#কোথাও কেউ ভালো নেই
জাহান আরা
পর্ব-০৮
রাতে খাবার পর পূরবী সুরভী মিলে তানভীরের আনা কাঁচাবাজার পাশের বাড়ির ফ্রিজে রেখে এলো। তারপর শুতে গেলো সবাই।
পূরবী আজ তানভীরের গা ঘেঁষে শুয়েছে।তানভীর এক হাত পূরবীর গায়ের উপর রেখে শুয়ে পড়লো।এবং শুয়ে পড়ার প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে গেলো।
আকাশে রূপার থালার মতো মস্ত বড় চাঁদ উঠেছে।ভরা পূর্ণিমার রাত।পূরবীর বুক আনচান করছে।ভীষণ কান্না পাচ্ছে।ছোট এই জীবনের পাওয়া না পাওয়ার হিসেব পূরবী মিলাতে পারছে না।
এক জীবনে মানুষ হাজার বার এই পাওয়া না পাওয়ার হিসেব মিলাতে চায়।কিন্তু পারে না অথবা হিসেব মিলে না।এই হিসাবের গড়মিল খুঁজতে খুঁজতে আমরা একটা জীবন কাটিয়ে দিই।
অথচ বেহিসেবী জীবন কি সুন্দর তা আমরা কখনো ভেবে দেখিনি।
সকালটা শুরু হতেই পূরবীর মনে হলো আজকের দিন ভালো যাবে।মাঝেমধ্যে কিছু দিনের সূচনা মানুষের মন ভালো করে দেয়।আজকের সকাল ও তেমন। ঘুম থেকে উঠতেই পূরবীর মনে হলো আজকের দিনটি সুন্দর।
রৌদ্রজ্বল ঝলমলে একটা দিন।পূরবী ঘুম থেকে উঠেই কাজে লেগে গেলো। পুরো উঠান ঝাড়ু দিলো,ঘর ঝাড়ু দিলো।গত রাতের বাসি প্লেট পরিষ্কার করলো
পাশের বাড়ি থেকে মাছ মাংস এনে ভিজালো।
সুরভী উঠে দেখে তার বোন কাজ করা শুরু করে দিয়েছে।রান্নাঘরের সামনে একটা পিঁড়ি পেতে সুরভী বসলো।
কালো রঙের শাড়ি পরা মেয়েটিকে কী অপূর্ব সুন্দর লাগছে। যেনো শরৎকালের কাশফুল।কোমল নরম মুখখানা যেনো পবিত্রতার প্রতীক। পেঁয়াজ কুঁচি করতে গিয়ে পূরবীর হাতের চুড়ি একে অপরের সাথে লেগে টুংটাং শব্দ হচ্ছিলো।
সুরভীর মনে হলো এই যেনো তার মায়ের প্রতিচ্ছবি।
সুরভী মৃদুস্বরে বললো, “বুবু”
মরিচ কাটতে কাটতে পূরবী বললো,”হ্যাঁ বল।”
“তুই এতো সুন্দর কেনো বুবু?ঠিক যেনো মায়ের মতো। তোকে কেমন মা মা লাগে বুবু।”
পূরবী থামকে তাকালো বোনের দিকে। সুরভীর চোখ টলমলে হয়ে আসছে আস্তেধীরে।
পূরবী হেসে বললো,”দূর পাগল। বোনেরা বড় হলে তো মায়ের আরেক প্রতিচ্ছবি হয়ে যায় তুই জানিস না?
তুই যখন আরেকটু বড় হবি তখন তুই ও মায়ের মতো হবি।”
সুরভী বললো,”আমি তো মায়ের মতো হতে চাই না বুবু,আমি আর একবার মা’কে কাছে পেতে চাই।মা’কে ভীষণ মনে পড়ে বুবু।তুই পরশু চলে যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারলাম এই বিশাল পৃথিবীতে আমি সবচেয়ে একা।চারপাশে এতো মানুষ অথচ আমাকে একবার ডেকে বুকে জড়িয়ে ধরার মতো কেউ নেই বুবু।
তুই যাওয়ার পর কেউ আমাকে একবার ডাকে নি। সেই যে শেষ বার তোর সাথে একসাথে খেয়েছি তারপর আমি গতরাতে খেয়েছি। বুবু,বাড়িতে এতো খাবার ছিলো।ছোট মায়ের বোন,ভাবী,মা সবাই খেয়েছে। কেউ একটি বার আমাকে ডাকে নি বুবু।
খাবার পর নষ্ট হয়ে যাওয়া খাবার ছোট মা মুরগী কে ছিটিয়ে দিয়েছে,আমাকে দিয়ে হাঁসকে দিয়েছে।
মসজিদের সামনের সেই লেজকাটা কুকুরকে দিয়েছে,অথচ আমি একটা মানুষ অভুক্ত ছিলাম বুবু,কেউ আমাকে একবার ডেকে একটু খেতে দেয় নি।
এরা কুকুর বেড়ালের জন্য মায়া দেখায়,অথচ আস্ত একটা জীবিত মানুষ এদের সামনে ছিলো কেউ একবার ডেকে জিজ্ঞেস করে নি খেয়েছি কিনা।
পেটের ক্ষুধায় আমার যেনো প্রাণ বের হয়ে যাচ্ছিলো অথচ কেউ কিছু খেতে দেয় নি।আমার মায়ের রেখে যাওয়া সংসারে আজ অন্য একজনের দখলদারিত্ব। অভিমানে আমি শুধু পানি খেয়েছি বারবার গিয়ে। তবুও খেতে দিতে বলি নি কাউকে।
বুবু,তুই যাওয়ার পর আমার মনে হলো কি এক অতল গহ্বর আমার চারপাশে। আমি কাউকে খুঁজে পাচ্ছি না।আমি যেনো শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে আছি যেকোনো সময় পা হড়কে পড়ে যাবো। একবার পড়ে গেলে আর উঠতে পারবো না।”
বিছানায় শুয়ে তানভীর শুনলো সুরভীর সব কথা।শুনে ব্যথিত হলো তানভীরের কোমল হৃদয়। তানভীরের মনে হলো এ যেনো এই যুগের এক বন্দী রাজকন্যা।
পূরবী অবাক হয়ে তাকালো বোনের দিকে। তার বোনটা দুই দিনেই যেনো কতো বড় হয়ে গেছে। পূরবীর ছায়া সরে যেতেই জীবন তার আসল রূপ দেখিয়ে দিয়েছে সুরভীকে।
নিজের কান্নাকে বুকের মধ্যে পিষিয়ে ফেলে পূরবী স্বাভাবিকভাবেই বললো,”ভাবিস না তুই,তোর ভাইয়া তোকে এখান থেকে নিয়ে যাবে বলেছে।এইতো আর অল্প কিছুদিন। ”
তানভীর উঠে এলো দুই বোনের কথা শেষ হলে।তানভীর কে দেখে পূরবী উঠে গিয়ে ব্রাশ আর টুথপেষ্ট এনে দিলো তানভীরকে।
হাতমুখ ধুয়ে এসে তানভীর লুঙ্গির উপর একটা টি-শার্ট গায়ে দিয়ে উঠোনে এসে বসলো মোড়ায়।
সুরভী দ্রুত হাতে রুটি বানাতে লাগলো। এক চুলায় আলুভাজি আর অন্য চুলায় মাংস কষাতে লাগলো পূরবী। তানভীর তাকিয়ে দেখলো কি অভ্যস্ত হাতে দুবোন কাজ করছে।
কষানো মাংসের ঘ্রাণে সালমার জিবে জল এলো। পূরবীর রান্নার হাত ভীষণ ভালো সেটা সালমা জানে।এখন মাংসের ঘ্রাণ পেয়ে সালমার মনে হলো এই কষানো মাংসের ঝোল দিয়ে দুই প্লেট ভাত সালমা অনায়াসে খেতে পারবে।
সালমা উঠে জানালার পাশে এসে দাঁড়ালো। একটা পিরিচে সুরভী লেবু টুকরো করে রাখছে।সালমার জিবের জল সামলানো দায় হয়ে গেলো।
লজ্জায় যেতে ও পারছে না সালমা। তানভীরকে তার ভরসা হয় না। কথার দ্বারা সালমাকে সে চূড়ান্ত অপমান করতে পারে যেকোনো সময়।
গতকাল তো দেখেছে সালমা কিভাবে নিজের বোন,ভাবী,খালাকে সে অপমানিত করেছে। সেখানে সালমা তো সৎ শাশুড়ী।
নিজের লোভকে দমিয়ে রেখে সালমা বিছানায় গিয়ে বসলো। কিন্তু ব্যর্থ হলো।
মনে হতে লাগলো সালমার প্রাণ পাখি বের হয়ে যাবে বুকের পিঞ্জর ছেড়ে যদি এখনই একটু মাংস খেতে না পারে।প্রেগন্যান্সির সময়টা এরকমই হয় সালমার মনে রইলো না।
একটু পর পূরবী গেলো সালমার ঘরে। দরজায় নক করতেই সালমা এসে খুলে দিলো দরজা।
দেখে একবাটি মাংস,একটা প্লেটে কয়েকটা রুটি নিয়ে পূরবী দাঁড়িয়ে আছে। পূরবী কিছু বলার আগে সালমা একপ্রকার কেড়েই নিলো পূরবীর হাত থেকে। কোনো কথা না বলে বিছানায় বসে গাপুসগুপুস করে খাওয়া শুরু করে দিলো বাসি মুখে।
পূরবী দাঁড়িয়ে সালমার খাএয়া দেখলো কিছুক্ষণ। তারপর সরে গেলো। তানভীরকে খেতে দিবে।
উঠানে মাদুর বিছিয়ে তিনজনে আবারও বসললো গত রাতের মতো করে।
অনেকদিন পরে আজ তানভীর পেট ভরে মাংস খেলো।তাদের বাড়িতে রান্না করে বাড়িতে কাজ করা তাহেরা।রেবেকা অথবা বউয়েরা কেউ-ই রান্না করে না।
তাহেরা যেভাবে যতোটা পারে রান্না করে। সেই রান্না খাবার হিসেবে কোনো মতে চালিয়ে নিতে হয়।
রেবেকা এই ১০ বছর রান্নার কাজ থেকে ইস্তফা দিয়েছে।
১০ বছর আগে তানভীর বিদেশে যাওয়ার পর থেকেই রেবেকার সংসারের শ্রী ফিরতে লাগলো। তানভীরের বেতন বাড়ার সাথে সাথে রেবেকার শৌখিনতা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকে।সেই শৌখিনতা রূপ বদলে অপচয়ে রূপ নিলো অল্প কয়েক দিনেই। এজন্য দশ বছরে তানভীর একটা বারের জন্যও ছুটিতে দেশে আসতে পারে নি।
তানভীর বিদেশে থাকতেই তারিনের বিয়ে হলো,তারপর একে একে তারেক তুহিন বিয়ে করলো।
বিদেশে থেকে তানভীর শুধু টাকা পাঠাতে লাগলো। ভাইবোনের বিয়েতে আনন্দ করার ভাগ্য আর রইলো না তার।যতোবারই তানভীর আসতে চেয়েছে,রেবেকা আঁতকে উঠে বলেছে,”আব্বা,তুই এই সময় দ্যাশে আসলে এতো খরচ কেমনে চালামু আমি। তোর মুখের দিকে তো আমরা সবাই তাকাইয়া আছি।”অবিবেচকের মতো এসে তানভীর তাই সবার আশা ভঙ্গ করতে পারে নি।
প্রবাসের মাটিতে গলাকাটা মুরগির মতো একা একা তড়পে মরেছে বারেবারে বাড়ির কথা মনে করে। কিন্তু কিছু করার ছিলো না তার।শুধু তমিজ মিয়া ছেলেকে ফোন করে বলতেন,”আব্বা,আর কতো দিন থাকবা তুমি ওই দ্যাশে?বাড়িতে আসপার মন চায় না আব্বা?
এই বুড়ো বাপেরে দ্যাখবার আসব না একবার?
সেই কবে তোমার চাঁদমুখখান দ্যাখছি,আমার যে ম্যালা কষ্ট হয় তোমার লাইগ্যা আব্বা।প্রতি ঈদে,উৎসবে আমার বাড়িতে চান্দের হাট বসে,সেই হাটে আমি আমার চান্দটারে খুঁইজ্যা পাই না আব্বা।আমার চান্দটা আমার থাইকা বহুদূরে একা একা জ্বলে। কি দরকার এতো টাকার? আমার আব্বারে আমি একবার বুকে জড়াইয়া ধরতে পারি না।এই ট্যাকা তো আব্বা তোমারে ছোঁয়ার সুখ দিতে পারে না।”
বাপের এই করুণ মিনতি তানভীরের সব কষ্ট দূর করে দিতো।রাতে ঘুমাতে যাবার আগে একবার করে ভাবতো,”কেউ অপেক্ষায় নেই তো কি হইছে,আমার আব্বায় আছে আমার অপেক্ষায়। আমার আব্বার তো পরান পোড়ে আমার জন্য। আমার আর কিসের কষ্ট তাইলে?”
পূরবী তাকিয়ে রইলো তানভীরের উদাসী মুখটির দিকে।হুট করেই পূরবীর মনে হলো,”এই যে কথায় কথায় এতো প্রতিবাদ করে এই মানুষটি। এই প্রতিবাদের পিছনে ও নিশ্চয় এক সীমাহীন ধৈর্যের গল্প লুকিয়ে আছে।যে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পর মানুষটা এরকম প্রতিবাদী হয়ে গেছে।”
চলবে……