কোথাও হারিয়ে যাব পর্ব-৩৫

0
539

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৫(প্রথমাংশ)

তুমি বুকে টেনে নাও না প্রিয় আমাকে…

ঘুমঘুম জাগরণে ধোঁয়াশা লাগছে চোখের সামনে সব। ঘাড়ের ডান পাশটায় তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয়েছিল সেই সাথে জ্বরও ছিল একশো তিন। ডাক্তার এসবের জন্য কি যেন ইনজেকশন দিলো একটা তারপর লম্বা সময় পর্যন্ত কোন ব্যথার অস্তিত্ব টের পায়নি সে। এখন দীর্ঘ বছর পর ঘুমটা ভেঙে গেল কানে ওই মধুর একটি গানের সুর শুনে। কেউ একজন খুব কাছে বসেই বোধহয় মৃদু আওয়াজে শুনছে গানটা। নাকে আসছে ঔষধের কড়া গন্ধ সেই সাথে পরিচিত একটা পারফিউমের সুবাস। হঠাৎ করেই মনে হচ্ছে সে কি স্বপ্ন দেখছে!

-ব্যথা আছে এখনও?

মুখের ওপর ঝুঁকে অর্ণব প্রশ্ন করতেই ঘুম পুরোপুরি কেটে গেল নুপুরের। গানের শব্দটাও আসছে না আর শুধু নাকের ভেতর পারফিউমের সুবাসটা এবার তীব্র ঠেকছে। মানুষটা এত বেশি কেন ঝুঁকে আছে তার বুকের কাছে? হৃৎপিণ্ড বিকল করে দিতে চাইছে নাকি! চোখ মুখ খিঁচে নুপুর বড্ড জোর খাটিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল, সরে দাঁড়ান।

-নাহ, আরও কাছে আসতে চাইছি অনুমতি পাশ না করলেও আসব।

কথাটা বলে ঝট করে দূরে সরে গেল অর্ণব।কেবিনের দরজা ঠেলে একজন নার্স ঢুকলো ভেতরে।
-আপনাকে যে বাইরে যেতে হবে এখন।

-শিওর

অর্ণব কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। নুপুর নার্সটিকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলো তার আগেই নার্স জানালো ড্রেসিং হবে এখন। বা হাতের কনুই থেকে ইঞ্চি দুয়েক উপরের এবং কোমরে আঘাত পেয়েছিলো সেটারই ড্রেসিং। নুপুর দম খিচে রইলো যেন পুরোটা সময়। নার্স চলে যেতেই অর্ণব হাজির হলো একজন পুলিশ নিয়ে। লোকটিকে নুপুর গত দু দিনে খুব ভালো করেই চিনে ফেলেছে। কিন্তু তার জবানবন্দি তো আগেই সে দিয়েছিলো!

– কেমন আছেন মিস.. মিসেস অর্ণব?

-আমার নাম নুপুর।

অফিসার মুচকি হাসলেন। এরা তো ভারী আজব কাপল! একজন বলেন আমার বিয়ে করা বউ মিসেস চৌধুরী বলবেন। অন্যজন বলে আমার নাম নুপুর। যাহোক, আপাতত কেস সলভের উদ্দেশ্যে আসা তাইহোক। শরাফত সাহেব নিজের ফোনটা নুপুরের দিকে এগিয়ে একটা ফটো দেখালেন। নুপুর দেখলো ফটোটা তাতে দুটো লাশ। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো, দুটো লাশকেই নুপুর চিনলো। এরাই তাকে অপহরণ করেছিলো এমনকি বছর খানেক আগে থেকে এদেরমধ্যের একজনই তাকে সবসময় ফলো করতো। আজ আর কিছুই এড়িয়ে গেল না নুপুর। টুকটুক করে সব বলল যতোটা প্রয়োজন ছিল। তাজ্জব ব্যাপার তাকে তুলে নেয়া দুজনই আজ মৃত। তবে তার সম্ভ্রমে হাত দেয়া ছেলেটারই কোন হদিশ পেলো না কোথাও। পুলিশও বর্ণনানুযায়ী খুঁজে চলছে। পুলিশের ধারণা তিনজন আসামীর একজন যে বেঁচে আছে সেই মূল আাসামী আর এরা তার সহকারী। অফিসার শরাফত চলে যেতেই অর্ণবও হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গেল। আজ অফিসে একটা মিটিং আছে। হেলায় সব ছেড়ে দিলে চলবে না। সারা বিকেল নুপুর পড়ে রইলো একা কেবিনটাতে। একজন নার্স অবশ্য একটু পরপর এসে চেক করে গেছেন অর্ণবের কাছ থেকে আলাদা কমিশন পেয়ে। শহরের আকাশে রোদ নিভে গেছে আরও কিছুক্ষণ আগে। হাসপাতালে এমনিতেই নীরবতা তারওপর এই সন্ধ্যের আলাদা এক নিস্তব্ধতা নুপুরকে শূণ্য করে রাখলো কেমন যেন। সেই শূণ্যতাকে এড়িয়ে যেতেই নুপুর কল্পনা করতে চাইলো কালকের ঘটনাগুলো। কাল সকালে অর্ণব কোলে তুলে দাদীকে নিয়ে হাজির হলো তার কেবিনে। অসুস্থ দাদী এসেই তাকে দেখে কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে উঠলেন। বোধহয় ভাবছিলেন তার নাতির পাশে এমন অপবিত্র, কলঙ্কিত এক মেয়েই কেন থাকবে। যে দাদী একটা সময় নুপুরকে কাছে পেলেই আহ্লাদে হাত টেনে নিজের কাছে কাছে রাখতেন তিনি কাল নুপুরকে একটুও ছুঁয়ে দিলেন না। বরং দূর থেকে চুপচাপ তাকে কিছু সময় দেখে অর্ণবকে বলল, আমার জন্য চা বা কফি কিছু নিয়া আয় অর্ণব। এই আচরণ ছিলো দাদীর একদমই স্বভাব বিরুদ্ধ। নুপুর অবাক না হলেও তারা ভাইবোন দুজনেই বোধহয় হয়েছিল। অর্ণব চলে গেলে দাদী অর্নির দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, ওরে কি ডাক্তারে সবরকম ঔষধপত্র দিছে?

অর্নি সায় জানায়, হ্যাঁ দাদী ডাক্তার ভালো করে ট্রিটমেন্ট করছে তো।

– ঐসব ঔষধপাতি কিছু দিছে যাতে পেটে কিছু না থাকে… কথাটা বলতে বোধহয় দাদী নিজেই সংকোচ বোধ করছিলো। অর্নিতা বিষ্ময়ে তাকায় দাদীর দিকে। দাদীর কথার অর্থ যে সে এবং নুপুর দুজনেই ভালো বুঝতে পেরেছে। নুপুরের চোখে জলের ধারা থামার নয় তবুও সে প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছে। অর্নি নির্বাক দাদীর চিন্তা ভাবনার লাগামহীন আচরণে। দরজার কাছে থেকে অর্ণবও যে শুনলো সবটা। ভাগ্যিস,দরজাটা খোলা ছিল তাই দাদীর প্রশ্নের জবাবটা সেই দিলো, “আমার দাদাদের সম্পদের তো কমতি নেই দাদী তাই আর কিছু করতে দেয়নি। আল্লাহর মাল দু চারটা চলে এলেও সমস্যা নেই।”

দাদী ক্রুদ্ধ নজরে তাকান অর্ণবের দিকে। নুপুরকে নাতির পাশে দেখে তিনি অখুশি নন কিন্তু তাই বলে কোন জারজ বাচ্চাকে নিজের বাড়ির অংশ করার কথা তিনি মানবেন না। নুপুর চুপ ছিলো পুরোটা সময়। দাদী বেশিক্ষণ থাকেন না হাসপাতালে। অর্নি আর দাদীকে অর্ণব বাড়ি পৌঁছে দিয়ে ফিরে আসতেই নুপুর তাকে ফিরে যেতে বলে।

-কেন করছেন এসব?

অর্ণব কমলার খোসা ছাড়ানোতে ব্যস্ত যেন শুনতেই পায়নি নুপুরের কথা। নুপুর আবারও বলে, এত মহান সাজতে চাইছেন কেন? আপনি অনেক মহান আমরা বুঝতে পেরেছি প্লিজ চলে যান এবার। আমার বাবা যতটুকু পারে করবে আমার জন্য।

-একা তোমার জন্য করবে কেন? একমাত্র জামাই হিসেবে আমারও হক আছে।

-বন্ধ করেন এসব নাটক। আমাকে করুণা করতে হবে না আরও অনেক মানুষ পাবেন করুণা করতে।

হুট করে অর্ণব খুব কাছে এসে দাঁড়ালো নুপুরের। তার কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল, “অন্যকে না আমি তোমাকেই করব করুণা। আমি নিজের জন্য তোমাকেই ডোবাবো করুণার সাগরে। সাধ্য থাকে তো এড়িয়ে যাও দেখি কতটুকু যেতে পারো।” কথা শেষ করে আবারও আগের জায়গায় ফিরে গেল অর্ণব। কালকের সেসব কথা মনে পড়তেই ফুপিয়ে কাদতে লাগল সে। কখন যে অর্ণব এসে ঢুকেছে কেবিনে টেরই পেলো না। সন্ধ্যের বিষন্ন নিস্তব্ধতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কান্নারত নুপুরের ওপর আবারও সেই দুপুরের মতই ঝুঁকে এসে চটাস করে চুমু বসিয়ে দিলো কপালে৷ এত আকস্মিক এত বেপরোয়া স্পর্শ করে লোকটা তাকে বড্ড অসহায় পড়ে নুপুর এই স্পর্শে। কখনো কাছে দাঁড়িয়ে দুটো মিঠে কথা না বলা পুরুষটা বিয়ের স্বাক্ষর করেই যেন লাগামছাড়া হয়ে উঠেছে।

চলবে

#কোথাও_হারিয়ে_যাব
#রূবাইবা_মেহউইশ
পর্ব-৩৫(শেষাংশ)

অর্নির পাসপোর্ট এর ঝামেলা শেষ করে রিদওয়ান এবার ছুটছে অর্নির কাছে। আমাদের দেশে অনেক জায়গাতেই টাকা ছড়িয়ে কাজ হাসিল করা যায় অথচ বাইরের উন্নত দেশ, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থায় যোগ্যতা ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়৷ অর্নিকে নিয়ে সে যেমনটা ভেবেছিলো তেমনটা হলো না। বিদেশে পড়াশোনার নামে প্রস্তুতি কিছুই সে নিতে পারেনি। বাড়ির পরিস্থিতি রিদওয়ানের অনুকূলে নেই সে এই মুহূর্তে চাইছেও না আব্বুর সাথে বাকযুদ্ধে জড়াতে। আব্বু যেমনই হোক নিশ্চয়ই সন্তানের ভালোটাই চেয়েছেন সবসময় এমনটা ভেবেই রিদওয়ানের একটুও রাগ নেই তার বাবার প্রতি। বাশার শেখ বলেছেন এ বাড়ির সাথে রিদওয়ানের কোন সম্পর্ক নেই। রিদওয়ানও চুপচাপ সে কথা মেনে নিয়ে অর্নিকে পাঠিয়ে দিলো চট্টগ্রামে। পড়াশোনায় মনোযোগ দিক সে আপাতত ছুটিছাটায় বাপের এসে থাকবে। তার সময় ফুরিয়েছে দেশের মাটিতে থাকার। আগামী সপ্তাহে তার ফিরে যাওয়ার দিন ঠিক হয়েছে এ কয়টা দিন ইচ্ছে ছিলো স্ত্রী,মা,ভাই-বোনকে নিয়ে কাটানোর কিন্তু তা আর হলো কই এখন শুধু স্ত্রীর সাথেই সময় কাটাবে। আবারও উঠতে হলো হোটেলে অর্নিকে নিয়ে। হাতে টাকাও আছে সীমিত তাই এবার একটু ছোট আর সস্তার হোটেলেই উঠতে হলো। মনে মনে সে ঠিক করে নিয়েছে এবার আর কোন হেলাফেলা নয় ফিরে গিয়ে রেস্টুরেন্ট জবটা চেঞ্জ করবে। রিদওয়ান যখন পৌঁছুলো তখন রাত নয়টা। অর্নি হল থেকে বের হতে পারলো না বলে রিদওয়ান একাই থাকলো সে রাতটা হোটেলে।পরের দিন সারাটা সময় চট্টগ্রামের কিছু পরিচিত জায়গায় ঘুরে এলো। সে জায়গা গুলো মূলত তার বাবার কাজের জায়গা আর তাদের নিজস্ব একটা কোম্পানিও আছে সেখানে। আগে রিদওয়ান কাজ করেছে সেখানে এখন সে কোম্পনির দায়িত্ব অবশ্য রিমন পালন করছে। আজ ভোরেও এসে উপস্থিত হওয়ায় সে ভাইকে ডাকলো দুপুরে একসাথে খাবে বলে। রিদওয়ান যখন পৌঁছুলো তখন আকাশ মেঘলা। ভরদুপুরে রোদ ঢেকে গেছে কুয়াশার মত ধোঁয়াটে মেঘের আড়ালে। বিষন্ন মুখটাতে কৃত্রিম হাসি ফুটিয়ে সে দাঁড়ালো রিমনের কেবিনের সামনে।

-মে আই কাম ইন!

ভাইয়ের কণ্ঠস্বর শুনতেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল রিমন।

-ভাইয়া! ফরমালিটি দেখাচ্ছো?

অভিমানী শোনালো রিমনের গলাটা। রিদওয়ান এগিয়ে গিয়ে বুক মিলিয়ে পিঠ চাপড়ালো।

-অফিস তো!

-তো!

-কিছু না। আম্মু কেমন আছে?

-কাল যেমন দেখেছো।

-আব্বু আর বৃষ্টি!

-আব্বুর শরীর ভালোই ঠেকছে তবে মনে কি চলছে বোঝা যাচ্ছে না। আর বৃষ্টি আপাতত… বুঝতেই পারছো।

কথা বলার ফাঁকে রিমন পিয়নকে খাবারের ব্যবস্থা করতে বলে দিলো। দু ভাইয়ে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে রিদওয়ান বের হলো সেখান থেকে। অর্নিকে কল করতেই জানা গেল মেয়েটা ক্যাম্পাসেই বসে আছে অপেক্ষা রিদওয়ান কখন আসবে!
__________

– আর কিছু বাকি আছে গোছানোর?

নাজিম সাহেব ব্যস্ত ভঙ্গিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন। নুপুর নিরুত্তর যেন শুনতেই পায়নি বাবার কথা। আজও ছোট মা এসেছেন তবে দায়ে পড়েই বোধহয় এসে উপস্থিত হয়েছেন। আজ ডিসচার্জ করায় অর্ণব গেছে বিল পরিশোধ করতে। নাজিম সাহেব নিজেই করতে চাইছিলেন অর্ণব শোনেনি সে কথা সে কারণেই ছোট মা কিছুটা প্রসন্ন হেসেছেন। বাবার তাড়াহুড়ো দেখে নুপুরের খুব মায়া হলো। আজ পাঁচদিন সে হাসপাতালে আছে আর সাত দিন পার হলো নিজের বাড়ি, নিজের ঘরের বাইরে। সেদিন বাড়ি থেকে বের হওয়ার একবারও কি মনে হয়েছিলো তার জীবনটা এতখানি বিভৎস হয়ে যাবে সেদিনের পর! এখনো সে সময়গুলো মনে পড়লে গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।

-এসো…

অর্ণব কেবিনে ঢুকেই নুপুরকে উদ্দেশ্য করে বলল। নাজিম সাহেব তাকালেন একবার অর্ণব একবার নুপুরের দিকে। মনের ভেতর খচখচানি চলছে অর্ণব কি নুপুরকে তার বাড়িতে নিতে চাইছে? মন বলছে ছেলেটা বলুক নিজের বাড়িতে নিতে চায় এতে মনটা স্বস্তি পাবে। মেয়েকে তিনি এ অবস্থায় নিজের কাছেই নেবেন তবুও বাপের মন বোধহয় মেয়ের বিয়েটা নিয়ে এখনো সাং সংশয়িত আছে। সে সংশয় অল্প সময়ের মধ্যেই দূর হয়ে গেল অর্ণবের কথা শুনে।

-আংকেল আপনারাও এখন আমার বাড়িতেই আসুন। বিকেলে আমি নিজে আপনাদের বাড়ি পৌঁছে দেব।

-না বাবা….

-আমার বাড়িতে দাদীই একমাত্র বয়স্ক মানুষ। ওকে নিয়ে যাব আপনারা একটু সাথে গেলেই আমার জন্য ভালো হতো।

ভারী স্বরটাকে যতোটা সম্ভব নমনীয় রেখে বলার চেষ্টা করলো অর্ণব। নুপুর এ কথা শুনে তৎক্ষনাৎ প্রতিবাদ করার মতই জোরে বলে উঠলো, “বাবা আমি বাড়ি যাব। আমাকে বাড়ি নিয়ে যাও অন্য কোথাও যাব না।”

-বাড়িতেই যাব আমরা এখন।

অর্ণবের কথা শুনেও না শোনার ভান করে নুপুর আবারও বলল, “আমাদের বাড়ি যাব আমি।”

– আমাদের বাড়িতেই…

-আপনার বাড়িতে না।

দৃঢ় স্বরে জবাব দিলো নুপুর। নাজিম সাহেব বিপাকে পড়লেন তবে মন চাইলো মেয়ের কথাটাই শুনতে। তিনিও এবার বললেন, “বাবা নুপুর ঠিকই বলতেছে। এমনিতেও তোমার দাদী অসুস্থ দেখলাম তারওপর ওরেও সাথে নিলে তুমি কারে দেখবা। তোমারও কাজবাজ আছে… ও এহন বাড়িতে থাক। সুস্থ হইলে না হয় মায়ই’মা আর অর্নিরে নিয়া ওরে নিয়া যাইবা।”

অর্ণব বুঝলো নাজিম সাহেবের কথার অর্থ। তিনি মেয়েকে নিজ বাড়ি থেকেই বিদায় করতে চান।তাি কথার বাড়াবাড়ি না করে সেও মেনে নিলো। উবারে করে নুপুরকে নিয়ে পৌঁছে গেল তাদের বাড়িতেই। নুপুরকে তার ঘরে বসিয়ে নিজেও বসলো চেয়ার টেনে। পুরো সময় নুপুর একটিবারও তাকালো না তার দিকে। ছোট মা আজ হাসি হাসি মুখেই খাবার আয়োজন করছেন রান্নাঘরে। এরই মাঝে জাকির এসে উপস্থিত হলো খালার বাড়ি। খালার মুখের হাসি দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলো, “এত খুশি ক্যান খালাম্মা?”

-খুশি হমু না! আপদ বিদায় হইবো ঘাড় থাইকা আর কয়টা দিন।

-ওহ ওই কালির তো এখন বড়লোক জামাই আছে। তা কি রানতেছেন ওর জামাইর জন্য!

অনেকটা ব্যঙ্গ করেই জানতে চাইলো জাকির। তাদের কথার মাঝেই হঠাৎ মনে হলো কেউ একজন রান্নাঘরের বাইরে আছে শুনছে তাদের কথা। সন্দেহ বশত জাকিরই উঁকি দিলো বসার ঘরটার দিকে। নাহ, কেউ নেই সেখানে হয়ত মনের ভুল তারা আর পাত্তা দিলো না। তারা জানলো না তাদের বলা প্রতিটা কথাই নির্ভুল শুনে গেছে অর্ণব। গলা শুকিয়ে গেছে নুপুরের ঘরে পানিও নেই তাই নিজেই এসেছিলো পানির জন্য। বসার ঘরেরই একাংশে রাখা ডাইনিং টেবিলে জগ থেকে পানি খেতে খেতে প্রতিটা কথাই স্পষ্ট শুনেছে সে। সোফায় বসা তুতুনকে দেখলো টিভি দেখায় মগ্ন। ছেলেটাকে ডেকে বলল, “চলো তুতুন আমরা ঘুরতে যাই।”

রান্নাবান্না শেষে দুপুরের খাবার সাজাতেই বিকেল তখন চারটা বেজেছে।নাজিম সাহেবও ততক্ষণে বাড়ি ফিরেছেন। এসেই দেখলেন, অর্ণব, তুতুন কেউ বাসায় নেই৷ স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করতে তিনিও জানেন না বলে নুপুরের ঘরে গেলেন।

-জামাই কই?

বাবার প্রশ্নে চমকে তাকায় সে। যাকে নাম সম্মোধনে অপছন্দ করতেন তাকে আজ ‘জামাই’ বলে স্নেহের সম্মোধন! সামান্য একটা স্বাক্ষরে এত জোর? নুপুর জবাব দিলো জানি না। নাজিম সাহেব ফোন করতে উদ্যত হলেন তখনই বসার ঘর থেকে আওয়াজ এলো, “আম্মু দেখো ভাইয়া কি এনেছে।”

তুতুনের গলার স্বর। নাজিম সাহেব বেরিয়ে গেলেন পেছনে তার স্ত্রীও। অর্ণব বাজার করে এনেছে। কাঁচা বাজার থেকে শুরু করে মাছ, মাংস এমনকি লিটার পাঁচেক দুধ। অর্ণবের পেছন পেছনে দু জন লোকও এসে ঢুকলো দুই ঝুড়ি মুদি বাজার নিয়ে। ছোট মা সেসব দেখে হা হয়ে গেলেন একদম। সাবান থেকে শুরু করে টয়লেট ক্লিনার অব্ধি আছে সেই বাজারের ঝুড়িতে। নাজিম সাহেব কেমন ক্ষুন্ন দৃষ্টিতে তাকালেন অর্ণবের দিকে৷ ছেলেটা কি তাঁকে নিজের অর্থবিত্ত বোঝাতে এমনটা করলো! না খুব একটা সময় লাগেনি নাজিম সাহেবের মনের মেঘ কাটতে। অর্ণব নিজেই উনাকে পাশে বসিয়ে কৈফিয়ত দেয়ার মত করে বলল, “রাগ করবেন না আঙ্কেল। ইচ্ছে ছিলো ওকে আমি আজই আমার বাড়িতে তুলব এবং সকল দায়িত্ব পালন করব। কিন্তু সে যেতে চাচ্ছে না আমিও তার অসুস্থতার দোহাই নিয়ে মেনে নিচ্ছে৷ যত্নটা আপনারাই করুন আমি শুধু তার এ কদিনের ভরণপোষণটা দেই। ও আমার ওখানে চলে গেলে না হয় আর করব না এমন কিছু!

অর্ণব কথাগুলো যেন ইচ্ছে করেই ছোটমাকে শোনালো। এই মহিলার চিত্ত জুড়ে লোভ, লালসা তা আন্দাজ করেই সে এমন পদক্ষেপ নিলো। কে জানে হয়ত লোভে পড়েই হয়ত নুপুরের প্রতি যত্নবান থাকবে মহিলা। তার ধারণা ভুল নয় তা কয়েক ঘন্টাতেই টের পেয়ে গেল অর্ণব। একটু পরপরই নুপুর কি করছে, কি খাবে সেসবের খোঁজ নিতেই ব্যস্ত হয়ে গেলেন মহিলা। অর্ণব চলে গেল সন্ধ্যের পর। যাওয়ার আগে ঘুমন্ত নুপুরকে একটু আদর করতে ভুলল না সে। আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে চুমু খেলো কপালটাতে। রাতটা সে বাড়িতেই থাকবে দাদীর জন্য৷ মানুষটা কিছুদিন ধরে বেশ নুয়ে পড়ছেন বয়স আর অসুস্থতায়। রাতটা বাড়ি, দিনটা অফিস, সন্ধ্যেটা নুপুর তিন ভাগ হয়ে গেছে তার সময়টা এখন। টানা চারদিন এভাবে কাটানোর পর হুট করে সে চলে গেল চট্টগ্রামে। অর্নি জানতো না ভাইয়া আসবে চট্টগ্রামে। রিদওয়ান চলে যাবে ভোর বেলাতেই তাই মুখ ভার করে বসেছিলো হোটেলের রুমটাতে। নির্দিষ্ট রুমের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ হলো ঠিক রাত্রি এগারোটা আটান্নতে। রিদওয়ান তখন হোটেলের লবিতে গেছে একটা সিগারেট খেতে।অর্নিতাও ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। রিদওয়ান এসেছে ভেবেই সে দ্রুতপায়ে গেল দরজা খুলতে।

-এত দেরি করলে ঘুমাবে কখন আর উঠবেই কখন!
দরজা খুলে কথাটাই সে আগে বলল। পরমুহূর্তেই থমকে গেল দরজায় দাঁড়ানো ভাইকে দেখে।

-ভাইয়া তুমি!
-হুশশশ। এটা রাখ।

কেকের বক্স আর একটা ছোট্ট শপিংব্যাগ এগিয়ে দিলো অর্নিকে৷

-আর মাত্র এক মিনিট বাকি। দ্রুত কেকটা আনবক্সিং কর ওকে দেখলাম বসা থেকে উঠেছে।

অর্নি বুঝলো ভাইয়া রিদওয়ানের কথা বলছে। অর্নির খুশিতে চোখ ছলছল। দ্রুত হাতে কেক আনর্যাপ করে ছোট্ট টি টেবিলটাতে রাখলো৷ দরজায় এসে তখন উপস্থিত রিদওয়ান৷ দু ভাইবোন একই সুরে গেয়ে উঠলো, “হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।”

রিদওয়ান চমকে গেল। আজ তারিখ কত? আজ তার বার্থ ডে! ওহহো সে ভুলেই গেছে কিন্তু আম্মু তো উইশ করলো না। প্রথম উইশ তো আম্মুই করে তাকে৷ হঠাৎ করে বিষন্ন মনটা বিষাদে ছেয়ে গেল। অর্ণবকে দেখে সুখী বা দুঃখী কোনটাই হতে পারলো না রিদওয়ান। অর্ণবের কি তা বুঝতে বাকি আছে? মোটেই না। সে ঠিক এ কারণেই এসে আজ উপস্থিত হয়েছে। হাতে সময় কম অথচ তার কতগুলো সম্পর্ক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আলাদা হয়ে গেছে। সময় থাকতেই সেগুলোকে গুছিয়ে নেয়া চাই। মনটা বড্ড পালাই পালাই করে সে ভেবে নিয়েছে সত্যিই কোনদিন পালিয়ে যাবে কোথাও। তার আগে সমস্ত সম্পর্কের দায় শেষ করে নেবে। সেসবের প্রথম ধাপটাই রিদওয়ানের সাথে দায় চুকানো। কেকের পাশে ছোট্ট গোলাপিরঙা একটি মোম জ্বালিয়ে নিজেই রিদওয়ানকে টেনে নিয়ে বসালো খাটের ওপর।

– খালামনি পাঠিয়েছে আমাকে। দ্যাখ তোর পছন্দের কেক আর সুজির হালুয়া।

ছোটো শপিং ব্যাগটাতে ছিল ছোট্ট একটা বক্স৷ তাতেই আছে হালুয়া আর চালের রুটি। এগুলো রিদওয়ানের সত্যিই খুব পছন্দের তবে তা রায়না বেগম পাঠাননি৷ রুজিনা খালার হাতেই তৈরি করিয়েছিলো সে৷ খালুজান যে রিদওয়ানের সাথে যোগাযোগে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সে কথা অর্ণব জানে বলেই এমনটা করেছে৷ এরই মাঝে ফোন বাজলো রিদওয়ানের।

-আম্মু!

– থ্যাঙ্কিউ আম্মু৷ তুমি অর্ণবকে দিয়ে কেন পাঠালে এসব। আমি তো কালই চলে যাচ্ছি। হালুয়াটা দেখতে দারুণ হয়েছে আম্মু। আব্বুও কি খেয়েছে এগুলো!

আনন্দ, উচ্ছাস, কি যে আহ্লাস! অর্ণব, অর্নিতা মুগ্ধ হয়ে তাকায় রিদওয়ানের দিকে। ছোট্ট বাচ্চাদের মত করে কথা বলছে রিদওয়ান৷ মায়ের সাথে কথা বলার সময় প্রত্যেকটা সন্তানই কি এমন বাচ্চা হয়ে যায়! একই প্রশ্ন বোধ দু ভাই-বোনের মনেই উঁকি দিলো। তাইতো তারা দৃষ্টি আড়াল করলো একে অপরের থেকে। অর্ণব অর্নিতা যখন নিজেদের অপূর্ণতায় চোখ সরায়, রিদওয়ান যখন মায়ের সাথে আহ্লাদে মেতে ওঠে কথা বকায় ঠিক তখনই আসে অনাকাঙ্ক্ষিত একটি ফোন কল অর্ণবের নম্বরে।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে