#কোনো_এক_শ্রাবণে
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(২)
পার্টি অফিস থেকে বেরিয়ে মালিবাগ আসতে আসতে প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো।নবনীতা সারাদিনের ধকলে প্রচন্ড রকম ক্লান্ত হয়ে দু’টো তপ্ত শ্বাস ছাড়ল।
মালিবাগ রেলক্রসিং আসতেই তার মুঠোফোন টি যান্ত্রিক শব্দে চতুর্থবারের মতো বেজে উঠল।নবনীতা আর সেটিকে ব্যাগ থেকে বের করল না।সে জানে কে ফোন করছে।সে একহাত রিকশার নামিয়ে রাখা হুডের উপর চেপে ধরে অনুনয়ের সুরে বলল,’আপাই চলে এসেছি সোনা।একটু অপেক্ষা কর।’
আজ নবনী একটা ভয়ংকর দুঃসাহসিকতার কাজ করেছে।মতিঝিল থেকে মালিবাগ পর্যন্ত সে সোজা রিকশা নিয়ে এসেছে।এই কাজ সে সচরাচর করে না।কেবল শুভ্রানী অথবা চিত্রা সাথে থাকলেই সে এই তিন পায়া যানে চলাচল করে।নয়তো তার জন্য লোকাল বাসই সবচেয়ে উত্তম পরিবহন।আরো ভালো হয় যদি পায়ে হেঁটে পথটুকু অতিক্রম করা যায়।
আজকের ঘটনা আলাদা।আজকে নবনীর শরীর ভালো নেই।সকাল থেকেই মাথা ঘুরছে,বুকে ব্যথা হচ্ছে।এই ক্লান্ত মূর্ছা যাওয়া শরীর নিয়ে লোকাল বাসে উঠে নতুন ঝামেলা বাধাতে সে ইচ্ছুক না।সে চাইছে দ্রুত বাড়ি ফিরতে।চিত্র নিশ্চয়ই এতোটা সময় তাকে না পেয়ে কাঁদছে।শুভি নিজেই তো ছোট মানুষ।সে আর চিত্রকে কেমন করে সামলাবে!
নবনীতা ঠিক বরাবর সাতটার দিকে বাড়িতে এসে পৌঁছাল।বাড়ির বাইরে কলিংবেল আছে।অন্যসময় সে ইচ্ছে করেই বেল বাজাতো।কিন্তু আজ সে তার ব্যাগে থাকা ডুপ্লিকেট চাবি ব্যবহার করে একদম আস্তে করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল।বসার ঘরের বাতি নিভিয়ে রাখা হয়েছে।
নবনীতা পা টিপে টিপে তার শোয়ার ঘরের সামনে গিয়ে ভেতরে উঁকি দিলো।চিত্রা আর শুভ্রানীকে দেখা যাচ্ছে।শুভ্রানী রং দিয়ে কিছু একটা আঁকার চেষ্টা করছে।ছোট্ট চিত্রা গভীর মনোযোগ দিয়ে সেই দৃশ্য দেখছে।
নবনীতা ঠোঁট টিপে হাসলো।কন্ঠ পরিষ্কার করে বলল,’শুভি!চিত্র!কোথায় তোমরা?’
শুভ্রানীর হাতের তিন আঙুলে চেপে রাখা রং পেন্সিলটা তক্ষুনি তার আঁকাআঁকি বন্ধ করে দিলো।দুই বোন তড়িৎ বেগে দরজার দিকে ফিরে বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠল,’আপাই!!”
নবনীতা দ্রুত মুখে আঙুল চেপে শাসনের সুরে বলল,’আহা আস্তে!এতো জোরে কথা বলতে নেই।’
জোরে কথা বলা বারণ।কিন্তু ছুটে গিয়ে বোনকে জড়িয়ে ধরা তো বারণ নেই।শুভ্রানী আর চিত্রা সমস্ত কাজ ফেলে দিয়ে এক দৌঁড়ে তার দিকে ছুটে গেল।আছড়ে পড়ল চব্বিশ ছুঁই ছুঁই রমণীর দুর্বল বক্ষে।সেই বক্ষ পুরুষালী বক্ষের ন্যায় প্রশস্ত না।কিন্তু সেখানে স্বস্তি আছে,ভালোবাসা আছে,শুভ্রানী আর চিত্রার একটা সুন্দর অস্তিত্ব আছে।
দুই বোনকে মন ভরে আদর করার পর নবনীতা সামান্য ঝুঁকে চিত্রাকে কোলে তুলে নিল।চিত্রার ফোলা ফোলা গাল দু’টোতে চটপট চুমু খেয়ে মিষ্টি স্বরে বলল,’তুমি আজ আবার আপাইয়ের জন্য কান্নাকাটি করেছ চিত্র?তোমাকে না আপাই বলেছি শুধু শুধু কাঁদবে না?বড় হচ্ছো না তুমি ধীরে ধীরে?’
চিত্রা ডানে বায়ে মাথা নাড়ল।সে কোথায় বড় হয়েছে?আপাইয়ের কাছে তো সে কোনোদিনই বড় হয়নি।সে তো এখনও ঐ ছোট্ট মেয়েটি আছে যার কাছে মা বাবা এমনকি পুরো পৃথিবীটাই তার পরী আপাই।
‘পরী!এ্যাই পরী?’
মিসেস রোকেয়ার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে।নবনীতা চিত্রাকে কোল থেকে নামিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল।রোকেয়া বেগম তাকে দেখা মাত্রই কর্কশ গলায় বললেন,’কোথায় ছিলে এতোক্ষণ?’
নবনীতা জায়গায় জায়গায় রং উঠে যাওয়া দেয়ালের দিকে চোখ রেখে নিচু স্বরে বলল,’একটা কাজ ছিল মামি।সেখানে আটকা পড়ে গিয়েছিলাম।’
রোকেয়া বেগম থমথমে মুখে আবারো প্রশ্ন করলেন,’ভাড়ার টাকা জোগাড় করেছ?কাল কিন্তু ভাড়া দিতে হবে যে করেই হোক।বাড়ির মালিক রোজ রোজ ভাড়া চাইতে আসেন।আমি আর কতো টালবাহানা করব?কালকের মধ্যে টাকা না দিলে ভীষণ ঝামেলা হয়ে যাবে কিন্তু।’
নবনীতা এক মনে তার কথা শুনল।কথা শেষ হতেই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খাটের এক মাথায় গিয়ে বসলো।শরীরটা ক্লান্তিতে ছিঁড়ে যাচ্ছে।এই মুহূর্তে একটু ভালো কথা নিমিষেই তার মন ভালো করে দিতে পারে।কিন্তু মামি কি সেই কথা বুঝতে পারে?মামি কি অনুভব করতে পারে নবনীতা যে প্রতিদিন একটু একটু করে শেষ হয়ে যাচ্ছে?
নবনীতা পার্স ব্যাগ হাতড়ে হাতড়ে মোট পাঁচ হাজার টাকা বের করল।সেটাই মামির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বিবশ কন্ঠে বলল,’আপাতত এটা রাখো মামি।কাল পরশু বাকিটা দিয়ে দিব।’
রোকেয়া বেগম এক খাবলায় পুরোটা টাকা নিজের হাতে নিলেন।কাটখোট্টা স্বরে বললেন,’ভাড়া কিন্তু ছয় হাজার।সাথে আবার গ্যাস কারেন্টও আছে।এ মাসে তো বাজারও করা হয়নি।সব মিলিয়ে আরো হাজার পাঁচেক লাগবে পরী।”
‘জোগাড় হয়ে যাবে মামি।আর দু’টো দিন অপেক্ষা করো।’
রোকেয়া বেগম শাড়ির আঁচলে নোটগুলো বেঁধে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।শুভ্রানী খেয়াল করল তার পরী আপাই বৃষ্টির দিনেও দর দর করে ঘামছে।সে এক গ্লাস পানি হাতে তার সামনে এসে দাঁড়ালো।কোমল গলায় ডাকল,’আপাই!’
‘কি হয়েছে?’দু’চোখ বুজেই জানতে চাইলো নবনীতা।
‘পানি খাও আপাই।তুমি কিন্তু আজকাল খুব ধকল নিচ্ছ।দয়া করে শরীরকে আর কষ্ট দিবে না আপাই।’
নবনীতা চোখ খুলে সামনে দেখল।তার সামনে পানির গ্লাস হাতে দাঁড়ানো ষোড়শী কন্যাটির চোখ দু’টো ভীষণ ঘোলাটে।মুখ জুড়ে বিষন্নতার ছড়াছড়ি।সে একটানে পানিটুকু খেয়ে শেষ করল।চিত্রা মনের আনন্দে খাটের উপর ছড়িয়ে রাখা রঙ পেন্সিল দিয়ে কাগজে আঁকিবুঁকি করে যাচ্ছিল।নবনীতা হাত বাড়িয়ে ডাকল,’শুভি,এদিকে আয় তো।’
শুভ্রানী বাধ্য মেয়ের মতো এগিয়ে এসে ঠিক তার আপাইয়ের গা ঘেঁষে বসল।নবনীতা তার ডানহাতের দুটো আঙুল পরম যত্নে তার চুলের ভাজে চালাতে চালাতে বলল,’তুই কেঁদেছিস শুভি?’
শুভ্রা চমকাল।দ্রুত মাথা নেড়ে বলল,’না আপাই।কাঁদবো কেন?তুমি যে কিসব বলো না!’
‘কেন কেঁদেছিস শুভি?আপাই আছি না?আপাই থাকতে তোদের কিসের কষ্ট শুনি?’
শুভ্রা নড়েচড়ে উঠল।চোখ দু’টোয় তার অশ্রু জমে চিকচিক করছে।দু’ফোঁটা জল তৎক্ষনাৎ মুক্তদানা রূপে ঝরে পড়ল।শুভ্রা ফুঁপিয়ে উঠল হঠাৎ করে,’আপাই আমার কলেজ যেতে ভয় করে।’
নবনীতা কোমল হাত দু’টো বাড়িয়ে তার চোখ মুছে দিলো।দু’হাতে শক্ত করে বোনকে আঁকড়ে ধরে বলল,’সেকি শুভি!কিসের ভয় তোর?আপাই বলেছি না আমি সব ঠিক করে দিব।চিন্তা করিস না শুভি।আপাই আছি তো বোকা মেয়ে।’
সুন্দর এই স্নেহের বাণী শুভ্রানীর কান্না থামালো না।বরং কিশোরী মেয়েটি তার কথা শুনতেই আগের চেয়ে বেশি শব্দ করে কেঁদে উঠল।হেঁচকি তুলতে তুলতে বলল,’তুমি আছো বলেই তো এতো ভালো আছি আপাই।তুমি না থাকলে কি হবে আমাদের?তুমি কেন নিজের এতো অবহেলা করো বলো তো?’
নবনীতা ভ্রু কুঁচকাল,’আমি কখন নিজের অবহেলা করলাম আবার?’
‘এই যে ঠিকঠাক ডাক্তার দেখাও না।আমাদের একটু জ্বর হলেই কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যাও আর নিজের বেলায় ঔষধ টুকুও কিনো না ঠিক মতোন।এসব করবে না আপাই।আমার খুব কষ্ট হয়।’
নবনীতা বিস্মিত নয়নে অপলক শুভ্রার আদুরে মুখটা দেখে নিল।বোকা মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল করে ফেলেছে।নবনী টের পেল তার দু’চোখ বার বার ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে,দুঃখে না বরং আনন্দে।এই শূন্য খা খা পৃথিবীটা যখন নবনীতার কাছে চরম অসহ্যের মতো মনে হয়,ঠিক তখনই শুভ্রানী আর চিত্রা নামের দু’টি নিয়ামত তার সাদাকালো জীবনে রংধনুর মতো আলো ছড়িয়ে দেয়।পুরো পৃথিবীর সাথে অঘোষিত লড়াই লড়তে লড়তে যখন নবনী খুব বেশি ক্লান্ত,তখন এই মানুষ দু’টো তাকে আগলে নেয়।
ক্লান্ত নিস্তেজ শরীরটা আলতো করে খাটের উপর ছেড়ে দিয়ে নবনীতা চোখ বুজে নিল।ঠোঁট দু’টোর মাঝে একটা মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে চঞ্চল কন্ঠে বলল,’আমার শরীর নিয়ে ভাবিস না শুভি।আমি একদম ভালো আছি।ঘন্টা খানেক ঘুমিয়ে নিতে দে।এরপরই একদম চাঙা হয়ে যাব।’
শুভ্রা ঘরের জানালার ভিড়িয়ে রাখা পর্দা টেনে দিলো।পাখার স্পিড কমিয়ে আলমারির তাক থেকে একটা কাঁথা নামিয়ে নবনীতার রুগ্ন শরীরটার উপর চাপিয়ে দিলো খুব যত্নে।নবনীতা ঘুমের ঘোরেই হালকা হাসল।শুভ্রা সেই অপরূপ স্নিগ্ধ সৌন্দর্য অবলোকন করে নিজ থেকেই বলল,’ইশশ!আমার পরী আপাই কতো সুন্দর!’
.
.
.
.
সমতট লেনের ছাব্বিশ নম্বর বাড়িটিতে লুবনারা ভাড়া থাকে।নবনীতা বাড়ির গেইটের কাছে এসেই কপালে লেগে থাকা ঘামটুকু মুছে নিল।কলিং বাজানোর পর প্রায় পাঁচ মিনিট বাদে লুবনা ঝিমুতে ঝিমুতে দরজা খুললো।
নবনীতা তাকে দেখতেই কঠিন মুখ করে বলল,’এই অসময়ে ঘুমাচ্ছ?পরীক্ষার ডেইট দিয়ে দিয়েছে লুবনা।একটু তো পড়াশোনায় মন দাও।’
কথা শেষ করেই সে জুতো খুলে লুবনার পড়ার ঘরে গিয়ে বসলো।লুবনা চোখে মুখে পানি দিয়ে এক প্রকার বিরক্ত হয়ে পড়ার টেবিলে এসে বসলো।নবনীতা পদার্থ বিজ্ঞান বইটা হাতে নিয়েই মহাকর্ষ আর অভিকর্ষ নামক অধ্যায়টি খুলে জানতে চাইলো,’যেই ছয়টা প্রশ্ন দাগিয়েছিলাম,সেগুলো করেছ?’
লুবনা মাথা নাড়লো,জানাল সে করে নি।নবনীতা কড়া গলায় তাকে কিছু বলতে গিয়েও বলল না।কেবল থমথমে মুখে বলল,’তাহলে এখন আগে সেগুলো করো।’
লুবনা হাই তুলতে তুলতে অঙ্ক করা শুরু করল।এই অধ্যায়টা এতো বিরক্তিকর কেন লুবনার জানা নেই।স্যাটেলাইট আকাশে গিয়ে কতো বেগে ঘুরবে এটা জেনে লুবনার কি কাজ?সে তো আর স্যাটেলাইট না।এটা তার জানার বিষয়ও না।স্যাটেলাইট নিজের মতো করে ঘুরছে ঘুরুক।এসব আবার লুবনাকে কেনো গুনে গুনে বের করতে হবে?লুবনা তো কোনো বিজ্ঞানী না।
নবনীতা গলা খাকারি দিলো।চোখ পাকিয়ে জানতে চাইল,’মনে মনে কি বিড়বিড় করছ লুবনা?আমাকে গালি দিয়ে লাভ নেই।আমি বই লিখিনি।’
‘জ্বী আপু।আপনাকে দিচ্ছি না।যারা বই লিখেছে তাদের কেই দিচ্ছি।’ লুবনা লিখার মাঝেই সোজাসাপ্টা জবাব দিলো।
নবনীতা জবাব শুনেই ফিক করে হেসে দিলো।পরক্ষণেই আবার হাসি থামিয়ে বলল,’গুড।ভেরি গুড।’
প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে লুবনার মা মিসেস ইয়াসমিন তার পড়ার ঘরে ঢুকে ঠিক নবনীতার মুখোমুখি এসে দাঁড়ালেন।তার হাতে কড়কড়ে পাঁচটা হাজার টাকার নোট।নবনী তার হাত দেখেই চোখ নামিয়ে নিল।ইয়াসমিন সুলতানা তার হাতের নোটগুলো নবনীতার দিকে বাড়িয়ে দিলেন।নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললেন,’এই নাও তোমার টাকা।’
নবনীতা হাত বাড়িয়ে চুপচাপ টাকাটা নিয়ে ব্যাগে পুরে নিল।মিসেস ইয়াসমিন বলতে শুরু করলেন,’শোনো নবনীতা,গত মাসে তুমি দুইদিন মিস দিয়েছ।জানি তুমি অসুস্থ ছিলে,কিন্তু মিস তো হয়েছেই তাই না?তাই এই মাসে তুমি যেকোনো দুই দিন মোট দুই বেলা এসে লুবনাকে পড়িয়ে দিবে বুঝেছ?’
নবনীতা মাথা নাড়ল।ছোট করে জানাল সে পড়িয়ে দিবে।মিসেস ইয়াসমিন আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না।শাড়ির আঁচল কোমরে গুজে হনহন করে বেরিয়ে গেলেন।নবনীতা ব্যাগ হাতড়ে তার ইনহেলার টা বের করে দুইবার টেনে টেনে শ্বাস নিল।লুবনা গোল গোল চোখ করে বলল,’খারাপ লাগছে আপু?’
নবনীতা হাত নেড়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বলল,’না না ধুর।এমন কিছু না লুবনা।তুমি অঙ্ক করো,আমি ঠিক আছি।’
লুবনাকে পড়ানো শেষ করেই নবনীতা তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে এলো।দু’মাস আগে একটা কুরিয়ার সার্ভিস অফিসে সে চাকরি নিয়েছে।অস্থায়ী চাকরি।আজ আছে কাল নেই এমন।তবে চাকরিটা নবনীর জন্য কোনো সোনার হরিণের চাইতে কম না।পার্ট টাইম জব হলেও বেতন পাওয়া যায় ছ’হাজার।এতো টাকার চাকরি নবনীতা কিছুতেই হাত ছাড়া করতে চায় না।
সে বিকেল হতেই কুরিয়ার অফিসে এসে পৌঁছুল।আসার পথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল।অফিসের ভেতর ঢুকতেই সবার প্রথমে তার সাথে সুনীতির দেখা হলো।সুনীতি তার ঘামে ভেজা মুখটা দেখতেই একগাল হেসে বলল,’তোমার ছুটোছুটি আর থামবে না তাই না?এতো কষ্ট কি করে করছ নবনী?’
নবনী স্মিত হাসলো।কাঁধের ব্যাগটা টেবিলের উপর রেখেই ক্লান্তি জড়ানো গলায় জবাব দিলো,’কষ্ট কোথায় সুনীতি?এটাই তো জীবন।লাইফ ইজ নট আ বেড অফ রোজেস সুনীতি।জীবনে একটু দৌঁড় ঝাপ থাকবেই।’
কুরিয়ার অফিসের কাজ শেষ হতে হতে প্রায় সাতটা বেজে গেল।নবনীতা ক্লান্ত শরীরটা টেনে টেনে কোনোরকম বাড়ি এসে পৌঁছাল।দুপুর থেকেই তার বুকে ব্যাথা হচ্ছে ভীষণ।এই মাসে তার ঔষধ কেনা হয়নি।মামার ঔষধ কেনার পর তার হাতে আর টাকা ছিল না নিজের ঔষধ কেনার মতো।
বাড়িতে আসতেই নবনী লক্ষ করল শুভ্রানী আজও কেমন উদাস হয়ে বসে আছে।নবনীতা হাত মুখ ধুয়ে ঠিক তার পাশটায় গিয়ে বসল।কাঁধে হাত রেখে তার নাম ধরে ডাকল,
‘শুভি!এ্যাই শুভি!কি হয়েছে তোর?মন খারাপ কেন?দেখি আপাইকে সব খুলে বল।’
শুভ্রানী জোরে জোরে মাথা নেড়ে উত্তর দিলো তেমন কিছুই হয়নি,সব ঠিক আছে।অথচ সে জানে না পরী আপাই থেকে কিছুই গোপন করা সম্ভব না।নবনীতা অনেক চেষ্টার পর তার মুখ থেকে আসল ঘটনা বের করে আনতে সক্ষম হলো।জানা গেল আরহামের চ্যালা পেলা গুলো এখনো আগের মতো কলেজের সামনে ভিড় জমায়।মেয়ে দেখলেই ইশারা ইঙ্গিতে অসভ্যতা শুরু করে।
নবনীতা চোয়াল শক্ত করে তার কথা শুনল।শুভ্রার মুখটা কতো মলিন দেখাচ্ছে!নবনী বোনের গালে আলতো করে চুমু খেল।দখিনা হাওয়াতে শুভ্রার চুল উড়ছে।নবনীতা তেলের শিশি হাতে শুভ্রার পেছনে হাঁটু গেড়ে বসল।শুভ্রার চুল অতো বড়ো না।পিঠ সমান।নবনীতা যত্ন করে তার সিঁথিতে অল্প অল্প করে তেল মালিশ করে দিলো।আরামে আবেশে শুভ্রার চোখ লেগে আসছিল।নবনী সমস্ত মনোযোগ তার মাথার উপর রেখে অনড় কন্ঠে বলল,’চিন্তা করিস না শুভি।এদের যদি একটা ব্যবস্থা না করি তবে আমিও নবনীতা নই।’
.
.
.
.
আজ পর পর দু’টো মিটিং হয়েছে।কাল সমাবেশ।সমাবেশে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য একটা স্ক্রিপ্টও রেডি করা হয়েছে।তোফায়েল স্ক্রিপ্ট টা টেবিলের উপর রেখে তার উপর পেপার ওয়েট রাখল।
এদিক সেদিক চোখ ঘুরিয়ে সে কিছুক্ষণ আরহামকে খোঁজার চেষ্টা করল।আরহাম আশেপাশে কোথাও নেই।সম্ভবত বিভিন্ন নেতাদের সাথে আলোচনা করছে কালকের সমাবেশ নিয়ে।সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে পল্টনের মোড়ে।মতিঝিল থেকে সামান্য রাস্তা।
আরহাম বেশ কিছুক্ষণ প্রবীণ নেতাকর্মীদের সাথে আলোচনা করে তার রুমে এসে ইজি চেয়ারটা টেনে বসল।তোফায়েল জানতে চাইলো,’ভাই স্ক্রিপ্ট টা কি করবেন?এখন পড়বেন নাকি বাসায় গিয়ে?’
আরহাম চোখ বন্ধ রেখেই নিরেট স্বরে বলল,’থাকুক এখানে।এটার প্রয়োজন পড়বে না আমার।আমি নিজ থেকেই বলতে পারব কথা।’
তোফায়েল মাথা নাড়ল।জানতে চাইল চা আনবে নাকি।আরহাম কেবল ডানে বায়ে মাথা নেড়ে জানাল তার প্রয়োজন নেই।তারপরই চেয়ারে ঠেস দিয়ে মাথাটা পেছনের দিকে ছেড়ে দিলো।
এমন সময় ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে অফিস রুমের কাঁচের দরজাটা খুলে গেল।তোফায়েল দ্রুত পেছন ফিরল।অফিস রুমের ভেতর নীল জামা পরা একটি মেয়ের অস্তিত্ব টের পেতেই তার চোয়াল ঝুলে গেল।আরহাম হাস্কি স্বরে শুধাল,’কে এসেছে তোফায়েল?’
‘আমি এসেছি’,কটমট করে জবাব দিলো নবনীতা।
সঙ্গে সঙ্গে আরহামের বুজে রাখা চোখ দু’টো খুলে গেল।এক লাফে আধশোয়া থেকে উঠে বসল সে।প্রথমবারেই মেয়েটিকে চিনতে পারল না।তারপর যখন মেয়েটি ক্রুদ্ধ পায়ে কিছুটা সামনে এগিয়ে এলো,তখন শেখ শাহরিয়ার আরহামের নিকট তার পরিচয় স্পষ্ট হলো।
আরহাম চোখ সরু করে প্রশ্ন ছুড়ল,’তুমি?’
নবনীতা কোনো ভূমিকা কিংবা উপসংহারে গেল না।বরং তিক্ত কন্ঠে গিরগির করে উঠল,’আপনি বলেছিলেন আপনি ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন।অথচ আপনার ছেলেরা এখনও সেই আগের মতো একই কাজ করে যাচ্ছে।এসবের মানে কি?আপনি কেনো তাদের কিছু বলছেন না?আপনি তাদের,,,,’
‘মেয়েদের কাজ কি?’নবনীতার কথা শেষ হওয়ার আগেই স্পষ্ট ভাষায় প্রশ্ন আরহামের।
প্রশ্ন শুনতেই নবনীতা ভড়কে গেল।চোখ উল্টে বলল,’কি?’
‘কথা কি একবারে বুঝো না?জানতে চেয়েছি মেয়েদের কাজটা কি?’আরেকটু জোরালো আর কঠিন শোনাল আরহামের কন্ঠ।
নবনীতা বোকার মতো কিছুক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে রইল।এটা কেমন প্রশ্ন?সে আমতা আমতা করে জবাব দিলো,’মেয়েদের কাজ পড়াশোনা করে মানুষ হওয়া।শিরদাঁড়া উঁচু করে দাঁড়ানো।আপনজনদের খেয়াল রাখা।আর,,’
এই উত্তরও পুরোপুরি দেওয়া হলো না তার আগেই আরহাম চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো।হাত তুলে বলল,’না হয়নি।এদের কোনোটাই মেয়েদের কাজ না।’
নবনীতা চমকাল।ফ্যালফ্যাল চোখ করে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি গায়ে জড়ানো লোকটিকে দেখল।আরহাম পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,’মেয়েদের কাজ পড়াশোনা করা না।মেয়েদের কাজ সংসার করা,মেয়েদের কাজ সন্তান জন্ম দেওয়া আর তাদের লালনপালন করা।’
আরহাম থামল।তার সামনে দাঁড়ানো তরুণীটির অবিশ্বাস্য চোখ দু’টো দেখে তার সামান্য হাসি পেল।নবনীতার মনে হচ্ছিল তার চোখ দু’টো কোটর ছেড়ে বেরিয়ে যাবে।একবিংশ শতাব্দীতে আসার পর কোনো ছেলের চিন্তাভাবনা এমন হতে পারে?এই যুগে এসেও কোনো ছেলে এমনটা ভাবতে পারে যে মেয়েদের কাজ শুধু সন্তান জন্ম দেওয়া আর তাদের লালনপালন করা।নবনীতা প্রতিউত্তর করার কোনো ভাষা খুঁজে পেল না।মুখ দিয়ে কোনো শব্দ সত্যিই বেরুচ্ছে না।
আরহাম পাঞ্জাবির কলার টেনে ঠিক করল।এলোমেলো চুলগুলোয় হাত ছুঁয়িয়ে খুব স্বাভাবিক কায়দায় বলল,’শুনুন মিস।মেয়েদের কিছু নির্দিষ্ট কাজের জন্য পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে।তারা যদি সেই কাজ গুলো নিয়ে থাকতো তাহলে এমন হেনস্তার শিকার হতো না।কিন্তু যেই তারা খুন্তি ছেড়ে কলম হাতে নেওয়ার কর্মযজ্ঞে নেমেছে,সেই তাদের অবনতি হতে শুরু করেছে।ছেলেরা গঠনগত ভাবেই এমন।নারীদের প্রতি আমাদের আকর্ষণ চিরন্তন।সেটা কি আপনি জানেন না?আর তাছাড়া,,,’
হঠাৎ কিছু একটা মনে পড়তেই আরহাম চট করে প্রশ্ন করল,’আপনার বোন হিজাব পরে?’
নবনীতা অতি বিস্ময়ে জবাব দেওয়া পর্যন্ত ভুলে গেল।সে এতোটাই আশ্চর্য হলো যে তাকে যে একটা প্রশ্ন করা হয়েছে সেটা পর্যন্ত তার মাথায় নেই।
আরহাম একনজর তাকে দেখে ভৎসনার সুরে বলল,’নিজেরই তো মাথায় কাপড় নেই।বোন আর কি হিজাব পড়বে!’
সূক্ষ্ম অপমানে আর খোঁচায় তেইশোর্ধ তরুণীর চোখ দু’টো রক্তিম হলো,কান দু’টো কেমন ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠল।কন্ঠে ফিরে এলো সেই চিরচেনা তেজ।এইবার গর্জন করে উঠল তার কন্ঠ,জানতে চাইলো,’আমি হিজাব পরি কি না পরি অথবা আমার বোন হিজাব পরে নাকি পরে না তাতে আপনার কি?বলতে চাইছেন আপনার দলের লাফাঙ্গাদের কোনো দোষ নেই?দোষ সব আমার,আমার বোনের,ঐ সকল মেয়েদের যারা হিজাব পরে না।তাই তো?আপনাদের সৃষ্টিগত দুর্বলতা আছে,তাই আপনারা মেয়েদের সাথে অসভ্যতা করবেন।আর আমরা এর বিরুদ্ধে টু শব্দ টুকু করতে পারব না?’
আরহাম সূচালো চোখে নবনীতা নামের যুবতী মেয়েটিকে একনজর দেখে নিল।মেয়েটির কি শ্বাস কষ্টের সমস্যা নাকি?দু’লাইন বলতেই এমন হাঁপিয়ে গেল কেন?
আরহাম সিদ্ধান্ত নিল মেয়েটিকে সে আরো একটু হাঁপিয়ে দিবে।চুপচাপ নবনীতার চেয়ে শ্বাস টেনে টেনে কথা বলা নবনীতাকে তার বেশি ভালো লাগছে।আরহাম কুটিল হেসে আবার বলতে শুরু করল,’নবনীতা অর হোয়াট,আই ডোন্ট কেয়ার।একটা কথা শুনো।আমার সামনে নির্বাচন।নমিনেশন থেকে শুরু করে ইলেকশান পর্যন্ত প্রতিটা কাজে ঐ ছেলেগুলোকে আমার প্রয়োজন।তাদের কোনো কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব না,আর আমি করতেও চাইছি না।তুমি বরং তোমার বোনকে একটু দেখেশুনে রাখো।কি হবে এতো পড়াশোনা করে?সেই তো স্বামীর টাই খাবে।তার চেয়ে ভালো দু’বোন মিলে রান্না শিখো।স্বামীর পাশাপাশি শ্বশুর বাড়ির বাকিদেরও খুশি রাখতে পারবে।মেয়েদের এসব দাবাংগিরি আমার একদম পছন্দ না।এখন তুমি আসতে পারো।খোদা হাফেজ।’
‘তার মানে আপনি আপনার দিক থেকে কিছুই করবেন না?’ নবনীতার সোজাসাপ্টা প্রশ্ন।
আরহাম একপেশে হাসল,’নাহ।আমি কিছুই করব না।’
‘আমি কিন্তু পুলিশে কেইস করব বলে দিলাম’
‘ভেরি গুড।এটা আরো ভালো হয়।করে দেখতে পার নবনীতা।’ আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে উত্তর দিলো আরহাম।
নবনীতার চোখ দু’টো ছলছল করে ওঠল।তার সামনে সটান দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিশোর্ধ যুবকটির গা ছাড়া ভাব দেখতেই তার গা গুলিয়ে এলো।সেদিকে একবার ঘৃণাভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নবনী থেমে থেমে বলল,’আপনি একটা জঘন্য লোক।আপনার মানসিক চিকিৎসা প্রয়োজন।’
কথা শেষ করা মাত্রই আর এক মুহূর্ত দেরি না করে সে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রুম থেকে।তোফায়েল হা করে কিছুক্ষণ সেদিকে,কিছুক্ষণ আরহামের দিকে দেখল।আরহাম টেবিলের উপর রাখা স্ক্রিপ্ট টা হাতে তুলে একবার চোখ বুলিয়ে নিল।তারপর হঠাৎ তার কি হলো কে জানে,পুরো কাগজটা ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে সে নিজেও রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
তোফায়েল শুকনো ঢোক গিললো।ভাইয়ের মাথায় কি চলছে তোফায়েল তা আন্দাজ করতে পারছে না।তবে ভাইয়ের মেজাজ খারাপের মূলে যে এই মেয়েটি,তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
চলবে-