#কোনো_এক_শ্রাবণে[তৃতীয় অধ্যায়]
লেখনীতে #মেহরিমা_আফরিন
(৫০)
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।সকাল নয়টা ত্রিশে ল্যান্ড করা দুবাই এয়ারলাইনসের যাত্রীরা ব্যস্ত তাদের ইমিগ্রেশনের ঝামেলা মেটাতে।ইমিগ্রেশন সহ বাকি ঝায় ঝামেলা মিটিয়ে এয়ারর্পোটের প্রথম টার্মিনাল পর্যন্ত পৌছাতে সময় নিল আরো এক ঘন্টা।
নিজের লাগেজ দু’টো দুই হাতে টেনে ইজমা বেরিয়ে এলো এয়ারর্পোট থেকে।বেরিয়েই কতোক্ষণ নিজের ঘাম মুছলো।তারপরই চোখ উপরে তুলে আকাশ দেখলো।অদ্ভুত বিষয়! সে শীতের একটু আগে আগে দেশে এসেছে,যেন অতিরিক্ত গরমে তার কষ্ট না হয়।অথচ এদিকে আসার পর মনে হচ্ছে এখানে এখনো গ্রীষ্মের গা জ্বালানো মৌসুম শেষ হয়নি।সে তাড়াতাড়ি মেইন রোডে এসে একটা সিএনজির খোঁজ করল।
মনে মনে সে ভীষণ এক্সাইটেড।কতোগুলো বছর পরে সে এই দেশে এসেছে।সে একটু মনে মনে ভাবল।দশ বছর তো হবেই।এখানকার রাস্তাঘাট সে চেনে না।রাস্তা সম্পর্কে কোনো ধারণা তার নেই।তাড়াহুড়ায় সে উবার কিংবা পাঠাও কোনোটাই ইন্সটল করেনি।দেশের মাটিতে পা রাখার পর তার মনে হলো এই কাজটা একদমই ঠিক হয়নি।সে এখন কি করবে?আদি কে তো এই ব্যাপারে জানানোও হয়নি।
সে জিপিএস অন করে নিজের লোকেশন দেখল।ওয়ারিতে তার এক দুঃসম্পর্কের ফুফু থাকে।সেখানে আপাতত গিয়ে উঠা যায়।তারপর আদির এড্রেসে গিয়ে বাকি কাজ করা যাবে।
সে তাড়াতাড়ি একটা সিএনজি ডাকে।কোনোরকমে ঠিকানা দিয়ে সেটার উপর চেপে বসে।সবকিছু বেশ ভালোই যাচ্ছিল।সিএনজি চলতে শুরু করার পর একটা সুন্দর শরীর জুড়ানো ঠান্ডা বাতাসে তার বেশ আরাম লাগছিল।কিন্তু দশ মিনিট পরেই কি থেকে কি হলো সে জানে না,,দ্রুতগামী একটা বাস পেছন থেকে ছুটে এসে ইজমার সিএনজিতে সজোরে আঘাত করল।তারপরই আর কোনো দিক না দেখে আগের চেয়েও দ্রুত বেগে সামনের দিকে ছুটে গেল।
মুহুর্তেই সবুজ রঙের সিএনজি টা একপাশ উল্টে ফুটপাতের উপর গিয়ে পড়ল।ইজমা প্রথমে ঘটনার আকস্মিকতায় চেঁচিয়ে উঠল,আর তারপর ভয়াবহ শারিরীক যন্ত্রনায় আর্তনাদ করে উঠল।চোখ বন্ধ হয়ে আসার আগমুহূর্তে সে টের পেল চারদিকে ভীষণ কোলাহল।লোকজন সব তাদের উল্টে যাওয়া গাড়ির দিকে দৌড়ে আসছে।ইজমা নিভু নিভু চোখ নিজের হাত দেখে।সিএনজির একটা রড লেগে তার হাতের একটা জায়গা কেটে সেখান থেকে র’ক্ত বের হচ্ছে।তার মস্তিষ্ক একটু একটু করে চেতনা হারাচ্ছে।এখন?তাকে কে বাঁচাবে?আদি তো জানে না সে যে দেশে।
.
.
.
.
‘রাজারবাগ মোড়ে মিজান চাচার একটা টং দোকান আছে।চাচা মানুষ হিসেবে ভীষণ ভালো।লুবনা কে যখন পড়াতাম,তখন প্রায়ই চাচার দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতাম।কখনো আবার বান পাউরুটি কিনতাম।চাচা তখন থেকেই আমায় খুব স্নেহ করতেন।কিছু মানুষ আছে না,যারা অকারণেই আমাদের ভালোবাসে।মিজান চাচা তাদেরই একজন।সেদিন গিয়ে দেখি মিজান চাচার দোকান ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে লীগের ছেলেরা।তার অপরাধ সে ঠিক মতো চাঁদা দেয়নি।চাচা কাঁদতে কাঁদতে বলল তার নাকি রোজ রোজ যা আয় হয়,তার চেয়েও বেশি চাঁদা চায় ছেলেগুলো।না দেওয়াতে দোকান ভেঙে এই অবস্থা করেছে।আমি এই বিষয়টা নিতে পারিনি।একটা অসহায় মানুষ কোনোরকমে একটা দোকান দিয়ে সংসার চালাচ্ছে।তার দোকানটাও ভেঙে দিতে হবে?এই মানুষটা থেকেও বাধ্যতামূলক চাঁদা তুলতে হবে?আমি এইসব অনাচার নিতে পারি না।আমার খুব খারাপ লাগল মিজান চাচার এই বিষয়টা।মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত।আর নবনীতার দৌড় আরহাম পর্যন্ত।তাই আমি ছুটে গেলাম তার কাছে।সবকিছু খুলে বললাম।সে পুরো কথা শুনেই থমথমে মুখে বলল তার পক্ষে নাকি কিছু করা সম্ভব না।দলের ছেলেদের সে কিছু বলতে পারবে না।এরা তার জলজ্যান্ত হাতিয়ার।এদের কটু কথা বলে সে নিজের দল হালকা করতে পারবে না।আমি দুইবার মুখের উপর উত্তর দিতেই সে ক্ষেপে গেল।চিৎকার চেঁচামেচি করে ঘরের পরিবেশ নষ্ট করে বেরিয়ে গেল।আমি সমস্ত রাত তার অপেক্ষায় জেগে রইলাম।অপমান আর অবহেলায় আমার দুই চোখ পানিতে ভরে গেল।আচ্ছা ইদানিং আরহামের ব্যাপার গুলোতে আমি এমন আবেগী হয়ে যাচ্ছি কেন?কেন আমি মেনে নিতে পারছি না যে আরহাম কখনোই এসব নোংরা রাজনীতি থেকে সরে আসবে না?আমার মন আজ ভীষণ খারাপ।সারারাত আমি জেগে ছিলাম।অথচ সে আসলো না।আমি চোখের পানি মুছতে মুছতে হয়রান।কোথায় আগে তো কখনো এমন করতাম না আমি।ইদানিং এসব কি হচ্ছে?আমি এতো কাঁদছি কেন?আরহাম একটু দুর্ব্যবহার করলেই দু’চোখে ঝাপসা দেখি।প্রতিবাদ করার আগেই ন্যাকুদের মতোন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে ফেলি।আরহাম ইদানিং কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।ভালো লাগে না,কিচ্ছু ভালো লাগে না।’
ডায়রি লিখা পুরোপুরি শেষ হয়নি,তার আগেই নিচ থেকে লাগাতার গাড়ির হর্ন বাজানোর শব্দে নবনীতার কলম আপনাআপনি থামলো।সে দ্রুত জানালা দিয়ে নিচে উঁকি দেয়।আরহামের গাড়ি।পুনরায় নিজের টেবিলে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল সে।
‘পরী! এ্যাই পরী! কোথায় তুমি?নিচে এসো তো এখনি।’
গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠটা একপ্রকার হুকুম ছুড়ে ডাকে।নবনীতা শক্ত হয়ে চেয়ারে বসে থাকে।যাবে না সে কিছুতেই।গমগমে নিরেট স্বরটা পুনরায় তাকে ডাকে।ডাকতে ডাকতেই কিছুটা রেগে যায়।পরমুহূর্তেই রাগ সামলে নেয়।অত্যন্ত শান্ত গলায় ডাকে,’সেনোরিটা! আমার জানেমান,একটু নিচে এসো গো পাখি।তোমার চাঁদবদন খানি একটু দেখি।’
নবনীতা বসে বসেই চোখ পাকায়।কি উদ্ভট সম্বোধন! ইচ্ছে করে তাকে ক্ষেপানোর জন্য এমনটা করছে।আরহাম পুনরায় গলা খাঁড়া করে ডাকে,’আরে পরী! সিরিয়াসলি ডাকছি।এসো না।’
নবনীতা উঠে গিয়ে ধুপধাপ পায়ে সিঁড়ি ভাঙে।সামনে না দেখেই কাটকাট স্বরে বলে,’কি হয়েছে?’
বলেই সে চোখ তুলে সামনে দেখে।সামনের দৃশ্য চোখে পড়তেই সে থমকায়।খানিকটা আশ্চর্য হয়ে বলে,’এসব কি?’
আরহাম তার হাতে থাকা হাওয়াই মিঠাইয়ের স্ট্যান্ডটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পুরো মুখে একটা ঝকঝকে হাসি ফুটিয়ে বলল,’এই নাও।এগুলো সব তোমার।তুমি নাকি হাওয়াই মিঠাই খুব পছন্দ করো?’
নবনীতার মুখের বিস্ময়ভাব তখনো কাটেনি।সে ফ্যালফ্যাল চোখে সামনে দেখে বলল,’এসব আবার কেন এনেছেন?’
‘কেন? তুমি খুশি হওনি?’
‘জ্বী হয়েছি।কিন্তু,,’
নবনীতা হাত বাড়িয়ে স্ট্যান্ডটা নিজের হাতে নেয়।তার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।তার যতটুকু মনে আছে শেষবার যখন তাদের কথা হয়েছিল,তখন তাদের ঝগড়া হয়েছিল।তাহলে আরহাম হঠাৎ এমন ভালো আচরণ করছে কেন?পরমুহূর্তেই তার মনে পড়ল শাহরিয়ার আরহাম কখনো মাফ চায় না,বিনিময়ে সে অত্যাধিক ভালো ব্যবহার শুরু করে।এই যেমন এই মুহুর্তে সে খুবই মোলায়েম আচরণ করছে।কারণ রাতেই সে বুঝতে পেরেছে ভুলটা তার।বাড়াবাড়ি টা বরাবরের মতো সেই করেছে।
নবনীতা একটা হাওয়াই মিঠাই নিজের হাতে নিয়ে বলল,’আপনি কি করে জানলেন আমার এসব পছন্দ?’
‘জানি।আমি সব জানি।’
নবনীতা হাওয়াই মিঠাই হাতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল।তার গম্ভীর অভিমানী মুখটা দেখেই আরহাম তার একহাত টেনে বলল,’চলো তো।আজ আমরা রিকশা বিলাশ করব।’
আশ্চর্যে তার মুখ হা হয়।সে কোনোরকমে হাওয়াই মিঠাই গুলো একপাশে রেখে আরহামের পায়ের সাথে নিজের গতি মেলাতে মেলাতে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।যেতে যেতে বিস্ময় জড়ানো কন্ঠে জানতে চায়,’রিকশা বিলাশ করব মানে?’
আরহাম বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটা হেলমেট মাথায় দিলো।কেবল চোখ দু’টো উন্মুক্ত করে নবনীতার দিকে দেখে চঞ্চল গলায় বলল,’কেউ দেখে নিলে ঝামেলা হবে।তাই এই সিস্টেম।চলো তো।আমার সাথে চলো।’
সে তাকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে অনেকটা দূরে গিয়ে একটা রিকশা ডাকে।নবনীতা তখনও হতবাক হয়ে তার কাজকর্ম দেখে।এই লোক হঠাৎ রিকশা ডাকছে কেন?
আরহাম রিকশায় চেপেই উঁচু গলায় বলল,’এ্যাই আমাদের কে একটু শহর ঘুরাও তো।খবরদার মেইনরোডে যাবা না।অলিগলি দিয়ে ঘুরো।চারপাশে যেন গাছপালা থাকে।’
কথা শেষ করেই সে নবনীতার দিকে তাকায়।স্মিত হেসে বলে,’তোমার নাকি অকারণেই রিকশায় ঘুরতে ভালো লাগে?তাই ভাবলাম তোমার শখ পূরণ করি।আমি না তোমার স্বামী?হু?’
নবনীতা কপাল কুঁচকায়।ক্ষমা চাওয়ার অভিনব কৌশল এই মানুষের জানা আছে।কাল রাতে খ্যাক খ্যাক করে এখন তার শখ পূরণ করতে তাকে করে হেলমেট পরে শহর ঘুরছে।সে গালের নিচে হাত রেখে চোখ পাকিয়ে বলল,’শুভির আজকে ফিজিক্স পরীক্ষা।আপনি তাকে আমি কি পছন্দ করি না করি,এসব বেহুদা প্রশ্ন করে বিরক্ত করেছেন তাই না?’
‘মোটেই বিরক্ত করি নি।শুভ্রার প্রস্তুতি এমনিতেই ভালো।তুমি চুপচাপ সবকিছু এনজয় করো।’
তিন পায়ার রিকশাটা ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।ঘন্টা বাজাতে বাজাতে ছুটে যায় আবাসিক এলাকার অলিতে গলিতে।নবনীতা আলতো করে তার মাথাটা আরহামের কাঁধে রাখে।তার ভীষণ খুশি খুশি লাগছে।তার রাগ পড়েছে,বেহায়া মনটাও স্বল্প আদরে বরফের মতোন গলে গেছে।সে তার কাঁধে মাথা রাখতেই আরহাম গাঢ় স্বরে বলল,’মন খারাপ কমেছে পরী?’
‘জানি না।’
‘তুমি নাকি রাতে ঘুমাওনি?’
‘জানি না।’
‘যাকগে,জানতে হবে না।আমিও ঘুমাইনি।তোমায় জানিয়ে দিলাম।’
নবনীতা কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে হঠাৎই মাথা তুলে বলল,’আচ্ছা আরহাম,আপনি আপনার ছেলেদের কিছু বলবেন না?মিজান চাচার ব্যাপারে আপনি কাল রাতে কিছু ভেবেছেন?’
আরহাম থমথমে মুখে তাকে দেখে।তারপরই তার একহাত চেপে সামনে দেখতে দেখতে বলে,’ঐ দেখো,কৃষ্ণচূড়া গাছ।তোমার না কৃষ্ণচূড়া পছন্দ ভীষণ?’
.
.
.
.
পোড়া গন্ধ নাকে লাগতেই ওয়াজিদ মুখ কুঁচকে নিল।ধীরে ধীরে সেই গন্ধটা প্রকট হয়ে নাসিকারন্ধ্রে পৌঁছুতেই সে চোখ খুলে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল।বড় বড় চোখে চারপাশ দেকে পোড়া গন্ধের উৎস খুঁজতেই তার মনে হলো গন্ধটা রান্নাঘর থেকে আসছে।চারপাশে কোথাও ঐ বাচালের অস্তিত্ব নেই।তার অস্তিত্ব না থাকা ওয়াজিদের জন্য আরেক আতঙ্কের বিষয়।সে তীব্র বেগে ছুট লাগায় রান্নাঘরের দিকে।
রান্নাঘরে পা রাখতেই তার চক্ষু চড়াকগাছ।রিমি কেবিনেটে বসে বসে ঝিমুচ্ছে।তার থেকে একটু দূরে চায়ের পাতিল থেকে চা উপচে পড়ছে।সেই চা পোড়া গন্ধই বারবার তার নাকে এসে লাগছে।সে হাত নেড়ে নেড়ে ধোঁয়া সরায়।বড় বড় পায়ে সামনে এসে রিমির কাঁধ ধরে ধাক্কায়,’এ্যাই রিমি! রিমি!’
রিমি চোখ খুলে লাফিয়ে উঠে বলল,’জ্বী।জ্বী।’
‘তুমি এসব কি করেছ?’
রিমি দ্রুত পাশ ফিরে।চুলার অবস্থা দেখতেই আঁতকে উঠে বলে,’কি সর্বনাশ! এসব কিভাবে হয়েছে?’
‘আমি কি করে জানবো?তুমি রান্নাঘরে ছিলে।আম্মু কোথায়?’
রিমি মলিন মুখে চুলায় বসানো পাতিল দেখতে দেখতে জবাব দেয়,’আপনার আম্মু আর আব্বু আপনার ফুফুকে দেখতে গিয়েছে।তার নাকি শরীর খারাপ?এজন্য আমাকে বলেছে সকালে উঠে যেন আপনাকে চা করে দেই।’
ওয়াজিদ বিরক্ত মুখে একবার স্টোভ,আরেকবার রিমিকে দেখে।ভ্রু কুঁচকে বলে,’আম্মু আর মানুষ পায়নি।তোমাকে এসব দায়িত্ব দিয়ে গেছে।যাও বের হও তো।আমার চা আমি করে নিব।’
বলা শেষ করেই সে এগিয়ে যায়।রিমি তাড়াহুড়ো করে তার হাত চেপে ধরে।দ্রুত মাথা নেড়ে বলে,’না না।আমি করে নিব।আপনাকে কাজ করতে দেওয়া যাবে না।আপনি কাজ করলে আমার গুনাহ হবে।’
ওয়াজিদ মুখ বিকৃত করে তার একহাত টানতে টানতে বলল,’তোমার এতো ভাবতে হবে না এসব নিয়ে।তুমি কাজ করার চেয়ে কাজ না করলেই আমার জন্য বেশি ভালো হয় ব্যাপারটা।’
ওয়াজিদ তাকে সরিয়ে নিজে স্টোভের সামনে দাঁড়ায়।কোনোরকমে দুই কাপ চা করে কেবিনেট থেকে একটা বিস্কুটের প্যাকেট হাতে নিতে নিতে বলল,’চলো চলো।চা বিস্কুট খেয়ে নেই।’
বলেই সে একটা ট্রে তে সবকিছু নিয়ে ডায়নিং এর দিকে পা বাড়ায়।রিমি তার পিছু ছুটতে ছুটতে বলল,’কিন্তু সব তো আপনিই করলেন।আমি তো কিছুই করতে পারলাম না।আমারও কিছু করতে ইচ্ছে করছে।’
ওয়াজিদ পেছন ফিরে তাকে দেখে।মৃদু হেসে বলে,’আপনি তো প্রিন্সেস ডায়না।আপনি শুধু অর্ডার করবেন।আমি করে দিব সবকিছু।আসুন।বসে খেয়ে যান।ধন্য করুন আমায়।’
রিমি বোকা হেসে টেবিলে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল।একটা কাপ হাতে নিয়ে ওয়াজিদকে দেখে কাচুমাচু মুখ করে বলল,’আমার নিজে থেকে অনেক কিছু করতে ইচ্ছে হয়।কিন্তু কেন যেন গুছিয়ে করতে পারি না কিছু।’
বলেই সে একটা চুমুক দেয় কাপে।আজ তাদের বিয়ের তেরো তম দিন।বিয়ের পর রিমি এই বাড়িতে দুই দিনের মতো ছিলো।তারপর সপ্তাহখানেক নিজের বাড়িতে থেকে গত পরশু সে আবার এখানে এসেছে।তার শ্বশুর শ্বাশুড়ি অত্যাধিক ভালো মানুষ।সে চায় তাদের মন মতো মেয়ে হতে।পড়াশোনার তো এমনিতেই তার ভয়াবহ অবস্থা।একপ্রকার ফেল করতে করতে পাশ করেছে শেষ বর্ষে।পড়াশোনা করার চেয়ে সংসার করা ঢের ভালো।রিমি এখন আটঘাট বেঁধে সংসার জীবনে নেমেছে।অনেক পড়াশোনা হয়েছে,এবার সে হবে যোগ্য গৃহিনী।
ওয়াজিদ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে রিমির দিকে দেখে অল্প হেসে বলল,’তোমার এতো গোছানো হতে হবে না।তুমি এমনিতেই ঠিক আছো।আমার তোমাকে এমনই বেশ লাগে।’
.
.
.
.
কানের ডানপাশে যান্ত্রিক শব্দে ঘট ঘট শব্দ হচ্ছে।শরীরের কিছু জায়গায় চিনচিন ব্যথা হচ্ছে।অবষন্ন শরীরটা সেই ব্যথা উপেক্ষা করেই অল্প নড়েচড়ে উঠে।মুখ দিয়ে অস্ফুট আর্তনাদ করে কিছু একটা বলে।
প্রায় দশ মিনিট চেষ্টা করার পর ইজমা তার চোখ খুলতে সক্ষম হলো।চোখ খুলতেই সবার প্রথমে সে হাসপাতালের সাদা পর্দাটা দেখলো।তারপর দেখল নিজের হাত।দেখতেই সে আঁতকে উঠে।তার হাত ভেঙে গেছে।হাতে প্যাঁচানো ব্যান্ডেজে ছোপ ছোপ র’ক্তের দাগ লেগে আছে।সে খানিকটা শক্তি সঞ্চয় করে ডাকে,’এক্সকিউজ মি,কেউ আছেন?’
ডিউটিরত নার্স পাঁচ মিনিট পর তার কেবিনে এলো।সে তাকে দেখতেই ম্লান হেসে বলল,’আমি কোথায়?’
নার্সের পোশাক পরিহিত ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে গাঢ় স্বরে বললেন,’তুমি হসপিটালে।তোমার সিএনজি নাকি উল্টে গিয়েছিল?যারা তোমাকে এখানে এনেছেন,তারাই এই কথা বলল।’
ইজমা অসহায় চোখে নিজের হাত দেখে।অতিশয় ক্ষীণ কন্ঠে বলে,’ভেঙে গেল নাকি?’
তার ভাবভঙ্গি দেখেই সিনিয়র নার্স রুবাইদা শারমিন হেসে ফেললেন।নিজের একটা হাত তার মাথায় রেখে বললেন,’সমস্যা নাই।পনেরো দিনে ঠিক হয়ে যাবে।বাড়ি কোথায় তোমার?’
ইজমা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।ভাবলেশহীন হয়ে জবাব দেয়,’আমেরিকা।’
‘কি সাংঘাতিক! জন্ম থেকেই সেখানে থাকো নাকি?’
‘হু।বাবা স্টুডেন্ট থাকা অবস্থাতেই সেখানে সেটেল্ড।আমার জন্ম সেখানেই।’
‘দেশে কি একাই এসেছ?’
ইজমা মুখ কালো করে জবাব দেয়,’হু।আমার ফ্রেন্ড কে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য।’
রুবাইদা আরো কিছু বলতেন।কিন্তু তার আগেই সাদা এপ্রোন গায়ে জড়ানো যুবকটা বেশ তাড়াহুড়ো করে কেবিনে ঢুকতে ঢুকতে বলল,’পেশেন্টের জ্ঞান ফিরেছে সিস্টার?’
ইজমা চোখ তুলে।কেবিনে আসা আগন্তুকের গায়ের পোশাক বলছে সে পেশায় একজন চিকিৎসক।ইজমার কৌতূহলী চোখজোড়াকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যুবকটা তার একহাত তুলে পালস রেট চেক করে।তারপরই গুরুগম্ভীর স্বরে বলে উঠে,’আমি ডাক্তার ইফতেখার আহমেদ ইফাজ।’
চলবে-