#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৬)
তাসনুভা হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে সেটাকে বারান্দায় নিয়ে দাঁড় করালো।আজ খুব সুন্দর করে চাঁদ উঠেছে।আকাশটা একেবারে স্বচ্ছ।মেঘ নেই,মিটমিট করে জ্বলতে থাকা তারা গুলো আকাশ দখল করে নিয়েছে।
বাগান থেকে গুনগুন আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।সম্ভবত সেখানে কেউ আছে।তাসনুভা বাগানে উঁকি দিলো।জসিম কাকা,মদিনা খালা আর তাদের ছোট্ট ছেলে জীবনকে দেখা যাচ্ছে।জসিম কাকার হাতে কাঁচা মাটি,আর খালার হাতে গাছ।জীবনের কোনো কাজ নেই,সে এমনিই এসেছে মা-বাবার সাথে।কোনো কাজ না থাকায় জীবন থেমে নেই।সে পুরো বাগানের এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে।
তাসনুভা থমকাল।তার সমস্ত মনোযোগ গিয়ে থামল জীবনের ছুটতে থাকা পা জোড়ার দিকে।ইশশশ!! কতো সুন্দর করে দৌঁড়াচ্ছে জীবন! তার কাছে দু’টো পা আছে,যেই পা দিয়ে সে যেখানে খুশি যেতে পারে।
তাসনুভা মাথা নুয়াল।তার কাছেও দু’টো পা আছে।কিন্তু অচল।সে এদের নিয়ে এমন ছুটতে পারে না।তাসনুভা আনমনে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।স্রস্টা তো সবাইকে সব দেয় না তাই না?তিনি আরহাম ভাইয়াকে ধৈর্য দেননি,আরিশ ভাইয়াকে বুদ্ধি দেননি,আর তাসনুভাকে চলাচলের ক্ষমতা দেননি।একসময় অবশ্য দিয়েছিলেন,এখন আবার নিয়ে গেছেন।
তাসনুভা এক গালে হাত রেখে বাগানের ফুল গাছ গুলো দেখে যাচ্ছিল।তার হঠাৎ বাগানে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।ঠিক তখনি সাদা রঙের একটি গাড়ি বাড়ির মূল ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল।তাসনুভার কপালে ভাঁজ পড়ল।এই সময়ে কে এলো আবার?
গাড়ির দরজা ঠেলে একপ্রকার ঢুলতে ঢুলতে বাইরে বেরিয়ে এলো সারাহ।তার পরনে কালো রঙের স্লিভলেস পোশাক।সেটা আবার শেষ হয়েছে হাঁটুতে।তাকে দেখাচ্ছে বিচ্ছিরি! জঘন্য!
তাসনুভার নিজে নিজে ভেঙচি কাটল।দাঁত কিড়মিড় করে বলল,’যেই না চেহারা,নাম রেখেছে পেয়ারা!’
গাড়ির ভেতর কে ছিল তাসনুভা দেখতে পায়নি,দেখার আগ্রহও দেখায়নি।সারাহ’র কাছে ভালো কিছু আশা করা যায় না।তাসনুভা অন্তত করে না।গ্রাম থেকে শহরে আসার পরেই তার পাখা গজিয়েছে।এই জাতের মানুষের পাখা কেটে দেওয়াটা একটু কষ্টের।
তাসনুভা দ্রুত চাকা ঘুরিয়ে রুমের বাইরে এসে দোতালার করিডরে গিয়ে থামল।এদিক থেকে নিচের সবকিছু ভালো করে দেখা যায়।
সারাহ বাড়ি ফেরার পরই তার সাথে সবার প্রথমে আফরোজা বেগমের দেখা হলো।বাড়িতে অবশ্য সে সময় আফরোজা আর তাসনুভা ছাড়া আর কেউ ছিল না।আফরোজা বেগম মেয়ের এই খোলামেলা পোশাক দেখেই মৃদু ধমকে উঠে বললেন,’এসব কি সারাহ?তোকে না বলেছি এধরনের জামা পরে বাড়ি আসবি না?আরহাম অথবা আরিশ দেখে নিলে কি একটা কেলেঙ্কারি বাধবে জানিস না?
সারাহ ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে তার মা কে পাশ কাটিয়ে হেঁটে গেল।যেতে যেতে কেবল মাথা নেড়ে বলল,’ওহহ কাম অন মা।এতোকিছু দেখার সময় আমার নেই।আমি এডাল্ট।প্রাপ্তবয়স্কা আমি।আমি তাই করব যা আমার ভালো লাগে।’
সারাহ হেলেদুলে নিজের ঘরে চলে গেল।তাসনুভা কপাল কোঁচকাল।নেশা টেশা করে নাকি?কেমন অদ্ভুত করে কথা বলছিল আর হাঁটছিল।
তাসনুভা আর সেসব ঘাটায় না।কেবল সিঁড়ির মাথায় এগিয়ে এসে আফরোজা বেগমকে ডেকে বলল,’ফুফু আমাকে একটু নিচে নামিয়ে দিবে?’
আফরোজা বেগম ঘুরে দাঁড়ালেন।এক প্রকার বিরক্তি নিয়ে এগিয়ে গেলেন।তাসনুভা যেন তার সেই বিরক্তিভাব ধরে ফেলতে না পারে,সেজন্যই সম্ভবত মুখে জোরপূর্বক একটা মেকি হাসি ফুটালেন।জানতে চাইলেন,’কেমন আছিস মা?শরীর ভালো?’
তাসনুভা মাথা নাড়ল,জানাল তার শরীর ভালো।আফরোজা বেগমকে তাসনুভার পছন্দ না।তার মধ্যে একপ্রকার ভন্ডামি আছে।আরহাম ভাইয়া বিচক্ষণ।আফরোজা যে একটা আস্ত ভন্ড সেটা আর না বুঝার কথা না।কিন্তু তারপরেও কেনো আফরোজা কে বাড়ি থেকে বের করছে না কে জানে?
নিচে নামার পরেই তাসনুভা দু’হাতে চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে সোজা বাগানে গেল।জীবন তাকে দেখতেই তার কাছে ছুটে এলো,তার গলা জড়িয়ে ধরল।তাসনুভা উৎফুল্ল মুখে বলল,’কেমন আছিস জীবু?’
জীবন লাজুক হাসল,একশব্দে জবাব দিল,’ভালো।’
জসিম তাকে দেখামাত্রই অবাক হয়ে বলল,’আম্মাজান! আপনি এতো রাইতে বাগানে কি করেন?’
তাসনুভা হাসিমুখে এগিয়ে এলো।চারদিক দেখে বলল,’বারান্দা থেকে তোমাদের দেখছিলাম।দেখেই আসতে ইচ্ছে হলো।কি করছ তোমরা?’
মদিনা ফুলের চারা টা তাসনুভার চোখের সামনে মেলে ধরে বলল,’এটা লাগাইতে আইসি।রাইত ছাড়া এটা লাগান যায় না।’
তাসনুভা হাত বাড়িয়ে বলল,’দেখি আমাকে দাও তো।নাম কি এই চারার?’
মদিনা শান্তভাবে হাত বাড়িয়ে চারাটা তার হাতে তুলে দিলো।নিরুদ্বেগ ভঙ্গিতে বলল,’নাম কইতে পারি না।বড় বাবায় আনাইছে।বিদেশি চারা।নাম ধাম জানি না।খালি এদ্দুর জানি যে এইটা রাইতে না লাগাইলে বাঁচে না।’
তাসনুভা চারাটা নেড়েচেড়ে দেখে আবার মদিনার হাতে তুলে দিলো।এসব অদ্ভুত জিনিস তার বড় ভাইয়ের দ্বারাই কেনা সম্ভব।
মদিনা কোমরে আঁচল গুজে মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে চারাটা ঠিকঠাক জায়গায় রাখলেন।জসিম তার উপর কাঁচা মাটি ফেলে প্রায় কয়েক ইঞ্চি পুরু মাটির স্তর দিলেন।তাসনুভা চোখ সরু করে বলল,’সেকি!গাছে তো কোনো ফুলও নাই!’
জসিম চারদিক পরিষ্কার করতে করতে গলা উঁচু করে জানাল,’এই গাছে কয়েক বছর পর পর একবার ফুল ফুডে।ফুল ফুডতে এখনো মেলা দেরি আম্মাজান।’
তাসনুভা নাক ছিটকাল।এতো ভালো ভালো গাছ থাকতে বড় ভাইয়া কিসব আধমরা,কয়েক বছরে একবার ফুল দিতে পারা গাছ এনেছে।বড় ভাইয়াকে নিয়ে তাসনুভার চিন্তা হয়।ভাইয়ার কাজকর্মের কোনো ঠিক নাই।বিয়ের বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে অথচ বিয়ের কোনো আগ্রহই দেখাচ্ছে না।তাসনুভার কতো জল্পনা কল্পনা তার হবু ভাবিকে নিয়ে।অথচ তার ভাই আদৌ বিয়ে করবে নাকি সেটাও তার জানা নেই।
.
.
.
.
সাদেক সাহেবের বাড়িতে টেলিভিশন নেই।কাজেই শুভ্রানী পর্যন্ত তার বোনের ঘটানো লঙ্কাকাণ্ডের খবর সাথে সাথেই পৌঁছায়নি।বিকেলে যখন সে বাড়ির ছাদে গেল ঠান্ডা বাতাস খেতে,তখন তার সহপাঠী নম্রতা তাকে তার মুঠোফোনে আজকের দিনের সকল নিউজ চ্যানেলের হাইলাইটেড আর জনপ্রিয় নিউজটা দেখালো।
শুভ্রা ফ্যালফ্যাল চোখে অপলক ভিডিও ক্লিপটা দেখল।পুরোটা দেখতেই তার চোয়াল ঝুলে গেল।আপাই আজ এতো বড় কান্ড ঘটিয়েছে?অথচ এতোকিছুর পরেও সে এতো শান্ত কি করে?
শুভ্রা পুরোটা ভিডিও আরো একবার দেখল।কি সাংঘাতিক ব্যাপার! এতো এতো ক্যামেরার সামনে আপাই এধরনের কথা বলছে সেটা শুভ্রার বিশ্বাস হচ্ছে না।আপাই ভীষণ নরম মনের মানুষ।শুভি সেটা জানে।কিন্তু সে এও জানে যে তার পরী আপাই সহজে কোনো ঝামেলায় জড়ায় না।অন্তত এসব মিডিয়া,রিপোর্টারস এর ঝামেলায় তো মোটেই না।
সে আর এক মুহূর্ত ছাদে দাঁড়াল না।এক দৌঁড়ে বাড়িতে এসে সোজা তাদের ঘরে গেল।গিয়েই দেখল নবনীতা চিত্রাকে কোলের ওপর বসিয়ে তাকে যোগ বিয়োগ শেখাচ্ছে।চিত্রা কয়েকমাস পরেই স্কুল যাবে।নবনীতা সিদ্ধান্ত নিয়েছে চিত্রাকে কোনো নার্সারি কিংবা কেজিতে পড়াবে না।একদম সোজা ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করাবে।নার্সারি কেজিতে যা পড়ায় সেটা নবনীতা নিজেই তাকে পড়াতে পারবে।
চিত্রাকে স্কুলে না দেওয়ার আরো একটা কারণ হচ্ছে যাতায়াতের সমস্যা।তাকে স্কুলে দিলে নবনীতার তাকে প্রতিদিন আনা নেওয়া করতে হবে।এই অফুরন্ত সময়েরই বড্ড অভাব নবনীতার।
শুভ্রানী হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকেই হড়বড় করে বলল,’তুমি এটা কি করেছ আপাই?’
নবনীতা বইয়ের পাতা থেকে চোখ সরাল।জানতে চাইল,’কি হয়েছে?কি করেছ আমি?’
শুভ্রা এগিয়ে এলো।আশ্চর্য হয়ে বলল,’তুমি জানো না তুমি কি করেছ?মিডিয়ার সামনে তুমি এসব কি বলেছ?’
নবনীতা কিছুক্ষণ চুপচাপ শান্ত হয়ে বসে থাকল।একটু সময় বাদে চিত্রাকে খাটে বসিয়ে সে সাবধানে উঠে এলো।ছোট ছোট পা ফেলে বারান্দায় গিয়ে রেলিং ধরে দাঁড়ালো।তার খোপা ঢিলে হয়ে গেছে।ফাঁক-ফোকর দিয়ে চুল বেরিয়ে যাচ্ছে।শুভ্রা বারান্দায় এলো।ঠিক নবনীতার পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল।আস্তে করে ডাকল,’আপাই!’
নবনীতা সেদিকে ফিরল না।আকাশে গুড়ুম গুড়ুম শব্দ হচ্ছে।স্বচ্ছ আকাশে ফালি ফালি মেঘ জমছে।নবনীতা আকাশ দেখতে দেখতে বলল,’এ জাতীয় ঝামেলা আমি সবসময় এড়িয়ে চলার চেষ্টা করি শুভি! আমি জানি দেশের রাজনীতির অবস্থা কতো খারাপ।কিন্তু আজ আমার কি হয়েছে আমি জানি না রে শুভি।’
বলতে বলতেই তার কন্ঠ কেঁপে ওঠল।শুভ্রা অবাক হয়ে বলল,’কি হয়েছে আপাই?তুমি এমন করছ কেন?’
নবনীতা খোলা বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিল।সুমিষ্ট স্বরে থেমে থেমে বলল,’আজকের ঐ লোকটাকে দেখে আমার বাবার কথা মনে পড়ে গেছে শুভি।আমি স্পষ্ট দেখেছি বাবা রাস্তায় পড়ে আছে,শরীরে অনেক রক্ত।বাবা কাতরাচ্ছে।আমি সত্যি বলছি শুভি।সেই দৃশ্য আমি সহ্য করতে পারি না।আমি রক্ত সহ্য করতে পারি না।রক্তে মাখামাখি হয়ে যাওয়া শরীর আমি সহ্য করতে পারি না।আমার অস্বস্তি হয়,পাগল পাগল লাগে।’
শুভ্রানী কিছু বলল না।কেবল চুপচাপ পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে রইল।আপাই যেই আনাড়ি হাতে খোপা বেঁধেছিল,সেটা খুলে গিয়ে মসৃণ চুলগুলো পীঠ ছাড়িয়ে কোমর পর্যন্ত নেমে এসেছে।বাইরে মৃদু বাতাস বইছে,সেই বাতাসে পরী আপার চুল উড়ছে।তাকে দেখতে ভালো লাগছে।শুভ্রা আর কিছু শুনল না।কেবল একনজরে নবনীতার অল্প অল্প কাঁপা ঠোঁট আর হাতটা দেখে নিল।কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অনেক দামি দামি ক্যামেরা এনে সবার ছবি তোলা হয়।এমন একটা ক্যামেরা এনে আপাইয়ের একটা ছবি তুলে নিলে কেমন হয়?আপাই কিছুতেই বিশ্বাস করে না সে কতোখানি সুন্দর।একটা ছবি তুলে নিলে নিশ্চয়ই আপাই বিশ্বাস করবে সে সত্যিই খুব সুন্দর।শুভ্রা মিথ্যে বলে না।পরী আপার মতো সুন্দর মেয়েমানুষ সে এই শহরে দু’টো দেখেনি।
সকালে যেই অসহ্য তাপদাহে রাস্তায় ঠিক মতো হাঁটা পর্যন্ত যাচ্ছিল না,এখন সন্ধ্যের একটু আগেই আকাশ মেঘলা হয়ে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।বারান্দার গ্রিল দিয়ে বৃষ্টির ছটা নবনীতার মুখে এসে পড়ছিল।নবনীতা বিষন্ন মলিন আর ক্লান্ত মুখে বারান্দা থেকে তার ঘরে এসে খাটের এক কোণায় গিয়ে বসল।অন্যসময় হলে সে শুভ্রাকে নিয়ে বারান্দার দরজা বন্ধ করে তবেই আসতো।কিন্তু আজ সে এমন কিছুই করেনি।শুভ্রা নিজেই দরজা টেনে ঘরের ভেতর এলো।নবনীর হাত তখনো কাঁপছিল।শুভ্রা এগিয়ে গেল।উৎকন্ঠা মেশানো স্বরে জানতে চাইল,’কি হয়েছে আপাই?ঠিক আছো তুমি?’
নবনী একহাতে চাদর খাঁমচে ধরে অন্যহাতে শুভ্রার হাত চেপে ধরল।তার গলা দিয়ে শব্দ বেরুচ্ছে না।সে শ্বাস টানতে টানতে কোনোরকমে বলল,’ইন-ইনহেলার টা দে শুভি।’
শুভ্রার হাত থেকে ইনহেলার নেওয়ার পরেই নবনীতা শ্বাস টানতে টানতে আস্তে করে মাথাটা বালিশে রাখল।শুভ্রা ভয়াতুর গলায় বলল,’কি হয়েছে তোমার?এমন করছ কেন?’
নবনীতা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল।চাপা গলায় বলল,’বাতিটা নিভিয়ে দে শুভি।দরজাটা চাপিয়ে দে।আওয়াজ ভালো লাগছে না আমার।’
চলবে-