গল্পঃ কে তুমি ( সপ্তম পর্ব )
লেখাঃ ইমতিয়াজ আহমেদ চৌধুরী
মীরার বেডে মীরা ও নিলয় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, নিলয় জানেনা কতবড় ষড়যন্ত্রের শিকার হতে যাচ্ছে সে।
ওদিকে নিলয়ের রুমে ঘুমিয়ে আছে নাবিলা। নিলয় নিজের রুম থেকে বেরিয়ে আসার সময় ফোনটা রেখে এসেছিল বেডে। রাত্রি দ্বিপ্রহরে নিলয়ের ফ্যাক্টরির নাইট সিফটে ডিউটিরত কোন এক স্টাফ সম্ভবত জরুরি প্রয়োজনে নিলয়ের ফোনে কল দিচ্ছে বারবার। বারবার কানের কাছে ফোনের রিং বাজায় ঘুম ভেঙে গেল নাবিলার, ঘুমঘুম চোখে ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কেউ বললো,– স্যার আমেরিকান বায়ারের দুপুরের পরে আসার কথা ছিল, কিন্তু হঠাৎ করে আবার জানালেন সকালেই আসবে, আপনাকে জানানো প্রয়োজন তাই এত রাতে বিরক্ত করলাম, সকাল সকাল চলে আসবেন অফিসে আজ।
নাবিলা কল কেটে দিয়ে খেয়াল করে দেখলো নিলয় তো রুমে নেই! তাহলে গেল কোথায় এত রাতে! দীর্ঘসময় অপেক্ষার পরে উঠে বসলো।
এখানে আসার পরে এবং নিলয়ের চাচা চাচী, মীরা রাকিব বাসায় ফেরার আগেই কয়েকটি ওয়্যারলেস মাইক্রোফোন বিভিন্ন যায়গায় সেট করে রেকর্ডিং চালু করে রেখেছিল নাবিলা, ডাইনিং টেবিলের নিচেও লাগিয়েছিল কারণ এখানেই সবাই জড়ো হয় একত্রে এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
নাবিলা ফোনে ইয়ারফোন লাগিয়ে কানে দিয়ে রেকর্ড প্লে করলো। স্কিপ করে শুনতে শুনতে এক যায়গায় এসে থমকে গেল নাবিলা, যেখানে নিলয়ের চাচি এবং তার ছেলে নিলকে ফাঁসানোর ষড়যন্ত্রের আলোচনা করেছিল, নিলয়কে মীরার রুমে শুইয়ে দিয়ে। নাবিলা ভীষণ অবাক! যে পরিবারকে নিজের পরিবার ভাবে নিলয়, সেই পরিবার নিলয়কে নিয়ে এমন ষড়যন্ত্র কীভাবে করতে পারে! তাহলে কি নাবিলার সন্দেহ সঠিক!
যাই হোক নিলয়কে এই ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচাতে হবে। রাত শেষের দিকে, নাবিলা উঠে দরজা খুলে পা টিপে মীরার রুমের সামনে গিয়ে ছিটকিনি খুলে নিলয়কে মীরার বেড থেকে কোনমতে নামিয়ে কাঁধে ভর করিয়ে নিলয়ের রুমে এসে বেডে শুইয়ে আবার গিয়ে সেরকম মীরার দরজার ছিটকিনি বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়ে আসলো।
নিলয়ের ঘুম ভেঙে গেল, এতকিছু ঘটে গেল তার কিছুই টের পায়নি নিলয়! নাবিলাকে সজাক দেখে অবাক হয়ে বললো,– তুমি এখনও সজাক নাবিলা!
নাবিলা বললো,– আমার ঘুম না ভাঙলে আপনার যে সর্বনাশ হয়ে যেত নিলয়!
: মানে! কি বলছো এসব নাবিলা!
: সকাল হলেই বুঝতে পারবেন সেটা, এবং সবাই জেগে ওঠার আগে আমার এখান থেকে চলে যেতে হবে।
: এখনও তো ভোর হতে বাকি নাবিলা!
: সমস্যা নেই, আমি চলে যেতে পারবো, আপনি নিজের দিকে খেয়াল রাখবেন!
: কিন্তু বিষয়টা কি একটু বুঝিয়ে বলবে!
: সকাল হলেই বুঝতে পারবেন!
নাবিলা তড়িঘড়ি করে চলে গেল।
সকাল হতেই নিলয়ের চাচি মীরার রুমের সামনে এসে জোরে জোরে বলতে লাগলো,– হায় সর্বনাশ! এটাও দেখার বাকি ছিল, দুধ কলা দিয়ে সাপ পুষছি এতদিন! নিলয় এমন সর্বনাশ করতে পারলো!
নিলয়ের চাচা এবং চাচাতো ভাই রাকিব মীরার রুমের সামনে আসলো।
রাকিব বললো,– কি হয়েছে মা, নিলয় কি করেছে?!
মা বললো,– কি করেছে আবার, মীরার সর্বনাশ করেছে, সারারাত ধরে মীরার রুমেই আছে!
মীরার বাবা বললো,– দরজা তো বন্ধ, তুমি কিকরে বুঝলে!
মীরার মা বললো,– আমি দুজনকে বেডে পাশাপাশি দেখেই বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি, যাতে পালাতে না পারে।
নিলয় তার রুমের দরজা থেকে উঁকি দিয়ে সব দেখছে এবং মুচকি হাসছে! এতক্ষণে নাবিলার কথা বুঝে এসেছে নিলয়ের।
রাকিব মীরার রুমের দরজা খুললো, ভেতরে মীরা সটান হয়ে ঘুমাচ্ছে দিব্যি! সারা রুমে নিলয়ের কোনো অস্তিত্ব নেই।
পেছন থেকে নিলয় এসে চাচিকে চাচি বলে ডাক দিতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো চাচি!
শান্ত মেজাজে নিলয় বললো,– আমাকে নিয়ে কি বলাবলি হচ্ছে চাচিআম্মা?
চাচি কি বলবে ভেবে না পেয়ে ইয়ে মানে ইয়ে মানে করতে লাগলো।
রাকিবও থ মেরে আছে, নিলয় কি করে মীরার রুম থেকে গায়েব হলো!
নিলয়ের চাচা তার স্ত্রীকে বললো,– কিসব বলছো, ঘাড়ে ভূত চেপেছে নাকি মতিভ্রম!
নিলয় কাউকে কিছু না বলে চুপচাপ অফিসে চলে এলো। নাবিলা এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললো,– মিস্টার নিলয়, এবার সবকিছু ক্লিয়ার হলো তো! আমরা এমনই, তাদেরকেই বিশ্বাস করে মনে স্থান দেই, যারা ক্ষতি করার জন্য ব্যস্ত সর্বদা। আজও আপনার সাথে এমন কিছু ঘটতো যা আপনার জীবনটাকে আরও একবার ওলট-পালট করে দিতো!
নীলয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,– হ্যাঁ তাইতো, অথচ আমি তাদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং ভরসার ভেবেছি, কিন্তু ওরা এমনটা করবে কখনও ভাবিনি নাবিলা! এখন তো দেখছি নিজের ঘরবাড়ি ছেড়ে যাদের কাছে ভালো থাকার জন্য আশ্রয় নিলাম, তাঁরাই আমার বড়ো শত্রু!
নাবিলা বললো,– নিলয়, পানির অপর নাম জীবন, আবার এই পানিতে ডুবেই কত প্রাণের মৃত্যু ঘটে! বিশ্বাস হলেও এতটা ভরসা করতে নেই যেটাকে বলে অন্ধ বিশ্বাস। কে কখন বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে পিঠে ছুরি মারবে তারও বিশ্বাস নেই।
নাবিলা গত রাতের রেকর্ড তার মোবাইলে প্লে করে নিলয়ের সামনে রাখলো। সবকিছু শুনে ভীষণ অবাক নিলয়।
আরও বেশি অবাক নাবিলার এই বুদ্ধিমত্তায়। নিলয় জিজ্ঞেস করলো,– তুমি তো জানতেনা এমন কিছু ঘটবে নাবিলা, তাহলে রেকর্ড করার চিন্তা কীভাবে তোমার মাথায় আসলো, এবং রেকর্ডিং ডিভাইস তুমি আগেভাগেই সেট করে রেখেছিলে সম্ভবত, কিন্তু কেন? কি ভেবে?
নাবিলা বললো,– সে সবের উত্তর আরও পরে দেয়া হবে, আমার আরও একটি রাত আপনার চাচার বাসায় থাকতে হবে লুকিয়ে, ঠিক গত রাতের মতো, এবং এর জন্য আপনার সহযোগিতা দরকার! বলুন করবেন?
নিলয় বললো,– তুমি এতবড় বিপদ থেকে রক্ষা করলে আমাকে, অবশ্যই করবো, এবং তুমি চাইলে আবার আজ রাতেই হবে।
বিকেলে বাসায় ফিরে দরজা খোলা রেখে নিলয় চাচা, চাচী, মীরা এবং রাকিবকে ডেকে একটা রুমে নিয়ে গিয়ে বললো,– জরুরি কথা আছে।
এদিকে সেই সুযোগে দরজা দিয়ে ঢুকে নাবিলা নিলয়ের রুমে চলে গেল।
নিলয়ের চাচা বললো,– কি ব্যাপার নিলয়, কোনো সমস্যা?
নিলয় বললো,– চাচা দীর্ঘদিন আপনাদের এখানে থেকেছি, যদি ভুল ত্রুটি করে থাকি ক্ষমা করে দিবেন সবাই, আমার এখন নিজের ঘরবাড়ি ঠিক করে বসবাস করার সময় এসেছে!
সবাই চুপচাপ, সকালের বিষয়টি যে নিলয় বুঝতে পেরেছে সেটা বুঝেই আর কারো বলার মতো কোনো অপশন নেই!
নিলয় নিজের রুমে চলে আসলো।
দরজা বন্ধ করে গিয়ে বেডে বসলো নিলয়। নাবিলা সামনে এসে বললো,– প্রিয় মানুষদের মুখোশ উন্মোচিত হলে পৃথিবীটা ওলট-পালট হয়ে যায় তাইনা নিলয়? আর তারচেয়ে মারাত্মক কষ্টকর প্রিয় মানুষটাকে হারানো! আপনার মতোই প্রিয় মানুষকে হারানোর যন্ত্রনায় দিনরাত আমিও ছটফট করছি!
নিলয় অবাক হয়ে বললো,– কাকে হারানোর যন্ত্রণা তোমার নাবিলা, আর এবার অন্তত সত্যিটা বলো কে তুমি?!
নাবিলার ঠোঁটে রহস্যময় হাসি…
চলবে…