গিত করে বলল,’বাপরে! একেবারে অফিস পর্যন্ত ঢুকে গেছে।ঠিক মতো খবর নিলে জানা যাবে শোয়ার ঘরেও যাতায়াত আছে।’

সবুজ ভেবেছিল ভাইয়ের অপছন্দের মানুষটি কে নিয়ে নিছক মজার ছলে একটা কুৎসিত বাক্য বলে দিলেই হয়তো ভাইসহ পুরো রুমের মানুষ হাসিতে ফেটে পড়বে।কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়,তেমন কিছুই হলো না।ঘর ভর্তি ছেলে ঘাড় ঘুরিয়ে এমনভাবে তাকে দেখল যেন সে খুবই বড়সড় অন্যায় করেছে।তোফায়েল চোখ গরম করে বলল,’বাজে বকবি না সবুজ।ঠিক আছে,নবনীতার সাথে ভাইয়ের বিভিন্ন ঝামেলা হয়েছে।আমাদের কারোই তাকে পছন্দ না।কিন্তু তার মানে এই না যে আমরা তার চরিত্র নিয়ে যা তা বলব।মেয়েটি সাহসী,অন্যান্য মেয়েদের চেয়ে আলাদা।তাই বলে তাকে চরিত্রহীন বলবি?আমার কিন্তু তাকে সেরকম লাগে নি একবারও।’

দেখা গেল তোফায়েলের কথার সাথে মোটামুটি সবাই একমত।অদ্ভুত বিষয়! মেয়েটিকে তাদের কারো পছন্দ না,তবুও তার নামে কুৎসিত কথা শুনতে তারা নারাজ।আরহাম সূচালো চোখে একনজর তার ছেলেপেলে দের দেখে নিল।তারপর আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বলল,’তা অবশ্য ঠিক বলেছিস তোফায়েল।আমারও তাকে তেমন মেয়ে মনে হয়নি।তবে ফাহাদ কেনো তার সাথে দেখা করল?কেসটা ঠিক কি বুঝতে পারছি না।’

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে