কোনো এক শ্রাবণে পর্ব-০৩

0
188

#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন

(৩)
পল্টনে যেই বিশাল সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছিল,সেই সমাবেশটা সফলভাবে শেষ হয়েছে।শুধু আরহাম না,সে বাদেও দলীয় আরো অনেক নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রেখেছে।সেই সাথে আসন্ন নির্বাচনে কেনো আরহামকেই মনোনয়ন দেওয়া উচিত সেই নিয়েও বিস্তর আলোচনা চলল।আরহাম যেমনটা ভেবেছিল,দেখা গেল সমাবেশ আরো বেশি সুন্দর আর শান্তিপূর্ণ ভাবে সম্পন্ন হয়েছে।বিরোধী দলের লোকরা কোনো ক্যাচাল করা তো দূর,সমাবেশ চলাকালীন সময়ে পল্টনের আশে পাশেও প্রবেশ করতে পারল না।

সমাবেশ শেষ করে যদিও আরহামের পরিকল্পনা ছিল দলীয় কার্যালয়ে যাওয়া,কিন্তু হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন আসাতে আরহাম সেই পরিকল্পনা বাদ দিয়ে সোজা বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নিল।

গুলশান রেসিডেন্সিয়াল এরিয়াতে যেই বাসাটিতে তারা থাকে,সেটা তার বাবা বছর দশেক আগে বানিয়েছেন।অফ হোয়াইট রঙের ডুপ্লেক্স বাড়িটির নাম আজিজ ভিলা।তার প্রয়াত পিতার নাম শেখ আজিজ হোসেন।

বাড়িতে আসার পরেই সবার প্রথমে তার সাথে আফরোজা বেগমের দেখা হলো।আফরোজা বেগম সোফায় পা তুলে টেলিভিশন দেখছিলেন।আরহাম বাড়িতে আসামাত্রই তিনি রিমোট ফেলে উঠে দাঁড়ালেন।

আরহাম ডানে বামে না দেখে সোজা দোতালায় উঠে এলো।তাসনুভার ঘরের দরজা সামান্য ভিড়িয়ে রাখা।আরহাম দরজার সামনে গিয়ে গলা খাকারি দিল,’তাস!আসবো?’

ভেতর থেকে আহ্লাদী স্বর ভেসে এলো,’আরহাম ভাই।তাড়াতাড়ি এসো।’

আরহাম পাঞ্জাবির কলারটা ঠিক করে ঘরে ঢুকল।খাটের মাঝামাঝি তাসনুভা বসে আছে।তার এক হাত হাঁটুর উপর,অন্য হাত আরিশের হাতের মুঠোয়।খাটের এক পাশে সিটি হসপিটালের এসিস্ট্যান্ট নার্স শাহানা খাতুন ইঞ্জেকশনের সুই হাতে দাঁড়িয়ে আছেন।আরহাম এগিয়ে গেল।জানতে চাইল,’কি হয়েছে তাস?তুই নাকি ঠিক মতো মেডিসিন নিচ্ছিস না,ইন্জেকশন দেখলেই চেঁচামেচি করছিস?’

তাসনুভার চোখ দু’টো পানিতে টইটম্বুর।যেনো ভাইয়ের আসার অপেক্ষাতেই সে পানিটুকু জমিয়ে রেখেছিল।ভাইকে দেখামাত্র সে ঠোঁট ভেঙে কেঁদে দিল।চমকে ওঠল আরহাম।আর কিছু না ভেবে সে সোজা তাসনুভার মুখোমুখি এসে বসল।তার হাঁটুর উপর রাখা হাতটা নিজের মুঠোয় চেপে বিচলিত আর ব্যস্ত হয়ে বলল,’কি হয়েছে তাস?কাঁদছিস কেনো?ভাইয়া এসেছি তো।কি হয়েছে বল।’

তাসনুভা জবাব দিল না।সে কান্না থামাতে ব্যস্ত।আরিশ আশাহত মুখ করে বলল,’তাস কিছুতেই ইঞ্জেকশন নিতে চাইছে না ভাইয়া।গতবার অনেক জ্বর এসেছিল,এই ভয়ে সে আজ সকাল থেকেই শাহানা আন্টির কাছ থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।আমি অনেক বুঝিয়েছি ভাই।কিন্তু সে কিছুতেই কথা শুনছে না।বললেই কেবল কান্না করছে।’

আরহাম ছোট করে একটা শ্বাস ফেলে আবার তাসনুভার দিকে ফিরল।তাসনুভা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,’ভাইয়া অনেক যন্ত্রণা হয়।সহ্য করতে পারি না আমি সেই যন্ত্রণা।’

বুকটা কেমন ছ্যাঁৎ করে ওঠল আরহামের।সে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘরের এক কোণায় ফেলে রাখা হুইল চেয়ারটা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।সামনে ফিরে তার ডানহাতটা তাসনুভার মাথার উপর রেখে অত্যন্ত কোমল হয়ে বলল,’আমি জানি তাস।আমি জানি তুই কতোখানি যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিস।কিন্তু সারাজীবন যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার চাইতে এখন একটু যন্ত্রণা সহ্য করে নেওয়া ভালো না বল?একটু কষ্ট কর।দেখবি আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠবি।’

‘ভাইয়া আমি কি কখনো নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারব?’ তাসনুভার সরল সোজা প্রশ্ন।

আরহাম ক্ষণিকের জন্য থমকে গেল।তারপরই নিজেকে সামলে নিয়ে দৃঢ় গলায় বলল,’অবশ্যই তাসনুভা।অবশ্যই তুমি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে।আমি কথা দিচ্ছি তোমায়।তুমি খুব দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠবে।’

তার কথার পিঠে আরিশ নিজ থেকে বলে ওঠল,’তুই এতো কেনো ভাবছিস তাস?তুই কেবল মেডিসিন আর ইঞ্জেকশন গুলো সময় মতো নিয়ে যা।এরপর দেখবি কখন যে নিজ পায়ে হাঁটার বদলে দৌঁড়ানো শুরু করেছিস টেরও পাবি না।’

তাসনুভা ভেজা চোখ দু’টো মেলে তার দুই ভাইকে একনজর করে দেখল।তারপর ভয়াতুর কন্ঠে বলল,’আমি ঠিক হবো তো ভাইয়া?আজ রাতে আবার জ্বর আসবে না তো?’

আরহাম ধৈর্যহারা হলো না।বরং আগের চেয়েও কোমল হয়ে বলল,’কিচ্ছু হবে না তাস।ভাইয়া আজকে তোমার সাথেই থাকবো।’

শাহানা ভরসা পেয়ে ইঞ্জেকশনটা একবার পরোখ করে নিয়ে খাটের ধাঁর ঘেঁষে দাঁড়াল।তাসনুভা শক্ত করে তার দুই ভাইয়ের হাত চেপে ধরল।বোকাসোকা মেয়েটি টের পেল দুই ভাইয়ের শক্ত মুঠোর দাপটে তার ভয় ভয় ভাব কেটে যাচ্ছে।তার আর ভয় হচ্ছে না।মনে হচ্ছে না আজ রাতে তীব্র জ্বর আর মাংসপেশীর অসহনীয় যন্ত্রণায় তার কেমন লাগবে।শুধু মনে হচ্ছে আরহাম ভাইয়া আর আরিশ ভাইয়া থাকতে তার কোনো দুঃখ নেই,কোনো কষ্ট নেই।

ইঞ্জেকশন দেওয়ার পর শাহানা খাতুন তাসনুভাকে আরো কয়েকটা ঔষধ খাইয়ে দিলেন।দেখা গেল ঔষধগুলো খাওয়ার মিনিট দশেকের মাথায় তাসনুভা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।আরহাম আর আরিশ ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।আরিশ জানতে চাইল সমাবেশ কেমন হয়েছে।আরহাম মাথা নাড়ল,ছোট করে বলল,’ভালোই হয়েছে।এখন শুধু ভালোয় ভালোয় নমিনেশন টা পেলেই হলো।’

দুপুর তিনটা বাজার কিছু সময় পর আরহামের ফোনে ওয়াজিদের কল এলো।আরহাম ঠিক মতো ফোন রিসিভ করার আগেই ওয়াজিদ হড়বড় করে বলল,’আরহাম তুই কোথায়?দ্রুত মালিবাগ থানায় আয়।টিটু আর মিরনকে থানায় আটকে রাখা হয়েছে।’

কথা কানে যেতেই আরহাম তৎক্ষনাৎ একটা ঢিলেঢালা টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে বেরিয়ে গেল।সে সবেমাত্র গোসল করেছে।ভেজা চুলগুলো থেকে পানি পড়ে তার কলারের দিকটা সিক্ত হয়ে আছে।

আরহাম গাড়িতে উঠেই সোজা মালিবাগ থানার পথ ধরল।আজ রাস্তায় তেমন মানুষ নেই।আরহাম তার পাজেরো গাড়িটি একপ্রকার উড়িয়ে এনে মালিবাগ থানার সামনে থামাল।

থানার গেইটে ওয়াজিদ দু’হাত আড়াআড়ি রেখে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল।আরহামকে দেখতেই সে দু’কদম এগিয়ে এলো।আরহাম জানতে চাইল কোথায় আছে তারা।ওয়াজিদ তর্জনী তুলে থানার ভেতরের একটা রুম দেখাল।

আরহাম তার ট্রাউজারের পকেটে একহাত গুজে হেলেদুলে ভেতরে গেল।ইন্সপেক্টর রিদওয়ান হাফিস তখন তার ডেস্কে বসে অভিযোগ খাতায় কিছু একটা লিখছিল।আরহাম রুমে ঢুকেই ডেস্কের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।গলা উঁচু করে অভিবাদন জানাল,’আসসালামুআলাইকুম ইন্সপেক্টর সাহেব।’

রিদওয়ান অভিযোগের ডায়রি থেকে মাথা তুলল। সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটিকে দেখামাত্রই সে এক লাফে উঠে দাঁড়াল।সালাম দিয়ে বলল,’স্যার আপনি?’

আরহাম গম্ভীর মুখ করে প্রশ্ন করল,’শুনেছি তুমি নাকি আমার দলের দু’জন ছেলেকে লক-আপে পুরেছ আজ?’

রিদওয়ান কপাল কুঁচকে নিল তার কথা শুনতেই।সহসা তার কপাল মসৃণ হলো।কিছু একটা বুঝে ফেলার মতো করে মাথা নেড়ে সে বলল,’ঐ ছেলেগুলো আপনার দলের ছিল?সরি স্যার,জানতাম না আমি এ বিষয়ে।’

আরহাম টেবিলের সামনে রাখা কাঠের চেয়ারটি টেনে তার উপর বসল।পায়ের উপর পা তুলে বলল,’দোষ কি করেছিল এমনিতে?মারপিট করেছিল নাকি?’

‘না স্যার।এরা দু’জন একটা মেয়েকে ফলো করছিল।ফলো করতে করতে মালিবাগ পর্যন্ত এসে গিয়েছিল।পরে মেয়ের বোন এদেরকে ধরে এনে আমার হাতে তুলে দিয়েছে।’

আরহাম বিষম খেল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’কি অদ্ভুত!মেয়ে করেছে এসব?’

‘জ্বী স্যার।একেবারে রোগা পাতলা একটা মেয়ে।সাথে আবার অভিযোগও দায়ের করেছে।’

আরহাম উপরনিচ মাথা নাড়ল।টেবিলের উপর রাখা পেপারওয়েট টা একবার শূন্যে ছুড়ে আবারো নিজের মুঠোর পুরে নিল।তারপর ধারাবাহিক ভাবে একই কাজ বার বার করতে লাগল।মাঝখানটায় ভরাট পুরুষালি কন্ঠে আদেশের সুরে বলল,’যাও তাদের কে বের করে আনো।’

রিদওয়ান ছুটল লক-আপের দিকে।দুই মিনিটের মাথায়ই সে তার পেছনে টিটু আর মিরনকে নিয়ে হাজির হলো।আরহাম এদের মুখের অবস্থা দেখেই চোখ কপালে তুলে বলল,’কিরে তোদের মুখের এই অবস্থা হয়েছে কেনো?কে মেরেছে তোদের?’

মিরন ঠোঁটের চারপাশে লেপ্টে থাকা রক্তটুকু মুছে নিল।তাদের হয়ে জবাব দিল রিদওয়ান।আফসোস করে বলল,’আরে স্যার,আর বলবেন না।ঐ মেয়ের বোনই তাদের এই অবস্থা করেছে।বেচারাদের লাঠিপেটা করতে করতে থানায় এনেছে ঐ মেয়ে।’

আরহাম দু’হাত বুকে বেঁধে উঠে দাঁড়াল।ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল কে সেই মেয়ে?নাম কি?

রিদওয়ান দ্রুত অভিযোগের ডায়রিটা হাতে নিল।অভিযোগকারী ব্যক্তিটির নাম দেখতেই সে গলা ছেড়ে উচ্চারণ করল,’নবনীতা নূর।সেই অভিযোগ টা করেছে।’

আরহাম শান্ত হয়ে কিছুক্ষণ সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইল।তার কপালের শিরা গুলো ফুলে যাচ্ছে।রাগে তার শরীর রি রি করছে,দাঁত কিড়মিড় করছে।ঐ নবনীতার দাবাংগিরি বন্ধ হয়নি।আরহাম নিরুত্তর থাকায় ঐ পাজি মেয়েটা নিজেই তার দলের লোকদের লাঠিপেটা শুরু করেছে।মেয়েদের এসব দস্যিপনা আরহামের বড্ড অপছন্দ।মেয়েরা হবে কোমল,স্নিগ্ধ,বহমান নদীর মতো শান্ত।একেবারে তাসনুভার মতো।মেয়েদের কে তো এমনই মানায়।মেয়েরা কেনো নবনীতার মতো ত্যাদড় আর জেদি হবে?জেদ শব্দের সাথে মেয়েদের সম্পর্ক কি?এসব জেদ আর তেজ মেয়েদের সাথে যায় না।

আরহাম দুই বার বড়ো করে শ্বাস নিল।রাগ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসতেই মিরন আর টিটুকে দেখে বলল,’চল বাইরে চল।’

মিরন আর টিটু চুপচাপ মাথা নামিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।ওয়াজিদ বাইরেই হাঁটাহাঁটি করছিল।আরহামকে দেখতেই সে এগিয়ে এলো।আরহাম কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইল,’তুই এই খবর কোথা থেকে পেয়েছিস ওয়াজিদ?’

ওয়াজিদ ক্ষীণ স্বরে উত্তর করল,’আমি মালিবাগ এসেছিলাম একটা কাজে।তখনই মানুষের ভিড় দেখে কৌতূহল বশত এগিয়ে গিয়েছিলাম।তখনই পুরো ঘটনা বুঝতে পারলাম।’

‘যখন সামনে থেকে দেখেছিস,তখন ঐ মেয়ের গালে দু’টো কষিয়ে চড় বসাতে পারলি না?এতো স্পর্ধা পায় কোথা থেকে?’

ওয়াজিদ চমকে ওঠল।আশ্চর্য হয়ে বলল,’তাকে মারব কেনো?দোষ তো তোর দলের ছেলেরা করেছে।একটা মেয়েকে ফলো করা কি কোনো ভালো কাজ?আমি তো এখানে নবনীতার কোনো দোষ দেখছি না।’

আরহাম চোখা চোখে একনজর তাকে দেখে নিল।বিদ্রুপ করে বলল,’বাপরে!খুব নবনীতার গান গাওয়া হচ্ছে দেখছি!’

‘জাস্ট শাট আপ আরহাম।সবকিছু নিয়ে ক্রিটিসাইজ করা বন্ধ কর।ফর গড সেক,’একপ্রকার চেঁচিয়ে ওঠল ওয়াজিদ।

‘ওকে।যেমনটা তুই বলবি।’ আরহাম মেকি হেসে জবাব দিল।

আরহাম পাশ ফিরল।টিটু আর মিরন একেবারে রোবটের মতো দাঁড়িয়ে আছে।না নড়ছে,না কিছু বলছে।আরহাম গলা খাকারি দিল,ভরাট কন্ঠে বলল,’এই যে রোমিওদের দল!এসব টাফালিং আর কতোদিন চলবে?রোজ রোজ তোদের থানা থেকে ছুটিয়ে নিতে কে আসবে?কাল থেকে একটু সীমার মধ্যে থাকবে কেমন?’

দু’জন রোবটের মতোই মাথা নেড়ে জানাল তারা এখন থেকে নিজেদের সীমার মধ্যেই থাকবে।আরহাম প্রসন্ন হেসে বলল,’গুড।মনে থাকে যেন।এখন সোজা বাড়ি যা।’

ছেলে দু’টো মাথা নেড়ে থানার গেইট দিয়ে বেরিয়ে গেল।আরহাম দু’হাত বগলদাবা করে মিনিট খানেক থানার প্রাঙ্গণে সটান দাঁড়িয়ে রইল।মাঝখানে আবার ট্রাওজারের পকেট থেকে মুঠোফোন বের করে সেখানটায় সময় দেখে নিল।ওয়াজিদ আড়চোখে পুরোটা সময় তার কার্যকলাপ দেখে গেল,তবে মুখ ফুটে কিছু বলল না।দু’জনের মধ্যে কিছুসময় স্নায়ুযুদ্ধ চলার পর শেষে আরহাম কেশে কন্ঠ পরিষ্কার করে বলল,’চল গাড়িতে এসে বস।এখানে ভীষণ রোদ।গরম লাগছে আমার।’
.
.
.
.
ষোলো বছর বয়সী কিশোরী মেয়েটির ভয়ে গুটিয়ে যাওয়া শরীরটা তখনও থরথর করে কাঁপছিল।দাঁতে দাঁতে ঘর্ষণের দরুন মুখ থেকে অদ্ভুত ধরনের শব্দ বের হচ্ছিল।

নবনীতা শুভ্রানীর গায়ে একটা কাঁথা মেলে দিয়ে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।শুভ্রার ভয়ে তটস্থ শরীরটা বোনের শক্ত আলিঙ্গনে বেড়াল ছানার মতো মিইয়ে গেল।সে দু’চোখ দিয়ে অনর্গল পানি ছেড়ে বলল,’আপাই আমার খুব ভয় করছে।চলো না আপাই,আমরা শহর ছেড়ে কোথাও পালিয়ে যাই।’

‘শুভি!!’ ছোট খাটো একটা ধমক দিল নবনীতা।

‘এসব কেমন কথা শুভি?আমরা কেনো পালাবো?দোষ কি আমাদের?শোন শুভি,পৃথিবীটা ওতো সোজা না।ওমন বেড়ালের মতো থাকলে শহর কিংবা গ্রাম কোথাও গিয়েই বাঁচতে পারবি না।একটু শক্ত হতে হবে সোনা।আমরা তো কোনো পাপ করছি না তাই না?তাহলে আমরা কেন পালাবো?পাপ করছে তারা যারা বিনা দোষে একটা নিরপরাধ মেয়ের জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করছে।আমরা কেনো তাদের ভয়ে নিজেদের কেই গুটিয়ে নিব?কতোবার গুটিয়ে নিব?কতোবার পিছু হটলে তারা খুশি হবে?বলতে পারিস আমাকে?’

শুভ্রানীর তরফ থেকে কোনো উত্তর আসে না।সে কেবল তার হাতের বন্ধন আরো দৃঢ় করে।আপাইয়ের দুর্বল শরীরটায় কেমন যেন আদর আদর গন্ধ মিশে আছে।শুভ্রা কি সত্যি সত্যি কোনো বেড়াল?না হয় সবকিছুতে এতো ঘ্রাণ খুঁজে নেয় কেমন করে?শুভ্রা আপাইয়ের জীর্ণ শীর্ণ শরীরের উপর নিজের সমস্ত ভার ছেড়ে পড়ে রইল দীর্ঘসময়।নবনীতা তাকে সরাল না,বরং আরেকটু কাছে টেনে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল,কপালে চুমু এঁকে দিল।

শুভ্রা কেবল বয়সেই বেড়েছে।আচরণে এখনো সেই ছোট্ট শুভিই রয়ে গেছে।ছোট বেলায় যেমন বিলি কেটে দিলে কয়েক মিনিটেই ঘুমিয়ে কাদা হতো,এখনও তাই।দেখা গেল দশ মিনিট পরেই সে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।নবনীতা সাবধানে তার মাথাটা বালিশে রেখে নিরবে উঠে এলো।

চিত্রা ফ্লোরের উপর তার খেলনা বিছিয়ে হাড়ি পাতিল খেলছিল।নবনীতা পা টিপে টিপে তার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল।পেছন থেকে তাকে চমকে দেওয়ার জন্য অকস্মাৎ শব্দ করে ওঠল,’ভাউ!!’

চিত্রা সত্যি সত্যিই ভয়ে কেঁপে ওঠল।নবনীতা খিলখিল করে হেসে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরল।তার লাল লাল গাল দু’টোতে খুব দ্রুত চুমু খেয়ে বলল,’কিরে!ভয় পেয়েছিস চিত্র?’

চিত্রা ভয় পেয়েছি নাকি বোঝা গেল না।তার মুখে ভয়ের কোনো ছাপ নেই,তবে চোখে দু’টোতে কেমন অদ্ভুত মুগ্ধতা মেশানো আছে।নবনীতা হাসি থামিয়ে ভ্রু উঁচু করে বলল,’কিরে?ওমন হা করে কি দেখছিস?আপাই কে কি আজ প্রথম দেখছিস?’

চিত্রা উত্তর না দিয়ে উল্টো হাত বাড়িয়ে নবনীতার গালে আঙুল ছোঁয়াল।নবনীতা বোকা বোকা মুখ করে চুপচাপ বসে রইল।চিত্রার চোখ দু’টো হুট করেই কেমন ঝকমক করে ওঠল।সে চোখ বড় বড় করে বলল,’তুমি যখন হাসো,তখন তোমাকে সিন্ড্রেলার মতো লাগে আপাই।’

চব্বিশ বছরের একটা বাঙালি মেয়ের সাথে যখন ফ্রান্স পুরাণের কোনো অনিন্দ্য সুন্দর কাল্পনিক চরিত্রের তুলনা করা হয় তখন তার জবাবে ঠিক কি বলতে হয়,তাও একটা ছয় বছর বয়সী বাচ্চাকে সেটা নবনীতার জানা নেই।সে উত্তর না দিয়ে কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে চিত্রার উৎসুক আর প্রাণবন্ত মুখটার দিকে চেয়ে রইল।

চিত্রা ইদানিং নিজ থেকে একটু একটু পড়তে পারে।তাকে গত মাসে নবনীতা বেশ কিছু গল্পের বই কিনে দিয়েছে।সেখানে সিন্ড্রেলার গল্পটাও ছিল।খুব সম্ভবত শুভ্রানী তাকে এই গল্পটা পড়ে শুনিয়েছে।

চিত্রা আরো একবার বলল,’পরী আপাই!তুমি সত্যিই সিন্ড্রেলার মতো দেখতে।’

নবনীতা চোখ পাকাল।জানতে চাইল,’তুই কেমন করে জানলি সিন্ড্রেলা দেখতে কেমন ছিল?’

চিত্রা হাত নেড়ে নেড়ে বলল,’শুভি আমায় বলেছে।বলেছে সিন্ড্রেলা দেখতে একেবারে পরীর মতো।’

নবনীতা হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষণ তার দিকে দেখে পরক্ষণেই আবার খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ল।হাসতে হাসতে তার চোখে জল এসে গেল।চিত্রা হা করে সেই দৃশ্য দেখল।তার আপাই এত্তো সুন্দর?অথচ সে এর আগে কোনোদিন খেয়াল করে নি।সে লাজুক হেসে বলল,’তোমাকে সবসময় সিন্ড্রেলা লাগে না আপাই।যখন তুমি হাসো তখনই তোমাকে সিন্ড্রেলার মতো লাগে।’

নবনীতা আজ অনেকদিন পর প্রাণ খুলে হাসল।হাসতে হাসতে তার গাঢ় খয়েরি চোখে কয়েকবার পানি এসে জমল।সে হাসিহাসি মুখ করে চিত্রাকে বলল,’না রে সোনা।আমি সিন্ড্রেলা নই।আমার জুতো সব আমার কাছেই আছে,কোনোটাই হারায়নি।’

‘জুতো হারাতে হবে না।তোমার রাজকুমার তোমাকে এমনিতেই চিনে ফেলবে।জুতো লাগবে না।সিন্ড্রেলা তো পরীদের সাহায্য নিয়েছিল।আমার আপাই তো নিজেই পরী।আমার আপাইকে রাজকুমার নিজেই খুঁজে নিবে।’

নবনীতা ঠোঁট টিপে হাসল।দুষ্টুমি করে বলল,’তা আমারও বুঝি রাজকুমার আছে?’

চিত্রা জেদ ধরল।জোর গলায় বলল,’আছে।সত্যি সত্যি আছে।দেখবে সে তোমাকে টুপ করে ধরে নিয়ে যাবে।’

‘তারপর?তারপর টুশ করে বিয়ে করে নিবে?’ নবনীতা হাসতে হাসতে প্রশ্ন করল।

চিত্রার মনঃক্ষুন্ন হলো।সে মন খারাপ করে বলল,’ভালো লাগে না আপাই।সবকিছুতে তুমি মজা করো।’

নবনীতা আবারো চট করে তার দুই গালে চুমু খেয়ে তাকে জাপটে জড়িয়ে ধরে বলল,’আচ্ছা আর মজা করব না।এবার তাহলে সত্যি কথা বলি।এসব সিন্ড্রেলা ফিন্ড্রেলা বলতে বাস্তবে কিছু নেই।ওগুলো সব গল্প।বাস্তবে না সিন্ড্রেলা আছে,না রাজকুমার আছে,আর না আছে সিন্ড্রেলার জাদুর জুতো।’

নবনীতা চুলগুলোকে কোনোরকম খোপায় বেঁধে চিত্রার খেলনা গুলো হাতে নিয়ে নিয়ে দেখল।অথচ সে জানল না পরী নামের সিন্ড্রেলার রাজকুমার সত্যিই এসে গেছে।বোকা নবনী বুঝলো না জুতো না হারালেও সিন্ড্রেলা হওয়া যায়।তবে সব রাজপুত্র তো আর একরকম হয় না।নবনীতার রাজপুত্র একটু ভিন্ন।কিছুটা এলোমেলো,কিছুটা মাথা গরম,আবার কিছুটা একরোখা।

চলবে-

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে